আট
লাইনের সবাই মেয়েটার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। গ্রীক মেয়েরা সুন্দরী এবং লম্বা-চওড়া হয় বটে, কিন্তু দুটোর এমন মহামিলন সহজে চোখে পড়ে না। শুধু পুরুষরা নয়, মেয়েরাও তাকিয়ে থাকল—তবে সম্ভবত মেয়েরাই শুধু ঈর্ষা বোধ করল।
প্যান অ্যামের টিকেট এজেণ্ট তো মেয়েটাকে দেখে একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়ল। দশ সেকেণ্ড হাঁ করে থাকল সে, আশপাশে মশা-মাছি থাকলে নির্ঘাত দু’একটা ঢুকে পড়ত। তারপর সংবিৎ ফিরে পেয়ে গদ গদ ভঙ্গিতে বলল, ‘ইয়েস, ম্যাডাম?’ ঘন ঘন হাত কচলাল সে। ‘বলুন আপনার কি খেদমতে লাগতে পারি?’
মেয়েটা তার পার্স যত্ন করে রাখল কাউণ্টারের কিনারায়, দস্তানা পরা হাত দুটো ভাঁজ করল বুকের কাছে, মাথা একদিকে একটু কাত করে মিষ্টি হেসে তাকাল লোকটার দিকে। সে জানে সে সুন্দরী। পরনে হাতে সেলাই করা এক রাঙা স্যুট—শরীরের যে গড়ন তাতে খোলামেলা থাকার বা সূÇ পোশাক পরার কুমতি না থাকারই কথা। কণ্ঠস্বর গভীর, তবে কোমল এবং সুরেলা।
ভাষাটা, বলাই বাহুল্য, গ্রীক।
‘ইণ্টারন্যাশনাল প্লেসমেন্ট সোসাইটির সেক্রেটারি আমি, বলল মেয়েটা। ‘সোফিয়া ডালিক্লিয়স। এতিম একটা শিশুকে লণ্ডনে পাঠাতে চাই।
দ্রুত মাথা কাত করল টিকেট এজেণ্ট, ‘শিশুটি কি একা যাবে, ম্যাডাম?’
মেয়েটা হাসল। দাঁতগুলো মুক্তোর মত ঝকঝকে। ‘হ্যাঁ। ওর্কশায়ারে এক পরিবার তার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয়, এই মুহূর্তে এমন কেউ নেই যাকে ওর সাথে পাঠানো যায়। তবে হিথ্রো এয়ারপোর্টে আমাদের প্রতিনিধি থাকবে, সে-ই ওর দায়িত্ব নেবে।’
একটা ফর্ম বের করল লোকটা। ‘শিশুর বয়স, ম্যাডাম?’
‘চার।’
মুখ তুলে তাকাল লোকটা। ইতস্তত করতে লাগল সে, ‘আপনি নিশ্চয়ই বোঝেন, ম্যাডাম, ফ্লাইটের শেষ মাথায় আমরা ওর দায়িত্ব নিতে পারব না।’
‘হ্যাঁ, জানি-বললামই তো, ওখানে আমাদের লোক থাকবে।’
আবার মাথা কাত করল লোকটা। ‘কবে তাকে পাঠাতে চান আপনি, ম্যাডাম?’
‘যদি সম্ভব হয় কালই।’
কাউন্টারে রাখা কমপিউটর সেটটা চেক করল এজেণ্ট। তারপর মুখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকাল। ‘কাল সকাল দশটায় একটা ফ্লাইট আছে, সীটও আছে মাত্র একটা।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ,’ মিষ্টি হাসল মেয়েটা। পার্স তুলে নগদ টাকা বের করল সে। টিকেটের দাম মিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। উপস্থিত সবাই ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তার চলে যাওয়া।
.
এথেন্স বন্দর, পিরিয়াস। ওশেনিয়া লাইনস-এর যাত্রীবাহী জাহাজগুলো শুধু বসফরাস নয়, শুধু বসফরাস নয়, দ্বীপগুলোতেও নিয়মিত আসা-যাওয়া করে।
টিকেট এজেণ্ট সবিনয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘যতটুকু পারি আপনার জন্যে করব আমরা, ম্যাডাম সসেলা। বলুন তো, ক’টা রিজার্ভেশন দরকার আপনার?’
‘সাতাশ জন মানুষ, আর ষোলোটা জানোয়ার,’ স্মিত হেসে বলল মেয়েটা।
ঝট্ করে মুখ তুলল লোকটা, বিস্মিত হয়েছে। ‘জানোয়ার?’
‘আমরা সার্কাস পার্টি, মিস্টার,’ মেয়েটা সগর্বে জবাব দিল।
‘ও, আচ্ছা, বুঝলাম…।’
দস্তানা পরা একটা হাত তুলে আশ্বস্ত করল মেয়েটা। ‘হিংস্রগুলো খাঁচায় থাকবে, বুঝতেই পারছেন। বাকি সব ক’টা পোষ মানানো। স্বভাবতই আমরা চাইব কার্গো হিসেবে দেখা হবে ওগুলোকে। আর হ্যাঁ, সাথে ট্রেনার থাকছে। আপনাদের চিন্তার কোন কারণই নেই …।’
‘ভেরি গুড।’ লোকটা খুঁটিয়ে দেখল-সার্কাসের মেয়ে, তাই তো বলি! এরকম সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী মেয়ে থাকায় সার্কাসের মালিক নিশ্চয়ই দু’হাতে টাকা কামাচ্ছে। সন্দেহ নেই, মোটা টাকা অ্যাডভান্স পেয়ে ইস্তা‡লে যাচ্ছে পার্টি। জিজ্ঞেস করল, ‘কোয়ারানটাইন পেপারস ঠিকঠাক আছে তো, ম্যাডাম?’
‘দু’মাস আগে সুইজারল্যাণ্ড ছাড়ার পর আটটা আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়েছি আমরা,’ বলল মেয়েটা। ‘কোয়ারানটাইন পেপারস ঠিক থাকবে না মানে?
‘কবে আপনারা যেতে চান?’
‘যদি সম্ভব হয় কালই।’
‘কাল? সাতাশজন লোক, ষোলোটা জানোয়ার, আর আপনি কিনা বলছেন কালই যেতে চান?’
ভুবনভোলানো হাসি দেখা গেল মেয়েটার কমলাকোয়া ঠোঁটে। ‘শিডিউল, মিস্টার, শিডিউল। দিন তারিখ ঠিক রাখতে পারি বলেই আমাদের পার্টির এত সুনাম।’
সুন্দর অবয়বের দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা। ‘ঠি-ই-ক আ-ছে। দেখি কি করা যায়।’ খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল সে। ‘আরও একটা ব্যাপার। চেক বা অন্য কিছু নেব না কিন্তু আমরা। ভাড়া আপনাকে নগদ মেটাতে হবে।’
‘আমি তৈরি হয়েই এসেছি,’ বলে পার্সটা চওড়া কোলের ওপর থেকে তুলে খুলল মেয়েটা। ‘হিসেব করে বলুন, কত দিতে হবে। সবার জন্যেই ডেক প্যাসেজ বুক করব আমি, শুধু একজনের জন্যে একটা কেবিন দরকার হবে। বড় কেবিন, মানে ডাবল। দু’জন ধরা যায় না, তবু দু’জনের জন্যে বড় একটা কেবিনই দরকার। একটা বাচ্চা আর তার বাবা।’
.
ছোটখাট একটা চার্টার এয়ারলাইন। নাম, গ্লাইফাদা। ডেস্কের পিছনে বসা প্রৌঢ় মহিলা মেয়েটাকে ঢুকতে দেখেই নিজের অজান্তে দাঁড়িয়ে পড়ল। নিঃশ্বাস আটকে গেছে তার। কোন মেয়ে এত সুন্দরীও হয়! ‘ইয়েস, ম্যাডাম?’
নরম সুরে কথা বলল মেয়েটা। অভিজাত ঘরের সুন্দরী বউ, অথচ এতটুকু গর্ব বা দেমাক নেই। ‘আমার ছেলে,’ ঠোঁটে বিষণ্ণ হাসি নিয়ে বলল সে। ‘দেখুন না কি ভাগ্য, এখানে বেড়াতে এসে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসেছে। এখন মোটামুটি সুস্থ, হাসপাতাল থেকে ওরা বলে দিয়েছে বাড়ি ফিরতে পারবে। এখন দেখুন আপনারা আমাদের অর্লিয়ান্সে নিয়ে যেতে পারেন কিনা।’
‘কেন পারব না!’ মিষ্টি হাসল প্রৌঢ়া। ‘কবে যেতে চান আপনারা?’
‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব,’ বলল মেয়েটা। ‘যদি সম্ভব হয় কালই। আমি আর এখানে এক মুহূর্ত থাকতে চাই না।’
.
এথেন্সের সবগুলো এয়ারপোর্ট আর বন্দরে অ্যাডভান্স রিজার্ভেশন চেক করছে গ্রীক ইন্টেলিজেন্স। শুধু এয়ারপোর্টেই বারোজন এজেণ্টকে লাগানো হয়েছে, কমপিউটর লিস্ট পরীক্ষা করে দেখবে তারা, বয়স এবং বর্ণনা মেলে এমন কোন বাচ্চার জন্যে সীট রিজার্ভ করা হয়ে থাকলে তদন্ত চালাবে। একঘেয়ে, কঠিন কাজ—তালিকায় চোখ বুলাও আর টিক চিহ্ন দিয়ে বাতিল করো। শয়ে শয়ে নাম পড়া হলো, তদন্তও হলো কয়েকটা কেস, কিন্তু বর্ণনার সাথে কোন বাচ্চাকেই মেলানো গেল না।
তবে একজন এজেন্টের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। সে তার তালিকার পরবর্তী নামটা দেখল। বহুগুণ বেড়ে গেল আগ্রহ। স্তূপ করা ডুপ্লিকেট টিকেট ফর্মগুলো নিল সে, পেয়ে গেল রিজার্ভেশনের সাথে যেটা মেলে। দ্রুত হাত বাড়িয়ে ফোনের রিসিভার তুলল সে। অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর দিল এক মহিলা কণ্ঠ, ‘ইণ্টারন্যাশনাল প্লেসমেন্ট সোসাইটি।’
‘ম্যাডাম সোফিয়া ডালিক্লিয়স, প্লীজ।’
‘দুঃখিত, তিনি এখানে নেই।
‘কবে ফিরবেন?’
‘এক সপ্তাহের আগে নয়।
‘এক সপ্তাহ।’
‘ম্যাডাম সোফিয়া দেশের বাইরে গেছেন, দশ দিনের ট্যুরে, তিন দিন আগে।’
এজেণ্ট লোকটা জরুরী ভঙ্গিতে কামরার আরেক দিকে বসা অফিসারের উদ্দেশে হাতছানি দিল। ‘আপনি ঠিক জানেন তো?’ ফোনে জিজ্ঞেস করল সে।
‘জানি না মানে? আপনাকে আর কেউ সাহায্য করতে পারে?’
‘ধন্যবাদ, ম্যাডাম, যথেষ্ট সাহায্য আপনি ইতিমধ্যেই করেছেন,’ বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল এজেণ্ট।
.
ক্যাপটেন ডেভিড কপার প্রসঙ্গ জেভ রিকার্ডের কানে এল ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে।
ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্সকে আগেই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, অস্বাভাবিক কোথাও কিছু ঘটলে সাথে সাথে তা রিপোর্ট করতে হবে। ডেভিড কপার কিছুদিন আগে পর্যন্ত সি.আই.এ. অপারেটর ছিল, ড্রাগের সাহায্যে ঘুম পাড়ানো অবস্থায় পাওয়া গেল তাকে, ঘটনাটাকে স্বাভাবিক মনে করার কোন কারণ নেই। তাছাড়া ক্যাপটেনের পাসপোর্ট, মানিব্যাগ, এবং অতিরিক্ত একটা ইউনিফর্মও খোয়া গেছে।
ইতোমধ্যে সি.আই.এ. কমপিউটর সেকশন থেকে রানার ফাইল পৌছে গেছে জেফ রিকার্ডের হাতে। সেটা খুলে নাড়াচাড়া করতেই জানা গেল, মাসুদ রানার বন্ধুদের মধ্যে ডেভিড কপার একজন। ডিফেন্সের ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্ট পাবার সাথে সাথে প্রেসিডেন্টের স্টাডিরূম থেকে এথেন্সে ফোন করলেন তিনি, গ্ৰীক ইন্টেলিজেন্স চীফের সাথে কথা বলে বুঝলেন, ডি.আই. ঘটনাটা তাকে অনেক দেরি করে জানিয়েছে।
‘ক্যাপটেন ডেভিড কপার এখনও এখানে অজ্ঞান অবস্থায় রয়েছেন,’ গ্রীক চীফ বললেন। ‘অথচ আজ সকালে তিনি এথেন্সের উদ্দেশে হেরাক্লিয়ন ত্যাগ করেছেন অলিম্পিক ফ্লাইটে।’
হতাশ হলেন জেফ রিকার্ড, সেই সাথে প্রভাবিতও হলেন। ‘আপনি ঠিক জানেন, এ-ও সেই একই ডেভিড কপার?’
‘যদি না আপনাদের একই নাম, একই পাসপোর্টে, একই চেহারায় দু’জন এয়ারফোর্স ক্যাপটেন থাকেন।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন জেফ রিকার্ড। রানা যে, তাতে কোন সন্দেহই নেই। কপারকে অনেক দিন থেকে চেনে রানা, তার চেহারা নেয়া কঠিন কিছু নয়, বিশেষ করে রানার ডোশিয়েতে বলা হয়েছে ছদ্মবেশে পটু সে। তাছাড়া, এ-ধরনের কৌশল অবল’ন করা রানার একটা বৈশিষ্ট্যও বটে। অপরপক্ষকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘এথেন্সে রানার গন্ধ খুঁজে বের করা সম্ভব বলে মনে করেন?’
গ্রীক ইন্টেলিজেন্স চীফ নির্ভেজাল আত্মতৃরি হাসি হাসলেন। ‘আপনি যা আশা করছেন, আমরা তার চেয়ে একটু বেশি এগিয়ে আছি, মি. রিকার্ড।’
‘আচ্ছা,’ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন সি.আই.এ. চীফ। ‘কি রকম?’
‘আমাদের বিশ্বাস করার কারণ ঘটেছে, আপনার মাসুদ রানা গ্রীস ছাড়ার চেষ্টা করছেন। কিভাবে তাঁকে আটকাতে হবে আমরা জানি।’
বাকশক্তি হারিয়ে জেফ রিকার্ড অপেক্ষা করছেন।
‘তিনজন মেয়ে,’ গ্রীক চীফ বললেন। ‘তিনটে নাম এবং জাতীয়তা, কিন্তু চেহারার বর্ণনা হুবহু এক।’
বাকিটুকুও নিঃশব্দে শুনে গেলেন জেফ রিকার্ড। তিনটে মেয়ে, প্রত্যেকে একটা বাচ্চাকে সাথে নিয়ে বা সাথে না নিয়ে এথেন্স ত্যাগ করতে চায়। গ্রীক, সুইস, আর ফ্রেঞ্চ। তিনজনই ভুয়া। ম্যাডাম সোফিয়া দেশের বাইরে। ম্যাডাম সসেলার সার্কাস পার্টি ন’মাসের জন্যে তাঁবু গুটিয়ে ফেলেছে। আর অ্যাটিক পেনিনসুলার কোন হাসপাতালে চার বছর বয়সের কোন বাচ্চাকে ভর্তিই করা হয়নি। তারমানে ম্যাডাম অলিভাও মিথ্যে কথা বলেছে।
তিনটে মেয়ে, চোখে ধুলো দেয়ার তিনটে প্ৰয়াস।
শুধু কি এই তিনটেই? জেফ রিকার্ড ভাবলেন। নাকি আরও আছে?
পরস্পর বিরোধী ভাবাবেগে আক্রান্ত হলেন তিনি। রাগ হলো, আবার মুগ্ধও হলেন, সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ করলেন। শুনতেই রানার মত লাগছে। প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায়, রানাই। কিন্তু জেফ রিকার্ড জানেন, মেয়ে তিনটেকে ধরা যাবে না, গেলেও তারা কেউ রানা হবে না-না এথেন্সে, না লণ্ডনে, বা পিরিয়াসে, গ্লাইফাদায়, বা অর্লিয়ান্সে।
একটাই কারণ—তিনটে মেয়েকেই পানির মত সহজে খুঁজে পাওয়া সম্ভব, রানাও সেটা জানে।
ফোন ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন জেফ রিকার্ড। রানাকে নিয়ে ভাবছেন। ডাইভারশন তৈরি করা রানার স্টাইল। যুক্তিগ্রাহ্য পথে যাওয়াটা নয়। সহজেই ট্রেস করা যায় এ-ধরনের তিনটে ডাইভারশন কেন সে তৈরি করতে গেল? নিশ্চয়ই পালাবার অন্য কোন রাস্তা ঠিক করে রেখেছে সে, ডাইভারশনগুলোর একটাও তার ব্যবহার করার দরকার পড়বে না।
জেফ রিকার্ড একজন প্রফেশনাল, রানার ফাইল মুখস্থ করে ফেলেছেন তিনি। রানার অতীত অ্যাসাইনমেণ্টগুলো সম্পর্কে জানেন। জানেন রানা কি ধরনের টেকনিক ব্যবহার করে। তার মন-মানসিকতা সম্পর্কে স্বচ্ছ একটা ধারণা জন্মেছে। সবশেষে তিনি একটা উপসংহারে পৌঁছুলেন-আমেরিকার সাথে রানা বেঈমানী করবে না। অন্তত এই অ্যাসাইনমেণ্টে রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা করবে না সে।
কিন্তু তবু এ-কথা সত্যি যে প্রেসিডেন্টের মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে রানা। সম্ভবত খুনও করেছে দু’একটা। তবে এ-ও ঠিক যে পিকেরিং যে বিশ্বাসঘাতক তা তার জানার কথা নয়। রানা জানত পিকেরিং সি.আই.এ-র পক্ষ নিয়েই কাজ করছে।
নাকি জানত না?
নতুন একটা চিন্তা ঢুকল মাথায়। কপালে রেখা ফুটল। নসোসে পিকেরিঙের সাথে ছিল রানা। সম্ভবত প্ল্যান করে পরস্পরের সাথে দেখা করতে যায় ওরা। প্রথম পুলিসকে খুন করার সময় পিকেরিং রানার নাম ধরে জোরে একবার চিৎকার করে উঠেছিল। রাগে? সে হয়তো ভেবেছিল পুলিস লোকটা রানা। তবে কি রানাকেই সে খুন করতে চেয়েছিল?
রানা কি ব্যাপারটা টের পেয়ে যায়? পিকেরিঙের দল ত্যাগ করে সে? নসোসেই ওদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?
ধারণাটা দৃঢ় হতে শুরু করল জেফ রিকার্ডের মনে, সেই সাথে তাঁর মুখে হাসি দেখা গেল। নিঃসঙ্গ রানা, বি.সি.আই. কিংবা নিজস্ব এজেন্সির সাহায্য চাইতে পারছে না, কারণ জানে জেফ রিকার্ডের লোকজন হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। যা যুক্তিগ্রাহ্য, এই একবার অন্তত, তা করতে পারে রানা। আর তো কোন পথ খোলা নেই তার সামনে। তিনটে মেয়েরই একটা করে চার বছরের বাচ্চা আছে। রানা যদি পিকেরিংকে ত্যাগ করে থাকে, তাহলে টিউলিপ নিশ্চয়ই রানার কাছেই আছে।
এটা নিঃসন্দেহে একটা সুসংবাদ, কারণ প্রাণ থাকতে টিউলিপের কোন ক্ষতি হতে দেবে না রানা।
সময়ের সাথে সাথে গোটা ব্যাপারটা জটিল থেকে জটিলতর রূপ নিচ্ছে। তাঁর আক্রোশ মেটাবার জন্যে পিকেরিংকে চাই, কিন্তু আরও বেশি দরকার রানাকে। কারণ রানার কাছে টিউলিপ রয়েছে। তবু সাবধান হবার প্রয়োজন আছে। এমন কিছু করা চলবে না যাতে কোণঠাসা হয়ে পড়ে রানা। বিকন্ধ পথ না পেলে ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিতে বাধ্য হবে সে, আর রানার ঝুঁকি নেয়া মানে টিউলিপের বিপদের মধ্যে পড়া।
তারপর আরেকটা চিন্তা মাথায় ঢুকল, নিভে গেল মুখের হাসি। রানা যদি পিকেরিংকে ত্যাগ করে থাকে, তাহলে পিকেরিং নিশ্চয়ই রানাকে গরু খোঁজা করছে-তার মতই। ব্যাপারটা তাহলে ধাওয়া নয়, প্রতিযোগিতা। গতিই এখন মুখ্য বিবেচ্য বিষয়। শুধু যে রানাকে পেতে হবে তাই নয়, পেতে হবে পিকেরিঙের আগে।
অথচ লাখ লাখ মানুষের মধ্যে যে-কেউ রানা হতে পারে!
হতাশায় প্রায় মুষড়ে পড়লেন জেফ রিকার্ড। ক্লান্তি এবং ভয় তাঁকে গ্রাস করতে চাইল। এর শেষ কোথায়? কিভাবে শেষ হবে? শেষের পর অবশেষ, কি হবে তার চেহারা? পিকেরিঙের বিশ্বাসঘাতকতা আর কি কি সর্বনাশ ঘটাতে পারে? আর কতজন এজেণ্টকে মারবে সে? তার সাথে আর কারা আছে? সি.আই.এ-র কোন্ লোকটা এখনও বিশ্বস্ত?
আর যাই হোক, রানা অন্তত সি.আই.এ. এজেণ্ট নয়। এখন বোঝা যাচ্ছে, পিকেরিঙের লোকও নয় সে।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো জেফ রিকার্ডের। রানার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ করলেন তিনি।
কারণটাও তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন। রানা বুদ্ধিমান, সে নীচ নয়, তার একটা কোমল হৃদয় আছে-সেজন্যেই এই কৃতজ্ঞতাবোধ। কৌশলজ্ঞানের কারণেই জেফ রিকার্ডের হাতে ধরা পড়বে না রানা, সেই একই কারণে পিকেরিং বা রাশিয়ানদের হাতেও ধরা পড়বে না সে।
কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন তিনি। উপলব্ধি করলেন, রানার ওপর তিনি নির্ভর করতে শুরু করেছেন। কিন্তু কেন? এখন কি করবে রানা? প্রশ্নের উত্তর ওই অদ্ভুত মানুষটার মতই অজ্ঞাত আর রহস্যময়।
তবু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে টিউলিপ রানার হাতে রয়েছে, ভাবলেন জেফ রিকার্ড। আর কেউ হলে এত সব বিরুদ্ধ শক্তির সামনে বারো ঘণ্টাও টিকতে পারত না।
.
যথারীতি নির্দিষ্ট সময়ে জেনোফন গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এল কেলী। বাসে চড়ে বাড়ি ফিরল সে, রোজই তাই ফেরে। পথে একটা মার্কেটে থামল, রুটি আর মাখন কিনল, সিগারেট কিনল এক প্যাকেট। কাউন্টারে বসা তরুণ ছেলেটির সাথে রসিকতা করল। আড়ষ্ট কোন ভাব নেই, মনটা প্রফুল্ল।
বাড়ি ফিরে গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে গিয়েও ঢালল না, বদলে কফি তৈরি করল। ভাবল, নার্ভ ভোঁতা করার সময় নয় এটা। পিকেরিঙের সাথে কথা বলা দরকার।
কিন্তু যোগাযোগ করার উপায় নেই। পিকেরিং যোগাযোগ করবে এই অপেক্ষায় আছে সে।
অবশেষে টেলিফোন বাজল।
‘হ্যালো?’
‘ডিকসন আছে নাকি?’
কেলীর চেহারায় পরম স্বস্তি ফুটে উঠল। কিন্তু ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল সে, ‘রঙ নাম্বার।’
‘দুঃখিত।’
‘নো ট্রাবল।’
অপরপ্রান্ত থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। ছোঁ দিয়ে পার্সটা তুলে নিয়ে হন হন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল কেলী। দশ মিনিট পর একটা ফোন বুদের ভেতর দেখা গেল তাকে। বেল বাজতেই রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল।
হ্যাঁ, পিকেরিংই।
‘বাঁচলাম!’
‘কেন, কি হয়েছে?’ পিকেরিং জিজ্ঞেস করল।
‘ডেভিড কপারকে মনে আছে আপনার?’
‘অবশ্যই। কেন?’
‘আজ সে হঠাৎ গ্যালারিতে এসে গোলাপ কুঁড়ি সম্পর্কে কথা বলছিল।’
একেবারে থ হয়ে গেল পিকেরিং। ‘বলো কি!’
‘জ্বি হ্যাঁ,’ বলল কেলী। এক সেকেণ্ড ইতস্তত করল সে। ‘কি বলব, মানে, কেমন যেন লাগল। একবার মনে হলো লোকটা বোধহয় কপার নয়।’
অপরপ্রান্তে পিকেরিং কথা বলছে না।
‘আমার ভুলও হতে পারে,’ আবার বলল কেলী। ‘দেখতে সে হুবহু কপারের মত, কথার ভঙ্গি, নড়াচড়া—সব কিছু তারই মত। কিন্তু সে চলে যাবার পর একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম।’
পিকেরিঙের নিঃশ্বাস পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। অপরপ্রান্তে কেউ আছে বলে মনে হয় না।
‘গোলাপ ফুলে অ্যালার্জি আছে কপারের,’ বলল কেলী। ‘আমার ডেস্কে অনেকগুলোই ছিল। অথচ তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি।’
হিম কণ্ঠে পিকেরিং বলল, ‘যা যা বলেছে সব রিপিট করো।’
চোখ বুজে কপারের অফিসে ঢোকার মুহূর্তটা স্মরণ করল কেলী। এক এক করে সব বলল সে, কিছুই বাদ দিল না। এয়ারফোর্স প্রসঙ্গ। চশমা আর ইউরিপিডিস। ইন্টেলিজেন্স কাজকর্ম, আর টিউলিপ। পল রিজওয়ে।
তার কথা শেষ হতে পিকেরিং একটা মাত্র প্রশ্ন করল, ‘কোথায় যাবে তার কোন আভাস পেয়েছ?’
‘না,’ বলল কেলী। ‘তবে ভুয়া বলে যখন সন্দেহ হলো, কয়েক জায়গায় ফোন করে দেখলাম কিছু জানা যায় কিনা। এথেন্সের হোটেল অ্যামব্যাসাডরে ডেভিড কপার নামে এক লোক একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে।’
.
সময় দিতে রাজি হয়েছে মস্কো। বারোজন কে.জি.বি. এজেন্টের ওপর হেরাক্লিয়নের দায়িত্ব দিয়ে সারটভকে নিয়ে এথেন্সে ফিরে এসেছে পিকেরিং, শিডিউল-বিহীন একটা প্লেনে চড়ে। তার মন গাইছিল, রানাও এখানে আসবে-এথেন্স বড় শহর, সব সময় ট্যুরিস্টদের ভিড় লেগে আছে, গা ঢাকা দেয়া যেমন সহজ, তেমনি প্রয়োজনে পালাবার রাস্তা আছে অনেকগুলো। প্রমাণ হয়ে গেল, ঠিকই আন্দাজ করেছিল সে।
এথেন্সে নেমে সরাসরি কোলোনাকি স্কয়ারে চলে আসে পিকেরিং। এখানে একজন সোভিয়েত কূটনীতিকের বাড়ি আছে। সাময়িক ছুটি নিয়ে মস্কোয় গেছে সে, তার ফোনটা সম্পূর্ণ নিরাপদ-হতেই হবে, কারণ কূটনীতিক লোকটা আসলে লোকাল কে.জি.বি. রেসিডেণ্ট।
ফোনটা পিকেরিং ব্যবহার করল সি.আই.এ-র ভেতর তার নিজের লোকদের সাথে যোগাযোগ করার কাজে। দূতাবাসে আছে তিনজন, লোকাল স্টেশনে একজন। কেলীর সাথে যোগাযোগ করায় পয়সা উসুল হয়ে গেল।
রিসিভার নামিয়ে রেখে সারটভের দিকে ফিরল সে। ‘হোটেল অ্যামব্যাসাডরে উঠেছে রানা।
মাথা ঝাঁকিয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল সারটভ। ঝড়ের বেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল দু’জন। গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে ছুটল। বিশ মিনিট পর রানার ঘরের সামনে দেখা গেল ওদেরকে। দরজার নিচ দিয়ে সরু এক ফালি আলো বেরিয়ে আসছে নির্জন করিডরে। মৃদু শব্দে একটা রেডিও বাজছে ভেতরে।
পিকেরিংকে পিস্তল বের করতে দেখে পিছিয়ে গেল সারটভ। দূরে সরে গিয়ে একটা কাঁধ নিচু করল সে, তারপর সবেগে ছুটে এসে দরজায় কাঁধ দিয়ে পড়ল। দড়াম করে খুলে গেল কবাট। এমন কি তালা পর্যন্ত দেয়া ছিল না।
না থাকারই কথা।
কুঁজো হয়ে পিস্তল ধরা হাতটা তুলল পিকেরিং। পরমুহূর্তে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল খালি কামরার দিকে। ডেভিড কপার কামরায় ছিল বটে, এখন শুধু তার ইউনিফর্মটা রয়েছে ক্লজিটে। ওটা ফেলে রেখে গেছে মাসুদ রানা। যাবার সময় সাথে করে নিয়ে গেছে প্রেসিডেন্টের মেয়েকে।
শহর থেকে বেরুবার মুখে ফুটপাথের পাশে একটা মেইল বক্সের সামনে থামল রানা। বক্সের ভেতর একটা প্যাকেট রাখল ও। ভেতরে কপারের পাসপোর্ট আর মানিব্যাগ আছে, আর আছে নগদ পাঁচ হাজার ডলার। ছোট্ট একটা চিরকুটও আছে, কপার জানতে পারবে কোথায় পার্ক করা আছে তার সাদা ফিয়াট।
উপকারী বন্ধুর জন্যে এটুকু না করলে কেমন দেখায়, ভাবল রানা।