অপহরণ

অপহরণ

মাত্র কয়েকদিন আগে উমাপ্রসাদ দত্ত-র মৃত্যুসংবাদ খবরের কাগজে ছাপা হয়ে বেরিয়েছে। তিনি কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি নন; তাঁর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। আমি যতদূর জানি, সামাজিক প্রতিষ্ঠাও উমাপ্রসাদের কিছু নেই। তবু খবরের কাগজে তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছাপা হবার কারণ, অস্বাভাবিক এক অবস্থার মধ্যে ওঁর মৃত্যু। উমাপ্রসাদ রাত্রের ট্রেনে হাজারিবাগ রোড স্টেশন থেকে গয়া যাচ্ছিলেন। জায়গার অসুবিধের জন্যে তিনি তাঁর টিকিট বদলে নেন। ফার্স্ট ক্লাস কামরায় তাঁর সহযাত্রী ছিল এক অবাঙালি দম্পতি। কোডারমা স্টেশনের কাছে চেন-টানা গাড়ি থামলে উমাপ্রসাদের কামরার সেই অবাঙালি ভদ্রলোকের ভীত, সন্ত্রস্ত, প্রায়-উন্মত্ত চেহারা এবং তাঁর চেঁচামেচি ও কান্নাকাটিতে রেলের লোকজন ও পুলিশ কামরায় ঢুকে দেখে—উমাপ্রসাদ নিহত, অবাঙালি মহিলাটি সামান্য আহত ও মূর্ছিত অবস্থায় পড়ে আছেন। —খবরের কাগজে এই মৃত্যুটিকে ‘শোচনীয় ও নৃশংস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সঙ্গত কারেণই যে তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য, উমাপ্রসাদ যদি এই ধরনের অস্বাভাবিক অবস্থায় মারা না যেতেন খবরের কাগজে তাঁর উল্লেখ থাকত না। প্রকাশিত সংবাদের বিবরণে বলা হয়েছে, অর্থ ও অলঙ্কারের লোভে জনৈক দুর্বৃত্ত কামরায় প্রবেশ করেছিল। যখন সে কামরার মহিলাটিকে আক্রমণ করে, তখন মহিলার স্বামী ভয়ে দিশেহারা হয়ে নিজেদের প্রাণভিক্ষা করছিলেন; তিনি স্ত্রীর অলঙ্কার ও অর্থ দুর্বৃত্তের হাতে তুলে দিতেও চেয়েছিলেন; উমাপ্রসাদ কিন্তু আততায়ীকে বাধা দিতে যান; এবং আহত হন। ভদ্রলোকের জবানবন্দী অনুসারে আততায়ী কোডারমা স্টেশনে গাড়ি পৌঁছবার আগেই পালিয়ে গেছে।

কাগজে সম্পূর্ণ ঘটনাটির রোমহর্ষক বিবরণ ও নৃশংসতার পরিচয় যত্ন করে তুলে ধরা হয়েছে; উমাপ্রসাদের দুঃসাহসের উল্লেখ তেমন কোনো যত্ন অবশ্য আমি খুঁজে পাইনি। এর জন্যে কাগজকে দোষারোপ করি না, কেননা নিশীথরাত্রে চলন্ত ট্রেনে ভয়ংকর রাহাজানি, খুন, মূৰ্ছিত মহিলা ইত্যাদি একটা ঘটনা, উমাপ্রসাদ ব্যক্তিগতভাবে কোনো ঘটনা নন, ঘটনার নিমিত্তমাত্র।

উমাপ্রসাদকে আমি চিনতাম, তাঁর ব্যক্তিগত রূপটিও আমার পরিচিত। তিনি সম্পর্কে আমার আত্মীয়। গত বছর পুজোর সময় আমি তাঁকে শেষ দেখেছি। আমার ধারণা, উমাপ্রসাদ এই মৃত্যুর দ্বারা তাঁর নিজের এবং তাঁর আঁকা ছবিগুলো কিছুটা সম্পূর্ণ করেছেন। সম্ভবত এবার যদি ছুটিতে হাজারিবাগে যাই, উমামামার ছবি আঁকার ঘরে ঢুকে আমি তাঁর শেষ বয়সের আঁকা ‘অপহরণ’ সিরিজের ছবিগুলিতে এই সম্পূর্ণতা অনুভব করতে পারব।

উমামামা ছবি আঁকতেন। ছবি আঁকিয়েদের লোকে শিল্পী বলে। উমামামাকে শিল্পী বলতে আমার কুণ্ঠা হয়। তিনি নিজেও কখনো বলতেন না, তিনি শিল্পী; বলতেন: চুপচাপ বসে থাকি সারাদিন, ওই একটা শখ, ছবি আঁকার চেষ্টা করি। উমাপ্রসাদ যদি শিল্পী হতেন, বাংলা দেশের মতন শিল্পীর দেশে লোকে তাঁর নাম শুনত বই কি! আমি প্রায় নিঃসন্দেহ, উমাপ্রসাদের নাম আজ পঞ্চাশ বছরের মধ্যে কেউ কোথাও শোনেনি; ঘরেও নয়, বাইরেও নয়। কাগজে উমাপ্রসাদের যে মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়েছে—তার কোথাও আপনারা উমামামার শিল্পী-পরিচয় পাবেন না।

উমামামার সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক ছিল, যোগাযোগ ছিল না। উনি আমার মা’র দূর সম্পর্কের ভাই। বছর পাঁচেক আগে আমরা একবার সপরিবারে শীতের সময় হাজারিবাগে বেড়াতে যাই। মা শুনেছিলেন, এখানে তাঁর এক আত্মীয় বহুকাল ধরে আছেন। খোঁজ-খবর করতে উমামামাকে আবিষ্কার করা গেল।

পাঁচ বছর আগে উমামামাকে যখন প্রথম দেখি, তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। মাথায় বেশ লম্বা, ছিপছিপে শক্ত চেহারা। তাঁর শারীরিক গড়নের মধ্যে পুরুষোচিত দীর্ঘতা ও সবলতার ভাব ছিল। গায়ের রঙটি ছিল কালো। মুখের ছবিটি মনে রাখার মতন: লম্বা ছাঁদের মুখ, শক্ত চোয়াল, দীর্ঘ উঁচু নাক, সরু পাতলা চিবুক চোখ দুটি তেমন উজ্জ্বল ছিল না, মোটা কাচের চশমার আড়ালে তাঁর দৃষ্টি সব সময়ই কেমন দুর্বল দেখাত। উনি চোখের অসুখে কিছুকাল যাবৎ ভুগছিলেন। উমামামার মাথার চুলগুলি আর কালো ছিল না, সাদা হয়ে গিয়েছিল। তাঁর ঠোঁট সবসময় ফাঁক হয়ে থাকত, এবং লক্ষ করলে বোঝা যেত তাঁর মুখের মধ্যে কিছু আছে। তিনি মুখের মধ্যে হরিতকীর কুচি রাখতেন।

কথাবার্তায় উমামামা সদালাপী, একটু জোরে জোরে কথা বলতেন এই যা, গলার স্বরটি ছিল ভরাট। দোষের মধ্যে, উনি এক সময় হয়তো অনর্গল কথা বলে গেলেন কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ একেবারে চুপ করে গেলেন। কিছুতেই আর মুখে একটি কথা ফুটনো যেত না। আমরা প্রথম প্রথম ভাবতাম, কোনো কারণে তিনি ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, স্বভাবতই আমরা অস্বস্তি বোধ করতাম পরে বুঝতে পারলাম, এইটেই ওঁর স্বভাব। হয়তো হাঁপানির অসুখের জন্যে খানিকক্ষণ একটানা কথা বলার পর তিনি ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে ওঠেন। কিংবা সাবধান হবার কথা মনে পড়ে যায়।

উমামামার বাড়িটা ছিল একেবারে একপ্রান্তে, তারপর আর লোকালয় ছিল না। বাড়ির পরই জঙ্গলের ঢালু জমি, একটা খালের মতন নদী, নদীর ওপর রেলের সাঁকো। ওঁদের বাড়িটা অনেককালের পুরনো, ভাঙা পাঁচিলে ঘেরা মস্ত চৌহদ্দি, অসংখ্য গাছপালা; প্রায় যেন জঙ্গল। বাড়িতে উমামামার আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ ছিল না। বাড়ির একপাশে দু-তিনটি দেহাতি স্কুল-পড়ুয়া ছেলে থাকত; কুয়াতলার দিকে তারের ভাঙা জালের মধ্যে কিছু বুনো পাখি খুশিমতন আসত যেত, এক সময় ওখানে তিনি ময়ূর থাকার ঘর করেছিলেন। কয়েকটি দিশি কুকুর সপরিবারে উমামামার বাড়িতে বসবাস করত।

বাড়িটা দেখে প্রথম দিন আমার তেমন ভাল লাগেনি। হাওয়া-বদলের শহরে ছিমছাম, সুন্দর, সুদৃশ্য বাড়ি কিছু কম ছিল না; সে-সবের তুলনায় উমামামার সেই শুকনো লেবুর মতন রঙ-ধরা জীর্ন বাড়ি, চতুর্দিকে গাছপালার অরণ্য, কুকুর বেড়ালের সর্বত্র বিচরণ আমার দৃষ্টিকটু লেগেছিল।

পরিচয়ের পর উমামামাকে আমার বড় পছন্দ হয়েছিল। মা’র কথা বলতেই সামান্য সময় যেন পুরনো স্মৃতি হাতড়ালেন, তারপরই চিনে ফেললেন; “রমার ছেলে তুমি!…আরে, আরে, তাহলে তো তুমি আমার ভাগ্নে। এসো, চলে এসো।…রমা এখানে এসেছে! আমায় একটা চিঠি দিল না কেন?…কোন বাড়ি নিয়েছ? ‘শুকতারা’? না বাড়িটা ভালই; তবে অযথা ভাড়া নিলে। আমার এখানে উঠলে তোমাদের অসুবিধে হত না। ক’জন তোমরা?”

ঘরে এনে বসিয়ে উমামামা চাকরটিকে হাঁক দিলেন, “চা তৈরি কর; বাবুকে আণ্ডা তৈরি করে দে।”

তারপর উমামামা পুরননা প্রসঙ্গে চলে এলেন। “নাইনটিন নাইনে অক্টোবরে আমার জন্ম, আর রমার—মানে তোমার মা’র—নো—সে জন্মেছিল নাইনটিন নাইনের ডিসেম্বরে। তিন মাসের ছোট-বড়। সাত-আট বছর বয়স পর্যন্ত আমরা ধরো একই বাড়িতে মানুষ। তারপর বাবা মুন্সেফ হয়ে নর্থ বেঙ্গলে চলে গেলেন, আমরাও চললাম।”

উমামামার ভরাট গলায় যতখানি আত্মীয়তা ও অন্তরঙ্গতা ছিল ঠিক ততখানি স্নেহ। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা উমামামার ভক্ত হয়ে উঠলাম।

মা উমামামাকে নাম ধরে ডাকত, উমামামা মাকে বলত, বুড়ি। মা’র ওটাই ডাক-নাম। আমার বাবা করপোরেশনের চাকুরে ছিলেন; মারা গেছেন কয়েক বছর আগে, মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়ে গিয়েছিলেন বরানগরে। উমামামা মাকে বলতেন, “বুড়ি, এখানে থাক না ক’টা মাস। তোর তো সব সাবালক ছেলেমেয়ে।” মা বলতেন, “তোমার জঙ্গলে আমার মন টিকবে কেন। এখন ক’টা লোক আছে, এরা চলে গেলে শুনেছি সব ফাঁকা। আর তোমার বাড়ি তো ভূতের বাড়ি করে রেখেছ।”…কথা শুনে উমামামা জোরে জোরে হাসতেন।

শীত কাটিয়ে ফেরার কথা, বউদির অসুখের জন্যে সেবারে আমাদের মাসখানেক পরেই ফিরতে হল।

উমামামা আমায় বললেন, “তোর তো কলেজের চাকরি চঞ্চল, তাও ছাত্র পড়াস না, ল্যাবরেটরি গুছোস। থেকে যা এই জানুয়ারি মাসটা।”

বললাম, “এবারে না মামা, পরে আবার আসব।”

“মিথ্যে কথা বলছিস কেন?…তোরা কলকাতা শহরের আজকালকার ছেলে, এই ঝোপজঙ্গল গাছপালা অন্ধকার তোদের ভাল লাগে না। তুই কি আর সহজে আসবি, চঞ্চল!”

“আমি প্রমিস করছি আসব।”

“কেন আসবি?”

কেন আসব সেকথা আমি বলতে পারিনি, অনুভব করেছিলাম শুধু। উমামামার মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতেও আমার লজ্জা হচ্ছিল। মুখ ফিরিয়ে অনেকক্ষণ পরে শুধু বললাম, “তোমার এই জায়গাটা বেশ। আমার ভাল লাগে খুব।”

উমামামা আমার মুখ দেখছিলেন। এক সময় বললেন, “আচ্ছা, দেখা যাক…”

তারপর গত পাঁচ বছরে আমি বার তিনেক উমামামার কাছে গিয়েছি। তাঁর কাছেই উঠতাম। কখনো পুজার আগে, কখনো পূজার পর ওঁর কাছে গিয়ে হাজির হতাম, পনেরো-বিশ দিন থাকতাম, ফিরে আসার আগে পায়ের ধুলো নিতে গেলেই উমামামা বেশ বিচলিত হয়ে উঠতেন।

“আবার সেই আসছে বছর—।”

“দেখি, শীতের সময় যদি পারি!”

“শীত ভাল; তবে একবার বর্ষার সময় আয় এমন বর্ষা চোখে দেখিসনি তুই। একেবারে কালিদাসের সেই ‘পাণ্ডুচ্ছায়োপবনবৃতয়ঃ কেতকৈঃ’…।”

“আমি সংস্কৃত জানি না, মামা।” হেসে বলি।

“আচ্ছা, আচ্ছা, বাংলা কালিদাসই পড়ে শোনাব তোকে। …ওই নে ঘন্টি পড়ল তোর গাড়ির।”

প্লাটফর্মে যাত্রীদের চাঞ্চল্য লক্ষ করতে করতে বললাম, “মামা, এবারে এসে তোমার ছবি শেষ হয়েছে দেখব তো?”

উমামামা আমার দিকে দু-মুহূর্ত তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

বললাম, “কতবার আর এই জিনিস আঁকবে!…একদিন তো শেষ করতে হবে তোমায়।”

উমামামা অস্পষ্ট করে অন্যমনস্কতার মধ্যে শব্দ করলেন।

এরপর গত পূজায় ওঁর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ। উমামামা চিঠি লিখতে অনভ্যস্ত ছিলেন। কদাচিৎ আমার চিঠির জবাব দিতেন। তাঁর শেষ চিঠি পেয়েছিলাম গত এপ্রিল মাসে। আজ আগস্ট মাসে তিনি আর ইহলোকে নেই।

উমামামার মৃত্যুসংবাদ শুনে মা মর্মাহত হয়ে বলল, “নিয়তি। মরণ টানছিল। নয়তো যাবার কথা সেকেন্ড ক্লাসে, টিকিট বদলে অন্য কামরায় আসে!”

দাদা বলল, “কোনো মানে হয় না। বুড়ো মানুষ, কি দরকার ছিল তাঁর এগিয়ে যাবার। যাদের যাচ্ছিল তারা তো প্রাণের মায়া করে সব দিতেই যাচ্ছিল—ওঁর এইরকম হঠকারিতা করতে যাওয়া কেন!”

ছোট বোন মায়া বলল, “দেখ আবার, যে লোকটা সাধু সাজছে তারই কোনো হাত আছে কিনা। অচেনা মানুষ সম্বন্ধে কিছু বলা যায় না, বাবা।”

মা যা বলেছে: নিয়তি; দাদা যা বলেছে: বুড়ো মানুষের হঠকারিতা; এবং মায়ার যা ধারণা—আমি তার কোনোটাকেই অস্বীকার করতে চাই না, আবার স্বীকার করতেও রাজি না।

উমামামার এই মৃত্যু আমার কানে কানে যেন বলছে: “চঞ্চল, আমি আমার ছবি শেষ করেছি।”

উমামামার চরিত্রের যেদিকটা সামাজিক এবং পারিবারিক, আত্মীয়-স্বজনের মত তার আভাস আমি দিয়েছি, কিন্তু তাঁর জীবনের অন্য কোনো কথা আমি বলিনি। আমার সঙ্গে তাঁর এমন একটি ঘনিষ্ঠতা হয়ে এসেছিল, যা ঠিক পারিবারিক আত্মীয়তার নয়, অন্য কিছুর। স্পষ্ট করে এই সম্পর্কের কথা বোঝানো আমার সাধ্য নয়। খুব গোপনে, কখনো কোনো হতাশায়, কখনো আবেগবশত, চেতনায় এবং অবচেতনে আমি যা অন্বেষণ করি, উমামামা আমায় তার ইঙ্গিত দিতে পারতেন। তাঁর এবং আমার মধ্যে অনুভবের একটি যোগসূত্র রচিত হয়েছিল, হয়ত বা আত্মিক এবং আন্তরিক। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম বস্তুত এই কারণে; উমামামার প্রতি আমার আকর্ষণ ও মমতার হেতুও তাই। তিনিও আমার কাছে তাঁর মন অনেকখানি খুলে দিতে পেরেছিলেন, অনেক অনুভবের কথা বলতে চেষ্টা করতেন। আমার প্রতি তাঁর স্নেহ প্রায় সখ্যের রূপ নিয়েছিল, বন্ধুর মতন আমরা অনেক সময় কথাবার্তা বলতাম, তিনি কখনো কখনো বয়সের পার্থক্য ভুলে গিয়ে আমায় তাঁর সমবয়স্ক করে তুলতেন।

উমামামার একটি জীবন ছিল, যাকে আমরা বাস্তবের জীবন বলি। মা’র কাছে কিছু, খানিক বা উমামামার মুখে আমি সেই জীবনের কথা শুনেছি।

উমামামার বাবা ছিলেন সেকেলে মুন্সেফ, পরে সাবজজ হয়েছিলেন। রাসভারী, কড়া মেজাজের মানুষ। উনি পরিবারের মেজ ছেলে; বড় ছেলে ছিল প্রায় বাবার মতন। উমামামার মা ছিলেন শান্তশিষ্ট ধর্মভীরু প্রকৃতির। উমামামার বাবাকে চাকরিতে প্রায়ই বদলি হতে হত। ছেলেদের শিক্ষার ব্যাপারে সেটা নিতান্ত ব্যাঘাত মনে হওয়ায় তিনি উভয় ছেলেকেই স্থায়ীভাবে রাজসাহীতে রেখে দেন, মামার বাড়িতে। যথাসময়ে উমামামা কলকাতায় কলেজে পড়তে এসে স্বদেশী হুজুগে মেতে কলেজ ছেড়ে দেন। তারপর হুজুগ কাটলে বেনারসে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। যে বছর তিনি পাস করলেন, সে বছর দাদার মৃত্যু ঘটল। শোকাহত জনক-জননী সান্ত্বনার আশায় গয়া কাশী হরিদ্বার করে বেড়ালেন, মন প্রবোধ মানল না। শেষে লোকালয়বর্জিত এই হাজারিবাগ জায়গাটিতে কেমন করে মন পড়ে গেল। উমামামার বাবা জায়গা-জমি কিনে বসবাস শুরু করলেন এখানে। জপতপে মন দিলেন মা। বাবাও শেষ বয়সে ধর্মের দিকে ঝুঁকেছিলেন।

উমামামা কিছুকাল চাকরিবাকরি করার চেষ্টা করেছেন, কোথাও মন বসাতে পারেননি। বাবার মৃত্যুর পর এখানেই স্থায়ীভাবে থেকে গেলেন; বাবার গচ্ছিত অর্থ ও এখানে জমিজমাতে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা ভালই ছিল। জঙ্গলের দেশ ছেড়ে তিনি আর নড়লেন না।

তারপর মা মারা গেলেন।

কৌতূহলবশত আমি আমার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “উমামামা বিয়ে করেননি?”

আমার মা উমামামার বাল্যকালের কথা ছাড়া আর কিছু প্রায় জানতেন না, সুতরাং বিয়ের কথাটাও তাঁর জানার কথা নয়। আত্মীয়স্বজনের মুখে শোনা কথা যা জেনেছিলেন, তাতে বিবাহ প্রসঙ্গ ছিল না। ফলে তিনি উমামামাকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি বরাবর বাউন্ডুলে হয়ে থাকলে! বিয়ে-থা করলে না কেন?”

জবাব উমামামা হেসে বলেছিলেন, “করেছিলাম, কপালে টিকল না।”

আমরা ধরে নিয়েছিলাম, উমামামার স্ত্রীও মৃত।

পরে আমার সঙ্গে উমামামার সম্পর্ক গভীর হলে আমি অন্য কিছুও জানতে পারি।

উমামামার সাধারণ পরিচয় শেষ হল। এবার তাঁর অন্য পরিচয়।

উমামামার সেই শুকনো লেবুর মন রঙ-ধরা বাড়ি, সেই প্রাচীনতা ও জীর্ণতা, গাছপালার জঙ্গল এবং কুকুর বেড়ালের আবাসস্থলাটি আমার প্রথম দিন ভাল না লাগলেও প্রথম পরিচয়ের পর তিনি যখন আমায় সেই বিরাট চৌহদ্দির পিছন দিকের একটি জায়গায় নিয়ে গেলেন, আমি যেন অরণ্যের মধ্যে একটি নির্জন স্তব্ধ পরিচ্ছন্ন দেবমন্দির দেখে বিস্মিত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম।

কদমগাছের আড়ালে একটি ‘কটেজ’ মতন, সামনে সবুজ ঘাসের প্রাঙ্গণ, চারপাশে তারের জাল দেওয়া বেড়া বেয়ে দেশি লতার ফুল ফুটে আছে, ছোট ছোট সবুজ পাতার রাশ! মাধবীলতার গুচ্ছ দুলছে শীর্ষে। একদিকে কয়েকটি গোলাপ চারা, অন্যদিকে একজোড়া শিউলি গাছ। কাঠের ছোট্ট ফটক খুলে পা বাড়ালে সিঁড়ি, সিঁড়ির গায়ে অপরাজিতার ঝোপ।

সিঁড়ি উঠে সরু বারান্দা, বারান্দার ওপর উমামামার খরগোশ-থাকা বাক্স, গাছের ডাল কেটে-একটা পাখি-বসা দাঁড়, একপাশে জলচৌকির ওপর মাটির এক শিবমূর্তি। একটা ডেক-চেয়ার পাতা ছিল বারান্দায়।

বারান্দার বাঁ দিক ঘেঁষে একটা ঘর, পিছনে আরও একটা; পিছনের ফালি মতন বারান্দার সঙ্গে এক চিলতে জায়গা মাটির দেওয়াল দিয়ে ঘেরা।

বাড়িটার গাঁথুনি ইটের, মাথার ওপর খাপরার ছাউনি, তলায় চুনকাম করা চটের সিলিং।

দু’টি ঘরের একটিতে বসে উমামামা ছবি আঁকার কাজ করেন, খুব খোলামেলা; অন্য ঘরটিতে কিছু ছবি, কিছু পুরনো বইপত্র, মাটি এবং কাঠের কিছু শিল্পকর্ম, তামার নৃসিংহমূর্তি, পেতলের মস্ত এক প্রদীপ পড়ে আছে, আর একপাশে সরু মতন একটি তক্তপোশ, বিছানা-পাতা।

উমামামার দ্বিতীয় পরিচয়টুকু জেনে আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, “আপনার স্টুডিয়ো?”

উনি বললেন, “না, আমি এখানে বসে একটু কাজকর্ম করার চেষ্টা করি, বিশ্রাম নিই।”

“আপনি আর্টিস্ট?”

“কে বলল! আমি শখ করে মাঝে মাঝে ছবি আঁকার চেষ্টা করি। এসব কিছু না। চলো, তোমায় আমার বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং দেখাই।”

উমামামা আমার কথাটা গায়ে মাখলেন না।

প্রাথমিক এই পরিচয় ক’দিনেই কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। মানুষটি আমায় কৌতূহলী ও আকৃষ্ট করে তুলেছিলেন; আচার, আচরণ, স্বভাব, এমনকি তাঁর জীবনযাপনও আমার কাছে অন্য রকম লাগত। উনি যে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন তা সহজেই বোঝা যেত, কিন্তু এই নিঃসঙ্গতার মধ্যে যে তিনি কাতর অথবা পীড়িত হচ্ছেন তা অনুমান করা যেত না। বরং আমার মনে হত, উমামামা নির্জনে এক ধরনের সাত্ত্বিক জীবনযাপন করেছেন যেন। তিনি নিরামিষাশী ছিলেন, বাড়িতে অনেকগুলি মুরগি দেখে আমি তাঁকে আমিষভোজী ভেবেছিলাম; আসলে মুরগিগুলি তাঁর গৃহে আপন স্বভাবে বিচরণ করত এবং উমামামার চাকর ও দেহাতি ছাত্রগুলি তাতে লাভবান হত। ওঁর কোনো রকম নেশাও ছিল না, চা অবশ্য খেতেন, সিগারেট পান ইত্যাদি খেতে দেখেনি। আমি তাঁকে কখনো পূজাটুজা করতে দেখতাম না। কিন্তু তিনি যে ধর্মগ্রন্থাদি পাঠ করতেন তা আমি দেখেছি, শুনেছি। উমামামার পুরনো বইয়ের মধ্যে মার্কণ্ডেয় চণ্ডীও ছিল। তবে, আমার ধারণা, উমামামা রামায়ণের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। আমার সঙ্গে যখন তাঁর পরিচয় হয় তখন তিনি রামায়ণ থেকে একটি বিষয় বেছে নিয়ে কয়েকটি ছবি আঁকার কাজে হাত দিয়েছেন। বিষয়টি সীতাহরণের। তিনি আমায় নাম দিতে বলায় আমি ছবিগুলির নাম দিয়েছিলাম ‘অপহরণ’ সিরিজ।

ছবি দেখায় আমি অভ্যস্ত নই। উমামামার ছবি অন্যের চোখে কেমন মনে হবে তা আমি জানি না, জানার ইচ্ছাও নেই। হয়ত উমামামা খুবই নিপুণ ও দক্ষ হাতে কাজ করতে পারতেন, হয়ত বা তাঁর হাত ভাল ছিল না, রঙের জ্ঞান ছিল না, অন্যান্য শিক্ষাও ছিল না। তাঁর আঁকা ছবির শিল্পমূল্য সম্পর্কে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি একটি বিষয়ে মাত্র নিঃসন্দিগ্ধ, উমামামার ছবি তাঁর আত্মানুসন্ধান।

উমামামার জীবনে কতকগুলি প্রশ্ন ছিল। আমার সঙ্গে তাঁর পাঁচ বছরের ঘনিষ্ঠতায় আমি ওঁর কয়েকটি প্রশ্ন জেনেছি।

ওঁর সমস্ত প্রশ্নের মূল হয়ে শেষাবধি একটি প্রশ্নই দেখা দিয়েছিল—মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য ও পরিণতি কী?

উমামামা শেষের দিকে রামায়ণের সীতাহরণ অবলম্বন করে যে কয়েকটি ছবি আঁকার কাজে হাত দিয়েছিলেন তার মধ্যে এই প্রশ্নটি ছিল।

তিনি পর পর এই ক’টি ছবি এঁকেছিলেন: পর্ণশালায় সজল নয়নে সীতা বসে আছেন। কুটির সংলগ্নে ছদ্মবেশী রাবণ: পরিধানে কাষায় বস্ত্র, মস্তকে শিখা, স্কন্ধে ষষ্টি ও কমণ্ডলু। দূরে গোদাবরী; চার পাশে বৃক্ষ। রাবণ সীতাকে লোভার্ত ও কামার্ত চোখে যেন স্তুতি করছে: বিশালং জঘনং পীনমূরু করিকরোপমৌ…ইত্যাদি। অর্থাৎ সীতার বিশাল ও স্থূল নিতম্ব, হাতির শুঁড়ের মতন ঊরুদ্বয়, বর্তুল,দৃঢ় পীনোন্নত স্তনযুগল—যা তাল ফলের মতন সুন্দর তা দেখে রাবণ বিমোহিত।

দ্বিতীয় ছবিটি, স্বমূর্তি প্রকাশ করে কুপিত রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। তার বিরাট দেহ, দশ মুখ, কুড়িটি হাত, নীল মেঘের ন্যায় বর্ণ, পরিধানে রক্তবাস।

তৃতীয় ছবিটি সীতাহরণের। রাবণ সীতার কেশ ধরে আকর্ষণ করে রয়ে উঠছে।

চতুর্থ ছবিটি জটায়ুর। বৃক্ষের ওপর বৃদ্ধ জটায়ু নিদ্রিত। সীতার বিলাপ তাঁর কানে আসছে।

পঞ্চম এবং শেষ ছবি: রাবণের সঙ্গে বৃদ্ধ জটায়ুর সংগ্রাম।

উমামামার সীতাহরণ সিরিজের ছবিগুলিতে আমি প্রথমে কোনো বিষয়বৈভব পাইনি। শতবার এই ছবি আঁকা হয়েছে। নতুন কিছু ছিল না।

একদিন উমামামাকে বললাম, “তুমি কি রবি বর্মা?”

উমামামা হেসে মাথা নাড়লেন। “না। কেন বলছিস বুঝতে পারছি।”

পরে একদিন তাঁকে বলেছি, “ওই এক ছবি আজ দু’বছর ধরে কী এত আঁকছ!”

“আঁকছি কোথায়, পারছি না।…”

“তাই দেখছি। তোমার একই ছবি বছরে বছরে পালটে যায়। সীতা খানিকটা পালটেছে। রাবণ আরও পালটে গেছে।”

“হ্যাঁ, যখন মনে হয় ঠিক হয়নি তখন আরও শুধরে নেবার চেষ্টা করি।”

“পারফেক্ট হবার চেষ্টা কর!”

“তা বলতে পারিস।”

“বেশি পারফেক্ট হবার চেষ্টা করার একটা বিপদ আছে মামা। একটা গল্প পড়েছিলাম, গল্পের সেই বিখ্যাত বুড়ো আর্টিস্টের অবস্থা হবে ।…সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।”

উমামামা বললেন, “সমস্ত সাধনাই এক সময় মানুষকে অন্ধ করে।…” বলে উমামামা চুপ করে গেলেন, অনেকক্ষণ পরে উদাসীন গলায় বললেন, হঠাৎ, “যাক গে, আমি তো আর্টিস্ট নই। আমার ভাবনাগুলোই বড় অসম্পূর্ণ।”

পরের বছর উমামামার সঙ্গে যখন দেখা হল, দেখলাম, তাঁর চারটে ছবি শেষ হয়েছে; শেষ ছবিটি নিয়েই তিনি বিব্রত ও অশান্ত হয়ে আছেন। রাবণের সঙ্গে জটায়ুর সংগ্রাম আবার নতুন করে আঁকছেন।

সেদিন কোজাগরী পূর্ণিমা। উমামামার সঙ্গে স্টেশনে ঘুরে বারোয়ারি তলায় গিয়েছিলাম। লক্ষ্মীপ্রতিমা দেখে ফিরছি, একটি মস্ত ঝকঝকে গাড়ি এসে বারোয়ারিতলায় থামল। বৃহৎ একটি পরিবার নেমে এল গাড়ি থেকে; বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বধূ, ছেলেমেয়ে। উমামামা দেখলেন সামান্য, তারপর পা বাড়ালেন।

রাস্তা দিয়ে আমরা পাশাপাশি হাঁটছি। অতি মনোহর জ্যোৎস্না। সমস্ত পথপ্রান্তর বৃক্ষলতা যেন পূর্ণিমার সাগরে ডুবে আছে। কার্তিক মাসের সামান্য হিম পড়ছিল। আকাশটি যেন রুপোর জলে টলমল করছে, মাথার ওপর পূর্ণচন্দ্র । রাস্তায় কুচি পাথরগুলি কিরণে চিকচিক করছিল। ঘাস মাটি এবং শস্যক্ষেত্রগুলি নিস্তব্ধ, যেন কোনো অলৌকিক মোহে অভিভূত হয়ে আছে।

সাঁকোর পর মেঠো পথ, উমামামার বাড়ি। সাঁকো পেরিয়ে এসে উমামামা বললেন, “ওই গাড়িটা দেখেছিলি?”

“কোনটা? যেটা এসে থামল! পেল্লায় গাড়ি।”

“হ্যাঁ । সিঙ্গীমশাইদের গাড়ি। প্রচুর ধনী লোক। পাটনায় থাকেন সব।”

“তোমার চেনা?”

“না, আমি এদের কাউকে চিনি না। একজনকে চিনতাম, সে আসেনি।” বলে উমামামা হাতের ছড়ি দিয়ে পথের ওপর পড়ে থাকা একটা শুকনো ডাল সরিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলেন। আমরা নির্জন ও নিস্তব্ধ মাঠ দিয়ে হাঁটছিলাম।…কিছুক্ষণ নীরবে হেঁটে এসে উমামামা প্রায় আপনমনে কথা বলার মতন করে বললেন, “খুব সম্ভব পেস্তা রঙের শাড়ি পরা সুন্দরী যে মেয়েটিকে দেখলি, সে ওরই মেয়ে।”

“কার?”

“আমি যাকে চিনতাম।”

উমামামা যে মেয়েটির কথা বললেন, আমি যেন তাকে চিনতে পারলাম। খুবই সুন্দরী, কিন্তু আমার ধারণা হল, তিনি বিবাহিতা এবং যুবতী। উমামামার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, “তুমি মেয়ে বলছ কেন, বউ বলো। বছর পঁচিশ বয়স তো হবেই।”

“তা হবে।” উমামামা অন্যমনস্ক।

ফিরে এসে আমরা উমামামার সেই ছবির বাড়িতে গিয়ে বসলাম। চায়ের সাধ হয়েছিল, চাকরে চা দিয়ে গেল। বারান্দায় একটি ডেক-চেয়ারে উমামামা, অন্য বেতের হেলানো চেয়ারটিতে আমি। আমাদের চোখের সামনে অবিরল জ্যোৎস্নার বৃষ্টি পড়ছে যেন।

চা খেতে খেতে আমি শুধোলাম, “তুমি যেন কী ভাবছ, উমামামা!…ছবির কথা?”

উমামামা সাড়া দিলেন না। ধ্যানীর মতন বসে থাকলেন। এই ধরনের মুহূর্তগুলি আমি সহ্য করতে পারি না, অধৈর্য হয়ে উঠি। তবু চুপ করে থাকলাম।

শেষে এক সময় উমামামা বললেন, “আমার ছবিগুলো কেমন লেগেছে তোর তা তো বললি না?”

“সীতা হরণ…! ভালই লেগেছে।…আমি তো ছবির কিছু বুঝি না।”

“সীতা বুঝিস তো!”

“বারে, রাম সীতা বুঝব না?”

উমামামা জবাব দিলেন না কথার। নীরবে বসে থাকলাম। আমার মনে হল, আমি উমামামাকে তাঁর ছবি সম্পর্কে ভাল মতন কিছু বললাম না, এবং আমার জবাব যথেষ্ট হয়নি। বস্তুত, এই ছবি নিয়ে—না, আঁকা নিয়ে নয়, বিষয় নিয়ে—উমামামার সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে তর্ক হয়েছে। আমি বুঝতে পারতাম না, তিনি কেন সীতার শারীরিক লক্ষণগুলির প্রতি নজর দেন। উমামামা অবশ্য আমায় বাল্মীকি রামায়ণের শ্লোক উদ্ধার করে বোঝাবার চেষ্টা করতেন, সীতার ওই সৌন্দর্য স্বয়ং মহাকবির বর্ণনীয় ছিল। আমার অভ্যস্ত চোখ সীতাকে যেন তপস্বিনীরূপে দেখতে চাইত।

কথাটা মনে এল; বললাম, “তোমার সীতাকে দেখলে আগেই আমার চোখ জ্বালা করত, এবার আরও ভীষণ করছে।”

উমামামা আমার কথা নিশ্চয় বুঝলেন, “জানিস, রাবণ সীতাকে বলেছিল: আমি বহু স্থান থেকে বহু উত্তম স্ত্রী সংগ্রহ করেছি; কিন্তু তোমাকে দেখে আমার তাদের ওপর আর অনুরাগ নেই।”

হয়তো উমামামা আমায় ইঙ্গিতে সীতার সৌন্দর্যের দাহের কথা বোঝাবার চেষ্টা করলেন। আমার বলার কথা খুঁজে পেলাম না। শেষে বললাম, “তোমার রাবণ—?”

“আমার রাবণ কী—?” উমামামা শুধোলেন।

“তাকে আরও ভয়ংকর মনে হয়।…কী জানি বুঝি না ঠিক।…ওই যে যেখানে সীতার সামনে স্বমূর্তি প্রকাশ করে দাঁড়িয়ে আছে—ওই ছবিটায় তোমার রাবণকে দেখলে আমার কেমন ভয় করে।”

“দশটা মাথার জন্যে? না কুড়িটা হাতের জন্যে?”

“ঠাট্টা করছ!…তোমার রাবণ কিন্তু রাক্ষসেরও বেশি। চরম পিশাচ।…দম্ভ, লোভ, কাম, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা—সব দিক দিয়েই আদি শয়তানের মতন।…কী করে তোমার মতন মানুষ এই রাবণ আঁকতে পারল ভেবে আমি অবাক হই।”

উমামামা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন আমার মনের খুব গভীরের কথাটা বোঝবার চেষ্টা করলেন, তারপর বললেন, “রাবণের এই চেহারা তুই দেখতে পাস না?”

“না।”

“এখন তোর অল্প বয়স, আরও বয়স হোক—এই সংসারকে দেখতে শেখ…”

“এর পর তো তুমি বাল্মীকির কথা বলবে। তাঁর রাবণের বর্ণনা শোনাবে।”

“না, আমি বাল্মীকির কথা বলব না, চঞ্চল; নিজের কথা বলব।”

কথায় কথায় আমি কিছু উত্তেজিত হয়েছিলাম, উমামামার কথায় তাঁর দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকালাম।

উমামামা মৃদু ও অন্যমনস্ক গলায় থেমে থেমে বললেন, “আমার স্ত্রী খুবই সুন্দরী ছিল। লোকে বলত আগুনের মতন রূপ। তার সেই রূপের আকর্ষণে এক রাবণ এসেছিল।”

আমার বুকের কোথাও যেন একটি ভীত স্পন্দন এসেছিল; সেই স্পন্দন ক্রমশই দ্রুত হচ্ছিল, এবং আমার যেন আন্দোলিত করছিল। সচকিতে উমামামার দিকে তাকিয়ে আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে গিয়েছিল। তিনি স্থির ও শান্ত। জ্যোৎস্নার কিরণ আমাদের ধৌত করছিল। অদ্ভুত একটি ঝিল্লিরবে সব যেন পূর্ণ হয়ে উঠেছে। উমামামার খরগোশের বাক্স শূন্য, তবু যেন জ্যোৎস্নার আলোয় সেই মৃত জীবটিকে অলৌকিকভাবে আমি অনুভব করছি।

“আমি তখন মুঙ্গেরে”, উমামামা বললেন, “চাকরি করি। টুরে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি, তাকে কে চুরি করে নিয়ে চলে গেছে।”

আমার আপাদমস্তক কম্পিত হল। অথচ কী নির্বিকার নিরাসক্ত চিত্তে উমামামা এই ভীষণ ঘটনার কথা বললেন, যেন সেই স্মৃতিতে তিনি আর বিচলিত নন, ব্যথিত নন। আমি অপলকে তাঁর মুখপানে তাকিয়ে থাকলাম।

“অসম্মান, অগৌরব, লজ্জা আমায় তখন খুবই পীড়িত করেছিল—”, তিনি বললেন, যেন আমার স্বাভাবিক বিস্মিত প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন, কিন্তু আমি চোরের অনুসন্ধান করিনি।”

স্তব্ধ ও আহত হয়ে এই মানুষটির অদ্ভুত সেই আচরণের কারণ বোঝাবার চেষ্টা করলাম। “কেন? তুমি খোঁজ করার চেষ্টা করলে না কেন?”

“তাতে কোনো ফল হত না। আমার মনে হয়েছিল, আমি তাকে ধরে রাখতে পারব না।”

“তুমি কী বলছ, উমামামা!…লোকটাকে তুমি চিনতে না?”

“পরে চিনেছি…”

“তবু তুমি এত বড় লজ্জা মুখ বুজে সয়ে গেলে।” উমামামার প্রতি আমার ঘৃণা ও ক্রোধ হচ্ছিল।

উমামামা কয়েক মুহূর্ত যেন আমার সেই উত্তেজনা লক্ষ করলেন; বললেন, “চঞ্চল, সংসারে আমাদের লজ্জা পাবার মতন ঘটনা অহরহ ঘটছে; আমরা কি তা মুখ বুজে সহ্য করে যাই না!…আমার স্ত্রীকে অন্য লোকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় আমি নিশ্চয় গৌরব বোধ করিনি। আমার মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল। আমার তখনকার মনের অবস্থা আজ বোঝানো যাবে না।” উনি থামলেন, যেন আমায় বুঝতে দিলেন, তিনি সে সময় স্বাভাবিক মানুষের মতনই পীড়িত হয়েছিলেন। তারপর কেমন অদ্ভুত স্বরে বললেন, “…কিন্তু পরে আমি ভেবে দেখেছিলাম, জীবনে অনেক কিছুর বিরুদ্ধেই তো আমি দাঁড়াতে পারিনি।”

“তুমি কার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাও?”

“আমার যাতে লজ্জা তার সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই কি আমার উচিত নয়!…একটু আগে তুই বলছিলি আমার রাবণ সাধারণ রাক্ষসের চেয়েও বেশি, সে চরম পিশাচ। দম্ভ, লোভ, কাম, ক্রোধ, নির্মমতার প্রতিমূর্তি, শয়তান…”

“আমার চোখে তাই মনে হয়েছে।”

“তোর চোখ আর একটু পরিষ্কার হলে বোধ হয় দেখতে পাবি, যে সংসারে আমরা বেঁচে আছি তার মধ্যেও এই বিশাল রাক্ষসটি আছে। দশানন সেই অরি কখনো আমার মধ্যে, কখনো বাইরে।”

আমার মধ্যে কোথাও বুঝি একটি গোপন দ্বার সহসা খুলে গেল, অবরুদ্ধ কক্ষটির অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আমার বোধবুদ্ধি নিঃসাড় হয়ে থাকল; তারপর সেই কক্ষের অন্ধকার ঘুচে গেলে, দশানন সেই অরিটিকে যেন আমি দেখতে পাচ্ছিলাম।

উমামামা বলছিলেন, “যে লোকটি আমার স্ত্রীকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল সে কামোন্মত্ত, হয়তো রূপোন্মত্ত; আমার স্ত্রীও যে নিজের রূপের আগুনে অন্যকে দগ্ধ করছিলেন না—তা-ই বা আমি জোর করে বলি কেমন করে? এ ধরনের ঘটনা আমাদের সংসারে অনেক ঘটেছে, অনেক ঘটবে। আমিও ঘটাতে পারতুম।”

“আমরা কি এরই মধ্যে বেঁচে আছি!” অব্যক্ত এক বেদনায় আমার স্বর রুদ্ধ হয়ে আসছিল।

“আমরা এরই মধ্যে বেঁচে আছি বহুকাল ধরে, এরই মধ্যে বেঁচে থাকব।”

উমামামার এই স্থির নিশ্চিত বিশ্বাস আমায় বড় শূন্য দুর্বল করে দিল। যেন আমি তাঁর কথা অবিশ্বাস করে আমার এই চেনা সংসারের দিকে তাকালাম সান্ত্বনার আশায়। দেখলাম, আমার মধ্যে ভয়, অসহায়তা, ব্যর্থতা, অক্ষমতার গভীর খাদ তৈরি হয়ে আছে; দেখলাম—এই জীবনে আমি কাম, ক্রোধ, লোভ, আত্মপরতার ক্রীতদাস; তারপর আমি সেই অবর্ণনীয় দশানন রাবণকে লক্ষ করলাম, যার দশটা ভয়াবহ মাথা এবং কুড়িটি অস্ত্রধৃত হাত আমাকে হনন করছে। মহাভয় সেই পিশাচ তার স্বার্থপরতা, লোভ, আত্মতুষ্টি, প্রতাপ ও প্রভুত্বের লিপ্সার জন্য আমায় ক্ষতবিক্ষত করছে।

উমামামা স্বগতোক্তির মতন বলছিলেন, “চঞ্চল, কবি বাল্মীকি রামকে ঐশী ক্ষমতা দিয়েছিলেন; আমি রাম নই। মানুষকে হারতে হয়। জীবনের অর্থই বেদনা। দুঃখ বই আমাদের গতি নেই। যন্ত্রণা ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কোথায়! আমাদের প্রেমে দুঃখ, সাধনায় দুঃখ, প্রার্থনায় ব্যর্থতা। আমার বাবা জীবনে কিছু পাননি, দাদা মৃত্যুর কাছে বঞ্চিত হয়েছে, মা তার ঠাকুরের কাছে, আমি মানুষের কাছে…। আমি স্বীকার করে নিয়েছি, মানুষের নিয়তিই এই, শেষ অবধি কোথাও না কোথাও পরাজয়।”

“তোমার কোথাও লজ্জা নেই, উমামামা?”

“আগে ছিল না। চোখের সামনে দেখতাম লজ্জা পাবার মতন ঘটনা অহরহ ঘটছে, আমি লজ্জিত হই না।…আমার মনুষ্যত্ব চুরি যাচ্ছিল, আমি অসহায়ের মতন তা চুরি যেতে দিচ্ছিলাম।…শেষে আমার মনে হল, আমি কেন বেঁচে আছি, কী অর্থ বেঁচে থাকার? অনেক দিন থেকেই কথাটা আমি ভাবছি, এখনও ভাবি।”

উমামামা যেন অনেক দূর থেকে রাত্রের পাহারাদারের মতন আমায় সজাগ থাকতে হাঁক দিচ্ছিলেন, আমি তাঁর সেই ডাক শুনতে শুনতে কোনো অতীন্দ্রিয় অনুভবে সহসা আমার মধ্যে জেগে ওঠার আবেগ অনুভব করলাম, আমার চেতনা জাগ্রত হল। পরক্ষণেই আমি এই সংসারের দশানন রাবণটিকে যেন দেখতে পেলাম, সে আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে, সে ক্রমশই বিরাট ও ভয়ঙ্কর হচ্ছিল, তার দর্পিত চক্ষু,অমিত পরাক্রম, নির্মম ও তীক্ষ্ণ অস্ত্রগুলি, এবং আমার প্রতি পরম অবজ্ঞা লক্ষ করে আমি ভীতার্ত ও অসহায় হয়ে আমার কী যেন মূল্যবান সম্পদ গোপন করার চেষ্টা করলাম। সে অতি অক্লেশে আমার সেই সম্পদ হরণ করার জন্যে হাত বাড়াল।

অস্ফুট স্বরে উমামামাকে আমি সাহায্যের জন্যে ডাকলাম।

সংবিৎ ফিরে পেতে শুনলাম, উমামামা বলছেন, “আজকাল আমার মনে হয় মানুষের জীবনে পরাজয়টা সত্য, বেদনা তার সহচর, তবু আমাদের বেঁচে থাকার একটা সঙ্গত কারণ আছে। এই সাময়িক জীবনকে আমরা সম্মানের জীবন করতে পারি, আমাদের পরাজয় সম্মানের ও অংহকারের হতে পারে।”

“সে কেমন জীবন, উমামামা?”

“আমি ঠিক জানি না।…জানার চেষ্টা করছি। …তুই দেখছিস না, আমি রাবণের সঙ্গে জটায়ুর যুদ্ধটা কতরকম ভাবে আঁকার চেষ্টা করছি।”

উমামামার জটায়ু-ছবিটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি নানাভাবে এই ছবিটি আঁকতে দেখেছি উমামামাকে। কখনও তাঁর জটায়ু বৃদ্ধের সমস্ত শৈথিল্য নিয়ে লড়ছে, কখনও সে যৌবনের মধ্যে ফিরে এসে লড়ছে, কখনও সংগ্রাম নিরাসক্ত নির্লিপ্ত প্রাণহীন, কখনও মনে হয়েছে পাপের বিরুদ্ধে পুণ্যের আদর্শ ও আবেগ নিয়ে সে যুদ্ধ করছে।

“তোমার জটায়ু কোন মূর্তিতে যুদ্ধ করবে, উমামামা?” অস্ফুট গলায় শুধোলাম। যেন এই প্রশ্নটি আমার।

“নানাভাবে তাকে এঁকেছি। হয় তার মূর্তিই এক, আলাদা আলাদা ভঙ্গি; না হয় তার মূর্তি আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমার মনে হয়, জটায়ু তার নিয়তি সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে শুধুমাত্র জীবনের সম্মান ও অহংকারের জন্যে যুদ্ধ করছে…হয়ত সেটাই ভাল।”

উমামামার সঙ্গে সেই আমার শেষ সাক্ষাৎ। তারপর এ-বছরে তিনি গয়া যাবার পথে ট্রেনে আততায়ী কর্তৃক নিহত হয়েছেন। তিনি বৃদ্ধ ও অক্ষম হয়ে এসেছিলেন, তাঁর দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে এসেছিল। এ বয়সে, শূন্য হাতে, শেষ দৃষ্টিটুকু সম্বল করে তিনি কার বিরুদ্ধে এবং কিসের বিরুদ্ধে বাধা দিতে গিয়েছিলেন তা আমি জানি। নিছক অর্থ অপহরণকারী এক তস্করের বিরুদ্ধে বাধা দিতে গিয়ে তিনি নিহত হয়েছেন এ কথা স্বীকার করলে আমার পক্ষে তাঁর প্রতি অবিচার হবে। তিনি তাঁর জটায়ু ছবিটি এতদিনে শেষ করেছেন বলেই আমি মনে করি।

1 Comment
Collapse Comments
Debashis Chowdhary July 3, 2022 at 10:57 pm

অসাধারণ ছবি এঁকেছেন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অপহরণ

অপহরণ

আমার মা? সাতটা গাঁয়ে দেখিনি অমন রূপ। কী রূপ! বাবাগো! কৈবর্তের ঘরে অত রূপ! ইস! বার করো দিকিনি একটা। কোথাও পাবে না। ভুলব? কেমন করে? সে কি কোনওদিন ভোলা যায়, না কেউ ভুলতে পারে। দুগগা পিতিমে দেখেছ তো? পাকা সোনা রঙের উপর ঘামতেল মাখানো। তেমনি রং। নজর পিছলে যায়। যেমন নাক, তেমনি চোখ। চোখের ফাঁদ কী। এ্যাত্তোখানি। চোখ পাকিয়ে তাকালে আমার বাঘা বাপও পালাতে পথ পেত না। আর…তেমনি মাথার চুল। কী যে বস্তু এই রূপ! আমি তখন কতটুকুন আর। এক ফোঁট্টা মেয়ে। তবু মায়ের রূপ আমাকেও ভুলিয়েছিল। মেয়ে হয়ে সারাদিন আঁচল ধরে ঘুরতুম আর বলতুম, মা, তোকে আমি বে করব। মা হাসত। বুকে চেপে বলত, আ মরণ তোর কথার। আমাকে কেন বে করবি। তুই আমার অমন সোনার টুকরো মেয়ে। এ্যাদ্দিন লোকে বিনি জেলেনির রূপের কথা বলেছে, এখন যে বিনির মেয়ের রূপ দেখে বিনিকে বলে, ওদিক থাক। মুখপুড়ি আমার সঙ্গে কেন লো৷ জাতের ঘরে চাঁদের মতো ছেলের সঙ্গে দেব তোর বে। পাকা ঘরে মোহরের ঘড়া থাকবে সেই ছেলের। খাওয়া নেই, কাজ নেই, জামাই অষ্টমপোহর মেয়ের মুখ দেখবে। তোর মুখ দেখলে আর কীসের বা কাজ, কীসের বা খাওয়া। শুনে আমি কেঁদে কেটে একশা হতুম। পড়ে থাকত খেলাঘরের বর কনে। মল পায়ে দাপাদাপি করে বাড়ি মাথায় করতুম। ঘড়া উলটে হাঁড়ি কুড়ি ফেলে একাক্কার করতুম ঘর-দোর। মা আমার তবুও হাসত। পাড়ার লোক ডাকত, সে খেলা দেখবার জন্য, হাততালি দিত আমার দাপাদাপির তালে তালে। মল বাজত ঝুম ঝুম। মা বলত খেপি আমার নাচছে।

এমনি ছিল আমার মায়ের খেলা। তারপরে বুকে চেপে সোহাগ করত। বলত, সেই হবে লো হারামজাদি, সেই হবে! আমাকে বে করেই যদি তোর সুখ হয়, তবে তাই করিস।তখন আমার সে কী আদরের ঘটা। দেখি দেখি মা, আমার দিকে এমনি করে তাকা। অমনি করে ঘোমটা দে। তেমনি করে যা আমার পাশ দিয়ে। মা বলত, মুখপুড়ি। মুখপুড়ির মরণ। কিন্তু যা বলতুম, তাই করত। ঘোমটা টেনে দাঁড়াত বাঁকা হয়ে। টেরে টেরে চেয়ে হাসত। আমি বলতুম, কী সোন্দর লো মা তুই।মা বলত, সত্যি? বলে এক হাত কোমরে, আর এক হাত থুতনিতে রেখে ঘুরে ঘুরে নাচত আমার সামনে। আর গান গাইত:

যৌবনের এ ভরাগাঙ্গে কে ধরবে হাল
শ্যাম তুমি যেও না কো

বড় হয়ে ঠাওর পেয়েছিলুম। মা আমার নাচতেও জানত। গলাখানিও ছিল বড় মিঠে।

সে খেলা ছিল মায়ের প্রাণের খেলা। তখন বুঝিনি পরে বুঝেছি। নিজেকে দিয়ে বুঝেছি।

রূপ যে কাল। রূপ যে বিষ! রূপে অমৃত ওঠে, গরল ওঠে তার চেয়ে বেশি। দেমাক না থাক, অহংকার না থাক, চোরা বানের মতো রূপের কারসাজি চলে লুকিয়ে নিঃসাড়ে। কেউ দেখুক বা না দেখুক। তার কাজ সে আপনি করে যায়। দু পাড় ডুবিয়ে ফুলে ফেঁপে দ্যাখ দ্যাখ করে ভরে ওঠে সে।

তেমনি রূপ। বিষের চোরা বান। কী তার জ্বলুনি। সেই জ্বালা ধরেছিল আমার মায়ের মনে। আমার গুণের মায়ের মনে। গুণ ছিল বইকী। অনেক গুণ ছিল। কিন্তু না ছিল গুণের আদর, না ছিল রূপের সোহাগ।

বাপ ছিল হুতো ভুতো মানুষ। ভাল তো ভাল। কেমন ভাল, অত কথার দরকার কী? ও সব প্যানপ্যানানিতে নেই বাপু। মন্দ তো মন্দ। কতখানি মন্দ, সে বাছবিচারের ধার কে ধারে। এমনি মানুষ ছিল বাপ। কিন্তু তা বললে কি হয়? খুব হলে খুব বলো, কথার গোছ হলে তাই বলো। না তা হবে না। বাপের বুকের ছাতিটা ছিল এ্যাত্তো বড়। বেশি বললে ছাতি ফুলিয়ে দেবে হাঁক। নিজের বেলা ষোলো আনা, পরের বেলা কানাকড়িও নয়। কেন? তা কি হয়!

বিনি জেলেনির রূপের কথা কে না জানত। হালিশহর গৌরীপুরের কে না জানত। বামুন কায়েত বদ্যি, তাঁতি জেলে বাগদি সক্কলে, সব ঘরে। পুরুষের চোখ ভরে ছিল বিনি জেলেনির রূপ। রূপের জাত নেই। জাত দেওয়া-নেওয়ার কথাও আসে না। বিনি জেলেনির রূপের ধ্যান বামুন কায়েত বদ্যিও করত। কার নাম করব। সে কি আজকের কথা। মরে সব ভূত হয়েছে কবে। নাম করাও ঠিক নয়।

ওমা! একদিন গঙ্গা থেকে ডুবে এসে মা আমার অস্থির। ছোট মেয়ে বুঝিনে সব। পাড়ার মেয়ে বউরা এল। কী হল, কী হল গো। মা বললে, পুরুষের তিন চোখ দেখলুম। তিন চোখ! সে আবার কী?

হ্যাঁ, পুব পাড়ার মেজো ঠাকুরের কপালেও একটা চোখ দেখলুম। ডুব দিয়েছিলুম জলে। উঠে দেখি সামনে মহাদেব। শিব ঠাকুর গো৷

কাঁটা দিয়ে উঠল সকলের গায়ে। কী বলে সর্বনাশী। মায়ের আমার রূপে যেন নতুন জোয়ার এসেছে তখন। একই মানুষের রূপ যে এমন বাড়ে কমে, তা কে জানত।

মা বললে, হ্যাঁ, মেজোঠাকুরের তিন তিনটি চোখ। মাথায় জটা, গায়ে গলায় সাপ। আমাকে বললে, তুমি দেবী, মহাদেবী। পৈতে ঘুচিয়ে দেব, জপ গায়ত্রী ছেড়ে দেব। ঘণ্টা নাড়া মন্তর পড়া সব ছেড়ে, তোমার পুজো করব। তুমি আমার পুজো নাও।

সবাই বললে, তারপর?

আর জবাব নেই। মা চুপ হয়ে গেল। খেলায় মাতল আমার সঙ্গে। বাপ এসে সব শুনে মাকে বাঁধল গোয়ালের খুঁটোয়। পিঠে ছপটি ভাঙলে গণ্ডা গণ্ডা। মারের চোটে ভূত ভাগে কিনা, তাই।

রাত পোয়ালে দেখা গেল, ভূতের সঙ্গে মাও ভেগেছে। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। আর খোঁজ। ভক্তের ডাকে পাগলি হয়েছে সে। পুজো নিতে গেছে। আর কি তাকে পাওয়া যায়।

মুখে যাই বলো, ছ্যাঁকা খেলে ঠাওর হয় ছ্যাঁকার জ্বালা। বাপ আমার অমন রাশভারী গোঁয়ার মানুষ। ছেলেমানুষের মতো কেঁদে আকুল হল। কেঁদে কেঁদে ধুলোয় গড়াগড়ি দিল। লোকে দূরের কথা, বিনি জেলেনিও জানত না, তার জন্য তার বরের আবার এত দরদও ছিল। প্রাণে এতখানি লাগবে। আমিও মা মা করে কেঁদে অস্থির।

কিন্তু আর তো মা এল না। প্রথম প্রথম, আমার উপরই বাপের যত আক্রোশ। কোথাও যেত না। আমাকে নিয়েই সারা দিন ঘরে বসে থাকত। উনুনে আগুন নেই, হাঁড়ি চাপে না। পাড়ার বউরা ডেকে নিয়ে খাওয়াত আমাকে।

বাপ বসে থাকত আর আমার দিকে তাকাত বিষনজরে। কখনও মিঠে গলায় কাছে ডেকে নিত। কোলে বসাত আর হাঁ করে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকত। থাকতে থাকতে দেখতুম বাপের চোখে ধকধকে আগুন। গলার কাছে সুড়সুড়ি দিতে দিতে সাঁড়াশির মতো বাপের হাত চেপে বসত আমার গলায়। যতক্ষণ না লাগত, কিছু বলতুম না। লাগলেই চেঁচিয়ে উঠতুম।…এখন ভাবি, জানলে পরে রা-টি কাড়তুম না। মরে পড়ে থাকতুম বাপের কোলে। এ জীবন আর বয়ে বেড়াতে হত না।

কিন্তু তখন কী বুঝি। বলে পিঁপড়ে কামড়ালে কেঁদে অস্থির হই।

তারপরে বাপ সুস্থির হল। কিন্তু আমাকে ছাড়া এক দণ্ড থাকতে পারে না। আমিও তেমনি। পাড়ার মেয়েরা বলত, উঃ ভারী বাপ-সোহাগি মেয়ে। বলতুম, নয় তো? কে কাকে হতে বারণ করেছে।

এই তো আমার পরিচয়। তবু আমার নাম বিনি জেলেনির মেয়ে বলে, পাড়ায় আমি মায়ের মেয়ে, বাপের মেয়ে নয়। নাম আমার ভানুমতী। আমার নাম গঙ্গা। দু-দুটো নাম থাকতেও লোকে বলত, বিনি জেলেনির মেয়ে।

বলে ভানুমতী চুপ করল। ভানুমতী নয় গঙ্গা বাড়িওয়ালি। অনেক রাত্রি হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই কোনও কারখানা থেকে পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো শব্দ হয়ে গেছে।

গ্রীষ্মকাল। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাত। অন্ধকারে সাদা কৃষ্ণকলির মতো অজস্র তারায় তারায় কালো আকাশের বাগান রয়েছে ভরে। ছায়াপথ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে পাতলা সাদা মেঘের মতো।

কিন্তু একটুও হাওয়া নেই। অসহ্য গরম। গঙ্গা বাড়িওয়ালির বস্তির সামনের মাঠে এলোমেলো খাঁটিয়া পেতে শুয়ে আছে অনেক লোক। বস্তির লোক। কারখানার মজুর।

মস্ত মাঠটা ঠিক মাঠ নয়। অনেকগুলি কারখানার রাবিশ ছড়ানো আঁস্তাকুড় বিশেষ। কোথাও খানাখন্দও আছে। গঙ্গার বস্তির অদূরে ডোম বস্তিতে শুয়োরের খাঁচা আছে কয়েকটা।

এই জমিটার পরেই গঙ্গা। জোয়ার কি ভাটা, বোঝা যায় না এখান থেকে। নিঃশব্দ গঙ্গা। স্রোতের বুকে নক্ষত্রের ঝিকিমিকি। অন্ধকারে চোরা হাসির মতো ঝলকিত স্রোত।

গঙ্গার ওপারে জমাট অন্ধকার। অন্ধকারের উপর অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওপারের পর্তুগিজ গির্জাটা। তীক্ষা বর্শাফলকের মতো তারাভরা আকাশে গিয়ে ঠেকেছে তার মাথা। ক্রুশের অগ্রভাগ।

পনেরোশো নিরানব্বই খ্রিস্টাব্দের গির্জা। ইতিহাস বলে, খ্রিস্টানদের ওইটি প্রথম গির্জা। গির্জা খ্রিস্টানদের ভজনালয়।

ভজনালয়ের অন্তরালে ওই ইমারতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকোনো ছিল হিংস্র বেনে পর্তুগিজ অস্ত্রাগার। লালমুখো নীলচোখা ছদ্মবেশী সেনাবাহিনী লুকিয়ে ছিল গোপন কুঠরির গুপ্ত দ্বারে দ্বারে। একদিকে কুঠি, আর একদিকে দুর্গ। আত্মরক্ষা শুধু নয়, অর্থরক্ষাও বটে। হিরা মুক্তা, জহরত আর দুষ্প্রাপ্য সম্পদ।

 ওই গুপ্ত দুর্গের মধ্যে লুকোনো ছিল সোনার সপ্তগ্রামের ধ্বংসবীজ। ছিল পর্তুগিজ জলদস্যুর ঘাঁটি। সে দস্যুর কিছু গড়বার বাসনা ছিল না। তার দুরন্ত লোভের থাবা সোনাদানা ছাড়িয়ে জীবন্ত সোনার দিকে পড়েছিল। বাংলার ছেলেমেয়ে ধরে নিয়ে বিক্রি করেছে তারা পৃথিবীর হাটে বন্দরে। পর্তুগিজ উন্মাদনার মতো তখন উত্তাল হুগলি নদী। ঘাটে ঘাটে তার শত শত সুলুপ আর বিরাট আকারের পর্তুগিজ মডেলের পাল-তোলা নৌকা। পর্তুগিজ রাজার পতাকা উড়ছে পতপত করে। হুগলি জুড়ে তখন তাদেরই গৌরব, তাদেরই সম্মান, তাদেরই প্রতি ভয় ও শ্রদ্ধা। গাঁয়ের নাম পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। নতুন নামে পরিচয় হয়েছে তার ব্যান্ডেল। পর্তুগিজ ভাষার বন্দর শব্দের অপভ্রংশ।

দেশ তখন অরাজক নয়। স্বয়ং শাজাহান বাদশা। কিন্তু বাংলা যে দোজখ। অর্থাৎ নারকী প্রদেশ। মুঘল দরবারের বিচারে শিরচ্ছেদ না করে এক সময়ে কয়েদিকে পাঠানো হত এই দোজখ প্রদেশে।

কিন্তু জলদস্যুর তাড়নায় অতিষ্ঠ মুঘলের জঙ্গি নৌবহর শেষে আক্রমণ করল পর্তুগিজ গির্জা। গির্জা নয় দুর্গ।…ষোলোনো বত্রিশ খ্রিস্টাব্দ। তিন মাস ধরে হুগলি আর হুগলি নদীর আকাশ কালো হয়ে ছিল তোপের ধোঁয়ায়। গোলার আগুনে দগ্ধ হয়েছে দিবানিশি মাঠ আর গ্রাম। বাস্তুহারা ভীত সন্ত্রস্তরা পালিয়েছে দূর গ্রামে।

আঘাতে আঘাতে চুরমার হয়েছে পর্তুগিজ গির্জা আর দুর্গ। কেউ পালিয়েছে, অসংখ্য সুন্দর সুন্দরী পর্তুগিজ বালক-বালিকা চালান হয়েছে রাজধানী দিল্লিতে। পর্তুগিজের ব্যবসা গিয়েছে তলিয়ে, বস্তাবন্দি নথিপত্র দেওয়া হয়েছে জ্বালিয়ে। হুগলি নদীর কিনারে শুধু ধ্বংসস্তূপ।

বাদশা ক্ষমা করেছিল। কিন্তু ভাঙা পাত্র আর জোড়া লাগেনি। পর্তুগিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজ এসে পড়েছে তখন। হার মানতে হয়েছিল তাদের কাছে। ব্যান্ডেল ছেড়ে সুমাত্রা বন্দরে সরে গিয়েছিল তারা।

কিন্তু পর্তুগিজেরা তখন হুগলির ঘরের মানুষ হয়েছিল। হরিনাম জপ করেছে, রসকলি কেটেছে কপালে। দুর্গাপূজার মণ্ডপে ঠুকেছে মাথা। মা কালীর থানে নেচেছে ধুনুচি নিয়ে।

মোঘলের গোলার ধ্বংসস্তৃপে উঠেছিল নতুন গির্জা। শুধু গির্জাই।

ওই সেই গির্জা। গতায়ুযৌবন। আলো সজ্জা নেই, লোকজন নেই, নেই সিপাই মাঝিমাল্লা। তোপের খিলান নেই। ঝনাৎকার নেই তলোয়ারের। ঘণ্টা বাজে না দৈনিক প্রার্থনার।

এই বিংশ শতাব্দীর পরিত্যক্ত এক গ্রাম। সে নগর নেই, নাগর নেই, বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি নেই, নেই আধুনিক যানবাহনের যন্ত্রের গর্জন।

আধুনিক রাজধানী থেকে অনেক দূরে এক শান্ত গ্রাম। নিশীথ রাত্রির অন্ধকার আকাশে লেপটে রয়েছে যেন যুগ-ভীত এক পঙ্গু বৃদ্ধ। নীল রক্তধারায় তার প্রাচীন ব্যান্ডেলের স্বপ্ন। নদীবক্ষে দস্যুতার স্তিমিত স্মৃতি।

খানিক দূর দক্ষিণে তার ইমামবাড়া। অদূর উত্তর সাগঞ্জ। ডানলপ কারখানার কোটিপতিদের প্রাসাদ। আলোর মালা দিনের মতো আলোকিত করেছে কুঠির পরিধি।

এপারে সামনেই দক্ষিণে হাজিনগর চটকল। আর এই গঙ্গার বস্তি। অদূর উত্তরে প্রাচীন ভাঙা মন্দির আর পুরনো বাড়ির ইটের স্তূপে ছাওয়া হালিশহর গ্রাম।

.

জীবনের তাড়নায় আসতে হয়েছিল এখানে। সস্ত্রীক এসেছিলাম। ভদ্রলোকের ছেলে বস্তিতে বাস করতে এলে কথা হয়। ঘোঁট পাঁচালি হয়। সন্দেহ করে লোক। তবে গঙ্গা কেন বিশ্বাস করবে।

বউ দেখে গঙ্গা বলল, মেয়েটাকে কোত্থেকে নিয়ে এলে?

বললাম, বউ।

দেখি তো৷ বলে তার নব্বই বছরেরও উপরে বাঁকা দেহটা নিয়ে এল থপ থপ করে। চোখ দুটি গলা। তবু নাকি দেখতে পায়। হুমড়ি খেয়ে দেখল। দেখে বলল, ডাগর বউ। জানাশোনা মেয়ে বুঝি?

বললাম, হ্যাঁ।

বুঝেছি। বলে কয়েক মুহূর্ত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। থরথর করে কাঁপছে। শরীর আর স্থির থাকে না। জ্ব জোড়া ঝুলে পড়েছে চোখের উপর। জিভটা বেরিয়ে পড়েছে আপনি।

হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যা হোক, সুখী হও। ভালবাসো। ছেড়ে দিয়ো না ভাঙা ভেলার মতো। ঘরছাড়া মেয়ে…জগৎজোড়া এ মানুষের সুমুদুরে তার কেউ নেই।

কেউ নেই।

অবাক হলাম গঙ্গার কথা শুনে। বিস্ময়ের অনেক কারণ ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম গঙ্গা অবাঙালিনি। রামু সর্দারের মা। রামু এখানকার চটকলের ডিপার্টের একজন সর্দার। কিন্তু পরে বুঝলাম, গঙ্গা বাঙালিনি। তা ছাড়া মেয়েমানুষ সম্পর্কে তার বিচিত্র ধারণা। সেও এক বিস্ময়ের ব্যাপার। সে কথা থাক। জীবনে অনেক বেড়াজাল। দুশ্চিন্তায় মন আমার দিবানিশি ভারাক্রান্ত। সারা দিন ঘুরি নিজের কাজের ফিকিরে। রাত্রে যখন ফিরে আসি বস্তিতে তখন শুধু মনে হয় পালাই-পালাই, আর পারিনে।

সেই ঘুপসি ঘর। অসহ্য গরম। আর জানালা দরজা বলে কিছু নেই। আমার বউ, আমার স্ত্রী থাকেন সারা দিনরাত্রি ওই ঘরে। তার পক্ষে বাইরে রাত কাটানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমি কিছুতেই থাকতে পারি না ওই ঘরে। বিশেষ করে রাত্রে কেবলই ঘর বার করি। প্রথম প্রথম তো তাই। অনভ্যাসের ফোঁটা কপাল চড়চড় করে।

আর ঘুমোয় না গঙ্গা। একটি হাতপাখা নিয়ে রোজ বসে থাকে মাঠের ধারে। সামনে থাকে একটি সলতে কমানো হারিকেন।

দিনের বেলা দেখেছি বুড়িকে। চাঁদের মা জটি বুড়ি যেন, মাথায় রুপালি চুল। এ বয়সেও গায়ের রং আঁচড়ানো কাঁচা সোনা। আঁচড়ানো, কেননা রেখাবহুল লোলচর্ম। গুল টিপে রাখে ঠোঁটে। এ বয়সেও ঠোঁট দুটি কী লাল। লাল টুকটুকে। ভাবি, যৌবনে গঙ্গার রূপ তা হলে কেমন ছিল।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেই ডাকে, এসো, এদিকে এসো৷ পাখাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ঘুম হচ্ছে না তো। মেয়েটাকে একলা ফেলে এসেছ, না। কাঁদবে না?

বলি, না। বুড়ি বলে, তবে হাওয়া খাও, আমাকেও একটু করো।তারপরে একটু চুপ। আবার, কী করে সব ঘুমোয় এরা জানিনে বাবা। আমার তো ঘুম আসে না।

দু-চারটি এমনি কথা বলেই সে এসে পড়ে আমার জীবনের প্রসঙ্গে। কুণ্ঠিত হই, লজ্জিত হই। তবু একদিন সব কথা বলেই ফেলি। আমার সব কথা।

শুনে গঙ্গা আমার হাত দুটি ধরে বলল, খুব ভাল করেছিস বাছা খুব ভাল করেছিস। তবে দেখিস, মেয়েমানুষ। মাঝ দরিয়ায় তরী ডুবোসনি যেন।

বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, হাল নেই, মাঝি নেই, মাঝ নদীর নৌকো। কখনও সে পাড়ে ঠেকে, কখনও ভাসে জলে। ভাসতে ভাসতে সে কোথায় যায়, কে তাকে ধরে রাখবে। ধরে রাখতে পারে শুধু তোদের মতো ছেলেগুলো। প্রাণে যাদের আগুন, মনে যাদের রস ফোটে টগবগ করে। রেখেও তো ছিল। কিন্তু পারেনি।

বললাম, কার কথা বলছ বাড়িউলি?

গঙ্গা বলল, ভানুমতীর কথা!

ভানুমতী কে?

আমি, এই মুখপুড়ি।

 কী বলছ?

 গরমে তার সর্বাঙ্গ খোলা। গায়ের লোলচর্ম দেখিয়ে বলল, সারা গায়ে দেখছ না কত কালের কথা আঁকা আছে। ভানুমতীর জীবনের নামাবলী এই চামড়া। তারই একটি কথা বলছিলাম।

বললাম, কী বলছ, বলো না?

গঙ্গা বলল, আকাশের তারা কি গোনা যায়। এ জীবনের কথার কি শেষ আছে। সে যে কত কথা। বাছা, তোদের জীবন তেজে ভরা,নতুন তোদের কাল। আমাদের সেকালের কথা এখন রাক্ষস রাজত্বের রূপকথা।

বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে পাখাঁটি আমার হাতে দিল। আমি হাওয়া করতে লাগলাম। আর গঙ্গা বহু দূর ঝরনার গুঞ্জনের মতো গুনগুন করে চলল এক বিচিত্র রাগিণী। নব্বই বছরে পথের এক অন্ধকারে সেই ঝরনা।

.

বৈশাখের ঘোর দুপুর।

ধীরে বইছে ভাগীরথী। ভাটার টানে চলেছে সমুদ্র সঙ্গমে। যায় আর আসে। এমনি যাওয়া আসা তার দিবানিশি। কাল যায় আর আসে তার স্রোতের বুকে। কালের কথা গুনগুন করে ফেরে তার কলকল ধ্বনির সঙ্গে। কত কথা। তার আদি আছে অন্ত নেই!

কখনও ইতিহাসের রচয়িত্রী সে নিজে। কখনও মানুষের গড়া ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গুঞ্জন করেছে তলে তলে।

কয়েক শতাব্দী আগে তার প্রধান স্রোতের বেগ নিয়ে ছুটেছে সে সরস্বতীর সঙ্গে সঙ্গে। ত্রিবেণী সঙ্গমের কোল থেকে তখন সে সমৃদ্ধ করেছে সপ্তগ্রাম। সমৃদ্ধ রাজ্য আর বন্দর সেদিন সপ্তগ্রাম।

আবার এক সময়ে আপন মনের খেয়ালে সে তার প্রধান স্রোত নিয়ে এসেছে নিজেরই খাতে। সপ্তগ্রামের পূর্ব সীমান্তের গভীর হোগলা বনের পাশ দিয়ে।

বাণিজ্যের আসর-সন্ধানী বিদেশিরা অমনি ছুটে এসেছে হোগলা বনের ধারে। হোগলা বনের ধারে গভীর স্রোতস্বিনী। বলে হোগলা নদী। হোগলা থেকে ওগলা, ওগলি, ওগোলিন। তারপরে হুগলি। হুগলি নদী। দ্যাখ দ্যাখ করে দু শতাব্দীর মধ্যে সপ্তগ্রাম গেল চুপসে। বন্দর হল হুগলি।

বৈশাখের ঘোর দুপুরে ছায়াশীতল গ্রাম এই হালিশহর। চব্বিশ পরগনার এক পরগনা এখন। তখন ছিল সপ্তগ্রামের অংশ। জীবন ও যৌবন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কেনা-বেচাসবার কেন্দ্র সপ্তগ্রাম।

তারপরে মুখোমুখি হুগলি। এপার ওপার। যোগাযোগ হয়েছে হুগলির সঙ্গে। হাট বাজার, ওঠা বসা, শিক্ষা দীক্ষা সবই!

আবার তাও ভাঙতে আরম্ভ করেছে। এক সময় সপ্তগ্রামকে কেন্দ্র করে, তারপরে হুগলিকে কেন্দ্র করে হালিশহর সমৃদ্ধ করেছে নিজেকে। আজ আবার সেই হুগলি বন্দর ক্রমে সরে যাচ্ছে। কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কলকাতায়।

সপ্তগ্রাম থেকে হুগলি। হুগলি থেকে কলকাতা৷ হালিশহর বোবা বিস্ময়ে লক্ষ করেছে এই বিচিত্র গতি। সপ্তগ্রাম থেকে হুগলির নাগাল পেয়েছে সে। কিন্তু কলকাতার নাগাল পাওয়া যাবে কি আর।

আর ঘোর দুপুরের অলস বিস্মিত নীরব হালিশহর দেখছে গঙ্গাকে। গঙ্গা, অর্থাৎ ভানুমতীকে। ভানুমতী নয়। বিনি জেলিনির মেয়ে ভানি।

হালিশহরের কথা বলছ? সে কি গ্রাম। গ্রাম নয়, শহর। ও তল্লাট খুঁজলে পাবে না এমন একখানি জায়গা। মস্ত বড় বড় মহলের পর মহল তোলা বাড়ি। বাড়ি নয়, রাজার বাড়ি। থাকবে না কেন। হালিশহরের লোকের ধন আছে, ধর্ম আছে। হুগলি বন্দরে অনেকের কাজ, অনেকের ব্যবসা। অনেকের ঘোড়ার আস্তাবলে ঘোড়া আছে। দুজনের আছে হাতি। লোকে বাড়ি তোলে, তার সঙ্গে তোলে মন্দির। বাড়ি বাগান মন্দির। বড় বড় সড়ক। গ্রাম নয় শহর। হাবেলি পরগনার হালিশহর। বামুন পণ্ডিত, কুলীন কায়েত, হাড়ি, বাগদি, জেলে, হাতি, ঘোড়া, পালকি, সব মিলিয়ে জমজমাট হালিশহর। জাগ্রত মা কালীর থান, রামপ্রসাদের পঞ্চবটী আর শিব মন্দিরের ছড়াছড়ি। গঙ্গার পারে আছে রানি রাসমণির ঘাট। হরেকেষ্ট বোষ্টমের মেয়ে রাসমণি। হালিশহরের মেয়ে। কপাল কী। কলকাতার নোক গঙ্গার পাড়ে রাসমণিকে দেখে পছন্দ করে ফেলল। জানবাজারের রাজচন্দ্রের তৃতীয় বিয়ের মেয়ে দেখতে বেরিয়েছিল তারা।

.

গঙ্গার এপারে দেখা যায় না বিশেষ নৌকা। কিন্তু কাতার দেওয়া রয়েছে ওপারে। শুধু নৌকা নয়। পাল ভোলা স্টিমের নৌকাও আছে। লোকে বলে জাহাজ। ওপারে স্কুল কলেজ হাসপাতাল আদালত। সাহেবরা পড়ায় স্কুলে কলেজে। এপার থেকে বামুন কায়েতদের ছেলেরা যায় ওপারে পড়তে। ওপারেই সব। সাহেব মেমের ছড়াছড়ি, সাহেব মেমে মারামারি। আর কী বাড়ি। বাড়ির গায়ে বাড়ি, তার গায়ে বাড়ি। এপার থেকে মনে হয়, সব যেন এর ওর গায়ে হেলান দিয়ে রয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যায় সামান্য কিছু মানুষের ব্যস্ততা। রাস্তায় ফিটন ও পালকির যাওয়া আসা। এক-আধজন দেশি বিদেশি ঘোড়সওয়ারের দৌড়াদৌড়ি। হালিশহরে শোনা যাচ্ছে, মেয়েছেলেরাও নাকি ওপারে লেখাপড়া করছে। তাদেরও স্কুল হয়েছে।

পরিষ্কার দেখা যায় ব্যান্ডেলের গির্জাটা। পাঁচিল ঘেরা উঠানে, কৃত্রিম কুঞ্জ বীথিতে পাথরের নারীমূর্তি। বাইরের জনহীন মাঠে একটা চার ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে দাঁড়িয়ে। না সহিস, না যাত্রী।

একটু উত্তরে তার পাঁচিলের ঘেরাও। ভাঙন ধরেছে পাঁচিলে। ঘেরাওয়ের মধ্যে বাগান ছিল। এখন জঙ্গলে ভরে উঠেছে। লোকে বলে মাদাম গ্র্যান্ডের বাগান ছিল। আজকের কথা তো নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকের কথা। আজ উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্ন অতিক্রান্ত। মাদাম গ্র্যান্ডকে অর্থাৎ দ্বিতীয়া ব্যারনেস ইনহফকে নিয়ে ওখানে প্রেম করতে আসতেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তখনকার দিনে হুগলি ও কলকাতার শ্রেষ্ঠা সুন্দরী। মেমসাহেব অনেকের চোখে রং ধরিয়েছিলেন। কিন্তু হেস্টিংসের রূপ, বীরত্ব, ক্ষমতা জয় করেছিল তাঁকে। বাগানের পেছনে ঝাউবন। বৈশাখের রোদে আগুনের ফুলকির মতো জ্বলছে কৃষ্ণচূড়া। আরও উত্তরে কেওটা আর সাগঞ্জ ক্ৰমে প্রাসাদের সারি ছাড়িয়ে গাছের মাথায় মাথায় শুধু গ্রামের চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এদিকে ব্যান্ডেল থেকে চুঁচুড়া। বন্দর ও শহর। স্কুল ও কলেজ। আপিস আর আদালত। কী রোদ। গাঁয়ে ঘরে কে বেরোয় এ সময়ে। এপারের লোক কাজে যায়, অকাজে যায়। সম্পর্ক ওপারের সঙ্গেই বেশি।

বৈশাখের প্রচণ্ড রোদে হালিশহর এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। নিস্তব্ধ। দ্বার বন্ধ নিঃশব্দ পুরী। দীঘি পুকুরে মানুষ নেই, রাস্তায় লোক নেই। ফাঁকা গঙ্গার ধারের মাঠ ও বাগান। অলস দুপুরে ঝোপে ডাকছে ঘুঘু কোথাও পিক পিক অথবা আচমকা কুহু কুহু! আম গাছে আম, কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল। কাঠবেড়ালির পৌষমাস।

কী রোদ! যাও বা দু-একজন বেরোয়, চলে গাছের ছায়ায় ছায়ায় মাথায় গামছা বেঁধে। শুধু গোরুর পাল চরছে গঙ্গার ধারে।

আর বেরোয় ভানুমতীর মতো মেয়ে। মেয়ের বোল ফুটতে না ফুটতে মা ঘর ছেড়ে গিয়েছে। মা, বিনি জেলেনি। রূপে তার হালিশহর আলো ছিল। ঘর ছেড়েছে এক বামুনের সঙ্গে।

ঘরে মা নেই। বাবা করে জাত ব্যবসা। সকাল থেকে মাছ ধরে, সন্ধে অবধি কাটে ওপারে।

ভানু সেয়ানা হয়েছে। সে-ই রাঁধে বাড়ে। ঘরের কাজ কর্ম করে। তারপর, বলার কেউ নেই, নেই কেউ চোখ পাকিয়ে ঘরে রাখবার। মেয়ে সারা দিন পাড়ায় পাড়ায় টো টো করে ঘোরে। মন গেলে দুস্তর জঙ্গল পেরিয়ে চলে যাবে গরিফায়। মেয়ের ভয় ডর বলে কিছুই নেই। প্রতিবেশীরা কেউ কিছু বলতে এলে অমনি কট কট করে দেবে দশ কথা শুনিয়ে। কে বলবে! মেয়ের চোখে মুখে কথা। শত হলেও বিনি জেলেনির মেয়ে তো৷ অসতী গৃহত্যাগিনী বিনি জেলেনি।

মেয়ে তো নয়। সাপের মাথার মণি। ময়লা ন্যাকড়া জড়ানো হিরের মতো চিরকুট কাপড় পরে দিব্যি চলেছে গঙ্গার ধারের বাগান দিয়ে। বাগানের ছায়ায় ছায়ায়। এক হাতে নুন, আর হাতে কাঁচা আম। নুনে জরিয়ে জরিয়ে খাচ্ছে আর জিভ দিয়ে শব্দ করছে টকাস টকাস করে। রূপে আলো করে চলেছে দশ দিক। বিনির রূপে চোখ ঝলসাত লোকের। কিন্তু পেট থেকে যে রূপের ড্যালাটি ফেলে গিয়েছে, তার রূপের তুলনা হয় না। বড় হলে, এ মেয়ের দিকে চেয়ে চোখ ঠিকরে পড়বে।

এখনও বড় হয়নি। বয়স মাত্র বারো। তবু এর মধ্যে লোকে বলতে আরম্ভ করেছে, মেয়ে তো নয়, একটা মস্ত মাগি।

হ্যাঁ, তা বটে। গায়ে হাত পায়ে ভারী হয়নি। লজ্জার অবকাশ আসেনি দেহে। তবু, হঠাৎ খানিকটা লম্বা হয়ে উঠেছে। একহারা, রোগা রোগা। মাথায় একরাশ চুল। তেল নেই, জল নেই, চুলের রং পিঙ্গল হতে চলেছে। চুল এলিয়ে পড়েছে কোমরের নীচে। পেছন থেকে দেখলে হঠাৎ একটি বড়সড় মেয়েমানুষ বলেই বোধ হয়।

চৈত্র বৈশাখের চারা গাছটির মতো। নববর্ষণে ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে ওঠার এই তো লক্ষণ। ফরসা ধবধবে মুখোনি রোদে পুড়ে লাল হয়ে উঠেছে। ঘেমে উঠেছে নাকের ডগা আর ঠোঁটের উপরিভাগ। কিশোরী চোখে তার অস্থির কালো তারা। স্বাভাবিক চাউনিটি দীপ্ত ও খরো। আপনি আপনি চোখ দুটি দপদপ করে জ্বলছে।

বোঝা যাচ্ছে, মনে মনে স্বগতোক্তি হচ্ছে একটা কিছু। অদ্ভুত শব্দ করতে করতে আম চিবুচ্ছে। তাকাচ্ছে এদিকে ওদিকে। ভ্র জোড়া নেচে উঠছে। হাসতে গিয়ে হঠাৎ অভিমান করে ঘাড় কাত করে চোখ বুজিয়ে ফেলছে নয়তো উদাস হয়ে উঠছে ওপারের দিকে চেয়ে।

গহনা কিছু নেই বিশেষ। রুপার দুটি চুড়ি আর ঝুটো পাথর বসানো একটি ছোট নাকছাবি। কানে দিয়েছে নিম কাটি। নইলে ফুটো বন্ধ হয়ে যাবে। আশা তো মরে না। একদিন সে সোনার দুল পরবে। রাসমণির মতো মস্ত ঘরে বিয়ে হবে তার। হিরে মুক্তোয় তার সর্বাঙ্গ ভরে উঠবে।

রূপের কথা শুনে শুনে কান তার ঝালাপালা। সবাই বলে, কী সুন্দর! শুনে শুনে এক এক সময়। তার সাজতে মন চায়। কিন্তু সাজবে কী দিয়ে। না আছে বেনারসি, না আছে নীলাম্বরী।

আম চিবুতে চিবুতে বসল একটি গাছের তলায়। আমটি ফুরোলে পরে লম্বা লম্বা ঘাস ছিঁড়ে তার বিনুনি করল। বিনুনি করে বিছে হারের মতো পরল গলায়। আবার ওই ঘাসের বিনুনি দিয়েই তৈরি করে কানের ফুল। আর গুনগুন করছে একটি গান:

জোড় হাতে বলি শুন, শুন কুলীন গণে
ক্ষেমা দেওরে ভাই নিত্য বিবাহ রণে

সম্প্রতি রটনা হয়েছে এই গান। গান নিয়ে হাসাহাসি, গান নিয়ে মারামারি। ভানুমতী গাইছে আপন মনে। তার কোনও কারণ নেই।

কিন্তু এমনি ধারা গান আজকাল সব জায়গায়ই শোনা যায়। ওপারে বিদ্যাসাগর ঘুরছেন, কোন কুলীন ব্রাহ্মণ কত বিয়ে করেছে তারই হিসাবনিকাশ করতে। সঙ্গে আবার লোক যায় গান গাইতে গাইতে।

সন্ধ্যাবেলা চণ্ডীমণ্ডপে, বারবাড়িতে বৈঠকখানায় সর্বত্র ওই একই আলোচনা। ওই নিয়েই তর্কের আসর, গল্প, হাসাহাসি, কোনও কোনও সময় হাতাহাতি, মারামারি, হুঁকো পেটাপেটি পর্যন্ত হয়। পুকুর ঘাটে হেঁসেলেও তাই। হালিশহরে, পাড়ায় পাড়ায়ও তাই।

বর্ধমানের জ্বর বলে এক সর্বনেশে রোগ এসেছে দেশে। ইংরেজরা বলে ম্যালেরিয়া। রোজ রোজ লোক মরছে বর্ধমানে। হুগলিতে তার চেয়ে বেশি। হালিশহরেও কম নয়। এমনকী রোগ সন্ধানী কমিশন প্রকাশ করেও দিয়েছে, বর্ষার সময় রোগটা শুরু হয়েছিল হালিশহরে। সেখান থেকে হুগলি, বর্ধমান ছড়িয়েছে। কিন্তু রোগের নাম হয়ে গিয়েছে বর্ধমান-জ্বর। দেদার লোক পালাচ্ছে কলকাতায়।

হালিশহরের থেকেও পালাচ্ছে অনেকে। যাদের যেমন অবস্থা, সেই অনুযায়ী। সবাই ঠাট্টা করে বলে এক দিকে বর্ধমান-জ্বর, আর এক দিকে কুলীনের ভীমরতি। ওষুধ নিয়ে ওপার থেকে আসছেন বিদ্যাসাগর।

নিশিকান্ত বাঁড়ুজ্জে তো খেপেই অস্থির। বয়স হয়েছে বাহান্ন। বিয়ে করেছে সাতচল্লিশটি। মাথাটিও সম্প্রতি একটু বেশি গরম হয়েছে। গঞ্জিকা সেবনে অষ্টপ্রহরই শিবনেত্র হয়ে থাকে। পাড়ায় কুচো কাচারা ঠাট্টা করে, আড়াল থেকে চেঁচায়, বিদ্যাসাগর আসছেন ওপার থেকে। এক বার শুনলে হয়। নিশিকান্তর নেশা অমনি ছুটে যায়। মস্ত একটি বাঁশ নিয়ে ছুটে যায় গঙ্গার ঘাটে। বলে, কই, কোথায় যুগ্ন করে চাল থেকে সেই ব্যাটা পণ্ডিত, এক বার দেখি।

অমনি কেউ বলে, ওই তো আসছে, সায়েবদের বজরায় করে। গোটা বিশেক বন্দুকধারী সঙ্গে আছে।

বন্দুকধারী? কটা? কুড়িটা? নিশিকান্ত মানে মানে গাঁয়ে ঢোকে। বলে, আচ্ছা, এবারটা যাক।বলে সরাসরি হালিশহর ছেড়ে দু দিনের জন্য গা ঢাকা দিয়ে থাকে।

সবাই ওই গান গুনগুন করে। ভানুমতীও করে। গান করতে করতে আপন মনে লতাপাতার অলংকার তৈরি করছে। চুড়ি, হার, দুল, নাকছাবি। এমন সময় দুটো লোক অদূরের একটি জামরুল গাছের তলায় এসে দাঁড়াল। দুজনেরই মাথায় ছোট ছোট চুল, সমান করে কাটা। আধ হাত পরিমাণ স্থূল শিখা। দুজনেই কালো। দুজনেরই স্থূল চেহারা। একজন কিঞ্চিৎ লম্বা।

একজনের নাম সর্বেশ্বর পাঠক। দ্বিতীয় নন্দন অধিকারী। সর্বেশ্বরের পাঠক পদবি আজ বিলুপ্তপ্রায়। বিশেষ, ঘটকালি করে করে, নাম তার ঘটক ঠাকুর দাঁড়িয়েছে। নন্দনের পেশা তাই, তবে নামটা ততোধিক নেই। দুজনে তারা হালিশহরেরই অধিবাসী। ভানুমতীর প্রতিবেশী। সর্বেশ্বরের খালি গা, গলায় মোটা পৈতা, ঘাড়ের উপর উড়নি, গামছাটি বগলে, নন্দনের গায়ে ফতুয়া, উড়নি নেই, গামছাটি কাঁধে।

দুজনেই তারা এক বার দেখল ভানুমতীকে। দেখে পরস্পর চোখাচোখি করে ঘাড় নেড়ে ইতি-উতি দেখল চারিদিকে।

সর্বেশ্বর চাপা গলায় বলল, নন্দন, অনেক দিন পেছু ঘুরছি। এই সুযোগ আর ছাড়া চলে না।

নন্দন একটু ভিতু। বলল, দিনক্ষণটা ঠিক ঠিক দেখেছ তোতা?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। এর আবার অত দিনক্ষণ কীসের? মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা। বুধে বুদ্ধি আপনি গজায়। বুদ্ধি থাকলেই পগার পার।

নন্দন তবু বলল, যদি কেউ দেখে ফেলে?

সর্বেশ্বর তার কুৎসিত মুখটা আরও বিকৃত করে বলল, তোমার মুণ্ডু। দেখে আবার ফেলবে কী? আমরা কি কেটে খাব? দাঁড়াও এখন! আমি উত্তর দিক দিয়ে ঘুরে যাচ্ছি। কথা বলে এগুলেই তুমি এসে দেখা দেবে, বুঝলে?

নন্দন বলল, আচ্ছা।

সর্বেশ্বর পা টিপে টিপে কোথায় অদৃশ্য হল। নন্দন ভীত চোখে তাকাতে লাগল এদিকে ওদিকে।

একটু পরেই দেখা গেল সর্বেশ্বর ভানুমতীর কাছে দাঁড়িয়ে। বলল, কে র‍্যা? আমাদের গঙ্গা না, বিনির বেটি?

ভানুমতী দেখল। নিজের কাজ করতে করতে মুখ না ফিরিয়েই বলল, ঘটক ঠাকুরদা, কোথায় যাচ্ছ এই দুকুরবেলা?

সর্বেশ্বর এদিক ওদিক দেখে হেসে বলল, এই তোর বের ঘটকালি করতে। দ্যাখ না, তোর কেমন বে দিই।

কিন্তু নিজের কাজে ভানু এমনই মশগুল, বিয়ের কথাতে তার একটুও উৎসাহ দেখা গেল না। বলল, তোমরা তো বামুনের বে দেও। আমরা তো জেলে।

সর্বেশ্বর বলল, হলই বা। তোর অমন রূপ। একশো মোহর কামিয়ে নেব তোর বে দিয়ে।

ভানুমতী তাকায়ও না। জবাবও দেয় না আর। সর্বেশ্বর হাত কচলায় উশখুশ করে তারপর হঠাৎ হামলে ওঠে, তোর বাপের কথা শুনেছিস?

ভানু অন্যমনস্কভাবেই বলল, কী কথা ঠাকুরদা?

সর্বেশ্বর বিস্মিত হয়ে জিভ দিয়ে আক্ষেপের শব্দ করে বলল, ওমা, সে কথা শুনিসনি? চুচড়োয় তোর বাবাকে যে এক সাহেবের ঘোড়া লাথি মেরে মাথার খুলি ভেঙে দিয়েছে।

বালিকা ভানুমতী আঁতকে উঠে তাকাল সর্বেশ্বরের দিকে। সর্বেশ্বরের আগের পরের কথাও লক্ষ করল না। কেবল মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক নিমেষ। তারপরেই হাতের অলংকার ছুঁড়ে ফেলে, ওগো আমার বাবা গো। বলে চিৎকার। কী দাপাদাপি! তবে, লোকজনের বাসস্থান থেকে অনেক দূরে গঙ্গার ধার। সেই যা রক্ষা। নইলে গাঁ মাথায় হত। অমনি নন্দন বেরিয়ে এসে বলল, কী হল রে? ও! তোর বাপের খবর পেয়েছিস বুঝি। আহা, এক ফোঁটা মেয়ে। আমি সকালেই দেখে এসেছি।

বুদ্ধি নেই, বিচার নেই। যত শোনে, ভানুমতী তত কাঁদে।

 সর্বেশ্বর বলল, আচ্ছা, অত কাঁদছিস কেন? বাপ কি কারও মরে না? কী বলল হে নন্দন। পাড়ায় অত লোক রয়েছে, আমরা রয়েছি।

নন্দন বলল, তা তো বটেই। ওপারেই যাচ্ছি আমি। আদালতের বারান্দায় তোর বাপকে শুইয়ে রেখেছে দেখে এসেছি। সর্বেশ্বর বলল, তা চলো না মেয়েটাকেও নিয়ে যাই, দেখে আসবে এক বার বাপকে?

ভানুমতী অমনি দুহাতে সর্বেশ্বরকে জড়িয়ে ধরে বলল, ও ঠাকুরদা, তোমার পায়ে পড়ি, এক বারটি আমাকে বাবার কাছে নে চলো।

সর্বেশ্বর বলল, তা চুবো চুবো। বেশ তো যাবি। বলে নন্দনকে চোখ টিপল। টিপে হুশ করে নিশ্বাস ফেলে বলল, আহা! এমন সোনার টুকরো মেয়ে।

নন্দন দেখল, ঘাটে কেউ আছে কি না। কেউ নেই। খালি তাদের আগের থেকেই ঠিক করা মাঝি বসে আছে নৌকা নিয়ে। সে ডাকল, কই, এসো হে সব্বো, আমার আবার তাড়াতাড়ি।

সর্বেশ্বর খালি বলে, চুবো চুবো। চল, নন্দনের নৌকা রয়েছে। তাইতেই চলে যাই।

ছই ছাওয়া নৌকা। নৌকা তো নয়, দিব্যি একখানি ছোটখাটো ভাউলে। ঢেউয়ের দোলায় নাচছে। মাঝিটি ওপারের মানুষ। জেনে শুনেই এসেছে। পাখি ডাকছে ছায়ায় বসে। বৈশাখের খর রোদে নিশীথের মতো সুপ্ত গ্রাম। কোথা থেকে একটা গোরু ডাকছে হাম্বা হাম্বা করে।

ওগো বাবা গো! বলে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ভানুমতী নৌকায় উঠল। কান্নায় তার চোখ লাল, মুখ লাল।

মুখে চোখে ছড়ানো এলোমেলো চুলের রাশি।

সর্বেশ্বর বলল, যা রোদ! চলো ভেতরে গিয়ে বসি।

নন্দন বলল মাঝিকে, কই হে, নৌকা খোলো৷ বলে গলা বাড়িয়ে একবার চার দিকে দেখল। কেউ নেই। নিঝুম গ্রাম। সূর্য একেবারে ঢলে না পড়লে আর লোকজন পথে বেরুবে না।

মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল। নন্দন ইশারায় অঙ্গুলি সংকেত করল উত্তর দিকে তাড়াতাড়ি চলার জন্য।

মাঝির সঙ্গে আগে থেকেই ষড় করা হয়েছে। সে ঘাড় নেড়ে হাল ধরল। নন্দন ঢুকল ছইয়ের ভিতরে। ভানু কাঁদছে। বালিকা ভানুমতী, শিশু গঙ্গা। বাপ সোহাগি, চলেছে মাথার খুলি ভাঙা বাপকে দেখতে। আর কয়েক প্রহর বাদেই তার যে বাপ পাড়ি দেবে ওপার থেকে এপারে। এ যাওয়া যে কী যাওয়া, সে জানে না, কেউ জানে না। জানে শুধু পাপের মতো ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর, মানুষরূপী সর্বেশ্বর আর নন্দন।

আর এ যাওয়া যে শেষ পর্যন্ত ভানুমতীকে কোথায় নিয়ে যাবে, সে কথা জানে না সর্বেশ্বর আর নন্দনও। গঙ্গার অতল রহস্যের মতোই তা অন্ধকার।

এ বিশ্বসংসারের সমুদ্রে সবাই ভাসছে। ভাসছে জীবন ভেলায়। ভানুমতীও ভাসল এক জীবন ভেলায়। তার নিজের অজান্তে যে জীবনের ভেলা তৈরি হয়েছিল তার জন্যে।