অবগুণ্ঠিতা – পরিচ্ছেদ ৭

০৭.

এমন সময় কিরীটী ওদের সামনে এগিয়ে এল, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস সুব্রত?

সুব্রত মুখ তুলে কিরীটীর দিকে তাকাল, কি?

মৃত ব্যক্তির বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে একটা ছোট্ট পট্টি জড়ানো!

বিনয়েন্দ্রবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, গতকাল সকালে কাঁচের গ্লাসে দুধ খেতে গিয়ে দাদার হাত থেকে কাঁচের গ্লাসটা পড়ে ভেঙে যায়। ভাঙা কাঁচের টুকরো টেবিল থেকে সরাতে গিয়ে দাদার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা কেটে যায়। আমি তখন দাদার সামনেই দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম।

কিরীটী শুধু মৃদুস্বরে বললে, হুঁ।

সুব্রত তখন বিনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, আপনি এখন যেতে পারেন বিনয়বাবু। অনুগ্রহ করে মিঃ সরকারের ভৃত্য রামচরণকে একটিবার পাঠিয়ে দিন।

বিনয়ে ধীরভাবে ঘাড় হেলিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

কিরীটী আবার বললে, সব ঘুরে দেখলাম, সু। একটা জিনিস বুঝতে পারছি না।

কি?

মিঃ সরকারের শয়নঘরের সংলগ্ন ঘোরানো লোহার সিঁড়ির সামনের ঘরের মধ্যে যাতায়াত করবার দরজাটা বন্ধ কেন?

ওটা তো শুনলাম সব সময়ই বন্ধ থাকে। মেথর ঐ ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরের পিছনের বারান্দা দিয়ে বাথরুমে যাতায়াত করে।

সব সময় বন্ধ থাকলেও আজ তো বন্ধ থাকার কথা নয়। বড় গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কেন বন্ধ আছে দরজাটা?

কি তুই বলতে চাস কিরীটী?

বলতে চাই দরজাটা বন্ধ কেন? কেন—কেন ওটা বন্ধ থাকবে? তাছাড়া আরও একটি। ব্যাপার, মিঃ সরকারের হাতঘড়িটা ভাঙল কি করে? ভাঙার তো প্রয়োজন ছিল না? দুটোর সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাই বলে ভাঙবে কেন?

সুব্রত কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললে, হয়তো পড়ে গিয়ে ভেঙেছে। কিন্তু

এর মধ্যে আবার কিন্তু কি? পড়েই বা যাবে কেন?

সুব্রত কিরীটীর ব্যবহারে এবার যেন একটু বিরক্তই হল, বললে, কিরীটী! আরও একটা কথা আছে, বিনয়বাবুর সামনে আমি সে কথা বলিনি—এই 5 c.c. সিরিঞ্জটা অশোকবাবুর ঘরে ল্যাবরেটারির টেবিলের উপর পাওয়া গেছে।

কিরীটী সুব্রতর হাত থেকে সিরিঞ্জটা নিয়ে একবার ঘুরিয়ে দেখল, হ্যাঁ, Needle বড় সাইজের এবং মোটাও। অনায়াসেই এটা ফুটিয়ে হার্ট puncture করা যায়। আর punctureটাও fifth intercostal space-এ left mamary line-এর laterally ও below-তাতে মনে হয় ভদ্রলোকের enlarged heart ছিল। যদি অবিশ্যি heart-এ puncture করেই হত্যা করা হয়ে থাকে! সিরিঞ্জের মধ্যে জমাটবাঁধা রক্তটা analysis করলে কিছু সন্ধান পাওয়া যেতে পারে–বলতে বলতে সিরিঞ্জটা আবার কিরীটী সুব্রতর হাতে ফিরিয়ে দিল।

কিছু বুঝতে পারলি? সুব্রত আবার প্রশ্ন করল কিরীটীকে।

মৃত ব্যক্তির চেয়ারের positionটা দেখ—এমনভাবে চেয়ারটা place করা-যে কেউ ঐ ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে বা শয়নঘর থেকে এই লাইব্রেরি ঘরে প্রবেশ করলে মিঃ সরকারের তা জানবার উপায় ছিল না। কিন্তু তা তো নয়, আমি ভাবছি অন্য কথা! মৃত ব্যক্তি চেয়ারে না বসে থেকে শোবার ঘরে খাটের ওপরেই শুয়ে থাকলেই বা কি এমন ক্ষতি ছিল?

কিরীটীর কথাগুলো আজ যেন কেমন-কেমন মনে হয় সুব্রতর।

অদ্ভুত বুদ্ধিপ্রাখর্যে যে চিরদিন সজাগ, তার মুখে আজ এসব কি আবোল-তাবোল কথা? ঘড়িটা ভাঙা কেন? দরজাটা বন্ধ কেন? মৃত ব্যক্তি চেয়ারে বসে কেন? সুব্রত আর একবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

হঠাৎ আবার কিরীটী বলে উঠল, বুঝলি সু, ভাঙা ঘড়ি আর চেয়ারে বসা এ দুটো ব্যাপার যেন কিছুতেই মেলাতে পারছি না।

কিন্তু ঘড়িগুলো যে দুটোর সময় বন্ধ হয়ে গেল? সকলের ঘড়িই!

Quite possible-সোজা! খুনীর ওটা একটা কৌশল মাত্র। কিন্তু ভাবছি, সিরিঞ্জটাও কিভাল কথা, তুই অশোকবারুকে সিরিঞ্জটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলি?

না।

ভালই করেছিস। জিজ্ঞাসা করবার ওর মধ্যে বিশেষ কিছুই নেই। জিজ্ঞাসা করলে নিশ্চয়ই সে বলত সিরিঞ্জ সম্পর্কে কিছুই জানে না।

কিন্তু সিরিঞ্জের গায়ের আঙুলের ছাপ?

একমাত্র খুনী ছাড়া তিনজন লোকের পাওয়া যেতে পারে—

মানে?

মানে আমার, তোমার ও অশোকের…

এমন সময় ঐ বাড়ির ভৃত্য রামচরণ ঘরে এসে ঢুকল।

সকলেই রামচরণের মুখের দিকে তাকাল একসঙ্গে।

কিরীটী একটিবার মাত্র তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রামচরণের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ বুজে চেয়ারটার নড়েচড়ে আরাম করে বসল।

সুব্রতই প্রশ্ন করলে, তোমারই নাম রামচরণ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

রামচরণের বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বেই হবে। রোগা লম্বাটে, ঢ্যাঙা চেহারা! মাথার চুলগুলি সাদায়কালোয় মিশানো। চক্ষু দুটি কোটরপ্রবিষ্ট, কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও সজাগ। চোয়ালের দুই পাশের হাড় বিশ্রীভাবে ঠেলে সজাগ হয়ে উঠেছে। লম্বা লম্বা হাড় বের করা আঙুল। হাতের শিরাগুলিও সজাগ।

পরিধানে পরিষ্কার একখানা ধুতি। গায়ে হাতকাটা একটা সাদা পিরান। কাঁধে একটি পরিষ্কার তোয়ালে! পায়ে একজোড়া চটি।

তোমার বাড়ি কোথায়?

আজ্ঞে কর্তা এই বাংলা দেশেই–বর্ধমান জিলার মেমারি গ্রামে।

সংসারে তোমার কে আছে?

কেউ নেই। ছোট বয়সে মা-বাপকে খেয়েছি। এক দূরসম্পর্কীয় কাকার কাছে মানুষ!

কতদিন এ বাড়িতে আছ?

তা আজ্ঞে আঠার বছর—

বাবু তোমাকে খুব ভালবাসতেন, তাই না রামচরণ?

আজ্ঞে হ্যাঁ। রামচরণের চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে উঠল।

হঠাৎ এমন সময় কিরীটী একটি প্রশ্ন করল, রামচরণ, তোমার কর্তার ঘুম খুব পাতলা ছিল, না গভীর ছিল?

আজ্ঞে কর্তা খুব কম সময়েই ঘুমাতেন। তবে যতক্ষণ ঘুমোতেন, গভীর ঘুমই হত।

ওঃ! আচ্ছা সুব্রত, তুই যা জিজ্ঞাসা করছিলি আবার কর?

সুব্রত আবার তার জবানবন্দি শুরু করল।

কালকের সন্ধ্যার পর থেকে আজকের সকাল পর্যন্ত ঘটনা আমাকে এতটুকুও গোপন না করে খুলে বলতে পার রামচরণ?

রামচরণ তখন বলতে লাগল, কর্তাবাবু আমাদের দেবতার মত লোক ছিলেন বাবু। চাকর হলেও আজ আঠার বছরের মধ্যে কখনও একটা উচু করে কথা বলেন নি। কাল বিকালে ছয়টার সময় যখন ব্যাংক থেকে বাড়ি ফিরে এলেন, আমি তার ঘরে জামাকাপড় খুলে দিতে গিয়েছিলাম। দেখলাম বাবুর মুখটা যেন গম্ভীর। আজ আঠার বছর বাবুকে দেখছি, বুঝলাম কিছু একটা ঘটেছে যার জন্য কর্তাবাবু গম্ভীর হয়ে আছেন। কেননা বরাবরই দেখেছি, কোন কারণে কর্তাবাবু অসন্তুষ্ট হলে বা রাগ করলে গম্ভীর হয়েই দুতিনদিন থাকতেন। কারও সঙ্গে বড় একটা কথাবার্তা বলতেন না। বাবু চিরকালই একটু গম্ভীর প্রকৃতির ও চাপা ছিলেন। চেঁচামেচি বড় একটা কোনদিনই করতে শুনিনি। বাবু আমাকে বললেন, রামচরণ, শরীরটা আজ আমার খারাপ, কেউ যেন বিরক্ত না করে। আজ আর কিছু খাব না। রাত্রে শুধু এক গ্লাস গরম দুধ দিয়ে যাস। রাত্রি দশটার সময়।

তারপর?

তারপর রাত্রি দশটার সময় যখন দুধ নিয়ে আমি..রামচরণ বলতে বলতে হঠাৎ যেন থেমে গেল।

হ্যাঁ, বল। গরম দুধ নিয়ে যখন যাও—তারপর?

ছোট দাদাবাবু মানে কর্তার ছোট ছেলে তখন লাইব্রেরিতে কর্তার সঙ্গে কথা বলছিল—

হঠাৎ এই সময় কিরীটী তীক্ষ্ণস্বরে প্রশ্ন করলে, তাদের কথা তুমি চুপিসাড়ে শুনতে চেষ্টা করেছিলে রামচরণ…বল, কি তুমি শুনেছ?

বাবু, আমি গরিব চাকরবাকর মানুষ রামচরণ ভেঙে পড়ল।

কিন্তু আড়ি পেতে শোনা তোমার অভ্যাস রামচরণ। কিরীটী বললে, কিন্তু কি শুনেছিলে?

আজ্ঞে ক্ষমা করবেন বাবু, আমার যেন মনে হল বাবু ছোট দাদাবাবুকে বেশ একটু জোর গলাতেই বলছেন, তুমি জাহান্নামে গেছ—একেবারে গোল্লায় গেছ হতভাগা। আমি শীঘ্রই নতুন। উইল করব। একটি পয়সাও তোমাকে দেব না। অপদার্থ! দুটো ছেলেই আমার অপদার্থ। একঘর কুলাঙ্গার নিয়ে আমি বাস করছি।

ছোটবাবু কি জবাব দিলেন তাতে? সুব্রত প্রশ্ন করলে।

মনে হল ছোটবাবুও যেন রেগে বললেন, বুড়ো হয়ে তোমার ভীমরতিতে ধরেছে। উইল যাতে তোমাকে আর না বদলাতে হয়, সে ব্যবস্থাও আমি করছি। বলতে বলতে ছোটবাবু যেন। একপ্রকার ঝড়ের মতোই হঠাৎ দরজা খুলে আমায় পাশ কাটিয়ে এ ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলেন। নিজের ঘরের দিকে।

তারপর?

তারপর আমি দুধ নিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। কর্তাবাবু আমাকে দুধের গ্লাসটা শোবারঘরের টেবিলের ওপরে রেখে চলে যেতে বললেন।

হঠাৎ আবার কিরীটী প্রশ্ন করলে, রামচরণ, তোমার বাবু কি সব সময়েই ঘড়ি হাতে দিয়ে থাকতেন?

আজ্ঞে বাবু অনেক রাত্রি পর্যন্ত পড়াশুনা করতেন লাইব্রেরি ঘরে। যতক্ষণ না শুতে যেতেন ঘড়িটা হাতেই থাকত। অনেক সময় ঘড়ি হাতেই বাঁধা থাকত, শুয়ে পড়তেন।

হুঁ। তোমার বাবু কি রাত্রে কখনও তোমাকে ডাকতেন?

আজ্ঞে না। তবু সর্বদাই আমি সজাগ থাকতাম। অন্তত যতক্ষণ না তিনি শুতে যান। তবে কাল। রাত্রি যখন দেড়টা, হঠাৎ একটা শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম আমার চিরদিনই পাতলা। শব্দটা শুনে প্রথমটা বুঝতে পারিনি। ঘুমের ভাব তখনও চোখে লেগে ছিল। ভাবছি কি করব। তারপর সাতপাঁচ ভেবে উঠে এসে এই ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। দেখলাম বাবু এখনও ঘুমোতে যাননি। উঁকি মেরে দেখলাম, তখনও বাবু চেয়ারের ওপরে পিছন ফিরে বসে আছেন। সামনে বই খোলা, ঘরে আলো জ্বলছে। বুঝলাম বাবু তখনও পড়ছেন। তাই আবার দরজা ভেজিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

কিরীটী আবার প্রশ্ন করলে, তোমার বড়দাদাবাবু সব শেষ কবে এ বাড়িতে এসেছিলেন রামচরণ?

আজ্ঞে কেন, কালই তো রাত্রে এসেছিলেন!

সুব্রত যেন ভয়ংকর রকম চমকে উঠে বললে, কাল রাত্রে এসেছিলেন? কখন?

আজ্ঞে রাত্তির তখন এগারোটা হবে। নীচের দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছি, এমন সময় বড় দাদাবাবু দরজায় ধাক্কা দিলেন–

তারপর?

তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কর্তাবাবু জেগে আছেন কিনা? তিনি তার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি বললাম, কর্তাবাবু জেগে আছেন বটে, তবে তার শরীর খারাপ। তখন তিনি। বললেন, তবে থাক—একটা জরুরি কাজে এসেছিলাম বাবার সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু তার শরীর যখন খারাপ, থাক কাল সকালেই আসব না হয়, বলে তিনি চলে গেলেন। আমিও দরজা বন্ধ করে উপরে চলে এলাম।

কিরীটী মৃদু গম্ভীর স্বরে বললে, হুঁ, টিকিটের কাউন্টার-পার্ট!