অবগুণ্ঠিতা – পরিচ্ছেদ ১৭

১৭.

বাবলুকে অমিয়াদির বাসায় নিরাপদে রেখে সুব্রত চলে গেল।

স্নেহান্ধ জননীর প্রাণ মুহূর্তেই চিরদুঃখিনী মেয়েটিকে তার হৃদয়ের স্নেহ দিয়ে আপনার করে টেনে নিল।

টুলটুলের কাছে বাবলুর সংবাদ পেয়ে রাণু পড়া ফেলে বাবলুকে দেখতে এল।

একটু বেশি বয়সে রাণু হওয়ায় মা বাপের স্নেহ সে একটু বেশি করেই পেয়েছিল।

তাছাড়া ছোট বয়স থেকেই চিররুগণা থাকায় অমিয়াদি তার অন্য দুটি সন্তানের চেয়ে রাণুকে বেশি ভালবাসতেন।

ক্রমে যখন আরও দুটি ছোট ছোট বোন এসে রাণুর মায়ের স্নেহের একাধিপত্যে ভাগ বসালে, রাণু সেটা মোটেই সুনজরে দেখেনি।

মা যদি কখনও তার অন্য সন্তানদের কোলে নিয়ে আদর করতেন, রাণু সেটা মোটেই সহ্য করতে পারত না। কান্নাকাটি বাধিয়ে দিত। বাধ্য হয়েই মাকে ফিরে রাণুর দিকেই নজর দিতে হত। এক কথায় রাণুর মনটা ছিল একটু বেশি রকম একলসেঁড়ে ও হিংসুক প্রকৃতির।

তার মায়ের আদরে কেউ ভাগ বসাচ্ছে, এটা সে আদপেই সহ্য করতে পারত না।

মাও মেয়েকে বেশি কিছু বলতেন না। একে সে চিররুণা, তার উপর বিশেষ খেয়ালী।

সেই রাণু যখন টুলটুলের মুখে শুনল, কে একজন উড়ে এসে তার মায়ের কোল জুড়ে বসেছে, হিংসায় রাগে সে ফুলতে ফুলতে বই ছড়িয়ে ফেলে নীচে ছুটে এল।

বাবলু তখন তার মায়ের কোলে বসে গল্প করছে।

দূর থেকে বাবলুকে তার মায়ের কোলে বসে থাকতে দেখে রাগে রাণু ফুলতে লাগল। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে বললে, মা, ও কে?

মা মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন।

রাণুর চাইতে বাবলু অনেক বেশি সুন্দর দেখতে। হাজার অযত্ন ও দুঃখকষ্টের মধ্যে মানুষ হলেও, তার স্বাভাবিক একটা সৌন্দর্যের দ্যুতি ছিল—যা তাকে করে তুলেছিল রমণীয়তায় ঢলঢল। তার ওপর আবার সদ্য ক্রীত নতুন পোশাকে যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল।

রাণুর চেহারা রোগা লিলিকে। গায়ের রং কালো, মাথার চুল ব করে কাটা। তাছাড়া, তার সহজাত হিংসার প্রবৃত্তি তার মুখের সমস্ত শিশুসুলভ কমনীয়তাটুকু যেন নিঃশেষে শুষে নিয়ে তাকে করে তুলেছিল রুক্ষ ও কঠিন।

মানুষের মনটাই হচ্ছে তার আসল রূপ? সেই আসল রূপ যার যেমন, বাইরের চেহারায়, বিশেষ করে মুখের ভাবে, সেইটাই ফুটে উঠে।

মেয়ের চিৎকারে মা মুহূর্তে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিমেষে বুঝে নিলেন মেয়ের চিৎকারের কারণটা কী?

তিনি সস্নেহে রাণুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আয় রাণু! এই দেখ কেমন সুন্দর তোের একজন খেলার সাথী এসেছে। এর নাম বাবলু।

রাণু তীব্ৰদৃষ্টিতে একবার মার মুখের দিকে, পরক্ষণেই অগ্নিগর্ভ দৃষ্টিতে বাবলুর মুখের দিকে তাকিয়ে দুমদুম করে আবার তখুনি উপরে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে।

অমিয়াদি বললেন, পাগলী মেয়ে! ওর ধারণা—ওর মার স্নেহ ও ভালবাসা সবটুকু অন্যে ছিনিয়ে নিল, ওর ভাগে কিছুই আর অবশিষ্ট রইল না!

***

সন্ধ্যা হওয়ার আর তখন খুব বেশী দেরি নেই। বাবলু ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়েছিল। বিলীয়মান সূর্যের অস্তরাগে আকাশ রাঙা হয়ে আছে। সামনের দেশবন্ধু পার্কে কত ছেলেমেয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ কার মৃদু স্পর্শে বাবলু চমকে ফিরে তাকাল। দেখল ঠিক তার পিছনেই দাঁড়িয়ে রাণু।

চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে তার একটা ঘোর বিতৃষ্ণার ভাবশ

একটা অবরুদ্ধ ক্রোধ ও হিংসা যেন আগুনের শিখার মতই তার সমগ্র মুখখানি ব্যেপে আছে—

বাবলু সহসা যেন অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে ছাদের প্রাচীর ঘেঁষে সরে দাঁড়াল। রাণু তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ বাবলুর মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বললে, তোমার নাম বাবলু?

হ্যাঁ। ঢোক গিলে কোনমতে বাবলু সভয়ে শব্দটা উচ্চারণ করলে।

তুমিই বুঝি আমার জায়গা দখল করতে এসেছ? আমার মার ভালবাসার ভাগীদার হতে এসেছ?

না, না। তুমি ভুল বুঝছ রাণু। আ—আমি…

থাম্‌। চুপ কর রাক্ষসী! আমি জানি, কেন তুই এসেছিস? কিন্তু শোন বাবলু হবে না। কখনই তা হতে দেব না আমি। তোর মা থাকে ভাল, তারই কাছে চলে যাবি। আর না থাকে তো যেখানে খুশী তুই চলে হ্যাঁ। এখানে তোর থাকা হবে না। শুনতে পাচ্ছিস কালামুখী, পেত্নী! এ বাড়িতে তোর থাকা হবে না। আর যদি তুই আমার কথা না শুনিস, তবে তোকে খুন করে ফেলব। আমার মাকে তুই ভালবাসতে পারবি নে—পারবি নে!

বলতে বলতে ঝড়ের মতই একপ্রকারে দৌড়ে রাণু নীচে নেমে গেল। আর বাবলু! তার। দুই চোখের কোল বেয়ে তখন দরদরধারায় অশ্রু নেমে এসেছে। সহসা সে ছাদের ওপরে লুটিয়ে

পড়ল।

কেন—কেন তাকে দাদা এখানে রেখে গেল? সে এখন কী করবে?

ক্রমে একটু একটু রাত্রি ঘনিয়ে আসতে লাগল। কিন্তু বাবলুর কান্না যেন আর শেষই হয় না। অভিমানে ব্যথায় তার ছোট্ট কচি বুকখানা যেন ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে।

তখন চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। মাথার উপরে কালো আকাশটার বুকে তারাগুলো সোনার প্রদীপের মত পিটুপি করে জ্বলছে।… মা গো কোথায় তুমি? কোন্ দূর দেশে? ঐ আকাশের তারাগুলোয় মাঝখানে কি তুমি লুকিয়ে আছ মা-মণি! এত তোমাকে ডাকি, সাড়া দাও না কেন? তোমার বাবলু যে এত তোমাকে ডাকছে তা কি শুনতে পাও না–মণি!

কাঁদতে কাঁদতে কখন একসময় সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ কার মৃদু সস্নেহ স্পর্শে ও চোখ মেলে তাকাল। চোখের কোলে তখন তার অশ্রুর ভিজা আভাস।

বাবলু–বাবলু সোনা! এখানে এমনি করে ঘুমিয়ে কেন মা? অমিয়াদি বাবলুকে দুহাত বাড়িয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন।

বাবলু অমিয়াদিকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল—মা!

কি হয়েছে সোনা? কাদছ কেন কাঁদছ কেন? চল খাবে চল। আমি তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজে হয়রান!