উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

অবতার

অবতার

সাদা শার্ট, সাদা টি-সার্ট, সাদা মোজা, সাদা কেডস পরে বড়মামা দোতলা থেকে একতলায় নেমে এলেন। এই কিছুটা আগে ভোর হয়েছে। বাড়ির সব জায়গা থেকে অন্ধকার এখনো সরেনি। পরপর তিনটে খাঁচা ঝুলছে। কালো কাপড় ঢাকা। পাখিদের ঘুম এখনো ভাঙেনি। মেজোমামা শিলে একটা নিমদাঁতন ফেলে নোড়া দিয়ে একটা মাথা থেঁতো করছেন। ভেতরে গেলেই দাঁত মাজা শুরু হবে। ব্রাশ ব্যবহার করেন না। দাঁতন দাঁতের স্বাস্থ্যের পক্ষে অতিশয় উপকারী। খরচও কম। মেজোমামা ক্রমশই কৃপন হচ্ছেন। বুঝতে পারেন না। আমরা পারি। এখন সদাই বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষেরই কিছু সঞ্চয় প্রয়োজন। গ্রীষ্মের পরেই আসে বর্ষা।’

বড়মামা নাম রেখেছেন, ‘স্মল সেভিংস।’

মেজোমামা বড়মামার পায়ের শব্দে তাকালেন, ‘বাবা! এ আবার কী! মর্নিং স্কুলে ভর্তি হলে বুঝি! কেজি ওয়ান!’

বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘এই নতুন কাজের লোকটা কোথা থেকে এল রে! সকালেই বাটনা বাটতে বসে গেছে। শিল-নোড়া ভেঙে না ফেলে। যে ভাবে ঠুকছে! কত্তা আগে কোথাও কাজ করেছ? না এই বাড়িতেই প্রথম হাত পাকাচ্ছ।’

মেজোমামার গায়ে লেগেছে। ফোঁস করে উঠলেন, ‘দেখ বড়দা, তোমাকে আমি অপমান করিনি, তুমি কিন্তু আমাকে ইনসাল্ট করলে!’

‘কাজের লোক বললে ইনসাল্ট করা হয়! কোনও মানুষকে প্রশংসা করার সময় আমরা বলি না! লোকটা ভীষণ কাজের লোক!’

‘তুমি সে ভাবে বলোনি! সে কাজের লোক আর এই কাজের লোক সম্পূর্ণ আলাদা! তুমি আমাকে চাকর বলেছ।’

‘তুমি আমাকে শিশু বলেছ।’

‘সরল শিশু, শিশুর মতো সরল এটা একটা ভয়ঙ্কর রকমের প্রশংসা। আমরা বলি লোকটা শিশুর মতো সরল। কত বড় গুণ!’

‘তুমি শিশু মিন করোনি ভাই, তুমি বলতে চেয়েছ, বুড়ো খোকা! তোমার এই সূক্ষ্ম খোঁচাটা না বোঝার মতো মোটা বুদ্ধি আমার নয়।’

‘বেশ করেছি, যাও।’

‘আমিও বেশ করেছি যা।’

‘বেশ করব বললেই করা যায় না।’

‘তুমি বেশ করতে পারো, আর আমি বেশ করতে পারি না?’

‘আমি কি বেশ করেছি?’

‘কেউই যদি কিছু করিনি তাহলে এত কথা আসছে কোথা থেকে?’

মাসিমা এসে গেছেন, ‘বাপরে বাপ, সাত সকালে এ কী আরম্ভ হল? দিন দিন বয়েস সব কমছে, না বাড়ছে? বলি, সব কচি খোকা হচ্ছ! কী নিয়ে হচ্ছে শুনি! দুটো হুলোর কী নিয়ে এই তর্জন গর্জন! আমার শিলে আবার তুমি নিম দাঁতন থেঁতো করছ! আবার বাসী কাপড়ে শিল ছুঁয়েছো?’

বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে ফোড়ন কাটলেন, ‘জাত-জন্ম, শুদ্ধাচার আর কিছুই রইল না।’

মাসিমা বললেন, ‘থামো, তুমিই বা ওটা কী করছ?’

‘কেন? আমি আবার কী করলুম! আমি তো জগিং করতে যাচ্ছি?’

‘সে তুমি যাও, জুতো পরে তুলসীমঞ্চে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কোন আক্কেলে?’

মেজোমামা সঙ্গে সঙ্গে জুড়লেন, ‘এই অনাচারের জন্যেই এ-বাড়িতে তুলসী গাছ আর বাঁচতে চাইছে না। জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে।’

মাসিমা হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘তোমরা দুটোতেই আমার চোখের সামনে থেকে সরে পড়ো। তোমাদের দেখলেই আজকাল আমার হাড় পিত্তি জ্বালা করে। চামড়ার চটি পায়ে শিল ধরেছ তুমি? চটিতে নোড়াতে এক হয়ে আছে? কি সর্বনাশ।’

মেজোমামা নোড়াটা পায়ের কাছে রেখেছিলেন অতটা খেয়াল করেননি। অপরাধীর সাফাই গাওয়ার গলায় বললেন, ‘কুসি এটা চামড়ার চটি নয়, স্যাণ্ডাল।’

বড়মামা তুলসীমঞ্চের কাছ থেকে সরে এসেছেন অনেকটা। বড়মামা বললেন, ‘আফটার অল চটি ইজ এ চটি। সে চামড়ারই হোক আর ভেলভেট-এরই হোক, জাতিতে চটি।’

মাসিমা বললেন, ‘তুমি ক্রমশ সরতে সরতে ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? দেখেছ, পায়ের কাছে কী আছে?’ বড়মামা তাকালেন, ‘কী বলতো! কালো মতো কী যেন একটা রয়েছে!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, রয়েছে! ঠাকুরের বাসন মাজার তেঁতুল। একজন শিলের ওপর উঠে বসে আছেন, এইবার তুমি বাইশ-শো-বাইশ জুতো দিয়ে তেঁতুলটার পিণ্ডি চটকে দাও। তোমরা দয়া করে বিদেয় হও না।’

বড়মামা মনে হয় একটু বেশি স্মার্ট হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। উঠোন থেকে জগিং করতে করতে বাগান, বাগান থেকে রাস্তায়। প্ল্যানটা মনে হয় এই রকমই ছিল। জগিং শুরু করলেন, ধিনিক ধিনিক। মট করে শব্দ। একেবারে ছাতু। পায়ের চাপে ত্রিভঙ্গ মুরারী হয়ে গেল প্লাস্টিকের চামচে।

মেজোমামা বললেন, ‘সব শেষ হয়ে গেল। মুকুজ্যে ফ্যামিলির স্থাবর অস্থাবর আর কিছু রইল না।’

বড়মামা আমাকে ইশারা করলেন, ‘পালিয়ে আয়।’ ধীর লয়ে ছুটতে ছুটতে বাগানে। বাগানে গোলাপ ফুটেছে। গাছের সামনে দাঁড়িয়ে ফুল দেখতে দেখতে স্পট-জগিং। জগিং-এর একটা নেশা আছে, আমিও ধিতিং ধিতিং করছি। সেখান থেকে নাচতে নাচতে রাস্তায়।

পথ বাঁদিকে মোড় নিয়ে সোজা চলে গেছে গঙ্গার দিকে। আমেরিকায় সবাই জগিং করে, মাইলের পর মাইল। আমেরিকার প্রেসিডেন্টও জগিং করেন। ওসব দেশের নিয়ম খুব কড়া। খাটো খাও। বেলা আটটা পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি। ঘুম যে আর ছাড়েই না। থ্যাসথ্যাসে শরীর। দেশের দরজা খুলে দূর করে দেবে—গেট আউট। লেজি লোকের নো প্লেস হিয়ার। বাঘের মতো শরীর চাই, সিংহের মতো সাহস, গণ্ডারের মতো গোঁ। হেলথ ইজ ওয়েলথ। বয়েস যত বাড়বে ব্যায়াম তত বাড়াতে হবে, তা না হলে খিলে জং ধরে যাবে। মাথা বোদা মেরে যাবে। শরীরে মোষের চর্বি জমবে। সামান্য পরিশ্রমেই দরদর করে ঘামবে। একতলা থেকে দোতলায় উঠতে হাপরের মতো হাঁপাবে। রোজ রাতে বড়মামা আমাকে এক নাগাড়ে এইসব উপদেশ দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েন। ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ নাসিকা গর্জন। বোধহয় স্বপ্ন দেখেন। কোনও কোনও দিন ঘুমোতে ঘুমোতেই বলে ওঠেন, তন্দুর, তন্দুর।

বড়মামা তন্দুরি রুটি আর মটন চাঁপ খেতে খুব ভালোবাসেন। হাজির দোকান থেকে কিনে আনেন বড়মামার কম্পাউন্ডার অক্ষয়বাবু। হার্টের দিকে কিছু একটা ঝামেলা হওয়ায় এখন সেটা বন্ধ আছে। সেই কারণে খাওয়াটা মনে হয় স্বপ্নেই হয়। বড়মামার আর একটা প্রিয় খাদ্য চৌসা আম। একসঙ্গে দশ-বারোটা এক সিটিং-এ। পাতের পাশে আঁটির পাহাড়। বিহারের বালক নরেশ বড়মামার প্রিয় সেবক। সে-ই মাল সাপ্লাই দেয়। মাসিমার এইসব অসহ্য। রাক্ষুসে খাওয়া দেখলে মানুষের মনুষ্যত্ব সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ জাগে।

বালতিতে আম ভিজছে। বড়মামা হাঁকছেন, ‘নরশুয়া, লাগাও ঔর একঠো।’ মেজমামার পরিপাকশক্তি দুর্বল। ভাস্কর লবণ মুখে ফেলতে ফেলতে আতঙ্কের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। স্মরণ করিয়ে দেন, ‘বেশি যদি খেতে চাও, তাহলে কম খাও।’

বড়মামা খপং খপং করে ছুটছেন, পেছনে আমি। আমার আবার আস্তে ছোটা আসে না। মাঝে মাঝে তরতরিয়ে এগিয়ে যাই। খেয়াল থাকে না। বড়মামা হিস হিস করেন। তখন দাঁড়িয়ে পড়ে স্পট-জগিং। বড়মামা এগিয়ে আসেন। আবার সেই ফর্মেসান, বড়মামা আগে, আমি পিছে।

আড়াল থেকে আওয়াজ—’দেখ, দেখ আগে নাচছে কুমড়ো, পেছনে চালকুমড়ো। আগে যায় হাতি, পিছে যায় নাতি।’

বড়মামা এই সব ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে কান দিতেন না। কোনো ভালো কাজ, মহৎ কাজ করতে গেলে লোকে টিটকিরি দেবেই। সব কথায় কান দিতে নেই। নিজের কাজ করে যাও। এখন আর কিছু বলে না। তবে আমার খুব লজ্জা করে। আমার কী, আমি তো দৌড়তেই পারি। ছোট ছেলে। বড়মামা বিশাল এক মানুষ, তাঁর কী দৌড়ানো সাজে! পাছে বড়মামা একা হয়ে যান, তাই সঙ্গে আসা।

ঋষি বঙ্কিম রোড দিয়ে আমরা চলেছি। একটা বাড়ির দোতলার বারান্দায় এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বড়মামাকে দেখে চিৎকার করে উঠলেন, ‘আরে ডাক্তারবাবু। একটু দাঁড়ান প্লিজ। ডাক্তারবাবু একটু দাঁড়ান প্লিজ।’

বড়মামার তো থামার উপায় নেই। লাফাতে লাফাতে ধীরগতিতে সামনে এগোতে এগোতে বলতে লাগলেন, ‘অসুখ বিসুখ সব পরে, দশটার সময় চেম্বারে।’

‘জ্বরটা কিছুতেই যাচ্ছে না যে। রোজ ঠিক মাঝরাতে আসছে।’

‘মেরে তাড়াতে হবে। আর ওষুধ নয়, এইবার চৌকিদার।’

‘এটা একটা কথা হল ডাক্তারবাবু। বুঝিবে সে কিসে…’

আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছি, ভদ্রলোক মুখ ঝুলিয়ে যতটা সম্ভব উঁচু গলায় শেষ করলেন।

‘কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।’

বড়মামা আমাকে বললেন, ‘এত কিছুর সেন্টিনারি হয়, এই কথাটার সেন্টিনারি হওয়া উচিত।’

হঠাৎ একটি ছেলে আমাদের পাশে পাশে ছুটতে শুরু করেছে। ছোটা তো নয় জগিং। দুলকি চাপে ঝুপুং ঝুপুং করে লাফাতে লাফাতে সামনে এগোনো। ছেলেটির বয়েস কুড়ি থেকে বাইশের মধ্যে।

ছেলেটি বলছে, ‘প্রায় একমাস হল ডাক্তারবাবু, ওষুধ খাচ্ছি অম্বল একটু কমল না।’

‘ভুগছ কত দিন?’

‘বছর তিনেক।’

‘তিন বছরের ব্যারাম এক মাসেই সেরে যাবে?’

‘যা খাই, খাওয়ামাত্রই পেটটা ফুলে ওঠে। আর ঢেউ ঢেউ ঢেঁকুর!’

‘একই ব্যাপার! আমারও তাই। পরশু ধোঁকা খেয়েছিলুম, আজও বসে আছে পেটে ঘাপটি মেরে।’

‘লিভারের কাছে টেরিফিক পেন।’

‘টেণ্ডার লিভার। সাইজে আনতে হবে।’

‘মাথা! সব সময় মাথা ধরে আছে।’

‘পেটটাকে ক্লিয়ার করতে হবে।’

‘গাঁটে গাঁটে ব্যথা।’

‘ইউরিক অ্যাসিড জমেছে।’

‘পাগল হয়ে যাব ডাক্তারবাবু।’

‘হতে পারলে ভালো। একমাত্র দাওয়াই। পাগলদের কোনও রোগ থাকে না।’

ছেলেটা আমাদের সঙ্গে অনেকটা চলে এসেছে। আমরা কেদার ব্যানার্জি রোডে পড়ে গেছি। সামনেই মোহনদার চায়ের দোকান। মোহনদা চামচে ফেলে বেরিয়ে এলেন। লাফাতে লাফাতে আসছেন।

‘ডাক্তারবাবু! ধরে ফেলেছি। চেম্বারে যা ভিড়। সোনোগ্রাফি করিয়েছি।’

‘বেশ করেছ। কিছুই পাওয়া যাবে না।’

‘ঠিক বলেছেন।’

‘ওটা গলব্লাডার নয়, কোলাইটিস।’

‘উপায়!’

‘দু’মাইল।’

‘মানে?’

‘মানে রোজ সকালে আমার সঙ্গে এইভাবে দু’মাইল ধপরধাঁই।’

দেখতে দেখতে আমাদের দল বড় হচ্ছে। ডাক্তারবাবুর চলমান চেম্বার। একটু দৌড়তে পারলেই ফ্রি-অ্যাডভাইস। পেট, মাথা, বুক, গাঁট এই চার সমস্যার নাম মানুষ। ভোলাদার মিষ্টির দোকান। তিনিও বিশাল শরীর নিয়ে তাল রাখার চেষ্টা করছেন। সমস্যা একটাই, কিছুই তেমন খান না, কিন্তু ক্রমশ ওজন বাড়ছে। যৌবনের সেই ঝরঝরে চেহারা দেখলে চোখ ফেলে জল আসে। পঁয়ত্রিশে শরীরের যদি এই অবস্থায় হয় তাহলে চল্লিশে তো গুজরাটি হাতি। প্রেসক্রিপশন একটাই—দু’মাইল।

বীরেন শাসমল রোডে পড়া গেল। বড়মামার ভীষণ সুনাম তল্লাটে। ভালো মানুষ, ভালো ডাক্তার।

হঠাৎ দেখা গেল উলটো দিক থেকে হরিনাম সংকীর্তনের দল আসছে। এই রাস্তার ওপরেই পাঠবাড়ি। মহাভক্ত বৈষ্ণব সাধকের সিদ্ধ সাধনাক্ষেত্র। আজ মনে হয় কোনও অনুষ্ঠান। সংকীর্তন বেরিয়েছে। নাচতে নাচকে আসছেন সবাই—হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ…রাম রাম হরে হরে।

রাস্তা জুড়ে আসছেন সবাই স্রোতের মতো। আমাদের জগিং-পার্টি তো ভেদ করে যেতে পারবে না। নামের এমন গুণ, বড়মামার ভাব এসে গেছে। শর্টস, কেডস, টি-শার্ট—দু’হাত তুলে নাচছেন তিনি। হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃক্ষ হরে হরে। উদ্দাম নৃত্য। দলের পরিচালক যেন বড়মামাই। ভক্ত গলায় দুলিয়ে দিয়েছেন সাদা ফুলের গোড়ের মালা। খোল বাজছে জোড়ায় জোড়ায় উচ্চ রোলে।

বড়মামার পেছন পেছন দল নাচতে নাচতে এসে গেল আমার মামারবাড়ির বিশাল উঠোনে। আনন্দনৃত্য, মহানৃত্য, হুঙ্কার, মহাভাবে মূর্ছা। মাসিমা, মেজোমামা, নরশুয়া, কাজের লোকজন সকলেরই চক্ষু ছানাবড়া। প্রতিবেশীর দলে দলে ছুটে আসছেন।

কেন্দ্রে হাফ প্যান্ট পরা বড়মামা ভাবে টলছেন। ভাবে মত্ত সংকীর্তনের দল। এক একজন তিন-চার হাত লাফিয়ে উঠছেন। বড়মামা ভাব সম্বরণ করে বললেন,—’কুসি তোর তুলসীমঞ্চ অপবিত্র করেছিলুম, এইবার দেখ, আজ কত হরি মহাপ্রভু পাঠিয়েছেন। শুচি, অশুচি, সব মনে রে ভাই। বলো, প্রেমদাতা?’ বড়মামার তুড়ি লাফ। সঙ্গে সঙ্গে ভক্তদের নৃত্য। গলার মালা দুলে দুলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে।

বড়মামা হুঙ্কার দিলেন—’কুসি, ভক্তদের জন্য ভোগের ব্যবস্থা করো। মহাভোগ।’ চার জোড়া খোল, ছ’জোড়া করতাল, সঙ্গে সংকীর্তন, তেমনি নৃত্য। প্রায় পঞ্চাশজন। সারা উঠোনে কলরোল, মত্ত মাতামাতি, বাতাসার হরির লুঠ। মেজোমামা ভয়ে একেবারে তিনতলায়। মাসিমা হতভম্ব।

বেশি রাতে সব মিটে যাওয়ার পর মাসিমা ক্লান্ত শরীরে বৈঠকখানার চেয়ারে কিছুক্ষণ এলিয়ে থেকে বললেন, ‘বড়দা, তোমাকে আমরা এতদিন চিনতে পারিনি। তুমি হলে অবতার। আজ একেবারে ভক্তির ধারা বইয়ে দিলে। কোথা দিয়ে যে কী হয়ে গেল!’

মেজোমামা বললেন, ‘চিনতে পেরেছিস তো। ইনি হলেন যবন হরিদাস। মামলেট আর মালপো, পলান্ন আর পায়েস দুটোই চলে।’

বড়মামা তেড়েফুঁড়ে উঠলেন, মাসিমা করুণ মুখে বললেন, ‘আজ থাক না, অনেক রাত হয়েছে। দুজনেই একটু তাঁর চিন্তা করো না। বলো, প্রভু! আমাদের একটু মানুষ করো।’

দুই মামা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন, ‘আর মানুষ হতে চাই না, তাহলেই অমানুষ হয়ে যাব।’

ঘড়ি বাজছে। এক, দুই…বারো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *