দশ
একটানা মেঘের গর্জন কানে নিয়ে হেলিকপ্টার থেকে নামলেন জেফ রিকার্ড। সিঁড়ির মাঝখানে রয়েছেন, বিদ্যুৎ চমকে উঠল, কড়কড় কড়াৎ করে বাজ পড়ল কাছে কোথাও। বিদ্যুৎ চমকের আলোয় তিনি দেখলেন, টার্মিনাল বিল্ডিঙের সামনে পার্ক করা রয়েছে আর্মি ট্রাকগুলো।
আকাশের দিকে মুখ তুললেন তিনি। ঝড়ো মেঘে ঢাকা পড়ে আছে। ভাবলেন, কি ধরে নেবেন, প্রকৃতিও কি মাসুদ রানাকে সাহায্য করতে চাইছে?
নিউআর্কে নিজেই চলে এসেছেন জেফ রিকার্ড। রানা যখন প্লেন থেকে নামবে, তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকতে চান। টিউলিপের দায়িত্ব নেয়ার জন্যে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকা দরকার তাঁর। অবশ্য প্লেনটা যদি আদৌ নামতে পারে এখানে।
টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে এল এক লোক। বাতাসে হেলান দিয়ে হেঁটে এল সে, টানা বাতাসের জন্যে রেনকোটের কিনারা এক করে বুকের কাছে ধরে আছে।
‘মি. জেফ রিকার্ড?’ ওদের পিছনে রানওয়ে ধরে লিফট-অফে ঢুকে যাচ্ছে একটা জাম্বো জেট, তাই চিৎকার করে কথা বলতে হলো তাকে। ‘আমি এফ.এ.এ-র উইলি কিপার। জঘন্য আবহাওয়া, তাই না?’
করমর্দন করার সময় গম্ভীরভাবে মাথা ঝাঁকালেন জেফ রিকার্ড। ‘কি মনে হয় আপনার?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ‘প্লেনটাকে কি অন্যদিকে ডাইভার্ট করতে হবে?’
আকাশটা দেখে নিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল উইলি কিপার। ‘এখনই বলা মুশকিল। বিশ মিনিটের মধ্যে মেঘ কেটে যেতে পারে। আবার জোরাল মেঘ শুরু হলেও আশ্চর্য হব না। বোস্টনে এই মুহূর্তে প্রলয় কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছে বাতাস। গাছের ডালপালা ছাড়া আর কিছুই নড়ছে না ওখানে।’
‘এখানের আবহাওয়া সম্পর্কে কি বলা হয়েছে?’
‘বৃষ্টি। কিন্তু পরিস্থিতি কতটা খারাপ হতে পারে আমাদের কোন ধারণা নেই। মেয়েমানুষ আর ঝড়, কার সাধ্য এদের মতিগতি বোঝে!’
উইলি কিপারকে পাশে নিয়ে হাঁটা ধরলেন জেফ রিকার্ড। টার্মিনাল ভবনের দিকে যাচ্ছেন। বোমা ফাটার আওয়াজের সাথে আবার আলোকিত হয়ে উঠল আকাশ। ক্ষণস্থায়ী আলোয় জেফ রিকার্ড দেখলেন, ক্যানভাস ঢাকা আর্মি ট্রাকের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে হেলমেট পরা মাথা। ফোর্ট ডিক্স থেকে দুশো ট্রুপ নিয়ে আসা হয়েছে, অ্যাকশনের জন্যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে তারা।
রানার সাথে যুদ্ধ করতে হবে সে-ধরনের কিছু ভাবছেন না তিনি। এয়ারপোর্টের দুর্বল জায়গাগুলোয় সশস্ত্র লোক দরকার তাঁর, তা না হলে সিকিউরিটি অ্যারেঞ্জমেণ্টে খুঁত থেকে যাবে, সেজন্যেই ওদেরকে আনা। তাছাড়া, দক্ষ মার্কসম্যানও দরকার হতে পারে।
‘ইতিমধ্যে,’ দরজার কাছে পৌঁছে বলল উইলি কিপার, ‘ম্যানেজারের সাথে আপনার একটু সমস্যা হতে পারে। বললেন, আবহাওয়া নিয়ে এমনিতেই তিনি বিপদের মধ্যে আছেন। বোস্টনে ল্যাণ্ড করতে না পেরে এখানে ল্যাণ্ড করেছে বেশ কয়েকটা প্লেন-জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। আপনার সমস্যাটাকে তিনি উটকো ঝামেলা হিসেবে দেখছেন।
‘তার কোন উপায় নেই,’ জেফ রিকার্ড বললেন। ‘যা বলব করতে হবে। কোথায় সে?’
‘আপনার জন্যে তাঁর অফিসে অপেক্ষা করছেন।’
.
মালাঞ্জার চাকর সাদা জ্যাকেটের বদলে কালো স্যুট পরেছে। প্লেনের স্টারবোর্ড সাইডের জানালার দিকে ঝুঁকে বাইরে তাকাল সে। ‘হ্যাঁ, আমেরিকান,’ নিশ্চিতভাবে জেনে তারপর বলল সে। ‘এফ-ফিফটিন।’
নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল রমিউলাস। পাশে বসা লোকটার দিকে ফিরল সে। ‘আমরা এখন কি করব?’
‘প্রার্থনা করলে কেমন হয়?’ প্রশ্ন করে নিজের দিকের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল গ্রীক অর্থোডক্স প্রিস্ট। ‘আরে, এদিকেও দেখছি রয়েছে একটা!’ শব্দ করে হেসে উঠল সে। ‘এসকর্টস! মাসুদ রানাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে!’
চোখে শক্তিশালী বিনকিউলার তুলল পিকেরিং। পেভমেন্টের ওপর চোখ বুলাল সে, তারপর বিল্ডিঙের পিছন দিকে দাঁড়ানো ছয়টা ট্রাকের ওপর স্থির হলো দৃষ্টি।
কয়েক সেকেণ্ড পর সারটভের দিকে ফিরল সে, আরেক জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারটভ। বিশতলা বিল্ডিংটা নিউআর্ক এয়ারপোর্ট থেকে এক মাইল দূরে, এখান থেকে এয়ারফিল্ড আর টার্মিনাল ভবন পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। এখানে ওরা এসেছে নিউ ইয়র্ক হয়ে, নিয়মিত অ্যারোফ্লট ফ্লাইটের ক্রু হিসেবে ছদ্মবেশ নিয়ে।
দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল পিকেরিং। জেফ রিকার্ড ওদের আগেই পৌঁছে গেছে। সাথে সেনাবাহিনীর একটা ব্যাটালিয়ন! ‘সারটভ?’
জানালার দিকে পিছন ফিরল সারটভ। ‘ওখানে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার,’ বলল সে। ‘রিকার্ডের প্ল্যানটা কি জানতে হবে আমাদের।’
মাথা ঝাঁকিয়ে আবার চোখে বিনকিউলার তুলল পিকেরিং। ‘ঠিক। সময় মত জানতে পারব। কিন্তু আপাতত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
.
জেফ রিকার্ড অফিস ঘরে ঢুকে দেখলেন জোনাথন টড গ্যাট হয়ে বসে আছেন তাঁর চেয়ারে। তিনি দাঁড়ালেন না।
তাঁর বয়স চল্লিশের মত, চুলে পাক না ধরলেও হালকা হতে শুরু করছে, একজোড়া ওয়্যার-ফ্রেম চশমার ভেতর ঠাণ্ডা হিম সাপের চোখ অন্তর ভেদ করে যায়।
‘মি. টড। আমি জেফ রিকার্ড।’
‘আমি জানি আপনি কে,’ জবাব দিলেন জোনাথন টড। ভারী, গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর। এয়ারপোর্টের জেনারেল ম্যানেজার না হয়ে রেডিওর ঘোষক হলেই গলাটা মানাত ভাল। আমেরিকার কোন কোন এয়ারপোর্ট আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন এটা একটা। এ ধরনের এয়ারপোর্টগুলো সরকার কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করবে, শেয়ার হোল্ডাররাই বা কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করবে, তা নিয়ে মাঝে মধ্যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কোন এয়ারপোর্টে এককভাবে কোন ব্যক্তির সার্বিক কর্তৃত্ব থাকে না, কিন্তু নিউআর্ক এয়ারপোর্টে জোনাথন টড প্রায় একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করতে চলেছেন। তাঁর মত দায়িত্বসচেতন, কঠোর পরিশ্রমী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, এবং বুদ্ধিমান একজন যে নিজগুণে বিস্তর ক্ষমতার অধিকারী হবেন তাতে আর আশ্চর্য কি।
‘তাহলে আপনি জানেন, আমি আপনার পূর্ণ সহযোগিতা পাব বলে আশা করি,’ জেফ রিকার্ড বললেন।
এক মুহূর্ত কোন উত্তর দিলেন না জোনাথন টড। সি.আই.এ. চীফের মুখের ওপর ঠাণ্ডা চোখ বুলিয়ে চেয়ার ছাড়লেন। ‘এইটুকু জানি আমি,’ বললেন তিনি। ‘আমাকে নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা সি.আই.এ. রাখে না। আমরা কেউ এখানে সি.আই.এ-র নির্দেশ মানতে বাধ্য নই। এয়ারপোর্ট বন্ধ করে দেয়ার সময় বা ইচ্ছে, কোনটাই নেই আমাদের। এখন আমাকে ওয়াশিংটনে একটা ফোন করতে হবে।’
‘হ্যাঁ, করবেন বৈকি,’ একটুও অবাক হননি জেফ রিকার্ড। ‘তবে তার আগে হয়তো আপনাকে আমার জানানো উচিত যে এখানে আমি সি.আই.এ. ডিরেক্টর হিসেবে আসিনি। এসেছি ফেডারেল মার্শাল হিসেবে। এই এয়ারপোর্ট জাতীয়করণ করার আইনগত অনুমতিও সাথে করে নিয়ে এসেছি আমি। হ্যাঁ, ঠিকই ভাবছেন আপনি, ইমার্জেন্সী পাওয়ার অ্যাক্ট-এর ক্ষমতা প্রয়োগ করে অনুমতিটা দেয়া হয়েছে আমাকে।’ পকেটে হাত ভরে চিঠিটা বের করলেন তিনি। জোনাথন টডের মুঠোয় সেটা গুঁজে দিয়ে হাত বাড়ালেন ফোনের দিকে।
‘কি করছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন জোনাথন টড।
‘সাহায্য,’ বললেন জেফ রিকার্ড। ‘আপনাকে। ওয়াশিংটনের সাথে কথা বলবেন না?’
জেফ রিকার্ড শুনতে পেলেন অপর প্রান্তে বেল বাজছে। তারপর তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করলেন। অপরপ্রান্ত থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর হ্যালো বলল। সি.আই.এ. চীফ বললেন, ‘আমি চাই তুমি এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের সাথে কথা বলো।’ রিসিভারটা এবার তিনি জোনাথন টডের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ‘নিন, কথা বলুন। প্রেসিডেণ্ট।’
*
ত্রিশ মিনিটের মধ্যে নিউআর্ক এয়ারপোর্টে প্লেন আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। টেক-অফ করার জন্যে তেরোটা প্লেন অপেক্ষা করছিল, এখন থেকে ওগুলো জেফ রিকার্ডের অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষাই করতে থাকবে। আরও আটটা মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছিল, এক এক করে সেগুলোকে নির্দেশ দেয়া হলো আশপাশের এয়ারপোর্টগুলোয় ল্যাণ্ড করো। টার্মিনাল লোকে লোকারণ্য, কিন্তু কাউকে প্লেনে চড়তে দেয়া হলো না। শুধু তাই নয়, ডিপারচার লাউঞ্জ থেকে সব লোকজনকে আরও নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো।
বাইরেও সমস্ত তৎপরতা থেমে গেল। এয়ারফিল্ড ছেড়ে চলে যেতে বলা হলো পোর্টারদের। গ্রাউণ্ড কনট্রোলারস এবং মেইন্টেন্যান্স স্টাফদের যে-ক’জনকে দরকার তাদের রেখে বাকি সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দেয়া হলো, তবে দরকারের সময় ডাকলেই তারা চলে আসবে। আর থাকল ফোর্ট ডিক্সের দুশো ট্রুপ।
অবজারভেশন ডেকের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন জেফ রিকার্ড, তুমুল বর্ষণে গোটা এয়ারফিল্ড ঝাপসা হয়ে আছে। এফ.এ.এ-র উইলি কিপার তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।
‘ঘাবড়াবেন না, স্যার,’ বলল সে। ‘ঝড়-বৃষ্টি যতই জোরাল হোক, তার মধ্যে আপনি যদি গাড়ি চালাতে পারেন, তাহলে পাইলট প্লেনও ল্যাণ্ড করাতে পারবে।’
‘আমাকে হতাশ করলেন। এই অবস্থায় আমি গাড়ি চালাতে রাজি নই।’
উইলি কিপার হাসল। ‘আবহাওয়া সমস্যা হতে যাচ্ছে কিনা এখুনি তা বলার উপায় নেই। হাতে কম করেও এখনও চল্লিশ মিনিট সময় রয়েছে। আর তাছাড়া, বিকন্ধ ব্যবস্থা তো করাই আছে, তাই না?’
‘হুম।’ মাথা ঝাঁকালেন জেফ রিকার্ড। এয়ারফোর্স এসকর্ট ব্যবহার করার বুদ্ধিটা তাঁরই। একটাই উদ্দেশ্য ছিল, রানা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। সমুদ্রের ওপর দিয়ে আসছে জেট প্লেনটা, পুবদিকে পাবে লম্বা সৈকত, বিপদ টের পেয়ে রানা যদি প্যারাস্যুট নিয়ে লাফ দেয়?
তা রানা দেয়নি, এবং এখন আর তা করা সম্ভব নয়। জেটের দু’পাশে এসকর্ট ঠিকই এতক্ষণে লক্ষ করেছে ও। দুদিকে আঠার মত লেগে আছে দুটো এফ-ফিফটিন।
এসকর্ট এখন আরেক কাজে লাগবে। আবহাওয়ার জন্যে প্লেনটাকে যদি অন্য কোন এয়ারপোর্টে ল্যাণ্ড করতে হয়, এফ-ফিফটিন দুটোও থাকবে সাথে। আশপাশের শহরে, উপকূলে, বা সাগরে, যেখানে যত ফেডারেল এজেণ্ট আর ট্রুপস আছে, সবাইকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। শুধু যোগাযোগের অপেক্ষা, সাথে সাথে রওনা হয়ে যাবে তারা। কোথাও কোন ফাঁক রাখা হয়নি। সব দিক থেকে কাভার দেয়া হয়েছে রানাকে। পালাবার তার কোন উপায় নেই। শুধু একটা কথা ভেবে একটু অস্বস্তি বোধ করছেন তিনি। রানার প্লেন যদি অন্য কোথাও ল্যাণ্ড করে, প্লেনের আগে সেখানে তাঁর পৌঁছানো সম্ভব নয়।
অথচ রানা প্লেন থেকে নেমে আসার সময় সেখানে তিনি উপস্থিত থাকতে চান।
.
মোলাঞ্জা রমিউলাস প্লেনের সামনের অংশে বসে আছে। পিছনের চেয়ে সামনেই কম লাগে ঝাঁকি আর আওয়াজ। তবুও বেশিরভাগ সময় চোখ বুজে আছে সে। প্লেনে ওঠার আগে ঘুমের বড়ি খেতে চেয়েছিল সে, কিন্তু রানা তাকে বারণ করেছে।
এমনিতে ভয় পায়, তার ওপর ঝড়ের মধ্যে পড়েছে প্লেন। সীটের হাতল ধরা হাতের আঙুল সাদা হয়ে গেছে তার। এই মুহূর্তে পাশে বসা গ্রীক অর্থোডক্স প্রিস্টের চেয়ে সে-ই ঈশ্বরকে বেশি স্মরণ করছে। ঠোঁট জোড়া সারাক্ষণ নড়ছে তার, নিঃশব্দে।
মাঝে মধ্যে চোখ খুলছে রমিউলাস। বাঁ দিকে জানালা। চট্ করে একবার তাকিয়েই ফিরিয়ে নিচ্ছে চোখ। দৃষ্টি চলে না, কিছুই দেখার নেই। ঘন কালো মেঘ যেন গিলে ফেলেছে প্লেনটাকে।
আবার চোখ বুজে রানাকে অভিশাপ দিল সে, ব্যর্থ চেষ্টা করল নিজেকে শান্ত করার। তারপর তার মনে পড়ল উপহার হিসেবে রানার কাছ থেকে কি পাবে সে।
অমূল্য একটা তথ্য। তার প্রতিষ্ঠানে একজন বিশ্বাসঘাতক আছে। নামটা জানার জন্যে দরকার হলে আরও হাজার বার প্লেনে চড়তে রাজি আছে সে।
.
ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠতেই ছোঁ দিয়ে ফোনের রিসিভার তুলল পিকেরিং।
অপরপ্রান্তের লোকটা নিউআর্ক এয়ারপোর্টের গ্রাউণ্ড ক্রু, বিশ বছরের চাকরি তার। ‘যা যা জানতে চেয়েছিলেন সব এখন বলতে পারব আমি।’
‘শোনাও।’
‘আবহাওয়া আরও খারাপ না হলে প্লেনটাকে ওরা নামাতে দেবে,’ বলল গ্রাউণ্ড ক্রু। ‘তারপর ওরা এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে করে বেরিয়ে যাবে। সামনে থাকবে দুটো আর্মি ইউনিট, পিছনে থাকবে দুটো আর্মি ইউনিট। সোজা ফোর্ট ডিক্সে ফিরবে ওরা, ওখানে ওদের জন্যে এয়ারফোর্স ওয়ান অপেক্ষা করছে।’
‘তুমি ঠিক জানো?’
‘পজিটিভলি। সিকিউরিটিতে আমার বন্ধু আছে, সরাসরি তার মুখ থেকে শুনেছি।
‘কি ধরনের গাড়ি?’ জানতে চাইল পিকেরিং।
‘গাড়িটাই সমস্যা হবে। ওটা একটা আর্মার্ড কার। ট্যাংকের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
পিকেরিঙের কপালে চিন্তার রেখা ফুটল। এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে, টিউলিপকে তারা এয়ারপোর্ট থেকে ছিনতাই করতে পারবে না। কাজটা সারতে হবে নিউ আর্ক আর ফোর্ট ডিক্সের মাঝখানে কোথাও। রাস্তার তলায় ডিনামাইট বসিয়ে আর্মি কারগুলোকে ধ্বংস করা কঠিন কোন কাজ নয়, দেখে মনে হবে আয়োজনটা রানাই আগে থেকে করে রেখেছিল। কিন্তু আর্মার্ড কার-কে থামাবার মত যথেষ্ট ডিনামাইট ব্যবহার করলে ভেতরে যারা থাকবে তারা সবাই মারা পড়বে।
মৃত টিউলিপকে কারও কোন দরকার নেই।
‘আরোহীদের কোথায় থাকতে দেয়া হয়েছে?’ জানতে চাইল পিকেরিং।
‘মেইন টার্মিনালে।’
‘ওখানকার সিকিউরিটি?
‘নেই। তবে এয়ারফিল্ড আর গাড়িটার কাছে অনুমতি ছাড়া কেউ যেতে পারবে না।’
‘গাড়ির কাছে তুমিও যেতে পারবে না?’
‘তা হয়তো পারব। এখানে আমার অনেক বন্ধু আছে।’
‘গুড,’ বলল পিকেরিং। ‘শোনো আমরা কি করব। আরোহী হিসেবে একজন লোককে পাঠাচ্ছি। সে তোমাকে একটা প্যাকেট দেবে।
‘প্যাকেট?’
‘একটা টাইম মেকানিজম,’ পিকেরিং বলল। ‘আর যথেষ্ট প্লাস্টিক। বিস্ফোরণে গাড়ির দরজাগুলো খুলে যাবে।’
.
রমিউলাসের পাইলট রেডিও খুলল। ‘নিউআর্ক অ্যাপ্রোচ কনট্রোল, দিস ইজ চ্যারিয়টিয়ার সেভেন। ডু ইউ রিড মি?’
সাথে সাথে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। তারপর শোনা গেল দ্রুতগতি শব্দজট। সব শেষে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর। ‘দিস ইজ নিউআর্ক। রিড ইউ, চ্যারিয়টিয়ার। হাউ ইজ দা ওয়েদার আপ দেয়ার?’
‘চপি। হেভী ক্লাউডস। নাথিং উই ক্যান-নট হ্যাণ্ডল অন ইনসট্রুমেন্টস।’
‘দা উইণ্ড ইজ আউট অভ দা নর্থ ইস্ট অ্যাট টোয়েনটি সিক্স নটস অ্যাণ্ড গাস্টিং। ডু ইউ হ্যাভ এনি ডাউট অ্যাবাউট ল্যাণ্ডিং?’
‘নান্,’ শান্তভাবে উত্তর দিল পাইলট। তারপর সে আনুষ্ঠানিক ভাবে অনুরোধ করল, ‘চ্যারিয়টিয়ার সেভেন রিকোয়েস্টিং ফাইনাল অ্যাপ্রোচ টু নিউআর্ক অন ইনস্ট্রুমেন্টস।’
আবার সাড়া পেতে বেশ একটু দেরি হলো। ‘রাইট, চ্যারিয়টিয়ার। টার্ন লেফট থ্রী জিরো সিক্স।’
‘লেফট থারটি সিক্স,’ বলল পাইলট।
‘উই আর হ্যাণ্ডিং ইউ অফ টু দা টাওয়ার নাউ।’
‘রজার, অ্যাপ্রোচ কনট্রোল। দিস ইজ চ্যারিয়টিয়ার সেভেন, আউট।’
পাইলট মাথা ঝাঁকিয়ে শেষ বারের মত ল্যাণ্ডিং সিস্টেম আর ব্রেক চেক করার নির্দেশ দিল কো-পাইলটকে। তারপর থ্রটল ঘুরিয়ে 306 ডিগ্রী বাঁক নিতে শুরু করল।
টাওয়ারে দাঁড়িয়ে রাডার স্কোপের খুদে আলোক বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে আছেন জেফ রিকার্ড, বিন্দুটা ধীরে ধীরে ডান দিকে সরে যাচ্ছে।
‘নিউআর্ক টাওয়ার, দিস ইজ চ্যারিয়টিয়ার সেভেন। উই জাস্ট টার্ন অন ফাইনাল।’
হেডসেট পরা রাডার স্কোপের সামনে বসা লোকটা মুখ তুলে জেফ রিকার্ডের দিকে তাকাল। তারপর মাউথ পীসে বলল, ‘উই আর চার্টিং ইউ, চ্যারিয়টিয়ার। রাইট হেডিং টু-জিরো। ইউ আর ক্লিয়ারড ফর রানওয়ে ফোর-ই।’
‘রাইট, নিউআর্ক। ডিসেনডিং টু ওয়ান থাউজ্যাণ্ড ফিট।’ হেডসেট পরা অপারেটর সি.আই.এ. চীফের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল, কিন্তু কোন মন্তব্য করল না।
‘ব্রেক সিস্টেম?’ কো-পাইলটকে জিজ্ঞেস করল পাইলট।
‘ওকে।’ উত্তর এল।
‘ল্যাণ্ডিং গিয়ার?’
‘ইন প্লেস অ্যাণ্ড লকড্।’
নিস্তব্ধতা নেমে এল। তারপর আবার শোনা গেল পাইলটের গলা, ‘উই আর অ্যাট টু থাউজ্যাণ্ড ফিট, নিউআর্ক।’
‘অ্যাণ্ড ক্লিয়ারড ফর ফাইনাল অ্যাপ্রোচ,’ বলল অপারেটর। ‘ব্রিং হার অন ডাউন।
‘রজার।’
.
প্রায় ছুটতে ছুটতে একটা প্রাইভেট এলিভেটরে ঢুকলেন জেফ রিকার্ড, সাথে উইলি কিপার। নিচেরতলায় নেমে এসে দেখলেন, ওঁদের জন্যে একটা ব্যাগেজ ট্রাক অপেক্ষা করছে। গিয়ার দিল ড্রাইভার, কিপারের পিছু পিছু লাফ দিয়ে ট্রাকের পিছনে উঠে পড়লেন জেফ রিকার্ড। ফোর-ই রানওয়ের দিকে ছুটল ট্রাক।
চশমা থেকে বৃষ্টির পানি মুছলেন জেফ রিকার্ড। উত্তেজনায় উল্লাসিত হয়ে আছে তাঁর চেহারা। তালু ঘামছে। পাঁজরের গায়ে দ্রিম দ্রিম বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। ফিল্ডের দিকে চোখ পড়তে দেখলেন, সৈনিকরা চারদিকে পজিশন নিয়েছে। নিউআর্ক এয়ারপোর্ট থেকে পিঁপড়ে গলে বেরোবার উপায় নেই।
রানা তাহলে ধরা পড়ল। আর মাত্র কয়েক মিনিট, তারপরই টিউলিপ কনওয়েকে ফিরে পাবেন তিনি।
দেখার আগেই প্লেনের আওয়াজ পেলেন তিনি। তারপর নিচু স্তরের মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল জেটটা। দ্রুত, সাবলীল ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে। সরাসরি রানওয়ের দিকে।
‘এসো রানা,’ বিড়বিড় করে বললেন জেফ রিকার্ড
শুনতে পেয়ে হেসে উঠল উইলি কিপার।
তারপরই থেমে গেল হাসি, কেউ যেন তার গলা টিপে ধরেছে। চোয়াল ঝুলে পড়ল, বিস্ফারিত হলো চোখ। জেফ রিকার্ডেরও একই অবস্থা। বুকের ভেতর লাফ দিয়ে উঠল হৃৎপিণ্ড। আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।
বড় বেশি দ্রুতবেগে খসে পড়ছে প্লেন। রানওয়ের দিকে নয়, পেভমেন্টের দিকে ধেয়ে আসছে।
উইলি কিপারের বিকট চিৎকার শুনতে পেলেন জেফ রিকার্ড, ‘বাতাসের ধাক্কা!’
দমকা বাতাস। ঝড়ের স্বাভাবিক গতির চেয়ে অনেক বেশি গতি, অনেক বেশি শক্তিশালী-এই অবস্থায় পড়ে বহু প্লেন ডিগবাজি খেয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে।
প্লেন ওপরে তোলার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করল পাইলট, কিন্তু রানওয়ের বড় বেশি কাছাকাছি নেমে এসেছে আগেই। পোর্ট সাইডে কাত হয়ে রয়েছে জেট। ডান দিকের ডানা তুলতে গিয়ে অনেক বেশি তুলে ফেলল, সেই সাথে অনেক বেশি নিচের দিকে নেমে গেল বাঁ দিকের ডানা। উঁচু আকাশে ফিরে যাবার চেষ্টা বাদ দিল পাইলট, প্লেনটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল এবার।
হঠাৎ একটা প্রশ্ন খচ্ করে বিঁধল জেফ রিকার্ডের মনে। রানা কি নিজেই প্লেন চালাচ্ছে? গোটা ব্যাপারটা কি তার চালাকি? ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালাবার পথ তৈরি করতে চায়?
পেভমেণ্ট স্পর্শ করল প্লেন। উঁচু হয়ে থাকল নাক। প্রথমে নামল চাকাগুলো। পেভমেন্ট ধরে ছুটল জেট, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল লক্ষ কোটি আগুনের ফুলকি। তারপর সমান হলো পেট।
জেফ রিকার্ডের মনে হলো, হৃৎস্পন্দন থেমে গেছে। চোখের সামনে দৃশ্যটা মিথ্যে বলে মনে করার চেষ্টা করলেন তিনি। সশস্ত্র সৈনিকরা প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক ছুটছে, আড়াল খুঁজছে তারা। পিছন থেকে ভেসে এল সাইরেনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ, প্লেনের দিকে রওনা হয়ে গেছে কয়েকটা ফায়ার ট্রাক। প্লেনের চাকা গড়াচ্ছে না, হড়কাচ্ছে। পেভমেন্টের কিনারা থেকে নামার সময় সিগন্যাল লাইট ভেঙে চুরমার করে দিল। তারপর কাদা আর ঘাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ, আর যেন এগোবার শক্তি নেই।
তুমুল বৃষ্টিতে নিভে গেল ফুলকিগুলো। আগুনের কোন বিস্ফোরণ ঘটল না। নিরাপদে নেমে এসেছে চ্যারিয়টিয়ার সেভেন।
চোখ বুজে সীটে হেলান দিলেন জেফ রিকার্ড। ভয় কেটে গিয়ে হঠাৎ পরম স্বস্তি বোধ করায় আশ্চর্য দুর্বল লাগল নিজেকে তাঁর। তারপর দ্রুত চোখ খুললেন, জোরে একবার ঝাড়া দিলেন মাথাটা। হ্যাচ খুলে গেছে, প্লেনের দরজায় পাইলটকে দেখা গেল। প্লেনের পেটে সিঁড়ি লাগানো হলো।
ট্রাক থেকে লাফ দিয়ে নামলেন জেফ রিকার্ড, ছুটলেন প্লেনের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে মোলাঞ্জা রমিউলাস। চোঙ আকৃতির মুখে কোন রক্ত নেই। চোখ দুটো বিস্ফারিত, বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার পিছু পিছু এল কালো স্যুট পরা এক লোক, তার পিছনে আরেকজন।
চোখ সরু করে তাকালেন জেফ রিকার্ড। খোলা দরজায় কালো আলখাল্লা পরা এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। একজন প্রিস্ট। দু’জনের চোখ এক হলো, কিন্তু ভাবের কোন আদান-প্রদান হলো না। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে লাগল প্রিস্টও।
ইস্টার্ন জেট রানওয়েতে থামল, ঘাড় ফিরিয়ে সীট-মেটের দিকে তাকাল গিয়াকোমো অগাস্টিন। ‘অত্যন্ত খুশি হলাম আপনার সাথে আলাপ করে,’ বলল সে।
‘মাই প্লেজার,’ অপর লোকটা নিঃশব্দে হাসল। ‘স্বীকার করা উচিত, এর আগে কোন প্রফেশনাল গলফার-এর সাথে আমার পরিচয় হয়নি। পি.জি.এ. প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ান হোন, এই প্ৰাৰ্থনা।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ।
সীট ছেড়ে উঠল গিয়াকোমো অগাস্টিন, প্লেন থেকে নামার জন্যে আরোহীদের সাথে লাইন দিল। কয়েক সেকেণ্ড পরই খুলে গেল দরজা, এক এক করে নামতে শুরু করল আরোহীরা।
একজন স্টুয়ার্ডেস আগেই তার গলফ ব্যাগটা বের করেছে। বড়সড় প্রফেশনাল মডেল। ফার্স্ট আর ট্যুরিস্ট ক্লাস কেবিনের মাঝখানে ক্লজিটের ভেতর ছিল ওটা। গিয়াকোমো অগাস্টিনকে এগিয়ে আসতে দেখে হাসল মেয়েটা। বলল, ‘আমার ধারণা, গলফ ব্যাগটাকে আপনি কখনও ব্যাগেজ হিসেবে লেখান না।
‘নো, ম্যা’ম,’ ভুবন ভোলানো হাসি দেখা গেল সুদর্শন গিয়াকোমো অগাস্টিনের মুখে। ‘এই ক্লাবগুলো আমার জীবন আর শরীরের অঙ্গ।’
বাইরে রোদ ঝলমলে প্রকৃতি। মৃদু বাতাসে পাম গাছের পাতা ঝিরঝির আওয়াজ করছে। মিয়ামি। তাপমাত্রা আশি ডিগ্রী।
গভীর করে শ্বাস টানল রানা। পিঠে গলফ ব্যাগ ঝুলিয়ে সামনে এগোল ও। সুপুরুষ, সপ্রতিভ, নিশ্চিন্ত। নিউআর্ক এয়ারপোর্টে যে প্রিস্টকে দেখা গেছে সে ছিল মোলাঞ্জা রমিউলাসের আরেকজন চাকর। ওই প্লেনের ধারে কাছে কখনও যায়নি রানা। যায়নি টিউলিপ কনওয়েও।