অপর্ণার পারণা বা স্যালাড
বাসনা ছিল দু-একটি গাল-গল্প বলার পর যখন আর খানিকটা ওম পেয়েছে তখন এই লেখাটিতে হাত দেব কিন্তু হিসাব করে দেখি সে আর হয় না। স্যালাড পাতা বাজারে ফুরিয়ে যাওয়ার পর এ লেখা বেরুলে কে আর সেটি ন মাস বাঁচিয়ে রাখবে? এমনকি মনে হচ্ছে এমনিতেই বোধহয় কিঞ্চিৎ দেরি হয়ে গেল। অবশ্য কলকাতা এবং হিলস্টেশনে যারা থাকেন তাদের কথা আলাদা।
স্যালাড শব্দের মূল অর্থ নোন কিন্তু এখন শব্দটি অন্য নানা অর্থে ব্যবহার হয়। প্রধানত কাঁচা পাতা খাওয়ার অর্থে। তাই আমি যখন কোনও ইয়োরোপীয়কে পান দিই, তখন বলি, যা সাম নেটিভ স্যালাড। অবশ্য তারা পান বলতে সেটাকে স্যালাডের ভিতর ধরেনি।
স্যালাড বললে দেশে-বিদেশে প্রধানত লেটিস (ইংরেজিতে বানান lettuce কিন্তু উচ্চারণ লেটিস) স্যালাডই বোঝায়। তার নানা জাত-বর্ণ আছে কিন্তু এদেশে প্রধানত হেড় এবং লিফ এই ধরনেরই রেওয়াজ বেশি। হেড অর্থাৎ মাথা– এ লেটিস দেখতে অনেকটা বাঁধাকপির মতো। আর লিস্ স্যালাডে থাকে শুধু পাতা। দুটোরই বাইরের দিকের পাতাগুলো পুরু এবং তেতো বলে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলে ভেতরের নরম-বস্তু কাজে লাগাতে হয়। আর যদি আপন বাগানে লিফু ফলিয়ে থাকেন তবে সূর্য ওঠবার সময় আগে হলে আরও ভালো প্রয়োজনমতো যে-কটি পাতা দরকার সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন লেটিসের ভিতরকার দিক থেকে ছিঁড়ে তুলে নেবেন (ন্নি ভিন্ন লেটিসে সেসব জায়গায় আবার নতুন কচি পাতা গজাবে, বাইরের দিকে যে পাতাগুলো হেঁড়েননি সেগুলোর নিরাপদ আশ্রয়ে)। কেউ কেউ বলেন স্যালাড তৈরি করা পর্যন্ত পাতাগুলো ভিজিয়ে রাখতে, আমি বলি ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে রাখতে।
অমলেট, মাছভাজা যেমন বেশি আগে তৈরি করে রাখা হয় না, স্যালাডও তেমনি খেতে বসার যত অল্পক্ষণ আগে করা যায় ততই ভালো না হলে পাতাগুলো নেতিয়ে একাকার হয়ে যায়।
সবচেয়ে ঘরোয়া আটপৌরে স্যালাড কী করে বানাতে হয় তারই বর্ণনা দিচ্ছি। এটা বানাতে যেসব মাল-মসলা লাগে সেগুলো আপনার ভাঁড়ারে আর সবজির ঝুড়িতেই আছে– আপনাকে শুধু কিছু লেটিস পাতা কিনে আনতে হবে। আপনার যদি স্যালাড সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জ্ঞানগম্যি থাকে তবে আপনি এখানেই তীব্র কণ্ঠে আপত্তি জানিয়ে বলবেন, কিন্তু অলিভ ওয়েল? সে তো আমাদের ভাঁড়ারে থাকে না! দাঁড়ান বলছি, ওটা বড় আক্রা জিনিস এমনকি খাজা ভেজালটাও কম আক্ৰা নয়। সেকথা পরে আসছে।
বাজার কিংবা বাগান থেকে লেটিস পাতা এনে তার বাইরের পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেবেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাইরের কটা পাতা? যত বেশি ফেলবেন, ভেতরের কচি পাতার গুণে স্যালাড তত সুস্বাদু হবে, কিন্তু তা হলে তো পরিমাণ এত কমে যাবে যে খরচায় পোষাবে না। অতএব আপনাকেই চিন্তা করে স্থির করতে হবে, বাইরের কটা পাতা ফেলে দেবেন। এ ব্যাপারে পাক্কা গিন্নির মতো বড় বেশি কঞ্জুসি করবেন না, কারণ লেটিস অতিশয় সস্তা জিনিস।
ভিতরের যে পাতাগুলো বাছাই করে নিলেন সেগুলো অতি সযত্নে ধুয়ে নেবেন। ধোয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য ওগুলো থেকে ধুলোবালি ছাড়ানো আর কিছু নয়। তার পর পাতাগুলো হাত দিয়ে টুকরো টুকরো ছিঁড়ে নেবেন, এই মনে করুন, টুকরোগুলো যেন তিন ইঞ্চির মতো লম্বা হয়। কিন্তু সাবধান! বঁটি দিয়ে কাটবেন না। যে জিনিস কাঁচা খাওয়া হয় সেগুলো লোহা দিয়ে কাটা উচিত নয়- এ তো জানা কথা। স্টেনলেস স্টিলের ছুরি অবশ্য ব্যবহার করতে পারেন অথবা যাকে বলা হয় ফ্রট নাইফ বা ফল কাটার ছুরি। কিংবা ঝিনুক, কিংবা বাশের ছিলকে দিয়ে। কাঁচা আম মা-মাসিরা যে পদ্ধতিতে কাটেন –বাংলা কথা। কিন্তু লেটিসের পাতা ছিঁড়বেন হাত দিয়েই। এগুলো দরকার হবে পরের জিনিসগুলো কাটবার জন্য।
এইবারে ছেঁড়া পাতাগুলো চিনেমাটির কিংবা শুধু মাটির চ্যাপ্টা থালাতে রাখুন। কাসা বা পেতল সম্পূর্ণ বর্জনীয়। কারণ এতে নেবুর রস আসবে। সবচেয়ে ভালো হয়, ময়দা আঁকার ছাকনির উপর রাখলে। তা হলে পাতার গায়ের জল ঝরে পড়ে পাতাগুলো ফের শুকনো হয়ে যায়।
তার পর মোটা সাদা পেঁয়াজ চাকতি চাকতি করে কাটুন। টমাটো, শসাও চাকতি চাকতি করুন। ঘোট ঘোট নরম লাল মুলো কিংবা খুব নরম সাধারণ মুলোও চাকতি চাকতি করে দিতে পারেন। কাঁচালঙ্কা কুচি কুচি করে দেবেন, যদি বাড়ির লোক কাঁচালঙ্কার ঝাল পছন্দ করেন।
এইবারে সবকিছু- অর্থাৎ লেটিসের ছেঁড়া পাতা ও এগুলো একসঙ্গে রাখুন। তার উপর সরষের তেল ঢালুন। যা, যা, সরষের তেল, যে তেল দিয়ে আমরা তেল-মুড়ি খাই। আপনি বলবেন, অলিভ তেলের কী হল? উত্তরে নিবেদন, স্যালাড বানাবার সময় মার্কিন-ইয়োরোপীয় বিশেষ করে ফরাসিরা মাস্টার্ড পাউডার অর্থাৎ সরষেওঁড়ো অলিভওয়েলের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়, কিংবা আগেভাগে সরষেওঁড়ো জলের সঙ্গে খুব পাতলা করে মিশিয়ে তার সঙ্গে লেটিস পাতা মাখিয়ে নেয়। অলিভওয়েলের আপন গন্ধ ও স্বাদ খুব কম। তার সঙ্গে সরষেওঁড়ো মেশালে ফলে তো সর্ষের তেলই দাঁড়াল অবশ্য আমাদের সরষের তেলের ঝাজ এবং ধক তাতে থাকবে না। অবাঙালি সর্ষের তেলের ঝাজ সইতে পারে না বলেই অলিভ ওয়েল করে। আমরা যখন ওইটেই পছন্দ করি তবে সরষের তেল দিয়ে স্যালাড বানাব না কেন? আমি নিজে তো পুরনো আচারের মজা-সরষের তেলই ব্যবহার করি।
সরষের তেলে সবকিছু আলতো আলতো করে মাখিয়ে নেওয়ার পর তার উপরে ঢালবেন পাতি বা কাগজি নেবুর রস। নুন। সবকিছু ফের আলতো আলতো করে মাখুন। ব্যস্ স্যালাড তৈরি।
নেবুর রসের বদলে অনেকেই ভিনিগার বা সিরকা দেয়। তার কারণ ইয়োরোপে ওই ভিনিগার ছাড়া অন্য কোনও টক বস্তু নেই। নেবুর রসের বদলে যদি ভিনিগার ব্যবহার করেন তবে সেটা জল দিয়ে ডাইলুট অর্থাৎ কম-তেজ করে নেবেন।
প্রশ্নটা, কতখানি লেটিসের সঙ্গে কতখানি পেঁয়াজ, টমাটো, শসা, তেল, নেবুর রস দেব? এর উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে মনে রাখা উচিত, লেটিস পাতাই হবে প্রধান জিনিস, সে-ই যেন বাকি সব জিনিসের উপর প্রাধান্য করে। পাতাগুলো তেলতেলে হওয়ার মতো তেলে মাখানো হবে, কিন্তু জবজবে যেন না হয়। নেবুর রস তেলের এক সিকি ভাগের মতো। বেশি টকটক যেন মনে না হয়; এবং খাবার সময় লেটিস পাতা যেন আর পাঁচটা জিনিসের চাপে আপন স্বাদ না হারায়।
এ স্যালাড অন্য পাঁচটা জিনিসের সঙ্গে খেতে হয়। অর্থাৎ ডাল-ভাত, ভাত-ঝোল, ভাত-মাংস, একগ্রাস মুখে দেবার পর খানিকটা স্যালাড মুখে নিয়ে একসঙ্গে চিবোবেন। স্বাধীন পদ হিসেবে যে স্যালাড খাওয়া হয় সেটাতে মাছ, মাংস কিংবা ডিম থাকে, এবং মায়োনেজ দিয়েই তৈরি করা হয়। (ডিমের হলদে ভাগের সঙ্গে তেল-সিরকা দিয়ে মেখে মেখে সেটা তৈরি করতে হয়; বড্ড খুঁটিনাটি বলে বাজারে তৈরি মায়োনেজ বোতলে পাওয়া যায়, টমাটো সসেরই মতো, যদিও ইটালিয়ান প্রতিদিন তাজা টমাটো সস বাড়িতেই বানায়, আমরা যেরকম বাজারের কারি পাউডার না কিনে নিজেরাই হরেক জিনিস বেটে-গুলে রান্নায় ব্যবহার করি। সেসব স্বাধীন পদের স্যালাড বানাতে এটা ওটা সেটা এবং সময়ও লাগে বেশি তদুপরি সবচেয়ে বড়কথা বাঙালি রান্নার আর তিনটে পদের সঙ্গে ওটা ঠিক খাপ খায় না।
অনেকে আবার তেল-নেবুর রস ব্যবহার না করে লেটিসপাতা-টমাটো-প্যাজ সবকিছু টক দইয়ে মেখে নেন, উপরে গোলমরিচের গুড়ো ছিটিয়ে দেন। আমার তো ভালোই লাগে।
কাবুলিরা ব্যত্যয়। তারা শুধু লেটিস পাতা একঠোঙ্গা মধুতে গুতা মেরে খেয়ে চলে রাস্তায় যেতে যেতে।
আমাদের দেশে শীতকালেও রোদ কড়া বলে লেটিস ভালো হয় না। তাই এদেশে লেটিস ফলাতে জানেন অল্প লোকই। লেটিস ক্ষেত যেন দিনে অল্পক্ষণের জন্য পুবের রোদ পায়, সার যেন বেশি না দেওয়া হয়, এবং জলসেচের পরিমাণ নির্ণয় কঠিন। মোট কথা, লেটিস যেন বড্ড বেশি প্রাণবন্ত না হয়। তাকে যেন খানিকটে জীবন্ত রাখা হয়। লেটিস পাতা পান ও তামাকপাতার মতোই বড় ডেলিকেট লাজুক কোমল প্রাণ। তাই আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বরজের মতো কোনও একটা ব্যবস্থা করে লেটিস ফলিয়ে দেখলে হয়।
এখন সর্বশেষ প্রশ্ন, আমি স্যালাড নিয়ে অত পাঁচ কাহন লিখছি কেন?
প্রথম: স্যালাড জিনিসটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। যে কোনও ডাক্তারকে শুধোতে পারেন।
দ্বিতীয় : বাঙালি গরিব জাত। লেটিস সস্তা এবং স্যালাড বানাতে আর যেসব জিনিস লাগে সেগুলো বাঙালির ঘরে ঘরে কিছু-না-কিছু থাকে। প্রত্যেককে একটি স্যালাড দিতে খর্চা তেমন কিছুই নয়। ডাল ভাত মাছ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি গ্রাস কিংবা দ্বিতীয় তৃতীয় গ্রসে কিছুটা স্যালাড খেলে ওই দিয়ে পেটের কিছুটা ভরে। একটা হাফ-পদও হল। পরে যদি স্যালাডে আপনার রুচি জন্মে যায় তবে আপনি তার পরিমাণ বাড়িয়ে পেটের আরও বেশি ভরাতে পারবেন।
তৃতীয় : স্যালাড এক্সপেরিমেন্ট করে করে অনেককিছু দিয়ে তার পরিমাণ বাড়ানো যায়। আলুসেদ্ধ চাকতি চাকতি করে (এমনকি আগের রাতের বাসি ঝোলের আলুগুলো তুলে নিয়ে, ধুয়ে, চাকতি চাকতি করে), মটরটি সেদ্ধ করে, গাজর বিট ইত্যাদি ইত্যাদি সবকিছুই তাতে দেওয়া যায়। এমনকি ঠাণ্ডা হাফবয়েলড ডিমও চাকতি চাকতি করে দেওয়া যায় তবে ওটা স্যালাড তৈরি হয়ে যাবার পর সর্বশেষে; নইলে ওঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে, অতি আলতো আলতোভাবে মাখাবার সময়ও। অর্থাৎ বাড়ির কোনওকিছু খামকা বরবাদ হয় না। এমনকি আগের রাতের মাছ-মাংস দিয়েও স্যালাড করা যায় তবে সে অন্য মহাভারত, পদ্ধতি আলাদা।
সর্বশেষে পাঠক, এবং বিশেষ করে পাঠিকাকে সাবধান করে দিচ্ছি, স্যালাড এমন কিছু ভয়ঙ্কর সুখাদ্য নয়, (দেখতেই পাচ্ছেন, যেসব মাল দিয়ে স্যালাড তৈরি হয় সেগুলো এমন কিছু মারাত্মক মূল্যবান সুখাদ্য নয় যে আপনি হন্তদন্ত হয়ে স্যালাড তৈরি করে খেয়ে বলবেন, ও হরি! এই মালের জন্য আলী সাহেব এতখানি বকর বকর করল।
মনে পড়ল, এক মহিলাকে আমি কথায় কথায় এক বিশেষ ব্র্যান্ডের সাবান ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছিলুম। দিন সাতেক পরে তার সঙ্গে রাস্তায় দেখা। নাক সিঁটকে বললেন, তা আর এমন কী সাবান! আমি বললুম, ম্যাডাম, আপনি কি আশা করেছিলেন যে ওই সাবান ব্যবহার করার সাত দিনের মধ্যেই আপনার কর্তা আপনাকে নতুন গয়না গড়িয়ে দেবেন! ১৪ ক্যারেটের আগের কথা বলছি।