২৩.
পরের দিন সকাল।
কিরীটী ফোনে সুব্রতকে যথাযথ উপদেশ দিয়ে বাবলুকে সঙ্গে নিয়ে বের হল।
আমহার্স্ট স্ট্রীটে আর্টিস্ট সুবোধ দত্তের বাড়িতে যখন কিরীটী ও বাবলু এসে দাঁড়াল, বেলা তখন প্রায় সোয়া দশটা হবে।
দরজার কড়া নাড়তেই সুবোধবাবু এসে দরজা খুলে দিলেন।
কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কাকে চান? কে আপনি?
কিরীটী হাসতে হাসতে সুবোধবাবুর মুখের দিকে চেয়ে বললে, আপনিই শিল্পী মিঃ দত্ত?
হ্যাঁ।
আমার নাম কিরীটী রায়।
আমার কাছে আপনার কী প্রয়োজন? মিঃ দত্তর গলার স্বরটা যেন একটু রূঢ়।
প্রয়োজন একটা আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটা আপনার সঙ্গে নয়!
তবে কার সঙ্গে?
কিন্তু কথাটা তো ছোট্ট নয়, একটু সময় নেবে। তাছাড়া আমার যা বলবার তা এই দরজার উপরে দাঁড়িয়ে বলা যায় না—ঘরের মধ্যে যেতে পারি কি?
ভ্রূ দুটো কুঁচকে সুবোধবাবু যেন এক মুহূর্ত কি ভাবলেন, তারপর বিরক্তিমিশ্রিত স্বরে বললেন, বেশ আসুন। কিন্তু সময় আমার খুব অল্প।
কিরীটী বাবলুকে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললে, সময়ের দাম আমারও আছে মিঃ দত্ত! ঠিক কাজের কথাটুকু বলা হলেই আমি চলে যাব, এক মুহূর্তও বেশি থাকব না বা আপনাকে বিরক্ত করব না।
একটা সোফা অধিকার করে কিরীটী বসল।
বলুন কি প্রয়োজন আপনার?
আমার প্রয়োজন আপনার বোন নমিতা দেবীর সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে কি?
সুবোধবাবু দারুণ বিরক্তিতে বললেন, কি প্রয়োজন আপনার আমার বোনের সঙ্গে?
সেকথা আমি তার কাছেই বলতে চাই, আপনার কাছে নয়। তবে আজ যে কথা আমি বলতে এসেছি তার সঙ্গে, তার উপরে আপনার মান সম্রম অনেক কিছুই নির্ভর করছে।
না, তার সঙ্গে আপনার দেখা হবে না। আপনার যা বলবার আমার কাছেই বলতে পারেন।
বলেছি তো মিঃ দত্ত, তা বলতে পারব না। বৃথা সময় নষ্ট করে দুদুটো নির্দোষ জীবন ধ্বংসের পথে এগিয়ে দেবেন না!
না, আমি কোন কথাই শুনতে চাই না, আপনি চলে যেতে পারেন। আমার বোনের সঙ্গে কারও দেখা হবে না। মিঃ দত্ত চিৎকার করে উঠলেন।
সুবোধবাবু, আপনি অনেক দাগা পেয়েছেন, আমি জানি। কিন্তু আজ যদি আপনি আপনার বোনের সঙ্গে আমায় দেখা করতে না দেন, তবে যে দাগা পাবেন তার সান্ত্বনা আপনার কোনদিন মিলবে না।
এমন সময় নমিতা দেবী নিজেই এসে ঘরে প্রবেশ করলেন, কী হয়েছে দাদা?
নমস্কার। আপনার নাম কী নমিতা দেবী?
হ্যাঁ, নমস্কার। কিন্তু আপনি!
আমার নাম পরে শুনবেন। কোন একটা বিশেষ কাজে আপনার কাছে আমি এসেছি, কিন্তু আপনার দাদা কিছুতেই আপনার সঙ্গে আমায় দেখা হতে দেবেন না!
কী দরকার আমার কাছে আপনার, বলুন?
মিঃ দত্ত গজগজ করতে করতে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
বসুন নমিতা দেবী।
নমিতা সামনেই একখানা সোফা অধিকার করলেন।
বলুন।
ইতিমধ্যে কিরীটী বাবলুকে নমিতা দেবীর দৃষ্টির আড়ালে নিজের পিছনের একখানা চেয়ারে বসিয়ে রেখেছিল। আরও একটু ভাল করে বাবলুকে নমিতা দেবীর দৃষ্টি থেকে আড়াল করে কিরীটী মৃদুস্বরে বলতে লাগল, বছর নয়েক আগে শিমুলতলায় আপনার দাদার কোন এক ধনী বন্ধুর সঙ্গে আপনার রেজেস্ট্রি ম্যারেজ হয়?
হ্যাঁ।
আপনার স্বামীর নামটি জানতে পারি কী?
না, কেননা আমিও তার সত্যিকারের নাম জানি না। পরিচয়ের গোড়া থেকেই তিনি নাম ভড়িয়েছিলেন আমাদের কাছে। কোনদিনই আমরা জানতে পারিনি তার দেশ ঘর বাড়ি কোথায়। কিন্তু এসব কথা আপনি জিজ্ঞাসা করছেন কেন?
আমি আজ এমন একটা সংবাদ নিয়ে আপনার কাছে এসেছি, যার উপর আপনার ও আপনার হারিয়ে যাওয়া একমাত্র সন্তানের শুভাশুভ সবকিছু নির্ভর করছে।
কে-কে আপনি? আমার কথা আপনি জানলেন কী করে?
ব্যস্ত হবেন না নমিতা দেবী, সব কথাই ক্ৰমে প্রকাশ হবে। পরিচয়ও আমার পাবেন। তবে এইটুকু জেনে রাখুন, আমি আপনার ভাইয়ের মত আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীই, শত্রু নয়!
কিন্তু…
আগে আমার কথাগুলোর জবাব দিন নমিতা দেবী। আপনার স্বামীর নাম ছদ্মনাম কী ছিল?
জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরী?
ঐ নামেই বিবাহ হয়েছিল?
হ্যাঁ।
ও নামটা যে তার ছদ্মনাম, কবে আপনি জানতে পারেন?
আমার সন্তানের জন্মের মাস দুই আগে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কোন একটা বিশেষ সাংসারিক গোলযোগে তিনি আমাকে তখন তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারছিলেন না, পরে সব মিটে গেলে আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলেছিলেন। তবে প্রত্যেক মাসে আমাকে দেড়শত টাকা করে ভরণপোষণ বাবদ দেবেন বলেছিলেন। শিমুলতলাতেই তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় এবং বিবাহের কুড়ি দিন বাদেই তিনি হঠাৎ আমাদের কাউকে কোন কিছু না বলে কোথায় চলে যান। তার ঠিকানা আমার কাছে ছিল। মাস পাঁচেক নিয়মিত টাকাও পেয়েছি। কিন্তু। দশ-বারাখানা চিঠি লিখে একখানারও জবাব পাইনি। ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে পরে জেনেছিলাম সেখানে উনি থাকেন না। সেটা একটা মনোহারী দোকান। তারপর হঠাৎ তার টাকা আসাও বন্ধ হয়ে গেল।
তারপর?
তারপর আর তার কোন খোঁজই আজ পর্যন্ত পাইনি।
না।
দাদার এক জমিদার বন্ধু ছিলেন— তার নাম বিনয়েন্দ্র সরকার। তারই দয়ায় আমি চাকরি পাই। নমিতা দেবী একে একে তার এ কয় বৎসরের জীবন কাহিনী বলে গেলেন।
আপনার মেয়েটির আর কোন সন্ধান পাননি?
না।
আপনার মেয়েটি যখন চুরি হয়, তখন তার বয়স কত ছিল?
ছয় বছর হবে।
আজ চার বছর সে চুরি গেছে?
হ্যাঁ, প্রায় পাঁচ বছর হবে।
আপনার মেয়ের নাম কি ছিল?
বাবলু। নমিতা দেবীর চোখের কোল দুটি অতীত স্মৃতির দোলায় ঝাপসা হয়ে ওঠে।
এমন সময় সহসা কিরীটী বাবলুকে সামনে টেনে এনে নমিতা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে, দেখুন তো, এই মেয়েটিকে আপনি চিনতে পারেন কিনা?
কে—কে? কে এই মেয়েটি? নমিতা দেবী অধীর আগ্রহে বাবলুকে বুকের ওপরে দু হাত বাড়িয়ে টেনে নিলেন।
পাগলের মতই তিনি মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ হাসি-কান্নায় যেন দুলে উঠলেন, এই তো, এই তো আমার মেয়ে। কোথায় পেলেন একে? বাবলুবাবলু সোনা।
মা–মা-মণি!
কিছুক্ষণ বাদে কিরীটী উঠে দাঁড়াল, আজ তাহলে আসি, নমিতা দেবী। আপনার স্বামীর পরিচয় শীঘ্রই আমি আনব। কিন্তু তার আগে, আপনাকে লেখা আপনার স্বামীর কোন চিঠি যদি আপনার কাছে থাকে, তবে সেটা দিলে আমার খুব সুবিধা হয়।
আছে—প্রথম দুখানা চিঠি এখনও আমার কাছে আছে। এখুনি এনে দিচ্ছি।