অপহরণ-২.১৪

চোদ্দো

‘ভেতরে ঢুকুন,’ জেফ রিকার্ড বললেন।

এক মুহূর্ত নড়ল না রানা। তারপর কথা না বলে গাড়ির ভেতর ঢুকল। সাথে অস্ত্র নেই, তিনজন সশস্ত্র লোকের বিরুদ্ধে একা কি করতে পারে ও?

ড্রাইভারের উদ্দেশে মাথা কাত করলেন সি.আই.এ. চীফ, গাড়িটা আবার যানবাহনের দ্রুতগতি মিছিলে ঢুকে গেল। জেফ রিকার্ড একটা বোতামে চাপ দিলেন, ড্রাইভারের সীটের পিছন থেকে কাঁচের একটা পার্টিশন সিলিং পর্যন্ত উঠে গেল।

দক্ষিণ দিকে ঘুরে কনেকটিকাট এভিনিউয়ে পড়ল লিমুসিন, হোয়াইট হাউস এবং মলের দু’পাশে সরকারি ভবনগুলো অনেক পিছনে ফেলে এসেছে ওরা।

রানা ভাবল, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ল্যাংলিতে?

কাঁচের পার্টিশনের দিকে ইঙ্গিত করলেন জেফ রিকার্ড। ‘সাউণ্ডপ্রুফ,’ বললেন তিনি। ‘আমরা কথা বলতে পারি।’

এক কথায় জানিয়ে দিল রানা, ‘আমার মূড নেই।’

‘তাহলে তো আমাকে একাই কথা বলতে হয়,’ শ্রাগ করলেন সি.আই.এ. চীফ।

ভাল-মন্দ কিছুই বলল না রানা।

‘জানতে ইচ্ছে করছে, মানসিকভাবে নিজেকে আপনি তৈরি করেছেন কিনা, বললেন জেফ রিকার্ড। ‘কি ঘটতে যাচ্ছে, আশা করি নিশ্চয় আপনি তা আন্দাজ করতে পারছেন?’

‘দু’জনের আন্দাজ দু’রকম হতে বাধ্য,’ বলল রানা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ও।

‘আচ্ছা! আপনার বুঝি তাই ধারণা?’ মৃদু হাসলেন জেফ রিকার্ড। ‘ঠিক আছে, আমি কি আন্দাজ করেছি বলি, দেখুন আপনারটার সাথে মেলে কিনা।’ নড়েচড়ে বসলেন তিনি। ‘কিডন্যাপিঙের ম্যাক্সিমাম শাস্তি যাবজ্জীবন। জানি, দুনিয়ার সেরা আইনবিদরা আপনার হয়ে লড়বে। সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত যাবে তারা। কিন্তু অপরাধটা পূর্ব পরিকন্ধিত, আর বিস্তর সাক্ষী প্রমাণ থাকায় ম্যাক্সিমাম শাস্তি না দিয়ে বিচারকদের কোন উপায় থাকবে না। রায়ের শেষে তাঁরা শুধু বলবেন, আসামী ক্ষমা ভিক্ষা চাইলে একমাত্র আমেরিকার প্রেসিডেন্টই শুধু সেটা বিবেচনা করার অধিকার সংরক্ষণ করেন। ঠিক জানি না, আপনি ক্ষমা ভিক্ষা নাও চাইতে পারেন, তবে আপনার পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল রাহাত খান, আপনার বস্, অবশ্যই শেষ চেষ্টা করে দেখবেন।

‘কিন্তু প্রেসিডেন্ট তাঁর আবেদন শুনবেন বলে মনে হয় না, কারণ তাঁরই মেয়েকে কিডন্যাপ করেছিলেন আপনি। ইতিমধ্যে, মামলা চলাকালে, রোমাঞ্চকর কিছু ঘটনা ঘটবে। হ্যাঁ, কমাণ্ডো স্টাইলে হামলা চালানো হবে আপনাকে পুলিসের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে। জেলখানায়, কোর্টে আনা-নেয়ার সময়। কিন্তু কোন চেষ্টাই সফল হবে না। মঝখান থেকে শুধু শুধু কিছু লোক অকালে মারা যাবে। তারপর, সাজা ভোগ করার সময়, জেল থেকে পালাবার চেষ্টা করবেন আপনি। কিন্তু কারারক্ষীদের মনে থাকবে কার মেয়েকে আপনি কিডন্যাপ করেছিলেন, কাজেই আপনার ওপর বিশেষ নজর রাখবে তারা। তারমানে, কোন উপায় নেই, বাকিটা জীবন চোদ্দ শিকের ভেতরই কাটাতে হবে আপনাকে।’ জেফ রিকার্ড চুপ করলেন, কয়েক সেকেণ্ড পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু বলছেন না যে? মিলল?’

‘না,’ বলল রানা, এই প্রথম ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল ওর ঠোঁটে। ‘মিলল না।’

‘তাহলে তো শুনতে হয় আপনি কি আন্দাজ করেছেন, ‘ আগ্রহের সাথে বললেন জেফ রিকার্ড।

‘তার আগে একটা প্রশ্ন করি?’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’

‘আপনি তো আমার ফাইল পড়েছেন। ওতে এমন কিছু পেয়েছেন নাকি যাতে আমাকে ইডিয়ট বলে মনে হয়? মনে হয়, আমি একটা গর্দভ?’

কেমন একটু থতমত খেয়ে গেলেন জেফ রিকার্ড। ‘না…মানে, ঠিক উল্টোটাই বরং মনে…’

‘তাহলে কিভাবে ধরে নিলেন নিজেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা না রেখে বাঘের ঘরে ঢুকেছি আমি?’ প্রশ্ন করল রানা।

‘তারমানে? আপনি জানতেন ধরা পড়ে যাবেন?’

‘জানতাম ধরা পড়তে পারি।’

‘এবং আপনি বলছেন, নিজেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা আপনার করা আছে?’

‘অবশ্যই,’ জোর দিয়ে বলল রানা।

বিস্মিত হলেন জেফ রিকার্ড। ‘জানতে পারি, কি সেটা?

‘অবশ্যই জানতে পারেন,’ মৃদু হেসে বলল রানা। ‘এবং জানার পরই আমাকে নিয়ে আপনাদের যে প্ল্যান সেটা বাতিল হয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি, বাতিল করে দিতে বাধ্য হবেন।’

‘প্লীজ বলুন, প্লীজ।’ সকৌতুকে জানতে চাইলেন সি.আই.এ. চীফ।

‘হেনরি পিকেরিং রাশিয়াকে কি কি তথ্য দিয়েছে আমি জানি, ‘ বলল রানা। ‘আরও জানি, কি কি ফাইল ল্যাংলি থেকে সরিয়ে গোপন জায়গায় রেখেছে সে, কিন্তু সময় আর সুযোগের অভাবে কে.জি.বি-র হাতে শেষ পর্যন্ত তুলে দিতে পারেনি। ফাইলগুলো কোথায় আছে তা-ও আমি জানি। টপ-সিক্রেট তথ্যগুলো পিকেরিঙের কাছ থেকে পাওয়ার পর কে.জি.বি সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নিজেদের ডিফেন্স সিস্টেমে ব্যাপক রদবদল করে…।’

রানার কথাগুলো গোগ্রাসে গিলছিলেন জেফ রিকার্ড, হঠাৎ ভুরু কুঁচকে উঠল তাঁর। ‘রাশিয়া ডিফেন্স সিস্টেম বদলালে আপনার তা জানার কথা নয়! এসব কিছুই আপনার জানার কথা নয়!’

‘নয়। কিন্তু জেনেছি।’ হাসল রানা। ‘বলতে পারেন সেকেণ্ড হ্যাণ্ড তথ্য। কিন্তু ইচ্ছে করলে আপনারা উৎস থেকেও এ-সব তথ্য আবার সংগ্রহ করতে পারবেন।’

‘পিকেরিং? ইয়েস, মাই গড, পিকেরিং!’ রানার দিকে ঝুঁকলেন সি.আই.এ. চীফ। ‘তারমানে আপনি জানেন কোথায় আছে সে?’

‘জানি।’

‘কোথায়?’

কথা না বলে মুচকি হাসল রানা।

একটু থেমে জেফ রিকার্ড বললেন, ‘আপনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমার আন্দাজটা মিথ্যে ছিল,’ অকপটে স্বীকার করলেন তিনি।

‘বলুন ভুল ছিল,’ সংশোধন করে দিল রানা।

‘না,’ জেফ রিকার্ড বললেন, ‘মিথ্যে ছিল।

‘মানে?’

‘আপনাকে আসলে আমি যাচাই করছিলাম,’ বললেন সি.আই.এ. চীফ। ‘আপনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুই আমি আন্দাজ করিনি। আপনার ভবিষ্যৎ কি তা আমি জানি।’

‘জানেন!’

‘ব্যাপারটা বোধহয় প্রথম থেকেই ব্যাখ্যা করা উচিত, একটা ব্যাখ্যা আপনার পাওনা হয়েছে,’ বললেন সি.আই.এ. চীফ। ‘পিকনিক। ওটা একটা ফাঁদ ছিল।’

‘হ্যাঁ, একটু দেরিতে বুঝেছি।’

‘দুঃখিত, কৌশলের আশ্রয় না নিয়ে উপায় ছিল না। আপনার মত পিচ্ছিল মানুষকে আর কিভাবে আটকানো যেত বলুন! খুশি লাগছে এই ভেবে যে ফাঁদটা কাজে দিয়েছে।’

‘কংগ্রাচুলেশন্স।’

চোখ থেকে চশমা খুলে কাঁচ দুটো রুমাল দিয়ে মুছলেন জেফ রিকার্ড। ‘আমি চাইনি ওখানে ওদের হাতে আপনি ধরা পড় ন। কারণ, প্রেসিডেন্ট চাইছেন একটা ট্রে-তে করে আপনার কল্লাটা তাঁর সামনে রাখা হোক।’ আবার চশমা পরলেন তিনি, রানার দিকে তাকালেন। ‘কিন্তু আমি আপনাকে অখণ্ড অবস্থায় রাখতেই পছন্দ করব।’

রানা একটা সিগারেট ধরাল। তারপর হঠাৎ ওর খেয়াল হলো: জেফ রিকার্ড কি বললেন? প্রেসিডেণ্ট চান ওর শাস্তি হোক, কিন্তু জেফ রিকার্ড চান না! ‘তারমানে?

‘মানে হলো, মাসুদ রানা টিউলিপ কনওয়েকে কিডন্যাপ করতে পারে না। প্রথমে আমারও তাই ধারণা হয়েছিল, কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছি ধারণাটা একদম ভুল।’ মুচকি মুচকি হাসছেন জেফ রিকার্ড। ‘কি করে রানা টিউলিপকে কিডন্যাপ করে, বলুন? টিউলিপ কিডন্যাপ হবার আগেই তো সে অসলো-য় গাড়ি অ্যাক্সিডেণ্ট করে মারা গেছে। দরকার হলে কবর থেকে আবার লাশ তুলব আমরা, পরীক্ষা করে নিশ্চিত হব সত্যি ওটা মাসুদ রানারই লাশ। জিজ্ঞেস করবেন, তাহলে টিউলিপকে কিডন্যাপ করেছিল কে?’ শ্রাগ করলেন তিনি। ‘জানি না। সারটভও হতে পারে। যে-ই হোক, সে পালিয়েছে।’

রানার মুখে কথা ফুটল না। জেফ রিকার্ডের মত ব্যক্তিত্ব মিথ্যাচারের আশ্রয় নেবেন না। তারমানে প্রেসিডেন্টের চোখে ধুলো দেবেন তিনি। রানার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ।

একটা হাত তুলে জানালার বাইরেটা দেখালেন জেফ রিকার্ড। ‘হোয়াইট হাউসের ওদিকে রাস্তার ওপারে, জাস্টিস ডিপার্টমেণ্ট, ‘ বললেন তিনি। ‘কিন্তু তথাকথিত সুবিচার নিশ্চিত করা আমার কাজ নয়। আমার হাতে আরও অনেক সমস্যা আছে-যেমন, বিশ্বাস করতে পারি না এমন লোকজনে ভরা সি.আই.এ.। ওটা আমাকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে, এবং ক্ষীণ একটু আশা রাখি, অনুরোধ করলে কাজটায় আপনি হয়তো আমাকে কিছুটা সাহায্য না করে পারবেন না।’

‘আসলে,’ হাসি মুখে বলল রানা, ‘প্রথম থেকেই আমি আপনাদের বিরুদ্ধে ছিলাম না।’ গোটা ব্যাপারটা খুলে বলল ও।

‘কিন্তু আমি সেটা অনেক পরে বুঝেছি,’ বললেন জেফ রিকার্ড। ‘একটা সময় গেছে, যখন আপনাকে খুন করতে পারলে আমার চেয়ে খুশি কেউ হত না। কিন্তু নসোসের পর, হ্যাঁ, আপনার উদ্দেশ্য আমার কাছে পরিষ্কার হতে শুরু করে। আপনি কি করতে চাইছেন, আমি আন্দাজ করতে পারি। টিউলিপকে হোয়াইট হাউসে পৌঁছে দিয়ে কেটে পড়বেন। পিকনিকের আইডিয়াটা আমার ছিল, আপনি যাতে হোয়াইট হাউসে ঢুকতে পারেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি, তারপর হঠাৎ রানার দিকে ফিরলেন। ‘কংগ্রাচুলেশন্স, মি. রানা। আপনি একটা কাজই করেছেন।’

‘কিন্তু আপনার হাতে আমি ধরা পড়ে গেলাম,’ রানার গলায় ক্ষীণ একটু খেদ।

‘তার কারণ আমার ব্যাপক ক্ষমতা,’ বললেন জেফ রিকার্ড। ‘কিন্তু আপনার সাফল্যের কোন তুলনা হয় না। টিউলিপকে আপনি বাড়ি ফিরিয়ে আনলেন, কারও সাহায্য ছাড়া, ওদিকে দুনিয়ার অর্ধেক ইন্টেলিজেন্স আপনাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। আমি আর আমার বিশ্বস্ত কয়েকজন লোক ছাড়া এখনও কেউ জানে না আপনি কোথায়।’ হাত তুলে বাতাসে ঝাপটা দিলেন তিনি। ‘অতীত ইতিহাস। আপনার নতুন কেস হেনরি পিকেরিং। রানা এজেন্সির ফি খুব বেশি, জানি। কিন্তু পিকেরিংকে আমার খুব বেশি দরকার। আমাকে মক্কেল হিসেবে রানা এজেন্সি পছন্দ করবে তো?’

‘নো, ফি,’ বলে পকেট থেকে একটা চাবি বের করল রানা। বাড়িয়ে দিল জেফ রিকার্ডের দিকে। বলল, ‘এটা আমি ডাকযোগে আপনার কাছে পাঠাতাম।’

‘কিসের চাবি?’

‘পিকেরিং।’

চাবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন জেফ রিকার্ড। তারপর রানার দিকে ফিরলেন। ‘পিকেরিংকে আপনি কোনও ঘরে আটকে রেখেছেন?

মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘প্যাচার মত মুখ করে মেঝেতে পড়ে আছে। জিজ্ঞেস করলেই গড়গড় করে বলে দেবে সব।’ ডাডিংটন প্লেসের ঠিকানাটা জানিয়ে দিল ও।

‘সেক্ষেত্রে আপনারও একটা চাবি পাওনা হয়েছে,’ বলে পকেট থেকে আর একটা চাবি বের করলেন জেফ রিকার্ড চাবিটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল রানা। রিঙের সাথে একটা প্লাস্টিক ট্যাগও রয়েছে, তাতে রোড আইল্যাণ্ড এভিনিউয়ের একটা ঠিকানা। রূম নং ৩০২, একজিকিউটিভ হোটেল।

একটা বোতাম টিপলেন জেফ রিকার্ড। গাড়ির গতি কমে এল, ফুটপাথের পাশে থামল ড্রাইভার।

জেফ রিকার্ড রানার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

করমর্দন করল রানা। ‘একটা সুতো ঢিল রয়ে গেছে,’ বলল ও। ‘রিপ নরটন নামে এক ক্লাউনকে দশ হাজার ডলার পেমেণ্ট করতে হবে।’

‘ঠিক আছে। কোথায় সে?’

‘ইতিমধ্যে নাইরোবিতে পৌঁছে গেছে।’

‘নাইরোবি?’

মাথা ঝাঁকিয়ে নিঃশব্দে হাসল রানা।

নেমে গেল গাড়ি থেকে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *