অপেক্ষা
অগোচরে সন্ধ্যা নামল। ধূসর অন্ধকার অবশিষ্ট আলোর রেখাগুলি মুছে দিলে শূন্যের কোথাও আর স্বচ্ছতা থাকল না। শিরীষগাছের মাথা ডিঙিয়ে শেষ কয়েকটি পাখি গঙ্গার দিকে চলে গেছে। এই সময় চৈত্রমাসের অস্থির হাওয়া এল মাঠে; কয়েক দণ্ড পর ওই বাতাস দূরান্তে চলে গেলে আকাশ বড় নিরিবিলি দেখাল।
শিবতোষ উদাস চোখে ফাঁকা আকাশ, ময়লা মেঘের তলায় আঁধারে ঘন হয়ে আসা দেখছিল। এখন কিছু আর চোখে পড়ে না; মনে হয়, দৃষ্টির ওপারে চলে গেছে সব। মাঠের গাছগুলি অন্ধকারে মিশে গাঢ় ছায়ার মতন দাঁড়িয়ে আছে; কাছাকাছি কয়েকটি মানুষ ছিল, তাদের দেখা যাচ্ছে না; কলা-ফুলের ঝাড় ছিল সামনে—এখন সেই গাছটিও ঠাহর করা যায় না।
ভুবন দত্তর কথা আবার মনে এল। কোনো কোনো সময় এই রকম হয়, যতবার বই খোলো সেই একই পাতা; কি করে যেন একটু ফাঁক জমে গেছে ওখানে, ঘুরে-ফিরে পাতাটা দেখা দেবে। ভুবন গতকাল রাত্রে মারা গেছে। কোনো মারাত্মক ব্যাধি নয়, দুর্ঘটনাও না। ভুবনের সাধারণ জ্বর হয়েছিল। বউ নিয়ে দার্জিলিঙ বেড়াতে গিয়েছিল মাসের প্রথম দিকে, ফিরে এসেছিল মাঝামাঝি; এসে বলেছিল, ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হয়েছে। কলকাতায় ফিরে কেমন করে যেন আবার একদিন জ্বরটা বেড়ে গেল। হু হু করে জ্বর উঠল। কমল একটু। তারপর কাল রাত্রে আর সে নিশ্বাস নিতে পারল না। বউকে নাকি বলেছিল, “পাখাটা ফুল করে দাও; আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
ঝড়ের মতন পাখা ঘুরছে মাথার ওপর, গলির মোড়ে রাত থমথম করছে, মুখের সামনে বউ; ডাক্তার এল, এসে দেখল ভুবন মারা গেছে। আ-হা!
শিবতোষ অনুভব করছিল, দুপুর থেকে সে কতবার বড় বড় নিশ্বাস ফেলেছে, তবু তার বুক ভার। যেন একটু একটু করে বাতাস তার বুকে ক্রমশই জমে যাচ্ছে, দীর্ঘ নিশ্বাসগুলি তার বুক থেকে সবটুকু বাতাস তুলতে পারছে না।
কোল থেকে চশমা তুলে নিয়ে পরল শিবতোষ; মুখ হাঁ করে যতটা পারল বাতাস উঠিয়ে ফেলার চেষ্টা করল।
ভুবন নিতান্ত ছেলেমানুষ ছিল। বছর বত্রিশের ছেলে। মাত্র সে-দিন বিয়ে করেছে। বছর দুই? নাকি তিন? অফিসেরই একটি মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল। ওরা স্বামী-স্ত্রীতে জোড়ে অফিসে আসত, ছুটির পর একসঙ্গে বেরুত ট্রাম-বাস ধরতে।
বিশু মিত্তির বড় রগুড়ে লোক। একদিন বর্ষায় ভুবন আর ভুবনের বউ দুজনে দুটো আলাদা ছাতায় মাথা ঢেকে অফিসে ঢুকছে দেখে বিশু চেঁচিয়ে ডেকে বলল, “কি রে ভুবন, বউমার সঙ্গে ঝগড়া নাকি?” ভুবন সস্ত্রীক থমকে দাঁড়াল; বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল। বিশু গম্ভীর হয়ে বলল, “তোদের তো ভাই এক ছাতা মাথায় দিয়ে আসার কথা।”
এখনও যেন সমস্বরে সেই বর্ষার দিনের হাসির হল্লা শুনতে পাচ্ছে শিবতোষ। ভুবনের হাস্যময় মুখ এবং প্রসন্ন দৃষ্টি, ভুবনের বউ গৌরীর সলজ্জ মুখ এবং ঈষৎ অপ্রস্তুত ভাব—শিবতোষ এই অন্ধকারেও যেন দেখতে পেল।
ঘাসের ওপর থেকে এবার পা গুটিয়ে নিল ও। অনেক দূরে কোনো একজন ট্রানজিস্টার সেট খুলেছে। হাতে ঘড়ি আছে, এত অন্ধকারে কাঁটা দেখা যাবে না জেনে শিবতোষ ঘড়ি দেখল না। বাড়ি ফেরার সময় উতরে যাচ্ছে। তার ওঠা উচিত। রাত হয়ে গেলে কমলা বড় ভাবে।
উঠে দাঁড়াল শিবতোষ। রুমাল বের করে মুখ মুছে নিল আলতো করে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল। তারপর অবসন্ন পায়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল। ট্রাম-গুমটি এতক্ষণে নিশ্চয় কিছুটা ফাঁকা হয়ে এসেছে, যথেষ্ট অন্ধকারে রাস্তার বাতিগুলোও পুরোপুরি ফুটে উঠেছে।
এ সংসারে কখন কি আসবে কেউ জানে না। ভুবন কত আশা করে ভালবেসেছিল, কত দীর্ঘকাল ভালবাসা নিয়ে বেঁচে থাকবে বলে ভেবেছিল। গৌরী কত নির্ভর করে এই ভালবাসার কাছে নিজেকে দিয়েছিল। কিন্তু কী হল?
বিশু আজ খেপে গিয়ে বলেছে, “শালার ভগবান। থানা থেকে লোকজন নিয়ে যেন কুকুর ধরতে আসে।”
তা সত্যি, কখন যে কী আসছে কেউ জানে না।
বাড়ি ফিরতে প্রায় আটটা বেজে গেল। গলির গলিতে বাড়ি। পথের বাতি আজ জ্বলে, কাল নেবে; আবার কর্পোরেশনের বাতি-জ্বালানো লোকটা যতদিন নতুন বালব্ না আনছে ততদিন এদিকটা অন্ধকার, তিরিশ চল্লিশ গজ জায়গা ঘুটঘুট করবে। শিবতোষ বাড়ি ফিরে দোতলায় ওঠবার সময় শুনতে পেল, নিচে বৈঠকখানা-ঘরে বাবুল আর টুলু চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করছে। ওদের মাস্টারমশাই এসেছেন যে সেটা বোঝা যায়, নয়ত পড়া ছেড়ে দুই ভাইবোনে দাপাদাপি করত।
দোতলার সিঁড়িতে পা দিয়ে চোখে পড়ল, কলতলার মুখোমুখি রান্নাঘরে চৌকাঠের কাছে কমলা দাঁড়িয়ে আছে; দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বামুনকে কিছু বলছিল। শিবতোষের পায়ের শব্দে কমলা মুখ ফিরিয়েছে।
নিজের ঘরে এসে শিবতোষ কাপড় জামা ছাড়ল। মেঝেতে এক পাশে সেলাই-কল নামানো রয়েছে; কিছু ছিট-কাপড়, কাঁচি, একটা বালতি-ব্যাগ সেলাই-কলের আশপাশে ছড়ানো। কমলা সেলাই নিয়ে বসেছিল, উঠে গেছে। হাতে সময় পেলে বসে মাঝে মাঝে; কিন্তু বড় অসতর্কভাবে সমস্ত ফেলে যায়। একদিন মিনু হাত পা কাটবে। শিবতোষ কাঁচি সরিয়ে রেখে সেলাই-কলের ডালাটা কলের মুখে ঢাকা দিয়ে দিচ্ছিল, কমলা এল।
“ঠিক, যা ভেবেছি—” কমলা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল কলের কাছে, “থাক, ঢাকনা দিও না, আমার কাজ আছে।”
“মিনু কোথায়?” শিবতোষ ডালা রেখে দিল।
“বলো না আর, ওই এক মেয়েতে আমি জ্বলে গেলাম। এক অক্ষর, পড়বে না। সারা দুপুর চাল্লি, সন্ধেবেলা শাঁক বাজতে না বাজতে ঢুলবে।” কমলা সতরঞ্জির আসন টেনে নিয়ে কলের সামনে বসে পড়ল।
শিবতোষ গায়ের জামা ছাড়তে আলনার কাছে সরে গেল।
“দিয়েছি দুটো চড়। খানিক কাঁদল, তারপর জেদ ধরে বসে থাকল। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়েছি নিচে। খাক, খেয়ে ঘুমোক।” কমলা বলল।
শিবতোষ অনুমান করতে পারল, মিনু একটু পরেই উঠে এসে বাবার বিছানায় শুয়ে পড়বে। রাগ হলে মিনু বাবার সান্নিধ্যই বেশি পছন্দ করে।
“আজ এত দেরী করলে?” কমলা সেলাই-কলের মুখের ওপর ঝুঁকে বুঝি সুতো পরিয়ে নিচ্ছিল।
“দেরি হয়ে গেল, মাঠে গিয়ে বসেছিলাম।” শিবতোষ কলঘরে যাবার জন্যে কাচা ধুতি, গেঞ্জি আলনা থেকে তুলে নিচ্ছিল। “মনটা খারাপ হয়ে গেছে—”
স্বামীর গলার স্বর এবং দীর্ঘনিশ্বাস গুনে কমলা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। “মন খারাপ! হঠাৎ! কী হল?”
“কাল রাত্তিরে ভুবন মারা গেছে।”
“কে?”
“ভুবন। আমাদের অফিসের ভুবন। সেই যে যার কথা বলি তোমায়—”
“সে কি!” মুহূর্তে যেন কমলা বিমূঢ়তা কাটিয়ে ভুবনকে চিনতে পারল। স্পষ্ট চিনতে পারল। শিবতোষের কাছে কত খুঁটি-নাটি শুনেছে ভদ্রলোকের বিষয়ে। একবার এ-বাড়িতে এসেছিল। “কি করে মারা গেল? হঠাৎ?”
“হঠাৎই। বলছে ব্রঙ্কোনিমোনিয়া। কি জানি!” শিবতোষ উদাসীন ভারী গলায় বলল। “মানুষের কখন কি হয়, কখন ডাক আসে কে জানে? …বেচারি!”
কমলা সেলাই-কলের সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল।
তারপর আরও রাত হল। ন’টা বেজে গেল কখন। সদর থেকে হাওয়া এসে এই গলিতে তার সাড়া দিচ্ছিল যেন। ঘরের সামনে গলির দিকে মুখ করে ফালি বারান্দা, এলোমেলো হাওয়ায় অন্ধকারে কমলার সেমিজ দুলছিল, টুলুর ফ্রক মাটিতে, টবের অপরাজিতা লতার ডালপালা বারান্দার রেলিং ছুঁয়ে ছুঁয়ে ক’হাত এগিয়েছে, বেতের একটা চেয়ার, তিন চাকার সাইকেল সব যথাযথ রয়েছে। নিচে বাবুলরা বসেছে, কমলা ছেলেমেয়েকে খাওয়াচ্ছে; মিনু শিবতোষের বিছানায় বালিশ জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে অকাতরে। আজ কোনো কিছুতেই মন বসছে না বলে শিবতোষ বই অথবা কাগজপত্র পড়ে সময় কাটাতে পারে নি। চেষ্টা করেছিল, ফল হয় নি। সামান্য আগে পাশের বাড়িতে রেডিয়ো খুলে দেওয়ায় তার কানে একটা গান ভেসে আসছিল, ইচ্ছে হয়েছিল ঘরের রেডিয়োটা খুলে দেয়; শেষ পর্যন্ত দেয় নি।
কখনও ঘরে কখনও বাইরে এসে বিছানায় শুয়ে, বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে, এ-কাজ সে-কাজে মন বসাতে গিয়ে সুস্থির হতে না পারায় শিবতোষ তৃতীয়বার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। অন্ধকার খুব হালকা করে আলো মেখে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ অতি অল্পই দেখা যাচ্ছে, তারা চোখে পড়ল। সামনের বাড়ির বেখাপ্পা চিলেকোঠা দৃষ্টি আটকে রেখেছে, নয়ত দূরান্ত চোখ পড়ত। কমলার সেমিজ উড়ে মুখে এসে লাগল। গলির পথ দিয়ে একটি বউ চলে যাচ্ছে।
গৌরীকে একটা চিঠি লেখার কথা হঠাৎ মনে হল শিবতোষের। যাওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু এ-সময় যাবার মতন সাহস হচ্ছিল না। ভীষণ অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে নিজেকে আরও দুর্বল মনে হয় শিবতোষের। কথা বলতে পারে না, তার বুক কাঁপে। আপাতত একটা চিঠি লিখে ঠিক এই অবস্থার মুখ থেকে সরে থাকা যাক। তারপর—তারপর কয়েকদিন পরে শ্রাদ্ধের সময় শিবতোষ যেতে পারবে।
চিঠি লেখার কথা মনে আসায় শিবতোষ ঘর এল। পশ্চিমের দেওয়াল ঘেঁষে টেবিল। টুকটাক জিনিস সাজানো আছে। টেবল-ল্যাম্প, মাটির ফুলদানি, দোয়াতদান, তারিখ-বদলানো ক্যালেন্ডার, দু-একটা বই, বাসী মাসিকপত্র। সামান্য কাগজ খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ একটা চিঠির কথা মনে পড়ল শিবতোষের। একটুক্ষণ থমকে গেল যেন। ভাবল। হ্যাঁ, চিঠিটা থাকা উচিত। এই টেবিল অথবা বইয়ের ফাঁকে কোথাও চিঠিটা থাকার কথা।
শিবতোষ চিঠি খুঁজল। টেবিল দেখল, বইপত্র হাতড়াল, ড্রয়ার ওলট-পালট করল। কি আশ্চর্য, কোথায় রাখল চিঠিটা? গেল কোথায়? কমলা দরকারী জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে বড়। ঘর গুছোনোর রোগ তার, সারাক্ষণ সময় পেলেই এখানের জিনিস ওখানে করছে; অথচ কমলা অসাবধান এবং ভুলো-মন।
চিঠি খুঁজে না পাওয়ায় শিবতোষ ক্রমে ক্রমে বিরক্ত হয়ে উঠছিল। অনেক সময় দেরাজের টানার মধ্যে কাগজপত্র রেখে দেয় কমলা। শিবতোষ আলনার কাছে গিয়ে দেরাজ টানল। ইনশিওরেন্সের রসিদ, কর্পোরেশনের ট্যাক্সের তাগিদ, টুলুর কোষ্ঠি, দু-দশটা পুরোনো চিঠি, বাড়ির ছাদ মেরামতির বিল—ইত্যাদি কয়েকটা জিনিস দেখা গেল, সেই চিঠিটা নেই।
“কমলা—” দোতলার ভেতর-বারান্দায় এসে ডাকল শিবতোষ। “একবার ওপরে এস।”
শিবতোষ বেশ চঞ্চল এবং বিরক্ত হয়ে উঠেছে। ঘরে এসে উদ্বিগ্নের মতন সে আরও একবার টেবিল হাতড়াল। না, চিঠিটা নেই। কমলা চিঠিপত্রের ব্যাপারে একেবারে ‘কেয়ারলেস’ । মনে মনে কেমন বিতৃষ্ণা অনুভব করল শিবতোষ স্ত্রীর ওপর। রাগ হচ্ছিল।
কমলা আসছে না। শিবতোষের খেয়াল হল, অনেক সময় বিছানার পায়ের দিকের তোশকের তলায় এটা সেটা কাগজপত্র রেখে দেয় কমলা। কথাটা মনে পড়ায় বিছানার পায়ের দিকের তোশক তুলে ফেলল শিবতোষ। ফ্রকের ডিজাইনের কাটা-ছেঁড়া পাতা, বিয়ের নেমন্তন্নর দুটো চিঠি এবং দুটো স্যারিডনের বড়ি পাওয়া গেল।
“বিছানা হাতড়ে কি খুঁজছ?” কমলা ঘরে এসেছে। ঘরে এসে দেখল, স্বামী বিছানাটা লণ্ডভণ্ড করে এক বিশ্রী অবস্থা করেছে। কমলার এটা একেবারেই পছন্দ হয় না। পুরুষমানুষ বিছানা হাতড়াবে কেন! আবার সব পরিপাটি করতে হবে কমলাকেই। এ-সংসারে দিনরাত শুধু পরিশ্রম করো।
“একটা চিঠি রেখেছিলাম টেবিলের ওপর, কোথায় ফেললে?” শিবতোষ বিরক্ত হয়ে জানতে চাইল।
“চিঠি! কার চিঠি? কিসের চিঠি?” কমলা বিছানার পায়ের দিকে এসে অগোছালো বিছানার তোশক চাদর আবার গুছোতে লাগল নিচু হয়ে।
কার চিঠি, কিসের চিঠি মনে করতে গিয়ে শিবতোষ কেমন থমকে গেল। কখনও কখনও এ-রকম হয়, খুব চেনা পরিচিত শব্দের প্রথম অক্ষরটি দেখেই পুরো শব্দটি মনে মনে ধরে নেওয়ার মতন আমরা অপরিচিত শব্দটিকে ভুল করে পরিচিত শব্দ বলেই ধরে নিই, পরে কেউ প্রশ্ন করলে হঠাৎ কেন যেন মনে পড়ে যায়, শব্দটি কি সত্যিই তেমন ছিল! বস্তুত মনোযোগ দিয়ে না দেখার ফলে যে সন্দেহ, সেই সন্দেহ পরে দেখা দিয়ে আমাদের কেমন বিব্রত করে। শিবতোষ প্রায় সেইরকম বিব্রত ও বিমূঢ় হল। সে মনে করতে পারল না চিঠিটা কার।
“সব ব্যাপারে তোমায় ঠিকুজি দিতে হবে—” শিবতোষ অত্যন্ত অপ্রসন্ন গলায় বলল, মুখচোখে প্রখর বিরক্তি। “কে যে তোমায় আমার কাগজপত্র হাত দিতে বলে। কেয়ারলেস…। রাখলাম চিঠিটা, বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল!”
“কী মুশকিল!” কমলা স্বামীর দিকে মুখ ফেরাল, “প্রায় দিনই তো চিঠি আসে বাড়িতে, কার চিঠি কেমন চিঠি বলবে, তবে না বুঝব।”
“তোমার মুণ্ডু বুঝবে!…আমি যা পছন্দ করি না সেই কাজটাই তোমার করা চাই। হাজারবার বলেছি, টেবিলে আমার যা থাকে থাক, তোমরা ঘেঁটো না। কেন ঘাঁটো?”
“চেঁচিয়ো না।” কমলা যেন ধমক দিল স্বামীকে। “আস্তে কথা বল। অত তিরিক্ষে মেজাজ করে কথা বলার কী হয়েছে!…কার চিঠি কবে এসেছে বলতে পারছ না?…দিদির চিঠি?”
“না। দিদি-ফিদির চিঠি নয় । দিদির চিঠি তুমি পড়গে যাও।”
“তোমারই দিদি, আমার নয়।”
“হোক আমার দিদি।…আশ্চর্য, কাল আমি রাখলাম চিঠিটা—আজ হাওয়া হয়ে গেল।” শিবতোষ যেন এই রহস্যের মর্ম বুঝতে না পেরে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছে।
“কাল কোনো চিঠি আসে নি তোমার। মুক্তির একটা পোস্টকার্ড এসেছিল।” কমলা বলল।
“তোমার বোনের চিঠি নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না।”
“তা হলে অন্য কোনো চিঠি আসেনি।”
“এসেছিল।”
“আচ্ছা জ্বালায় পড়লাম তো! এসেছিল যদি, তবে কি উড়ে গেল। কার চিঠি তাও বলবে না, কেমন চিঠি তাও বলবে না, শুধু চেঁচাবে।” কমলা অধৈর্য, তিতিবিরক্ত। “খাম, না, ইনল্যান্ড লেটার?”
“আমার মাথা। বুঝলে, আমার এই মাথা—” রাগে বিরক্তিতে বদমেজাজে যেন জ্বলে-পুড়ে শিবতোষ অদ্ভুত এক ভঙ্গি করে নিজের মাথা দেখাল। তারপর বলল, “হাতির পিঠে হাওদায় বসে সংসার করছ। কোনো দিকে চোখ নেই, গ্রাহ্যও নেই। কাজের মধ্যে অকাজ। তুমি আর কখনও আমার কাগজপত্র চিঠিতে হাত দেবে না।”
কমলারও রাগ চড়ে গিয়েছিল মাথায়। মানুষে যদি অকারণে মাথা গরম করে যা খুশি বলে যায় তবে কতটা আর সহ্য করে অন্যে? কমলা চেরা গলায় বলল, “কথা বলো না আর, কি আমার হাওদার ওপর বসিয়ে রেখেছ! এক গুচ্ছের ছেলেমেয়ে নিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মরছি তার ওপর তোমার ফরিক্কি সামলানো। পারব না। নিজের জিনিস নিজে রাখবে, নিজে নেবে; খবরদার কমলা কমলা করবে না।” বলতে বলতে কমলা রাগে অসহিষ্ণু হয়ে ঘর থেকে চলে গেল।
শিবতোষ দাঁড়িয়ে থাকল। কমলার পায়ের শব্দ সিঁড়ি থেকে নিচে নেমে নেমে মিলিয়ে গেল। বাবুল আর টুলুর গলা পাওয়া যাচ্ছে। ঘরে বিছানায় মিনু ঘুমোচ্ছে। এই সংসারের চেহারাটা হঠাৎ রেল-কামরার চেহারার মতন দেখাল, কয়েক পলক, তারপর আবার সব ঠিক হয়ে এল। ঘরে একশো পাওয়ারের বাতিটা যথেষ্ট আলো ছড়িয়ে জ্বলছে, টেবিল আলমারি দেরাজ আলনা—সব সেইরকম, ঘরের মাঝদরজা দিয়ে পাশের ঘর দেখা যাচ্ছে। ও-ঘর এখন অন্ধকার।
শিবতোষ চিঠিটার কথা ভাবল। কাল কি আসে নি তবে? গত পরশু এসেছিল? হতে পারে, শিবতোষের ভুল হচ্ছে। পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড নয়, খাম বলেই মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়িতে চিঠিটা একবার আধখাপচা চোখ বুলিয়ে রেখে দিয়েছিল। খুবই অন্যমনস্ক ছিল শিবতোষ তখন। ফলে তেমন কিছুই মনে পড়ছে না চিঠিটার। কে লিখেছে তাও না। নামটা কি দেখেছিল শিবতোষ? দেখেছিল, তবে তেমন খেয়াল করে নয়।
সামান্য মন দিয়ে চিঠিটা পড়লেই এই বিশ্রী অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হত না। শিবতোষ সবই মনে রাখতে পারত। পরে পড়ে দেখব ভেবে এবং আগের থেকেই যেন কেমন এক অদ্ভুত পূর্বজ্ঞান নিয়ে চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে মোটেই দেখে নি শিবতোষ। ভুল হয়েছে, খুব খারাপ ভুল।
চিঠিটা কে লিখেছে, কবে এসেছে, কি লেখা ছিল মনে করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করল শিবতোষ। এবং বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
বারান্দায় এলোমেলো বাতাস এসেছে, কমলার সেমিজ দুলছে, বাবুলের ছেঁড়া জামা গোঁজা আছে রেলিঙে; অন্ধকারে এ-সবই দেখা যায়, চেনা যায়। চিঠিটার কথাই যেন মনে পড়ছে না।
দুই
অনেক সময় অফিসের ঠিকানাতেও চিঠি আসে শিবতোষের। পুরোনো বন্ধুদের অনেকে, যারা এক সময়ে তার সহকর্মী ছিল, এখন কলকাতায় নেই কিংবা অন্য অফিসে চলে গেছে তারা অফিসের ঠিকানাতেই চিঠি দেয়। মনে রাখার পক্ষে সহজ ঠিকানা অফিসেরই। তা ছাড়া, এমনিতেও অনেক সময় অফিসের ঠিকানাতেই চিঠি পায় শিবতোষ। বিয়ের নেমন্তন্ন, শ্রাদ্ধ, লটারীর টিকিট, রিডার্স ডাইজেস্ট—এ-সব বেশির ভাগই অফিসের ঠিকানায় আসে। আশুবাবু তাকে রিডার্স ডাইজেস্ট গিফট করেছেন বলে ওটা অফিসেই আসছে। মোহিত বরাবর অফিসেই চিঠি লেখে। ওইরকম আরও।
শিবতোষ ভেবেছিল, তা হলে সম্ভবত চিঠিটা অফিসেই এসেছে। কাজের মধ্যে ডুবে থাকায় পড়তে পারে নি ভাল করে, রেখে দিয়েছিল পরে দেখবে বলে, তারপর ভুলে গেছে। কিংবা এমনও হতে পারে, বাড়িতেই এসেছিল অফিস যাবার বেলায়, তাড়াতাড়িতে তেমন নজর করে দেখে নি, পকেটে পুরে অফিসে চলে গিয়েছিল, অফিসেই ফেলে এসেছে।
চিঠির চিন্তা এবং সেটা হারানোর অস্বস্তি শিবতোষ থেকে থেকেই অনুভব করছিল। তার স্বভাবে বেশ খানিকটা অন্যমনস্কতা আছে, অনেক সময় মন দিয়ে নজর করে বড় বড় জিনিসও দেখে না; দোকানে জিনিস কিনে ফেরত পয়সা গুনে নেয় না, ভুল করে ট্রামে দু’বার টিকিট কিনেছে কতবার, অনেক সময় আবার পকেটে টাকা-পয়সা না নিয়ে অফিসে বেরিয়ে পড়েছে। তার অন্যমনস্কতা এবং অবহেলা তাকে ছেলেবেলা থেকেই নানাভাবে ভুগিয়েছে। এই বিশ্রী স্বভাবদোষের ফলে কখনও সে লেখাপড়ায় ভাল হতে পারে নি; আই-এ পরীক্ষায় আর একটু হলেই ফেল করে যেত, বি-এ পড়ার সময় ভয়ে ইতিহাস পড়েনি, ভুলে যাবার ভয়ে। এই দোষে সবচেয়ে বড় রকমের ক্ষতি হয়েছে তার দু’বার; বাবা যখন মারা গেলেন আর সুরমা যখন তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করল। বাবার বুকের যন্ত্রণা প্রথম যখন উঠল তখন সে তেমন গা করে নি। গা করার পরেও একটা ভুল করল। মানসিক উদ্বেগে এত জ্ঞানহারা হয়েছিল যে, বাথগেটে ওষুধ কিনতে গিয়ে প্রেসক্রিপশন হারাল; বাড়ি ফিরে এসে ডাক্তারবাবুকে আবার খোঁজ করে ধরে প্রেসক্রিপশন লিখিয়ে ওষুধ আনতে এত দেরি হয়ে গেল যে সে-ওষুধ বাবার কাজে লাগল না। বরাবরই একটা ক্ষোভ রয়ে গেছে শিবতোষের। মৃত্যুকে কেউ রোধ করতে পারে না। তবু বাবার মৃত্যুর কোথাও যেন তার দায়িত্বহীনতার কাঁটা ফুটে থাকল।
সুরমার বেলায়ও শিবতোষ বড় বেশীরকম অন্যমনস্কতা দেখিয়েছিল। সব মানুষ জীবনে ঘরসংসার করে, ছেলেমেয়ের বাবা-মা হয় কিন্তু ক’জন মানুষ ভালবাসা পায় জীবনে। বিয়ে, ঘরসংসার, ছেলেপুলে—এ-সমস্তই হয়ত ভাল; কিন্তু এর দশ আনাই আমাদের অভ্যাসবশে রক্তে এসে যায়। এক ধরনের ‘কনডিশানড রিফ্লেক্স’। ভালবাসা এ-রকম নয়, অন্তত শিবতোষ আজও তা মনে করে না। বিয়ে করেছি, আমার স্ত্রী—অতএব ভালবাসি। ভালবাসা এখানে বাধ্য মনোগত প্রতিক্রিয়া। কিন্তু শুধু ভালবাসা তা নয়। সুরমা যখন তাকে ভালবেসেছিল তখন ভালবাসার মধ্যে বাধ্যবাধক অবস্থা সাংসারিকভাবে হয় নি। তার ভাল লেগেছিল বলে ভালবেসেছিল। শিবতোষ যখন সুরমাকে ভালবেসেছিল তখন বিয়ের আওতায় বউ করে তাকে পায় নি; সুরমার নম্রতা, স্নিগ্ধ স্বভাব, অমলিন হৃদয় ও আন্তরিকতাই তাকে মুগ্ধ করেছিল। অথচ শিবতোষ নিজের আলস্য ও অন্যমনস্কতার জন্যে এই ভালবাসাও হারাল। সুরমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে, চাকরি থেকে রিটায়ার করার আগে সুরমার বাবা মেয়ের বিয়ে সেরে ফেলতে চান। সুরমা চাইছে শিবতোষ একটা কিছু করুক, বাড়িতে বলুক, অন্তত যেমনই হোক একটা চাকরি জুটিয়ে নিক আপাতত। কিন্তু শিবতোষ সমস্ত ব্যাপারটাই তাচ্ছিল্য করে যাচ্ছিল। হবে, হচ্ছে করে দিন কাটাচ্ছিল। বাঙালী বাড়িতে কুমারী মেয়ে থাকলে বাপ-মা বিশ পঁচিশবার দেখিয়ে থাকে, তাতে কিছু যায় আসে না। মেয়ের বাড়ি থেকে সব সময় সোনার কার্তিক জামাই চায়, সরকারী বড় চাকুরে খোঁজে। সংসারে চাইলেই কি পাওয়া যায়! একদিন সুরমার বাবা কিছুই পাবেন না, শিবতোষকেই মেয়ে দেবেন। চাকরি শিবতোষ পাবেই; আপাতত সে তেমন চেষ্টা করবে না।…গা না-করার ফল কিন্তু ফলে গেল। তমলুকের এক মুনসেফের সঙ্গে সুরমার বিয়ে পাকা হয়ে গেল। শিবতোষের ততদিন ঘুম ভেঙেছে। নিজের ঐশ্বর্য অন্যে নিয়ে চলে গেলে যেমন হা-হা করে ওঠে মানুষ, শিবতোষ সেই রকম চঞ্চল ও অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু কোনো লাভ হল না। আশীর্বাদী মেয়েকে সে তুলে আনার সাহস রাখে না; মেয়েও কেলেঙ্কারী করার মতন কিছু করবে না। সুরমা মুনসেফের গিন্নী হয়ে তমলুক চলে গেল।
যৌবনের এই দুটি ভুলই শিবতোষকে অনেক অনুশোচনা করিয়েছে। মৃত্যু এবং প্রেম—দুটি জিনিসের কোনোটিকেই সে নিজের আয়ত্তে আনতে পারে নি; তারা শিবতোষকে যেন সুযোগ দিয়েছিল, তারপর আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়ে দেখিয়েছে, শিবতোষ কত অযোগ্য। হয়ত এরা দুটি জিনিসই এইরকম—সুযোগ দেয়, ধরা দেয় না।
চিঠিটা না পাবার অস্বস্তিতে মন এ রকম ভরে থাকল যে, শিবতোষ শান্তি পেল না।একই অক্ষরের ওপর ক্রমাগত কালি বুলিয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত সেই অক্ষর যেমন কিম্ভূত এবং যথার্থ অবয়ব হারিয়ে অন্য কিছু হয়ে যায়, সেইরকম ওই চিঠির চিন্তা ক্রমাগত মনে পুষে রাখতে রাখতে এত অসংখ্য কথা ভাবল, বিচিত্র চিন্তা করল শিবতোষ যে, ঘটনাটা বৃহৎ ও অদ্ভুত এক আকার নিল। রাত্রে ভাল করে ঘুম হল না। অশান্তি তাকে জড়িয়ে থাকল।
অফিস এসে শিবতোষ তার টেবিলের সর্বত্র খুঁজল; কাগজপত্র ফাইল হাতড়াল; ব্যক্তিগত যাবতীয় যা কিছু আতিপাঁতি করে দেখল; চিঠি পেল না। বেয়ারাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে, একটা চিঠি আমি ফেলে গিয়েছিলাম ভুলে; টেবিলের নিচে পড়ে যায় নি তো? তুই কাগজ-ফেলা ঝুড়িতে ফেলে দিস নি তো?” বেয়ারা মাথা নাড়ল। তার মনে নেই। মাটিতে পড়ে গিয়ে থাকলে জমাদার ফেলে দিয়েছে ঝাঁট দিয়ে; কাগজের ঝুড়িতে বাবু যদি নিজে ফেলে দিয়ে থাকেন তবে এতদিনে পুরনো কাগজঅলাদের বস্তা থেকে কোথায় চলে গেছে।
শিবতোষ বেয়ারার ওপর রাগ করল, ধমকাল, তা ডিপার্টমেন্ট থেকে হঠিয়ে দেবে বলে শাসালো; কিন্তু অনুভব করতে পারল—চিঠিটা পাবার শেষ আশাটুকুও হারিয়ে গেল।
মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল শিবতোষের। বড় ফাঁকা লাগছিল। সংসারে কারও ওপর নির্ভর করা যায় না। কেউ তোমার প্রয়োজন অপ্রয়োজন দেখে না। আশ্চর্য, যেহেতু শিবতোষ তেমন খেয়াল করে নি, ভুলো-মন হয়েছিল, সেহেতু তার চিঠিটা হারিয়ে গেল, কেউ দেখল না।
অফিস ছুটির বেলায় ওরা ক’জনে ভুবনের বাড়ি যাচ্ছিল, গৌরীর সঙ্গে দেখা করতে। বিশু মিত্তির বলল, “কি শিবু, যাবে নাকি!” চল! একবার যাব। গৌরীর দরকার-টরকার থাকতে পারে।”
“তোমরা আজ যাও। আমার ভাল লাগছে না। পরে যাব।” শিবতোষ বিষণ্ণ মুখে জবাব দিল ।
বিশুরা চলে গেল গৌরীকে দেখতে।
তিন
কোনো কোনো সময় এ রকম হয়, ভুলে যাওয়া স্বপ্ন হঠাৎ ঝাপসাভাবে মনে পড়ে যায়। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে শিবতোষ শুনল, কমলার ভাই প্রকাশ এসেছিল; আগামী বুধবার একুশ তারিখে বোনরা গৌহাটি চলে যাচ্ছে। কমলার ভাই-বোন-ভগিনীপতিরা কে কোথায় যাচ্ছে শিবতোষের জেনে রাখা অপরিহার্য নয়। কিন্তু ওই কথায় শিবতোষের চিঠির কথা মনে পড়ে গেল। কী আশ্চর্য, তার খেয়ালই হয় নি, চিঠিতে একটি তারিখ ছিল। সতেরো? না, সতেরো নয়—ষোলো। হ্যাঁ, ষোলোই ছিল তারিখটা। মানে শুক্রবার। শিবতোষ ঘরে ক্যালেন্ডার ভাল করে দেখে নিয়ে মনে মনে হিসেব করল । পরশু দিনই দেখা করার কথা। কিন্তু চিঠি লেখার সময় মানুষটি নিশ্চয় ভাল করে হিসেব করে নি দিন-বারের। লিখেছে, ষোলো তারিখে দেখা করব, অথচ বার লিখতে লিখেছে আগামী বৃহস্পতিবার। মানে, পনেরো ষোলো দু দিনই তার আসবার সম্ভাবনা আছে।
পত্ৰলেখকের ওপর যথেষ্ট বিরক্তি বোধ করা সত্ত্বেও শিবতোষ আজ এই মুহূর্তে কিছুটা হালকা হল। মনে হয়েছিল, চিঠিটা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে, কিছু আর মনে পড়বে না। দেখা গেল, চিঠিটা যদিও হারিয়ে গেছে, তবু দরকারী ব্যাপারটা মনে পড়ে গেছে শিবতোষের। আজ বুধবার—চৌদ্দই; আগামী ষোলো তারিখে তার দেখা করার কথা। কিন্তু ওই একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে রেখেছে, বৃহস্পতিবার নাগাদ দেখা করবে। তার মানে—হয় তারিখ ভুল করেছে, না-হয় পনেরোই তারিখটা বসাতে ভুলে গেছে।
শিবতোষ যতটা বিরক্ত হয়েছিল প্রথমে, ক্রমে সেই বিরক্তি কেটে গেল। অনেকটা যেন মার্জনা করে নিল পত্ৰলেখককে। হয়ত এই ভুল বা গোলমেলে ব্যাপারটা তার নজরে পড়ে নি, তাড়াতাড়িতে চিঠি লিখেছে। শিবতোষের মতনই অনেকটা স্বভাব, কাজের সময় অন্যমনস্ক থাকে! মনে মনে শিবতোষ সকৌতুক প্রসন্নতা অনুভব করল । অবশ্য শিবতোষের পক্ষে দুটি দিনই সমান। ছুটির পর সাধারণত সে সরাসরি বাড়ি ফেরে না; মাঠের দিকে চলে যায়, বেড়ায় খানিকটা, ঘাসে বসে থাকে, অর্থাৎ এক দেড় ঘণ্টা সময় তার একা একা মাঠের দিকে কাটে। কাজেই লোকটি বৃহস্পতিবারই দেখা করতে আসুক কি শুক্রবারই আসুক, শিবতোষের পক্ষে সমান কথা।
মনের অস্বস্তি এবং ভার অনেকখানি বুঝি কেটে গেল শিবতোষের। হারানো চিঠির জন্যে এখন তার তেমন ক্ষোভ হচ্ছিল না। বরং তার পক্ষে চিঠির প্রয়োজনীয় বিষয়টি মনে পড়া একটি কৃতিত্বের মতন মনে হচ্ছিল। ও মানে—যে-মানুষটি চিঠি লিখেছে সে যে শিবতোষের সঙ্গে অফিসে দেখা করবে না, অফিস ছুটির পর বাইরে দেখা করবে বলেছে—শিবতোষের তাও মনে পড়ে গিয়েছিল। বলতে কি, এর পর হারানো চিঠির জন্যে ক্ষোভ করা অর্থহীন। দেখা হবেই যখন, তখন মানুষটি কে, কি তার ঠিকানা, তার প্রয়োজন কি—এবং নামধাম জানতে অসুবিধে কোথায়!
যত দূর মনে হয়, মানুষটি বাইরের লোক। অপরিচিত বইকি। পরিচিত হলে বাড়ি আসত। অন্তত তার নামটা শিবতোষ ভুলে যেত না।
মোটামুটি মন হালকা এবং নিরুদ্বেগ করে শিবতোষ কমলাকে ডাকল। সামান্য পরে কমলা ঘরে এলে শিবতোষ বলল, “তুমি কি কাল হেনাদের আসতে বলেছ?”
“না, কাল নয়; রবিবার বলেছি।”
শিবতোষ নিশ্চিন্ত বোধ করল। আগামী কাল হেনারা এলে তাকে অসুবিধেয় পড়তে হত।
অফিসের বেলা ফুরোলো যখন, তখন আকাশতলায় রোদ ছিল। চৈত্রের বিকেল ওইরকম, যাবার জন্যে পা বাড়িয়েও সহজে যায় না; উঁচু-উঁচু বাড়ির মাথাগুলোয় আরও সামান্য সময় বসে থাকবে, যেন গা নেই যাবার, তারপর এক সময় বাধ্য হয়ে চলে যাবে। শিবতোষ স্বভাবতই ট্রাম-বাস ও হন্যে-হওয়া ভিড়ের গা বাঁচিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি একটা পথ নিল। ওই পথে ছায়া এবং অবসন্ন দিনের মালিন্য ছিল। খানিকটা হেঁটে এসে তার পরিচিত ও পছন্দসই চায়ের দোকানে ঢুকল। মুখচোখে জল দিয়েছিল অফিসেই, দোকানে বসে ধীরে সুস্থে চা খেল এক কাপ, এক টুকরো কেক; তারপর সিগারেট ধরিয়ে পথে নামল।
গ্রীষ্মের দিন যে সমাগত বোঝা যায়; রাস্তা এবং আশপাশের বাড়ি যথেষ্ট তাপ ছড়াচ্ছে। এখনও বাতাস বয় নি দমকা। না, আর রোদ নেই, আকাশের নিচে পাতলা পরদার মতন কালো রয়েছে এখনও। লাটবাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শিবতোষ কিছু গাছ দেখল, ফুলবাগান চোখে পড়ল দূরে। এই জায়গাটা যেন কলকাতা নয়; শিবতোষ যখনই এ-পথ দিয়ে যায়, তার এই কৌতুককর কথাটা মনে হয়। লাটবাড়ির গাছগাছালি বড় স্নিগ্ধ এবং এখনই কেমন সন্ধ্যার নির্জনতা সৃষ্টি করেছে।
মাঠে এসে পৌঁছতে যতটুকু সময় লাগল ততক্ষণে বিকেল শেষ হয়েছে। গোধুলির সাজসজ্জা চলছে আকাশে। নিজের অভ্যস্ত জায়গার কাছাকাছি একটি স্থান বেছে নিয়ে শিবতোষ বসল । আজ যেন এপাশে ভিড় একটু বেশি। দুটি বৃদ্ধ পায়চারি করছে, একটি কলেজি ছেলে আকাশমুখো হয়ে সটান শুয়ে আছে, তার পাশে বসে সমবয়সী এক বন্ধু সিগারেট টানছে। খেলার মাঠ থেকে হল্লার একটা ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছে। শিবতোষ বুঝতে পারল না, আজ কিসের খেলা? হকি নাকি অন্য কিছু!
ঘড়িতে ছ’টা বেজে গেছে। হু হু করে এবার চৈত্রের অন্তিম আলোটুকু মুছে আসছে। ট্রাম-বাস, গাড়ি-ঘোড়ার মিশ্রিত একটি গুঞ্জন বাতাসে ভেসে আছে সর্বক্ষণ; সামান্য দূরে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে নিচু গলায় কথা বলতে বলতে এসে বসল, সেই এক-চোখ কানা চিনেবাদামঅলাটা এসে গেছে; পায়ে কেডসের জুতো, হাফ-প্যান্ট-পরা অ্যাংলো মেয়ে দুটি মাঠে ছুটছে।
আজ গঙ্গায় ঘন ঘন ভোঁ দিচ্ছে জাহাজ। মস্ত একটা মেঘ এসে গেছে পশ্চিম থেকে। ঝড় আসছে নাকি? বোঝা যায় না। এক দঙ্গল মাড়োয়ারী বউ-ঝি বাচ্চাকাচ্চা এসে পড়েছে মাঠে। ঘাসের রঙ ক্রমশই সীসের মতন হয়ে আসছিল।
সন্ধ্যা নামল দ্রুতই যেন। অন্ধকার হয়ে গেল। আকাশ থেকে সেই মেঘ সরল না, শূন্য ছায়ায় ছায়ায় ভরে গেল। শিবতোষের কাছাকাছি কেউ কেউ এসে বলল, কেউ বা উঠে গেল, পাখিরা আর ডাকল না, গানের সুর ভাসল কোথাও, কোথাও বা অট্টহাসি উঠল। নিবিড় আঁধার যখন আর কোনো কিছুকে চিনিয়ে দেয় না, তখন শিবতোষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসল।
আজ সে এল না। বৃহস্পতিবারের কথাটা অকারণেই লিখেছিল। আগামীকাল ষোলোই তারিখে তবে আসবে। সারাটা বিকেল শিবতোষ মিছিমিছি অপেক্ষা করল, অনর্থক।
কিঞ্চিৎ বিরক্তি অবশ্য বোধ করল শিবতোষ। এই অপেক্ষা বড় বিরক্তিকর। অপেক্ষা মানে প্রত্যাশা; এই যে শিবতোষ আশায় থাকল অর্থাৎ কেউ এল না, এর ফলে শিবতোষের প্রত্যাশা মিটল না। মানুষকে অনর্থক উৎকণ্ঠিত রাখা, ভরসা দিয়ে বসিয়ে রাখা অত্যন্ত দায়িত্বহীনতার কাজ।
ট্রামের সিটে বসে এক সময় বিরক্তির বদলে শিবতোষ অকস্মাৎ নিজের এক গাফিলতি অনুভব করতে পারল। অনুভব করে লজ্জা পেল সামান্য। সে বড় বোকা, মানে—আজ বোকামির পরিচয় দিয়েছে। দুটি লোক আজ মাঠে তার কাছাকাছি এসে বসেছিল। একজন একটু প্রবীণ, অন্যজন যুবক। তারা অনেকক্ষণ বসেছিল কাছাকাছি। এ ছাড়া একবার, যখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে, একটি বয়স্কা মেয়ে তার প্রায় মুখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরক্ষণেই সরে গিয়েছিল। এমন হতে পারে, এদের মধ্যেই কেউ সেই পত্ৰলেখক। শিবতোষের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। দেখা করতে এসেও তারা তবে কেন দেখা করল না? বোধ হয় শিবতোষকে ভাল চিনতে পারে নি। চিনতে না পারায় এগিয়ে এসে আলাপ করতে সঙ্কোচ অনুভব করেছে।
খুবই আশ্চর্যের কথা, পত্রলেখক শিবতোষকে ভাল করে না চিনেও সাক্ষাৎ করার কথা লিখেছে। যে-মানুষ জানে, শিবতোষ অফিস ছুটির পর মাঠে বেড়াতে আসে, সে কি শিবতোষকে ভাল করে না চিনেই দেখা করার কথা লিখেছে! বোধ হয় নয়। শিবতোষের কাছে মানুষটি অপরিচিত। কিন্তু শিবতোষ তার কাছে অপরিচিত হতে পারে না।
কে জানে, হয়ত সেও শিবতোষকে চেনে না। লোকমুখে শিবতোষের কথা শুনেছে, জেনেছে শিবতোষ মাঠে এসে বসে, ভেবেছে শিবতোষকে খুঁজে নেবে।
যদিও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হল না শিবতোষের যে, লোকটি তাকে বিন্দুমাত্র না চিনেই অফিস অথবা বাড়ির বাইরে মাঠে ঘাটে দেখা করার কথা লিখতে পারে, তবু শিবতোষ ভাবল, তার কাছাকাছি যারা এসে বসেছিল, যারা তাকে মাঝে মাঝে দেখছিল, লক্ষ্য করছিল—তাদের সঙ্গে শিবতোষের আলাপ করা উচিত ছিল। আলাপ করলেই এক সময় শিবতোষ নিজের পরিচয় দিতে পারত, এবং সেই মানুষটি শিবতোষের সঙ্গে দেখা করতে এলে দেখা হয়ে যেত।
মানুষ যেমন দাবাখেলার ছক সামনে পেতে নানা রকমের চাল ভাবে, এটা-ওটা-সেটা ভেবে ভেবেও কুল না পেয়ে প্রথম-ভাবা চালটি চেলে দিতে বাধ্য হয়, শিবতোষও সেইরকম গোড়ার কথাটিই স্থিরভাবে ভেবে নিল । আগামীকাল ষোলো তারিখ, শুক্রবার; চিঠিতে ষোলো তারিখের কথা আছে। কালই সে আসবে। অবশ্য এমন হতে পারে, শিবতোষকে সে ভালমতন চেনে না; তার ভুল হতে পারে; কাজেই আগামীকাল তার কাছাকাছি যারা এসে বসবে, তাকে লক্ষ্য করবে, তার কাছে দেশলাই চাইবে বা সময় জানতে চাইবে, শিবতোষ এ-রকম লোকের সঙ্গে আলাপ করবে সামান্য। তাতে ক্ষতি নেই, বরং লাভ।
পরের দিন যথারীতি শিবতোষ মাঠে এল । আজ সে আসবে। অপেক্ষা করল শিবতোষ। কাছাকাছি যারা এসে বসেছিল, যারা তার সামনে দিয়ে বার কয় আসা-যাওয়া করেছিল, যারা সিগারেট ধরাতে দেশলাই চেয়েছিল, সময় জানতে চেয়েছিল—তাদের সঙ্গে টুকটাক আলাপ করার চেষ্টাও করল শিবতোষ। অবশেষে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হল, মাঠ ফাঁকা হয়ে আসতে লাগল, রাত্রি নামল, শিবতোষ অপেক্ষা—অপেক্ষা—অপেক্ষা করে, যথেষ্ট রাত সঙ্গে নিয়ে মাঠ ছেড়ে ফিরে চলল। না, সে এল না। সে আশা দিয়ে, আসতে বলে, শিবতোষকে উদ্বিগ্ন, ব্যাকুল ও উৎকণ্ঠিত করেও শেষ পর্যন্ত এল না। শিবতোষ কেমন শূন্য, ভার এবং হতাশ মন নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল।
চার
কোনো দাঁত সদ্য পড়ে গেলে সেই জায়গাটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে, বার বার জিবের ডগা এসে সদ্য-বিয়োগব্যথার মতন অভাবটি মনে করিয়ে দেয়, তারপর ক্রমে ক্রমে সয়ে আসে। চিঠির ঘটনাটাও শিবতোষের সয়ে আসছিল। কয়েকদিন পরে সে মনে করতে শুরু করেছিল, ওই চিঠি বাস্তবিকই তাকে অকারণে বড় বেশি উদ্বিগ্ন করেছে, উতলা করেছে এবং অশান্তি দিয়েছে। অতি বেশিরকম গুরুত্ব না দিলে, ওই এক চিঠি-চিঠি করে সারাক্ষণ না ভাবলে এ-রকম হত না। চিঠিটা জরুরী কিংবা প্রয়োজনীয় হলে পত্রলেখক নিশ্চয় যথাসময়ে আসত, দেখা করত; সে আসে নি, আসার গা করে নি। বোঝাই যাচ্ছে, ও-পক্ষ থেকে কোনো গরজ ছিল না, নেই।
সেদিন মন ভাল না থাকায় এবং কমলার সঙ্গে অকারণে কথা কাটাকাটি করতে গিয়ে চিঠির ব্যাপারটা সে ফেনিয়ে তুলেছিল। বোধ হয়, ওই যে কার চিঠি, কিসের চিঠি, কবে এসেছে—এ-সব বৃত্তান্ত কিছু বলতে না পারায় নিজের দোষ কাটাতে সে যথেষ্ট বেশি জেদ ধরেছিল। জেদের পরিণাম যা হয়।
মন যখন আর তেমন অস্থির নয়, ওই এক চিন্তা ক্রমাগত তাকে পীড়িত করছে না, তখন, সেই প্রায়-সয়ে-আসা ফাঁকা দাঁতের কাঁচা মাড়িতে একটা ধারালো কিছু হঠাৎ ফুটে গেল যেন। কাঁটার মতন।
“দেখা হল?” সন্ধে উতরে বাড়ি ফিরতেই কমলা জিজ্ঞেস করল।
“দেখা!” অবাক হল শিবতোষ। “কার সঙ্গে?”
“ওমা, এই তো গেল; তুমি তার পর-পরই বাড়ি ঢুকছ।” কমলাও যেন বুঝতে পারছিল না কিছুই।
“কে গেল? কার কথা বলছ তুমি?” শিবতোষ স্ত্রীর দিকে চেয়ে থাকল।
“আমি কি ছাই চিনি তাকে! কে একজন তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।”
“আমার সঙ্গে!” শিবতোষ অকস্মাৎ তার মনে আবার সেই চিঠির কাঁটা-ফুটে-যাওয়া অনুভব করল। “কখন এসেছিল?”
“এই তো তুমি এলে আর ও গেল ।…আমি ভাবলাম তোমার সঙ্গে পথে দেখা হয়ে গেছে।”
“না, না; আমার সঙ্গে কারও দেখা হয় নি। তুমি দেখেছ তাকে?”
“না, আমি কলঘরে তখন। দেখছ না” —কমলাকে তার সদ্য গা-ধোওয়া অবস্থাটা দেখাল।
“তা হলে কে দেখল? কার সঙ্গে কথা হল?”
“টুলু। টুলুকে ডেকে জিজ্ঞেস কর।” কমলা ভিজে শাড়ি-জামা মেলে দিতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
নিচে থেকে টুলু এল। বাবার ডাক শুনে মাস্টারমশাইয়ের হাতে অঙ্কের বইটা গছিয়ে দিয়ে এক ছুটে ওপরে চলে এসেছে।
“কে এসেছিল রে?” শিবতোষ মেয়েকে শুধলো।
“একটা লোক।”
“চিনিস না? দেখিস নি তাকে?”
“না।” টুলু মাথা নাড়ল। “অত্তো লম্বা—” বলে টুলু তার হাত যতখানি সম্ভব তুলে আগন্তুকের দীর্ঘতা বোঝাবার চেষ্টা করল।
“কি নাম বলল?”
“নাম বলে নি।”
“কোথা থেকে এসেছে, কি দরকার…কিছু বলে নি?”
টুলু বড় বড় চোখ করে বাবাকে দেখছিল। সেই লোকটা কড়া নাড়ছিল বলে পড়ার ঘর থেকে ছুটে টুলু সদরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। লোকটা খালি জিজ্ঞেস করল, বাবা আছেন বাড়িতে? টুলু মাথা নেড়ে না বলে দিল। তারপর আর কিচ্ছু বলে নি লোকটা, চলে গেল। টুলুর তেষ্টা পেয়েছিল জল খেতে রান্নাঘরে যাচ্ছে, মার সঙ্গে দেখা; মা গা ধুয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল। মা জিজ্ঞেস করল, কে এসেছিল রে? টুলু বলল, বাবাকে খুঁজতে এসেছিল একটা লোক।
কমলা বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এসেছিল। বলল, “আবার হয়ত আসবে ঘুরে।”
শিবতোষ কেন যেন পুনরায় সেই অস্বস্তি অনুভব করছিল। কে এল? অপরিচিত কেউ? শুধু টুলুর অপরিচিত, নাকি তারও?
“আবার আসবে বলে গেছে?” শিবতোষ মেয়েকে শুধলো।
“কি জানি!” টুলু নাক ঠোঁট কুঁচকে বলল; ঠিক যেমন করে পড়ার বইয়ের না-জানা পড়ার জবাব দেয়।
কমলা আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। “তুই যা।” মেয়েকে পড়ার ঘরে পাঠিয়ে দিল কমলা।
শিবতোষ চিন্তিত ও অসন্তুষ্ট হচ্ছিল। কে এসেছিল বোঝার উপায় নেই। গলিতে তার চেনা অচেনা কত লোকই পাশ দিয়ে চলে গেছে; ওর মধ্যে কে শিবতোষের খোঁজে এসেছিল কী করে বোঝা যাবে! তা ছাড়া, সে গলির মধ্যে ব্যানার্জি ব্রাদার্স-এ ঢুকেছিল একবার, ব্লেড এবং টুথপেস্ট কিনতে; হতে পারে সে-সময় লোকটি গলি দিয়ে চলে গেছে, শিবতোষকে দেখতে পায় নি। এমনও সম্ভব, যে এসেছিল সে শিৰতোষকে চেনে না, শিবতোষও তাকে চেনে না; ওরা একে অন্যের সামনাসামনি দাঁড়িয়েও কেউ কাউকে চিনতে না পেরে পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেছে। কিন্তু…কিন্তু…এইটুকু সময়ের মধ্যে লোকটি চলে গেল!
“এ যে কী হতচ্ছাড়া এক বাড়ি হয়েছে আমি বুঝতে পারি না।” শিবতোষ রাগ করে বলল, “বাড়িতে লোক এলে তাকে দুটো কথা জিজ্ঞেস করতে পার না কেউ?”
আয়নায় মুখ দেখে কমলা সামান্য পাউডার মেখে নিচ্ছিল, স্বামীর কথায় বিরক্ত হল; বলল, “তোমার মেয়েকে বল। আমায় শোনাচ্ছ কি!”
“যেমন মেয়ে তেমনি তুমি।”
“আমি—! আমি কি কলঘর থেকে তোমার লোক দেখতে ছুটব!” কমলা রেগে গিয়েছিল। “যা মুখে আসে বোলো না, একটু ভেবে-চিন্তে কথা বল।”
“ভেবে-চিন্তেই বলেছি। মানুষ ছোটদের সব সময় শিক্ষা দেয়। তোমার ছেলেমেয়েকে এমন শিক্ষা দিয়েছ যে, লোক এলে দুটো কথা জিজ্ঞেস করতে পর্যন্ত শেখে নি। ওআর্থলেস—!” রাগে ধিক্কারে শিবতোষ যেন আর কথা খুঁজে পেল না, চুপ করে গেল।
কমলা স্বামীর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। এমন অবুঝ মানুষ সংসারে আর হয় না। কোনোদিন ভাল করে কিছু বুঝবে না। বলল, “দেখ, অত শিক্ষা-শিক্ষা করো না। তোমার শিক্ষা যদি ভাল তবে ছেলেমেয়েকে দয়া করে দিলেই পার শিক্ষাটা, কে তোমায় মাথার দিব্যি দিয়ে বারণ করেছে!”
“তাই দিতে হবে।” শিবতোষ আলনা থেকে ধোয়া, কুঁচোনো কাপড় উঠিয়ে নিল।
“হ্যাঁ, দিয়ো। ছেলেমেয়ে তোমারও, আমি তাদের বয়ে আনি নি—”
শিবতোষ আর কথা বলল না; বলার সাহস পেল না; ইচ্ছেও হল না। মুখহাত ধুয়ে চলে গেল। যেতে যেতে শুনল, কমলা গজগজ করে বলছে, “সাত বছরের কচি মেয়ে, সে বুড়ো লোকের মত বুদ্ধি খেলিয়ে হাজার কথা জিজ্ঞেস করবে অচেনা মানুষকে, কী আমার কথা! কে এসেছিল, কে এসেছিল করে পাগল হয়ে গেলেন! যার আসার, দরকার থাকলে সে আবার আসবে নিজের গরজে, অত হাঁসফাঁস করার কি আছে!”
যে এসেছিল সে কিন্তু আর এল না। শিবতোষ দুর্ভাবনায় থাকল, শতরকম অনুমান করল, কিন্তু সে এল না। বিকারে দাঁড়িয়ে গেছে বললেও হয়। শিবতোষের কেমন সন্দেহ হয়ে উঠেছিল, এই লোকই সেই মানুষ, যে তাকে চিঠি লিখেছিল; মাঠে দেখা করতে পারে নি বলে বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে দেখা করতে এসেছিল। অদ্ভুত লোক; এল, চলে গেল—কিছু বলে গেল না; অপেক্ষা করল না, আবার ফিরে এল না। অশান্তি, বড় অশান্তির মধ্যে থাকল শিবতোষ এবং ক্রমাগতই বিশ্রী এক অস্বস্তি তাকে পীড়িত করতে লাগল। কেন লোকটা এ-রকম করছে, তার কী দরকার, আসব বলে আসে না, অসময়ে এসে ফিরে যায়—কেন, কেন, কেন? শিবতোষ খুঁটিয়ে কত ভাবল, কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না, অনুমান করতেও পারল না।
শিবতোষ অসুস্থ উদাস এবং অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল।
পাঁচ
বিকেল ফুরিয়ে আসার আগে আগেই আকাশে মেঘ জমেছিল। ঘন কালো সেই মেঘখণ্ড দেখে বোঝা যায় নি, তার পিছনে এক পাল ঝড়ো মেঘ হা-হা করে ছুটে আসছে। দেখতে দেখতে তারা এসে গেল, আকাশ আড়াল হল, ঘুটঘুটে অন্ধকার মতন হয়ে এল, তারপর কালবৈশাখীর ঝড় নামল। এই বুঝি এ-বছরের প্রথম কালবৈশাখী। দাপট দেখে মনে হচ্ছিল, সারা বছর পরে রীতিমত সাড়া দিয়ে আসছে। ঝড়ের শেষে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির তলায় তলায় ঝড়ের ঝাপটা থেকে গেল।
আজ রবিবার। সকালে, একটু বেলায় শিবতোষকে যেতে হয়েছিল ভুবনের বাড়ি। শ্রাদ্ধকৰ্ম ছিল আজ। অফিসের সবাই ছিল; দোতলার ঘরে ভুবনের একটি ছবি বাঁধানো, কিছু ফুল। ধূপ পুড়ছিল। কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন এসেছিল ভুবন এবং গৌরীর। কিন্তু কাজকর্ম যা করার অফিসের বিশু মিত্তির, প্রফুল্লবাবু, রাখাল—এরাই করছিল। কীর্তনের ব্যবস্থা ওরা করে নি। ভুবন একেবারে এ-কালের ছেলে ছিল, এ-সব সে পছন্দ করত না, ভালবাসত না। শার্মামশাই কয়েকটি ভগবৎ গান গেয়েছিলেন ওই ঘরে বসে, পুরনো বাংলা গান।
গৌরীর সঙ্গে দেখা হতে শিবতোষ চোখ নামিয়ে নিল। নিজেকে ভীষণ অপরাধীর মতন লাগছিল। গৌরীর পরনে শ্বেতবস্ত্র, সমস্ত মুখটি সাদা পাথরের মতন। সিঁথিটি যে কী ভীষণ খাঁ খাঁ করছিল, যেন গৌরীর সমস্ত জীবন শূন্য হয়ে গেছে। শিবতোষ চোখ নামিয়ে নিয়ে আর উঠোতে পারছিল না। দু’ একটি কথা বলল গৌরী; শিবতোষ কোনো রকমে হুঁ হাঁ করল, সে কথা বলতে পারছিল না; দুটো সান্ত্বনার কথাও তার মুখে এল না।
শ্রাদ্ধ থেকে ফিরতে বেশ বেলা হয়ে গেল। মন যেন একটি দূর কোনো রিক্ত প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সমস্ত কিছু অর্থহীন অকারণ লাগছিল, বিধাতার নিষ্ঠুরতায় তার চোখের তলায় কোথায় যেন জ্বালা আর ঘৃণা অনুভব করছিল।
এমন অবস্থায় দুপুর কাটল, বিকেল গেল। তারপর ঝড় উঠল কালবৈশাখীর, বৃষ্টি নামল। অন্য দিনের তুলনায় আজ দ্রুত সন্ধ্যা নেমেছিল এবং বৃষ্টিঝড়ে রাত ঘন ও বিষণ্ণ হয়ে এসেছিল।
শিবতোষ ঘরে শুয়ে ছিল। ছেলেমেয়েরা বড় হল্লা করছিল বলে নিচে পড়ার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। কমলাও নিচে রান্নাঘরে। বিছানায় অলসভাবে শুয়ে শিবতোষ মন অন্যমনস্ক করার জন্য প্রথমে রবিবারের কাগজটা তন্নতন্ন করে দেখেছে, পড়তে চেষ্টা করেছে, সামান্য কয়েকটা লাইন পড়ে ছেড়ে দিয়েছে; তারপর বিজ্ঞাপন দেখেছে; সেটাও ভাল লাগে নি। কাগজটা ফেলে কমলার আনানো বাংলা উপন্যাস নিয়ে মন ভুলোতে গেছে, পারে নি। রিডার্স ডাইজেস্ট? তাও না। একবার রেডিয়ো খুলেছিল, পল্লীমঙ্গল চলছে, বন্ধ করে দিয়েছে। চা খেয়েছে, দুবার, পাঁচ-সাতটা সিগারেট পুড়িয়েছে, তবু এই বিষণ্ণতা তার বিন্দুমাত্র কাটল না। এখন বিছানায় চুপ করে শুয়ে আছে শিবতোষ। পাশের ঘর অন্ধকার। এই ঘরেও জোর বাতিটা নিবিয়ে দিয়েছে, হালকা বাতিটা জ্বলছে। বাইরে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে, ঝড়ের ঝাপটা আসছে মাঝে মাঝে।
শুয়ে শুয়ে শিবতোষ ছেঁড়া বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে কত কথা ভাবছিল । কখনও ব্যক্তিগত কথা, কখনও এই বৃহৎ সংসারের কথা। জীবনের যে-সব উদাস চিন্তা মানুষকে নিঃসঙ্গ ও অতি দীন অনুভব করায়, এক সময় শিবনাথ তার চিন্তাও করছিল। সে ভুবনের কথা ভাবছিল, গৌরীর কথা ভাবছিল, নিজের কথা, বাবার কথা, সুরমার কথাও। এবং সে অফিসের কারও কারও কথা, যারা নেই, মৃত তাদের ও আজকের শ্রাদ্ধের কথাও ভাবছিল। শর্মামশাই যে গানগুলি গাইছিলেন, তার একটি গানের দুটি কলি ভাঙা ভাঙা ভাবে শিবতোষের মনে পড়ছিল: ‘আঁখি তৃষিত অতি আঁখিরঞ্জন, আঁখি ভরিয়া মোরে দাও হে দেখা…।’ সমস্ত চিন্তা একটি অন্যকে নিজের জগতে টেনে এনে এক জটিল অস্পষ্ট নীহারিকা-লোক যেন তৈরি করে রেখেছিল। শিবতোষ মৃদু অনুজ্জ্বল আলোয় এবং নিরিবিলি নিঃশব্দ ঘরে বিছানায় শুয়ে আধবোজা চোখে এই বিবিধ চিন্তায় যখন আত্মবিস্মৃত, বাইরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে ঝিরঝির করে, তখন হঠাৎ শুনতে পেল শব্দটা।
নিচে কে যেন কড়া নাড়ছে। খুব জোরে কেউ কড়া নেড়ে দিল। দু’ মুহূর্ত অপেক্ষার পরই শিবতোষ অনুমান করল, তাকে কেউ খুঁজতে এসেছে। আর পরক্ষণেই তার মনে হল, নিচে থেকে ওরা কেউ আগন্তুককে দরজা খুলে দেয় নি। হয়ত শব্দটা তাদের কানে যায় নি।
আচমকা এক ধরনের ভীত উত্তেজনা এবং বিহ্বলতার বশে শিবতোষ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। গলির দিককার বারান্দায় এল দ্রুত পায়ে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে, বাতাস বেশ উদ্দাম। গলির নিচের বাতিটা আজ খারাপ হয়ে আছে। অন্ধকার গায়ে গায়ে মাখানো। কিছু দেখতে পেল না শিবতোষ। “কে?” শিবতোষ ঝুঁকে পড়ল, চোখ যতদূর সম্ভব তীক্ষ্ণ করে দেখবার চেষ্টা করল। “কে? নিচে কে?” বাতাসের ওপর গলা তুলে চিৎকার করার মতন করে ডাকল শিবতোষ। কেউ সাড়া দিল না।
পা সামান্য কাঁপছিল, বুকের মধ্যেও কাঁপছিল, নিশ্বাসপ্রশ্বাস কিছুটা দ্রুত। শিবতোষ নিচে নেমে এল। বাবুল আর টুলু পড়ার ঘরে বসে খাতা পাকিয়ে গোল করে মুখে ধরেছে, ধরে ঘোড়ার ডাক গাধার ডাক মুরগির ডাক-এর খেলা খেলছে।
ওরা জানে না, কে কড়া নেড়েছে, ওরা শোনে নি। বাবুল বলল, “কুকুর—একটা কালো রঙের কুকুর আছে না গলিতে বড়মতন, সে মাঝে মাঝে দরজায় এসে গা ঘষে।”
কমলা রান্নাঘরে, মিনু মার কাছে। ওরা কেউ বাইরে এল না। বাবুল আর টুলু আবার শান্ত ও শিষ্ট হয়ে গিয়ে বইয়ের পাতা খুলল। শিবতোষ অবসন্নের মতন, যেন তার শেষ প্রত্যাশাও ব্যর্থ হয়ে গেছে, নিতান্ত হৃতসর্বস্ব চেহারা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এল।
অলৌকিক কাহিনী অশরীরী মানুরে মতন ওই মানুষটি আসে যায়। ওর আসা অনুভব করা যায়, দেখা যায় না, বলা যায় না। মনের ভুল দিয়ে সে আসে কি? হয়ত আসে না।
শিবতোষ বুঝতে পারল না, আবার কবে সে আসবে? সে কে? সে কেমন?
অত্যন্ত অস্বস্তির মধ্যে ঘুম ভেঙে গেল শিবতোষের। সে এক দুঃস্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নের মধ্যে সে শিলাবৃষ্টিতে যথেষ্ট ভিজেছে এবং আহত হয়েছে। খুবই আশ্চর্যের কথা, একটি মনোরম মন্দির ছিল সামনে তবু শিবতোষ শিলাবৃষ্টিতে সেই মন্দিরের দিকে যেতে পারে নি, পৌঁছতে পারে নি।
ঘুম ভেঙে গেলে দুঃস্বপ্নের অস্বস্তি এবং স্বেদ অনুভব করল শিবতোষ। গলার তলায় যথেষ্ট ঘাম হয়েছে। হাত ভিজে গেল। তবু, এখন অনেকটা স্বস্তি অনুভব করতে পারছিল। ঘর নিকষ-কালো; এক কণা আলো নেই কোথাও, কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাইরে কি বৃষ্টি পড়ছে না।
শিবতোষ সোজা হয়ে শুল। মনে হল, পাশে কমলা শুয়ে আছে। ও-ঘরে বড় করে বিছানা পাতা থাকে, তিনটি ছেলেমেয়ে ঘুমোয়। কমলা মিনুর পাশে শুয়ে পড়ে কোনোদিন, কোনোদিন বা উঠে স্বামীর পাশে চলে আসে? মিনুও মাঝে মাঝে বাবার কাছে শুয়ে থাকে। আজ কমলা শুয়ে আছে । কমলা যে পাশে আছে, তাকে স্পর্শ না করেও বোঝা যায়। কেননা, কমলা ঘুমিয়ে পড়লেই প্রায় মিনুর মতনই তার একটা হাত স্বামীর বুকের কাছে মুঠো হয়ে থাকবে। কী অদ্ভুত, এত বয়স হয়ে এল, পঁয়ত্রিশ প্রায়, তবু ঘুমিয়ে পড়লে এখনও সে শিবতোষের বুকের কাছে গেঞ্জিটা মুঠো করে ধরে রাখে। এই অভ্যেস ছাড়ানো গেল না কমলার। বললে লজ্জা পায়, তারপর হেসে জবাব দেয়, “বেশ করি; থাকবই তো ধরে। কি জানি বাবা, যদি পালিয়ে যাও!”
পালিয়ে যাবে শিবতোষ! কোথায়?
অন্ধকারে বড় দুঃখীর মতন দু’ দণ্ড নিশ্বাস নিল শিবতোষ। মনে হল, ঘরের পাখাটা তেমন করে ঘুরছে না। এই পাখাটা অনেক দিনের, বাবার আমলের। বিলিতি পাখা; আজও কাজ দিচ্ছে। বাবার কথায় নিজের কথাও মনে এল শিবতোষের। বিশ বছরের পাখা। তার বয়স যখন পঁচিশ-টচিশ, তখন বাবা কিনেছিল। হ্যাঁ, পাখা কেনার বছরেই শিবতোষ দেখতে পেল, মা মারা যাচ্ছে। বাবা মারা গেছে শিবতোষ যখন একত্রিশ বছরের, বত্রিশ বছর বয়সে শিবতোষ বিয়ে করেছিল, আজ তার বয়স পঁয়তাল্লিশ ছাড়িয়ে যাবে।
দেখতে দেখতে অনেকটা পিছু ফেলে আসা গেল। এবার—এবার একদিন…।
কমলার হাতের মুঠো সরিয়ে দিতে গিয়েও শিবতোষ কেমন দুর্বল সহানুভূতিভরে, কোমল করে ও প্রেমভরে সেই মুঠো ধরে থাকল। কমলা বলে, তাকে পালিয়ে যেতে দেবে না।
আমার বুকের কাছে এক মুঠো গেঞ্জি ধরে তুমি আমায় আটকে রাখবে, কমলা! শিবতোষ কতকালের নিশ্বাস যেন বুকে চেপে ধরে অনেকক্ষণ স্তব্ধ থাকল, তারপর মনে মনে বলল, আমি ভুবনের মতন এই মুহূর্তে চলে যেতে পারি। তুমি মুঠো খুলবে যখন, তখন দেখবে আমি নেই।
শিবতোষ কেমন যেন এক ধরনের জলরাশির তলায় চাপা পড়ে গেল, তার চেতনার ওপর দিয়ে অদ্ভুত এক স্রোত বয়ে যেতে লাগল, নিঃস্বতার স্রোত। মনে হল, অখণ্ড কোনো শূন্যতার মধ্যে সে ভেসে যাচ্ছে। তার চতুপার্শ্বে সে কোনো অবলম্বন বা আশ্রয় পাচ্ছে না। সে বড় একাকী।
শিবতোষ ভাববার চেষ্টা করল, সে কোথায় ছিল? কেন, এই সংসারে! মনে মনে জবাব দিল শিবতোষ। আজন্ম এই সংসারে সে আছে। কমলা, বাবুল, মিনু, টুলু, অফিস বাড়ি গলি মনিহারী দোকান…এ-সবের মধ্যে সে ছিল, সে রয়েছে।
কিছুটা সান্ত্বনা পেতে যাচ্ছিল শিবতোষ, হঠাৎ নিজেকে সতর্ক করে দিয়ে ধিক্কার দিল। না, সে এ-সবের মধ্যে নেই। তার থাকাটা ছায়ার মতন; হ্যাঁ—এই থাকা ছায়ার অস্তিত্ব সদৃশ; মিথ্যা নয় অথচ মিথ্যাই। আমি, আমি, আমি। তুমি কে শিবতোষ? তুমি এই সংসারে একান্ত অন্যের ছায়া। তুমি অন্য বস্তুর গুণে একটি মিথ্যা আকার পেয়েছ, যেমন কিনা আলো এবং বস্তু বিনা ছায়া হয় না, অতএব তুমি নির্গুণ এবং আলো ও বস্তুটিই প্রকৃত গুণ।
ভাল লাগল না। চিন্তাটা ভাল লাগল না শিবতোষের, মনঃপূত হল না। এই সংসারে সে আছে। কমলা, বাবুল, মিনু, টুলু—এদের মধ্যে সে আছে, সে এদের সঙ্গে বন্ধন ও একাত্মতা অনুভব করে। এদের সঙ্গে তার প্রতিটি দিনের গ্রন্থি, সুখ-দুঃখ, প্রেম, বেদনা, স্নেহ ও আশার বন্ধন। যদি আমি মিথ্যা হতাম, তবে এই বন্ধন সত্য হয় কী করে?
শিবতোষ যেন প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পেরেছে ভেবে এবার কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষ তাকে স্বস্তি দিল না, বলল: ওরা যদি তোমার সর্বস্ব তবে তোমার এই অভাব, এই উদাস ভাব, অন্যমনস্কতা কেন? কেন তুমি এমনিভাবে মাঝ-রাতে জেগে ওঠ?
কেন শিবতোষ জেগে ওঠে সে কি জানে? সে কি জানে, কেন সে কোনোও কোনোদিন প্রবল শিলাবৃষ্টিতে ভিজে এবং আহত হয়েও একটি আশ্রয় খুঁজে পায় না? এই সুখ পাওয়াও কি তবে অভ্যস্ত অবস্থার বাধ্যবাধকতা, কুকুরের জিবে জল আসার মতন তারও ইন্দ্রিয়ে সুখের জল আসছে?
এইসব এলোমেলো অগোছালো চিন্তার মধ্যে অকস্মাৎ শিবতোষের সেই চিঠির কথা মনে পড়ে গেল। চিঠিটা যেন উড়ে এসে এসে তার চোখের সামনে খুলে পড়ল। শিবতোষ একদৃষ্টে বুঝি চিঠিটার প্রেরককে খুঁজছিল।
অবিশ্বাস্য ভাবেই এখন শিবতোষের দুটি কথা মনে পড়ে গেল। চিঠির শেষে লেখা ছিল কথা দুটি। শিবতোষ স্পষ্ট যেন দেখতে পাচ্ছে সেই ছত্রটা: ‘আমি আসব। আমার অপেক্ষা করো।’
শিবতোষ অনুভব করতে পারল, কোনোদিন সে আসবে, অতি অবশ্যই সে আসবে। কিন্তু সে কেমন, কতদিন অপেক্ষা করতে হবে, শিবতোষ বুঝতে পারল না। শুধু শিবতোষ আজ এই মধ্যনিশীথে পরিপূর্ণ নীরবতার মধ্যে সেই অবধারিতকে অনুভব করতে পারছে।