অবগুণ্ঠিতা – পরিচ্ছেদ ১৪

১৪.

মেয়েটি সুব্রতর দরদপূর্ণ সাদর ব্যবহারে বিস্ময়ে একেবারে হকচকিয়ে গেছে। এ শুধু অজানিতই নয়, অভাবিতও।

সে তো কোনদিনই কারও কাছে এতখানি মধুর ব্যবহার পায়নি। তার শিশুচিত্তের ব্যথা বেদনাতে কেউই তোদরদের সোনার কাঠি ছোঁয়ায়নি।

যেদিন থেকে তার সামান্য জ্ঞান হয়েছে, ও পেয়ে এসেছে শুধু নিষ্ঠুর কঠিন ব্যবহার। পেয়েছে শুধু উঠতে-বসতে, খেতে-শুতে তিরস্কার আর তিরস্কার। নিত্য প্রহার আর শত লাঞ্ছনার অশ্রুজলে তার প্রতিটি দিনরাত্রির কাব্যখানি ভরা।

তার অন্ধকারময় জীবনযাত্রাপথে কেউ তো মণিদীপ জ্বেলে সান্ত্বনার প্রলেপ বুলোয়নি।

তাই তো আজ সুব্রতর ব্যবহারে ওর সদা-শঙ্কিত শিশুচিত্ত বিস্ময়ে কেমন আত্মহারা হয়ে গেছে।

ঐ চেয়ারটায় বসো খুকী!

মেয়েটি কিন্তু চেয়ারে বসল না। তার মলিন ছিন্ন বেশভূষার দৈন্য যেন এই সুখ-ঐশ্বর্যের– মণিকোঠায় তাকে আরও বেশি কুণ্ঠিত করে ফেলেছে। সে নীরবে মাথা হেলিয়ে বসতে অস্বীকার করে বললে, আমার নাম ক্ষেন্তী। ওরা মাঝে মাছে আমাকে পেত্নী বলেও ডাকত।

সুব্রত এবারে হাত ধরে এনে মেয়েটিকে একখানা সোফার ওপরে বসিয়ে দিল।

মেয়েটি যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে জড়োসডো হয়ে বসল। কুণ্ঠাতে যেন তার রুগণ দেহখানি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যেতে চায়।.চিরকাল সে দাঁড়িয়ে থেকেছে।

রাত্রে স্যাতস্যাতে অন্ধকার ঠাণ্ডা ঘরের মেঝেতে আরশোলা ও ইদুরের সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে একটা ছেড়া চটের ওপরে শুয়ে শুয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছে।

এই বিলাস-ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য তার স্বপ্নের অগোচরে ছিল চিরদিন। চোখের কোল দুটি তার অকারণেই যেন জলে ভরে আসতে চায়।

কেন যেন খালি কান্না পাচ্ছে। একটা অহেতুক ভয়, একটা অজানিত আশঙ্কা যেন তার সমগ্র শিশুচিত্তটিকে সন্দেহের দোলায় দোলাচ্ছে।

কী করবে ও? উঠে পালিয়ে যাবে?

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে না তো ও? যেমন করে মাঝে মাঝে রাত্রে সেই ছেড়া ময়লা চটের ওপরে একা একা শুয়ে স্বপ্ন দেখেছে কী সুন্দর তার চেহারা। লালপেড়ে শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা, ঘোমটার আড়ালে মমতাভরা দুটি চোখের সকরুণ চাউনি। ধীরে ধীরে তিনি এসে  ওর শয্যার পাশটিতে বসেছেন। তার নরম ঠাণ্ডা হাতখানি ওর আতপ্ত কপালের ওপরে গভীর স্নেহে ন্যস্ত করেছেন। মা-মাগো! তোমায় যে কেবলি মা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে মা। কেবলই আসো তুমি ঘুমের ঘোরে। জেগে উঠলে কেন তোমাকে দেখতে পাই না? কেন পাই না তোমাকে খুঁজে? কোথায় তুমি লুকিয়ে থাক? কোন্ রহস্যের পরপারে? কোন স্বপ্নের সোনার পালঙ্কে থাক তুমি ঘুমিয়ে? সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে ঐ দুর্দান্ত লোকগুলোর কথা। তাদের নিষ্ঠুর ব্যবহার, তাদের গালাগালি, তাদের চিৎকার। মার খেয়ে খেয়ে ওর সমস্ত দেহে ব্যথা হয়ে গেছে। শিউরে উঠে ও চোখ বুজে ফেলল। ও যেন শুনতে পাচ্ছে তারা চিৎকার করে বলছে, ক্ষেন্তী হারামজাদী, আজ তোকে মেরে খুন করবো!

সুব্রত কলিং বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডাকল।

বেয়ারা এসে সেলাম জানাল।

দুজনের খাবার নিয়ে এসো–কী খাবে তুমি খুকী?

মেয়েটি কাতর দৃষ্টি তুলে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।

কী খাবে? রসগোল্লা? সন্দেশ?

রসগোল্লা। সেটা কী?–মেয়েটা বোকার মতই যেন প্রশ্ন করলে।

সুব্রত বেয়ারাকে দোকান থেকে কিছু ভাল ভাল খাবার আনতে বললে। আরও বললে, ঘণ্টাখানেক বাদে ম্যানেজারকে ডেকে দিতে।

বেয়ারা সেলাম দিয়ে চলে গেল।

শোন খুকী, ক্ষেন্তী ছাড়া তোমার আর কোন নাম নেই?

মেয়েটি সুব্রতর প্রশ্নে আবার মুখ তুলে তাকাল।অনেকদিন আগে আমার একটা পুরোনো নাম ছিল।

কী নাম তোমার মনে নেই?

আছে। বাবলু।

বাবলু! বাঃ কী সুন্দর নাম।

কিন্তু ওরা তো আমাকে ও নামে ডাকত না। মেয়েটি ভয়ে ভয়ে বললে।

তা হোক, এখন থেকে তোমাকে সবাই ও-নামেই ডাকবে।

কেউ আমাকে ও নামে ডাকে না, ও নামটা আমি ভুলেই গেছি। কিন্তু মাঝে মাঝে রাত্রে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, কে যেন ঐ নামে চুপি চুপি কেবলই ডাকছে-বাবলু, সোনামণি! মেয়েটির চোখের কোল দুটি ছলছলিয়ে এল।

কতদিন তুমি ওদের ওখানে আছ, বাবলু? মনে পড়ে তোমার?

না—তা অনেক দিন। অনেকদিন আগে একদিন আমার মনে পড়ে আমি ঘুমিয়েছিলাম মার কাছে। জেগে উঠে দেখি ওদের বাসায় আমি কখন এসে গেছি। কত কাঁদলাম মা-মা করে, কিন্তু মা আর এল না, আর মাকে খুঁজে পেলাম না। ওই মোটা লোকটা—যে আমাকে মারছিল না, ওর নাম অবু সর্দার, ওকে অবু বলে ডাকে। অবু বললে : আমি একটা পেত্নী, পেত্নীর মা থাকে না। আমার মা কোনদিনই ছিল না।

অবু মিথ্যা কথা বলেছে বাবলু। তোমার মা নিশ্চয়ই আছেন। আমরা তাঁকে খুঁজে বের করবো। তুমি কিছু ভেবো না, কেমন?

সহসা বাবলুর মলিন মুখখানা যেন একটু আনন্দের খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। সে ব্যগ্রকণ্ঠে বললে, সত্যি পারবেন? সত্যি আমার স্বপ্নের মাকে খুঁজে দেবেন? আপনাকে তাহলে আমি খুব ভালবাসব। আপনার সব কথা শুনবো। আপনার সব কাজ করে দেবো।

না, বাবলু। আমার জন্য তোমায় কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু আমাকে ভালবেসো। আমি তোমার মাকে নিশ্চয়ই খুঁজে দেবে। কিন্তু যখন তুমি তোমার মাকে পাবে, আমাকে ভুলে যাবে না তো?

আপনাকে ভুলে যাব! না, কোনদিনও না। আপনি এত ভাল! আপনাকে আমি কি বলে ডাকব, বাবু?

জানো বাবলু, আমার ছোট বোন নেই তুমি আমার বোন হবে? আমাকে দাদা বলে ডাকবে?

হ্যাঁ, আপনি আমার দাদা।

দাদাকে তুমি ভালবাসবে তো বাবলু?

হ্যাঁ, খুব ভালবাসবো।

জানো বাবলু, আমার মা নেই।

আহা, আপনার নিশ্চয়ই তাহলে আমার মতই কষ্ট।

হ্যাঁ, কিন্তু আমার নিজের মা না থাকলেও আর একজন মা আছেন।

এমন সময় বেয়ারা ট্রেতে করে নানাপ্রকারের লোভনীয় খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল!

বাবলু, তোমার নিশ্চয়ই খুব ক্ষিদে পেয়েছে! তুমি তো কিছু খাওনি এস দুজনে খাওয়া যাক।

সুব্রতর কথায় বাবলু যেন সহসা অত্যন্ত সস্ত্রস্ত ও বিব্রত হয়ে উঠলো, না না, আমার এখন ক্ষিদে পায়নি দাদা। তাছাড়া রোজ রাত্রে তো আমি খেতাম না! আপনি খান দাদা।

তা কি হয় ভাই, এসো, আমরা দুজনে একসঙ্গে বসে খাব।

সুব্রত সস্নেহে বাবলুকে নিজের পাশে সোফার ওপরে এনে বসাল।

আমার কাপড়জামা ময়লা, দাদা। আপনার সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

তুমি কিছু ভেবো না বাবলু। আমার অনেক আছে। এস এখন খাওয়া যাক।

সুব্রত একটা রসগোল্লা বাবলুর ত্রস্ত কুণ্ঠিত হাতখানার ওপরে তুলে দিল, নাও, খাও। ধীরে। ধীরে অতি সংকোচের সঙ্গে বাবলু খেতে শুরু করে।

কেমন লাগছে খেতে বাবলু?

খুব ভাল।

সুব্রত ধীরে ধীরে বাবলুর সংকুচিত ভীত শিশুচিত্তকে নিজের সস্নেহে ব্যবহারে নিজের দিকে টেনে নিতে লাগল। একটু একটু করে তার মনের বিশ্বাস আনতে লাগল। সুব্রত স্পষ্টই বুঝতে পারছিল, বাবলুর শিশুচিত্তের মধ্যে এমন একটা সংকোচ ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে যেটা দূরীভূত করতে সময়ের প্রয়োজন। আজ তার কাছ থেকে ও যা ব্যবহার পাচ্ছে, এ শুধু তার কাছে অসম্ভবই নয়, অভাবিত। স্নেহ ও দরদ দিয়ে ওর শিশুচিত্তকে জয় করতে হবে। অল্পে অল্পে বাবলু যে তার স্নেহের সিঞ্চনে পুনর্জীবিত হয়ে উঠেছে তাতেও কোন সন্দেহ নেই।

খাওয়া হয়ে গেল। সুব্রত বাথরুমে হাতমুখ ধুতে গেল।

হাতমুখ ধুয়ে ফিরে এসে ও দেখে বাবলু সযত্নে উচ্ছিষ্ট প্লেটগুলো নিয়ে বাথরুমের দিকে চলেছে।

ও কি! বাবলু ওসব এঁটো প্লেট নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?

এগুলো ধুতে হবে না দাদা। ধুতে নিয়ে যাচ্ছি।

ছি ছি, ওসব নোংরা কাজ তোমার না রেখে দাও, রেখে দাও, এখুনি বেয়ারা এসে নিয়ে যাবে।

ভয়চকিত দৃষ্টিতে বাবলু সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল, কেন দাদা? আপনি কি আমার উপরে কোন রাগ করেছেন? ওদের ওখানে সব বাসনপত্র তো আমিই ধুয়ে রাখতাম। তাড়াতাড়ি না ধুলে তারা মারত। তবু খেতে দিত না আমাকে।

বাবলুর কথা শুনে সুব্রতর চোখে জল এসে যায়, সে কোনমতে অশ্রু গোপন করে মৃদু সস্নেহ কণ্ঠে বললে, না ভাই, এখন তো আর তুমি তাদের ওখানে নেই। আমার এখানে ওসব নোংরা কাজ একেবারেই করতে হবে না। রেখে দাও এগুলো নামিয়ে। যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এস।

বাবলু একবার কাতর দৃষ্টিতে সুব্রতর মুখের দিকে চেয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল, ট্রেটা আবার মাটিতে নামিয়ে রেখে।

সুব্রত এসে আবার সোফায় বসে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো।

এই মেয়েটি কে? কার মেয়ে? কেমন করে মেয়েটি ঐ গুণ্ডার দলে জড়িয়ে গেল? মেয়েটির আসল পরিচয় কী? কোথায় বাড়ি? নানা চিন্তা একসঙ্গে ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল।

হঠাৎ একটা কথা ওর মাথায় বিদ্যুৎ-চমকের মত এসে উদয় হয়। অদ্ভুত চিঠিটার অনুসন্ধান করতে লোকগুলো তার ফ্ল্যাটে হানা দিয়েছিল এবং তাদেরই অনুসরণ করতে গিয়ে ও শেষ পর্যন্ত ঐ গুণ্ডার দলে গিয়ে পড়ে। সেইখানেই আশ্চর্যভাবে মেয়েটিকে পাওয়া গেল। তবে কি মিঃ সরকারের হত্যার সঙ্গে মেয়েটির জীবনের কোন সূত্র পাক খেয়ে আছে?

প্রথম থেকে আগাগোড়া ব্যাপারটা সমালোচনা করলে স্পষ্টই এখন বোঝা যায়, মিঃ সরকারের মৃত্যুর সঙ্গে প্রকাণ্ড একটা জটিল রহস্য পাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা যতখানি ও সহজ ভেবেছিল ঠিক ততখানি সহজ তো নয়ই, বরং বেশ কিছু গোলমেলে ও জটিল।

পর পর দুটো দিন ও নানাভাবে এত ব্যস্ত রয়েছে যে কিরীটীর সঙ্গে গিয়ে বর্তমান কেসটা সম্পর্কে যে একটা ভোলাখুলি আলোচনা করবে তার সময় পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর যে চারজন লোককে ও সেই বাড়িতে বন্দী করে পুলিসের হেফাজতে তুলে দিয়ে এসেছে, কাল সর্বাগ্রে তাদের নাড়াচাড়া করে দেখতে হবে। হয়তো বা সেদিক থেকেও কোন সূত্রের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

কিন্তু তার সন্দেহ যদি সত্যই অমূলক হয়, তবে সর্বাগ্রে যেমন করেই হোক বাবলুকে একটি বিশেষ নিরাপদ স্থানে রেখে আসা দরকার। কিন্তু কোথায় সে বাবলুকে রাখতে পারে? হোটেল তো সে বর্তমানে ছেড়েই দেবে। কেননা গত রাতের ব্যাপারে ও স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে। হোটেলের ম্যানেজারকে ওরা হাত করেছে। ম্যানেজারকে আর বিশ্বাস করা চলে না। নিজের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায় নিয়ে যাবে? বাড়িতে এক রাজুর মা। বাকি সব বেশির ভাগ সময় বাইরে বাইরে থাকে। গুণ্ডার দলের কিছুই অসাধ্য নেই। মেয়েটিকে সত্যিই যদি তাদের প্রয়োজন থাকে, তবে যে কোন সময় চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। কিরীটীর ওখানে রাখবে? না, তাও সম্ভব নয়। তবে কোথায় রাখা যেতে পারে? কোথায় মেয়েটি নিরাপদে থাকবে? হা ঠিক মনে পড়েছে। নিশীথের বোন অমিয়াদি শ্যামবাজারে থাকেন। তারও দুটি-তিনটি ছেলেমেয়ে আছে। ঠিক, অমিয়াদির বাসাতেই আপাতত এখন বাবলুকে কিছুদিন রাখাই সর্বাপেক্ষা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। তাছাড়া বাবলুকে যদি অমিয়াদির বাসাতেই রাখা যায়, তবে গুণ্ডার দল হয়তো ওর সন্ধান সহজে নাও পেতে পারে। সুব্রতর আঙ্গুলো তো ওদের জানা থাকাই বেশী সম্ভব। বাবলুকে অমিয়াদির ওখানে কিছুদিন রাখতে হবে।

চিন্তার স্রোতে সুব্রত ভেসে চলেছিল, বাবলুর কথা ওর মনেই ছিল না। হঠাৎ চোখ মেলে চাইতেই দেখলে সামনে দাঁড়িয়ে বাবলু ভীরু দৃষ্টি মেলে এই দিকে তাকিয়ে আছে।

সুব্রত ব্যস্ত হয়ে উঠল।—এ কি বাবলু তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোসো।

আপনি তো আমাকে বসতে বলেননি দাদা!

বোসো, বোসো।

বাবলু এবার সোফাটায় বসল সংকুচিতভাবে।