অবগুণ্ঠিতা – পরিচ্ছেদ ২১

২১.

বুকভরা উৎকণ্ঠায় অমিয়াদি ও ডাঃ বোস তখনও বাইরের ঘরের দুখানা সোফায় মুখোমুখি হয়ে জেগে বসেছিলেন।

রাত্রি তখন সাড়ে তিনটে বেজে গেছে।

সুব্রত দুহাতে রাণু ও বাবলু দুজনকে ধরে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল, অমিয়াদি!

কে? একসঙ্গে দুজনেই চমকে সামনের দিকে চোখ তুলে তাকালো।

এই নিন অমিয়াদি, আপনাদের রাণু!

অমিয়াদি আকুলভাবে মেয়ের দিকে দুহাত প্রসারিত করে দিলেন। রাণু একপ্রকার ছুটে এসেই মায়ের বুকের ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। মা, মা-মণি! অমিয়াদির চোখের কোল দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠল।

ডাঃ বোস প্রশ্ন করলেন, কেমন করে কোথায় ওকে খুঁজে পেলেন সুব্রতবাবু? আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে আজ আর ছোট করবো না!

ধন্যবাদ যদি দিতেই হয় ডাঃ বোস, তবে আমার বোন বাবলুকে দিন। বাবলু না থাকলে আজ রাণুকে উদ্ধার করা কোনমতেই সম্ভব হত না।

ডাঃ বোস এগিয়ে এসে বাবলুর মাথার ওপরে শুধু গভীর স্নেহে একখানা হাত রাখলেন, কী আর বলবেন তিনি! সকল ভাষা আজ যেন তার কৃতজ্ঞতার বন্যায় ভেসে গেছে।

অনেক রাত হয়েছে। ওদের শুতে নিয়ে যান অমিয়াদি। সুব্রত বললে, এখন আমি যাই, কাল সকালে এসে সব কথা খুলে বলব। হাতে আমার অনেক কাজ বাকি।

ডাঃ বোস বললেন, এই শেষরাত্রে আর আপনি নাই বা গেলেন সুব্রতবাবু। আপনার শরীরের ওপর দিয়ে তো কম ধকল যায়নি। বাকি রাতটুকু এখানে শুয়েই বিশ্রাম করে নিন।

অমিয়াদিও বললেন, সেই ভাল সুব্রত। আজ রাত্রে কোথায় যেও না।

গুরু পরিশ্রমে সুব্রতর শরীরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আপাতত খানিকটা বিশ্রামের বিশেষ প্রয়োজন। তাই সে রাজী হয়ে গেল।

বাবলু আর রাণুকে শুইয়ে সুব্রতর বিছানা পেতে দিয়ে গেলেন অমিয়াদি। সুব্রত শয্যার ওপরে গা এলিয়ে দিল।

***

সকালবেলা হাত-মুখ ধুয়ে চা খেয়ে সুব্রত বের হতে যাবে, সহসা বাবলু পিছন থেকে সুব্রতকে ডাকল, দাদা!

সুব্রত ফিরে দাঁড়াল। সামনেই একান্ত কুণ্ঠিতভাবে বাবলু দাঁড়িয়ে।

কে, বাবলু? আমাকে কিছু বলবে ভাই?

হ্যাঁ! আমাকে আপনি সঙ্গে নিয়ে চলুন দাদা!

সুব্রত আশ্চর্য হয়ে গেল, কেন? তোমার কি এখানে থাকতে কোন কষ্ট হচ্ছে মণি?

না, মা আমাকে খুব ভালবাসেন।

তবে তুমি যেতে চাইছ কেন ভাই?

বাবলু কুণ্ঠিতভাবে ইতস্তত করতে লাগল।

বল, তোমার কি কোন কষ্ট হচ্ছে?

না দাদা, এঁরা সবাই আমাকে খুব ভালবাসেন। রাণুদি বোধ হয় চায় না যে, তাদের বাসায় আমি থাকি। রাণুদির কোন দোষই নেই দাদা। সে হয়তো চায় না, তার মা-বাবার স্নেহে অন্য কেউ ভাগ বসাক। আমিও হয়তো চাইতাম না। আমারও খুব ইচ্ছা ছিল না, যতক্ষণ না আপনি আমার মাকে খুঁজে দেন, এখান হতে অন্য কোথাও যাই। কিন্তু গতরাত্রের সমস্ত ব্যাপারই তো আপনি দেখেছেন দাদা, তবু আমি চাই না যে আপনি রাণুদির মা-বাবাকে রাদি সম্বন্ধে কোন কথা বলেন। সব কথা শুনলে হয়তো রাণুদিকে তারা বকাবকি করবেন। আমার মাকে যদি সত্যি খুঁজে দিতে পারেন, তবে আমি তার কাছেই যাব। আর যদি তাকে খুঁজে নাই পাওয়া যায়, আমি অন্য কোথাও চলে যাব। আমি এখান থেকে চলে গেলেই আর রাণুদির কোন দুঃখ থাকবে না। আর সে কষ্টও পাবে না মনে। সে সুখী হবে।

বাবলুর কথাগুলি শুনে সুব্রত বিস্ময়ে ও শ্রদ্ধায় যেন থ হয়ে গেল। এতটুকু মেয়ের এতখানি ঔদার্য! এ শুধু অভাবনীয় নয়, অপূর্ব!

সস্নেহে সুব্রত বাবলুকে কোলের কাছে টেনে নিল। তারপর তার রুক্ষ চুলগুলিতে গভীর স্নেহে হাত বুলোত বুলোতে বলল, আমি সব বুঝেছি বাবলু। আজকের দিনটা তুমি এখানে থাক। কাল সকালে এসে তোমাকে আমি এ বাড়ি থেকে নিয়ে যাব।

বাবলু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

বাবলুর মাথায় নীচু হয়ে একটা গভীর স্নেহে চুম্বন করে মুখ তুলতেই সুব্রত দেখল, কখন একসময় রাণু এসে দরজার ওপরে দাঁড়িয়েছে। ওরা দুজনে কেউই তা লক্ষ্য করেনি।

সুব্রত মুখটা বাবলুর দিক থেকে ফিরিয়ে নিল। তারপর বাবলুর দিকে চেয়ে বলল, বাড়ি থেকে কোথাও কার সঙ্গে কিন্তু বেরিও না বাবলু। আমি বিকেলে এসে তোমাকে নিয়ে যাব।

***

সেইদিন দ্বিপ্রহরে সুব্রত কয়েকজন লালপাগড়ী ও তালুকদারকে নিয়ে চিৎপুরের বাড়িটায় হানা দিল।

কিন্তু সমস্ত শূন্য বাড়িটা খাঁ-খাঁ করছে। কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই। সন্ধ্যার দিকে সুব্রত কিরীটীর সঙ্গে দেখা করতে গেল।

কিরীটী নিজের শয়নঘরে একটা সোফার ওপরে কাত হয়ে শুয়ে একখানা কেমিস্ট্রি বই পড়ছিল। সুব্রতর পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকাল, সু যে!

সুব্রত ক্লান্তভাবে একটা সোফার উপরে গা এলিয়ে দিয়ে বললে, হ্যাঁ।

তারপর এতদিন ড়ুব দিয়েছিলি কোথায়? ফোন করে করেও তোর পাত্তা পাই না! ব্যাপার কী?

গিয়েছিলাম অতীতের অন্ধকারে ড়ুব দিয়ে অতীতের ইতিহাস মন্থন করতে। …কিন্তু সে অনেক কথা, তার আগে শুনতে চাই তুমি কতদূর এগুলে।

শরীরটা আজ কয়েকদিন খারাপ। ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে। কোথাও বের হতে পারিনি। তবে মনে মনে কদিন ছ কেটেছি।

কোন suggestion?

কিরীটী মৃদু হাসলে, হ্যাঁ, কিছু আছে। কিন্তু একটা জায়গায় এসে আমার সমস্ত সূত্রগুলি যেন কেবল জট পাকিয়ে যাচ্ছে। খুনী কে আমি তা জানি সুব্রত।

জানো?

হ্যাঁ।

কে? সুব্রতর কণ্ঠস্বরে একরাশ উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে। উত্তেজনায় ও অধীর হয়ে ওঠে।

কিরীটী ধীর সংযত কষ্ঠে আশ্বাস দেয়, দাঁড়া, ব্যস্ত হোসনে। খুনী কে, সেটা তো শুধু জানলেই হবে না! একটা হাইপথেসিস মাত্র। সমগ্র থিওরিটা শূন্যে একটা নেবুলার মত পাক খেয়ে ফিরছে মাত্র।মোটিভটা যেন কোনমতেই খাপ খাওয়াতে পারছি না। দ্যাখ, একটা কাজ করতে পারি?

কী? সুব্রত উৎসুক ভাবে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।

সরকার ফ্যামিলির কোন অতীত ইতিহাস আছে কিনা তলে তলে একটা খোঁজ নিতে পারিস? আমার মনে হয় পুকুরের তলায় অনেক পচা কাদা জমে আছে!

তবে শোন! সুব্রত ধীরে ধীরে এই কদিনের সমগ্র ব্যাপারটা আগাগোড়া কিরীটীর কাছে খুলে বলে গেল।

সুব্রতর কথা শুনতে শুনতে কিরীটীর মুখের ওপরে নানা ভাব-বৈচিত্র্যের রঙ খেলে বেড়াতে লাগল।

সুব্রতর কাহিনী শেষ হলে কিরীটী চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, হয়েছে! পেয়েছি। প্রায় সমস্ত সমস্যারই মীমাংসা হয়ে গেল সু। কেবল সামান্য দুচারটে তথ্য আবিষ্কার করতে পারলেই খুনীকে আমরা হাতেনাতে ধরে ফেলবো! খাচ্ছিল তাঁতী তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে।

কিন্তু কথা বলতে বলতে সহসা যেন কিরীটীর ভাব-পরিবর্তনে সুব্রতও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করলে, কী হল?

কিরীটী তখন গম্ভীরভাবে হাত দুটো পশ্চাতের দিকে পরস্পর মুষ্টিবদ্ধ করে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করেছে। সুব্রতর কথার কোন জবাবই দিল না সে।

সুব্রত বুঝলে, কিরীটী কোন বিশেষ কারণেই বিশেষ চিন্তান্বিত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ আপন মনেই যেন কিরীটী বিড়বিড় করে বলতে লাগল, শেষ পর্যন্ত—শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা তাহলে এই দাঁড়াল! কিন্তু… কিন্তু….

অনেকক্ষণ বাদে আবার কিরীটী এক সময় সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, বাবলুকে না-হয় আজই আমার বাড়িতে রেখে যা সু। সাবধানের মার নেই। আর কাল সকালে সর্বাগ্রে আমাদের মিঃ সরকারের অ্যাটর্নীর কাছে যেতে হবে। হ্যাঁ  ভাল কথা, মিঃ সরকারের ঘর দুটো লক আপ করা আছে তো?

হ্যাঁ।

কাল রাত্রে ছোট্ট একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে।

কোথায়?

মিঃ সরকারের বাড়িতে।

বেশ।

তুই বাবলুকে নিয়ে আয় এখুনি।

সুব্রত উঠে দাঁড়াল।