অপাঙক্তেয়

অপাঙক্তেয়

অন্যদিন নেপাল ঘরে ঢুকতেই পাঁচুগোপাল বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘কীরে ন্যাপলা, কাল রাতে ঘুম-টুম হয়েছিল?’’ নেপালের উত্তরের অপেক্ষা না করেই তারপর খ্যাকখ্যাক করে হেসে ওঠেন, ‘‘হুম, মুখ-চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে হয়নি৷ অবিশ্যি ঘুমের আর দোষ কি বাপু, অমন গো-হারা হারলে কি আর কারুর ঘুম হয়?’’

কিন্তু আজ আর আগের দিনের দাবা খেলার হারজিত নিয়ে পাঁচুগোপাল কিছু বললেন না, বরং নেপালই দ্রুতপদে এগিয়ে এসে বললেন, ‘‘কী ব্যাপার গোপলা? জলখাবারটা খেয়ে আমি তো আসতামই, হঠাৎ ফোন করে এত জলদি তলব কেন? কী হয়েছে?’’

পাঁচুগোপাল খবরের কাগজটা মুখ থেকে সরিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘‘জলখাবার পরে হবে, আগে বোস, একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে৷’’

পাঁচুগোপাল আর নেপালের বন্ধুত্ব সামনের আশ্বিনে পাক্কা পঞ্চান্ন বছরে পড়বে৷ সেই দশ বছর বয়সে হাই স্কুলে ভর্তি হবার দিন থেকে দুজনে অভিন্নহৃদয় বন্ধু, সেই বন্ধুত্ব জীবনের সময়নদী দিয়ে সহস্র ধারা জল বয়ে গেলেও অমলিন ও অক্ষুণ্ণ রয়েছে৷ স্কুল, স্কুল পেরিয়ে কলেজ, তারপর চাকরিজীবন, বিয়ে, সংসার, অবশেষে রিটায়ারমেন্ট, সব কিছুর মাঝেই দুজনের মানসিকতা, রুচি বহুদিক থেকে ভিন্ন হলেও চুম্বকের দুই বিপরীত মেরুর প্রবল আকর্ষণের মতোই রয়ে গেছেন তাঁরা৷ কাজেই দুজন দুজনকে যতটা ভালো চেনেন, তাঁদের নিজেদের স্ত্রীরাও বোধ হয় অতটা চেনে না৷

নেপাল ভ্রূ কুঁচকোলেন৷ পাঁচুগোপাল এমনিতে রগুড়ে হলেও এখন মুখ দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা সিরিয়াস৷

তিনি গলা নামিয়ে বললেন, ‘‘কী হয়েছে বল তো?’’

পাঁচুগোপাল বলতে যাবেন, এমন সময় ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল পিকু, পাঁচুগোপালের সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা নাতি৷ ভারী ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, আই আই টি-তে চান্স পেয়েছে সদ্য৷ তড়িঘড়ি উলটেপালটে ড্রয়িংরুমের আনাচেকানাচে কী খুঁজছিল, অবশেষে ক্রিকেট ব্যাটটা পেয়ে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে থমকে গেল, ‘‘আরে নেপালদাদু! কখন এলে!’’

নেপাল হাসলেন, ‘‘এই তো! খেলতে বেরোচ্ছিস বুঝি? তোর ক্লাস কবে থেকে?’’

পিকু হাসল, ‘‘হ্যাঁ খেলতে৷ এই তো সোমবার থেকে৷’’ পরক্ষণেই কী একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে একটু এগিয়ে এল, ‘‘নেপালদাদু, তোমরা তো সেলিব্রিটি হয়ে গেছ! কাগজে তোমাদের নিয়ে লেখা বেরোচ্ছে, বিশাল তো! দাদুর কাছে চাওয়া তো বেকার, তোমার কাছে ট্রিটটা ডিউ রইল কিন্তু!’’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই পিকু বেরিয়ে গেল৷

নেপাল হেসে মাথা নাড়লেন৷ পিকু ছেলেটা বেশ, নেপালকে ছোট থেকেই দাদু দাদু করে৷ কিন্তু সেলিব্রিটি না কী বলে গেল, সেই নিয়ে পাঁচুগোপালকে জিজ্ঞেস করতে যাবেন, এমন সময় পাঁচুগোপাল বললেন, ‘‘এই ব্যাপারটাই বলছি৷’’ সামনে থেকে একটা বাংলা নামী খবরের কাগজের রবিবারের ট্যাবলয়েডটা তুলে নিয়ে ওলটাতে ওলটাতে বিশেষ একটা পৃষ্ঠা খুলে নেপালের দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘‘আগে এটা পড়ে দ্যাখ!’’

নেপাল কাগজটা নিয়ে দেখলেন, একটা গল্প, না গল্প নয়, ধারাবাহিক একটা উপন্যাস রয়েছে সেই পৃষ্ঠাতে৷ আজই প্রথম পর্ব৷ তিনটে কিস্তিতে শেষ হবে এই উপন্যাস৷ লেখকের নাম ‘অপাংক্তেয়’৷ নেপাল যদিও গল্পের বইটই বিশেষ পড়েন না, তবু এই লেখকের নাম তিনি কস্মিনকালেও কোথাও দেখেননি এটা স্মরণ করতে পারলেন৷

যার ছদ্মনামই এত খটোমটো, তার লেখা না জানি আরও কত কঠিন হবে! তিনি নিজে অঙ্কের মাস্টার ছিলেন, এত কঠিন বাংলা তাঁর কোনোকালে আসে না৷ তবু নেপাল দ্বিরুক্তি না করে পড়তে শুরু করলেন; পাঁচুগোপাল যখন একবার পড়ে দেখতে বলেছে, তখন হাজার জিজ্ঞেস করলেও তার আগে মুখ খুলবে না৷

কিছুটা পড়তেই তাঁর মুখের অভিব্যক্তি নিজের অজান্তেই পালটে যেতে লাগল, দায়সারা মুখভঙ্গিটা উধাও হয়ে গিয়ে ভ্রূ কুঁচকোনো ভাবটা ফিরে এল৷ যত এগোচ্ছিলেন, তত সেই ভ্রূ কুঁচকোনো ভাবটাও চলে গিয়ে একটা অবাক ভাব জেগে উঠছিল৷

পাঁচুগোপাল মন দিয়ে বন্ধুর মুখের এক্সপ্রেশনের পরিবর্তন লক্ষ করছিলেন৷ প্রায় মিনিট দশেক পরে নেপাল যখন কাগজটা থেকে মুখ তুললেন, তখন তাঁর হতবাক ভাবটা দেখে হেসে বললেন, ‘‘অবাক লাগছে তো? আমারও সেইরকমই মনে হয়েছিল৷’’

নেপাল বিমূঢ়ভাবে বললেন, ‘‘এ তো হুবহু মিলে যাচ্ছে রে! নাম, জায়গা, স্কুল, এমনকি চেহারার বিবরণ পর্যন্ত!’’

পাঁচুগোপাল মাথা নাড়লেন৷ ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে মজার লাগলেও মজার নয় মোটেই৷ আজ থেকে এই কাগজের রবিবারের পাতায় শুরু হয়েছে ধারাবাহিক একটা উপন্যাস, নাম ‘অমীমাংসিত’৷ লেখকের নাম ‘অপাংক্তেয়’৷ পাঁচুগোপাল নিজে নেপালের মতো নন, তাঁর সাহিত্যপ্রীতি বহুকালের৷ ইংরেজি-বাংলা বই, ম্যাগাজিন প্রতিটাই তিনি নিয়মিত পড়েন৷ তবু আজ সকালের ক্রসওয়ার্ড পাজলে এমন ডুবে গিয়েছিলেন, প্রথমে চোখে পড়েনি৷

বউমা সুচরিতারও বইপত্রের দিকে ঝোক বেশ, তিনিই এসে বললেন, ‘‘বাবা, দেখেছেন? বর্ধমান নিয়ে লেখা তাই পড়তে শুরু করেছিলাম, ওমা পড়তে পড়তে দেখি এ যে আপনাদেরই কথা!’’

পাঁচুগোপাল পড়তে শুরু করে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন৷ শুধু যে তাঁর আর নেপালের বন্ধুত্ব নিয়ে লেখা তাই নয়, গল্পের দুই বন্ধুর নাম, তাদের স্কুল, তাদের গ্রাম, সমস্ত কিছু হুবহু এক! আর সবথেকে যেটা আশ্চর্যের সেটা হচ্ছে, তাঁদের মতো এটাও শুরু হচ্ছে দুই বন্ধুর ছোটবেলা থেকে শুরু হওয়া বন্ধুত্ব দিয়ে, তাঁদেরই গ্রামে!

এখন পাঁচুগোপাল আর নেপাল দুজনেই বর্ধমান টাউনে বাড়ি করে চলে এলেও ছোটবেলাটা তাঁদের কেটেছে দামোদরের তীরে বনতীর নামে ছোট্ট এক গ্রামে৷ তখন তাঁদের গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না, পাশের বামনিয়া গ্রামের স্কুলে অনেকদূর হেঁটে পড়তে যেতেন তাঁরা, তারপর বর্ধমান রাজ কলেজে এসে দুই বন্ধু ভর্তি হয়েছিলেন৷ এই উপন্যাসেও তাই!

শুধু ওঁদের দুজনের নামধামই নয়, তাঁদের ছোটবেলার স্কুলে ঘটা নানান মজার ঘটনা, দুষ্টুমি সব কিছুই হুবহু মিলে যাচ্ছে এই লেখার সাথে৷ দামোদরের তীরে স্কুল পালিয়ে দিনভর নৌকার খোলে চড়ুইভাতি করা থেকে শুরু করে ইতিহাসের মাস্টারমশাই অনুকূলবাবুর ধুতিতে কালীপটকা বেঁধে দেওয়া, সবই এক!

এতটা মিল কখনো কাকতালীয় হতে পারে?

নেপালের প্রশ্নে পাঁচুগোপাল কিছুক্ষণ থুতনিতে হাত দিয়ে বসে রইলেন, তারপর বললেন, ‘‘সেটাই তো বলছি তোকে৷ এ-ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহই নেই যে, যে লিখছে সে তোর-আমার শুধু পরিচিত নয়, ছোটবেলাটা তার আমাদের সাথেই কেটেছে৷ দ্যাখ, আজকের পর্বটা শেষ হয়েছে রাজ কলেজে ভর্তি হবার পর৷ এদিকে মুশকিল হয়েছে, বউমা সবাইকে বলে ফেলেছে এটা আমাকে নিয়েই লেখা, এখন তো পাড়ার সবাইকে ডেকে ডেকে দ্যাখাচ্ছে!’’

নেপাল হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘শোন, আমাদের ক্লাসের বিদ্যুৎ তো এখন বনতীর স্কুলেই পড়ায়, ওকে বরং একটা ফোন কর, আমাদের ব্যাচের কেউ লেখক-টেখক হয়েছে কিনা ও বলতে পারবে ভালো৷’’

পাঁচুগোপাল একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ‘‘তুই কর, আমার সাথে ওর ঠিক সদ্ভাব নেই৷’’

শুধু বিদ্যুৎ কেন, অনেকের সাথেই পাঁচুগোপালের বিশেষ সদ্ভাব নেই, তাঁর অসম্ভব কিপ্টেমি, সবজান্তা ভাব আর অতিরঞ্জিত করে কথা চালাচালি করা স্বভাবের জন্য৷ এই কারণে রিটায়ারের পর পাড়ার ক্লাবের নানা অনুষ্ঠানে প্রথম প্রথম ডাকাডাকি হলেও তাঁর এই স্বভাবের জন্য সেখানকার মেম্বারদের মধ্যে ঝামেলা লেগে যাচ্ছিল, শেষে পাঁচুগোপালবাবু বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন৷ বছরদুয়েক আগে গ্রামের এক দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের ট্রাস্টে বিদ্যুৎ কিছু সাহায্য করতে বলেছিল, পাঁচুগোপাল করেননি৷ সেই থেকেই মনোমালিন্য৷

নেপাল কিন্তু এরকম একদমই নন, কী করে যে দুজনের বন্ধুত্ব এতকাল টিকল, এ অনেকের কাছেই এক আশ্চর্যের বিষয়৷

বিদ্যুৎকে ফোন করে কিছুই লাভ হল না৷ তাঁদের ব্যাচের এরকম কোনো লেখকের সন্ধান সে দিতে পারল না৷ দুই বন্ধুর সেদিন আর দাবা খেলা বেশি জমল না৷

খুঁতখুঁতে মন নিয়ে নেপাল বাড়ি চলে গেলেন৷

পরের ছ-টা দিন মোটামুটি কাটল৷ পরের রবিবার ঠিক সকাল সাতটায় নেপালের বাড়ির দরজায় সজোরে কড়া নাড়লেন পাঁচুগোপাল৷ চোখমুখ লাল, চুল উশকোখুশকো, পরনে বাড়িরই লুঙ্গি, বগলে একটা খবরের কাগজ৷ নেপাল মুখে টুথব্রাশ নিয়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে ডুকরে চিৎকার করে উঠলেন পাঁচুগোপাল, ‘‘ন্যাপলা, এ তো যা ভেবেছিলাম, তার থেকেও সাংঘাতিক কেস রে! এ যে আমার মানসন্মান সব ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে!’’

পাঁচুগোপালকে কোনোমতে নিরস্ত করে বসিয়ে কিছুটা কাগজটা পড়ে আর কিছুটা পাঁচুগোপালের কথা শুনে নেপাল বুঝলেন, এটা সত্যিই আর হেলাফেলা করার বিষয় নয়, মারাত্মক আকার ধারণ করতে চলেছে৷ আজকের কাগজে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে পাঁচুগোপাল আর নেপালের রাজ কলেজে ভর্তি হওয়া দিয়ে৷ লেখাটা পড়লেই বোঝা যায়, লেখকের কলমের মুনশিয়ানা সাংঘাতিক৷ ছোটবেলার দুষ্টুমি, ছেলেমানুষি থেকে এই পর্বে অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন কীভাবে বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচুগোপালের মধ্যে নেতিবাচক দিকগুলো প্রকাশিত হতে লাগল আর নেপালের মধ্যে ইতিবাচক৷ পাঁচুগোপাল প্রচণ্ড মিথ্যে কথা বলে, তার মধ্যে স্বাভাবিক মনুষ্যত্ব বলতে কিছুই নেই৷ তার নিষ্ঠুরতার প্রমাণ অনেক ছোট ছোট ঘটনায় দিয়েছেন লেখক৷

তবে প্রতিটা ঘটনাই একশো শতাংশ সত্যি৷ পাঁচুগোপাল কলেজ থেকে ফেরার সময় একদিন একটা বুড়ো কুকুরের লেজ শুধু ইলেকট্রিক ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তার নাকে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন৷ বেমালুম মিথ্যে বলে এক বন্ধুকে প্রায় কলেজ ছাড়ার উপক্রম করিয়েছিলেন৷ এই সব ঘটনাই নেপাল ভালো করেই জানেন৷ তখন প্রতিটা ব্যাপারেই তিনি পাঁচুগোপালকে অনেক বোঝাতেন, পালটাবার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু লাভ হয়নি বলাই বাহুল্য৷

গল্পের নেপালও বন্ধুর এই বিপথগমন বুঝতে পেরেও সরে যায় না, অসীম ধৈর্য নিয়ে বোঝায়, তাকে পালটাবার চেষ্টা করে৷ কলেজ শেষে ঠিক তাঁদের দুজনেরই মতো গল্পের পাঁচুগোপাল পোস্ট অফিসে আর নেপাল স্কুলে ঢোকে৷ সেখানেও পাঁচুগোপাল নানারকম দুর্নীতিমূলক কাজকর্মে লিপ্ত হয়, কাউকে পছন্দ না হলে তার দরকারি চিঠি পর্যন্ত আটকে দেয়, অফিসে এর কথা ওর কাছে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে গণ্ডগোল পাকাতে থাকে প্রায়ই৷

এই পর্যন্ত তবু ঠিক ছিল, কিন্তু এই দ্বিতীয় পর্বের শেষ তিনটি অনুচ্ছেদ পড়ে নেপালেরও বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল৷ তিনি হতবুদ্ধি হয়ে পাঁচুগোপালের দিকে তাকালেন, ‘‘এসব কী রে! এসব তো জানতাম না! তু-তুই কি সত্যিই এসব…..কে শোভনা!’’

পাঁচুগোপাল ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘‘ন্যাপলা, আমি এসব করলে তুই কি জানতে পারতিস না বল? আমার মরা বাপমায়ের দিব্যি খেয়ে বলছি ভাই, এসব আমি কিচ্ছু করিনি!’’

পাঁচুগোপালের গলার শির ফুলছে ঘন ঘন৷ নিঃশ্বাস ওঠাপড়া করছে দ্রুত গতিতে৷ অবশ্য করারই কথা৷ শেষ তিনটে অনুচ্ছেদ সত্যিই মারাত্মক৷ গল্পের পাঁচুগোপালের নজর পড়েছে একটা মেয়ের দিকে, তার নাম শোভনা৷ শোভনা শান্ত নম্র ভদ্র মেয়ে, তার বিয়েও ঠিক, তা সত্ত্বেও পাঁচুগোপাল তাকে নানাপ্রকারে উত্ত্যক্ত করে চলেছে৷ এই পর্বের শেষ অনুচ্ছেদে মেয়েটির হবু বর রাস্তার মধ্যে পাঁচুগোপালকে এইরকম অসভ্যতার জন্য অপমান করে৷ অবশেষে পাঁচুগোপাল ঠিক করে সে শেষ দেখে ছাড়বে৷

পাঁচুগোপাল বললেন, ‘‘এটা তো পুরোপুরি মানহানি! শোভনা নামের কাউকে আমি কোনোদিনও চিনি না৷ তুই তো জানিস বল, আমি এমনি হয়তো রগচটা, একটু হিসেবি, কিন্তু এই মেয়েঘটিত রোগ তো আমার নেই, কোনোকালে ছিলও না!’’

ঘটনা আরো বাজে দিকে যেতে লাগল এরপর থেকে৷ পাঁচুগোপালের বাড়ি থেকে প্রথমে যাদের ফোন করে বলা হয়েছিল যে এটা তাঁদের দুই বন্ধুরই জীবনের ঘটনা, তারা ফোন করে এবার সত্যি-মিথ্যে জিজ্ঞেস করতে লাগল৷

তখন উৎসাহের বশে পাঁচুগোপাল নিজেই অতিরঞ্জিত করে লোকজনকে বলেছিলেন, যে তাঁদেরই একব বন্ধু এটা লিখছে, বেশ গর্বও করেছিলেন, এখন তাঁর বাড়ি থেকে বেরোনো দায় হয়ে পড়ল৷ এমনকি শোভনা নামক মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনা পড়ে পুত্রবধূ সুচরিতা পর্যন্ত একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগলেন৷

পাঁচুগোপালের রাতের ঘুম চলে গেল৷ বর্ধমানের গোটা রাধানগর পাড়ায় দাবানলের মতো এই কেচ্ছা ছড়িয়ে পড়ল৷ যে-সব ছেলেপিলেদের পাঁচুগোপাল এক পয়সা চাঁদা দিতেন না, তারা আরো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ছড়াতে লাগল, বাড়ির দরজায় পর্যন্ত উলটোপালটা কথা লিখে যেতে শুরু করল৷

এখন লোকজন আকারে-ইঙ্গিতে তাঁকে দেখলে হাসে, এমনকি নিজের ছেলে সমরেশ পর্যন্ত একদিন বলে ফেলল, ‘‘এসব কী বাবা! তুমি এইসব করতে! ছি ছি!’’

শুক্রবার বিকেলবেলা পাঁচুগোপাল নেপালের হাত ধরে কেঁদে ফেললেন, ‘‘ওরে আমার কী সর্বনাশ হল রে ন্যাপলা, আমি তো কোথাও মুখ দ্যাখাতে পারছি না, কেউ বিশ্বাসও করছে না! তুই আমাকে বাঁচা! তুই বিশ্বাস কর আমি কোনোদিনও এসব করিনি৷’’

নেপাল অনেকক্ষণ ধরে কী ভাবছিলেন, এবার বললেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করছি৷ শোন, আমি এই ক-দিন অনেক কিছু ভেবেছি৷ কেউ একজন তোকে ইচ্ছে করে সবার সামনে খারাপ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে৷ কারুর সাথে তোর তেমন শত্রুতা আছে কি?’’

পাঁচুগোপাল ঢোঁক গিললেন৷ একদম প্রত্যক্ষ শত্রুতা না থাকলেও তাঁকে যে অনেকেই পছন্দ করে না, সেটা তো সত্যি৷

কিন্তু এরকম আদাজল খেয়ে পেছনে লাগার মতো শয়তানি কে করতে পারে!

নেপাল আবার বললেন, ‘‘এখানকার কেউ হবে না, কারণ এরা তোর ছোটবেলার কথাগুলো জানবে না৷ আমাদের বনতীর গ্রামের কেউ নয় তো! যার তুই কিছু ক্ষতি করেছিলি!’’

পাঁচুগোপাল ভ্যাবলা মুখে বললেন, ‘‘অ্যাঁ! বনতীরের!’’

নেপাল বললেন, ‘‘বিশুকে মনে পড়ে? যাকে তুই সবার সামনে তোর পেন দিয়ে একবার শুধু লেখার অপরাধে নাকখত দিইয়েছিলি, শুধু তাই নয়, ওর বাবাকে উলটোপালটা লাগিয়ে মারও খাইয়েছিলি? সেই ঘটনাটা কিন্তু এই লেখায় রয়েছে৷ বিশু নয় তো!’’

পাঁচুগোপাল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বললেন, ‘‘বিশু! সে কি এখন বনতীরে নাকি!’’

নেপাল ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘‘কী করে জানব! বিদ্যুৎ তো কিছু বলতে পারল না৷ আমার মনে হয় কাল ওই কাগজের পাবলিশার হাউজে দেখা করে চল এই অপাংক্তেয় না কি নাম, তার ঠিকানা নিয়ে আসি৷ যাবি?’’

পাঁচুগোপাল জবুথবু ভাবটা কাটিয়ে উঠে বললেন, ‘‘আচ্ছা শোন, তোর কথায় মনে পড়ল, অপাংক্তেয় মানে তো যে এক পঙক্তিতে বসার যোগ্য নয়৷ তোর মনে আছে সেই ডোমেদের ছেলেটা কী যেন নাম, আমাদের সঙ্গে পড়তে আসত বলে আমি তাকে একবার হাত-পা বাঁধিয়ে কী সব করেছিলাম?’’

নেপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ পাঁচুগোপাল কী সব করিয়েছিলেন সেটা পাঁচুগোপালের নিজের না মনে থাকলেও তাঁর ভালোই মনে আছে৷ স্কুলে পড়ার সময় তাঁর আর পাঁচুগোপালের খুব বন্ধুত্ব থাকলেও পাঁচুগোপালের গুন্ডাগিরি করার দলে তিনি কোনোদিনই থাকতেন না, আর পাঁচুগোপাল ছিল সেই দলের পান্ডা৷ কোনো ছেলে ক্লাসে নতুন ঢুকলেই পাঁচুগোপালের দলের তার উপর হুজ্জুতি শুরু হত, রোজ তার থেকে পয়সা নিয়ে টিফিন খাওয়া, তার পেন-খাতা নিয়ে টানাটানি করা৷

ডোমেদের বাড়ির ওই গরিব ছেলেটার নাম ছিল পঞ্চা৷ পঞ্চা ছেলেটা পড়াশোনোয় ভালো ছিল, কিন্তু পাঁচুগোপালের দলের গুন্ডামিতে কিছুতেই সায় দিত না৷ একদিন ফার্স্ট বেঞ্চে বসার অপরাধে পাঁচুগোপাল তাকে হাত-পা বাঁধিয়ে কপালে ‘ডোমের বাচ্চা’ লিখে দিয়েছিলেন৷ বেচারার চোখ দিয়ে নীরবে গড়িয়ে পড়া চোখের জল নেপালের আজও মনে আছে৷

নেপাল একটু চুপ করে রইলেন, বললেন, ‘‘পঞ্চানন নাম ছিল তার৷ চল কাল ওই পাবলিশারের কাছে যাই৷ নাকি একেবারে শেষ পর্বটা বেরোনোর পর রোববার যাবি?’’

পাঁচুগোপাল ছটফটিয়ে উঠে বললেন, ‘‘না না! রোববার হবে না৷ রোববার সকালে পিকু খড়গপুর চলে যাচ্ছে৷ সোমবার থেকে ক্লাস শুরু তো৷ রবিবার বেরোতে পারব না৷ তুই কালই চল৷’’

পাবলিশার হাউজে গিয়ে বিশেষ কিছু লাভ হল না৷ সব ঘটনা খুলে বলার পরও এডিটরমশাই স্পষ্ট জানালেন, তাঁরা লেখকের নাম প্রকাশ করতে পারবেন না, এটা নিয়মবিরুদ্ধ, লেখক যে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক, তা আগেই লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছেন৷

কেস করার ভয় দেখিয়েও কিছু হল না, এডিটর সাফ বললেন, ‘‘বেশ তো, কেস করুন না, যিনি লিখছেন তিনি যা করার করবেন৷ আমাদের তো কোনো দায় নেই!’’

হতাশ হয়ে দুই বন্ধু ফিরে এলেন৷ পাঁচুগোপাল নেপালের হাত চেপে ধরলেন, ‘‘ওরে, কাল কী হবে রে! কাল কী বেরোবে বল তো!’’

নেপাল বললেন, ‘‘আরে অতো চিন্তা করিস না তো! সব ঠিক হয়ে যাবে৷’’

কিন্তু শেষ পর্বে যেটা বেরোল তা দেখে পাঁচুগোপাল তো দূর, নেপালেরও ঘুম উড়ে গেল৷ শেষ পর্বে গল্পের পাঁচুগোপাল শোভনাকে একদিন বাড়িতে একা পেয়ে খুন করল৷ সেদিনের বাজারে সবার সামনে অপমানের প্রতিশোধ স্পৃহা দাউদাউ করে জ্বলছিল তার মনে৷ রীতিমতো ঠান্ডা মাথায় গ্লাভস পরে সব দিক দেখে খুন৷

মারার আগে শোভনাকে দিয়ে সুইসাইড নোট লিখিয়ে নিল, যে তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়, এই বিয়েতে তার মত নেই বলে সে জীবনটা শেষ করে দিচ্ছে৷ তারপর খুন করে শোভনার বডিটা সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিল৷ তখনকার দিনে একটা অবিবাহিত মেয়ের এরকম আত্মহত্যা এমনিই পরিবারের কাছে প্রচণ্ড লজ্জাজনক; কিছুটা পরিবারের চাপে, কিছুটা প্রমাণের অভাবে পুলিশ কিছুই করতে পারল না৷ পাঁচুগোপাল বেমালুম বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল৷ উপন্যাসটার শেষটায় কত অপরাধী এরকম জঘন্য ক্রাইম করেও সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাই নিয়ে লেখকের বেশ খানিকটা খেদোক্তি রয়েছে লেখার ছত্রে ছত্রে৷

পড়ে পাঁচুগোপালের মাথা বনবন করে ঘুরছিল৷ বউমা সুচরিতা সেদিন আর থাকতে পারলেন না, বললেন, ‘‘ছি ছি বাবা! আপনি…আপনি সত্যিই এ-কাজ করেছিলেন? আমি তো ভাবতেও পারছি না! বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, আমার স্কুলের কলিগ সবাইকে আগে থেকে ঢাক পিটিয়ে আপনার জীবনী ছাপা হচ্ছে বলে বেড়িয়ে এখন তো বাইরে বেরোনো দায় হয়ে উঠবে দেখছি!’’

পাঁচুগোপাল কিছু বললেন না৷ তাও ছেলে সমরেশ পিকুকে স্টেশনে গাড়িতে তুলতে গেছে, এখনো ফেরেনি৷

সে পড়লে পাঁচুগোপাল কোথায় মুখ লুকোবেন? পরে যদিও বা কেস করে ক্ষতিপূরণ পান, কিন্তু তাঁর এই সন্মান কি আর ফিরবে? মানুষকে যখন পুলিশ কোনো কারণে ধরে, তখন ফলাও হয়ে সেটা চাউর হয়, বেকসুর খালাস পেলে ক-জন জানতে পারে?

পাঁচুগোপাল নেপালকে এদিন আর ফোন করলেন না৷

বিমূঢ়ভাবে এসে ধীরে ধীরে নিজের শোবার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন৷

নিজের মনকেই প্রশ্ন করলেন, সত্যিই কি এরকম কিছু তিনি করেছিলেন, এখন ভুলে গেছেন? সত্যিই কি তিনি একজন খুনি? অনেক ভেবে-টেবে বুঝলেন, জীবনে হয়তো অনেক অন্যায়ই করেছেন, কিন্তু কস্মিনকালেও এমন জঘন্য কাজ তিনি করেননি৷

কী করবেন এখন পাঁচুগোপাল? গল্পের ওই শোভনার মতো তিনিও কি সিলিং থেকে ঝুলে পড়বেন? পাঁচুগোপালের মাথা আর কাজ করছে না৷ যত বেলা হবে, বাড়িতে লোকের আনাগোনা বাড়বে, পাড়ার লোক কথাচ্ছলে জানতে চাইবে এ-সব সত্যি কিনা!

সত্যি-মিথ্যে যাই বলুন তিনি, ওরা সত্যিই ধরে নেবে৷ সেটাই সমাজের নিয়ম৷ তিনি নিজেও তো এতকাল দেখে এসেছেন, এর নামে ওকে বললে কেমন চট করে সেটা বিশ্বাস করে নেয় লোকে!

একপাশে ঝোলা ধুতিটা আনমনে টেনে নিলেন পাঁচুগোপাল, সিলিং এ ছুড়ে পাকাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু লাগল না, উল্টে টেবিলের ওপর পেপারওয়েট চাপা দেওয়া কয়েকটা কাগজের ওপর পড়ে সেগুলোকে মেঝের ওপর এলোমেলো করে ফেলে দিল৷

পাঁচুগোপাল কাগজগুলো তুলে টেবিলের ওপর রাখতে গিয়েও থমকে গেলেন৷ একটা চিঠি৷

‘‘দাদু,

আজ আমি প্রথম এই বাড়ি থেকে এতদূর কোথাও একা একা থাকতে যাচ্ছি৷ ছোট থেকে তোমাকে অনেক কিছু বলার ছিল, কিন্তু সেগুলো বলতে পারিনি, তাই আজ লিখে যাচ্ছি৷ দাদু, আমার সব বন্ধুদের কাছে দাদু মানেই ছিল আনন্দ-আদর আর ভালোবাসা৷ কিন্তু আমি তোমার কাছ থেকে কোনোদিনই এসব পাইনি৷ ছোটবেলায় বাবা-মা যখন তোমার কাছে রেখে নিজের নিজের কাজে বেরিয়ে যেত, তখন থেকেই৷ বাবা-মা সারাটা দিনের পর খেটেখুটে যখন বাড়ি ফিরত, তখন তুমি আমার সারাদিনের দুষ্টুমিগুলোকে অনেক রং চড়িয়ে বাবা-মাকে বলতে৷ আমি বিনা দোষে মার খাচ্ছি দেখেও কোনোদিনও আটকাওনি তুমি বাবা-মাকে৷ কোনোদিনও আমাকে কোলে বসিয়ে গল্প করোনি, একটা লজেন্সও কিনে দাওনি কখনো৷ উল্টে আমার বন্ধুবান্ধব এলে তাদের কাছে আমার গোপন কোনো কথা বলে আমাকে অপ্রস্তুত করেছ, বিদ্রূপ করেছ৷ এমনকি বাবা-মায়ের কখনো ঝগড়া হলেও তুমি থামাও তো নি, উল্টে দুজনকেই ইন্ধন জুগিয়েছ৷

আমি তোমার কাছে অনেকবার ভালোবাসা পেতে চেয়েছি, উল্টে পেয়েছি খালি কষ্ট৷ কেন তুমি এমন দাদু? কই নেপালদাদু তো এমন নয়! তোমার অবসর সময় কাটে না বলে তোমাকে ল্যাপটপে ইন্টারনেট করা শিখিয়েছিলাম আমি, তার তুমি কী প্রতিদান দিলে দাদু? আমারই সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল থেকে আমার বান্ধবীদের সাথে নোংরা কথা বলে তাদের কাছে আমার কী ইমেজ করেছিলে তুমি মনে পড়ে? তবু আমি কিচ্ছু বলিনি৷ আড়াল থেকে নেপালদাদু আর তোমার ছোটবেলার গল্প শুনতাম, তোমার কাজগুলোর নিষ্ঠুরতা দেখে শিউরে উঠতাম আর বুঝতাম, ছোট থেকেই তোমার মধ্যে একটা অপরাধপ্রবণতা রয়েছে, যেটা মাঝে মাঝেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে৷ সবসময় দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে, তাকে ছোট করে, কষ্ট দিয়ে তুমি এক জান্তব মজা পাও৷ তোমার বাইরেটা যাই হোক, তোমার ভেতরে একটা বিকৃত ক্রিমিনাল সবসময় বাস করে৷ এটা একটা রোগ৷ যেটা তুমি নিজেই নিজের মধ্যে বাড়িয়ে তুলেছ৷

তাই, বয়সে অনেক ছোট হয়েও তোমাকে ছোট্ট একটা শিক্ষা দিলাম, যে মানুষকে অন্যায়ভাবে অন্যদের কাছে ছোট করলে কেমন লাগে! ছোট-বড়, সবারই আত্মসম্মান আছে, সেটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে নেই৷

যদি সত্যিই নিজের ভুল বুঝতে পেরে থাকো, তবে সায়কিয়াট্রিস্ট দেখিও দাদু৷

ফার্স্ট সেমেস্টারের পর যখন বাড়ি ফিরব, তখন আমি অন্য এক দাদুকে দেখতে চাই৷

ঠিক নেপালদাদুর মতো!

 পিকু৷’’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *