অপারেশন য়াহলোম

অপারেশন য়াহলোম

যেদিন সন্ধেয় ভারতীয় বায়ুসেনার পাইলট অভিনন্দন বর্তমান পাকিস্তান থেকে এসে ভারতের মাটিতে পা রাখলেন, সেদিন মন বলছিল, ‘স্যর, য়ু আর দ্য ইন্ডিয়ান ড্যানি শাপিরা।’

আশা করি অভিনন্দন বর্তমানের পরিচয় দেওয়া বাতুলতাই হবে। কিন্তু একটি ন্যায্য প্রশ্ন তুলতেই পারেন সুধী পাঠকবন্ধুরা: কে এই ড্যানি শাপিরা?

ড্যানি শাপিরা একজন ইসরায়েলি পাইলট।

একজন পাইলটের মধ্যে আলাদা এমন কী আছে যে তাঁর নাম এভাবে উচ্চারণ করতে বাধ্য হচ্ছি?

কারণ এই ড্যানি মিগ ২১ উড়িয়ে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাস।

আশা করি মিগ ২১-এর সূত্রে পাঠকবন্ধুরা গেঁথে ফেলতে পারবে অভিনন্দন বর্তমান আর ড্যানি শাপিরার নাম। মিগ ২১-এ চেপে পাকিস্তানি ফ্যালকন ১৬ ফাইটার জেটকে ধাওয়া করে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন অভিনন্দন। এই মিগ ২১ কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এখন ‘উড়ন্ত কফিন’ নামে কুখ্যাত। টেকনিক্যাল ফল্টের কারণেই পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে পড়েন অভিনন্দন। বাকি ইতিহাস সকলের জানা।

এত বদনাম! এত কুখ্যাতি! তবুও এই মিগ ২১-ই ছিল এক সময়ের চমৎকার! ড্যানি শাপিরা এই মিগ ২১ নিয়েই ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন।

এ এক এমন সময়ের কথা, যখন মিগ ২১ নিয়ে পাশ্চাত্যের প্রতিটি দেশে চরম উন্মাদনা। কী আমেরিকা, কী য়ুরোপ আর কী ইসরায়েল, সকলেই চাইছিল অন্তত একটা মিগ ২১ হাতে পেতে।

সেই সময়ে মিগ ২১ নিয়ে সবথেকে বড় বিপদের মুখে ছিল ইসরায়েল। কারণ সোভিয়েতের কাছ থেকে সব মুসলমান রাষ্ট্রগুলি মিগ ২১ কিনে নিয়ে ক্রমশ ঘিরে ফেলছিল ইসরায়েলকে।

ত্রস্ত ইসরায়েল ঘোষণাই করে বসেছিল:

বিশ্বের যে কোনো পাইলট যদি একটি মিগ ২১ নিয়ে এসে ইসরায়েলের বুকে নামাতে পারেন, তাহলে তাঁকে ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার পুরস্কার দেবে ইসরায়েল সরকার এবং সপরিবারে সুরক্ষিত ভাবে তাঁকে স্থান দেওয়া হবে ইসরায়েলের মাটিতে।

এই ঘোষণার পর মিগ ২১ অধিকৃত প্রতিটি দেশ সতর্ক হয়ে যায়। প্রত্যেক দেশ নিজের পাইলটদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে।

সোভিয়েত কোনো অবস্থাতেই পশ্চিমের কোনো দেশকে মিগ ২১-এর টেকনোলজি দেওয়ার পক্ষপাতী ছিল না।

কিন্তু সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখাল ইসরায়েল। বলা ভালো, ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই। মাঝে দু-দু’ বার অসফল হয়েও।

এ এক অদ্ভুত ইতিহাস! বিশ্বের প্রথম কোনো দেশ, বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে হরণ করে আনল অপর কোনো দেশের লড়াকু বিমান। অনেকে বলবেন, এ তো চুরি! আবার অনেকের কাছেই এই অধ্যায় গর্বের।

আসুন বন্ধুরা, বলি, মিগ ২১ হরণের সেই কাহিনি।

বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকের মধ্য এশিয়া। এ সেই সময়ের কথা, যখন দুই দশক ধরে ইহুদি আর আরবদের মধ্যে চলা দ্বৈরথ রূপ নিতে চলেছিল যুদ্ধের।

বড় অদ্ভুত পরিস্থিতি। আব্রাহমের তিন সন্তানের মধ্যে দুই সন্তান যুদ্ধের মোহানায় এসে দাঁড়িয়েছিল। ইহুদি এবং মুসলমান।

মধ্য এশিয়া দাঁড়িয়েছিল বারুদের স্তূপে। প্রত্যেকে নিজের সাধ এবং সাধ্য অনুসারে অস্ত্র জোগাড় করে চলেছিল। আর ঠিক সেই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্ত হৃদয়ে আরবদের জন্য খুলে দিয়েছিল নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার।

আর ইহুদিদের দেশ ইসরায়েল সন্ধান করছিল একটি শক্তিশালী ফাইটার প্লেনের। সোভিয়েত শস্ত্রাগারের মুকুটমণি মিকোয়ান গুরেভিচ টোয়েন্টিওয়ান বা মিগ ২১ ছিল সেই সময়ের সবথেকে প্রসিদ্ধ যুদ্ধবিমান। কারণ যেমন ছিল এর গতিবেগ, তেমনই ছিল অধিক উচ্চতায় ওড়ার ক্ষমতা। ফরাসি এবং ইসরায়েলি মিরেজ ৩-এর তুলনায় ওজনে ছিল এক টন হালকাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সোভিয়েতদের কাছ থেকে মিগ ২১ বিমান বা তা নির্মাণের পদ্ধতির কোনোটাই ইসরায়েলের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। বিশ্ব কূটনীতির চক্রে আটকা পড়ে গিয়েছিল ইহুদি জাতি তথা ইসরায়েল।

তাই ইসরায়েলি বায়ুসেনা পুরোপুরি ভাবে ফ্রান্সের দাসোঁর তৈরি মিরাজ থার্ডের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে বসেছিল।

১৯৬৫ সাল নাগাদ ইসরায়েলি বায়ুসেনার প্রধান ছিলেন আইজার ওয়াইজম্যান। পরবর্তীতে ইসরায়েলের সপ্তম রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেছিলেন।

ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থার নাম হল মোসাদ। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির নাম মোসাদ। মোসাদ আসলে এক আশ্চর্যের নাম! এর কাণ্ডকারখানার কথা লিখতে বসলে হয়তো মহাভারতের থেকেও মোটা হয়ে যাবে বইয়ের বহর। ১৯৬৫ সালের সেই দিন ইসরায়েল তথা সারা বিশ্বের ইতিহাসে লেখা থাকবে অদ্ভুত সম্ভ্রমের সঙ্গে, যেদিন মোসাদ চিফ ব্রেকফাস্টের টেবিলে বায়ুসেনার প্রমুখের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন।

দুজনে একে অপরের বন্ধু। মোসাদ চিফ যদি নিজের যৌবনের দিনে একটি প্যারাশুট জাম্পিং-এর সময় ঘায়েল না হয়ে যেতেন, তাহলে হয়তো প্রৌঢ়ত্বে এসে হয়ে উঠতেন ইসরায়েলের স্থলসেনার প্রমুখ।

এসব কথাই চলছিল। হাসি, মজায় গমগম করছিল ঘর।

মোসাদ চিফ বলে চলেছিলেন, ‘আরে ছাড়ো তো আইজার। এই হলে কী হত, ওই হলে কী হত— এসব মনভোলানো কথা বলে কোনো লাভ আছে নাকি? অফিসিয়াল কথাবার্তায় ঢোকো দেখি। বলো, অ্যাজ আ মোসাদ চিফ আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’

মির অমিত। হ্যাঁ, তৎকালীন মোসাদ চিফের নাম এটাই ছিল এবং মোসাদ চিফের কাছ থেকে আসা এমন খোলা আমন্ত্রণ পেয়ে হতভম্বের মতোই তাকিয়ে রইলেন বায়ুসেনার প্রধান আইজার। কথাটা শুনে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন আইজার ওয়াইজম্যান।

দু’ হাতের তর্জনী পরস্পরের সঙ্গে ঠেকিয়ে দু’ চোখ সামান্য কুঁচকে বললেন, ‘আমার একটা মিগ ২১ চাই!’

টেবিলের ওপর ডান হাতটাকে চাপড়ে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিয়ে মির অমিত বললেন, ‘মজা করছ আইজার? পুরো ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডের কাছে অমন একটা পিসও নেই!’

নিজের বাঁ হাতের কনুইটাকে টেবিলের ওপরে রেখে সামান্য এগিয়ে এসে আইজার বললেন, ‘আমাদের একটা মিগ ২১ চাই! এটা কোনো মজার কথা নয়। তুমি বড় মুখ করে বললে বলেই কথাটা পাড়লাম। ক্ষমতায় না কুলোলে ছেড়ে দাও।’

কথাটা সম্মানে লেগে যায় মিরের এবং এই দিনের পর থেকে ওঁর কার্যকালের এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি অক্ষত মিগ ২১-কে ইসরায়েলের মাটিতে এনে নামানো। আগেই লিখেছি যে, মোসাদ এক আশ্চর্যের নাম। সঙ্গে সঙ্গে তৈরি করে ফেলা হল কর্মসূচি। চারটি ধাপে।

ক. এমন একটি দেশকে বেছে নেওয়া, যেখানকার বায়ুসেনার পাইলট(রা) নিজের দেশের প্রতি বীতশ্রদ্ধ

খ. সেই দেশে মোসাদের আন্ডারকভার এজেন্ট স্থাপন করা।

গ. মিগ ২১ জেটকে উড়িয়ে ইসরায়েলের মাটিতে এনে নামানোর মতো পাইলটের চয়ন।

ঘ. মিগ ২১-কে ইসরায়েলের মাটিতে ল্যান্ড করাবার যাবতীয় পরিকল্পনা।

প্রথম ধাপ পার করার জন্য মির অমিত ডেকে পাঠালেন রেহাবিয়া বারদিকে। রেহাবিয় বারদি, মোসাদের এক পুরোনো পেয়াদা। এক দশক ধরে মিশর এবং সিরিয়ার পটভূমিতে মিগ ২১ আয়ত্তে আনার কাজে নিযুক্ত ছিল এই বারদি।

বারদির নেটওয়ার্ক কাজে লাগালেন মির। তার সাহায্যেই সারা আরবে ছড়িয়ে দিলেন নিজের গুপ্তচরদের। কাজ হলও। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ইরাক থেকে আশা জাগানো খবর পেলেন মির।

ইরাক থেকে লিখেছিলেন মোসাদের গুপ্তচর দলের প্রধান য়াকোব নিমরোদি। চিঠির বক্তব্য ছিল:

মির,

ইরাকে জোসেফ শেমস নামে একজন ইহুদি আছে। সে এমন একজন পাইলটের সন্ধান জানে যে ইসরায়েলের মাটিতে মিগ ২১ নিয়ে গিয়ে নামাতে পারবে।

য়াকোব নিমরোদি।

মোসাদের চিফ মিরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল শব্দগুলো পড়েই। তাঁর মুখের হাসি দেখে মনে হল যেন মিগ ২১-কে ইসরায়েলের মাটিতে নামতে দেখছেন মির।

কিন্তু না আঁচালে বিশ্বাস নেই বলে কোনো রকমের তাড়াহুড়ো করতে চাইলেন না মির অমিত। এত বড় তথা গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের ক্ষেত্রে একটা ভুল পদক্ষেপ সমগ্র আরব দুনিয়ায় মোসাদের নেটওয়ার্ককে মুহূর্তের মধ্যে নষ্ট করে দিতে পারত।

মির চাইলেন জোসেফ শেমসকে একটু পরখ করে নিতে। আর এখান থেকেই শুরু হল পরিকল্পনার দ্বিতীয় চরণ।

মোসাদের ছোটখাটো কয়েকটা কাজের দায়িত্ব জোসেফকে দিলেন মির। ফলাফল হল চমকপ্রদ। মির নিজেও এতটা ভালো কাজের আশা করেননি জোসেফের কাছে।

এরপর কেবল ইতিহাস গড়ার দিকে এক পা, এক পা করে এগোতে থাকল ইসরায়েল, মোসাদ এবং মির অমিত। ১৯৬৫ সালের শেষ ভাগে মিগ ২১ নিয়ে প্রোজেক্টের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হল নিমরোদি আর জোসেফকে।

অপারেশন পা রাখল তৃতীয় পর্বে।

নিমরোদি মির অমিতের কাছে যে পাইলটের নাম করেছিলেন, তাঁর নাম ছিল মুনির। মুনির রেড়ফা। পেটানো চেহারা। চওড়া কাঁধ। বছর ত্রিশ বয়েস তাঁর।

জোসেফ আর মুনিরের মধ্যে আত্মীয়তাও ছিল। জোসেফের স্ত্রী এবং মুনিরের সহধর্মিণী ছিলেন দুই বোন। শুধু এটুকুই অবশ্য মোসাদের কাজের জন্য যথেষ্ট ছিল না। নিমরোদি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে জেনে নিয়েছিলেন যে, মুনির নিজের কাজের জায়গা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না।

জোসেফ একদিন ডিনার টেবিলে মুনিরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তা মুনির, আপনার নেক্সট প্রোমোশন কবে হচ্ছে?’

উদাস মুনির উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সম্ভবত আর কোনো প্রোমোশনই হবে না আমার।’

আরেকটু খুঁচিয়েছিলেন জোসেফ, ‘এত দিনে তো আপনার স্কোয়াড্রন লিডার হয়ে যাওয়া উচিত ছিল।’

‘জোসেফ, আমি একজন ক্রিশ্চান এবং ইরাকের এয়ারফোর্সে একজন ক্রিশ্চানের পদোন্নতি হওয়া প্রায় অসম্ভব। অ্যান্ড সো আই অ্যাম আ পাইলট স্টিলা’

গভীর এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে মুনিরের দিকে তাকিয়েছিলেন জোসেফ।

এরপর থেকে যত বার, যেখানে ওঁদের দুজনের সাক্ষাৎ হয়েছে, তত বারই জোসেফ মুনিরের হুনুরির তারিফ করে গেছেন এবং মুনির হতাশ ভঙ্গীতে বলেছেন যে, কর্মক্ষেত্রে তিনি কিছুতেই এগোতে পারছেন না।

একদিন জোসেফ হঠাৎই মুনিরকে বললেন, ‘চলুন না, এথেন্স থেকে ঘুরে আসা যাক। হতেই তো পারে যে আপনার ভাগ্য ওখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’

বিশ্বের সকল রাষ্ট্রেই সমস্ত সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিদেশে যাওয়ার জন্য অনুমতির প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু ইরাক সরকারের পক্ষ থেকে মুনিরকে যাওয়ার পারমিশন দেওয়া হল না।

যে কোনো যুদ্ধ জিততে গেলেই লাগে ছল, বল এবং কৌশল। তার ভরপুর প্রয়োগ করলেন জোসেফ। ইরাকি বায়ুসেনাকে জানালেন যে, মুনিরের স্ত্রী ভয়ানক অসুস্থ এবং সেই রোগের চিকিৎসা একমাত্র এথেন্সেই হতে পারে। এর সঙ্গে যোগ করা হল যে, পরিবারে একমাত্র মুনিরই ইংরাজিতে কথা বলতে সক্ষম। তাই ওঁকে ছাড়া কোনো কাজই হবে না।

খাপে খাপ মেলানোর পর এথেন্সের মাটিতে পা রাখলেন জোসেফ এবং মুনির।

এই হল মহাপালার শেষ পর্ব। এখানেই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সর্বাধিক। হলও। অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও গলদ ঘটলই। কিন্তু অপারেশন সফলই হল। সম্ভবত দেবতা য়হোবা ইসরায়েলের প্রতি উদারই ছিলেন।

মির জানতেন যে, একজন পাইলটই অপর একজন পাইলটের ভালো বন্ধু হতে পারেন। তাই নিজেদের পক্ষ থেকে কাজ উদ্ধারের জন্য পাঠালেন কর্নেল জেবকে। কর্নেল জেব ইসরায়েলি বায়ুসেনার পাইলট ছিলেন এবং স্থলবাহিনীর প্লেন ওড়াতেন।

জেব। লিরঁন জেব। দুনিয়া জানত যে জেব একজন সেনা আধিকারিক, কিন্তু বাস্তবে ছিলেন মোসাদের দুর্ধর্ষ এক এজেন্ট।

জেবের একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল। ওঁকে দেখলে পোলিশ মনে হত। পোলিশ বলতে পোল্যান্ডের নাগরিক এবং বাস্তবেও তা-ই ছিলেন উনি। হিটলারের হলোকাস্ট থেকে কোনোক্রমে রক্ষা পাওয়া এক যুবক হয়ে উঠেছিল ইসরায়েলের বিমানচালক তথা মোসাদের স্তম্ভ।

কিন্তু মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাতে জেব কেবল বললেন, ‘আমি একজন পোলিশ পাইলট।’

ঘনিষ্ঠতা বাড়ল দুজনের। বন্ধুত্ব গাঢ় হলে মুনিরকে রাজি করিয়ে ফেললেন জেব। কী ব্যাপারে? না, ইরাকের মিগ ২১ ফাইটার প্লেন মুনির এনে নামাবেন ইসরায়েলের বুকে।

আর এরপরই সিনে প্রবেশ করলেন জেহুদা পোরাত। জেহুদা ছিলেন ইসরায়েলি বায়ুসেনার রিসার্চ অফিসার। মুনিরের ডেইলি প্ল্যান জানতে চাইলেন জেহুদা। নিজের রুটিন সাগ্রহে জানালেন মুনির।

নিজের দরকারের একটা কথা জেনে নিয়েছিলেন পোরাত। প্রতিদিন সকালে একজন করে পাইলটকে মিগ ২১-এ করে ইরাকের কুর্দ সীমান্তবর্তী এলাকার গ্রামগুলোতে রুটিন চক্কর দিতে পাঠানো হত।

পোরাত জানালেন মুনিরকে, ‘কুর্দ সীমান্তে এসে পৌঁছানো মাত্রই তোমার প্লেনের রেডিওতে কোল ইসরায়েলের সিগন্যাল ক্যাচ করবে। তুমি সেখানে আরবি গান শুনতে পাবে— মরহবতে মরহবতে…। আর এটাই হবে আমাদের পক্ষ থেকে দেওয়া নিশান। তুমি জানবে গোটা ইসরায়েল তোমাকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে।’

শেষ অবধি ইসরায়লের অপেক্ষার অবসান ঘটল। ১৬ আগস্ট, সকাল আটটার সময়ে ইসরায়েলের হৎজোড় বিমানবন্দরে এসে নামল মিগ ২১।

সে এক উৎসবের দিন!

যে বৃত্তান্ত লেখা হল, তার মধ্যে সমস্যাগুলোর কথা প্রায় উল্লেখই করা হয়নি। জেনে রাখুন পাঠক, এমন এমন সব পরিস্থিতির উদ্রেক হয়েছিল যে মনে হয়েছিল এই কাজ করা অসম্ভব।

প্রথম সমস্যা হয়েছিল তখন, যখন ইরাক থেকে এথেন্স এবং এথেন্স থেকে রোম হয়ে ইসরায়েল নিয়ে যাওয়ার পথে তেল আবিবের বিমানে ওঠার আগে উধাও হয়ে যান মুনির। ফ্লাইট টেক অফ করার অন্তিম মুহূর্তে জেব এবং পোরাত মুনিরকে আসতে দেখেন। কারণ জিজ্ঞেস করায় জানা যায় যে মশাই নাকি কায়রো যাওয়ার প্লেনে চড়ে বসেছিলেন এবং কেবিন ক্রু শেষ মুহূর্তের গুনতিতে ওঁকে প্লেন থেকে নামিয়ে দেয়।

ভেবে দেখুন তো, এত গুপ্ত একটা মিশনে নিয়োজিত পাইলট যদি কোনো ক্রমে মিশরে গিয়ে পড়তেন, তাহলে জিনিসটা আর ধামাচাপা রইত কি?

দ্বিতীয় ভুলের কথা শুনলেও চমকে উঠতে হয়। ইরাক ছেড়ে আসার আগে নিজের বাড়ির সমস্ত আসবাব নিলামের একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে মূর্খের মতো কাজ করে বসেন মুনির। এই খবর শোনার পর হার্ট অ্যাটাক হতে বসেছিল মির অমিতের। নিজের বিচক্ষণতা নিয়ে শোক প্রকাশ করেছিলেন মির। বলেছিলেন, ‘এ কোন মূর্খকে দায়িত্ব দিলাম?’

বিশ্বের মিগ ২১ ধারী সব দেশ সেই সময়ে ইসরায়েলের মিশন সম্পর্কে কম- বেশি খবর রাখায় নিজের পাইলটকে সন্দেহের চোখে দেখছিল। আর সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন মিগ ২১ পাইলট নিজের বাড়ির সব আসবাব নিলামে বিক্রি করে দিতে চাইছি। কিন্তু বরাতের জোরে বেঁচে গিয়েছিলেন মুনির। রক্ষা পেয়েছিল ইসরায়েলের প্রকল্প। ইরাকি গুপ্তচর সংস্থা মুখবরাত কীভাবে যে এত বড় একটা খবর দেখতে বা বুঝতে পারেনি তা ঈশ্বরই জানবেন।

ভাগ্যের জোরেই রক্ষা পেয়েছিল অপারেশনটা।

তৃতীয় বাধা সামনে এল ১৪ আগস্ট। সেবারেও অল্পের জন্য রক্ষা পেল মিশন।

কী হয়েছিল? যখন মুনিরের প্লেন ইসরায়লের কোল ক্যাচ করল, শোনা গেল আরবি গান ‘মরহবতে মরহবতে… ‘, তখনই ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে গেল ওঁর প্লেনের ককপিট।

কতকটা বাধ্য হয়েই মুনির মাটিতে নামাতে বাধ্য হলেন নিজের ফাইটার মিগ ২১-কে। সৌভাগ্যবশত সেদিন প্লেন ইসরায়েলের মাটি ছুঁয়েছিল। নইলে মিগ ২১-এর মুখ দেখতেই পেত না ইসরায়েল। দৈব সহায় ছিল। তাই ১৯৬৬ সালের ১৬ আগস্ট সঠিক জায়গায়, সঠিক সময়ে দেখা দিল মিগ ২১।

এই ছিল অপারেশন ডায়মন্ড!

হ্যাঁ, হিরের মতোই দামি ছিল এই মিশন। মোসাদ নিজের দেশকে, দেশের আগামী প্রজন্মকে সেদিন এমন একটি উপহার দিয়েছিল যার ঋণ শত শত বছরেও শোধ করতে পারবে না ইসরায়েলের উত্তরপুরুষেরা। মোসাদের উদ্দেশ্য ছিল— ‘কেউ যুদ্ধবিমান দিচ্ছে না তো ছিনিয়ে নিয়ে এসো!’

এই মিশন সারা বিশ্বে ‘অপারেশন ডায়মন্ড’ নামেই পরিচিত। তবে ইসরায়েলে একেই বলা হয়েছিল ‘অপারেশন য়াহলোম’। ইসরায়েলের হিব্রু ভাষায় ‘য়াহলোম’ শব্দের অর্থ হল ‘হিরে’।

আসলে য়াহলোম ছিল এই অপারেশনে মুনির রেড়ফার কোডনেম। এই নাম কখন ঠিক হয়েছিল সে কথা বলেই ইতি টানি কাহিনির। মির আর মুনিরের প্রথম সাক্ষাতেই স্থির হয়েছিল এই কোডনেম। মুনিরের শান্ত, সমাহিত মুখ-চোখ দেখে মির জেবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এ কি পারবে?’

জেব উত্তরে বলেছিলেন, ‘ইস্ য়াহলোম স্যর! ইটস্ য়াহলোম!’ মানে, ‘এ পাইলট নয় স্যর, হিরে! এ হিরে স্যর!’

.

এ তো গেল মিগ ২১ হরণের কথা। আসি, তার পরের উপাখ্যানে।

মিগ ২১ ইসরায়েলের বুকে নামানোর পর মুনির কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে কি আমাকে এই জেট ওড়াতে দেওয়া হবে?’

উত্তরটা দিয়েছিলেন ওয়াইজম্যান ‘না মুনির। এই প্লেন ওড়াবেন আমাদের সেরা পাইলট মিস্টার ড্যানি শাপিরা। আপনি ওঁকে শিখিয়ে দেবেন।’

ওয়াইজম্যানের কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের বাইরে নক হল। কেউ একজন বললেন, ‘মে আই কাম ইন স্যর?’

ঘরের বাইরে থেকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাওয়া ব্যক্তিটি ছিলেন ড্যানি শাপিরা। আসলে সবকিছুই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। মিগ ২১-কে ইসরায়েলের এনে ফেলার পরে কে ওড়াবে, কে তাঁকে শেখাবে সবকিছুই।

আগে থেকেই মিলিটারি কম্যান্ডার আলুফ হোড ড্যানিকে ডেকে বলে দিয়েছিলেন, ‘ড্যানি, তুমি ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডের প্রথম পাইলট হতে চলেছ যে মিগ ২১ ওড়াবে। যত তাড়াতাড়ি পারবে, ওড়ানোটা শিখে নাও।’

ঘরে প্রবেশ করলেন ড্যানি। মুনিরের সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দিলেন ওয়াইজম্যান এবং বলাই বাহুল্য যে, সাক্ষাৎকার সফল হল।

পরদিন সকালে মুনির এবং ড্যানি দাঁড়িয়ে ছিলেন রানওয়ের ওপরে। দুজনের মধ্যিখানে ছিল মিগ ২১। দেখা গেল, প্লেনের সমস্ত সুইচের লেবেলিং করা আছে রাশিয়ান এবং আরবি ভাষায়।

কিন্তু ড্যানি তো ড্যানিই! সবার থেকে আলাদা। মাত্র এক ঘণ্টা মুনিরের সঙ্গে প্লেন ওড়াবার পর মুনিরকে বললেন, ‘এবার আমি একাই ওড়াব!’

মুনির হাসতে হাসতে বললেন, ‘স্যর, এই প্লেন ওড়ানোর জন্য কয়েক মাসের কোর্স করতে হয়। আর আপনি মাত্র এক ঘণ্টায় সব শিখে ফেললেন? এখন আপনার একা ওড়ানো মানে মৃত্যুর মুখে নিজেকে সঁপে দেওয়া।’

ড্যানি পাত্তাই দিলেন না। হ্যাঙ্গার থেকে প্লেন বের করা হল। গ্লাসলিড খুলে ভেতরে ড্যানি পা রাখতেই যাবেন এমন সময় পিছন থেকে শুনলেন ওয়াইজম্যানের কণ্ঠ— ‘ড্যানি, কোনো রকমের কায়দা দেখাবে না। এই প্লেনটা গায়ে যেন একটাও আঁচড় না পড়ে!’

‘ইয়েস স্যর!’ এটুকুই ছিল ড্যানির উত্তর। হাওয়ায় উড়ে গেলেন ড্যানি।

স্বচ্ছন্দে ওড়ালেন মিগ ২১। নামার পর মুনির ড্যানিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘আমি আপনার মতো পাইলট আগে কখনো দেখিনি। এই আরব দুনিয়ার কোনো পাইলটেরই আপনার সঙ্গে লড়ার মতো হিম্মত কুলোবে না।’

ড্যানি পরে কিংবদন্তী হয়ে ওঠেন। মাত্র কয়েক মাসের কয়েকটা টেস্ট ফ্লাইটের পর সিক্স ডে’জ ওয়্যার (ছ’ দিনের যুদ্ধ)-এ কয়েক মিনিটের মধ্যেই ধ্বংস করেন মিশরের ছ’টা মিগ ২১। ইসরায়েলি ইনটেলিজেন্স সংস্থায় একটা নতুন কথা চালু হল — BA before Amit, AM – after Meir!

হার মানতে বাধ্য হল মিশর। খলিফা হতে যেতেই অন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলি সরে যেতে বাধ্য হল। ছ’ দিনের যুদ্ধ জয়ের কৃতিত্ব ছিল ড্যানির। ছিল মুনিরের। ছিল মিগ ২১-এর এবং অবশ্যই অপারেশন য়াহলোমের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *