অবতারবরিষ্ঠ
একটা নাটক দেখেছিলাম মনে পড়ছে। তাতে মা বসুন্ধরা কাঁদছেন। আর একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করছে; মা, কাঁদছ কেন তুমি? বসুন্ধরা উত্তর দিচ্ছেন: আমার বুকে এত অন্যায় হচ্ছে, আমার সন্তানরা পথভ্রষ্ট, পাপাসক্ত। তাই আমি কাঁদছি। কাঁদছি আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছি, ‘ভগবান, তুমি এস। তুমি এসে যদি পথ না দেখাও তাহলে আর উপায় নেই।’
বাস্তবিক, পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা দেখি, মাঝে মাঝে এমন একটা সময় আসে, যখন সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। মানুষ পথ হারিয়ে ফেলে। ভুলে যায় কোন্টা ন্যায়, কোন্টা অন্যায়; কোন্টা ভালো, কোন্টা মন্দ; কোন্টা শ্রেয়, কোন্টা প্রেয়। শাশ্বত যে সব মূল্যবোেধ সেগুলো মানুষ হারিয়ে ফেলে। সত্যের শক্তিতে, ধর্মের শক্তিতে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। একটা আত্মবিস্মৃতি এসে মানবসমাজকে গ্রাস করে। এরকম যখন হয়, মানুষ যখন নিজের শক্তিতে নিজেকে আর রক্ষা করতে পারে না, হিন্দুরা বিশ্বাস করে, তখন ভগবান স্বয়ং আবির্ভূত হন মানুষকে পথ দেখাতে। হিন্দুদের বিশ্বাস, এভাবেই ভগবান এসেছেন বারবার যুগের প্রয়োজনে।* আমাদের মতো তিনি চলেন ফেরেন, আমাদের মতো শোক-তাপ, ব্যাধি-যন্ত্রণা সহ্য করেন, আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু তাঁদের সাধারণ মানুষের মতো। কিন্তু তবুও সবকিছুই যেন অ-সাধারণ। তাঁদের সবকিছুই লৌকিক, আবার তার মধ্যেও অনেক কিছুই আছে যা মনে হবে অ-লৌকিক। কেন তাঁরা নরদেহ ধারণ করে আসেন? কেন তাঁরা সাধারণ মানুষের মতো আচরণ করেন? কারণ, তা যদি না হত, তাহলে আমরা তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখতাম। ঠাকুর বলছেন: অবতার হলেন সূর্যোদয়ের সময়কার সূর্য। সেই সূর্যের দিকে আমরা তাকাতে পারি। কিন্তু মধ্যাহ্নসূর্যের দিকে তাকাতে পারি না। অবতার মানুষের কাছে একটু নরম ভাব ধরে আসেন, শক্তি আবৃত করে আসেন। আমাদের জন্য, আমাদের প্রয়োজনে তাঁর আবির্ভাব। তাই আমাদের সকলের মধ্যে আমাদের মতো করেই তিনি থাকেন, আমাদের সকলকে কাছে টেনে নেন। আমরা অনেক সময় বুঝতেও পারি না কে তিনি, কি তাঁর স্বরূপ। তারপর হঠাৎ যখন একদিন চলে যান, তখন আমরা চমকে উঠি, হঠাৎ যেন আবিষ্কার করি, তিনি আমাদের এমন কিছু দিয়ে গেছেন, যা আমাদের ছিল না। আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল না, তিনি প্রেম দিয়ে গেছেন; পবিত্রতা কি ভুলে গেছিলাম, তিনি পবিত্রতা দিয়ে গেছেন; ত্যাগ-বৈরাগ্য-ভক্তি-বিবেক এগুলি আমরা হয়তো বইয়ে পেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি সেগুলো শিখিয়ে গেছেন আমাদের, নিজের জীবনে সেগুলোর প্রমাণ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। বাস্তবিক, সব ধর্মে সব দেশেই এই অবতারের ধারণা আমরা দেখতে পাই। আমরা বলি স্বয়ং ঈশ্বরই নরদেহ ধারণ করে আসেন, অন্যেরা বলে থাকেন ঈশ্বর তাঁর দূতকে পাঠান অথবা ঈশ্বর তাঁর সন্তানকে পাঠান।
কেন ঈশ্বর অবতীর্ণ হন? কখন আসেন অবতার? গীতাতে ভগবান বলছেন:১
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
—যখনই ধর্মের গ্লানি হয়, অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, মানুষ সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়, তখনই আমি নরদেহ ধারণ করে অবতীর্ণ হই। আবার বলছেন:২
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥
—যারা সাধু, তাদের রক্ষা করার জন্য, যারা দুষ্কৃতকারী তাদের ধ্বংস করার জন্য, ধর্মস্থাপন করবার জন্য আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই।
আমরা বিশ্বাস করি যে, অবতার বারবার এসে থাকেন। ভাগবতে আছে:৩
অবতারা হ্যসংখ্যেয়া হরেঃ সত্ত্বনিধের্দ্বিজাঃ।
যথাবিদাসিনঃ কুল্যাঃ সরসঃ স্যুঃ সহস্রশঃ॥
—সত্ত্বগুণের আকর হরির অসংখ্য অবতার। তিনি যেন একটা অক্ষয় সরোবর। সহস্রধারায় তা থেকে জল বেরিয়ে যাচ্ছে নানাদিকে, কিন্তু সেই সরোবর যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। ঈশ্বর তেমনি যেমন ছিলেন তেমনি আছেন, কিন্তু তাঁর করুণার ধারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, বিভিন্ন অবতারের ভিতর দিয়ে।
খ্ৰীষ্টানরা কিন্তু এই অনেক অবতারের ধারণাটা স্বীকার করেন না। তাঁরা বলেন যে, যীশুখ্রীষ্টই হচ্ছেন ভগবানের একমাত্র সন্তান—The only begotten Son. তাঁরা বলেন, আর যাঁরা এসেছেন, মহাপুরুষ—ভাল তাঁরা। বুদ্ধ ভাল, মহম্মদ ভাল, চৈতন্য ভাল—সব ভাল। কিন্তু ভালর ভাল সবচেয়ে ভাল—যীশুখ্রীষ্ট ছাড়া আর কেউ নন। ঈশ্বরপুত্র বা ঈশ্বরের দূত যদি কাউকে বলতে হয়, তাহলে সে যীশুখ্রীষ্ট ছাড়া আর কেউ নন। বেশ কিছুদিন আগে খ্রীষ্টানদের বিভিন্ন দলের কয়েকজন প্রতিনিধি রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারে* এসেছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই পাদরী। তাঁরা বললেন: আপনাদের সঙ্গে অর্থাৎ হিন্দুদের সঙ্গে একটা ‘dialogue’ করতে চাই আমরা। অর্থাৎ হিন্দুদের সঙ্গে খ্রীষ্টানদের একটা মতবিনিময় করতে চান। এ-বিষয়ে তো আমাদের আপত্তি হবার কিছু নেই। আমরা রাজী হলাম। আলোচনার দিনে আমাদের একজন উঠে দাঁড়িয়ে রামকৃষ্ণদেবের জীবনী সংক্ষেপে বললেন। বললেন যে, তিনি হিন্দু ছিলেন, কিন্তু তিনি এটা মনে করতেন না যে, হিন্দুধর্মই একমাত্র ধর্ম। অন্যান্য ধর্মও তিনি অনুশীলন করেছিলেন, ইসলাম ধর্ম বা খ্রীষ্টান ধর্মও তিনি অনুশীলন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন তখন জিজ্ঞেস করলেন: কত দিনের জন্য তিনি খ্রীষ্টান হয়েছিলেন? আমাদের যিনি প্রতিনিধি তিনি বললেন: বেশী দিনের জন্য নয়, অল্প সময়ের জন্য। তখন সেই ভদ্রলোক—একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক তিনি—খুব উত্তেজিতভাবে বললেন: এইভাবে খ্রীষ্টান হওয়া যায় না। তার জন্য ‘lifelong commitment’ চাই। অর্থাৎ চিরজীবনের জন্য আমি খ্রীষ্টান, আমি খ্রীষ্টকেই উপাসনা করি, আর কাউকে করি না। একদিনের জন্য, কি সাতদিনের জন্য, কি ছ’মাসের জন্য আমি খ্রীষ্টান হলাম—তাকে খ্রীষ্টান হওয়া বলে না। তারপরে খুব তর্ক লেগে গেল। শেষে তাঁদের দলেরই একজন, নেদারল্যাণ্ডসের একজন মহিলা, এমন একটা ভাষণ দিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে যে, আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যা আমরা বলতাম, তা সেদিন ঠাকুর আমাদের দিয়ে না বলিয়ে তাঁর মুখ দিয়েই বলিয়ে নিলেন। শেষ পর্যন্ত আলোচনার হাওয়া পালটে গেল, হাওয়া আবার আমাদের অনুকূলে চলে এল। তারপর যখন আমরা বিরতির সময় একসঙ্গে চা খাচ্ছি তখন সেই অধ্যাপক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম: আচ্ছা তুমি যে বলছিলে ‘lifelong commitment to Christ’—সারাজীবনের জন্য যীশুখ্রীষ্টের প্রতি আনুগত্য—এই যীশুখ্রীষ্ট একটা প্রতীক না ব্যক্তি? Symbol of an idea? না, person? এইখানেই তিনি কিন্তু গোলমাল করে ফেললেন, বললেন: Person. আদর্শ নয়, চিন্তা নয়, দর্শন নয়—ব্যক্তি। ব্যক্তি হিসাবে যীশুখ্রীষ্টের প্রতি আনুগত্য। আমি বললাম; তাহলে যদি হিন্দুরা বলেন, কৃষ্ণকে ভজনা না করলে হবে না? কারণ, কৃষ্ণ যে বলছেন, ‘মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু’? তখন তিনি বলছেন: সে তো mythology। অর্থাৎ অনেক আগের ব্যাপার, পৌরাণিক ঘটনা সেসব। আমি বললাম: আচ্ছা মহম্মদ যীশুখ্রীষ্টের আগে না পরে? পরে তো? তা মহম্মদও যে তাঁকেই অনুসরণ করতে বলে গেছেন? যদি ব্যক্তিকেই অনুসরণ করতে হয়, তাহলে তো মহম্মদকেই অনুসরণ করতে হয়। তাঁর আগে যাঁরা এসেছেন সব বাতিল। আমাদের কৃষ্ণ বাতিল, তোমাদের যীশুখ্রীষ্টও বাতিল। এরপরে হয়তো আর একজন এসে ঐকথাই বলবেন। তাহলে? তখন তিনি খুব মুশকিলে পড়ে গেছেন। তখন আমি তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, পারলাম কিনা জানি না: দেখ, commitment নিশ্চয়ই— কিন্তু সে কোন ব্যক্তিকে বা মূর্তিকে নয়, একটা ভাবকে, একটা আদর্শকে। যীশুখ্রীষ্ট একটা আদর্শের প্রতীক। সেই আদর্শ আমাদের ধর্মে আছে, তোমাদের ধর্মে আছে, সব ধর্মেই আছে। সেই ভাব বা আদর্শ আয়ত্ত করতে তোমার-আমার হয়তো সারাজীবন লাগে, সারাজীবন ধরে যীশুখ্রীষ্টের চিন্তা করতে হয়। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের মতো ব্যক্তির পক্ষে তার জন্য বেশী দিন লাগে না। আজকাল অনেকেই বলে থাকেন, একমাত্র খ্রীষ্টান হচ্ছেন যীশুখ্রীষ্ট। কারণ, তিনি যে-সত্য প্রচার করে গেছেন, একমাত্র তিনিই সেই সত্য জীবনে সম্পূর্ণভাবে প্রতিফলিত করতে পেরেছেন। একই সত্য বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে রূপ গ্রহণ করে। তাঁদেরই আমরা অবতার বলি। সেই সত্য এক—কিন্তু অবতার বহু।
একটা বাঙলা গান আছে, বিনোদেশ্বর দাশগুপ্তের রচনা। বুদ্ধ পর্যন্ত সব অবতারের কথা বলার পরে তিনি বলেছেন যীশুখ্রীষ্ট, মহম্মদ, শঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য এবং নানকের কথা। শ্রীচৈতন্য এবং নানকের পর এনেছেন শ্রীরামকৃষ্ণকে। বাস্তবিক, কোন একজনের সম্পর্কে বলা যায় না তিনি ঈশ্বরের সর্বশেষ এবং একমাত্র অবতার। যখনই তাঁর আসার প্রয়োজন হবে তখনই তিনি আসবেন। গীতাতে নিজমুখে তিনি তাই বলেছেন। বিনোদেশ্বর দাশগুপ্তের গানটি হল এই:
জয় বেদোদ্ধারণ যুগাবতরণ ভূভার-হরণ হরি হে।
জয় মীন কূর্ম বরাহ বিগ্রহ নৃসিংহরূপ-ধারি হে॥
বামন বলি-বদ্ধকারী, ক্ষত্রিয়-নাশন পরশুধারী।
।জয় সীতাপতি রামচন্দ্র রাবণ-নিধন-কারি হে॥
যশোদানন্দন ভয় হর, দনুজ দলন হলধর।
জয় ব্রজ-গোপাল কৃষ্ণচন্দ্র পার্থরথ-বিহারি হে॥
বুদ্ধ কৃপা-বিগলিত-হৃদি, শঙ্কর বেদ-জ্ঞান ভাতি।
জয় মেরী-নন্দন পাপ-হরণ, মহম্মদ তমোহারি হে॥
জয় নবদ্বীপ-পূর্ণচন্দ্র, ভক্ত বৎসল কীৰ্ত্তনানন্দ।
জয় গুরুজী নানক, শিষ্য-পালক ভেদ-নাশ-কারি হে॥
নরেন্দ্র-নন্দিত রামকৃষ্ণ, একাধারে রাম ও কৃষ্ণ।
জয় ম্লেচ্ছভাব-নিবহ-নিধনে জ্ঞান অসিধারি হে॥
—প্রথমে বলছেন: ‘জয় বেদোদ্ধারণ যুগাবতরণ ভূভার-হরণ হরি হে।’ ভগবান প্রথমে আবির্ভূত হয়ে কি করেছিলেন? বেদকে উদ্ধার করেছিলেন। বেদের সম্বন্ধে আমাদের ধারণা এই যে, বেদ অপৌরুষেয়। অর্থাৎ কোন পুরুষ তা লেখেনি, কেউ উদ্ভাবন করেনি। ‘বেদ’ কথাটা এসেছে ‘বিদ্’ ধাতু থেকে। বেদ হচ্ছে সঞ্চিত জ্ঞানরাশি, শাশ্বত সত্য। যুগে যুগে সেই সত্য আত্মপ্রকাশ করে ঋষিদের ভিতর দিয়ে। আমরা দেখি, মোজেস বাণীলাভ করেছেন। মহম্মদের বেলাতেও তাই। আসলে আর কিছু নয়, চিরন্তন যে সত্য, সেই ‘বেদ’ তাঁরা নিজেরা উপলব্ধি করলেন। একটা জিনিস ছিল, সেটাকে তাঁরা জানলেন, আবিষ্কার করলেন—ইংরেজি ‘discovery’ কথাটা যে অর্থে ব্যবহার করা হয়। ভগবান সেই বেদ উদ্ধার করেন, প্রচার করেন, যুগের প্রয়োজনে অবতীর্ণ হয়ে ধরিত্রীর ভার তিনি হরণ করেন, ভার লাঘব করেন। এইজন্যই তো তিনি হরি। দুঃখ হরণ করেন, সংসারভার হরণ করেন, তাই তিনি হরি। ভগবান এইভাবে এসেছেন মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রামচন্দ্র, কৃষ্ণ, বলরাম এবং বুদ্ধ-রূপে। এঁদের মধ্যে বুদ্ধ হলেন নিঃসংশয়ে প্রথম ঐতিহাসিক পুরুষ। বুদ্ধের পরে এলেন শঙ্করাচার্য— ‘শঙ্কর বেদ-জ্ঞান ভাতি’। শঙ্করাচার্যকে বলা হয় শিবের অবতার। জ্ঞানের ঐশ্বর্য নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সমস্ত বেদ তাঁর মধ্যে যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল। আমরা জানি, বুদ্ধদেব শাস্ত্রের কথা কিছু বলতেন না। কারণ, তিনি দেখেছিলেন, মানুষ শাস্ত্র নিয়ে অনর্থক তর্ক-বিচার করে, সেদিকেই তাদের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে, জীবনের যে আসল লক্ষ্য—মোক্ষলাভ বা তিনি যেটাকে বলেছেন ‘নির্বাণলাভ’—তার দিকে নজর নেই। তাই শাস্ত্র সম্বন্ধে তিনি নীরব রইলেন। তিনি তাঁর জীবন দিয়ে যা প্রচার করলেন তা সেই বেদেরই কথা, কিন্তু বেদ কথাটা বা উপনিষদ কথাটা তিনি কোথাও ব্যবহার করেননি কখনও। তার ফলে এই হল যে, তাঁর যাঁরা অনুগামী তাঁরা শ্রুতি মানতেন না। অথচ আমাদের দেশে শাস্ত্রই হচ্ছে একমাত্র প্রামাণ্য। এমন কিছু এখানে চলে না যা শাস্ত্র, বিশেষ করে যা কিনা শ্রুতি, তার সঙ্গে মেলে না। তার ফলে পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের পতন হল, নানারকম অনাচার দেখা দিল। তখন এলেন শঙ্করাচার্য, বেদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। ‘জয় মেরী-নন্দন পাপ-হরণ’—যীশুখ্রীষ্ট এলেন, মেরী তাঁর মা। সমস্ত মানবজাতির পাপ হরণ করতে যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাব। খ্রীষ্টানরা বলেন ‘originalsin’ —আদি পাপ। কি সেই পাপ? ঈশ্বরের অবাধ্য হওয়া। অ্যাডাম আর ইভ—প্রথম পুরুষ আর নারী। ভগবানের নিষেধ অমান্য করে শয়তানের প্রলোভনে তাঁরা জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়েছিলেন। সেই হল আদি পাপ। ঈশ্বর তাঁদের স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দিলেন। পৃথিবীতে এলেন তাঁরা, তারপর থেকে মানুষ এত কষ্ট পাচ্ছে। সেই পাপ থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য যীশুখ্রীষ্ট পৃথিবীতে এলেন। যীশুখ্রীষ্ট হচ্ছেন ঈশ্বরের সন্তান—খ্রীষ্টানদের মতে, একমাত্র সন্তান। মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। আর এসেছেন ‘মহম্মদ তমোহারি হে’। আরববাসী প্রকৃত ধর্ম ভুলে অজ্ঞানের তমসায় ডুবে ছিল। সেই অন্ধকার দূর করবার জন্য মহম্মদ আবির্ভূত হলেন। ‘জয় নবদ্বীপ-পূর্ণচন্দ্র, ভক্ত বৎসল কীর্তনানন্দ।’ প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্য এলেন, এলেন নানক—সমস্ত ভারতবর্ষ আলো করে। তাঁরা ‘ভেদ-নাশ-কারি’। প্রেমের অবতার তাঁরা। প্রেমের শক্তিতে তাঁরা মানুষে মানুষে সমস্ত ভেদ মুছে দিয়েছিলেন। শঙ্করাচার্যের মধ্যে আমরা দেখি মেধার বিকাশ। কিন্তু শুধু মেধার দিকে জোর দিলে অপূর্ণতা থেকে যায়। হৃদয়ও চাই। তাই শ্রীচৈতন্য এলেন। স্বামীজী বলছেন; কিন্তু পৃথিবীতে এবার দরকার হল এমন একজনের যাঁর মধ্যে একাধারে দেখা যাবে শঙ্করাচার্যের জ্ঞান আর শ্রীচৈতন্যের প্রেম, শঙ্করের মস্তিষ্ক আর চৈতন্যের হৃদয়। তাই এলেন: ‘নরেন্দ্র-নন্দিত রামকৃষ্ণ, একাধারে রাম ও কৃষ্ণ।’
শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন নিজের সম্বন্ধে: যে রাম, যে কৃষ্ণ, সেই ইদানীং রামকৃষ্ণ; বলছেন: এবার ছদ্মবেশে আসা, রাজা যেমন কখনও কখনও ছদ্মবেশে বের হয়। প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখবার জন্য রাজা মাঝে মাঝে ছদ্মবেশে বেড়ান। শ্রীরামকৃষ্ণও রাজা। রাজার রাজা। ভগবান স্বয়ং! ছদ্মবেশে এসেছেন—মানুষের দুঃখ নিজের চোখে দেখতে; তাদের উদ্ধার করতে। আবার বলছেন: দেখলাম—খোলটি—(দেহটি) ছেড়ে সচ্চিদানন্দ বাহিরে এল, এসে বললে, আমি যুগে যুগে অবতার!⋯ দেখলাম, পূর্ণ আবির্ভাব। তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য। (৩-১২-৩) শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে সচ্চিদানন্দের পূর্ণ প্রকাশ। ‘তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য’। তাঁর মধ্যে সত্ত্বগুণের আধিক্য দেখি আমরা। শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের ছিল রাজৈশ্বর্য, দৈহিক পরাক্রম ও শৌর্য। অর্থাৎ রজোগুণের ঐশ্বর্য। কিন্তু এবারে রামচন্দ্রের ধনুর্বাণ নেই, শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্র নেই। বুদ্ধের যে রাজ-ঐশ্বর্য ছিল, শ্রীচৈতন্যের বা শঙ্করাচার্যের যে পাণ্ডিত্যের ঐশ্বর্য ছিল—এবার সেসব কিছু নেই। এবারের ঐশ্বর্য নিরৈশ্বর্য। এবারের বিভূতি পবিত্রতা, এবারের বিভূতি সত্যনিষ্ঠা, এবারের বিভূতি অহংশূন্যতা। এ সব সত্ত্বগুণের লক্ষণ।
অথচ অন্যান্য অবতারের যেসব মূল আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য, সেগুলি তাঁর মধ্যে আছে। অন্যান্য যেসব অবতার এসেছেন তাঁরা একটি বা দুটি ভাব মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। যেমন রামচন্দ্রের সম্বন্ধে বলা যায়, তাঁর প্রধান ভাব সত্যনিষ্ঠা। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই তাঁর সব লীলা—বনবাস, রাবণবধ, সীতা বিসর্জন, অথবা লক্ষ্মণবর্জন। তেমনি, শ্রীকৃষ্ণের অনাসক্তি, বুদ্ধদেবের অহিংসা, যীশুখ্রীষ্ট্রের প্রেম, শ্রীচৈতন্যের ঈশ্বরমত্ততা, শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ। এইরকম এক একটা ভাব আমরা এঁদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। ধর্মের সমগ্র রূপ—এ কিন্তু তাঁরা প্রচার করেননি, তার প্রয়োজনও হয়তো তখন ছিল না। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণে দেখছি, একটা বিশেষ কোন ভাব নয়, অথবা বিশেষ কয়েকটি ভাব নয়—এই সব ভাবের ঘনীভূত প্রকাশ। সব অবতারের বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে। একটা গানে আছে:
ত্রেতাতারী রাম, দ্বাপরের শ্যাম,
রামকৃষ্ণ দোঁহে একাধারে।
গৌতমের প্রাণ, শঙ্করের জ্ঞান,
অবতীর্ণ লয়ে ধরা পরে।
রামানুজ, গোরা, একপ্রেমে জোড়া,
কবীর, নানক এক ডোরে,
যত অবতার সমষ্টি সবার,
রামকৃষ্ণরূপে এইবারে॥
রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, শঙ্করাচার্য, রামানুজ, শ্রীগৌরাঙ্গ, কবীর, নানক—এঁদের সবার সমষ্টি শ্রীরামকৃষ্ণ। এঁদের সবার ভাব তাঁর মধ্যে রয়েছে। স্বামীজীর ভাষায় ‘অনন্তভাবময়’ তিনি। বলছেন: ব্রহ্মজ্ঞানের ইয়ত্তা হতে পারে, কিন্তু—‘প্রভু’র অগম্য ভাবের ইয়ত্তা হয় না। স্বামীজী তাই বলছেন: ‘অবতারবরিষ্ঠ’* —শ্রেষ্ঠ অবতার শ্রীরামকৃষ্ণ।
অন্যান্য অবতারদের ছোট করছেন না স্বামীজী। একই ভগবান যুগে যুগে অবতীর্ণ হন। যত অবতার এ পর্যন্ত এসেছেন, তাঁরা কেউই আলাদা নন, এক তাঁরা। তাঁদের মধ্যে পার্থক্যটা শুধু শক্তির প্রকাশে। যে যুগে যতটা প্রয়োজন, ততটা শক্তি নিয়ে ভগবান আবির্ভূত হন। সেইজন্য অবতারকে তাঁর যুগের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হয়। বরাহ অবতার এবং বুদ্ধ অবতারকে একই মাপকাঠিতে বিচার করলে চলবে না। বিচার করতে হবে, যে বিশেষ প্রয়োজন মেটাতে তাঁরা এসেছিলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে। সেইভাবে বিচার করলে দেখা যায় যে, তাঁদের কারুরই অবদান কম নয়, কেউ কারও থেকে ছোট নন। কিন্তু স্বামীজী ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে,** প্রতি অবতারে ভগবান তাঁর ‘আত্মস্বরূপ’ আর একটু বেশী প্রকাশ করেন। প্রতি অবতার তাঁর পূর্ববর্তী অবতারের তুলনায় বেশী শক্তি নিয়ে আসেন। শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব যুগের প্রয়োজনে, যুগের প্রয়োজনেই তাঁর মধ্যে সর্বোচ্চ শক্তির প্রকাশ। স্বামীজী বলছেন: শ্রীরামকৃষ্ণ ‘সর্বযুগাপেক্ষা সমধিক সম্পূর্ণ, সর্বভাব-সমম্বিত, সর্ববিদ্যা-সহায়’ যুগাবতার। ধর্মজগতে যত ভাব আছে, যত রকম ভাব ধরে মানুষ এতকাল ধর্মপথে এগিয়ে চলেছে, সমস্ত ভাবের সমন্বয় হয়েছে তাঁর মধ্যে। আর ধর্মের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজের জীবন দিয়ে এই সমন্বয় ঘটালেন। আমরা তো শ্রুতিতেই পেয়েছিলাম সেই কথা: একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি। কিন্তু সেটা এতকাল ছিল শুধু একটা তত্ত্ব। সেই তত্ত্ব এই প্রথম বাস্তবরূপ গ্রহণ করল— শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে। সব মত সব পথ দিয়ে তিনি গেলেন; গিয়ে দেখালেন যে, ঈশ্বরলাভের অনন্তপথ, সব পথই সমান সত্য। তিনি যে বললেন, ‘যত মত তত পথ’—এ শুধু কথা নয়, এ একটা পরীক্ষালব্ধ সত্য, এ তাঁর উপলব্ধি। এইখানেই শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠত্ব। এইজন্যই তিনি ‘অবতারবরিষ্ঠ’।
স্বামীজী তাঁর এক মাদ্রাজী ভক্তকে লিখছেন:৪ ‘শ্রীরামকৃষ্ণের মতো এত উন্নত চরিত্র কোন কালে কোন মহাপুরুষের হয় নাই।’ আবার স্বামী শিবানন্দকে লিখছেন:৫ ‘দাদা, বেদ-বেদান্ত পুরাণ-ভাগবতে যে কি আছে, তা রামকৃষ্ণ পরমহংসকে না পড়লে কিছুতেই বুঝা যাবে না।⋯He was the living commentary to the Vedas and to their aim. He had lived in one life the whole cycle of the national religious existence in India.’ —বেদের জীবন্ত ভাষ্য শ্রীরামকৃষ্ণ। শুধু তাই নয়, যুগ যুগ ধরে ভারতে যত ধর্মচিন্তা, যত ধর্মসাধনা ও উপলব্ধি হয়ে এসেছে—তার সমস্ত স্তর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের জীবনে ফুটিয়ে তুলেছেন। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখছেন ঐ একই কথা:৬ ‘He was the embodiment of all past religious thoughts of India. His life alone made me understand what the Shastras really meant, and the whole plan and scope of the old Shastras.’ —ভারতে যত ধর্মচিন্তা হয়েছে, তিনি হচ্ছেন তার ঘনীভূত মূর্তি। শাস্ত্রের মর্ম কি, কি তার উদ্দেশ্য ও পরিধি—এ আমি তাঁর জীবন দেখেছি বলে বুঝতে পারছি।
প্রমদাদাস মিত্রকে (পণ্ডিত মানুষ, সম্রান্ত জমিদার, কাশীতে থাকতেন) লিখছেন:৭ ‘রামকৃষ্ণের জুড়ি আর নাই, সে অপূর্ব সিদ্ধি, আর সে অপূর্ব অহেতুকী দয়া, সে intense sympathy বদ্ধ-জীবনের জন্য—এ জগতে আর নাই।’ আবার শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে লিখছেন:৮ শ্রীরামকৃষ্ণ কি জান?
যস্য বীর্যেণ কৃতিনো বয়ং চ ভুবনানি চ।
রামকৃষ্ণং সদা বন্দে শর্বং স্বতন্ত্রমীশ্বরম্॥
—যাঁর শক্তিতে আমাদের সমস্ত কৃতিত্ব, বিশ্বচরাচরের সমস্ত সৃষ্টি যাঁর থেকে, তিনিই হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সেই শ্রীরামকৃষ্ণকে সর্বদা প্রণাম করি। কারণ তিনি মঙ্গলস্বরূপ। তিনি স্বতন্ত্র ঈশ্বর—স্বয়ং ঈশ্বর। আবার লিখছেন শশী মহারাজকে:৯
প্রাপ্তং যদ্বৈ ত্বনাদিনিধনং বেদোদধিং মথিত্বা
দত্তং যস্য প্রকরণে হরিহরব্রহ্মাদিদেবৈর্বলম্।
পূর্ণং যত্তু প্রাণসারৈর্ভৌমনারায়ণানাং
রামকৃষ্ণস্তনুং ধওে তৎপূর্ণপাত্রমিদং ভোঃ॥
—‘পূর্ণপাত্র’ শ্রীরামকৃষ্ণ, অমৃতের পূর্ণপাত্র। যে অমৃত অনাদি অনন্ত বেদসমুদ্র মন্থন করে পাওয়া গেছে, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর প্রভৃতি দেবতার শক্তি যাতে যুক্ত হয়েছে; ‘ভৌমনারায়ণানাম্’ অর্থাৎ পৃথিবীতে যত অবতার এসেছেন, তাঁদের প্রাণের নির্যাস যাতে রয়েছে, সেই অমৃতের পূর্ণপাত্র শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি বেদ-মূর্তি; সর্ব-দেবদেবী-মূর্তি, সর্ব-অবতার-মূর্তি। তাই তিনি ‘অবতারবরিষ্ঠ’।
আমরা ‘কথামৃতে’ দেখি বারবার শ্রীরামকৃষ্ণ অবতারপ্রসঙ্গ তুলছেন। বিশেষ করে তাঁর অন্ত্যলীলার দিনগুলিতে। যেন এই উদ্দেশ্যে তুলছেন যে, লোকে বুঝুক তিনি কে, তাঁর স্বরূপটা চিনুক লোকে। তিনি মাঝে মাঝে বলতেন: যাওয়ার আগে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে যাব। অর্থাৎ লোককে জানিয়ে দিয়ে যাবেন তিনি কে। ভগবান যে মানুষের শরীর নিয়ে অবতীর্ণ হন, এ তখনকার দিনে শিক্ষিত যাঁরা তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। আমরা দেখি শ্রীরামকৃষ্ণের সামনেই একজন বলছেন: কলিযুগে অবতার আর নেই। শ্রীরামকৃষ্ণ হাসছেন, বলছেন: তুমি কি করে জানলে যে অবতার নেই? শুধু এইটুকু বলছেন, আর কিছু বলছেন না। স্বামী বিবেকানন্দ, তখন তিনি নরেন্দ্রনাথ, তিনিও ছিলেন এই দলে। ঠাকুরকে অবতার ভাবা তো দূরের কথা, অবতার কখনও যে সম্ভব হতে পারে এটাও তিনি মানতেন না প্রথম প্রথম। তিনি বলতেন: ঈশ্বর অনন্ত। যা কিছু আমরা দেখি, শুনি—জিনিসটি, কি ব্যক্তিটি—সব তাঁর অংশ, এ পর্যন্ত আমাদের বলবার যো নাই। Infinity—তার আবার অংশ কি? অংশ হয় না। (১-১৪-২) যিনি অসীম তাঁর আবার একটা সীমা করব কেমন করে? খণ্ড করব কেমন করে? কাজেই, অনন্ত ভগবান, তিনি একটা শরীরের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করবেন, অবতার হয়ে লীলা করবেন এ কখনও হতে পারে না। কিন্তু ঠাকুর বলছেন: ঈশ্বর অনন্ত হউন আর যত বড় হউন, — তিনি ইচ্ছা করলে তাঁর ভিতরের সার বস্তু মানুষের ভিতর দিয়ে আসতে পারে ও আসে। তিনি অবতার হয়ে থাকেন।⋯(ঐ) আমরা দেখি গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন:১০
অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া॥
—আমার জন্ম নেই, আমার মৃত্যুও নেই। আমি অব্যয়, আমি সকলের ঈশ্বর তবুও আমি আমার নিজের প্রকৃতিকে আশ্রয় করি, আমার মায়া দ্বারা আমি বারবার জন্মগ্রহণ করি। অর্জুনকে বলছেন:১১
বহৃনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন।
তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ॥
—তুমিও বহুবার জন্মগ্রহণ করেছ, আমিও বহুবার জন্মগ্রহণ করেছি। তাহলে তোমার সাথে আমার তফাৎ কি? আমি সেইসব অতীত জন্মের কথা জানি, তুমি জান না। কারণ, আমি স্বেচ্ছায় জন্মগ্রহণ করি, আর তুমি জন্মগ্রহণ কর আমার ইচ্ছায়। আমি মায়াধীশ, তুমি মায়ার অধীন। ঠাকুরও সেইকথাই বলছেন: ভগবান নরদেহে অবতীর্ণ হতে পারেন—যদি তিনি ইচ্ছা করেন। যুগে যুগে তিনি এসে থাকেন।
ঠাকুর বলছেন: মানুষদেহ ধারণ করে ঈশ্বর অবতীর্ণ হন। (১-১৬-৩) ‘অনুগ্রহায় ভূতানাং মানুষং দেহমাস্থিতঃ’১২ —জীবদের অনুগ্রহ করবেন বলে তিনি মানুষদেহ ধারণ করেন। ‘সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা।’১৩ সাধকদের কল্যাণার্থে ব্রহ্মের রূপকল্পনা। যিনি স্বয়ং ব্রহ্ম, যিনি সচ্চিদানন্দ তিনি নররূপে অবতীর্ণ হন। ঠাকুর বলছেন: ভক্তের ভালবাসার জন্য সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ চৌদ্দপোয়া হয়ে লীলা করতে আসেন। ভক্তেরা তাঁকে চান। ভক্তেরা একা একা খেলবেন কি করে, আর একজন যদি না থাকে? একা একা কি খেলা জমে? সেইজন্য ভক্তেরা ভগবানকে চান। ভগবান কখনও দেখা দেবেন, কখনও দেবেন না। এই লুকোচুরি খেলা, ভক্ত-ভগবানের লুকোচুরি খেলা। ভগবান লুকোচ্ছেন আর ভক্ত খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁকে। এই খুঁজে বেড়ানোর মধ্যে আনন্দ আছে। তাতে যদি কাঁদতে হয় তবুও আনন্দ। কারণ, কান্নার পরেই হাসি। এই খেলা হবে না যদি ভগবান না আসেন। কিন্তু ভগবান নিজেই এই খেলা ভালবাসেন, তিনি আসেন। এসে কি করেন? ‘ভজতে তাদৃশীঃ ক্রীড়া যা শুত্ব তৎপরো ভবেৎ।’১৪ তিনি এসে এমন সব লীলা করেন, যা শুনে, যা অনুসরণ করে মানুষ ভগবৎপরায়ণ হয়ে যায়। আমাদের প্রয়োজনেই তাঁর আবির্ভাব। বলছেন: ঈশ্বর সর্বস্থানে সর্বভূতে আছেন বটে, কিন্তু অবতার না হলে জীবের আকাঙ্ক্ষা পূরে না, প্রয়োজন মেটে না। (ঐ) প্রেম ভক্তি শিখাবার জন্য ঈশ্বর মানুষ দেহ ধারণ করে সময়ে সময়ে অবতীর্ণ হন। (১-১৪-২) অবতার আমাদের এইজন্য দরকার যে, তাঁকে দেখে আমরা শিখব। ‘শুদ্ধজ্ঞানস্য ভক্তেশ্চ প্রচারার্থমবাতরৎ।‘১৫— শুদ্ধ জ্ঞান ও ভক্তির প্রচারের জন্য তাঁর অবতরণ। অবতারকে দেখে আমরা শিখব জ্ঞান কি, শুদ্ধ ভক্তি কি। অবতার একটা আদর্শ দেখিয়ে যান, তাই দেখে আমরা শিখি। শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখে আমরা শিখব, কি করে ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল হতে হয়, কি করে ঈশ্বরের জন্য কাঁদতে হয়; ত্যাগ কাকে বলে, প্রেম কাকে বলে, সহিষ্ণুতা কাকে বলে, ঈশ্বরনির্ভরতা কাকে বলে, সরলতা কাকে বলে, নিরভিমানতা কাকে বলে। এইগুলিই ধর্মের মর্ম। পূজা, পার্বণ, ব্রত, নিয়ম, উপবাস ইত্যাদি ধর্মের সহায়ক বটে, কিন্তু ধর্মের মর্ম কি যদি কেউ জিজ্ঞেস করে তাহলে আমরা বলব—প্রেম, পবিত্রতা, জ্ঞান, সংযম, ক্ষমা, উদারতা, ত্যাগ এগুলি হচ্ছে ধর্মের মর্ম। যাঁর মধ্যে এগুলি আমরা সবচেয়ে বেশী দেখব, তাঁকেই বলব অবতার। কারণ: শক্তিরই অবতার। (ঐ) ঈশ্বর সর্বত্রই আছেন, কেবল তাঁর শক্তির প্রকাশ কোন জায়গায় কম, কোন জায়গায় বেশী। অগ্নিতত্ত্ব কাঠে বেশী। ঈশ্বরতত্ত্ব যদি খোঁজ, মানুষে খুঁজবে। মানুষে তিনি বেশী প্রকাশ হন। (ঐ) সূর্য সব জলেই কিরণ দিচ্ছে। কিন্তু যে জল স্থির, মলিনতা নেই, শেওলা নেই—পরিষ্কার ও শান্ত, সেই জলেই সূর্যের প্রতিবিম্ব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে পড়ে, সেই জলেই সূর্যের সবচেয়ে বেশী প্রকাশ। তেমনি যে আধারে দেখি সবচেয়ে বেশী অভিমানশূন্যতা, সবচেয়ে বেশী পবিত্রতা, সবচেয়ে বেশী ত্যাগ-প্রেম-ভক্তি সেই আধারেই বুঝব ঈশ্বরের সর্বোত্তম প্রকাশ, তাঁকেই বলব অবতার। যে মানুষে দেখবে উর্জিতাভক্তি—প্রেমভক্তি উথলে পড়ছে—ঈশ্বরের জন্য পাগল—তাঁর প্রেমে মাতোয়ারা—সেই মানুষে নিশ্চিত জেনো, তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন। (ঐ) ঠাকুর উপমা দিয়ে বলছেন: গরুর মধ্যে শিংটা যদি ছোঁয়, গরুকেই ছোঁয়া হলো; পা’টা বা লেজটা ছুঁলেও গরুটাকে ছোঁয়া হলো। কিন্তু আমাদের পক্ষে গরুর ভিতরের সার পদার্থ হচ্ছে দুধ। সেই দুধ বাঁট দিয়ে আসে। (ঐ) ঠাকুরের এই যে উপমা, এটা শাস্ত্রসম্মত। তন্ত্রে আছে এটা।
গবাং সর্বাঙ্গজং ক্ষীরং স্রবেৎ স্তনমুখাৎ যথা।
তথা সর্বগতো দেবঃ প্রতিমাদিষু রাজতে॥১৬
—গরুর সমস্ত শরীরেই দুধটা ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু সেটা বেরুচ্ছে গরুর শরীরের একটা বিশেষ জায়গা থেকে, বাঁট থেকে। তেমনি, ভগবান সর্বত্রই রয়েছেন, কিন্তু প্রতিমাতেই তাঁর বেশী প্রকাশ। অবতারও একটা প্রতিমা, শ্রেষ্ঠ প্রতিমা। প্রতিমা জাগ্রত হয় ভক্তের ভক্তির জোরে। কিন্তু অবতাররূপ যে প্রতিমা সেই প্রতিমা নিজে থেকেই জাগ্রত, ভক্তের প্রতি করুণায় সেই প্রতিমা নিজে থেকেই জাগ্রত। সেই প্রতিমা সচল, সেই প্রতিমা যেচে যায় ভক্তের দ্বারে। ঠাকুরের সম্বন্ধে বলা হচ্ছে: ‘ভক্তানুকম্পাধৃতবিগ্রহং বৈ’* —ভক্তের প্রতি অনুকম্পাবশত, কৃপাবশত তিনি দেহধারণ করেছেন। বাস্তবিক, যে কোন অবতার সম্বন্ধেই এই কথা খাটে। লোককল্যাণের জন্য তাঁদের আবির্ভাব—‘লোকন্সংগ্ৰহাৰ্থম্’। চৈতন্যচন্দ্রোদয়ে বলছে:১৭
বৈরাগ্যবিদ্যানিজভক্তিযোগশিক্ষার্থমেকঃ পুরুষঃ পুরাণঃ।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যশরীরধারী কৃপাম্বুধির্যস্তমহং প্রপদ্যে॥
—শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, তিনিই হচ্ছেন ‘পুরুষঃ পুরাণঃ’—আদি পুরুষ তিনি, তিনিই ব্রহ্ম। সেই সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যশরীর ধারণ করে অবতীর্ণ হয়েছেন, কৃপার সাগর রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। কেন তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন? যাতে তাঁর প্রতি ভক্তি হয় লোকের। তাঁর প্রতি যদি ভক্তি হয়, লোকের কল্যাণ হবে। সেইজন্য, মানুষকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার জন্য, তিনি নরদেহ ধারণ করে এসেছেন। আমরা দেখি, শ্রীরামকৃষ্ণ কাউকে কাউকে বলছেন; আমাকে দেখো, আমাকে মনে রেখো। শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী বলছেন: মনে রেখো, তোমাদের একজন মা আছেন। আত্মপ্রশংসা নয়, আত্মপ্রচার নয়। তাঁদের সবকিছুই তো পরার্থে। দয়া করে এঁরা আসেন, দয়া করে এঁরা প্রচার করেন। জানেন, তাঁদের দিকে যদি লোকের মন যায় তবে লোকের কল্যাণ হবে। ভালবেসে এঁরা এগুলি বলেন। ঠাকুর বলছেন; তাঁর অবতারকে দেখলেই তাঁকে দেখা হলো। (১-১৪-২) ‘মায়াশ্রিতো যঃ সগুণো মায়াতীতশ্চ নির্গুণঃ।’১৮ নির্গুণ, নিষ্ক্রিয় ব্রহ্ম—তিনিই মায়ার আশ্রয় নিয়ে সগুণ হয়েছেন, নিজের মায়াকে অবলম্বন করে অবতার হয়েছেন। অবতারকে দেখা মানেই ব্রহ্মদর্শন, বা ঈশ্বরদর্শন। কারণ, সেই ব্ৰহ্ম বা স্বয়ং ঈশ্বরই অবতাররূপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। বাইবেলে আছে, সকলেরই খুব পরিচিত কথা: He who has seen me has seen also the Father. যীশুখ্রীষ্টকে বলা হয় ঈশ্বরের সন্তান। যীশুখ্রষ্ট বলছেন:আমি ঈশ্বরপুত্র, আমাকে যে দেখেছে আমার পিতাকেও সে দেখেছে, অর্থাৎ ঈশ্বরকেও সে দেখেছে। ঠাকুরও সেইকথাই বলছেন যে, তাঁর অবতারকে যদি কেউ দেখে তাহলে তাঁকেই দেখা হল। উপমা দিয়ে বলছেন: যদি কেউ গঙ্গার কাছে গিয়ে গঙ্গা জল স্পর্শ করে, সে বলে—গঙ্গা দর্শন স্পর্শন করে এলুম। সব গঙ্গাটা হরিদ্বার থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত, হাত দিয়ে ছুঁতে হয় না।(ঐ) সমস্ত গঙ্গাটা আমি দেখতে পাচ্ছি না, ছুঁতে পাচ্ছি না—তা সম্ভবও না। কিন্তু আমার ঘাটে দাঁড়িয়ে আমি গঙ্গার কিছুটা অংশ দেখছি, গঙ্গার জল ব্যবহার করছি, আমার যা প্রয়োজন ঐ ঘাটে দাঁড়িয়েই মিটিয়ে নিচ্ছি—সমস্ত গঙ্গাটার আমার দরকার হচ্ছে না। ব্রহ্ম যেন ঐ গঙ্গা আর অবতার যেন আমার ঘরের কাছের ঘাট। ধর্মজগতে মানুষের যা কিছু প্রয়োজন, অবতারের মধ্যেই তা পাওয়া যায়। তোমার পা’টা যদি ছুঁই, তোমায় ছোঁয়াই হলো। যদি সাগরের কাছে গিয়ে একটু জল স্পর্শ করো, তাহলে সাগর স্পর্শ করাই হলো। (ঐ)
কতরকম উদাহরণ দিয়ে ঠাকুর অবতারতত্ত্ব বোঝাচ্ছেন। বলছেন: ধর, নায়েব, সে জমিদারীর এক জায়গায় একটা গোলমাল মিটিয়ে ফিরল। জমিদার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আর এক জায়গায় পাঠাবেন অন্য কোন কাজে। অন্য কর্মচারীদের ছুটি আছে, কিন্তু নায়েবের কোন ছুটি নেই। সাধারণ জীব, তারা আসছে যাচ্ছে, জন্মমৃত্যুর চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। তারাও একদিন না একদিন এই চক্রের বাইরে যেতে পারবে, মুক্ত হবে। কিন্তু অবতারপুরুষের মুক্তি নেই—যখনই পৃথিবীতে ধর্মের বিপর্যয় ঘটবে তখনই তাঁকে আসতে হবে। চিরকাল এরকম চলবে। ঠাকুর নিজের সম্বন্ধেও বলছেন: আমার মুক্তি নেই। বলছেন: আমি আবার আসব। বায়ুকোণে আমি আবার আসব। আবার আর একজায়গায় বলছেন; অবতার কিরকম জান? ধর, একটা বিরাট মাঠ আছে, মাঠটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। আর সেই দেয়ালে একটা গর্ত আছে। সেই গর্তে যদি তুমি চোখ রাখ, তাহলে দেখবে ওপাশে ধূধূ করছে বিরাট মাঠ। অবতারপুরুষ হচ্ছেন সেই গর্ত। তাঁর ভিতর দিয়ে আমরা অনন্তকে দেখতে পাচ্ছি। কতরকম উপমা দিচ্ছেন ঠাকুর। কিন্তু, বলছেন: তিনি অবতার হয়ে থাকেন, এটি উপমা দিয়ে বুঝান যায় না। অনুভব হওয়া চাই। প্রত্যক্ষ হওয়া চাই। উপমার দ্বারা কতকটা আভাস পাওয়া যায়। (ঐ) গীতাতে বলছেন শ্রীকৃষ্ণ:১৯
অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্॥
—আমি সর্বভূতের ঈশ্বরু হয়েও যে মানুষদেহ আশ্রয় করে আসি, মূঢ় ব্যক্তিরা এটা বিশ্বাস করতে পারে না। তাই তারা আমাকে অবজ্ঞা করে। বুঝতে পারে না যে, আমার পক্ষে সবই সম্ভব।
কতরকমভাবে তাঁকে জানা যায়? ঠাকুর বলছেন: বিচার করে এক রকম জানা যায়, তাঁকে ধ্যান করে এক রকম জানা যায়। (১-১৪-৮) বিচার করে অর্থাৎ শাস্ত্র বিচার করে। শাস্ত্রে অবতারের যেসব লক্ষণ দেওয়া আছে, বিচার করে দেখলাম একজনের মধ্যে সেই সব লক্ষণগুলো আছে। তখন আমি তাঁকে বললাম অবতার। এইভাবে অবতারকে চেনা যায়। আমরা যেমন দেখি, পণ্ডিতসভাতে বিচার হচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণকে নিয়ে, সেখানে পণ্ডিতরা রায় দিচ্ছেন: হ্যাঁ, ইনি অবতার। আবার ধ্যান করেও তাঁকে জানা যায় অর্থাৎ যোগের পথ দিয়ে জানা যায়। আবার তিনি যখন দেখিয়ে দেন—সে এক। তিনি যদি দেখিয়ে দেন—এর নাম অবতার—তিনি যদি তাঁর মানুষ লীলা দেখিয়ে দেন, তা হলে আর বিচার করতে হয় না, কারুকে বুঝিয়ে দিতে হয় না! (ঐ) অর্থাৎ যাকে আমরা বলি কৃপাসিদ্ধি। কৃপা করে তিনি নিজেই ধরা দিচ্ছেন। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন: যেমন অন্ধকারের ভিতর দেশলাই ঘসতে ঘসতে দপ্ করে আলো হয়। সেরকম দপ্ করে আলো যদি তিনি দেন, তা হলে সব সন্দেহ মিটে যায়। (ঐ) আমি দেশলাই ঘষছি অর্থাৎ সাধনভজন করছি তাঁকে জানার জন্য। কিন্তু তিনি নিজেই যদি দেশলাইটা জ্বেলে দেন তাহলে সব অন্ধকার দপ্ করে দূর হয়ে যায়। ঈশ্বর যদি তাঁর নরলীলা কৃপা করে বুঝিয়ে দেন তাহলে এক মুহূর্তে মনের সব সন্দেহ দূর হয়ে যায়।
‘কথামৃতে’ ঠাকুর বলেছেন কাকভূষণ্ডীর কথা। ইনি আসলে একজন ব্রাহ্মণ, লোমশমুনির শাপে কাক হয়েছিলেন। কাকভূষণ্ডী প্রথমে রামকে অবতার বলে মানেননি। চন্দ্রলোক, দেবলোক, কৈলাস সর্বত্র তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন— কিন্তু দেখলেন যে রামের হাত থেকে তাঁর নিস্তার নেই। রাম শেষ পর্যন্ত তাঁকে ধরে গিলে ফেললেন। তিনি তখন দেখলেন যে, তাঁর গাছের উপর তিনি বসে আছেন। অর্থাৎ রামচন্দ্রের মধ্যেই সব। রামচন্দ্রকে দেখতে সাধারণ মানুষের মতো হলেও তাঁর মধ্যেই ব্রহ্মাণ্ড। তখন কাকভূষণ্ডী রামচন্দ্রকে বুঝতে পারলেন। আবার দেখি, ভরদ্বাজ প্রভৃতি, বারোজন ঋষি রামচন্দ্রকে অবতার বলে চিনতে পেরেছেন, তাঁরা স্তবস্তুতি করছেন: তুমিই সচ্চিদানন্দ, তোমার মায়া আশ্রয় করে এই রূপে এসেছ। কিন্তু অন্যান্য যেসব ঋষি তাঁরা কেউ তাঁকে চিনতে পারছেন না। বলছেন: রামচন্দ্র দশরথের ব্যাটা। বাস্তবিক, অবতারকে চেনা খুব কঠিন। তিনি নিজে বুঝিয়ে না দিলে আমরা সাধারণত বুঝতে পারি না।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে আমরা দেখি, কত লোক তাঁর কাছে আসছেন। কেউ বলছেন: তিনি একজন পূজারী ব্রাহ্মণ, তবে ভাল মানুষ। আর একদল বলছেন: বেশ ভাল ভক্ত, ভাল সাধক। আবার কেউ কেউ বলছেন: সিদ্ধপুরুষ। এই পর্যন্ত তাঁরা স্বীকার করছেন। কিন্তু অবতার বলে তাঁকে চিনতে পারছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক। আজ আমাদের দেশের অনেক মানুষ লোকের কথা শুনে হোক বা বিচার করেই হোক, বই পড়ে হোক বা যে ভাবেই হোক—তাঁকে অবতার বলে স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু অবাক হয়ে যেতে হয় যখন দেখি বিদেশী মনীষীরাও তাঁকে অবতার বলছেন, তাঁর প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করছেন; রোমাঁ রোলাঁ, খ্রীষ্টোফার ইশারউড, আর্নল্ড টয়েনবী—এঁদের মতো জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরাও কত শ্রদ্ধার সাথে তাঁর কথা বলছেন। কয়েক বছর আগে ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল জার্মান ভাষায় লেখা একটি বইয়ের কথা।* তার যিনি লেখক, তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন, অনেক জায়গায় ঘুরেছেন, অনেক সাধুসন্ত দেখেছেন আর অনেক বই পড়েছেন। একেবারে রাজা রামমোহন থেকে আরম্ভ করে গান্ধীজী পর্যন্ত সকলের চরিত্র বিশ্লেষণ করে তিনি বলছেন: সত্যি সত্যি এঁদের মধ্যে কারও সম্বন্ধে যদি আমরা বলতে পারি যে, ইনি ভারতের আত্মাকে সবচেয়ে বেশী সকলের সামনে তুলে ধরেছেন, তাহলে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি সবাইকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, কাউকে অবজ্ঞা করছেন না, কিন্তু তিনি বলছেন: এঁরা পাশ্চাত্যভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। এমন কি স্বামীজীকে পর্যন্ত তিনি বাদ দিচ্ছেন। শুধু শ্রীরামকৃষ্ণকে নিচ্ছেন—তাঁর মধ্যেই ভারতের আত্মার সবচেয়ে বেশী প্রকাশ। বাস্তবিক, সেই জন্যই তো তিনি অবতার। ধর্মই তো ভারতের আত্মা। সেই ধর্মের প্রকাশ যাঁর মধ্যে সবচেয়ে বেশী, যিনি মূর্তিমান ধর্ম, তিনিই তো অবতার। আজ দেখছি দিকে দিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ছে। কত লোক যে তাঁকে ডাকছে, ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো নিবেদন করছে তার খবরও আমরা জানি না। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের দেহ-থাকাকালীন তো চিত্রটা এরকম ছিল না। অথচ দেখছি, তখনই ভাগ্যবান কেউ কেউ তাঁকে অবতার বলে চিনছেন। প্রথম চিনছেন: কামারপুকুরের চিনু শাঁখারী। শ্রীরামকৃষ্ণ বালক। চিনু শাঁখারী বৃদ্ধ। অথচ দুজনে যেন বন্ধু। ভগবানের কী অদ্ভুত লীলা! এই জন্যই বলছে: মর্ত্যলীলা মনোহরা। সেই চিনু শাঁখারী একদিন ঠাকুরকে পুজো করছেন, বলছেন: প্রভু, আমি জানি তুমি কে। তুমি কত লীলা করবে, কিন্তু আমার সময় নেই, আমি তা দেখতে পাব না। তবে এটা মনে রেখ ঠাকুর, এই চিনু শাঁখারীই প্রথমে তোমাকে চিনেছে। আবার দেখছি, ভৈরবী ব্রাহ্মণী তাঁকে চিনছেন। চিনেছিলেন গিরিশ ঘোষ আর রামচন্দ্র দত্তও। গিরিশ ঘোষ কবি, নাট্যকার, অভিনেতা। আর রামচন্দ্র ছিলেন ডাক্তার। এঁরা দুজন আবার নিজেরা বুঝেই চুপ করে থাকতেন না। তাল ঠুকে সকলের কাছে বলে বেড়াতেন—শ্রীরামকৃষ্ণ অবতার। শ্রীরামকৃষ্ণ মজা করতেন এই নিয়ে: আমাকে অবতার বলে দুজন—একজন থিয়েটার করে; আর একজন—মড়া-কাটা ডাক্তার। এঁরা জোর গলায় প্রচার করে চলেছেন, নির্ভয়ে। শ্রীরামকৃষ্ণ মাঝে মাঝে সতর্ক করে দিচ্ছেন, মাঝে মাঝে ছলনা করছেন: অবতার হলে আবার ক্যানসার হয়? আবার মনে মনে খুশি হচ্ছেন যে, এরা আমাকে চিনতে পেরেছে। অনেক সময় ধরা দিতেও চাচ্ছেন, আকারে ইঙ্গিতে বলছেন। কিন্তু সবাই নিতে পারছেন না, ধরতে পারছেন না। মাঝে মাঝে তিনি ইচ্ছে করেই এই অবতারপ্রসঙ্গ তুলছেন, ভক্তদের মধ্যে তর্ক বাধিয়ে দিচ্ছেন। উদ্দেশ্য, সবাই জানুক তাঁকে। তাঁর দিন ফুরিয়ে আসছে। যাওয়ার আগে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে যাবেন, তার প্রস্তুতি চলছে। তার আগে যদি কোন ভাগ্যবান ভক্ত তাঁকে চিনে ফেলে জেনে ফেলে! তাঁকে জানা-চেনা বলতে কি বোঝায়? তাঁর বাড়ি কামারপুকুরে ছিল, নাম ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায়, এখন তাঁকে রামকৃষ্ণ পরমহংস বলা হয়—এই বোঝায়? তা নয়। তাঁকে জানা মানে, তিনি যে আদর্শ দেখিয়ে গেছেন তাকে জানা। তাঁকে জানা মানে এই জানা যে, ধর্মের মূল তাৎপর্য হচ্ছে ত্যাগ, প্রেম, পবিত্রতা, জ্ঞান, ভক্তি। এগুলিই শ্রীরামকৃষ্ণ প্রচার করেছেন, আর কিছু নয়। তিনি যে একটা নতুন দর্শন সৃষ্টি করেছেন, নতুন একটা তত্ত্ব সৃষ্টি করেছেন, নতুন একটা পথ দেখিয়ে গেছেন, তা নয়। চিরাচরিত যে পথ, যে পথ আবহমানকাল ধরে ভক্ত ভগবানের জন্য ব্যবহার করে আসছে, সেই পথ শ্রীরামকৃষ্ণ দেখিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। আর যা তিনি বলছেন, নিজের জীবনে আচরণ করে বলছেন। তাতেই লোকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
আমরা দেখতে পাই, প্রথম যখন ব্রাহ্ম পত্রিকায় শ্রীরামকৃষ্ণের কথা প্রকাশিত হল, লোকে চমকে উঠেছিল। সেটা লিখেছিলেন কেশবচন্দ্র সেন। লিখছেন; আমরা অদ্ভুত এক সাধুব্যক্তির সাক্ষাৎ লাভ করেছি। একটা বিরাট আবিষ্কার হল যেন। আচ্ছা, এই যুগেও আমাদের মধ্যে এরকম ব্যক্তি থাকতে পারে? যখন সমস্ত মানবজাতি ছুটছে অর্থের পিছনে ভোগের পিছনে নামের পিছনে, শক্তি বা ক্ষমতার পিছনে, এমন একজন মানুষ কি থাকতে পারে যে এগুলি তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে? সকলে উচ্চকিত হয়ে কান খাড়া করে শুনলেন। এরকম একজন ব্যক্তি আছেন সত্যি সত্যি? এ কি সম্ভব? কে সেই ব্যক্তি? কোথায় সেই ব্যক্তি? সেই প্রথম শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি পড়ল তাঁর দিকে। তারপর ধীরে ধীরে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেকে প্রকাশ করলেন, ধরা দিলেন। যেচে যাচ্ছেন। যেখানে দেখছেন ভাল আধার সেখানে যেচে যাচ্ছেন, ধর্মোপদেশ দিচ্ছেন, এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাকে। যার মধ্যে দেখছেন এতটুকু অপূর্ণতা সেই অপূর্ণতা দূর করে দিচ্ছেন। কাউকে আঘাত করছেন না, কারও ভাব নষ্ট করছেন না, তার যেটুকু অভাব সেটুকু পূর্ণ করে দিচ্ছেন শুধু। শ্রীরামকৃষ্ণ যেন প্রজাপতি, ফুলে ফুলে গিয়ে বসছেন আর ফুল পাপড়ি মেলে দিচ্ছে, সাধকের হৃদয়কুসুম প্রস্ফুটিত হয়ে যাচ্ছে। এই জন্যই তো তাঁদের আসা। লোককল্যাণের জন্যই তো তাঁদের শরীরধারণ। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই বলছেন: কেউ একলা খেয়ে মুখ মুছে ফেলে, আবার কেউ চিৎকার করে সবাইকে ডাকে, একসাথে ভাগ করে খায়। কেউ ছোট কাঠের টুকরো—একা কোনরকমে ভেসে যেতে পারে। কেউ আবার বাহাদুরি কাঠ—নিজে ভেসে যায়, অন্য অনেককেও সঙ্গে নিয়ে যায়। ঠাকুর তো সেই রকম ব্যক্তি, যিনি সকলের সঙ্গে মফিলেমিশে খান, যিনি নিজে ভেসে যান, আবার অন্যকেও নিয়ে যান সঙ্গে, যিনি সেই ‘চার নম্বর বন্ধু’। চার বন্ধু পাঁচিলের ওপার থেকে খুব হৈ-চৈ আওয়াজ আসছে শুনতে পেল। প্রথম তিন বন্ধু পাঁচিলে উঠে ওপারটা দেখেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফিয়ে পড়ল—ফিরে এল না। আর চতুর্থ বন্ধু, সে পাঁচিলে উঠল, সেই আনন্দ দেখল, আস্বাদ করল, আবার ফিরে এল—অন্যকে সেই আনন্দের খবর দেবে বলে। ঠাকুর তো এই চতুর্থ বন্ধু। মুহুর্মুহুঃ সমাধিস্থ হচ্ছেন, আবার নেমে আসছেন। হিমালয়ের সর্বোচ্চ শিখরে উঠে যাচ্ছেন, আবার নেমে আসছেন। যে আনন্দ পেয়েছেন, তা একা ভোগ করবেন না, সবাইকে দিয়ে, সবার সঙ্গে তা ভোগ করবেন। এই জন্যই তো তাঁদের আবির্ভাব। অবতারপুরুষ আসেন তো এইজন্যই। করুণায় বিগলিত হয়ে তাঁরা দেহধারণ করেন। অহৈতুকী করুণা—সেই করুণার কোন হেতু নেই। অকারণ করুণার বশে তাঁরা শরীরধারণ করেন।
তাঁর জীবনে আমরা দেখি, কী অদ্ভুত সাধনা করে তিনি ঈশ্বরলাভ করলেন। তারপরেও তিনি কাঁদছেন। মায়ের জন্য কেঁদেছেন, ঈশ্বরের জন্য কেঁদেছেন—সেই কান্নার কোন তুলনা নেই বোধহয়। ঈশ্বরলাভ করেও কাঁদছেন আবার, ভক্তদের জন্য কাঁদছেন—ওরে তোরা কে কোথায় আছিস আয়! নিজেকে যেন সামলে রাখতে পারছেন না। এ যেন সেই উপনিষদের আহ্বান–‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূঃ।’২০ দারুণ একটা অস্থিরতা তাঁর মধ্যে। একটা অমৃতভাণ্ড তিনি পেয়েছেন। সেই অমৃত তিনি সকলের মধ্যে বিতরণ করতে চান। দেখছেন: মানুষ অজ্ঞান, উদাসীন। তিনি যা পেয়েছেন, তা না পেয়ে মানুষ নিশ্চিন্ত। তিনি তা দেওয়ার জন্য ব্যাকুল, অথচ মানুষ উদাসীন। তাই তিনি ডাকছেন: ওরে তোরা কে কোথায় আছিস আয়। গানে বলছে: ‘দু বাহু তুলিয়ে ডাকে, আয়রে তোরা আয় চলে।’ আমরা বুদ্ধদেবকে দেখেছি, তিনি পদব্রজে ঘুরছেন, ধর্মচক্র স্থাপন করছেন, সর্বত্র প্রেম-মৈত্রী-করুণার বাণী প্রচার করছেন। চৈতন্যদেবকেও দেখছি, নিত্যানন্দকেও দেখছি, বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, হরিনাম বিলোচ্ছেন। শিষ্যদের ভিক্ষেয় পাঠাচ্ছেন। কি ভিক্ষে? বলছেন: লোকের দ্বারে দ্বারে যাবে আর বলবে ‘কৃষ্ণ ভজ’। আর কোন ভিক্ষে চাই না, তোমার মন তুমি কৃষ্ণে দাও—শুধু এই ভিক্ষে। অপমানিত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন, জীবন বিপন্ন হচ্ছে—তবু তাঁরা যাচ্ছেন। পায়ে ধরে বলছেন: তোমরা একবার হরি বল। মাধাইকে বলছেন: ‘মেরেছিস কলসির কানা তাই বলে কি প্রেম দেবো না’। শ্রীরামকৃষ্ণকেও তাই দেখি। তাঁর যেন আর বিশ্রাম নেই। সারাদিন কত লোক আসছে তাঁর কাছে। তাদের সাথে ধর্মপ্রসঙ্গ করে যাচ্ছেন—কোন ক্লান্তি নেই, একটুও বিরক্তি নেই। যেখানে দেখছেন ভাল আধার, নিজেই সেখানে ছুটে যাচ্ছেন, সেখানে গিয়ে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করছেন, ‘দীন, ধনী, মানী, জ্ঞানী বিচার নাই জাতি কুলে’। আবার কত দুঃখ তাঁর, শরীর অশক্ত, গাড়ি ছাড়া চলতে পারেন না— বলছেন: নিতাই আমার দ্বারে দ্বারে গিয়ে প্রেম বিলিয়েছিল, আমি তা পারছি না। আমি গাড়ি ছাড়া চলতে পারি না। বড় বড় ধর্মনেতাদের কাছে যাচ্ছেন, সেই সময়কার যাঁরা গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁদের কাছে যাচ্ছেন। কে তিনি? প্রায় নিরক্ষর এক পূজারী ব্রাহ্মণ, তথাকথিত সভ্যতা-ভব্যতার ধার ধারেন না। পরনের কাপড়ও তো ঠিক থাকে না তাঁর। অথচ সর্বত্র দেখছি, তিনি মধ্যমণি, তিনি প্রবক্তা। বক্তা অনেক হতে পারেন, কিন্তু প্রবক্তা হন দু-চারজন—ঈশ্বর যাঁদের মধ্য দিয়ে কথা বলেন। আমরা যাঁদের বলি Messenger। শ্রীরামকৃষ্ণ সেইরকম ব্যক্তি। ইংরেজি- শিক্ষিত গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাঁর কথা শুনছেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন। রোজার কাছে সাপ যেভাবে চুপ করে থাকে। আমরা দেখছি, কেশব সেন তাঁর কথা শুনছেন, বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর কথা শুনছেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কথা শুনছেন, আবার শিবনাথ শাস্ত্রী, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, প্রতাপচন্দ্র মজুমদারও শুনছেন। প্রতাপচন্দ্র মজুমদার একটা প্রবন্ধে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করছেন: কে শ্রীরামকৃষ্ণ আর কে আমি? আমাদের দুজনের মিল কোথায়? মিল তো কিছু নেই। আমি ইংরেজি-শিক্ষিত, ধর্মমতে আমি ব্রাহ্ম—আর শ্রীরামকৃষ্ণ নিরক্ষর, পৌত্তলিক, কালীর উপাসক। আমি পৃথিবীর যত বড় বড় বক্তা, ডিসরেলি ফসেট প্রভৃতি সকলের বক্তৃতা শুনেছি। অথচ তবুও আমি এঁর কাছে ঘন্টার পর ঘণ্টা কেন বসে থাকি? কিসের আকর্ষণে এঁর কাছে বারবার ছুটে আসি? আবার দেখছি মহেন্দ্রলাল সরকারকে। চিকিৎসক হিসেবে এসেছিলেন। প্রথমে নিশ্চয়ই, অশ্রদ্ধাভরে না হলেও শ্রদ্ধাভরে আসেননি। কিন্তু যা আমরা সাধারণত শুনে থাকি, ‘…who came to scoff remained to pray.’* (যারা এসেছিল বিদ্রূপ করতে তারা রয়ে গেল প্রার্থনা জানাবার জন্য), এও যেন অনেকটা তাই। ডাক্তার সরকার বিদ্রূপ করতে আসেননি ঠিকই, তবে প্রথম যখন এসেছিলেন, তখন চিকিৎসক হিসেবে একজন রোগীর প্রতি যে মনোভাব তার অতিরিক্ত কিছু তাঁর মধ্যে ছিল না। অথচ সেই ডাক্তার সরকারকেই দেখছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাকুরের কাছে বসে আছেন, নিজের প্র্যাকটিসের কথা ভুলে যাচ্ছেন। বলছেন: আর ডাক্তারী! পরমহংসের পাল্লায় পড়ে সব গেল। অথচ ডাক্তার সরকার মোটেই সহজ ধাতের লোক নন। অত্যন্ত কঠোর, অত্যন্ত একগুঁয়ে, যা ভাল বোঝেন তাই করেন, মুখের উপরে কোন একটা কথা বলে দিতে তাঁর আটকায় না। তার উপরে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, হিন্দুধর্মের যেসব সনাতন বিশ্বাস তার অনেকগুলিই তাঁর কাছে কুসংস্কার ছাড়া কিছুই না। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর তফাৎ অনেক। অথচ সেই ডাক্তার শ্রীরামকৃষ্ণের ভালবাসায় পড়ে গেছেন। কথা বললে ঠাকুরের কষ্ট হয়, তাই ডাক্তার হিসেবে তিনি তাঁকে কথা বলতে বারণ করছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও আবার বলছেন: তবে আমি যখন আসব আমার সঙ্গে কথা বোলো। শুধু আমার সঙ্গে বলবে—আর কারও সঙ্গে না। এত ভাল লাগছে তাঁর ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলতে। শেষ রাতে উঠে ঠাকুরের কথা ভাবছেন: ভাল আছেন তো তিনি? গলার কষ্ট বাড়েনি তো? ঠাকুর বলছেন; ইংরাজী প’ড়েছে, ওকে বলবার যো নাই আমাকে চিন্তা কর; তা আপনিই ক’রছে। (১-১৬-২) এই ঈশ্বরের কৃপা। কত ছলে তিনি ভক্তকে কৃপা করেন। একটা শ্লোকে বলছে: ঈশ্বরের যত রকম লীলা আছে তার মধ্যে মর্ত্যলীলাই সব থেকে মনোহর।** এইজন্যই তো মনোহর। ঈশ্বর যিনি ভবব্যাধি দূর করেন, তিনি ভক্তের কাছে হাজির অসহায়রূপে। ভক্ত চিকিৎসক, ভগবান তার উপর নির্ভর করছেন। ভক্ত ভাবছে; তাকে ছাড়া ভগবানের চলবে না। এইজন্যই তো মর্ত্যলীলা মনোহরা। আবার দেখছি, সমাজের শীর্ষস্থানীয় লোকদের কাছে ঠাকুর যাচ্ছেন, অথচ তাঁর মধ্যে কোন সঙ্কোচ নেই, দ্বিধা নেই। মাঝে মাঝে একটু ভয় অবশ্য পেতেন, শিশু যেমন অপরিচিত কাউকে দেখলে প্রথম প্রথম একটু ভয় পায়। কিন্তু যখন তিনি কথা বলছেন, তখন কত সাবলীল, কত স্বচ্ছন্দ। সমানে-সমানে কথা হচ্ছে যেন। আর কী অপূর্ব তাঁর বাক্যবিন্যাস! বিদ্যাসাগরের সাথে তাঁর সেই সাক্ষাৎকার মনে করা যাক। দেখামাত্রই বলছেন: আজ সাগরে এসে মিললাম। এতদিন খাল, বিল, হ্রদ, নদী দেখেছি—এইবার সাগর দেখছি। বিদ্যাসাগর বলছেন: তবে নোনাজল খানিকটা নিয়ে যান। কেননা, সাগরে তো নোনাজলই পাওয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ একটুও চিন্তা না করে বলছেন: না গো! নোনাজল কেন? তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও, তুমি যে বিদ্যার সাগর। তুমি ক্ষীরসমুদ্র। এই সাগরের জল নোনা হয় না।—কী অদ্ভুত কথোপকথন, সাহিত্যরস-সমৃদ্ধ। সমাজের উচ্চস্তরে বিচরণ করছেন, আবার দেখছি তিনি রসিক মেথরকে কৃপা করছেন। তাঁর কাছে তো জাতিকুলের ভেদ নেই। একটিমাত্র জাত তিনি মানেন।—ভক্ত। যদি ভক্ত হও তাহলেই তুমি কুলীন, তার কাছে তিনি ছুটে যাচ্ছেন। থিয়েটারে যাচ্ছেন। থিয়েটারের যারা অভিনেতা-অভিনেত্রী তাদেরকে কৃপা করছেন। গিরিশ ঘোষকে কৃপা করছেন, বিনোদিনীকে কৃপা করছেন। বিনোদিনীর কথা সকলেই জানেন, ‘চৈতন্যলীলা’য় তাঁর অভিনয় দেখে ঠাকুর বলেছিলেন, আসল-নকল এক দেখলাম। ঠাকুরের শেষ অসুখের সময় বিনোদিনী একবার ঠাকুরকে দেখতে গিয়েছিলেন। ঠাকুরের কাছে যাওয়া তখন কঠিন ব্যাপার। সারাক্ষণ যুবক ভক্তেরা দরজা আগলে বসে আছেন। যেমন তাঁদের চেহারা, তেমনি কর্তব্যে কঠোর। তার উপর তখনকার দিনে যেসব নারী থিয়েটার করতেন, সমাজে তাঁদের খুব হেয় করে দেখা হত। কাজেই, বিনোদিনী সাহেব সেজে ঠাকুরের কাছে গেলেন। সবাই ভেবেছেন সত্যিই বুঝি সাহেব, ঠাকুরের ঘরে ঢুকতে দিয়েছেন। আমরা দেখছি, ঠাকুর তাঁকে সাদরে গ্রহণ করছেন। কত কথা বলছেন তাঁর সঙ্গে, কতরকম উপদেশ দিচ্ছেন, কত রকমে আশীর্বাদ করছেন তাঁকে। শ্রীশ্রীমা বলছেন; এইজন্যই তো ঠাকুর এসেছিলেন। ঠাকুর কি শুধু রসগোল্লা খেতে এসেছিলেন? পতিত, দুর্বল, অক্ষম—এদের উদ্ধার করবার জন্যই তো তিনি। গলায় ক্যান্সার, কথা সরে না, কথা বললে কষ্ট হয়। তবুও তিনি কথা বলে যাচ্ছেন। ধর্মপ্রসঙ্গ করছেন। জানেন, তাঁর মর্ত্যলীলা শেষ হয়ে আসছে, হাতে সময় নেই। এইটুকু সময়ের মধ্যে যা পারি দিয়ে যাই। অবতারপুরুষ সম্বন্ধে বলা হয় ‘ভূরিদা’। ভূরি মানে প্রচুর। প্রচুর যিনি দেন, তিনিই ভূরিদা। শ্রীরামকৃষ্ণ ভূরিদা। কি তিনি দিচ্ছেন? প্রচুর টাকা-পয়সা দিচ্ছেন? তা তো নয়। এমন জিনিস দিচ্ছেন, যা পেলে মানুষের আর কিছু পাওয়ার থাকে না—‘যং লব্ধ্বচাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ’।২১ সেই ঈশ্বরভক্তি, ভালবাসা তিনি দিচ্ছেন, অকাতরে বিতরণ করছেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মানুষের যাতে আত্যন্তিক-দুঃখ-নিবৃত্তি হয়, সেই পথ বলে দিচ্ছেন। কোন বিরাম নেই তাতে, কোন বাছবিচার নেই। যে আগ্রহী তাকেই দিচ্ছেন। আবার কেউ হয়তো আগ্রহী নয়, অথচ তিনি বুঝতে পারছেন তার যোগ্যতা আছে—তাকেও গিয়ে দিচ্ছেন, যেচে দিচ্ছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সেই শেষ অবস্থায় একজন মহিলা এসেছে, উন্মাদিনী। প্রায়ই আসত সে ধর্মপ্রসঙ্গ করতে। অন্যেরা বিরক্ত হতেন, ঠাকুরেরও শরীরে কষ্ট হত। যুবক ভক্তদের তাই খুব আপত্তি, যাতে সে না আসে। কিন্তু ঠাকুর বলছেন: না, আসুক সে। এই কৃপা। অহেতুক কৃপাসিন্ধু তিনি। স্বামীজী বলছেন: ‘চির-উন্মদ-প্রেম-পাথার।’ প্রেমসমুদ্র শ্রীরামকৃষ্ণ, চিরকাল সেই সমুদ্র উত্তাল—ভক্তের জন্য, মানুষের জন্য। বলছেন: শ্রীরামকৃষ্ণ কি? ঘনীভূত ভালবাসা—L-O-V-E।
তাঁর সম্বন্ধে একটা গান আছে: ‘এসেছে নূতন মানুষ দেখবি যদি আয় চলে।’ সত্যিই তো নতুন মানুষ। এইযুগে এরকম মানুষ আমরা কল্পনা করতে পারি? যখন সমস্ত মানুষ ইংরেজি-শিক্ষার পিছনে ছুটছে তখন সেই শিক্ষাকে তিনি বর্জন করছেন, বলছেন: চালকলাবাঁধা বিদ্যা। পুস্তকী বিদ্যাকে গোড়া থেকে অগ্রাহ্য করছেন— বলছেন; পাস না ফাঁস, গ্রন্থ না গ্রন্থি। জগৎসুদ্ধ লোক অর্থের পিছনে ছুটছে। আর তাঁকে কি দেখি? টাকা ছুঁতে পারেন না। হাত বেঁকে যায়, যন্ত্রণা হয়। স্বামীজী পরীক্ষা করেছিলেন। বিছানার নীচে একটা মুদ্রা রেখে দিয়েছিলেন। ঠাকুর সেই বিছানায় বসতে পারছেন না। বারবার চেষ্টা করছেন—পারছেন না। সমস্ত জগৎ ভোগের পিছনে ছুটছে আর শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনি খাওয়ার পরে ভুল করে একটু মশলা নিয়ে ফেলেছেন। শ্রীশ্রীমা-ই তাঁকে দিয়েছিলেন। যতটুকু মশলা তিনি খান ততটুকু খেয়েছেন, আর একটু মশলা হাতে দিয়ে মা বলেছেন: এইটুকু নিয়ে যাও। ঐটুকু সঞ্চয়, তাও তিনি করতে পারছেন না। নহবত* থেকে তাঁর ঘর কতটুকুই বা পথ, ঐ পথটুকুও তিনি ঠিকমতো চিনতে পারছেন না, ভুল করে গঙ্গার দিকে চলে গেছেন—ঐটুকু সঞ্চয় হয়ে গেছে বলে। একেই বলে ‘nervous association’। এমন অবস্থা যে, ভুলেও তিনি বেচালে পা দিতে পারছেন না। ধর্মের ইতিহাসে আর কারও জীবনে এরকম ঘটেছে বলে আমরা জানি না। পতিতা রমণীকে দেখছেন, তাকে প্রণাম করছেন: মা, তুমি মন্দিরে একরূপে এখানে আর একরূপে। অদ্ভুত! সব নারীই তাঁর চোখে মা! নতুন মানুষ তিনি। শুধু কি তিনিই নতুন, তাঁর সঙ্গে যাঁরা এসেছেন তাঁরাও তো নতুন। ঠাকুর অলৌকিক, তাঁর সাথে যাঁরা এসেছেন, লীলাসহচর—ঠাকুর যাঁদের বলছেন ‘কলমীর দল’—তাঁরাও অলৌকিক। সাধারণ মাপকাঠিতে এঁদের ফেলা যায় না।
বঙ্গরঙ্গমঞ্চের যে বিকাশ তাতে ঠাকুরের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। আমরা দেখছি, গিরিশের মধ্য দিয়ে ঠাকুর বঙ্গরঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন। থিয়েটারে যাচ্ছেন, গিরিশকে উৎসাহ দিচ্ছেন থিয়েটার করতে। বলছেন: লোকশিক্ষা হয় ওতে। থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাথে কথা বলছেন, তাঁদের আশীর্বাদ করছেন। সেইসময়ে সুরুচিসম্পন্ন লোকেরা থিয়েটারে যেত না। থিয়েটারের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদেরকে সমাজে খুব হেয় করে দেখা হত। অনেকেই সেই গল্প হয়তো শুনে থাকবেন—অধ্যক্ষ হেরম্ব মৈত্র রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, একজন ছাত্র জিজ্ঞেস করছেন তাঁকে: স্টার থিয়েটারটা কোথায় বলতে পারেন? উনি উত্তর দিচ্ছেন: জানি, কিন্তু বলব না। স্বামীজী পর্যন্ত বলছেন: যুবক অবস্থায় ফুটপাতের যে ধারটায় থিয়েটার সেদিকটাই মাড়াতাম না—অন্য দিক দিয়ে যেতাম। এরকম যখন লোকের মনোভাব, তখন শ্রীরামকৃষ্ণের মতো দেবকল্প পুরুষ—যাচ্ছেন থিয়েটার দেখতে। বলছেন: লোকশিক্ষা হয় এতে। সমস্ত বঙ্গরঙ্গমঞ্চের ধারাটা এর ফলে পাল্টে গেল। শ্রীশ্রীমা বলছেন; ঠাকুর হাঁচি-টিকটিকি পর্যন্ত মেনেছেন। অবতারপুরুষ তো কোন কিছু ভাঙতে আসেন না, পূর্ণ করতে আসেন। যেখানে যতটুকু অপূর্ণতা থাকে সব তাঁরা পূর্ণ করে দেন। তাঁরা ইতিবাচক কতগুলো কাজ করেন, এমনভাবে করেন যে, যা বর্জনীয় আপনা-আপনিই তা দূর হয়ে যায়। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম, থিয়েটারের বিজ্ঞাপনের উপরে লেখা থাকত: শ্রীরামকৃষ্ণঃ শরণম্। তখন বুঝতে পারতাম না, থিয়েটারের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের নাম জড়ায় কি করে। এখন বুঝতে পারি, বঙ্গরঙ্গমঞ্চের ইতিহাসের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা স্বীকারও করেন যে, বাংলার রঙ্গমঞ্চকে সমাজে তোলা শ্রীরামকৃষ্ণেরই অবদান।
শুধু বাংলা বঙ্গমঞ্চ কেন, যদি খুঁটিয়ে দেখা যায় তবে দেখা যাবে, শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবের পর থেকে বাংলা, ভারত, সমস্ত পৃথিবীর চেহারা পালটে যাচ্ছে। বস্তুত, তাঁর আবির্ভাবের ঐতিহাসিক তাৎপর্য এখনও আমরা বুঝতে পারিনি। যতই দিন যাবে দেখব, তাঁর প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি কথা, প্রতিটি উপলব্ধির কত গভীর অর্থ। তিনি যখন এলেন, ভারতবাসী এক বিরাট সঙ্কটের মুখোমুখি। ইংরেজ শাসন এদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা পুরনো আদর্শকে বর্জন করেছি, পশ্চিমী সভ্যতার অনুকরণ করছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব। যা প্রাচীন, যা সনাতন তার প্রতীক তিনি। কলকাতার উপকণ্ঠে উপস্থিত। আপাতদৃষ্টিতে একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষ। অথচ অদ্ভুত তাঁর আকর্ষণী শক্তি। সেই সময়কার ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরা তাঁর কাছে আসছেন। তিনি তাঁদের সাথে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলছেন। আর ধীরে ধীরে সেইসব ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের পাশ্চাত্যের প্রতি মোহ কেটে যাচ্ছে। ভারতবর্ষকে শ্রদ্ধা করতে শিখছেন তাঁরা। কারণ, শাশ্বত ভারতবর্ষকে তাঁর মধ্যে দেখছেন। ত্যাগ-প্রেম-পবিত্রতা-ঈশ্বরানুরাগ, স্বার্থশূন্যতা, অহংশূন্যতার ঘনীভূত মূর্তি। তাঁকে দেখে তাঁরা চিনছেন ভারতবর্ষকে, ভারতবর্ষকে ভালবাসতে শিখছেন। তিনি নিজেকে প্রচার করছেন না। বারবার বলছেন: আমি গুরু নই, কিছু নই। ভারতবর্ষের যুগ-যুগ ব্যাপী সঞ্চিত যে জ্ঞান, তাই তিনি পরিবেশন করছেন। পরিবেশন করছেন অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে, নিজের উপলব্ধির ভিত্তিতে। আর তার মাধ্যমে তিনি যেন এক নতুন সভ্যতার বীজ বপন করে দিচ্ছেন। কারণ, যে চিন্তাকে তিনি তুলে ধরছেন তা আপাতদৃষ্টিতে ভারতীয়, কিন্তু আসলে তা সমস্ত গণ্ডির ঊর্ধ্বে। শ্রীরামকৃষ্ণের চিন্তা সমস্ত মানবজাতির জন্য। কোন নির্দিষ্ট দেশের কোন নির্দিষ্ট ধর্মের জন্য নয়। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সবার তাতে অধিকার। আজ পৃথিবীর যে চেহারা, সেখানে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের বিশেষ ব্যবধান নেই। পৃথিবীর এক প্রান্তে নতুন কোন চিন্তা দেখা দিলে মুহূর্তের মধ্যে তা আর এক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, দর্শন এখন কোনও ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ থাকে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার কল্যাণে যে সভ্যতা রূপ নিচ্ছে, তাকে আমরা আর প্রাচ্য বা প্রতীচ্য বলে আগের মতো চিহ্নিত করতে পারি না। আমরা আজ পরস্পরের খুব কাছে চলে এসেছি। শ্রীরামকৃষ্ণ যেন এই সভ্যতাকে আগেই দেখতে পেয়েছিলেন। যে শিল্পসভ্যতা আজ পৃথিবীকে এক করে দিয়েছে, তার রূপটি তিনি যেন আগেই দেখতে পেয়েছিলেন। এই যে গঙ্গা, যার পূতসলিলকে ঠাকুর বলতেন ব্ৰহ্মবারি, সেই নদীর দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে কলকারখানার ময়লা—ইনডাসট্রিয়াল ওয়েস্ট। গঙ্গার তীরে গড়ে উঠেছে এক শিল্পসভ্যতা। এর আভাস শ্রীরামকৃষ্ণ সম্ভবত পেয়েছিলেন। যেন বুঝেছিলেন, যে সভ্যতা আসছে, তা আমাদের জীবনযাত্রার বাইরের রূপটা অনেকটা পালটে দেবে। আর আমরা তপোবনের যুগে ফিরে যাব না, সে আর সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য—যা ভারত চিরকাল বিশ্বাস করে এসেছে—তা যেন আমরা ভুলে না যাই। সেই উদ্দেশ্য হল ঈশ্বরলাভ, সেই উদ্দেশ্য হল ব্রহ্মোপলব্ধি। যদি এই উদ্দেশ্য ঠিক থাকে, তাহলে আসুক শিল্পসভ্যতা, আসুক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা—তাতে আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাহলে সেই সভ্যতাই হবে আদর্শ সভ্যতা। সেই সভ্যতার কেন্দ্রে আছে ধর্ম, আর বাইরে প্রাচুর্য, সুখস্বাচ্ছন্দ্য, কর্মপ্রবাহ। জ্ঞাতসারে হোক, অজ্ঞাতসারে হোক—মানুষ আজ এই সভ্যতারই স্বপ্ন দেখছে। আজ যা স্বপ্ন, কাল তা বাস্তব হবে। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে এই সভ্যতাই সর্বত্র দেখা দেবে। আর ভারতবর্ষ হবে তার পথপ্রদর্শক। শ্রীরামকৃষ্ণ সেই সভ্যতারই বীজ বপন করে গেছেন।
বস্তুত, এই পারমাণবিক যুগে মানুষের হাতে যে প্রচণ্ড শক্তি এসেছে, সেই শক্তির সদ্ব্যবহার যদি না হয়, তাহলে ধ্বংস অনিবার্য। সদ্ব্যবহার করতে গেলে চাই সংযম, চাই প্রেম-প্রীতি-মৈত্রী ও ত্যাগ। সমস্ত পৃথিবী আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ে ভীত। কারণ, যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তবে তা হবে পারমাণবিক যুদ্ধ। আর পারমাণবিক যুদ্ধ হলে মানবসভ্যতা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই অবস্থায়, প্রায় এক শতাব্দী পার হয়ে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের কানে আসছে শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী: সংযম অভ্যাস কর, ত্যাগ অভ্যাস কর, সবাইকে আপনার করে নিতে শেখ, সব ধর্মমতকে শ্রদ্ধা কর। শুধু পরমতসহিষ্ণুতা নয়—পরমতগ্রহীষ্ণুতা। Tolerance নয় শুধু—Acceptance। ‘যত মত তত পথ’। স্বামীজী বলছেন; এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ। কোন্ ভারতবর্ষ? যে ভারতবর্ষ শাশ্বত, যে ভারতবর্ষ রূপ নিয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক টয়েনবি বলছেন; এই পারমাণবিক যুগে, ভারতের পথ যদি আমরা গ্রহণ না করি, সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। ‘ভারতের পথ’ বলতে, যে পথ অশোক দেখিয়ে গেছেন, যে পথ শ্রীরামকৃষ্ণ দেখিয়ে গেলেন। সংযমের পথ, ত্যাগের পথ, প্রেম-পবিত্রতার পথ। এই মানবসভ্যতা যে পথে চলছে, শ্রীরামকৃষ্ণ যেন সেই পথ থেকে তার মোড় ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করছেন। বর্তমান সভ্যতা কাম-কাঞ্চনের দাস। আর শ্রীরামকৃষ্ণকে কি দেখছি? ‘কাম -কাঞ্চনের’ নামও শুনতে পারেন না তিনি। আবাল্য জেহাদ তাঁর এ দুটির প্রতি। ভারতবর্ষের বাণী ত্যাগের বাণী—‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’, ‘ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’। যে ত্যাগ কোন নেতিবাচক জিনিস নয়। ত্যাগ মানে বৃহত্তর বস্তুর জন্য ক্ষুদ্রতর বস্তুর ত্যাগ। স্থায়ী সুখের জন্য ক্ষণিক সুখ ত্যাগ। ঈশ্বরের জন্য ইন্দ্রিয়সুখ ত্যাগ, ব্রহ্মানন্দের জন্য বিষয়ানন্দ ত্যাগ। সেই ত্যাগের আদর্শ শ্রীরামকৃষ্ণ প্রতিষ্ঠা করলেন। মনুষ্যত্বের নতুন সংজ্ঞা দিয়ে গেলেন। বললেন: মানুষ মানে ‘মান হুঁশ’। হুঁশ-যুক্ত মানুষ, চৈতন্যবান মানুষ, আত্মজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, ব্রহ্মজ্ঞ মানুষ। সেই মানুষই প্রকৃত মানুষ। আর তিনিই তার দৃষ্টান্ত। প্রকৃত মানুষের কি রূপ—কতটা সুন্দর, কতটা পবিত্র, কতটা প্রেমিক, কতটা নিঃস্বার্থ—তা আমরা দেখছি শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে। যেন জগতের কাছে একটা ছাঁচ দিয়ে গেলেন। যেন বলছেন: যদি তোমরা শান্তি চাও, আনন্দ চাও, বিভেদ-বিসংবাদ ভুলতে চাও, আমাকে আদর্শ কর, আমার ছাঁচে নিজেদের গড়তে চেষ্টা কর। শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা ধীরে ধীরে আজ সারা পৃথিবী নিচ্ছে। পৃথিবীর চেহারা পালটে যাচ্ছে। স্বামীজী বলছেন: শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সত্যযুগ আরম্ভ হয়েছে। ছোটবেলায় আমরা শুনতাম: ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এত বিস্তৃত, এত ব্যাপক যে সেখানে কখনও সূর্যাস্ত হয় না। আমরা সাম্রাজ্যবাদের যুগে জন্মেছিলাম। কোথায় গেল সেই সাম্রাজ্যবাদ? সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কোথায় গেল? আজ সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি: স্বাধীনতার জয়গান, মুক্তির জয়গান। আবার দেখছি; দুর্বলের উপর সবলের যে অত্যাচার তার অবসান ঘটতে চলেছে। স্বামীজী বলেছিলেন: শূদ্রের জাগরণ হবে। যারা দুর্বল যারা পদদলিত আজ তাদের অভ্যুত্থান দেখছি সর্বত্র। আবার দেখছি: নারী-জাগরণ। তখনকার দিনের নারী আর এখনকার দিনের নারী—কত তফাৎ। জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীরা আজ এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের কথা আমরা জানি না। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সত্যিই একটা নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। হঠাৎ হয়তো আমাদের চোখে পড়ে না। যে কাজ গভীর, যে কাজ স্থায়ী, যে কাজ মহৎ—তাতে চাঞ্চল্য থাকে না, বিজ্ঞাপন থাকে না। তাই চোখে পড়ে না। আমরা ভোরবেলায় ফুল দেখে মুগ্ধ হই। এই ফুলটা ফুটে ওঠার পেছনে যে শিশিরকণা আছে, তাকে কিন্তু আমরা জানি না। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব ঐ শিশিরকণার মতো। সকলের অজ্ঞাতসারে, নীরবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর যে আবির্ভাব এ তো সাধারণ কোন ঘটনা নয়। যুগান্তকারী ঘটনা। আমরা শুনি divine intervention। এমন এক একজন ব্যক্তি আসেন, ঈশ্বর-প্রদত্ত শক্তি তাঁদের, ইতিহাসের ধারাটাকেই তাঁরা নিয়ন্ত্রিত করে থাকেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সেইরকম একজন ব্যক্তি। আমরা বুঝি বা না বুঝি, আমরা স্বীকার করি বা না করি, এমন কি আমরা যদি প্রতিরোধও করি—তবুও শ্রীরামকৃষ্ণ কাজ করে যাবেন, তাঁর বাণী জগতে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ সেইজন্যই তিনি এসেছিলেন।
তাঁর সম্বন্ধে উইলিয়ম ডিগবী বলছেন:২২ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে দুই জন মনীষীর নাম আমরা খুব শুনি। সবাই তাঁদের খুব সম্মান করি। একজন কবি ব্রাউনিং আর একজন বিশিষ্ট দার্শনিক সমাজতত্ত্ববিদ জন রাস্কিন। কিন্তু আমি এমন একজনের নাম করব, যাঁর সঙ্গে তুলনা করলে মনে হয়, এঁরা শুধু অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন (‘gropers in the dark’)। এই লোকটি হচ্ছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বাংলার এক অখ্যাত পল্লীতে এঁর জন্ম। কিন্তু তাঁর মেধা, তাঁর জ্ঞান, তাঁর চরিত্র—তাঁর কাছে এঁরা দুজন শিশুমাত্র। ডিগবী একজন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক, তিনি এইভাবে মূল্যায়ন করছেন শ্রীরামকৃষ্ণের। আবার ম্যাক্সমূলার—ভারতবর্ষে আসেননি, শ্রীরামকৃষ্ণকে কখনও দেখেননি—তিনি তাঁর সম্বন্ধে বলছেন: ২৩A Real Mahatman. রোমাঁ রোলাঁ বলছেন:২৪ ভারতের ত্রিশ কোটি মানুষের দু-হাজার বছরের অধ্যাত্মসাধনার পূর্ণ পরিণতি শ্রীরামকৃষ্ণ। অরবিন্দ বলছেন:২৫ The epitome of the whole—সারাৎসার, সারেরও সার তিনি। বাস্তবিক, কী একটা বৈচিত্রময় জীবন তাঁর! বর্ণাঢ্য। একটা রং নয়, সব রং তাঁর মধ্যে সাজানো। ধর্মের ইতিহাসে যত অভিজ্ঞতা আছে, সব অভিজ্ঞতা এই একজনের মধ্যে বিধৃত হয়ে আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ যেন একটা বিশ্বকোষ। ধর্মজগতে যত কিছু ঘটেছে, ঘটে বা ঘটতে পারে—এ সব সেখানে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। ভগবানকে নিয়ে কত খেলা করেছেন তিনি। কে বড় কে ছোট এ বুঝতে পারা যায় না। ভগবান যেন ছোট হয়ে গেছেন তাঁর কাছে, তাঁকে যেন তিনি অনায়াসে করায়ত্ত করে রেখেছেন। যখন যেভাবে খুশি তাঁকে সেইভাবে দেখছেন। একটা ভাব আয়ত্ত করার জন্য লোকে কত জন্ম-জন্মান্তর তপস্যা করে। আর শ্রীরামকৃষ্ণ স্বচ্ছন্দে একটা ভাব থেকে আর একটা ভাবে বিচরণ করছেন। গানের যত সুর আছে, যত রাগরাগিণী—সবগুলিকে নিয়ে স্বচ্ছন্দে তিনি যেন খেলা করছেন। কখনও দেখছি তিনি নিত্যে রয়েছেন, ছাদে উঠে বসে আছেন। আবার পরমুহূর্তেই দেখছি—তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছেন, লীলায় চলে এসেছেন। নিত্য আর লীলা, Absolute আর Relative—এই দুয়ের মধ্যে তিনি আনাগোনা করছেন অবলীলাক্রমে। যা নাকি আমাদের কাছে আয়াসসাধ্য তা তাঁর কাছে অনায়াসলভ্য। সত্যিই শ্রীরামকৃষ্ণ এক পরম বিস্ময়। অতুলনীয়। কোন্ অভিধায় তাঁকে চিহ্নিত করব? কোন্ বিশেষণে? তিনিই তাঁর উপমা—অদ্বিতীয়। তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলা নির্বুদ্ধিতা, বলতে চেষ্টা করাও নির্বুদ্ধিতা। ঈশারউড সেইজন্যই বলছেন:২৬ Phenomenon. একটা মহাঘটনা শ্রীরামকৃষ্ণ—এমন ঘটনা যার কোন ব্যাখ্যা চলে না।
আকর-তালিকা
১। গীতা, ৪/৭
২। ঐ, ৪/৮
৩। ভাগবত, ১/৩/২৬
৪। পত্রাবলী, পৃঃ ১০৯
৫। ঐ, পৃঃ ২৫৫
৬। ঐ, পৃঃ ৩৪১
৭। ঐ, পৃঃ ৩৬
৮। ঐ, পৃঃ ৫৬২
৯। ঐ, পৃঃ ১৯৭
১০। গীত, ৪/৬
১১। ঐ, ৪/৫
১২। ভাগবত, ১০/৩৩/৩৭
১৩। কুলার্ণবতন্ত্র, ৬/৭৩
১৪। ভাগবত, ১০/৩৩/৩৭
১৫। লঘুভাগবতামৃত (লীলাবতার), ৪
১৬। কুলার্ণবতন্ত্র, ৬/৭৬
১৭। চৈতন্যচন্দ্রোদয়, ৬/৭৪
১৮। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ (কৃষ্ণজন্মখণ্ড), ৪৩/৫৫
১৯। গীতা, ৯/১১
২০। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ, ২/৫
২১। গীতা, ৬/২২
২২। World Thinkers on Ramakrishna-Vivekananda, Edited by Swami Lokeswarananda, 1983. p. 29
২৩। Ibid.. p. 2
২৪। Ibid., p. 5
২৫। Ibid., p. 18
২৬। Ibid., p. 14
* ‘যুগের প্রয়োজনে’ কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। তাই দেখি, নরশরীর গ্রহণের আগে তিনি মনুষ্যেতর প্রাণীর শরীর গ্রহণ করেছেন। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ রূপে যেমন তিনি এসেছেন, তেমনি আবার এসেছেন বামন, পরশুরাম, রামচন্দ্র, কৃষ্ণ অথবা বলরাম (শঙ্করাচার্যের রচনা বলে যে ‘দশাবতার স্তোত্র’ প্রচলিত তাতে কৃষ্ণ অষ্টম অবতার। জয়দেবের স্তোত্রে বলরাম অষ্টম অবতার।) এবং বুদ্ধ রূপে। হিন্দুদের যে অবতারের প্রসিদ্ধ ঐতিহ্য তাতে প্রথম অবতার দেখছি মৎস্য—জলচর প্রাণী, তারপর কূর্ম—উভচর, তারপর বরাহ—স্থলচর; তারপর অর্ধেক মানব ও অর্ধেক প্রাণী নৃসিংহ। তারপরে ভগবান এলেন পূর্ণ মানুষের শরীর নিয়ে কিন্তু বামনাকৃতি। তারপর পরশুরাম, রামচন্দ্র প্রভৃতি। জীববিজ্ঞানীরা হয়তো হিন্দুর এই অবতারের বিবর্তনের মধ্যে প্রাণীর বিবর্তনের একটি বৈজ্ঞানিক ধারা খুঁজতে পারেন।
* রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। দক্ষিণ কলকাতার গোলপার্কে অবস্থিত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি বিনিময়ের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই প্রতিষ্ঠানটির বহুমুখী কর্মধারার সঙ্গে দেশী-বিদেশী বহু পণ্ডিত ও বিদ্বজ্জন নানাভাবে জড়িত আছেন। ‘কথামৃতে’র ব্যাখ্যাকার এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ।
* ‘অবতারবরিষ্ঠ’ কথাটি স্বামীজী-রচিত বিখ্যাত প্রণামমন্ত্রটিতে আছে। ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই ফেব্রুয়ারি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পরম ভক্ত শ্ৰীযুক্ত নবগোপাল ঘোষ হাওড়ার রামকৃষ্ণপুরে নিজের নতুন বসত-বাড়িতে স্বামীজীর দ্বারা শ্রীরামকৃষ্ণ-বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন। স্বামীজী স্বয়ং ঠাকুরের পুজো করেন এবং পুজোর আসনে বসেই মুখে মুখে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রণামমন্ত্রটি রচনা করে দেন। মন্ত্রটি এই:
স্থাপকায় চ ধর্মস্য সর্বধর্মস্বরূপিণে।
অবতারবরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নমঃ॥
যিনি ধর্মস্থাপন করতে এসেছেন, যিনি স্বয়ং সর্বধর্মস্বরূপ, শ্রেষ্ঠ অবতার সেই শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম।
** স্বামীজীর ‘হিন্দুধর্ম ও শ্রীরামকৃষ্ণ’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য। বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১৩৮৩
* উদ্ধৃত অংশটি শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ স্বামী অভেদানন্দ রচিত নিম্নলিখিত প্রণাম-মন্ত্রের অন্তর্গত:
নিরঞ্জনং নিত্যমনন্তরূপং ভক্তানুকম্পাধৃতবিগ্রহং বৈ।
ঈশাবতারং পরমেশমীড্যং তং রামকৃষ্ণং শিরসা নমামঃ॥
* ‘দেশ’, ৪/২/৭৮ সংখ্যায় দেবীপ্রসাদ ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য। মূল গ্রন্থের নাম: ইণ্ডিন্ ইস্ট আন্ডের্স (Indien ist Anders)—‘ভারতবর্ষ অন্যরকম’। লেখক: মাক্সিমিলিয়ান ফন রগিস্টের। জার্মান পর্যটক।
* ‘Truth from his lips prevailed with double sway./And fools who came to scoff remained to pray.’ (The Deserted Village, Oliver Goldsmith)
** বিবিধাশ্চর্য-মাধুর্য-বীর্যৈশ্বির্যাদিসম্ভবাৎ।
স্বদেবাদিলীলাভ্যো মর্ত্যলীলা মনোহরা॥
—নানারকম আশ্চর্য, মাধুর্য, বীর্য ও ঐশ্বর্যাদি সম্ভব অর্থাৎ প্রকাশিত হতে পারে বলে মানুষরূপে তাঁর যে লীলা তা সেই সেই দেবলীলার চেয়ে মনোহর। (লঘুভাগবতামৃত, কৃষ্ণ, ৩৩৪)
* দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীমার থাকবার ঘর—ঠাকুরের ঘর থেকে কয়েক গজ উত্তরে।