অপরেশ রমলা ও আমি
আমি প্রথমটা দেখতে পাইনি। বাসে উঠতে যাচ্ছি, একজন মহিলা নামছেন দেখে পথ ছেড়ে দাঁড়িয়েছি। এক পায়ে চটি, ভদ্রমহিলার পায়ের দিকে তাকিয়েই আমার বুকটা একটু শিরশির করে উঠল। মনে হল, এই পা দুটি আমার হাতের মতন, বহুদিন আমি এই দুটি পা আমার হাতের মুঠোয় ধরেছি। চোখ তুলে মুখের দিকে তাকিয়ে ভদ্রমহিলাকে পুরোপুরি দেখে বললুম, তুমি?
রমলা তখন বাস থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। আমার সে বাসে ওঠা হল না। জিজ্ঞেস করলুম, কেমন আছ?
রমলা হেসে সামান্য ডানদিকে ঘাড় হেলিয়ে বললো, আপনি কেমন আছেন?
‘আপনি’ শুনেই বুঝলুম, রমলার পিছন পিছন যে দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ লোকটি নেমেছে, সেই রমলার স্বামী। রমলা কোনোদিনই আমাকে অন্য লোকের সামনে তুমি বলত না। অন্য লোকের সামনে আমি ছিলাম ওর দাদার একজন বন্ধুই।
রমলার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললুম, ভালো আছেন?
অপরেশ রায় মুখে কিছু না বলে ঘাড় হেলালেন। কিন্তু আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। অপরেশ রায়কেও আমি আগে চিনতাম কিন্তু বছর সাতেক দেখিনি, মুখ মনে ছিল না অথচ রমলার পা দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলুম ঠিকই। এই সাত বছরে রমলার পা নিশ্চয়ই খানিকটা বদলেছে, আমারও চোখ বদলেছে নিশ্চিত, তবু মুখের দিকে তাকিয়ে চিনতে পেরেছিলুম।
হঠাৎ চৌরঙ্গিতে এই শেষ বিকেলবেলায় ওদের সঙ্গে দেখা হতে আমার ভালোই লাগল। শেষ যখন দেখেছিলুম, তখন ওর চোখের দুধার বড়ো শুকনো ছিল, এখন পুরো মুখটাই মসৃণ হয়েছে। কী জানি এই ছয়-সাত বছর রমলা কলকাতাতেই ছিল কিনা, আমি ছিলাম না মাঝে দু-এক বছর—তবু, এর মধ্যে কোথাও একদিনের জন্যেও দেখা হয়নি। গত তিন-চার বছর একবারও ওর কথা মনেও পড়েনি বোধহয়। কিন্তু এই মুহূর্তে হঠাৎ মনে হল, রমলা আমার থেকে খুব দূরে সরে যায়নি , চোখের কোণে চিকচিকে হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি বেশ সরল হাস্যে বললুম—বাঃ, বেশ সুন্দর চেহারা হয়েছে তোমার!
অপরেশবাবু, আপনারা কোথায় আছেন এখন?
অপরেশ কোনো কথা না বলে তেমনি হাসিমুখেই দাঁড়িয়ে রইলেন। রমলাই উত্তর দিল, আমরা এখন গড়িয়াহাটায় থাকি। ওঁর অফিস থেকে কোয়ার্টার দিয়েছে।
আপনি এখন কী করছেন?
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই অপরেশ বললেন, এক সেকেন্ড! তারপর স্ত্রীকে ডেকে নীচু গলায় কী যেন বলতে লাগলেন।
আমি ওদের দিকে—সস্নেহে বললে খুব ভারিক্কি শোনাবে কিন্তু, বেশ সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে রইলুম। অপরেশের পাশে রমলাকে ভারী সুন্দর মানিয়েছে। রমলা আগে ছিল রোগা-পটকা। এখন অপরেশের সবল চেহারার পাশে ওকেও খানিকটা স্বাস্থ্যবতী হতে হয়েছে। আমি যে রমলাকে একসময় সত্যি ভালোবাসতুম তা এই মুহূর্তে আবার বুঝতে পারলুম, কারণ ওদের একসঙ্গে দেখে আমার একটুও ঈর্ষা হচ্ছে না। গ্রীষ্মকালে এক গ্লাস ঠান্ডা জল পাওয়ার মতো, ওদের দেখার পর থেকেও আমার বুকের মধ্যে যেন আস্তে আস্তে খুশি গড়িয়ে আসছে। অপরেশকে বিয়ে করে খুবই বুদ্ধিমতীর কাজ করেছিল রমলা—তার বদলে আমাকে বিয়ে করলে বেচারার দুর্ভোগের সীমা থাকত না। স্বাস্থ্য কি এমন নিটোল হতে পারত? না, তার বদলে এতদিনে মুখে পড়ত ক্লান্তির ছাপ—আমিই আমার নিজের জীবন নিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি, সেই জীবন আশ্রয় করে কতদিন শান্তিতে থাকতে পারত রমলা? তা ছাড়া গড়িয়াহাটায় অফিস থেকে পাওয়া কোয়ার্টার—তা জোগাড় করা কোনোদিন আমার পক্ষে সম্ভব হত না। সত্যি রমলা, তুমি যে সুখে আছ, এ দেখে আমারও খুব ভালো লাগছে।
অপরেশ বললেন, আপনারা একটু দাঁড়িয়ে কথা বলুন। আমি এক মিনিট আসছি। আমি রমলাকে জিজ্ঞেস করলুম, কোথায় গেল তোমার স্বামী?
চুরুটের বাক্স কিনতে।
খুব চুরুট খান বুঝি?
হুঁ! আর কোনো বিশেষ নেশা নেই—কিন্তু চুরুট না হলে চলে না। সবসময় হাতে চুরুট থাকা চাই। এক এক দিন চায়ের মধ্যে চুরুটের ছাই পড়ে যায়! মশারির মধ্যে ঢুকেও—
আমি হাসতে লাগলুম। রমলা বলল, ওর বাবাও এমন চুরুট খান—
আমার মনে হল, অপরেশ বোধহয় আমাদের দুজনকে নিরালায় দু-একটা কথা বলার সুযোগ দেবার জন্যই ছুতো ধরে চলে গেল। কিন্তু সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা অপরেশ আর তার বাবার চুরুট খাওয়ার নেশা নিয়েই কথা বলতে লাগলুম।
তা ছাড়া আর কিই-বা বলতে পারতুম! বলা যায় কি, রমলা আমাকে তোমার মনে পড়ে? নাঃ! আমারই ওকে মনে পড়ে না—ওরই বা পড়বে কেন? কিংবা, একথাও কি বলা যায়, তোমার মনে আছে তোমার সেই প্রতিজ্ঞা? তোমাদের ছাদের চিলেকোঠায়, সরস্বতী পুজোর রাত্রে তুমি বলেছিলে, তোমার বুকের বাঁ দিকটা আমার। আমি যখন খুশি দাবি করতে পারি—বুকের ওপরটা বা ভিতর যা ইচ্ছে। না, এরকম দাবি জানাবার ইচ্ছেও আর আমার মনে পড়েনি।
কোনোদিন যদি চুরুট একেবারে ফুরিয়ে যায় তখন কী করে জান? সাদা কাগজ মোটা করে পাকিয়ে—হাতে ধরে থাকে। মাঝে মাঝে কাগজটা মুখে টানার ভান করে, অন্যমনস্কভাবে অবিকল চুরুটের ছাই ঝাড়ার মতো আঙুল দিয়ে টোকা দেয়। নেশাটা মুখের না হাতের…আমার…
রমলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও হাসছিলুম। অপরেশ ফিরে এলেন এর মধ্যে। এবার অপরেশের মুখের হাসিটা আর দেখা যায় না। আমি বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলুম, কোনো বিশেষ কাজে যাচ্ছিলেন নাকি? নইলে, আসুন না, একটু বসে চা খাওয়া যাক। অপরেশ বললেন, না আমার একটু তাড়া আছে।
কত আর সময় লাগবে! একটু চা খেয়ে যাওয়া—
অপরেশ ভ্রূকুটি করে বলল, বাঃ, আমি থাকব কী করে? অলি মাসির বাড়ি আমি যাব বলে কথা দিয়েছি! তুমি একা গেলে কী ভাববেন ওঁরা।
তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, আজ চলি! একদিন আসুন না বাড়িতে!
আমি আর বিশেষ জোর করলুম না! রমলার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে পরে ঘাড় ঘুরিয়ে অপরেশকে একবার নমস্কার জানালুম। অপরেশ ততক্ষণে এগুতে শুরু করেছে।
রমলা ওর বাড়িতে যাওয়ার কথা বলল, অথচ ঠিকানা দিয়ে গেল না। তার মানে ওটা কথার কথা। অথবা ধরেই নিয়েছে আমি যাব না, বা যাবার দরকার নেই আমার।
কিন্তু সেই পড়ন্ত বিকেলে ওদের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হওয়ায় আমার বেশ ভালো লাগছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল ওদের সঙ্গে বসে একটু গল্প করি, প্রচুর হাসাহাসি হোক, অপরেশের সামনে রমলাকে দু-একটা পুরোনো কথা তুলে লজ্জা দিই—যাতে অপরেশও প্রচুর মজা পেয়ে হাসতে পারে।
ছ-সাত বছর ওদের কথা একেবারেই ভাবিনি কিন্তু সেই দেখা হওয়ার পর, একদিন আমি এক বন্ধুকে টেলিফোন করার জন্য গাইডের পাতা ওলটাতে অন্যমনস্কভাবে অপরেশ রায়ের নাম খুঁজতে লাগলুম। অফিস থেকে কোয়ার্টার দিয়েছে যখন, তখন বাড়িতে ফোন থাকা খুবই স্বাভাবিক। গাইডে তিনজন অপরেশ রায়—গড়িয়াহাটের ঠিকানা যার—আমি তার নম্বর ঘোরাতে লাগলুম। এখন দুপুরবেলা—অপরেশের বাড়িতে থাকার কথা নয় যদিও।
রমলা আমাকে কখনও টেলিফোন করেনি কিন্তু গলা শুনেই আমি চিনতে পারলুম। আমি বললুম, রমলা, আমি।
ওপাশে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর শান্তসুরে জিজ্ঞেস করল, এতদিন পর তুমি হঠাৎ ফোন করলে যে?
আমায় চিনতে পারছ তো?
হ্যাঁ। কিন্তু এতদিন পর!
এতদিন পর হঠাৎ সেদিন দেখা হল কিনা। তুমি কেমন আছ?
আমি ভালো আছি। কিন্তু তুমি আর কোনোদিন ফোন করো না।
সে কী! রমলা, আমার তো কোনো খারাপ মতলব নেই। এমনিই তো শুধু—
না, লক্ষ্মীটি। ও তোমার জন্য এখনও কষ্ট পায়।
কে? অপরেশ? আমার জন্য? কেন?
কেন, তুমি জানো না?
আমি কী করে জানব? আমি ওর মনের কথা কী করে বুঝব?
ও ভাবে, তোমার সঙ্গে এখনও আমার লুকিয়ে দেখা হয়।
যাঃ। সাত বছরেও…
অথবা…
অথবা কী?
ও ভাবে, আমি তোমার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে কখনও কাঁদি।
সত্যি কাঁদ নাকি?
আমি টেলিফোনে অনেকখানি হাসি পাঠিয়ে দিলুম রমলার কাছে। বললুম, যতসব পাগলের কাণ্ড! অপরেশকে দেখে মনে হল বেশ বুদ্ধিমান, সপ্রতিভ লোক। সে সাত বছরেও নিজের স্ত্রীকে চিনতে পারল না? সাত বছর আগে যা চুকে গেছে—
হ্যাঁ, চুকেই তো গেছে। কিন্তু, তুমি আর কোনোদিন ফোন করো না লক্ষ্মীটি। আমরা তো দুজনে আর কেউ কারোর নই—তবে কেন আর—
আচ্ছা, ফোন করব না আর কখনও। কিন্তু রমলা, আমার ইচ্ছে ছিল, অপরেশের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হোক—তাহলে হয়তো ওর ভুল ভেঙে যাবে। ও তো আগে সবই জানত। জানত—তুমি ইচ্ছে করেই ওকে বিয়ে করেছ—কেউ তোমাকে জোর করেনি। আমার সাধ্য ছিল না তোমাকে আঁকড়ে রাখি।
প্লিজ, নীলুদা, ওসব কথা থাক। তুমি আমাকে ভুলে যাও। আর কোনোদিন—
লাইন ছেড়ে দিল। আমি দুঃখিত হাতে কিছুক্ষণ রিসিভারটা ধরে রইলুম তবু। কড়-র-র শব্দ হতে লাগল। আমি রিসিভারটা একবার রেখেই আবার তুলে নিয়ে সেই একই নম্বর আবার ডায়াল করলুম। ওপাশ থেকে তুলতেই আমি সঙ্গে সঙ্গে বললুম, রমলা, আবার আমি—
নীলুদা। তুমি আমার সঙ্গে শত্রুতা করতে চাও?
না, রমলা। আমায় বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে সুখী করতে চাই। আমি আর কোনোদিন তোমাকে ফোন করব না। পথে দেখা হলেও এড়িয়ে যাব। সত্যি রমলা, তোমাদের জীবনে একটুও ব্যাঘাত করার ইচ্ছা নেই আমার। ভেবেছিলুম বন্ধুর মতো একটু দেখাশোনা করে গল্প-গুজব করব। তাও দরকার নেই। কিন্তু অপরেশের কথা শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল, সে বুদ্ধিমান ছেলে, লেখাপড়া শিখেছে—কিন্তু এ কীরকম মন তার। সাত বছর আগেকার ব্যাপার সে মনে পুষে রেখেছে? সেদিন তো দেখে কিছু বুঝতে পারিনি।
ওই যে সেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর, ইচ্ছে করে একটুক্ষণ আড়ালে চলে গেল। ধরেই নিয়েছিল, তোমার সঙ্গে আমি গোপন দুঃখের কথা বলব।
গোপন দুঃখ? তা নিয়ে আবার মুখে কথা বলা যায় নাকি? কী সর্বনাশ। অপরেশ কি তোমাকে কষ্ট দেয়?
মোটেই না। নিজেই মন খারাপ করে। প্রায়ই বলে, আমি ওকে ভালোবাসি না। কারণ আমি নাকি তোমাকে ভুলতে পারি না।
ইশ, ছি ছি। আচ্ছা, আমি আর এর মধ্যে থাকতে চাই না। আমি আর কোনোদিন তোমাদের মধ্যে আসব না। অপরেশ কোন অফিসে চাকরি করে?
কেন? তুমি জানতে চাইছ কেন?
কোনো ভয় নেই তোমার, রমলা। আমি তোমাকে আমার পুরোনো গলায় বলছি, কোনো ভয় নেই। আমাকে প্রায়ই নানা কাজে অনেক অফিসে যেতে হয়, অপরেশের অফিসের নামটা জেনে রাখি—সেখানে কোনোদিন যাব না। যাতে কোনোদিন ওর সঙ্গে হঠাৎও আর দেখা না হয়।
আলফা এক্সপোর্ট। স্টিফেন হাউসে অফিস।
আচ্ছা রমলা, আমি ছেড়ে দিচ্ছি এবার। রমলা আমরা অনেক দূরে সরে গেছি।
এতদূর থেকে কেউ কারুর দিকে হাত বাড়াতে পারি না? আমার দিক থেকে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। যাই—আর কোনোদিন হয়তো দেখা হবে না।
নীলুদা, তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ তো?
ক্ষমার কথা উঠছে কীসে? রমলা, ছেলেবেলাতে আমি যা করেছি—তার জন্য আমি কোনোরূপ অনুতাপও করি না, আবার অতৃপ্তির হাহাকারও নেই। ছেলেবেলায় যা করেছি, তা ছেলেবেলাতেই মানায়, এখন যেমন মানায়—সেই রকম ভাবেই বেঁচে আছি। কোথাও কোনো দুঃখ নেই। তুমি ভালো থেকো রমলা।
আচ্ছা!
এর পরদিন আমি যা করলুম, তার ঠিক যুক্তি হয়তো দেখাতে পারব না। আমি লোকটা তেমন খারাপ নই—স্বাভাবিক মানুষ যেমন হয়—সেই রকম। তবে, নিজের কয়েকটি ইচ্ছার আমি নিজেই যুক্তি খুঁজে পাই না। যেমন, একদিন আমি পার্কে আলুকাবলি খেয়ে বেরিয়েছি, খুব ঝালে ঠোঁট উস উস করছি—দুহাতে লঙ্কার গুঁড়ো, নুন আর ঝোল লেগে আছে—হাত মোছা হয়নি। কোথায় হাত মুছব ভাবছিলুম—পকেট থেকে রুমাল বের করে মোছা যায় কিন্তু সেই রুমাল দিয়ে ভুল করে যদি কখনও মুখ মুছতে যাই—তবে চোখের সর্বনাশ হয়ে যাবে। কী করব ভাবছিলুম, সেই সময় একটি সুবেশ যুবকের দিকে আমার চোখ পড়ে। চমৎকার চেহারা, খুব দামি পোশাক পরা—পরিচ্ছন্ন চেহারার যুবকটি পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। হঠাৎ আমার ইচ্ছা হল, সেই যুবকটির গায়ের জামায় হাত দুটি মুছে দিই! ভাবতেই আমার হাসি পেল, এখন সোজা গিয়ে যদি ওর ফর্সা জামায় আমার হাত দুটি ঘষে দিই—কী অবস্থা হবে? যুবকটি হয়তো কোনো নারীর জন্য অপেক্ষা করছে—তাহলে … আমার ইচ্ছাটা এমন প্রবল হল যে, আমি ওর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালুম। কিন্তু সামনা-সামনি হাতে ঘষে দেব তত সাহস আমার নেই। কিন্তু প্রবল ইচ্ছা হতে লাগল। ছেলেটির চোখে কালো গগলস—সেই দেখেই কিনা, হঠাৎ আমার মনে হল, ছেলেটি আমার শত্রু, এর ওপর প্রতিশোধ নিতেই হবে—অথচ ওকে আমি কোনোদিন দেখিনি।
যুবকটি হাঁটতে শুরু করতেই আমি ওকে অনুসরণ করলুম। দশ মিনিট হাঁটল সে—আমিও ওর পিছনে পিছনে যাচ্ছি। তখন আর আমার ফেরার উপায় নেই, তাহলে আমি ওর কাছে হেরে যাব। আমার হাতের পাঞ্জা দুটি খোলা—তখনও লঙ্কা তেঁতুলের টক লেগে আছে। হাজরার মোড় থেকে ছেলেটি একটি বাসে উঠল। সেই আমার সুযোগ—আমিও বাসে উঠে পড়লুম—খুব ভিড় ছিল, ভিড় ঠেলে আমি ওর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়েছি এবং এক সুযোগে ওর পিঠে এঁকে দিয়েছি, আমার দু হাতের ছাপ। তারপরেই জয়ের গর্বে মন ভরে তুলতে—আমি নেমে পড়েছি বাস থেকে।
বোধহয় সেইরকম কোনো যুক্তিতে, আমার বার বার মনে হতে লাগল, অপরেশের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব করা দরকার। সে আমাকে শত্রু ভাবছে, অথচ আমি তো সত্যই তার বন্ধু। রমলাকে সে বিয়ে করে সুখী করেছে—সে আমার বন্ধু হবে না? আমি রমলাকে এক সময় পাগলের মতো ভালোবাসতুম—এখনও ভালোবাসি নিশ্চয়ই। যদি দেখতুম রমলার স্বামী একজন কুচ্ছিত গরিব লোক কিংবা মাতাল লম্পট জুয়াড়ি—তার ওপর আমি নিশ্চিত রেগে যেতুম, সে হত আমার শত্রু। কিন্তু অপরেশ অমন দৃপ্ত স্বাস্থ্যবান—সে রমলাকে স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে—সে আমার শত্রু হবে কেন?
এতসব ভাববার আগেই কিন্তু আমি আলফা এক্সপোর্ট কোম্পানির অফিসে ঢুকে পড়েছি। আলাদা ঘরের সামনে অপরেশের নাম লেখা—বেশ বড়ো অফিসারই মনে হল। বাইরের কোনো বেয়ারার হাত দিয়ে স্লিপ পাঠালে যদি অভিমানী অপরেশ আমার সঙ্গে দেখা করতে না চায়, এই ভেবে আমি দরজা খুলে সোজা ঘরে ঢুকে পড়লুম।
আমাকে দেখে অপরেশ নিশ্চিত খুবই অবাক হয়েছেন—কিন্তু অফিসাররা মুখের বিস্ময় লুকোতে জানে। ফাইলে মুখ গোঁজা ছিল, মুখ তুলে নির্বিকারভাবে বললেন, কী ব্যাপার?
আমি বললুম, পাশের অফিসে আমার এক বন্ধু কাজ করে, তার ওখানেই আপনার নাম শুনে ভাবলুম একবার দেখা করে যাই। খুব বেশি ব্যস্ত ছিলেন নাকি!
না খুব নয়।
অপরেশ তখনও আমাকে বসতে বলেননি। সে অভিমান করে আছে। কিন্তু আমার এসব ছোটোখাটো ব্যাপারে কিছু মনে করলে চলে না। আমি নিজেই চেয়ার টেনে বসলুম। বললুম, সেদিন পথে দেখা হল কিন্তু আপনার সঙ্গে ভালো করে কথাই হল না।
হুঁ।
এ অফিসে কতদিন আছেন?
একটা কথা আগে জিজ্ঞেস করে রাখি। আপনি নিশ্চয়ই আপনার ভাইপো বা বন্ধুর ভাইয়ের জন্য চাকরির উমেদারি করতে আসেননি? এখন লোক নেওয়া হচ্ছে যদিও কিন্তু আমাদের অফিসে ওসব চলে না।
এ যে স্পষ্ট অপমান। এ কথায় আমার খুব রেগে ওঠাই উচিত ছিল বোধহয়। তবু হেসে বললুম, না আমি কারুর চাকরির জন্য আসিনি। আমার নিজের জন্যও নয়। আমি আন্তরিকভাবেই দু-একটা কথা বলতে এসেছিলাম।
আমার কাছে? হঠাৎ!
আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করছেন না। তার কারণ হয়তো—
কোনোই কারণ নেই। আপনার সঙ্গে আমার কোনোদিনই ভালো করে পরিচয় ছিল না—হঠাৎ অর্ধপরিচিত লোকদের সঙ্গে আন্তরিক আলোচনা করা আমার স্বভাবও নয়। আমার স্ত্রীর মাকে আমি মা বলে ডাকি, তা বলে আমার স্ত্রীর সব বন্ধুদেরও আমি বন্ধু ভাবব, তার কী মানে আছে?
‘স্ত্রীর বন্ধু’ বলতে আপনি ঠিক কী ভাবছেন?
ঢং ঢং করে বেল টিপে অপরেশ বেয়ারাকে ডাকলেন। তারপর রুক্ষ গলায় বললেন নন ফেরাস মেটালের ফাইলটা এখনও পেলাম না কেন?
অপরেশের সঙ্গে ওর অফিসে এসে দেখা না করলেই ভালো হত—অফিসের বাইরে ছুটির পর দাঁড়িয়ে থাকাই উচিত ছিল আমার। এইসব অফিসারদের ব্যবহার এমন হাস্যকর হয়—যতক্ষণ নিজের কামরায় বসে থাকে! বাইরে বেরুলেই এরা সাধারণ মানুষ কিন্তু নিজের এই পার্টিশন করা ঘরের মধ্যে টেবিলের উলটোদিকে নিজের ঘুরোনো চেয়ারে বসলেই আর কিছুতে মুখের ভাব সরল করতে পারে না। কার্টুনের মতো মুখভঙ্গি করে থাকে। অপরেশ আমার দিকে ফিরে আবার বললেন, বলুন।
আমি চেয়ারটাকে টেবিলের আরও কাছে টেনে আনলুম। আমার মুখে হাসি। বললুম, আপনার সময় জরুরি। সুতরাং অল্প সময়ে স্পষ্ট করে কথা বলে যাই। সেদিন আপনাদের দেখে একটা কথা মনে হল। আপনি আমাকে পছন্দ করছেন না। না করুন, কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু মনে কোনো জ্বালা রাখবেন না। রমলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল—একথা জেনেও আপনি ওকে বিয়ে করেছেন। কিন্তু তারপর আর ওর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ছেলেবেলায় এরকম বন্ধুত্ব অনেকেরই থাকে—আপনারও হয়তো কোনো মেয়ের সঙ্গে ছিল। বিয়ের পর আর ওসব কে মনে রাখে? রমলাকে আমার মনেও পড়ে না।
আপনি এসব কথা আমাকে বলতে এসেছেন কেন দয়া করে সেটা জানাবেন কি? রমলাকে আপনি মনে রেখেছেন কি রাখেননি এটা শুনে সে দুঃখিত বা খুশি হতে পারে—কিন্তু আমার কি করার আছে? আমার স্ত্রীর সব ব্যাপারে আমি মাথা ঘামাব—এরকম আমি হীন নই। আপনার সঙ্গে যদি তার গোপনে সেন্টিমেন্টাল অ্যাফেয়ার থেকেই থাকে—তাতেই বা—
আমি হঠাৎ টেবিলে দুম করে একটা ঘুষি মেরে চেঁচিয়ে বললুম, যদি বলছেন কেন? বলছি না, নেই! কিছু নেই! আমার মুখ দেখে বুঝতে পারছেন না?
অপরেশের মুখ আরও কঠিন হয়ে উঠল। অহংকারী গলায় বললেন, এটা একটা অফিস, দয়া করে মনে রাখবেন। নাটক করার জায়গা নয়—
এখনও মনে হচ্ছে বুঝি নাটক করছি?
আপনি আমার কাছে মহত্ত্ব দেখাতে এসেছেন, আপনি প্রেমিক আর আমি স্বামী। অর্থাৎ আপনি হলেন নায়ক, আমি ভিলেন। আপনার আত্মত্যাগ কী অসামান্য—রমলাকে আপনি আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। এখন আবার এসেছেন উদারতা দেখাতে—আপনি ব্যর্থ প্রেমিক—আপনি এসেছেন নায়িকাকে সুখী করতে! আমার কিছু যায় আসে না, আপনি রমলার সঙ্গে ব্যভিচার করুন কী মনের দুঃখে আত্মহত্যা করুন, আমার কিছু যায় আসে না। দয়া করে শুধু আপনার ওই ফিলথি ফেস আমাকে আর দেখাবেন না।
অপরেশবাবু শুনুন—
আপনি যদি এখন চলে না যান, আমাকে ইংরেজিতে গেট আউট বলতে হবে। সেটা খুবই কর্কশ শোনাবে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলে ভর দিয়ে অপরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলুম।
সেই হাসি দিয়ে আমি ওকে বললুম, তুমি একটা বিষম বোকা লোক।
সেখান থেকে বেরিয়ে আমি সোজা চলে এলাম গড়িয়াহাটায়। ঠিকানা খুঁজে পেতে দেরি হল না। তেতলায় তিনটে ঘরের ফ্ল্যাট। রমলা দরজা খুলতেই আমি জোর করে ঢুকে পড়লুম।
বিবর্ণ মুখে রমলা বলল, নীলুদা, একি সর্বনাশ করতে এসেছ আমার?
আমি দুহাতে জড়িয়ে ওকে বললুম, মিলু, আমাকে দয়া কর, দয়া কর। সাত বছর তোমাকে দেখিনি, আমি তো বেশ ছিলুম। কিন্তু সেদিন তোমাকে একবার দেখে আমার বুকের মধ্যে আবার সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। আমি আর থাকতে পারছি না। এখন বুঝতে পারছি, মিলু, এই সাত বছর আমি তোমার কথাই ভেবেছি। তোমাকে ছাড়া আমি কী করে বাঁচব মিলু?
না, না, নীলুদা, ও যে-কোনো সময়ে এসে পড়বে, এখন যাও, তোমার পায়ে পড়ি—
না, আসবে না। অফিস ছুটি হতে অনেক দেরি। তার আগে আমি তোমার সামনে বসে একটু কথা বলতে চাই।
সাড়ে চারটের সময় আমার ছেলেকে আনতে যেতে হবে স্কুল থেকে। নীলুদা, তুমি যাও।
সাড়ে চারটেরও একঘন্টা দেরি। মিলু, আমাদের আগেকার সবই কি মিথ্যে হয়ে গেল?
নীলুদা, তুমি কেন বিয়ে করোনি? কেন আমাকে ভুলে যাওনি। এ আমি সহ্য করতে পারব না।
আমি আর অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে পারি না। আমি আজ তোমার কাছে আমার দাবি জানাতে এসেছি। তোমার বুকের বাঁ দিক আমার ছিল। আমি আমার জমি আবার উদ্ধার করে নিতে চাই।
রমলার মসৃণ, সৌরভময় শরীর আমার বাহুর মধ্যে। আমি বুঝতে পারলুম ওর শরীর কাঁপছে। হয়তো আমার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়—কিন্তু ওর একটা হাত আমার পিঠে। আমি ওর মুখ উঁচু করে কপালে ও ঠোঁটে চুমু খেলুম। মনে হল, ওর একটা ঠোঁট ঠান্ডা, একটা ঠোঁট উষ্ণ। আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এলুম।
রমলা ঠোঁটে হাত চেপে আর্তকণ্ঠে বলল, না, না, আমি পারব না, আমার ঘর সংসার সব ভেসে যাবে। আমি পারব না। তাহলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। কিন্তু আমার ছেলে আছে—
রমলার পায়ের কাছে বসে বললুম, মিলু, এবার তোমার পা দুটো আমার বুকের ওপর রাখি। বিশ্বাস করো, আমি সাত বছরে একটুও বদলাইনি। আমি দুর্বৃত্ত ডাকাত হয়ে যাইনি, কিছুই কেড়ে নেব না জোর করে। …আমি নিজেকে বুঝতে পারি না …কাল পর্যন্ত জানতুম, আমি তোমাকে সম্পূর্ণ ভুলে গেছি, তোমার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই—কিন্তু আজ অপরেশের সঙ্গে দেখা করার পর—
তুমি ওর সঙ্গে দেখা করেছিলে? কেন? তবে যে আমাকে কথা দিয়েছিলে—
জানি না। কেন যে দেখা করতে গেলাম জানি না। কিন্তু অপরেশ আমাকে অপমান করল—
রমলা আমার বুকের ওপর এসে হুহু করে কাঁদতে লাগল। ফিসফিস করে বলল, আমিও তোমাকে ভুলতে চেয়েছিলাম, ভুলতে পারিনি, অনেক চেষ্টা করেছি—ও আমার মুখ দেখে ঠিকই বুঝতে পারত—কিন্তু তুমি আবার কেন এলে? কেন?
জানি না। এক ঘন্টা আগেও ভাবিনি, তোমার কাছে কখনও আবার আসব। কিন্তু দেখলুম অপরেশ নির্বোধ।
সাত বছর আগে তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলে কেন?
সে কথা সাত বছর আগে জানতুম। এখন ভুলে গেছি! এই সাত বছরে তুমি আরও সুন্দর হয়েছ। কিন্তু তোমার শরীর এখনও আমার কাছে ঠিক সেই রকম চেনা।
তোমার চেহারা এমন রুক্ষ হয়ে গেছে কেন?
যদি বলি তোমার জন্য, তাহলে কি খুশি হবে? কিন্তু তা বোধহয় সত্যি নয়। মিলু, এখন যদি অপরেশ এসে পড়ে?
তাহলে আমাকে বিষ খেয়ে মরতে হবে—
না, না, তুমি মরবে কেন? কিন্তু আমাকেও যেন জানালা দিয়ে লাফাতে বলো না। তিনতলা থেকে আমি লাফাতে পারব না। বাথরুমেও লুকোতে পারব না। বাথরুমের মধ্যে আমি ধরা পড়তে চাই না। খাটের তলায়ও ঢুকে থাকা অসম্ভব।
ওখানে নিশ্চয়ই আরশোলা আছে।
নীলুদা, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ, সত্যি করে বলো?
আমি রমলার চুলের মধ্যে হাত বুলতে বুলতে বললুম, অপরেশ আমাকে আসতে বলল।
কী।
আমি অপরেশের কাছে গিয়েছিলাম। দেখলুম, ও একটা বোকা অহংকারী। ও আমার মুখ দেখে বুঝতে পারল না যে, আমি সত্যি কথা বলেছি! ও আমাকে অপমান করে সুখী হতে চায়। যেমন, ও তোমাকে চিরকাল সন্দেহ করেই সুখে থাকবে। ও তোমার ওপর অত্যাচার করবে না কোনোদিন। তোমাকে সন্তান দেবে, সম্পদ দেবে—তোমাকে ভালোবাসবে—কিন্তু সন্দেহ করে যাবে বহুদিন, সারাজীবন। আমার কাছ থেকে তোমাকে জয় করে নিয়েছে—এটা যেমন ওর গর্ব, তেমনি স্বামী হিসেবে তোমাকে সন্দেহ না করলে ওকে মানায় না—এ কথাও ও জানে। অর্থাৎ তোমার গোপন প্রেমের দুঃখ সত্ত্বেও—সবল সুস্থ স্বামী হিসেবে ও তোমাকে অধিকার করে আছে—এই হবে ওর সারাজীবনের অহংকার।
নীলুদা, তুমি কী বলছ।
ঠিক বলছি। ওর কাছ থেকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ আমার মনে হল, তাহলে আমিও বা কেন ক্ষতি স্বীকার করবো। আমি চাই তোমাকে দেখতে, আমি চাই তোমাকে ছুঁতে, তোমার বুকের গন্ধ শুঁকতে। সন্দেহ যখন ও করবেই—তখন আমি কেন ফিরে আসব না? শুধু গোপনতা রক্ষা করাই যথেষ্ট। অপরেশ এমন দুর্বল নয় যে, দুপুরে হঠাৎ অফিস থেকে ফিরে এসে স্ত্রীর ওপর গোয়েন্দাগিরি করবে।
রমলা আমার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ব্লাউজের বোতাম আঁটতে আঁটতে বলল, কিন্তু আমি পারব না। এরকম আমি কিছুতেই পারব না। তুমি ওর দিকটাই ভেবে দেখছ, আমার কথা ভাবছ না? আমি কেউ নই, আমি একটা খেলনা? এতদিন আমি মনে মনে জানতাম, আমি বিয়ের পর থেকে ওর সঙ্গে কোনো ছলনা করিনি। মনে মনে তোমাকে ভুলতেই চেয়েছি। কিন্তু এখন ওর সঙ্গে অভিনয় করতে হবে নিয়মিত—সে গ্লানি আমি সইব কী করে?
তবে কি তুমি আমার সঙ্গে চলে আসবে?
কোথায়? সেদিন কাপুরুষের মতো দূরে সরে গিয়েছিলে, আজ আর কোথায় যাব! আজ তোমার সঙ্গে যেতে আমাকে যত মূল্য দিতে হবে—ভালোবাসার জন্য ততটা কি মূল্য দেওয়া যায়? না, যায় না!
ঠিক। শুধু ভালোবাসার জন্য কে আজকাল দুঃখকষ্ট সহ্য করতে চায়। অপরেশ জানে না, প্রেমিকরা আজকাল আর নায়ক নয়, স্বামীরাই নায়ক! নাটক নভেলে সেই পুরাতন ব্যাপার দেখা গেলেও জীবন এখন বদলে গেছে। প্রেমের জন্য কে আর আত্মত্যাগ করতে চায়। সব প্রেমিকই এখন ব্যর্থ প্রেমিক।
আমি আর একটা চুমু খেয়ে মিলুর চোখের জল মুছে নেব ভেবেছিলুম—এমন সময় দরজায় ধাক্কা পড়ল। মিলু ঝট করে ঘুরে সরে দাঁড়িয়ে বলল, এবার? এবার আমার কী হবে?
আমি জিজ্ঞেস করলুম, অপরেশ নাকি?
নিশ্চয়ই।
যাঃ, তা হতেই পারে না। প্রতিবেশী হতে পারে, কোনো সেলসম্যান বা তোমার ঝি নেই।
হিংস্র চোখে রমলা বলল, আমি ওই আওয়াজ চিনি। শেষে তুমি আমার সর্বনাশ করে গেলে।
সর্বনাশ কী মিলু। আমি তো তোমার পাশেই আছি!
রমলার চেহারা কী রকম হিংস্র হয়ে উঠেছে। বিস্রস্ত চুল, অল্প অল্প কান্নায় ফুঁসছে। দরজায় আবার ধাক্কা পড়তেই আমি দরজাটা খুলতে এগিয়ে গেলুম।
রমলা বললো, চুপ।
আমি বললুম, তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দেওয়াই তো সবচেয়ে স্বাভাবিক।
রমলা অল্প অল্প কান্নার আওয়াজ করতে করতে বলল, তুমি আমার কেউ নও। শুধু শুধু তুমি আমার সঙ্গে খেলা করতে এসে সর্বনাশ করে গেলে। আমি তোমাকে কোনোদিনও ভালোবাসিনি।
কিন্তু আমি এ ঘরে প্রথম ঢোকার পরই তুমি আমার আলিঙ্গনে ধরা দিয়েছিলে।
চুপ। বলেই পাগলাটে ধরনের রাগে রমলা কী একটা পেপারওয়েট না অন্য কোনো ভারী জিনিস ছুড়ে মারল আমার দিকে। ওর ব্যবহার এমনই অস্বাভাবিক যে আমি মুখটা সরিয়ে নিইনি। সোজা এসে সেটা আমার কপালে ও নাকে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলেও মনে হল ভাগ্যিস চোখে লাগেনি! আমার সাধারণ শরীর, তাই নাক দিয়ে বেশ রক্ত বেরিয়ে এল। আমি রুমাল দিয়ে নাকটা চেপে ধরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলুম। রমলা আরও কি একটা যেন ছুড়ে মেরেছে আমাকে। কিন্তু ততক্ষণে আমি দরজা খুলে দিয়েছি।
একটা ফুটফুটে ছ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে, অপরেশ নয়। রমলার ছেলে—একাই বা কারুর সঙ্গে ফিরে এসেছে। ভারী সুন্দর দেখতে হয়েছে তো ছেলেটাকে। মায়ের মুখ পেয়েছে।
ছেলেটা ঘরে ঢুকতেই, ঘরের কোণ থেকে এগিয়ে এল রমলা। রমলার কপালের টিপটা ধেবড়ে গেছে, চোখের পাশে শুকনো কান্না। কিন্তু এতটুকু ছেলের চোখে কি এসব ধরা পড়বে?
রমলার মুখের চেহারা আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। জিজ্ঞেস করল, তুই কার সঙ্গে এলি?
বিলটুদের গাড়িতে। তুমি এলে না।
নীলুদা, তুমি একটু বেঞ্জিন লাগাবে?
আমি হেসে বললুম, না, এমন কিছু লাগেনি। আমি যাই। আমি ছেলেটার চুলে হাত দিয়ে একটু আদর করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম—রমলা পেছন থেকে তাকিয়ে আছে কিনা তা দেখারও ইচ্ছে হল না একবার।