০৬.
সুব্রত গণেনবাবুকে এরপর ডেকে পাঠলো।
মিঃ তালুকদারের মুখের দিকে তাকিয়ে সুব্রত বললে, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ তালুকদার, মিঃ সরকারের লাইব্রেরির বড় ওয়াল ক্লকটা, তার হাত-ঘড়িটা, অশোকের ঘরে টীপয়ের ওপরে রাখা রিস্টওয়াচটা, সৌরীনবাবুর রিস্টওয়াচটা—সব কটাই ঠিক রাত্রি দুটোর সময় বন্ধ হয়ে গেছে।
সুব্রতর কথা শেষ হবার আগেই গণেন এসে ঘরে প্রবেশ করে।
মোটাসোটা গোলগাল চেহারা।
মাথার সামনের দিকে দুপাশে টাক দেখা দিয়েছে। কপালের ও রগের দুপাশের চুলে পাক ধরেছে। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। পরিধানে অ্যাশকলারের দামী গরম স্যুট। পায়ে পালিশ করা চকচকে শু। বয়েস বোধ করি—চল্লিশ-বিয়াল্লিশের মধ্যে হবে। মুখখানা গম্ভীর।
সুব্রতই প্রথম কথা বললে, আসুন। নমস্কার। আপনারই নাম—
নমস্কার, গণেন্দ্রনাথ সরকার।
বসুন ঐ চেয়ারটায়। সুব্রত অঙ্গুলি-নির্দেশে একখানা চেয়ার দেখিয়ে দিল।
গণেন্দ্র চেয়ারটার উপর উপবেশন করল।
আপনিই মহালক্ষ্মী ব্যাংকের প্রোপ্রাইটার?
না, অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার।
ও!
অতঃপর দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ!
আবার সুব্রত প্রশ্ন করলে, কাল সারা দিনরাত্রিতে আপনি কোথায় ছিলেন?
সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যাংকে ছিলাম। তারপর মার্কেটে যাই। কয়েকটা জিনিসপত্র আমার কেনবার ছিল। জিনিসপত্র কিনতে কিনতে আমার রাত্রি নয়টা বাজে। নয়টার শোতে মেট্রোতে ছবি। দেখতে যাই। এই দেখুন তার টিকিট। বলতে বলতে রাত্রি নয়টার শোর টিকিটের একটা অংশ। গণেনবাবু পকেট থেকে বের করে দেখাল।
সুব্রত হাত বাড়িয়ে টিকিটখানা দেখে বললে, হুঁ। তারপর?
রাত্রি সাড়ে বারোটার শো শেষ হলে বাস্-এ প্রায় রাত্রি সোয়া একটার সময় বাসায় ফিরি। বাসায় ফিরে আজ সকালে সাড়ে নয়টার সময় ফোনে সৌরীনের কাছ থেকে খবর পেয়েই আসছি।
শুনেছি আপনার বাবার সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় আপনি আজ বছর তিনেক হল আলাদা হয়ে গেছেন?
একটু ভুল শুনেছেন—মনোমালিন্য কিছুই হয় নি। মতের মিল হয়নি। তাই বাবার অর্থসাহায্যেই আমি আলাদা হয়ে গেছি।
আপনি আলাদা হয়ে যাবার পর প্রায়ই আপনাদের এ বাড়িতে আসতেন?
না, ক্কচিৎ কখনও আসতাম।
শেষ কবে আপনার বাবার সঙ্গে আপনার দেখা হয়?
দিন পনেরো আগে বাবার ব্যাংকে। তা
রপর আর দেখা হয়নি? সুব্রত তীব্র দৃষ্টিতে গণেন্দ্রর মুখের দিকে তাকাল।
একটু ইতস্তত করে আস্তে আস্তে গণেন্দ্র বললেন, না।
আপনার প্রতি আপনার বাবার ব্যবহার কেমন ছিল?
আগে খুবই ভালবাসতেন আমায়। তবে গত তিন বছর আলাদা হয়ে যাওয়ায় বিশেষ কোন সম্পর্ক ছিল না। তবে দেখা হলে ভাল ব্যবহারই করতেন।
আপনার পিসতুতো ভাই অশোকবাবু সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
অশোক মেধাবী ও ধীর শান্ত ছেলে। বাবা তাকে নিজের ছেলের মতই ভালবাসতেন।
আর আপনার ছোট ভাই সৌরীন্দ্রবাবু?
সৌরীন্দ্রও ভাল ছেলে! তবে একটু জেদী ও একগুঁয়ে। তাছাড়া কানাঘুষায় শুনছি, সে নাকি রেস খেলতে শুরু করেছিল ইদানীং। এ ছাড়া আর বিশেষ কিছু তার সম্পর্কে জানি না।
আপনার কাছে কোনদিন সে টাকার জন্য গিয়েছিল?
না।
আপনার বাবা সৌরীন্দ্রবাবুকে কেমন ভালবাসতেন?
মনে হত আমাদের দুভাইয়ের মধ্যে সৌরীন্দ্রকেই একটু যেন বেশী ভালবাসতেন।
আপনাদের জ্ঞাতি সুবিমল সম্পর্কে আপনার ধারণা কি? আপনার বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কি রকম ছিল?
শুনেছি সে বাবার কাছ থেকে মাঝে মাঝে অর্থসাহায্য নিত! তাছাড়া তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছুই আপনাকে বলতে পারব না। বাইরে থেকে যেটুকুই জানি তা ভাল বলেই মনে হয়।
আপনার বাবার উইল সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা আছে?
না। অ্যাটর্নী রামলালবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেই সব জানতে পারবেন।
আচ্ছা, আপনার বাবার কোন শত্রু ছিল বলে আপনার মনে হয়?
না, বাবা চিরদিনই শান্তিপ্রিয় নির্বিরোধী লোক ছিলেন? তার কোন শত্রু থাকা একেবারেই সম্ভব নয়।
আচ্ছা এখন আপনি যেতে পারেন। আপনার ঠিকানাটা দিয়ে যাবেন।
গণেন্দ্র সরকার তার নামঠিকানা ও ফোননাম্বারযুক্ত একখানা আইভরী কার্ড সুব্রতর হাতে দিয়ে ধীরপদে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
সুব্রত বিনয়ে সরকারকে এবার ডেকে পাঠালেন।
সুব্রত আবশ্যকীয় কয়েকটা পয়েন্ট তার নোটবুকে নোট করে নিচ্ছে, এমন সময় হঠাৎ ও শুনল, কিরে সুব্রত?
সুব্রত লেখা বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, আরে কিরীটী! কি আশ্চর্য, তুই হঠাৎ কোথা থেকে?
কিরীটী হাসতে হাসতে এগিয়ে এল। তার পশ্চাতে বিনয়েও এসে ঘরে প্রবেশ করল।
কিরীটী বললে, বিনয় মানে মিঃ সরকারের ছোট ভাই কিছুদিন আমাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে বি. এস-সি পড়েছিল। সেই থেকেই ওর সঙ্গে চেনা। হঠাৎ আজ সকালে কিছুক্ষণ আগে ফোনে। আমাকে ডেকে সব কথা বলে আমার সাহায্য চায়। তাই দেখতে এলাম যদি কিছু সাহায্য করতে পারি। তারপর তোর কতদূর?
যাক্, তুই এসেছিস ভালই হল। ব্যাপারটা একটু জটিল বলেই মনে হচ্ছে!
বোসো বিনয়, তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
বিনয়ে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
ব্যাপারটা কি বল তো? কিরীটী প্রশ্ন করে।
কিরীটীর অনুরোধে অতঃপর সুব্রত সংক্ষেপে আগাগোড়া সমস্ত ঘটনাটা বলে গেল।
কিরীটী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট টানতে টানতে সব শুনে গেল। তারপর মৃদুস্বরে বললে, এবারে তাহলে বিনয়ের জবানবন্দী?
হ্যাঁ। সুব্রত জবাব দিল।
বেশ, শুরু কর তোর কাজ। ততক্ষণ আমি একবার চারিদিক ঘুরে দেখে নিই, কেমন?
বেশ তো।
কিরীটী প্রথমেই মৃতদেহের কাছে এগিয়ে গেল। এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মৃতদেহ পরীক্ষা করতে লাগল।
এদিকে সুব্রত ততক্ষণে তার জবানবন্দী শুরু করেছে।
আপনি কাল সন্ধ্যা সাতটা থেকে সারারাত্রি কোথায় ছিলেন বিনয়বাবু?
বরাহনগরে আমাদের এক বন্ধু সমীর সেনের বৌভাতের নিমন্ত্রণ ছিল। আমি সন্ধ্যা সাতটার সময় বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে রাত্রি প্রায় দেড়টা হয়ে যায়। তখন আর ফিরবার কোন উপায় নেই দেখে ওখানেই শুয়ে পড়ি। আজ সকালে প্রথম বাস্-এ সাতটায় বাড়ি ফিরেছি।
শুনেছি আপনি মেডিকেল কলেজের সেকেণ্ড ইয়ার থেকে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে এখন আর্টের চর্চা করছেন?
হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকে গানবাজনা ও ছবি আঁকার দিকে একটা টান ছিল। অন্য কোন কাজের থেকে সেটাই আমার বেশী ভাল লাগে, তাই–
আপনার দাদার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
দাদা আমাকে খুবই ভালবাসতেন। আমি যে তার সৎভাই, এটা কখনও জানতেই পারিনি।
আপনার সঙ্গে আপনার দাদার কখনও কোন ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়নি?
না।
আপনার দাদার কোন শত্রু ছিল বলে আপনার মনে হয়?
না। আর থাকলেও বলতে পারি না।
সুবিমলবাবুর সঙ্গে আপনার দাদার কি রকম সম্পর্ক ছিল?
সুবিমল মাঝে মাঝে দাদার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিত। মাঝখানে কিছুদিন আগে একবার দাদার সঙ্গে তার খুব ঝগড়াও হয়েছিল। দাদা তাকে বাড়ি থেকে বেরও করে দেন। পরে আবার সে এসে একদিন দাদার হাতেপায়ে ধরে ক্ষমা চায়। সব মিটমাট হয়ে যায়। তোক যে ঠিক কিরকম তা বলতে পারব না। তবে শুনেছি সে চিরদিনই একটু বেহিসেবী ও উচ্চুঙ্খল প্রকৃতির। Rainbow ক্লাবের সে একজন মাতব্বর ব্যক্তি শুনেছি।
অশোকবাবু সম্পর্কে আপনার ধারণা কি রকম?
অশোক বড় ভাল ছেলে। দাদা তাকে ছেলের মতই ভালবাসতেন।
আপনার দাদার উইল সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা আছে?
কানাঘুষায় শুনেছি, দাদার সম্পত্তি দুভাগে ভাগ করা হবে। অর্ধেক public donation-এ। যাবে। বাকি অর্ধেক সমান ভাগে আমি, অশোক, সৌরীন ও সুবিমল পাব।
কাউকে আপনি আপনার দাদার হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেন?
সুব্রতর কথায় বিনয়েবাবু কিছুক্ষণ গুম হয়ে চুপ করে বসে রইল। তারপর ধীরস্বরে বলল, না।