অবর্তমান – বনফুল

অবর্তমান – বনফুল

সমস্তটা দিন বন্দুক কাঁধে করে একটা চখার পিছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম৷ যাঁরা কখনো এ কার্য করেন নি তাঁরা বুঝতে পারবেন না হয়তো যে, ব্যাপারটা ঠিক কি জাতীয়৷ ধু-ধু করছে বিরাট বালির চর, মাঝে মাঝে ঝাউগাছের ঝোপ, এক ধার দিয়ে শীতের শীর্ণ গঙ্গা বইছে৷ চারদিকে জনমানবের চিহ্ন নেই৷ হু-হু করে তীক্ষ্ন হাওয়া বইছে একটা৷ কহলগাঁয়ের খেয়াঘাটে গঙ্গা পেরিয়ে প্রায় ক্রোশ দুই বালির চড়া ভেঙে আমি এই পারিপার্শ্বিকের মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম সকালবেলা৷ সমস্ত দিন বন্দুক কাঁধে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি৷ বালির চড়া ভেঙে ভেঙে কতখানি যে হেঁটেছি, খেয়াঘাট থেকে কতদূরেই বা চলে এসেছি, তা খেয়াল ছিল না৷ তবে মনে হচ্ছিল, সারাজীবন ধরে যেন হাঁটছিই, অবিশ্রান্ত হেঁটে চলেছি, চতুর চখাটা কিছুতেই আমার বন্দুকের মধ্যে আসছে না, ক্রমাগত এড়িয়ে এড়িয়ে উড়ে পালাচ্ছে৷

আমি এ অঞ্চলে আগন্তুক৷ এসেছি ছুটিতে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে৷ আমি নেশাখোর লোক৷ একটি-আধটি নয়, তিনটি নেশা আছে আমার—ভ্রমণ, সঙ্গীত এবং শিকার৷ এখানে এসে যেই শুনলাম খেয়াঘাট পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই গঙ্গায় পাখি পাওয়া যাবে, লোভ সামলাতে পারলাম না, বন্দুক কাঁধে করে বেরিয়ে পড়লাম৷ লোভ শুনে মনে করবেন না যে, আমি মাংস খাবার লোভেই পাখি মারতে বেরিয়েছি৷ তা নয়৷ আমি নিরামিষাশী৷ আলুভাতে ভাত পেলেই আমি সন্তুষ্ট৷

খেয়াঘাট পেরিয়ে সকালে চরে এসে প্রথমে যখন পৌঁছলাম, তখন হতাশ হয়ে পড়তে হল আমাকে৷ কোথায় পাখি! ধু-ধু করছে বালির চড়া, আর কোথাও কিছু নেই৷ গঙ্গার বুকে দু-একটা উড়ন্ত মাছরাঙা ছাড়া পাখি কোথায়! বন্দুক কাঁধে করে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় কাঁআঁ শব্দটা কানে এল৷ কয়ে চন্দ্রবিন্দু আকার আর অয়ে চন্দ্রবিন্দু আকার দিয়ে যে শব্দটা হয়, চখার শব্দটা ঠিক সে রকম নয়, তবে অনেকটা কাছাকাছি বটে৷ কাঁআঁ শুনেই বুঝলুম চখা আছে, কোথাও কাছে-পিঠে৷ একটু এগিয়ে গিয়েই দেখি, হ্যাঁ ঠিক, চকাই বটে৷ কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলাম মাত্র একটি দেখে৷ চখারা সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় থাকে৷ বুঝলাম, দম্পতির একটিকে কোনো শিকারী আগেই শেষ করে গেছেন! এটির ভব-যন্ত্রণা আমাকেই ঘোচাতে হবে৷ সাবধানে এগুতে লাগলাম৷

কাঁআঁ—

চখা উড়ে গেল৷ উড়বে জানতাম৷ চখা মারা সহজ নয়৷ দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ৷ বেশ খানিকক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে আবার সাবধানে এগুতে লাগলাম৷ কাছাকাছি এসেছি, বন্দুকটি বাগিয়ে বসতে যাব, আর অমনি—কাঁআঁ—

উড়ে গেল৷ বিরক্ত হলে চলবে না, চখা শিকার করতে হলে ধৈর্য চাই৷ এবার চখাটা একটু কাছেই বসল৷ আমিও বসলাম৷ উপর্যুপরি তাড়া করা ঠিক নয়—একটু বসুক৷ একটু পরেই উঠলাম আবার৷ আবার ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম, কিন্তু উল্টো দিকে৷ পাখিটা মনে করুক যে, আমি তার আশা ছেড়ে দিয়েই চলে যাচ্ছি যেন৷ কিছুদূর গিয়ে ও-ধার দিয়ে ঘুরে তারপর বিপরীত দিক দিয়ে কাছে আসা যাবে৷ বেশ কিছুদূর ঘুরতে হল—প্রায় মাইলখানেক৷ গুঁড়ি মেরে মেরে খুব কাছেও এসে পড়লাম৷ কিন্তু তাগ করে ঘোড়াটি যেই টিপতে যাব, আর অমনি—কাঁআঁ৷

ফের উড়ল৷ উড়তেই লাগল অনেকক্ষণ ধরে৷ কিছুতেই আর বসে না৷ অনেকক্ষণ পরে বসল যদি, কিন্তু এমন একটা বেখাপ্পা জায়গায় বসল যে, সেখানে যাওয়া মুশকিল৷ যাওয়া যায়, কিন্তু গেলেই দেখতে পাবে৷ আমার কেমন রোক চড়ে গেল, মারতেই হবে পাখিটাকে৷ সোজা এগিয়ে চললাম৷ আমি ভেবেছিলাম, একটু এগুলেই উড়বে, কিন্তু উড়লো না৷ যতক্ষণ না কাছাকাছি হলাম, ঠায় বসে রইল৷ মনে হল, অসম্ভব বুঝি সম্ভব হয় কিন্তু যে-ই বন্দুকটি তুলেছি আর অমনি—কাঁআঁ৷

এবারেও এমন জায়গায় বসল যার কাছে-পিঠে কোনো আড়াল-আবডাল নেই—চতুর্দিকেই ফাঁকা৷ কিছুতেই বন্দুকের নাগালের মধ্যে পাওয়া যাবে না৷ বাধ্য হয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে উড়িয়ে দিতে হল৷ এবার গিয়ে বেশ ভালো জায়গায় বসল৷ একটা ঝাউবনের আড়ালে আড়ালে গিয়ে খুব কাছাকাছিও আসতে পারলাম—এত কাছাকাছি যে তার পালকগুলো পর্যন্ত দেখা যেতে লাগল—ফায়ার করলাম৷

কাঁআঁ—কাঁআঁ—

লাগল না৷ ঝোপে-ঝোপে যা দু-একটা ছোট পাখি ছিল তারাও উড়ল, মাছরাঙাগুলোও চেঁচাতে শুরু করে দিলে৷ সমস্ত ব্যাপারটা থিতুতে আধ ঘণ্টারও ওপর লাগল৷ নদীর ঠিক বাঁকের মুখটাতেই বসল আবার চখাটা গিয়ে৷

আমি বসেছিলুম একটা বালির ঢিপির উপর, মুশকিল হল—উঠে দাঁড়ালেই দেখতে পাবে৷ উঠলাম না৷ শুয়ে পড়ে গিরগিটির মতো বুকে হেঁটে হেঁটে এগুতে লাগলাম৷ কিন্তু কিছুদূর গেছি, আর অমনি কাঁআঁ—

আমার মাথাটাই দেখা গেল, না বালির স্তর দিয়ে কোনোরকম স্পন্দনই গিয়ে পৌঁছল তার কাছে, তা বলতে পারি না৷ উঠে দাঁড়ালাম৷ রোক আরো চড়ল৷

হঠাৎ নজরে পড়ল সূর্য অস্ত যাচ্ছে৷ নদীর জল রক্ত-রাঙা৷ পাখিটা ও-পারের চরে গিয়ে বসেছে৷ সমস্ত দিন আমিও ওকে বিশ্রাম দিই নি—ও-ও আমাকে দেয় নি৷ এখন দুজনে দু’পারে৷ চুপ করে রইলাম৷

সূর্য ডুবে গেল৷ অস্তমান সূর্য-কিরণে গঙ্গার জলটা যত জ্বলন্ত লাল দেখাচ্ছিল, সূর্য ডুবে যাওয়াতে ততটা আর রইল না৷ আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে স্নিগ্ধ হয়ে উঠল চতুর্দিক৷ সমস্ত অন্তরেও কেমন যেন একটা বিষণ্ণ বৈরাগ্য জেগে উঠতে লাগল ধীরে ধীরে৷ পূরবী রাগিণী যেন মূর্ত হয়ে উঠল আকাশে, বাতাসে, নদীতরঙ্গে৷ হঠাৎ মনে পড়ল—বাড়ি ফিরতে হবে৷

কত রাত হয়েছে জানি না৷

ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি গঙ্গার চরে চরে৷ রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি৷ মধ্যগগনে পূর্ণিমার চাঁদ—চতুর্দিক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে৷ অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে শেষে বসলাম একটা উঁচু জায়গা দেখে৷ অনেকক্ষণ চুপ করে বসেই রইলাম৷ এমন একা জীবনে আর কখনো পড়িনি৷ প্রথম প্রথম একটু ভয় করছিল যদিও, কিন্তু খানিকক্ষণ পরে ভয়ের বদলে মোহ এসে আমার সমস্ত প্রাণ মন সত্তা অধিকার করে বসল৷ আমি মুগ্ধ হয়ে বসে রইলাম৷ মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম৷ মনে হল, কত জায়গায় কতভাবে ঘুরেছি, প্রকৃতির এমন রূপ তো আর কখনো চোখে পড়ে নি৷ রূপ নিশ্চয়ই ছিল, আমার চোখে পড়ে নি৷ নিজেকে কেমন যেন বঞ্চিত মনে হতে লাগল৷ তারপর সহসা মনে হল, আজীবন সব দিক দিয়েই আমি বঞ্চিত৷ জীবনের কোনো সাধটাই কি পুরোপুরি পূর্ণ হয়েছে? জীবনের তিনটি শখ ছিল—ভ্রমণ, সঙ্গীত, শিকার৷ ভ্রমণ করেছি বটে—ট্রেনে স্টিমারে চেপে এখানে ওখানে গেছি কিন্তু তাকে কি ভ্রমণ বলে? হিমালয়ের উচ্চ চূড়ায়, সাহারার দিগন্তপ্রসারিত অনিশ্চয়তায়, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রের তরঙ্গে, হিমশীতল মেরুপ্রদেশের ভাসমান তুষার-পর্বতশৃঙ্গে যদি না ভ্রমণ করতে পারলাম, তা হলে আর কি হল! সঙ্গীতেও ব্যর্থকাম হয়েছি৷ সা রে গা মা সেধেছি বটে কিন্তু সঙ্গীতের আসল রূপটি আলেয়ার মতো চিরকাল এড়িয়ে এড়িয়ে গেছে আমাকে৷ সেদিন অত চেষ্টা করেও বাগেশ্রীর করুণগম্ভীর রূপটি কিছুতেই ফুটিয়ে তুলতে পারলাম না সেতারে৷

ঠিক ঘাটে ঠিক ভাবেই আঙুল পড়ছিল কিন্তু সেই সুরটি ফুটল না, যাতে আত্মসম্মানী গম্ভীর ব্যক্তির নির্জন-রোদনের অবাঙময় বেদন মূর্ত হয়৷ শিকারই বা কি এমন করেছি জীবনে? সিংহ হাতি বাঘ গণ্ডার কিছুই মারি নি৷ মেরেছি পাখি আর হরিণ৷ আজ তো সামান্য একটা চখার কাছেই হার মানতে হল৷

কাঁআঁ—কাঁআঁ—কাঁআঁ—

চমকে উঠলাম৷ ঠিক মাথার উপরে চখাটা চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ পাখিরা সাধারণত রাত্রে তো ওড়ে না—হয়তো ভয় পেয়েছে কোনোরকমে৷ উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলাম৷

কাঁআঁ—কাঁআঁ—

আরো খানিকটা নেবে এল৷

হঠাৎ বন্দুকটা তুলে ফায়ার করে দিলাম৷

কাঁআঁ—কাঁআঁ—কাঁআঁ—কাঁআঁ—

লেগেছে ঠিক৷ পাখিটা ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়ল মাঝগঙ্গায়৷ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম—দেখলাম, ভেসে যাচ্ছে৷

যাক৷ জীবনে যা বরাবর হয়েছে, এবারও তাই হল৷ পেয়েও পেলাম না৷ সত্যি, জীবনে কখনই কিছু পাই নি, নাগালের মধ্যে এসেও সব ফসকে গেছে৷

চুপ করে বসে ছিলাম৷

চতুর্দিকে ধু-ধু করছে বালি, গঙ্গার কুলুধ্বনি অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে, জ্যোৎস্নায় ফিনিক ফুটছে৷ শিকার, চখা, বন্দুক, সমস্ত দিনের শ্রান্তি কোনো কিছুর কথাই মনে হচ্ছিল না তখন, একটা নীরব সুরের সাগরে ধীরে ধীরে ভেসে চলেছিলাম৷ হঠাৎ চমকে উঠলাম৷ দীর্ঘকায় ঋজুদেহ এক ব্যক্তি নদী থেকে উঠে ঠিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে গামছা দিয়ে গা মুছতে লাগলেন৷ অবাক হয়ে গেলাম৷ কোথা থেকে এলেন ইনি, কখন বা নদীতে নাবলেন, কিছুই দেখতে পাই নি৷

একটু ইতস্ততের পর জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কে?

লোকটি এতক্ষণ আমাকে লক্ষ্যই করেন নি৷

আমার কথায় মন্ত্রোচ্চারণ থেমে গেল ফিরে আমার দিকে চেয়ে রইলেন ক্ষণকাল—তারপর বললেন, আমি এখানেই থাকি৷ আপনিই আগন্তুক, আপনিই পরিচয় দিন৷

পরিচয় দিলাম৷

ও, রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন আপনি? আসুন আমার সঙ্গে, কাছেই আমার আস্তানা৷

দীর্ঘকায় ঋজুদেহ পুরুষটি অগ্রগামী হলেন, আমি তাঁর অনুসরণ করলাম৷ একটু দূর গিয়েই দেখি, একটি ছোট্ট কুটির৷ আশ্চর্য হয়ে গেলাম, সমস্ত দিন এ অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছি, এটা চোখে পড়ে নি আমার৷ ছোট্ট কুটিরটি যেন ছবির মতন, সামনে পরিচ্ছন্ন প্রাঙ্গণ, চতুর্দিকে রজনীগন্ধার গাছ, অজস্র ফুল৷ অনাবিল জ্যোৎস্নায় ধরণীর অন্তরের আনন্দ সহসা যেন পুষ্পায়িত হয়ে উঠেছে গুচ্ছ গুচ্ছ রজনীগন্ধার ঊর্ধ্বমুখ বিকাশে৷ মৃদু সৌরভে চতুর্দিক আচ্ছন্ন৷ আমিও আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ তিনি এসেই ঘরের ভিতরে ঢুকেছিলেন৷ একটু পরেই বেরিয়ে এলেন এবং শতরঞ্জি-গোছের কি একটা পাততে লাগলেন৷

বসুন৷

বসে দেখলাম শতরঞ্জি নয়—গালিচা৷ খুব দামি নরম গালিচা৷ তিনিও এক প্রান্তে এসে বসলেন৷ বলা বাহুল্য, আমার কৌতূহল ক্রমশই বাড়ছিল৷ তবে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম, তিনিও চুপ করে রইলেন৷ শেষে আমাকেই কথা কইতে হল৷

সমস্ত দিন এ অঞ্চলে ঘুরেছি, কিন্তু আপনার দেখা পাই নি কেন ভেবে আশ্চর্য লাগছে৷

সব সময় সব জিনিস কি দেখা যায়?

মুখের দিকে চেয়ে ভয় হল, চোখ দুটো জ্বলছে—মানুষের নয়, যেন বাঘের চোখ৷

একটা গল্প শুনুন তা হলে৷ রাজা রামপ্রতাপ রায়ের নাম শুনেছেন?

না৷

শোনবার কথাও নয়৷ দুজন রামপ্রতাপ ছিল, দুজনেই জমিদার, একজন সুদ-খোর আর একজন সুর-খোর৷

সুর-খোর?

হ্যাঁ, ও-রকম সুর-পাগল লোক ও-অঞ্চলে আর ছিল না৷ যত বিখ্যাত ওস্তাদদের আড্ডা ছিল তাঁর বাড়িতে৷ আমার অবশ্য এসব শোনা কথা৷ আমার পাঞ্জাবে জন্ম, পাঞ্জাবী ওস্তাদের কাছেই গান-বাজনা শিখেছিলুম৷ বাংলা দেশে এসে শুনলুম, রামপ্রতাপ নামে নাকি একজন গুণী জমিদার আছেন, যিনি সুরের প্রকৃত সমঝদার৷ প্রকৃত গুণীকে কখনো ব্যর্থমনোরথ হতে হয় নি তাঁর কাছে, গাড়িতে একজনের মুখে কথায় কথায় শুনলুম৷ তখনি যদি তাঁকে ঠিকানাটাও জিজ্ঞেস করি, তা হলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়, কিন্তু তা না করে আমি সপ্তাহখানেক পরে আর একজনকে জিজ্ঞেস করলুম, রাজা রামপ্রতাপ রায় কোথায় থাকেন? তিনি বলে দিলেন সুদখোর রামপ্রতাপের ঠিকানা৷ ডানকুনি স্টেশনে নেবে দশ ক্রোশ হাঁটলে তবে নাকি তাঁর নাগাল পাওয়া যাবে৷ একদিন বেরিয়ে পড়লাম তাঁর উদ্দেশে৷ ডানকুনি স্টেশনে যখন নাবলাম, তখন বেশ রাত হয়েছে৷ সেদিনও পূর্ণিমা৷ স্টেশনে আর একজনকে জিজ্ঞেস করলাম৷ সুদখোর রামপ্রতাপ ও-অঞ্চলে প্রসিদ্ধ লোক, সবাই চেনে৷ যাকে জিজ্ঞেস করলুম, সে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বললে, সোজা চলে যান৷ চলতে লাগলাম৷ কতক্ষণ চলেছিলাম তা ঠিক বলতে পারি না৷ খানিকক্ষণ পরে দেখলাম একটা বিরাট প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে হাঁটছি, চারদিকে কেবল মাঠ আর মাঠ, কোথাও কিচ্ছু নেই৷ মনে হল যেন শেষও নেই৷

কিছুদূরে গিয়েই হঠাৎ সামনে প্রকাণ্ড রাজবাড়িটা দেখা গেল, যেন মন্ত্রবলে আবির্ভূত হল—সাদা ধবধব করছে, মনে হল যেন মর্মর পাথর দিয়ে তৈরি৷ মিনার, মিনারেট গম্বুজ, সিংহদ্বার সমস্ত দেখা গেল ক্রমশ৷ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ, তারপর এগিয়ে গেলাম৷ প্রকাণ্ড সিংহদ্বারের দু’পাশে দেখি দু’জন বিরাটকায় দারোয়ান বসে আছে, দুজনেই নিবিষ্টচিত্তে গোঁফ পাকাচ্ছে বসে৷ ভিতরে ঢুকব কিনা জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ কোনো উত্তরই দিল না, গোঁফই পাকাতে লাগল৷ একটু ইতস্তত করে শেষে ঢুকে পড়লাম, তারা বাধা দিলে না৷ ভিতরে ঢুকে দেখি বিরাট ব্যাপার, বিশাল জমিদারবাড়ি জমজম করছে প্রকাণ্ড কাছারি-বাড়িতে বসে আছে সারি সারি গোমস্তারা৷ কেউ লিখছে, কেউ টাকা গুনছে, কেউ কেউ কানে কলম গুঁজে খাতার দিকে চেয়ে আছে, সবারই গম্ভীর মুখ৷ সামনে চত্বরে বসে আছে অসংখ্য প্রজা সারি সারি৷ সবাই কিন্তু চুপচাপ, কারো মুখে টুঁ শব্দটি নেই৷ আমি তানপুরা ঘাড়ে করে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলাম, কেউ আমার দিকে ফিরেও চাইলে না, আমারও সাহস হল না কাউকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতে, আমি ঘুরেই বেড়াতে লাগলাম৷ আমার মনের ইচ্ছা রাজা রামপ্রতাপকে গান শোনাব, কিন্তু হঠাৎ দেখতে পেলাম, কিছুদূরে ছোট্ট একটা বাগান রয়েছে, বাগানের মধ্যে ধবধবে সাদা মার্বেল পাথরের উঁচু চৌতারা, আর সেই চৌতারার উপরে কে একজন ধবধবে সাদা তাকিয়া ঠেস দিয়ে প্রকাণ্ড একটা গড়গড়ায় তামাক খাচ্ছেন৷ গড়গড়ার কুণ্ডলী-পাকানো নলের জরিগুলো জোৎস্নায় চকমক করছে৷ বাগানে ছোট্ট একটি গেট, গেটের দু’ধারে উর্দী-চাপরাস-পরা দু’জন দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে—ঠিক যেন পাথরের প্রতিমূর্তি৷ কেমন করে জানি না, আমার দৃঢ় ধারণা হল, ইনিই রাজা রামপ্রতাপ৷ এগিয়ে গেলাম৷ দারোয়ান দু’জন নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, বাধা দিলে না৷ রাজা রামপ্রতাপের কাছাকাছি এসে ঝুঁকে প্রণাম করলাম একবার৷

তিনি গম্ভীরভাবে মাথাটি নাড়লেন একবার শুধু৷ আস্তে আস্তে বললাম, হুজুরকে গান শোনাব বলে এসেছি, যদি হুকুম করেন—

তিনি সোজা হয়ে উঠে বসলেন, হাতের ইঙ্গিতে আমাকেও বসতে বললেন৷ তারপর কখন যে আমি দরবারী কানাড়ার আলাপ শুরু করেছি আর কতক্ষণ ধরে যে সে আলাপ চলেছে, তা আমার কিছুই মনে নেই৷ যখন হুঁশ হল তখন দেখি, একছড়া মুক্তোর মালা তিনি আমার গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন৷ মালাটা দেখবেন? কুটিরের ভিতর ঢুকে গেলেন তিনি, পরমুহূর্তেই তিনি বেরিয়ে এলেন একছড়া মুক্তোর মালা নিয়ে৷ অমন সুন্দর এবং অত বড় বড় মুক্তো আমি আর দেখি নি কখনো৷

তারপর?

আমাকে মালা পরিয়ে দিয়ে তিনি আস্তে আস্তে উঠে গেলেন৷ আমি চুপ করে বসেই রইলাম৷ তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, কিছু মনে নেই৷ সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি, রাজবাড়ি কাছারি-চৌতারা লোকজন—কোথাও কিছু নেই, ফাঁকা মাঠের মাঝখানে আমি একা শুয়ে ঘুমুচ্ছি!

একা! কি রকম?—সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলাম৷

হ্যাঁ৷ ফাঁকা মাঠের মাঝখানে একা—কেউ নেই৷ পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, গুণী রাজা রামপ্রতাপ অনেকদিন হল মারা গেছেন৷ বেঁচে আছে সেই সুদখোর ব্যাটা৷ তার বাড়ির পথ সবাই আমাকে বলে দিয়েছিল৷ কিন্তু আমার মনের একান্ত ইচ্ছে ছিল গুণী রামপ্রতাপকে গান শোনাবার, তাই তিনি মাঠের মাঝখানে আমাকে দেখা দিয়ে আমার গান শুনে বকশিশ দিয়ে গেলেন৷

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলাম৷ কতক্ষণ তা মনে নেই৷

হঠাৎ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, গান শুনবেন?

যদি আপনার অসুবিধে না হয়—

অসুবিধে আবার কি? সুরের সাধনা করবার জন্যেই আমি এই নির্জনবাস করছি—

আবার উঠে গেলেন৷ কুটিরের ভিতর থেকে বিরাট এক তানপুরা বার করে বললেন, বাগেশ্রী আলাপ করি শুনুন৷

শুরু হয়ে গেল বাগেশ্রী৷ ওরকম বাগেশ্রীর আলাপ আমি কখনো শুনি নি৷ যা নিজে আমি কখনো আয়ত্ত করতে পারি নি কিন্তু আয়ত্ত করতে চেয়েছিলুম তাই যেন শুনলাম আজ৷ কতক্ষণ শুনেছিলাম মনে নেই, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাও জানি না৷ ঘুম ভাঙল যখন তখন দেখি, আমি সেই ধু-ধু বালির চড়ায় একা শুয়ে আছি, কোথাও কেউ নেই৷ উঠে বসলাম৷ উঠতেই নজরে পড়ল চখাটা চরে বেড়াচ্ছে, মরে নি৷

আমরা তিনজনেই সবিস্ময়ে ভদ্রলোকের গল্পটা রুদ্ধশ্বাসে শুনিতেছিলাম৷ শিকার উপলক্ষ্যেই আমরা এ অঞ্চলে আসিয়া সন্ধ্যাবেলা এই ডাকবাংলায় আশ্রয় লইয়াছি৷ পাশের ঘরেই ভদ্রলোক ছিলেন৷ আলাপ হইলে আমরা শিকারী শুনিয়া তিনি নিজের এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার গল্পটি আমাদের বলিলেন৷ অদ্ভুত অভিজ্ঞতাই বটে! জিজ্ঞাসা করিলাম, তারপর?

তারপর আর কিছু নেই৷ রাত হয়েছে, এবার শুতে যান, আপনাদের তো আবার খুব ভোরেই উঠতে হবে৷ আমারও ঘুম পাচ্ছে—

এই বলিয়া তিনি আস্তে আস্তে উঠিয়া নিজের ঘরে প্রবেশ করিলেন৷ আমরা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম৷ তাহার পর হঠাৎ আমার কৌতূহল হইল, কোন অঞ্চলের গঙ্গার চরে এই কাণ্ড ঘটিয়াছিল জানিতে পারিলে আমরাও একবার জায়গাটা দেখিয়া আসিতাম৷ জিজ্ঞাসা করিবার জন্য পাশের ঘরে ঢুকিয়া দেখি, ঘরে কেহ নাই৷ চতুর্দিক দেখিলাম, কেহ নাই৷

ডাকবাংলার চাপরাসীকে জাগাইয়া প্রশ্ন করিলাম, পাশের ঘরে যে ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি কোথাকার লোক? চাপরাসী উত্তর দিল, পাশের ঘরে তো কোনো লোক নাই, গত দুই সপ্তাহের মধ্যে এখানে আর কেহ আসে নাই৷ এ ডাকবাংলায় কেহ বড় একটা আসিতে চায় না৷—বলিয়া সে অদ্ভুত একটা হাসি হাসিল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *