চার
এথেন্স ফ্লাইট থেকে সবার আগে নামল হেনরি পিকেরিং। অফিশিয়াল পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রায় সাথে সাথে কাস্টমস আর এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি পেরিয়ে এল। টার্মিনাল ভবনের বাইরে তার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করছিল। ড্রাইভার সি.আই.এ. স্টেশন চীফ নয়, পদস্থ ল্যাংলি অফিসারের সাথে প্রকাশ্যে দেখা করবে না সে। একই কারণে যে মেয়ে-এজেণ্ট টিউলিপকে দেখেছে তারও আসার কথা নয়।
কুইন সোফিয়া স্ট্রীটে মার্কিন দূতাবাস, গাড়ি দিয়ে সেখান থেকে পাঠানো হয়েছে ড্রাইভারকে। নেহাতই ড্রাইভার, এসপিওনাজ সম্পর্কে বিন্দু-বিসর্গ কিছুই জানে না। টার্মিনাল ভবনে, ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে পিকেরিঙের সাথে হাঁটতে শুরু করল সে। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দেখাল, বলল, ‘বাইরে গাড়ি আছে, স্যার।’
কালো একটা পণ্টিয়াক, উজ্জ্বল রোদে ঝকঝক করছে। আশপাশে আরও কয়েকটা গাড়ি দেখল পিকেরিং। দুটো বাস, একটা লিমুসিন, তিনটে মাইক্রোবাস, ডজন দুয়েক প্রাইভেট কার। টার্মিনাল ভবন থেকে ভিড় করে বেরিয়ে আসছে লোকজন, ঢুকছেও বহু লোক। হঠাৎ একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেল সে।
হাঁটার গতি শ্লথ হলো না, চোখে ফুটল না এতটুকু বিস্ময়। ড্রাইভার দরজা খুলে ধরল, পিছনের সীটে চড়ল সে। ঘুরে সামনে চলে গেল ড্রাইভার, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। স্টার্ট নিল গাড়ি। টার্মিনাল চত্বর থেকে রাস্তায়, যানবাহনের সচল জটলায় বেরিয়ে এল। হেলান দিয়ে বসে থাকল পিকেরিং, একবারও পিছন ফিরে তাকাল না। তার দরকারও নেই, কারণ রিয়ার ভিউ মিররে ধূসর মার্সিডিজটাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে।
এথেন্স ধূসর রঙের মার্সিডিজ মানেই ট্যাক্সি। ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে অনেকগুলোই ছিল। পিছু পিছু একটার আসার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু আরোহী সেই পরিচিত লোকটা। শ্লাভিক অবয়ব, মুখের গড়ন অস্বাভাবিক চওড়া। লোকটা নিজেই ট্যাক্সি চালাচ্ছে।
সারটভ!
সামনের দিকে ঝুঁকে ড্রাইভারের সাথে কথা বলল পিকেরিং। ‘পিছনের ট্যাক্সিটাকে দেখছ?’
রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল ড্রাইভার, তারপর আবার সামনের রাস্তায়। ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল সে।
‘ওটাকে খসাতে পারবে?’ জিজ্ঞেস করল পিকেরিং।
‘ইয়েস, স্যার।’
‘তাহলে দেরি কোরো না।’
অশুভ চেহারার কালো মেঘ আর হিম কুয়াশাকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে বসন্ত যেন হঠাৎ করে পিছিয়ে গেছে। বছরের এই সময়ে, দিনের বেলা, এমন অন্ধকার ভাব ওয়াশিংটনে কখনও দেখা যায় না।
হাতঘড়ি দেখলেন জেফ রিকার্ড। বিকেল পাঁচটা। ফুটব্রিজটা মাটি আর পাথর দিয়ে তৈরি, ভার্জিনিয়া আর পেনিনসুলা টেডি রুজভেল্টকে এক করেছে। তিনি জানেন, সূর্যাস্তের সাথে সাথে পার্ক বন্ধ করে দেয়া হয়—ইউ.এস. পার্ক সার্ভিসের নির্দেশ তো আছেই, পটোম্যাক নদীর জোয়ারও একটা কারণ। উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই, এখানে তাঁর রাত কাটাতে হবে না। দু’চার মিনিট আলাপ করে চলে যাবেন।
ব্রিজ পেরিয়ে এলেন সি.আই.এ. চীফ। দু’পাশে ঘন ঝোপঝাড়, আর আকাশ ছোঁয়া গাছপালা, মাঝখান দিয়ে রাস্তা। খানিকদূর সামনে ফাঁকা একটা জায়গা, ওল্ড রাফ রাইডারের বিশাল ব্রোঞ্জ মূর্তি কালচে আকাশে মাথা উঁচু করে রয়েছে, মূর্তির চারধারে চওড়া পাথুরে চাতাল। মূর্তিটাকে পাশ কাটিয়ে, চাতাল পেরিয়ে বনভূমির ভেতর ঢুকলেন জেফ রিকার্ড।
কারও সাথে তাঁর দেখা হলো না। এই রকম আবহাওয়ায় দেখা হওয়ার কথাও নয়। তবু পথটার দু’দিকেই একটা তীক্ষ্ণ চোখ রেখে ঘন ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। তাঁর পিছন থেকে, ছোট্ট একটা ডাল ভাঙার আওয়াজ হলো।
জেফ রিকার্ড ফিরলেন, হ্যাঁ, মিখাইল পোলোনভ। পরনে বিজনেস স্যুট, ওভারকোটের কলার তুলে ঘাড় ঢাকা দিয়ে রেখেছে। তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন, কি ভাবছে বোঝার কোন উপায় নেই, তবে মুখের চেহারা থমথম করছে। দ্রুত পায়ে তার দিকে এগোলেন জেফ রিকার্ড। ‘বলুন?’
‘সাধ্যমত করেছি আমি,’ পোলোনভ বলল। ‘ইউরি সারটভকে পিকেরিঙের ওপর নজর রাখতে বলেছিলাম। ইউরোপে সারটভ আমাদের সেরা।’
‘তারপর?’
পোলোনভ এক মুহূর্ত ইতস্তত করল। ‘আপনার পিকেরিং ঘাস খায় না। সারটভকে খসিয়ে দিয়েছে।’
‘ইউরোপের সেরা, আপনাদের সারটভ?’
‘এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।’ কাঁধ ঝাঁকাল পোলোনভ। ‘কেউ কারও চেয়ে কম যায় না, দু’জনেই সমান চতুর।’
‘কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন কেন, পিকেরিং মাঠ থেকে অনেক দিন হলো অবসর নিয়েছে। আপনার রিপোর্ট আমাকে হতাশ করল, কমরেড পোলোনভ।’ জেফ রিকার্ড তার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালেন। ‘পিকেরিংকে আমার পেতেই হবে!’
আড়ষ্ট একটু হাসল পোলোনভ। ‘ঠিক এই পর্যায়ে ব্যাপারটা একটু অযৌক্তিক দেখায় না?’
‘আপনার কোন ধারণা নেই প্রয়োজনে কতটা অযৌক্তিক আমি হতে পারি,’ কঠিন সুরে জবাব দিলেন জেফ রিকার্ড। হতাশায় পিছন ফিরলেন তিনি। সারটভ যদি ওদের সেরা এজেণ্ট হয়ে থাকে, তাহলে আর আশ্চর্য কি পিকেরিং তাকে দেখামাত্র চিনতে পারবে। পোলোনভের দিকে ফিরলেন তিনি। হঠাৎ করেই নতুন একটা চিন্তা তাঁকে রীতিমত ধাক্কা দিল। একটার পর আরেকটা। সবগুলো খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি, পোলোনভকে ছাড়িয়ে দূরে চলে গেছে দৃষ্টি।
এখন তিনি জানেন টিউলিপ কনওয়েকে কিডন্যাপ করার হুকুম কে দিয়েছিল। তাঁর মনে হলো, কারণটাও তাঁর জানা। শুধু তাই নয়, টিউলিপ কোথায় আছে তাও তিনি আন্দাজ করতে পারলেন।
.
টিনের কৌটা আর কাগজের প্যাকেট খুলে টিউলিপের প্রিয় খাবারগুলো এক এক করে বের করল রানা। ক্যাণ্ডি, পীনাট বাটার, আইসক্রীম, স্যাণ্ডউইচ, পাইনঅ্যাপল জুস, স্ট্রবেরি, পনির, আর দুধ। কোমরে হাত রেখে সব দেখল টিউলিপ, তারপর মন্তব্য করল, ‘তুমি দেখছি আমাদের মার্কেটিং অফিসারের চাকরিটা খাবে, মি. গ্রেসন। এত ভাল বাজার করতে পারো।’
বেদম হাসি পেল রানার। এত থাকতে টিউলিপ ওকে বাজার সরকার ভাবল। তবে মেয়েটাকে যতই দেখছে ও, ততই বিস্মিত হচ্ছে। কে বলবে মাত্র চার বছর বয়স, কথা শুনে মনে হবে পাকা বুড়ি। তবু তো মেয়েটার প্রাণচাঞ্চল্য এখনও পুরোপুরি ফিরে আসেনি।
শেষ প্যাকেটটা খুলল রানা। টিউলিপের চোখ কৌতূহলে জ্বলজ্বল করছিল, প্যাকেট খোলা হতে প্রায় আঁতকে উঠল সে, এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘ওমা, কি ওটা?’
হেসে উঠল রানা। ‘অক্টোপাস। এক কামড় চলবে নাকি?
দ্রুত, ঘন ঘন মাথা নাড়ল টিউলিপ। ‘শুধু আব্বা খুব পছন্দ করেন, আর কেউ আমরা ছুঁয়েও দেখি না।’
‘এসো, বসো,’ প্যাকেটের ভেতর অক্টোপাস ভরে রেখে বলল রানা। ‘তোমাকে খাইয়ে তারপর আমি খাব।’
‘ইস, আমি যেন কারও হাতে খাই!’ সগর্বে বলল টিউলিপ। ‘সেই যখন থেকে হাঁটতে শিখেছি তখন থেকে নিজের হাতে খাই আমি।’ এগিয়ে এসে চেয়ারটায় বসল সে। ‘নাও, তুমি শুরু করো।’
মেয়েটাকে নিয়ে কোন ঝামেলাই হচ্ছে না রানার। অচেনা একটা বাড়িতে রানার সাথে একা আছে, আপনজনদের কাউকে দেখতে পাচ্ছে না, অথচ তবু কোন প্রশ্ন বা কান্নাকাটি নেই। সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে এ-ধরনের অচেনা পরিবেশে প্রায়ই থাকতে হয় তাকে, এবং রানার আন্তরিক যত্ন তার মন জয় করে নিয়েছে।
একটা সময় বোধহয় সব পুরুষের জীবনেই আসে যখন সন্তানের পিতা হবার সাধ জাগে মনে। সাধ জাগলেও, সেটা পূরণ হবার সম্ভাবনা আপাতত রানার জীবনে নেই। ওর মনে হয় বটে, সোহানাকে জন্ম-জন্মান্তর ধরে ভালবাসে ও, কিন্তু বিয়ের কথা উঠলেই চারদিক থেকে কতরকম দ্বিধা, ভীতি, আশঙ্কা, সংশয়, সংকোচ, অনীহা, ইত্যাদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আসল সমস্যা, ওর এই পেশা। হঠাৎ যদি মারা যায় ও? যে-কোন মুহূর্তে যেতে পারে। খুব ভাল করেই জানা আছে, তারপর বাকিটা জীবন বিধবা হয়ে কাটিয়ে দেবে সোহানা, আর কোন পুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না পর্যন্ত। সমস্যা আরও আছে। বাঁধনে জড়ালে এই স্বাধীন জীবন হারাতে হবে। অথচ হারাতে মন চায় না। তাছাড়া, পুরোদস্তুর সংসারী হওয়া যাকে বলে, তা কোনদিনই কি হতে পারবে ও? ওর প্রকৃতির মধ্যেই জিনিসটা নেই। প্রতিবার চিন্তা-ভাবনার শেষে সিদ্ধান্ত নেয় ও, এই তো বেশ আছি, –একা, স্বাধীন, লাগামহীন বুনো ঘোড়া। তবু দুর্বল মুহূর্তগুলোয় ঘর বাঁধার সাধ জাগে বৈকি, সন্তানের পিতা হতে ইচ্ছে করে। ফুলের মত ফুটফুটে শিশু দেখলেই কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে।
সেই আদর পেয়েই রানাকে আপনজন ভেবে নিয়েছে টিউলিপ।
নিজের হাতেই খেলো টিউলিপ, তবে এক এক করে রানা তার সামনে এগিয়ে দিল খাবারগুলো, বুঝিয়ে-শুনিয়ে সবগুলো থেকে একটু একটু করে খাওয়াল। সবশেষে দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে জানালার সামনে গিয়ে বসল টিউলিপ, তার কোলের ওপর খেলনা ভাল্লুকটা দিয়ে এল রানা।
‘লুকোচুরি খেলা?’ জিজ্ঞেস করল টিউলিপ।
‘দশ মিনিট পর।
‘কানামাছি?’
‘বিকেলে।’
‘তারমানে দুপুরে তুমি আমাকে ঘুম না পাড়িয়ে ছাড়বে না, এই তো?’ মুখ টিপে হাসল টিউলিপ। ‘আচ্ছা, একসাথে ক’টা চাকরি করবে তুমি, শুনি? শেষ পর্যন্ত মিসেস কেনটারকির চাকরিটাও খেতে চাও?’
জবাবে শুধু মিষ্টি একটু হাসল রানা। টেবিল পরিষ্কার করার সময় বারবার টিউলিপের দিকে তাকাল ও। দুধের গ্লাস শেষ করে ভাল্লুকটা নিয়ে খেলায় মগ্ন সে।
এক __ হলো আমেরিকা থেকে তাকে বের করে এনেছে রানা। হফ ভ্যানডেরবার্গের কফিনের নিচে, ফলস কমপার্টমেন্টে ভরে। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ক্রীটে এনেছে আজ দু’দিন। উপাদেয় খাবারদাবার, আর মুক্ত নির্মল বায়ু টিউলিপের চোখের নিচে জমে ওঠা কালি মুছে দিয়েছে, মুখে ফিরে এসেছে লালচে আভা।
টেবিল পরিষ্কার করে খবরের কাগজ নিয়ে বসল রানা। হেরাল্ড ট্রিবিউন-এ আন্তর্জাতিক খবরের অভাব নেই। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে ব্রিটেনে হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির জন্যে কে দায়ী তাই নিয়ে জার্মানীতে বিতর্কের ঝড়। ওয়াশিংটনে, ক্যাপিটলের কাছে, একজন কংগ্রেস সদস্য খুন। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের মেয়ে কিডন্যাপ সম্পর্কে কোন খবর নেই। ভেতরের পাতা খুলল রানা।
ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল ফোন।
প্রায় চমকে উঠে মুখ তুলল রানা।
‘দেখে হয়তো মিসেস কেনটারকি ফোন করেছেন,’ জানালার কাছ থেকে বলল টিউলিপ। ‘তোমার চাকরির মেয়াদ বুঝি ফুরোল!’
মিষ্টি হেসে ঠোঁটে একটা আঙুল রাখল রানা, বলল, ‘ফোনে কথা বলার সময় তুমি কিন্তু আমাকে ডাকবে না, কেমন?’
খিল খিল করে হেসে উঠল টিউলিপ। ‘ও, তুমি বুঝি ভেবেছ একা থাকতে আমার ভয় করবে!’
‘জোয়ান অভ আর্ক!’ বলে পাশের কামরায় চলে এল রানা, রিসিভার তুলল। ‘হ্যালো?’
একটা মেয়ের গলা, ‘অবশেষে ঝামেলা চুকল।’ সাঙ্কেতিক মেসেজ, কর্নেল অবসনের তরফ থেকে এল।
‘আমি বাঁচলাম,’ পাল্টা সঙ্কেত দিল রানা। ‘কেমন আছ?’ কণ্ঠস্বরটা পরিষ্কার চিনতে পেরেছে ও।
‘ব্যস্ত,’ বলল জিনা। ‘তোমার জন্যে উইলিয়াম অবসনের একটা মেসেজ আছে।’
‘জানি। অবশেষে ঝামেলা চুকল। কখন?’
‘আজ মাঝরাতে। নসোস-এ। গোলাপ কুঁড়ি বাড়ি ফিরছে।’
‘আজ রাতে! কিন্তু অবসন আমাকে বলেছিলেন এখানে আমাকে দু’রাত বা তারও বেশি থাকতে হবে। হঠাৎ তাড়াহুড়ো কেন, খারাপ কিছু ঘটেছে?’ রানার মনে সন্দেহ।
‘কি জানি, আমি তো কিছু জানি না।’
এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল রানা। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, প্ল্যানটা কি বলো।’
‘সহজ। টিউলিপকে আপনি অবসনের হাতে তুলে দেবেন, অবসন তাকে বাড়ি নিয়ে যাবেন।’
‘তারপর কি ঘটবে?’
‘তা তো জানি না। দেখা হলে অবসনকেই বরং জিজ্ঞেস করবেন।’
হ্যাঁ, ভাবল রানা, কর্নেল অবসনকে অনেক কথাই জিজ্ঞেস করার আছে ওর। কিন্তু সে-সব পরে। ‘নসোস-এ নাইট গার্ড আছে, তাই না?’
‘মাত্র দু’জন-একজন গেটে, আরেকজন ভেতরে। অবসনের অনুরোধ, উনি পৌঁছুবার আগে ওদের একটা ব্যবস্থা করবেন আপনি।’
‘পালা বদল হয় না?’
‘হয়। রাত ন’টায় আসে গার্ড, দু’জন, সকাল পর্যন্ত থাকে। পালাবদল হয় সকাল সাতটার পর।
প্ল্যানটা ঠিক পছন্দ হলো না রানার। জায়গাটা বড় বেশি নির্জন। তবে নসোসে মূল্যবান এমন কিছু নেই যে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করতে হবে। বেশিরভাগ প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হেরাক্লিয়ন মিউজিয়ামে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ‘তুমিও কি থাকবে ওখানে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘সন্দেহ আছে।’
‘খারাপ কথা।’
‘এই ব্যাপারটা মিটে গেলে আবার আমাকে পাওয়া যাবে।’ অপরপ্রান্তে পরিচিত হাসিটা কন্ধনায় দেখতে পেল রানা। ‘কথাটা মনে থাকবে,’ বলল ও।
‘গুড। তাহলে মাঝরাতে, কেমন?’ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
নড়ল না রানা, হাতে রিসিভার নিয়ে জানালা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল জলপাই ঝোপের দিকে। জানে, স্বস্তিবোধ করা উচিত ওর। বিপদ প্রায় কেটে গেছে, কর্নেল অবসনের হাতে টিউলিপকে তুলে দিতে পারলে আর কোন দায়িত্ব থাকে না। কিন্তু উদ্বেগ আর সন্দেহের অনুভূতি ছাড়ছে না ওকে, বরং আরও বেড়ে গেল। সঙ্কেতটা বড় তাড়াতাড়ি পৌঁছুল। মাত্র দু’দিন হলো ক্রীটে রয়েছে ওরা, অথচ থাকার কথা ছিল কমপক্ষে দু’হপ্তা। কোথাও কিছু গোলমাল হয়েছে?
কিচেনের দিকে পিছন ফিরল রানা।
‘কার ফোন জানতে পারি?’
ধীরে ধীরে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে খবরের কাগজটা তুলে নিল রানা। টিউলিপের বেডরূমে এসে ঢুকল। ‘মিসেস কেনটারকির নয়। তবে তাকে তুমি খুব তাড়াতাড়ি দেখতে পাবে। তোমার বাবা-মাকেও।’
উৎসাহে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কচি মুখটা। ‘কখন?’
‘কখন তা এখনই বলা যাচ্ছে না, তবে বেশি দেরি নেই।
‘বাবাকে বলব, তুমি আমার খুব যত্ন নিয়েছ,’ বলে আবার আপনমনে খেলতে শুরু করল টিউলিপ।
খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় মন দিল রানা। কিন্তু টিউলিপ চুপ করে থাকার মেয়ে নয়।
‘কি মজা, কি মজা, জেফ কাকার ছবি ছাপা হয়েছে!’
কাগজটা ঘুরিয়ে নিয়ে তাকাল রানা। সত্যিই তাই, সি.আই.এ. চীফের ছবি ছাপা হয়েছে। তাঁর দু’পাশে দু’জন কূটনীতিককে দেখা যাচ্ছে। জেফ কাকা, হুহ্-ভাবল রানা। টিউলিপ হয়তো বিশ্বাসই করবে না তার এই জেফ কাকাকে হাতেনাতে ধরার জন্যেই…
টিউলিপের দিকে ফিরে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল রানা, তারপর আবার মন দিল পড়ায়।
‘জেফ কাকা ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন কবে?’ জিজ্ঞেস করল টিউলিপ, খেলায় তার আর মন নেই।
বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। পড়ার বারোটা বাজল। কাগজটা ভাঁজ করে চেয়ারের উপর রাখল ও। টিউলিপের দিকে তাকাল। ‘কে বলল তোমাকে জেফ রিকার্ড ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন?’
‘কে আবার, বাবা!’
রানার একটা ভুরু কপালে উঠে গেল।
‘আমাকে নয়, আম্মিকে-আমি শুনে ফেলেছি।’ মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে রোদ ঝলমলে বাগানের দিকে তাকাল টিউলিপ। ‘আমাকে ফাঁকি দিতে চাও, তাই না? কই, সাঁতারের কথা ভুলেও তো মুখে আনোনি। বলো কখন যাবে!’
‘ঘুম থেকে ওঠার পর,’ বলল রানা। কৌতূহল আর আগ্রহ নিয়ে টিউলিপের দিকে তাকিয়ে আছে ও। ‘জেফ কাকা ভাইস প্রেসিডেণ্ট হবেন। তোমার বাবা বলেছেন—কবে?’
কাঁধ ঝাঁকাল টিউলিপ। তার মনে নেই, বা আগ্রহ নেই। হয়তো জানেই না। ‘তোমার সবটুকু কিন্তু ভাল না—এখনই সাঁতার কাটতে গেলে কি হয় শুনি!’
‘এই গরমে? পানি থেকে ওঠার সাথে সাথে আবার আগুন হয়ে যাবে গা। বিকেলে রোদ পড়ে আসবে, তখন, কেমন?’ কাগজটা আবার তুলে নিল চেয়ার থেকে।
‘আগামী ইলেকশনের পরে।’
মুখ তুলল রানা। ‘কি?’
‘বাবা তাই বলেছেন। আগামী ইলেকশনের পর জেফ কাকা ভাইস প্রেসিডেন্ট হবেন।’ হঠাৎ টিউলিপের চেহারায় কৌতূহল ফুটে উঠল। ‘আগামী ইলেকশন কবে বলো তো?’
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল রানা, কিন্তু আগ্রহে ছটফট করে উঠল মন। ‘তোমার বাবা তাই বললেন? তোমার ঠিক মনে আছে?’
‘বলল, শুনলাম, মনে থাকবে না কেন?’
‘কখন?’
‘এই তো বললাম।’
‘না, কখন তিনি কথাটা বলেন?’
‘জানি না।’
কাগজটা আবার চেয়ারে রাখল রানা, উঠে জানালার পাশে, টিউলিপের সামনে দাঁড়াল। ‘লড়ী সোনা, মনে করার চেষ্টা করো। ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, বুঝলে? চিন্তা করো, মনে পড়বে। ঠিক কখন তোমার বাবা-মা কথা বলছিলেন?’
কবে চোখের পাতা বন্ধ করল টিউলিপ। ঝাড়া এক মিনিট পর খুলল আবার। ‘আমি তখন একটা উপহারের প্যাকেট খুলছিলাম।’
‘কি রকম উপহার?’
‘একটা বই। বেড়াতে যাব, তাই…’
‘মিশিগানে?’
মাথা ঝাঁকাল টিউলিপ।
‘মিশিগানে বেড়াতে যাবার আগে-কোন্ দিন?’
রানার দিকে তাকিয়ে থাকল টিউলিপ। তারপর হঠাৎ তার মুখে ছড়িয়ে পড়ল উজ্জ্বল হাসি। ‘সেদিনই, যেদিন আমরা মিশিগানে বেড়াতে যাই।’
‘তোমার ঠিক মনে আছে?’ জরুরী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘ভাল করে মনে করে দেখো—সেদিনই, না অন্য কোন দিন?’
চেয়ার থেকে নেমে ভাল্লুকটা মেঝেতে রাখল টিউলিপ, কোমরে হাত রেখে কড়া দৃষ্টিতে তাকাল। ‘আমাকে কি ভাবো তুমি, মি. গ্রেসন? অনেক কথা ভুলে যাই বটে, কিন্তু যেটা মনে পড়ে সেটা ঠিকভাবেই মনে পড়ে। আমি নিজের হাতে বইটা সুটকেসে রাখি, সেদিনই প্লেনে চড়ি আমরা। ‘
যেদিন মিশিগানের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল টিউলিপ। নিউ ইয়র্কে রানার সাথে কর্নেল অবসনের দেখা হওয়ার পুরো এক হা পরে।
স্থির পাথর হয়ে বসে থাকল রানা, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে কচি মেয়েটার দিকে। বেচারি নিজের অজান্তেই এমন একটা তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে, সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল রানার। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড কনওয়ে যদি জানেন সি.আই.এ. চীফ জেফ রিকার্ড রাশিয়ার হয়ে কাজ করছেন, তাহলে কেন তিনি তাঁকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাইবেন?
তারমানেই দাঁড়ায়, কর্নেল অবসন ওকে মিথ্যে কথা বলেছে। প্রেসিডেণ্ট টিউলিপকে কিডন্যাপ করার অনুমতি দেননি।
টেবিলের কাছে ফিরে এসে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ল রানা। চমকে উঠে রানার দিকে তাকাল টিউলিপ। ‘ফ্রেণ্ড, কি হলো তোমার? তুমি কি অসুস্থ?’
জোর করে হাসল রানা। ‘আরে না। একটা সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি, তুমি খেলো।’
ব্যাপারটা তাহলে কি দাঁড়াল? আমেরিকার প্রেসিডেণ্ট, আমেরিকার কমাণ্ডার-ইন-চীফ-ও বটেন, তাঁর মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে রানা। ওকে বলা হয়েছিল, এই কাজে প্রেসিডেণ্টের অনুমোদন আছে, এমনকি একটা অনুমতি-পত্রও দেয়া হয়েছিল ওকে।
জাল।
তারমানে টিউলিপ কিডন্যাপ হবার আগে এ-সম্পর্কে প্রেসিডেণ্ট কিছু জানতেনই না। প্ল্যানটা তাহলে কর্নেল অবসনের একার, প্রেসিডেন্টের কোন ভূমিকা নেই।
মেয়েকে হারিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিশ্চয়ই পাগলপারা হয়ে আছেন। দুনিয়ার সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিমান পুরুষ তিনি, কিডন্যাপারকে কি শাস্তি দেয়ার কথা ভেবে রেখেছেন একমাত্র তিনিই জানেন।
নিজের অজান্তেই শিউরে উঠল রানা। তারপর নিজের ওপর রাগ হলো। অবসনের মত একটা লোক তাকে এমন রাম বোকা বানিয়ে ছাড়ল!
কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হলো রানার। জীবনে বোধহয় এই প্রথম নিজের কাছে স্বীকার করল ও, ভয় করছে। খুলিতে কেউ রিভলভারের নল ঠেকালে যে-ধরনের ভয় জাগে মনে, এটা সেরকম নয়। জীবনের ভয় নয়, ভয় স্বাধীনতা হারাবার।
স্বাধীনতা মানেই তো জীবন। স্বাধীনতাহীন জীবনের চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।
‘মি. গ্রেসন?’
পাশে চলে এসেছে টিউলিপ, ওর শার্টের আস্তিন ধরে মৃদু টান দিল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রানা, কেমন যেন দিশেহারা দৃষ্টি চোখে। ‘কিছু বলবে?
ঠোঁট ফুলে রয়েছে টিউলিপের, অভিমান হয়েছে। ‘কি এমন সমস্যা যে তুমি আমার সাথে কথাও বলছ না…।’
আদর করে কচি মেয়েটাকে কাছে টেনে নিল রানা। বুকে জাপটে ধরে চুমো খেল তার কপালে। ‘দুঃখিত, মাণিক। সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এসো, এবার লুকোচুরি খেলি। যাও, আগে তুমি লুকাও।’
‘বারে, তুমি আগে চোখ বন্ধ করো—ভেবেছ কোথায় লুকাব দেখে নেবে, না?’
চোখ বন্ধ করল রানা। এখন আর ভয় লাগছে না। রাগে কষকষ করছে শরীর। কর্নেল অবসনকে দেখে নেবে ও। ফল হাড়ে হাড়ে টের পাবে বাছাধন। অবসন ওকে ব্যবহার করেছে। ঠেলে দিয়েছে ভয়ঙ্কর এক বিপদের মুখে। তাকে রানা ক্ষমা করবে না।
একটু পর রাগও আর থাকল না। ভাবাবেগে অন্ধ হবার সময় নয় এটা। গোটা ব্যাপারটা সাবধানে বিশ্লেষণ করতে হবে, গভীর চিন্তা-ভাবনার দরকার, নিখুঁত একটা প্ল্যান চাই। প্রেসিডেন্ট কিছু জানেন না, অবসন মিথ্যে কথা বলেছে। কিন্তু সে কি জেফ রিকার্ড সম্পর্কেও মিথ্যে কথা বলেছে? তা যদি হয়, তাহলে টিউলিপকে কিডন্যাপ করাল কেন?
একটা ব্যাপারে রানা নিশ্চিত, রাত কাবার হবার আগেই অবসনকে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে হবে। প্রতিটি ব্যাখ্যা সন্তোষজনক হওয়া চাই। তা না হলে তার কপালে খারাবি আছে।
‘এই যে আমি এখানে!’ দরজার ওদিক থেকে টিউলিপের চিৎকার ভেসে এল। চোখ মেলল রানা। খোলা দরজার দিকে এগোল।
সাক্ষাতের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। আজ মাঝরাতে, নসোসে। গোলাপ কুঁড়ি বাড়ি যাচ্ছে।
সত্যি কি যাচ্ছে?