অপারেশেন মিরর হান্ট

অপারেশেন মিরর হান্ট

“অসম্ভব। আমার পক্ষে কোনভাবেই ওই ভাঙাচোরা পুরনো মডেলের করোলায় চড়া সম্ভব না। আমি কোন অন্যায় করিনি যে আমাকে চুরি ডাকাতি করে বাড়ি থেকে বের হতে হবে।” আশফাক চৌধুরী বললেন। সোফা ছেড়ে উঠে তিনি পায়চারি করতে শুরু করলেন। তিনি বেশ উত্তেজিত। 

“আপনি নিরাপদে মিটিং-এ পৌঁছাতে চান তো?” ফিরোজ জিজ্ঞাসা করলেন। 

“অবশ্যই চাই।” আশফাক চৌধুরী বললেন। 

“তাহলে আমার মনে হয়, এটাই সব থেকে নিরাপদ উপায়।” ফিরোজ বেশ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে কথাটা বললেন। 

আশফাক চৌধুরীকে বিভ্রান্ত মনে হল। গলায় বিভ্রান্তি ফুটিয়ে বললেন, “কিন্তু সিকিউরিটি ছাড়া আমি কিভাবে যাব?” 

“এই মুহূর্তে সিকিউরিটিই হচ্ছে আপনার জন্য সব থেকে বড় বিপদ। যদি সিকিউরিটি থাকে তাহলে ওরা আপনাকেই টার্গেট করবে আগে। এখন পর্যন্ত যতজন মারা গিয়েছেন, মানে খুন হয়েছেন, তার ভেতরে প্রায় সবাই বডিগার্ড বেষ্টিত হয়ে ছিলেন।” ফিরোজ বললেন। 

“তাছাড়া” ফিরোজ জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “একজন জনদরদী নেতার কেন নিরাপত্তা লাগবে বলেন? যদি তিনি জনদরদীই হন?” 

আশফাক চৌধুরী খোঁচাটা ধরতে পারলেন না। খোঁচা ধরার মত সময়ও এটা না। তার চোখে মুখে একটা চাপা অস্থিরতা। ফিরোজকে ভরসা করার কারণ খুঁজছেন যেন। এইমুহূর্তে তার দিকেই পাল্লা ভারি। ফিরোজকে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলার মত তথ্য আছে তার কাছে। মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে গবেষনা করার ঘটনা চাইলেই তিনি ইউনেস্কো আর বিবিসির মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারেন। ফিরোজ এখন তার হাতের পুতুল। তার কিছু হলে তিনিও ফিরোজকে ছাড়বেন না। 

“ঠিক আছে।” গোঁয়ারের মত বললেন তিনি। 

***

ঠিক সকাল নয়টায় আশফাক চৌধুরীর বাড়ি থেকে সাদা পাজেরোটা বের হয়ে গেল। সেটার সামনে একটা কালো মিতসুবিসি। আর পেছনে একটা কালো মিতসুবিসি। দুটোতেই মোট ছয়জন সরকারি বডিগার্ড। আর পেছনে চারটা পুলিশের মোটরসাইকেল। আর একটা পুলিশ ভ্যান। 

গাড়িগুলো বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই একটা ময়লা ফেলা ড্রাম নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের একজন পরিচ্ছন্ন কর্মী বের হয়ে এলো আশফাক চৌধুরীর বাড়ি থেকে। সে ধীরে ধীরে ড্রামটা ঠেলে নিয়ে গেল আশফাক চৌধুরীর বাড়ি থেকে দশ মিটার দূরের ল্যাম্পপোস্টটার কাছে। একটা সাদা করোলা অপেক্ষা করছিল ওইখানে। ময়লা ফেলা ড্রাম থেকে আশফাক চৌধুরী বের হয়ে দ্রুত করোলার প্যাসেঞ্জার সিটে শুয়ে পড়লেন। সাথে সাথে সাদা করোলাটা বাম পাশের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেল। 

মিরর এক 

মেরিলিনার গাড়ির বনেটের ভেতরে মেজর জেনারেল ফিরোজ।”নাসরিন” ফিরোজ হক ওয়াকিটকির মাউথ পিসে বললেন, “ড্রোন ওয়ানের অবস্থা কি? আর মিরর এক এর অবস্থা কি? 

“অবস্থা স্বাভাবিক স্যার। আর মিরর এক, মানে আপনাদের গাড়ির অবস্থান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তিন কিলোমিটার দুরে।” নাসরিনের যান্ত্রিক কণ্ঠ। 

ফিরোজ এবার বললেন, “মুরাদ। ড্রোন দুই এর কি অবস্থা? মিরর দুই এর অবস্থান বল।” 

স্পিকারে খড়খড় করে মুরাদের কণ্ঠ শোনা গেল, “ড্রোন দুই এর অবস্থাও স্বাভাবিক স্যার। মিরর দুই, মানে রঞ্জন স্যাররা কার্যালয় থেকে আর আড়াই কিলোমিটার দুরে আছেন।” 

ফিরোজ এবার বললেন, “রঞ্জন, শুনতে পাচ্ছ?” 

“হ্যাঁ স্যার।” 

“আমাদের আগে তোমাকে কার্যালয়ে পৌঁছাতে হবে। তুমি ঢোকার পরে আমরা ঢুকব।” 

“আচ্ছা স্যার।” 

মিরর দুই

আশফাক চৌধুরীর হৃৎপিণ্ডটা ধড়াস ধড়াস করছে। আশেপাশে গাড়ি কম। রাস্তাতে তেমন একটা ভিড় নেই। নরম রোদ এসে তার পায়ে পড়ছে। তার হালকা লাগার কথা। কিন্তু হালকা লাগছে না। মনে হচ্ছে বুকের ওপরে কেউ যেন চেপে বসে আছে। দুশ্চিন্তা কমাতে তিনি বললেন, “তোমার কি মনে হয় রঞ্জন? ফিরোজ সত্যি সত্যিই আমাকে অনেক সম্মান করে?” 

রঞ্জন বললেন, “হ্যাঁ স্যার।” 

আশফাক চৌধুরী নিজেকে নিজেই বললেন, “আরে আমার কিছু হলে ওর গর্দান থাকবে? আমি মন্ত্রী। আমি দেশ চালাই হে। আমার কিছু হলে প্রধানমন্ত্রী ওকে ছেড়ে দেবেন?” 

রঞ্জন কিছুই বলল না প্রভুতরে। তার কেন জানি খুব অস্বস্তি লাগছে। যেকোন একটা গাড়ির ওপরে হামলা হলে যেন এই অস্বস্তিটা কমে। 

মিরর এক 

“নাসরিন। ড্রোন একের খবর কি? মিরর এক এর অবস্থান কোথায়?” ফিরোজ বললেন। 

“ড্রোন এক বলছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক স্যার। কার্যালয় থেকে মিরর এক আর দুই দশমিক তিন কিলোমিটার দূরে। আশেপাশে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ছে না।” 

“মুরাদ? ড্রোনের কি অবস্থা?” 

“ড্রোন দুই অনুযায়ী চারপাশ স্বাভাবিক। মিরর দুই কার্যালয় থেকে এক দশমিক আট কিলোমিটার দূরে।” 

সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক হচ্ছে। এখন শুধু অপেক্ষা। 

হঠাৎ নাসরিনের গলা শোনা গেল স্পিকারে। 

“স্যার। ড্রোন এক অনুযায়ী সামনের শতরঞ্জির মোড়ে চারটা গাড়ির বহর মিরর একের দিকে এগিয়ে আসছে। আই রিপিট। একটা গাড়ির বহর মিরর একের দিকে এগিয়ে আসছে। খুব দ্রুত বেগে এগিয়ে আসছে।” 

মেজর জেনারেল ফিরোজ বললেন, “মেরিলিনা?” 

“শুনতে পাচ্ছি।” 

“যা কিছু হয়ে যাক। স্বাভাবিকভাবে গাড়ি চালাবে। থামবে না।” 

“হুম।” 

একটু পরে আবার নাসরিনের কণ্ঠে একই সুর শোনা গেল। ফিরোজ এবার মাউথপিসে বললেন, “মুরাদ। ড্রোন দুই খবর কি? মিরর দুই কত দুরে?” 

“স্যার ড্রোন দুই অনুযায়ী সব স্বাভাব…… স্যার ড্রোন দুই অনুযায়ী মিরর দুইকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মেরেছে। আই রিপিট। মিরর দুইকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মেরেছে। স্যার শুনতে পাচ্ছেন?” 

মিরর দুই

ট্রাকটা পাশের একটা গলি থেকে বিদ্যুৎ গতিতে বের হয়ে আসল যেন। রঞ্জন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রাকটা পুরনো করোলার সামনের অংশে সজোরে একটা ধাক্কা মারল। মুহূর্তের ভেতরে করোলার উইন্ডশিন্ডে ফাটল ধরে উইন্ডশিল্ড ঝাপসা হয়ে গেল। সামনের বনেটটা এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেল। করোলা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে পাশের ফুটপাথে উঠে একটা ডাস্টবিনের দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলো। রঞ্জন পরিস্থিতি বুঝে ওঠার সাথে সাথে ব্যাক গিয়ার দিয়ে গাড়ি পেছাতে শুরু করলো। আশফাক চৌধুরী সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে শুরু করলেন। রঞ্জনের দুই হাত গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ব্যস্ত। সে ওয়াকিটকিতে বারবার বলতে লাগলেন, “স্যার, আমাদের ওপরে হামলা হয়েছে স্যার। স্যার শুনতে পাচ্ছেন?” 

অদ্ভুতভাবে রঞ্জনের কথা কেউ শুনতে পেল না। রঞ্জনের ওয়াকিটকির নেটওয়ার্ক জ্যাম হয়ে গিয়েছে। 

মিরর এক 

“স্যার। ড্রোন এক অনুযায়ী শতরঞ্জির মোড়ে একটা গাড়ি বহর এগিয়ে আসছে।” 

নাসরিন একটু পর পর বলে যাচ্ছে। ফিরোজ মেরিলিনাকে ওয়াকিটকিতে বললেন গাড়ি স্লো চালাতে। তারপর এজেন্টদেরকে বললেন, “যা কিছু হোক, বশির কিংবা যে তিনজনের ছবি দেওয়া হয়েছে তাদেরকে না দেখা পর্যন্ত যেন গুলি না চলে।” 

তারপর বললেন, “সব এজেন্টদের উদ্দেশ্যে বলছি, নিজেরা আগে থেকে কোন পদক্ষেপ নেবে না। একমাত্র হামলা হলেই পদক্ষেপ নেবে।” 

হঠাৎ মুরাদের অস্পষ্ট কণ্ঠ ভেসে আসল, “স্যার, মিরর দুইয়ে হামলা হয়েছে। তিনজন…….” 

মুরাদের কথা শেষ হল না। ফিরোজ বার বার হ্যালো হ্যালো বললেন। ওপাশ থেকে কোন উত্তর এলো না। ওদিকে গাড়ির বহরটা ধেয়ে আসছে মেরিলিনার গাড়ির দিকে। এটা কোন চাল না তো? মেজর জেনারেল কি দুই নম্বর দলের এজেন্টদেরকে মিরর দুইয়ের কাছে যেতে বলবেন? তাহলে এদিকে যদি গোলাগুলি শুরু হয়? 

মেজর জেনারেল বুঝতে পারলেন, কী বড় একটা ভুল করে ফেলেছেন তিনি। 

মিরর দুই 

করোলাটা ব্যাক গিয়ারে পেছনে যেতেই আরেকটা ট্রাক পেছন থেকে সোজা করোলার দিকে এগিয়ে গেল। রঞ্জন বুঝতে পারলো, তিনি আটকে পড়েছেন। সামনেও ট্রাক, পেছনেও ট্রাক। সামনের ট্রাকটা আড়াআড়ি রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর পেছনের ট্রাকটা ধেয়ে আসছে সোজা করোলা বরাবর। রঞ্জন হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করলেন। আশফাক চৌধুরীকে বলল, “স্যার আপনি গাড়ির মেঝেতে শুয়ে পড়েন। কিচ্ছু হবে না। আমি আছি। আমাদের টিম রওনা হয়ে গিয়েছে।” 

শেষের বাক্যটা ছিল মিথ্যা। রঞ্জন যেন নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিলেন। আশফাক চৌধুরী বিলাপ করতে করতে করোলার মেঝেতে শুয়ে পড়লেন। 

হঠাৎ পাশের গলি থেকে একটা পিকআপ ভ্যানকে এগিয়ে আসতে দেখলেন রঞ্জন। জানালা দিয়ে হাত বের করে পরপর তিনটে গুলি চালালেন পিকআপ ভ্যান বরাবর। দুইটা গুলি বিধে উইন্ডশিন্ডে ফাটল ধরল। রঞ্জন আরও দুইটা গুলি করার আগেই পিকআপ ভ্যানটা সজোরে করোলার মাঝামাঝি বরাবর মারল ধাক্কা। 

রঞ্জন বিদ্যুৎ বেগে উল্টো দিকের দরজা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়লেন। বেঁকে যাওয়া দরজার লোহায় লেগে ছড়ে গেল কনুই। হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে পড়ে হারিয়ে গেল। রঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ির আড়ালে বসে পড়লেন। 

আশফাক চৌধুরী বাইরে লাফিয়ে পড়তে পারলেন না। জানালা দিয়ে বের হতে গিয়ে আটকে গেলেন। শরীরের অর্ধেক ভেতরে বাকি অর্ধেক বাইরে। 

পিকআপ ভ্যান থেকে যে লোকটা লাফিয়ে নামলো তার নাম বিকাশ। হাতে আলগোছে ধরা অ্যাসস্ট রাইফেল। ট্রাক দুইটা থেকে দুইজন করে চারজন মুখোশধারী নেমে এলো। এরা বিকাশের দলের ছেলে। 

আশফাক চৌধুরী চিৎকার করে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। সৃষ্টিকর্তার নামে তাকে মাফ করে দেওয়ার জন্য বারবার বলতে লাগলেন। প্রায় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়ির ভেতরে আটকে আছে ‘তিন’ তিনটা জীবন। 

বিকাশ তার হাতের অস্ত্রটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ধুঁকতে থাকা করোলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। ওয়াকিটকিতে বলল, “প্যাকেজ পেয়ে গেছি। ওই গাড়িতে কিছুই নাই। শালারা গেম খেলতে গেছে আমাদের সাথে।” ইশারায় দলের দুইজনকে ডিকিটা খুলে দেখতে বলল। তারপর বলল, “দুইটাকে ট্রাকে ওঠা। আর দেখ গাড়িতে বোম টোম আছে কিনা।” 

একজন ডিকির দিকে হাতের এসএমজি তাক করল। আরেকজন ডিকি খুলতে গেল। 

পুরো ব্যাপারটা ঘটে গেল মাত্র চার মিনিটে। 

মিরর এক 

“কেউ থামবে না। সবাই ধীরে ধীরে এগোতে থাকো। আমরা থেমে থাকলে ওরা ভাববে আমরা ওদের জন্য অ্যামবুশ করার জন্য বসে আছি।” ফিরোজ বললেন, “কেউ গুলি চালাবে না। আবার বলছি, কেউ গুলি চালাবে না।” 

গাড়ি বহরটা শতরঞ্জি মোড়ের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। মেরিলিনার গাড়িসহ অন্য সব গাড়িগুলো আস্তে আস্তে এগোতে লাগল। 

আর মাত্র কয়েক মিটার দুরেই শতরঞ্জির মোড়। 

দৈত্যের মত দুইটা বড় বড় ট্রাক আর একটা পিকআপ ভ্যান মোড় ঘুরে এগিয়ে আসতে থাকল মেরিলিনার গাড়ি বহরের দিকে। 

মেজর জেনারেল ফিরোজ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে মাউথপিসে বললেন, রেডি? সবাই রিভলভার আর এসএমজির ট্রিগারে আঙুল রাখল। গুলি চললেই পাল্টা গুলি চলবে। 

গাড়ি বহরটা মেরিলিনাদের গাড়ি বহরটাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কিছুই হল না। আর না হওয়াটাই সবাইকে বুঝিয়ে দিল, জীবন কতটা মুল্যবান। 

খড়খড় করে উঠল স্পীকার। মুরাদের কণ্ঠ, “স্যার। মিরর দুই শেষ। স্যার, শুনতে পাচ্ছেন? আশফাক চৌধুরী, মেজর রঞ্জন আর একজন অচেনা লোককে ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছে।” 

নীরবতা নেমে এলো ওয়াকিটকির দুই পাশেই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *