১৮.
বাবলুকে অমিয়াদির কাছে রেখে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হয়েই সুব্রত এসে ট্যাক্সিতে উঠে বসল এবং ট্যাক্সিওয়ালাকে লালবাজার থানার দিকে গাড়ি ছোটাতে বললে। থানায় এসে যখন ও পৌছাল বেলা তখন প্রায় এগারোটা। নিজের বসবার ঘরে ঢুকে প্রথমেই তালুকদারকে ডেকে পাঠাল। একটু পরেই তালুকদার এসে ঘরে প্রবেশ করল।
এই যে তালুকদার! কালকের সেই আসামীরা ধরা পড়ে ছিল তো?
া, তারা চারজনেই হাজত ঘরে বন্দী আছে।
তাদের এই ঘরে আনাও তো। লোকগুলোকে একবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই।
তালুকদার ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে একজন সার্জেন্টকে আসামীদের সুব্রতর ঘরে হাজির করতে বলে এল।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই দুজন পুলিস আসামী চারজনকে নিয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
সুব্রত তখন একটা কাগজের ওপরে কী যেন লিখছিল। কলমটা টেবিলের ওপরে একপাশে নামিয়ে রেখে চোখ তুলে তাকাতেই বিস্ময়ে সে যেন হাঁ হয়ে গেল। এ কি! এরা কে? এদের কোথা থেকে ধরে আনলে?
চারজন কুলীমজুর লোক, অতি মলিন ছিন্ন বসন পরিধানে।
তালুকদার বললে, কেন, এদেরই কাল ধরে আনা হয়েছে!
হেড কনেস্টবল রমজান কোথায়? তাকে ডাক। সে-ই কাল সেখানে ছিল।
রমজানকে ডেকে আনা হল। রমজান বললে, এই চারজন লোককেই গতকাল রাত্রে চীৎপুরের বাড়িতে বন্দী অবস্থায় পাওয়া গেছে। লোকগুলোকে নানাভাবে প্রশ্ন করেও সুব্রত। কিছুই বুঝতে পারলে না। সে স্পষ্টই বুঝতে পারল সত্যিকারের আসল আসামীরা কোন গুপ্ত উপায়ে সরে গিয়ে প্রকাণ্ড চাল চেলেছে সুব্রতকে জব্দ করবার জন্য। নিশ্চয়ই ঘরের মধ্যে কোথাও গুপ্তদ্বার ছিল, যার সাহায্যে ওরা সরে পড়ে এই লোকগুলোকে তাদের জায়গায় রেখে গেছে। উঃ, কী শয়তান! কী ধড়িবাজ! কী জব্দই না করেছে তাকে!
সুব্রত লোকগুলোকে আপাতত হাজতেই বন্দী করে রাখতে বললে। সার্জেন্ট বন্দীদের নিয়ে চলে গেল।
কী করবে এখন সে? কোন্ পথ ধরে এগুবে?
আজই আর একবার সে বাড়িটা গোপনে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখতে হবে। বাড়িটার কোথায় কোন্ রহস্য গোপন হয়ে আছে, তার সব সন্ধান তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
দ্বিপ্রহরের দিকে সুব্রত রাজলক্ষ্মী মিলের অফিসে সুবিমল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে গেল।
সুবিমলবাবু তার অফিসঘরে বসে কতকগুলো কাগজপত্র সই করছিলেন। সুব্রত ডোর-স্ক্রিন ঠেলে অফিসঘরে ঢুকতেই কাগজপত্র থেকে মুখ না তুলেই বললেন, আসুন!
সুব্রত একখানা চেয়ার অধিকার করে বসল। এক মিনিট—এই কাগজপত্রগুলো সই করে নিই, তারপর আপনার সঙ্গে কথা বলব।
মিনিট দশেকের মধ্যেই সুবিমলবাবুর কাজ শেষ হয়ে গেল। ঘন্টি বাজালেন। বেয়ারা এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল।
বেয়ারার হাতে কাগজপত্রগুলো তুলে দিয়ে সুবিমলবাবু বললেন, এগুলো ডেসপ্যাচ ক্লার্ককে দিয়ে এস।
বেয়ারা কাগজপত্রগুলো নিয়ে সেলাম জানিয়ে চলে গেল।
তারপর কী সংবাদ বলুন? আপনার তদন্ত কত দূর এগুলো?
এগুচ্ছে ধীরে ধীরে। মৃদুভাবে সুব্রত জবাব দিল।
কেষ্টার একটা কিনারা হবে বলে আপনার মনে হয় সুব্রতবাবু?
নিশ্চয়ই।
সেদিন আপনি সরকারবাড়ির সকলেরই জবানবন্দী নিয়েছিলেন সুব্রতবাবু?
হ্যাঁ।
সৌরীনকে কী রকম মনে হল?
সাধারণ। একটু বেশীরকম নার্ভাস। দোষী বলে তাকে একটুকুও আমার সন্দেহ হয় না।
হয় না? কেন?
ক্ষমা করবেন মিঃ চৌধুরী, কেন তা আপনাকে আমি বর্তমানে বলতে পারব না।
তাহলে নিশ্চয়ই আপনি অন্য কাউকে দোষী বলে সন্দেহ করেন!
হয়তো তাই।
আমাকে কী?
এমন কথা আমি নিশ্চয়ই আপনাকে বলিনি, মিঃ চৌধুরী!
মিঃ চৌধুরী হঠাৎ হেসে ফেললেন, যাক্, কতকটা তবু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। তারপর এখন বলুন দেখি, হঠাৎ আমার কাছে আপনার কী বিশেষ প্রয়োজন হল?
শুনুন মিঃ চৌধুরী, আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন আমি করতে চাই। আশা করি সোজা ভাবেই জবাবগুলো দেবেন।
মৃদু হেসে মিঃ চৌধুরী বললেন, শোনাই যা!
শুনুন মিঃ চৌধুরী, সেদিন আপনার দেওয়া ঠিকানামত আপনার আর্টিস্ট বন্ধু মিঃ সুবোধ দত্তর সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছিলাম।
তাই নাকি? তারপর? বেশ লোকটি, না?
হ্যাঁ, বেশই বটে। তবে মনে হল, গভীর জলের মাছ। সহজে ধরা দিতে চান না।
হ্যাঁ, আর্টিস্ট মানুষ কিনা! একটু খেয়ালী চিরদিনই। তারপর কী সে বললে?
অনেক কিছুই বললেন—যাতে বেশ আশ্চর্যই হতে হয়েছে আমাকে। প্রথমেই তো তিনি বললেন, তিনি জীবনে কোন দিনই আপনাকে ও ধরনের ডি ভায়োলেট কালি উপহার দেননি! জীবনে কোনদিনই তিনি চীনে যাননি!
এতে আশ্চর্য হচ্ছি না আমি এতটুকুও সুব্রতবাবু!
কেন? লোকটা ভয়ানক মিথ্যেবাদী না কী?
না, সে মিথ্যুক কিনা তা আমি জানি না।
কিন্তু একথা আপনি নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারেন না মিঃ চৌধুরী যে, আপনি বলেছিলেন সেদিন আপনারই জবানবন্দীতে, মিঃ দত্তই আপনাকে কালিটা দিয়েছিলেন!
সত্যি কথাই সেদিন আমি আপনাকে বলেছিলাম, সুব্রতবাবু। সেদিন আপনাকে যখন ও কথাগুলো বলি, তখন সব কথা আপনাকে খুলে বলা প্রয়োজন মনে করিনি।
শুনতে পারি কি, কেন প্রয়োজন মনে করেননি? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুব্রত সুবিমলবাবুর মুখের দিকে তাকাল।
সুবিমলবাবু কিছুক্ষণ মৌন হয়ে বসে রইলেন। তারপর ধীর সংযত কণ্ঠে বললেন, বলিনি তার কারণ ব্যাপারটা অতি সামান্য। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, ঘটনাটাকে কেন্দ্র করে আপনার মনে সন্দেহ জেগেছে। সুবোধের এক বন্ধু চীন থেকে কালিটা নিয়ে আসে এবং সে সুবোধকে কালিটা দেয়। তাকে ঐ কালিতে কয়েকটা জাপানী স্কেচ করে দেবার জন্য। সুবোধের সেই বন্ধুটি একজন খেয়ালী জমিদার। সুবোধ বন্ধুর প্রস্তাবে রাজী হয়। কিছুদিন বাদে তার প্রতিশ্রুতিমত। কয়েকখানা ছবি ঐ কালিতে এঁকে দেয়। সুবোধের বন্ধুর মতলব ছিল আলাদা। সে সেই। ছবিগুলো চীনের কোন শিল্পীর কাছে চড়া দামে বিক্রি করে এবং চীনের সেই শিল্পীটি আরও কতকগুলো ছবি চেয়ে পাঠায় সুবোধের বন্ধুর কাছে।
সুবোধ কিন্তু ব্যাপারটা কোন রকমে আগাগোড়া জানতে পারে। এইখানে একটা কথা আছে। একটা বেদনার্ত ইতিহাস। আসলে যার জন্য ব্যাপারটা আপনাকে বলিনি। কোন এক সময় সুবোধের ঐ জমিদার বন্ধুটি সুবোধকে অর্থ দিয়ে নানাভাবে সাহায্য করেছিল। সুবোধরা দুটি ভাইবোন। ওর বোন নমিতার বয়স যখন পাঁচ, ওর বয়েস আঠারো, ওদের মা-বাবা মারা যান। এক ঘণ্টার ব্যবধানে এসিয়াটিক কলেরায়। সুবোধের পিতা হারাধনবাবু কলকাতা কর্পোরেশনের সামান্য পঁয়ত্রিশ টাকা মাইনের কেরানী ছিলেন। কাজে কাজেই যা তিনি উপায় করতেন তা ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোতো না।
পিতার মৃত্যুর পর সুবোধকে এক প্রকার বাধ্য হয়েই ছোট বোনটির হাত ধরে পথের ওপর এসে দাঁড়াতে হল। কেননা তার ধনী আত্মীয়-স্বজনরা সকলেই ওই হতভাগ্য পিতৃ-মাতৃহারা ভাইবোন দুটিকে এতটুকু কৃপাদৃষ্টি থেকেও বঞ্চিত করলেন।
দুটো বসর সুবোধ বহু কষ্টে বোনটিকে নিয়ে একটি ভোলার ঘরে কাটায়। ঐ সময় সুবোধের ঐ ধনী জমিদার খেয়ালী বন্ধুটির সঙ্গে পরিচয় হয় এবং ঐ ধনী বন্ধুটির সাহায্যেই সুবোধ আর্ট স্কুলে প্রবেশাধিকার পায়। ক্রমে নিজের সাধনার দ্বারা সুবোধ যখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, ওর বোন নমিতার খুব একটা বড় রকম অসুখ হয়। বোন একটু সুস্থ হলে ও বোনকে নিয়ে শিমূলতলায় বেড়াতে যায়।
মাসতিনেক বাদে ও যখন বোনকে নিয়ে ফিরে এল, দেখলাম, ওর বোনের সিঁথিতে সিন্দুর। কিন্তু শিমুলতলা থেকে ফেরা অবধি সুবোধ যেন কেমন হয়ে গেল। আমার সঙ্গে পর্যন্ত ও সমস্ত সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেললে।
কানাঘুষায় একদিন সংবাদ পেলাম সুবোধের বোনের একটি মেয়ে হয়েছে হাসপাতালে। সেই মেয়েটির যখন বছর ছয়েক বয়েস, হঠাৎ মেয়েটিকে কারা চুরি করে নিয়ে গেল। সেই থেকে সুবোধ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। কারও সঙ্গে দেখা হলেও কথা বলে না।
যাই হোক, ঐ সময় বছরখানেক সুবোধের অবস্থা আবার খুব খারাপ হয়ে যায়। আবার সুবোধের জমিদার বন্ধুটি এগিয়ে আসে এবং একটি গার্লস স্কুলে নমিতাকে চাকরি দেয়। আজও নমিতা সেই স্কুলেই চাকরি করছে। এখন ঐ সব কারণেই সুবোধ বন্ধুর ছবি বিক্রির কথা জেনেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়।
আরও একটা মজার কথা, সুবোধের বন্ধুটি সুবোধের আঁকা ছবিগুলি নিজের নামে আঁকা বলে বিক্রি করেছিল। তাতে সুবোধ খুব বেশী মর্মাহত হয় এবং জগতে তার যত বন্ধু ছিল সকলের উপর চটে যায়। অথচ সেই বন্ধুটি যখন আবার ছবির জন্য বললে, ও ভেবে পেলে না যে কি করবে। একদিকে নিজের বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা, অন্যদিকে বন্ধুর বন্ধুত্বের দাবিতে বিশ্বাসঘাতকতা—দুয়ে বাধল সংঘর্ষ।
এমন সময় হঠাৎ একদিন তার বাড়িতে আমি যাই। কথায় কথায় ও বলে, সুবিমল, তুই কালিটা নিয়ে হ্যাঁ। তাকে বলবো, কালি ফুরিয়ে গেছে, তাই ছবি আঁকতে পারলাম না। আমি কালির শিশিটা নিয়ে আসি।
এরই দিন দুই পরে ওর বোনের চাকরিটা যায়। আমাদের অফিসে একজন লেডি ক্লার্কের পদ খালি ছিল। সুবোধের অবস্থা আমি জানি, তাই তাকে বলেছিলাম তার বোনকে আমাদের অফিসে ঢুকিয়ে দিতে। তাতে সে ভয়ানক চটে উঠল এবং বললে, আর বন্ধুদের পরামর্শ নয়— একজন বন্ধুত্বের মুখোশ পরে এসে অভাগিনী বোনটিকে বিবাহ করে গা-ঢাকা দিল। একটা মেয়ে ছিল, তবু বোনটার সান্ত্বনা, সেও চুরি গেল। তারপর আর এক ধনী বন্ধু আমার আঁকা ছবি নিজের নামে বিক্রি করল। আর বন্ধুদের সাহায্য আমি চাই না। যথেষ্ট হয়েছে। বেরিয়ে যাও তুমি আমার বাড়ি থেকে!
তার ঐ অভদ্র ব্যবহারে আমি গেলাম চটে। দুজনে রাগারাগি হল। আমি চলে এলাম। এসব ব্যাপার ঘটেছে আজ প্রায় মাস-সাতেক আগে। ঐ ঘটনার পর আর আমাদের পরস্পরের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। কেউ কারও সঙ্গে দেখা হলেও কথা বলি না।
সুবিমলবাবু চুপ করলেন।
সুব্রত সুবিমলবাবুর কথা শুনতে শুনতে ভিতরে ভিতরে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। একটা অন্ধকার রহস্যের যবনিকা যেন একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। একটা সন্দেহ মনের কোণে জট-পাকানো ছিল—তবে কি বাবলুই সেই হারানো মেয়ে? তাই যদি হবে, তবে বাবলুর সঙ্গে মিঃ সরকারের খুনের সম্পর্ক কী?
হঠাৎ একটা আলোর রেখা যেন অন্ধকারের বুকখানাকে ঝলসে দিয়ে গেল—পেয়েছি,
পেয়েছি!
এমন সময় সুবিমলবাবু আবার প্রশ্ন করলেন, কী ভাবছেন সুব্রতবাবু?
ভাবছি আপনার কথা যদি সত্যিই হয়, তবে কে চিঠিটা লিখল আমাকে?
তা যদি জানতাম, তবে সেকথা সেদিনই আপনাকে আমি বলতাম সুব্রতবাবু!
সুব্রত যখন সুবিমলবাবুরর কাছে থেকে বিদায় নিল, বেলা তখন প্রায় সাড়ে চারটে। অফিসের সর্বে ছুটি হতে শুরু করেছে।