অপেক্ষা
মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে জানালার চৌকাঠে। দু—হাতে ধরে আছে জানালার শিক, শিকের ফাঁকে মুখ গলানো। তার বাবা ফিরতে দেরি করছে। বাবা ফিরলে তারা সবাই দোকানে যাবে। আজ ফ্রক কেনা হবে পুজোর। কিন্তু বাবা ফিরছে না।
পাঁচ বছরের মেয়ে, সব কথা কইতে পারে। হঠাৎ মুখটা ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কটা বাজে মা?
মেয়ের মা সেলাই মেশিন থেকে মুখ তুলে ঘড়ি দ্যাখে। সাতটা, মানুষটা এত দেরি কখনো করে না। বড্ড মেয়ে ন্যাওটা। বউ ন্যাওটা মানুষ, অফিসের পর আড্ডা—টাড্ডা দেয় না বড়ো একটা। দিলেও আগে—ভাগে বলে যায় ফিরতে দেরি হবে। সরকারি অফিস, তাই ছুটি—টুটির ধার ধারে না, অফিসের ভিড় ভাঙার আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে। তার ওপর আজ পুজোর কেনাকাটা করতে যাওয়ার কথা। দেরি হওয়ার কারণ নেই। তবু সাতটা বেজে গেল, মানুষটা আসছে না।
মেয়ের মার বয়স মোটে ছাব্বিশ, ছয় বছর হল বিয়ে হয়েছে। দেখতে শুনতে আজও বেশ ভালো। পাতলা দীঘল গড়নের যুবতী, এখনও কত সাধ—আহ্লাদ। মেয়ের বাবারও বয়স ত্রিশের মধ্যেই। ভালো স্বাস্থ্য, সাবধানী, সংসারী এবং সঞ্চয়ী পুরুষ। সংসার সুখেরই!
তারা দু—বেলা ভাত খায় এই আকালের দিনেও। তবু কেন সাতটা বেজে গেল। সময়ের চোরা স্রোত কেন বয়ে গেল হু হু করে?
মেয়ের মা সারাদিন সেলাই করছে। মেয়ের বাবার বড়ো শখ হয়েছে ফতুয়া পরবে। পরশু চার গজ পাতলা লংক্লথ কিনে এনেছে। দুটো ফতুয়া সেলাই করতে করতে চোখ ঝাপসা, মাথা টিপটিপ, মেশিনটা সরিয়ে রাখে বউ মানুষটা। মন ভালো লাগে না। দুশ্চিন্তা হচ্ছে বড়ো। সাতটার মধ্যে না আসার কথা নয়।
মেয়ে আজকাল ইস্কুলে যায়। তাই মেয়ের মা সারাদিন একাভোগা। কী করে, কী করে, কী করে! ঘুরেফিরে ঘর সাজায়। বিছানার কভার পালটায়, জানালার পর্দা পালটায়, সেলাই করে। উল বোনে, একশোবার ঘরের আসবাব এধার থেকে ওধার করে।
আজও সারাদিন সাজিয়েছে, তারা আর বেশিদিন এই ফ্ল্যাটে থাকবে না। গড়িয়ার দিকে একটা জমি কেনা হয়েছে। বিল্ডিং মেটেরিয়ালের জন্য দরখাস্ত করা হয়েছে। বাড়ি উঠলে তারা নিজেদের বাড়িতে উঠে যাবে। কথা আছে। বাড়ি হলে সামনে শখের বাগান করবে বউটি, স্টিলের আলমারি করবে, ভগবান আর একটু সুদিন করলে গ্যাসের উনুন আর একটি সস্তার রেফ্রিজারেটরও হবে তাদের। মেয়ের বাবার শখ টেপ রেকর্ডারের, আর ডাইনিং টেবিলের। তাও হয়ে যাবে। সাশ্রয় করে চললে সবই পাওয়া যায়। কিন্তু সাতটা বাজে। সময় বয়ে যাচ্ছে।
মেয়ের মা রান্নাঘরে আসে। দুশ্চিন্তা আর দুশ্চিন্তা। দেরির একটাই মানে হয়। কিন্তু মানেটা ভাবতে চায় না বউ মানুষটি। সে ঢাকনা খুলে দেখে রুটিগুলি শক্ত হয়ে গেল কিনা। সে এলে আবার একটু গরম করে ঘি মাখিয়ে কচুর ডালনার সঙ্গে দেবে। চায়ের জলটা কি বসাবে এখুনি? হাতে কেটলি নিয়ে ভাবে বউটি। জনতা স্টোভের সলতে উসকে দিয়ে দেশলাই ধরাতে গিয়েও কী ভেবে রেখে দেয়। জল বেশি ফুটলে চায়ের স্বাদ হয় না। এসেই তো পড়বে এক্ষুনি, তখন চাপাবে।
মেয়ে আবার চেঁচায়, কটা বাজল মা?
বুকটা ধ্বক করে ওঠে। ঘড়ি না দেখেই বউটি উত্তর দেয়, কয় টা আর! এই তো সাড়ে ছয়টা।
মিথ্যে কথা, প্রকৃত হিসেবে সাতটা পেরিয়ে গেছে।
সিঁড়িতে জুতোর শব্দ। বউটি নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা খুলল।
না। সে নয়। উপরতলায় লোক সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল।
বাবা আসছে না কেন? মেয়ের প্রশ্ন।
এল বলে। তুই বেণীটা বেঁধে নে না ততক্ষণে।
বাবা আসুক।
আচ্ছা বাপ—ন্যাওটা মেয়ে যা হোক।
কেন আসছে না বাবা?
রাস্তাঘাট আটকে আছে বুঝি! আজকাল বাসে—ট্রামে বুঝি সহজে ওঠা যায়!
রোজ তো আসে।
আজও আসবে।
বিশ্বাস। বিশ্বাসের জোরেই বউটি হাত—মুখ ধুয়ে এসে পরিপাটি করে চুল বাঁধল। সিঁদুরটা একটু বেশিই ঢালল সিঁথিতে। ইদানীং বাজে সিঁদুরে চুল উঠে যায় আর মাথা চুলকোয় বলে সিঁদুরটা কমই লাগাত। আজ কম দিল না। একটু ফাউন্ডেশন ক্রিম ঘষল মুখে। লিপস্টিক বোলালো। সূক্ষ্ম কাজলও টানল একটু। ঘড়ির দিকে চাইল না।
সকালের রাঁধা তরিতরকারি জ্বাল না দিলে নষ্ট হয়ে যাবে। তাই যখন স্টোভ জ্বেলে জ্বাল দিতে বসল তখনই সে টের পেল, গায়ে—পায়ে একটা কাঁপুনি আর শীত। শরীর বশে থাকছে না। ভয়? না কি পেটে একটা শত্তুর এল?
কিন্তু রাত থেমে থাকল না। গড়াতে লাগল সময়। একসময়ে বউটির ইচ্ছে হল উঠে গিয়ে ঘড়িটাকে আছাড় মেরে বন্ধ করে দিয়ে আসে। কারণ আটটাও বেজে গেল? মানুষটা ফেরেনি।
লুকিয়ে আছে কোথাও? ভয় দেখাচ্ছে না তো?
জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়েছে শিশুটি! তার খিদে পেয়েছে, তেষ্টা পেয়েছে। বউটি পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে একবার ঘুরে এল। ও ফ্ল্যাটের কর্তা ফিরেছে। ও বাড়ির বউ শুনে—টুনে বলে, রাত তো বেশি হয়নি, সাড়ে আটটা। আর একটু দেখুন, তারপর না হয় আমরা কর্তাকে খোঁজ নিতে পাঠাব। শুনলুম, কারা মিছিল—টিছিল করেছে, রাস্তা খুব জ্যাম।
আশ্বাস পেয়ে বউটি ফিরে আসে। কিন্তু ঘরে এসে শান্ত বা স্থির থাকতে পারে না। কেবলই ছটফট করে। ঘড়ির কাঁটা এক মুহূর্ত থেমে থাকছে না যে! বউটি বার দুই বাথরুমে ঘুরে এল। মেয়েকে খাওয়াতে বসে বারবার চোখে আসা জল মুছলে আঁচলে। তার বয়স বেশি নয়। মাত্র ছ—বছর হল বিয়ে হয়েছে। একটা জীবন পড়ে আছে সামনে।
ঘড়ির কাঁটা জলস্রোতের মতো বয়ে চলেছে। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, বারবার ওপরে উঠে আসে আরও ওপরে উঠে যায়। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ নেমে আসে, নেমে যায়। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। সময় যাচ্ছে বয়ে।
শিশু মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমোবার আগে ক্ষীণ কণ্ঠে একবার বলে, মা, বাবা বাক্যটা শেষ করে না। বউটি আগ্রহে ঝুঁঁকে শুনবার চেষ্টা করে বাক্যটি। শিশুরা তো ভগবান, ওদের কথা অনেক সময় ফলে যায়। কিন্তু শিশু মেয়েটি বাক্যটা শেষ করে না। বউটির বুক কাঁপে।
এবার বউটি একা! জানলার পাশে। শিকের ফাঁকে চেপে রাখা মুখ চোখের জলে বাসে! ন—টা বেজে গেল বুঝি! বউটি আস্তে আস্তে বুঝতে পারে, তার মানুষটা আর আসবে না। অমন মানুষটার নানা চিহ্ন তার মনে পড়ে। কথা বলার সময় ওপরের ঠোঁটটা বাঁদিকে একটু বাঁক খায়, লোকটার দাঁত একটু উঁচু, গাল ভাঙা, কপালের ডান দিকে একটা আঁচিল, সাবধানি ভীতু এবং খুঁতখুঁতে মানুষ। বড্ড মেয়ে—ন্যাওটা আর বউ—ন্যাংটা। এমনিতে এসব মনে পড়ে না, কিন্তু এখন বড্ড মনে পড়ছে। বউটা হাপুস হয়ে কাঁদতে থাকে।
সদর খোলা ছিল। সিঁড়িতেও শব্দ হয়নি।
অন্ধকার ঘরের ভিতর একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে, একী, সব অন্ধকার কেন?
চমকে ওঠে বউটি, বুঝতে পারে, মানুষটা ফিরেছে।
কী হয়েছিল শুনি!
আর বোলো না, সত্যকে মনে আছে?
কে সত্য?
কোন্নগরের। আমরা বুজুম ফ্রেন্ড। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা গেল। খবর পেয়ে অফিস থেকেই গিয়েছিলুম। মনটা যে কী খারাপ লাগছে।
বউটি আলো জ্বালে, ঘরদোর আবার হেসে ওঠে। তারা খাওয়াদাওয়া সারে। হাসে গল্প করে।
মানুষটা বারবারই তার মৃত বন্ধুর কথা বলে। বউটি বলে আহা গো।
কিন্তু বউটি তবু সুখীই বোধ করে। কারণ তার মানুষটা ফিরেছে। মানুষটা ফিরেছে। মানুষটা বেঁচে আছে।