৪
কয়েকদিন পর শাকিল ফজুকে সঙ্গে নিয়ে ভাগ চাষের ফসল উসুল করার জন্য কাঞ্চনপুর এল। শাকিল বিগত কয়েক বছরের ফসল উসুলের কাগজপত্র সঙ্গে করে এনেছে। চৌধুরী সাহেবের হুকুমে গোমস্তা আসেন নি। এখানে এসে শাকিল ফজুকে নিয়ে এক গরিব কৃষকের বাড়িতে উঠল। তার নাম সামসু।
গোমস্তার ছেলে মিনহাজ বাবার চিঠি পেয়ে সবকিছু আগেই জেনেছে। সে জানতো ম্যানেজার তাদের বাড়িতে উঠবে। কিন্তু একজন গরিব কৃষকের বাড়িতে উঠেছে জানতে পেরে সেখানে এসে আলাপ পরিচয় করে তাদের বাড়িতে থাকার জন্য অনেক করে বলল।
শাকিল রাজি না হয়ে বলল, প্রয়োজন মতো আপনাকে খবর দেব। আমি এখানকার মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে চাই।
অগত্যা মিনহাজ বিফল মনোরথে ফিরে এল।
সামসুর একটা মাত্র ঘর। তাতেই তিন চারটে ছেলেমেয়ে নিয়ে দিন কাটায়। চৌধুরী ষ্টেটের ম্যানেজার তাদের এখানে থাকবে শুনে কি করবে না করবে ভেবে তটস্থ। হয়ে উঠল।
শাকিল তাকে বলল, আপনার চিন্তা করার কিছু নেই। আমি টাকা দিচ্ছি, আপনি লোকজন নিয়ে আজই আপনার ঘরের সামনে যে খালি জায়গা রয়েছে, ওখানে একটা বেড়ার ঘর বেঁধে দিন। আমরা থাকব। আর আপনারা শুধু আমাদের খাবার ব্যবস্থা করবেন। সে জন্যেও টাকা দিচ্ছি।
সামসু কি আর করবে, ম্যানেজারের কথামতো ব্যবস্থা করতে লেগে গেল।
শাকিল প্রথমে ফজুকে সঙ্গে নিয়ে দু তিন দিন সেই গ্রামের ও আশপাশের গ্রামের মানুষদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে বুঝতে পারল, এই এলাকার কিছু গরিব লোক ছাড়া প্রায় সবাই প্রতি বছর ফসলের ভাগ ঠিকমতো দেয়। গোমস্তা সে সবের সিংহভাগ নিজের গোলায় তুলে বাকিটা ষ্টেটে পৌঁছে দেওয়ার সময় বলে, ঐ এলাকার লোকেরা খুব গরিব। তার উপর অতি বৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির ফলে ফসল ভালো হয় না। তাই তারা ফসলের ভাগ ঠিকমতো দিতে পারে না।
ফসলের উসুল নেয়ার জন্য শাকিলকে একমাস থাকতে হল। সে খুব গরিব চাষির কাছ থেকে ফসলের ভাগ নিল না। অবস্থা বুঝে অনেকের কাছ থেকে কম ফসলও নিল। তারপরও যা ফসল উসুল হল, তা অন্যান্য বছরের তুলনায় তিন চার গুণ বেশি।
ফসল উসুল নেয়ার সময় গোমস্তার ছেলে মাঝে মাঝে সঙ্গে থাকলেও টু শব্দ করতে পারল না। লজ্জায়, দুশ্চিন্তায় ও ভয়ে সে অস্থির হয়ে পড়ল। মিনহাজ বড়লোক গোমস্তার ছেলে। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে গ্রামের কিছু উচ্ছঙ্খল ছেলেদের নিয়ে মাস্তানি করে বেড়ায়। ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়স। বিয়ে করেছে। একটা ছেলে ও একটা মেয়ে। তবু মাস্তানি করে বেড়ায়। বাবার চিঠিতে সবকিছু জেনে ভেবে রেখেছিল, ম্যানেজার তাদের বাড়িতে উঠলে খাবারের সঙ্গে বিষ দিয়ে কাজ হাসিল করবে। পরে ডোম পাড়ায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে রটিয়ে দেবে, কে বা কারা তাদেরকে খুন করেছে। সেই প্ল্যান ভেস্তে যেতে সে তার এক বন্ধুর সাহায্যে ভিন গ্রাম থেকে বাছাই করা বেশ কয়েকজন লেঠেল আনার ব্যবস্থা করল।
শাকিল যা ফসল উসুল করছে, তা ট্রাকে করে মেহেরপুরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। একদিন বিকেলে শাকিল ফজুকে সাথে করে পাশের গ্রামের একজন গরিব বৃদ্ধার ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করার জন্য গিয়েছিল। কাজ সেরে ফেরার সময় পথে সন্ধ্যে হয়ে গেল। এক বাড়ির সদরে মাগরিবের নামায পড়ে ফিরে আসতে লাগল। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। ঐ গ্রাম ছেড়ে একটা ছোট মাঠ। মাঠটার একপাশে পোড়ো জমি। জমিটা জঙ্গলে ভর্তি। তার পাশ থেকে রাস্তা। তারা যখন সেই পোড়ো জমিটার পাশের রাস্তা দিয়ে আসছিল, তখন পনের বিশ জন লাঠিয়াল লাঠি উঁচিয়ে হৈ হৈ করে ছুটে এসে তাদেরকে ঘিরে ফেলল।
ফজু বিদ্যুৎ গতিতে জামার ভেতর থেকে পিস্তল বের করে এক হাতে সেটা তাদের দিকে নিশানা করে এবং অন্য হাতে লাঠি বাগিয়ে ধরে চিৎকার করে উঠল, খবরদার, ম্যানেজার সাহেবের গায়ে যদি একটা লাঠির ঘা পড়ে, তা হলে সবাইকে লাশ বানিয়ে ফেলব।
বিপদের আঁচ পেয়ে শাকিল আগেই ফজুর পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে একহাতে তাদের দিকে পিস্তল ধরে অন্যহাতে একটা বড় ছুরী ঘোরাতে শুরু করেছে।
দুজনের হাতে দুটো পিস্তল দেখে এবং শাকিলের ছুরী ঘুরানোর কায়দা দেখে লাঠিয়ালরা থমকে গেল।
শাকিল বলল, আপনারা লড়বেন, না সন্ধি করবেন? তাদেরকে চুপ করে থাকতে দেখে শাকিল আবার বলল, আমরা কিন্তু দুটোতেই রাজি। তবে সন্ধি করলে আপনাদেরই বেশি লাভ। না করলে আমরা দুজন মারা যাবার আগে আপনারা অনেকেই মারা পড়বেন। আপনারা সামান্য কয়েকটা টাকার জন্যে ছেলে মেয়েদের এতিম ও স্ত্রীদের বিধবা করতে চাইলে লড়াই শুরু করুন। আর যদি তা না চান, তা হলে আসুন আমরা একটা পরামর্শ করি। শাকিলের কথা শুনে লাঠিয়ালরা নিজেদের মধ্যে কানাকানি করতে লাগল।
তাই দেখে শাকিল আবার বলতে লাগল, আপনারা আমাদেরকে মেরে ফেললে আমাদের মা বাবা আত্মীয় স্বজন যেমন দুঃখ পাবে। আমরাও যদি আপনাদেরকে মেরে ফেলি, তা হলে আপনাদের মা বাবা এবং আত্মীয়স্বজনও তেমিন দুঃখ পারে। আল্লাহপাক কি বলেছেন আপনারা বোধ হয় জানেন না। তিনি বলেছেন, “কোন বান্দা যদি শেরেকী ছাড়া আশমান জমিনপূর্ণ গোনাহ নিয়ে আমার কাছে হাজির হয়, আমি রহমানুর রহিম, তাকে ইচ্ছা করলে মাফ করে দেব। কিন্তু যদি সে কারো মনে দুঃখ বা কষ্ট দেয়, তা হলে সেই দুঃখী লোক যতক্ষণ না তাকে মাফ করবে ততক্ষণ আমিও তাকে মাফ করব না। আপনারা নিজের ও স্ত্রী ছেলে মেয়েদের ভাত কাপড়ের জন্য আমাদেরকে হত্যা করে টাকা রোগজার করতে এসেছেন। আপনারা যদি মুসলমান হন, তা হলে নিশ্চয় জানেন, আল্লাহ একমাত্র রেজেক দাতা। তিনি সত্তাবে পরিশ্রম করতে বলেছেন, রেজে তিনি দেবেন। তিনি কুরআন পাকে বলিয়াছেন! “আমি যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রেজেক দান করি।” আরো বলিয়াছেন, “আমি উত্তম রেজেক দাতা।” আল্লাহর রসুল (দঃ) বলিয়াছেন “তোমরা অন্যায় পথে রেজেকের অনুসন্ধান করো না।” আপনারা কি ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা চিন্তা করেন না? হারামী রোজগারের খাবার খেয়ে যে সন্তানের জন্ম দেবেন, তারা কোনো দিন ভালো হবে না। তারাও হারামখোর হবে।
এবার ফজু বলে উঠল, সাহেব, আপনি যতই ভালো কথা বলুন না কেন, ওরা শুনবে না। যা করার তাড়াতাড়ি আমাকে হুকুম দিন।
শাকিল তাকে থামিয়ে দিয়ে লাঠিয়ালদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, আপনারা যার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমাদেরকে মেরে ফেলতে এসেছেন, এখন আমরা যদি আপনাদেরকে তার চেয়ে আরো অনেক বেশি টাকা দিই, তা হলে আপনারা কি সেই লোককে মেরে ফেলতে পারবেন? আপনারা রাজি হলে আমি টাকা দিতে প্রস্তুত। তবে একটা কথা জেনে রাখুন। আমি টাকা দিলেও তাকে মেরে ফেলতে বলব না। কারণ কোনো কারণেই আমি কোনদিন কারো ক্ষতি করা তো দূরের কথা, সেকথা চিন্তাও করি না। আর একটা কথা জেনে নিন, আমি আপনাদের সকলের ভালর জন্য এসেছি। যদি কারো কোন ক্ষতি করে থাকি তা হলে আপনারা আমাকে যা খুশি করুন, আমি বাধা দেব না। আল্লাহপাক তো কাল কেয়ামতের ময়দানে ন্যায় অন্যায়ের বিচার করবেনই। সব শেষে আর একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না, আপনাদের হাতে আমাদের মৃত্যু যদি লেখা থাকে, তবে মরবো, নচেৎ আপনাদের মতো হাজারটা লাঠিয়ালও আমাদের কিছু করতে পারবে না।
লাঠিয়ালরা পেটের দায়ে গোমস্তার ছেলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এদেরকে মারতে এসেছিল। এখন শাকিলের মুখে কুরআন হাদিসের কথা শুনে ও তার অমায়িক ব্যবহারে তাদের জ্ঞানের চোখ খুলে গেল। তারা তাদের সর্দার কি করে সেই অপেক্ষায় রইল। তাদের সর্দারের নাম কালু সেখ। শাকিলের কথা শুনে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সে লাঠি ফেলে দিয়ে সঙ্গিদেরকে বলল, ভাইসব, আমরা এতদিন না জেনে না শুনে সামান্য কটা টাকার জন্য মানুষের উপর অন্যায়ভাবে অত্যাচার করে অনেক গোনাহ করেছি। এই সাহেবের কথা শুনে আমার জ্ঞানের চোখ খুলে গেছে। আসুন আমরা আজ ওনার হাতে হাত রেখে মাফ চেয়ে ওয়াদা করি, আর জীবনে কোন দিন কোন অন্যায় কাজের জন্য লাঠি ধরব না। সর্দারের কথা শুনে সবাই লাঠি ফেলে দিল।
লাঠিয়ালদের লাঠি ফেলে দিতে দেখে শাকিল নিজের পিস্তল ও চাকু যথাস্থানে রেখে তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে কালু সেখকে জড়িয়ে ধরে বলল, আল্লাহ পাকের দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই, যিনি আমার মতো একজন গোনাহগার বান্দার কথায় আপনাদের জ্ঞানের চোখ খুলে দিয়েছেন। তারপর সে সকলের সঙ্গে হাত মোসাফাহ করতে লাগল।
কালু সেখ বলল, আপনি আমাদেরকে মাফ করে দেন।
শাকিল বলল, আপনারা তো আমার কোন ক্ষতি করেন নি। আমার কাছে মাফ চাইতে হবে না। আল্লাহপাকের কাছে মাফ চান। তিনি অসীম দয়ালু। কোনো বান্দা অন্যায় করে তার কাছে মাফ চাইলে, মাফ করে দেন।
কালু সেখ বলল, আমরা তাই চাইব। এখন আমাদের পরামর্শ দিন কি করব? আপনি চলে যাওয়ার পর গোমস্তা ও তার ছেলে আমাদের ওপর এর প্রতিশোধ নেবেন।
শাকিল বলল, ওনারা যাতে সে রকম কিছু না করেন তার ব্যবস্থা আমি করব। এখন আপনারা আমার সঙ্গে চলুন।
শাকিল ও ফজু যখন লাঠিয়ালদের নিয়ে গোমস্তার বাড়ির দিকে যেতে লাগল তখন গ্রামের মানুষ জানতে পেরে অবাক হয়ে তাদের সঙ্গে চলল।
গোলমাল শুনে মিনহাজ ঘরের বাইরে এসে তাদেরকে দেখে যেমন অবাক হল তেমনি খুব ভয়ও পেল। কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে পারল না।
গোমস্তার ছেলেকে দেখে কালু সেখ বলল, আজ ওনাদেরকে আমরা দেখে নেব। ওনাদের হুকুমে অনেক অন্যায় অত্যাচার করেছি। গ্রামের লোকেরাও কালু সেখের কথার প্রতিধ্বনী করে উঠল।
শাকিল তাদেরকে থামিয়ে মিনহাজকে বলল, আপনার বাবা যার চাকরি করেন তার টাকা আত্মসাত করেছেন। গরিব চাষীদের উপর জুলুম করে টাকা পয়সা আদায় করেছেন। এ সমস্ত আপনিও নিশ্চয় জানেন। এটা ঠিক না বেঠিক কোনদিন চিন্তা করে দেখেছেন? আপনাদের কোন কর্মচারি যদি এ রকম করত, তা হলে আপনারা তখন কি করতেন? আপনারা যে একদিন মারা যাবেন, সে কথাও কি কোন দিন চিন্তা করে দেখেছেন? যাদের উপর অত্যাচার করছেন, তারাই তো একদিন আপনাদের দাফন কাফন করবেন। দাফনের পর কি বলাবলি করবেন জানেন? বলবেন, এই গোমস্তা ও তার ছেলে মারা গিয়ে খুব ভালো হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে জালিমদের হাত থেকে রক্ষা করলেন। কারো মৃত্যুর পর লোকেরা যদি তার সম্বন্ধে ভাল আলোচনা করে, তা হলে আল্লাহ পাক তার আযাব অনেক লাঘব করে দেন। আর যদি তার সম্বন্ধে খারাপ আলোচনা করে, তা হলে সে আরো বেশি আযাব ভোগ করবে। আল্লাহর সৃষ্টির সেরা হয়ে যদি আমরা দুর্নিতীপরায়ণ হই এবং মানুষের উপর অন্যায় অত্যাচার অবিচার করি, তা হলে আমাদের উপর কি আল্লাহ পাকের গজব নাজিল হবে না? ধনী লোকদের ও শাসকদের জেনে রাখা উচিত, মজলুমের চোখের পানি আল্লাহ কবুল করে থাকেন। দুদিন আগে হোক পরে হোক তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। প্রত্যেক মানুষের উচিত, নিজের ভাল মন্দের সাথে সাথে অন্যের ভালমন্দ চিন্তা করে সেই মতো কাজ করা। আল্লাহ পাকের রসুল হজরত মুহাম্মদ (দঃ) বলিয়াছেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা নিজে যা পছন্দ কর, অন্যের জন্যও তা না কর ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না। যাই হোক এখন আপনি কি চান; আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দিই?
মিনহাজ এতক্ষণ শাকিলের মুখে এই সমস্ত কথা শুনে নিজের ভুল বুঝতে পেরে চোখের পানি ফেলছিল। সেই অবস্থাতে একবার সবাই-ওর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, আপনার কথায় আমার জ্ঞান ফিরেছে। আমি অনুতপ্ত। আমাকে মাফ করে দিন। পুলিশের হাতে না দিয়ে ভাল হবার সুযোগ দিন। এতদিন যা কিছু করেছি এবং আজকের এই ঘটনা নায়েবের হুকুমেই করেছি। কথা দিচ্ছি, কোন রকম অন্যায় কাজ আর করব না। বাবাকেও করতে দেব না। আপনি আমাদেরকে মাফ করে দিন।
শাকিল বলল, আল্লাহ সবাইকে মাফ করুন, হেদায়েত দান করুন। তিনি উত্তম হেদায়েৎ দানকারী। তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কেউ হেদায়েত পেতে পারে না। তিনি আমাদের সবাইকে হেদায়েত নসীব করুন। তারপর উপস্থিত সকল লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারা এবার চলে যান। সবাই যাওয়ার পর শাকিল মিনহাজকে আরো অনেক কুরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে বোঝাল। তারপর ফজুকে নিয়ে ফিরে এল।