অপরাধ

অপরাধ

চাপা গলার আওয়াজ। চাপার থেকে একটু নিচেই হবে। অনেকটা ফিসফিসানির মতো। আওয়াজ আসছে বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে। বাইরে কেউ কথা বলছে? এখনও ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। রাত চলে গেলেও তার ছায়া রয়ে গেছে। এই ছায়ামাখা ভোরে কে কথা বলছে?

ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। লাগবারই কথা। একেই মফঃস্বল শহর। তার ওপর আমাদের বাড়ির এদিকটায় গাছপালা একটু বেশি। আমার ঠাকুরদা শহর থেকে একটু সরে এসে নিরিবিলিতে বাড়ি করেছিলেন। গাছগাছালি, দিঘি, নির্জনতা অনেকটা কমে গেলেও কিছুটা তো রয়ে গেছে। আমি গায়ের চাদরটা ভালো করে টেনে নিলাম। এটা আমার ঘর। সেই স্কুলবয়েস থেকে এ ঘরে থাকি। এটা আমার রাজত্ব। আমার লেখাপড়া, আমার গান, আমার স্বপ্ন, আমার কান্নার সাক্ষী। এক সময় ঘরটা খুব অগোছালো করে রাখতাম। খাটে জামাকাপড়, বইখাতা স্তুপাকৃত হয়ে থাকত। মা বকাবকি করত।

‘মেয়েদের ঘর অগোছালো থাকা অলক্ষুণে।’

আমি হেসে বলতাম, ‘কী হয়? পরীক্ষার কোয়েশ্চন শক্ত হয়?’

মা গজগজ করতে করতে বলত, ‘দেখবি কী হয়।’

আমি মাকে খেপানোর জন্য বলতাম, ‘বলো না কী হয়?’

মা আমার জামা কাপড় ভাঁজ করতে করতে বলত, ‘মা মারা যায়।’

আমি রেগে বলতাম, ‘যত সব পচা সংস্কার।’ তবে সঙ্গে সঙ্গে নিজে উঠে ঘর গোছাতে শুরু করে দিতাম। মা মুচকি হাসত।

মা মারা যাওয়ার পর ঘর আমাকেই গোছাতে হয়। তবে এখন তো আমি আর স্কুলে পড়া ছোটো মেয়ে নই, এখন আমি ডাক্তার আঁখি সরকার। আমার বয়স ছাব্বিশ। যদিও এই ঘরে আমি থাকি খুব কম। কলকাতার হাসপাতালে কোয়ার্টার পেয়েছি। সেখানেই থাকতে হয়। এতদূর থেকে যাতায়াত করে চাকরি করা যাবে না। হাসপাতালের ডাক্তারদের ডিউটির কোনো ছিরিছাঁদ নেই। তাই সপ্তাহ শেষে আসি। বাবার কাছে থেকে যাই।

আমার বাবা সুকুমার সরকার। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী। বয়স চৌষট্টি বছর তিনমাস। চেহারা ভালো। মোটাও নয়, আবার রোগাও নয়। এই ধরনের চেহারার পুরুষমানুষের শরীরে অসুখবিসুখ কম ধরে। মেদ কম, আবার রোগাভোগাও নয়। বাবার কিন্তু অসুখ হয়েছে। গত চার বছরে দু-দুটো হার্ট অ্যাটাক। প্রথমটা বড়, দ্বিতীয়টা ছোট। ডাক্তার বলেছে, তৃতীয় অ্যাটাক ছোট-বড় যাই হোক সেটা হবে বিধ্বংসী। যুদ্ধবিমানের মতো বোমা ফেলে চলে যাবে। কিছু করার থাকবে না। স্বাভাবিক ভাবেই শরীরের দিক থেকে বাবা নড়বড়ে। কিছুদিন হল বাবার চিন্তা ভাবনাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। নড়বড়ে সমস্যা। সেই সমস্যা বাড়ছে। শুক্রবার রাতে বাড়ি এসে খবর পেলাম, বাবা ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়িতে ঢুকতেই উশীদি খবরটা দিল। উশীদি সোম থেকে শুক্রবার এ বাড়িতে থেকে বাবাকে দেখাশোনা করে। শুক্রবার বা শনিবার আমি এলে বাড়ি চলে যায়। দুটো রাত কাটিয়ে আবার ফেরে সেই সোমবার। তবে কোনো কোনো সপ্তাহে আমি আসতে পারি না। ফোনে জানিয়ে দিলে উশীদি থেকে যায়।

উশীদির মুখে ওষুধের ঘটনা শুনে আমি বিরক্ত হলাম। বললাম, ‘আগে জানালে না কেন? আমাকে ফোন করতে পারতে।’

উশীদি বলল, তাহলে উনি ভাবতেন আমি তোমাকে নালিশ করেছি। এখন তুমি নিজের চোখে দেখে বলবে। আমি তো জানতাম, আজ না হোক কাল তুমি আসছ।’

কথাটা পুরো মেনে নেওয়া যায় না। ওষুধ একটা জরুরি বিষয়। তারপরেও আমি চুপ করে গেলান। উশীদির সঙ্গে তর্ক না করাই ভালো। সে-ই তো বাবাকে দেখে। বেঁকে বসে কাজ ছেড়ে দিলে বিপদে পড়ব। আজকাল বিশ্বাসী লোক পাওয়া কঠিন। যেখানে বাবা ছাড়া বাড়িতে কেউ থাকে না। শুক্রবার রাতেই বাবার সঙ্গে কথা বললাম। ঘটনা রাগারাগি করবার মতো। তারপরেও রাগারাগি কিছু করিনি। ঠান্ডাভাবেই বলেছি। সাড়ে চারবছর আগে মা মারা যাওয়ার পর আমাদের বাড়িতে রাগারাগি, চেঁচামেচির পাট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মায়ের রাগ একটা ভয়াবহ ঘটনা ছিল। ঘটত তিন-চার মাস অন্তর। কখনও সেটা বেড়ে ছ’মাসও হয়েছে। বাকি সময় একেবারে নর্মাল। মা রাগ করত বাবার ওপর। রেগে পাগলের মতো আচরণ করত। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারাত যেন। জিনিসপত্র ভেঙে, নতুন শাড়ি ছিঁড়ে ফেলে, বাবার অফিসের কাগজে আগুন ধরিয়ে, দেয়ালে কপাল ঠুকে এক তুলকালাম কাণ্ড। কোনো কোনোদিন গায়ের কাপড় খুলে ফেলত। বাবা তাড়াতাড়ি মাকে টানাহেঁচড়া করে ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে দরজা দিত। বাইরে থেকে মায়ের চিৎকার শুনতে পেতাম। ‘দেখো, আমাকে নেংটো করে দেখো। আমি কম কীসে? বলো আমি কোথায় কম?’

আমি কাঁদতে কাঁদতে কানে আঙুল দিতাম। মনে হত, মা পাগল হয়ে গেছে। বড় হয়ে জেনেছি, ঘটনা তাই। এটা একধরনের স্কিৎজোফেনিক অ্যাটাক। অল্প সময়ের জন্য হয়। ইনঅ্যাপ্রোপিয়েট বিহেভিয়ার বা আচরণে অসঙ্গতি এই রোগের সিম্পটম্। হ্যালোপিরিডল বা ক্লোরোপ্রোমাজিন গ্রুপের ওষুধ কাজ করে। তবে যেহেতু আক্রমণ স্থায়ী নয়, রোগ ধরা মুশকিল। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেও বোঝা যায় না। বাড়ির লোকের কথার ওপর নির্ভর করে ওষুধ দিতে হয়। সেটা আবার আর এক ফ্যাকড়া। অনেকে মিথ্যে করে বউকে পাগল বানাতে চায়। যাই হোক, ছোটবেলায় মায়ের ওই রুদ্রমূর্তিতে ভয়ে পেয়ে কাঁদতাম। তারপরেও ভয় করত। পরে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। আরও বড় হয়ে মায়ের রাগের কারণ জেনেছি। তখন অবশ্য আমি বেশিরভাগ সময়েই বাড়ি থাকি না। কলকাতার মেডিকেল কলেজের হস্টেলে থেকে পড়ি। আমি জানতাম, এইভাবে চলতে পারে না। এই রাগ মাকে একদিন বিপদে ফেলবে। মাকে আমি সেকথা বলেওছিলাম।

‘মা, তুমি আলাদা হয়ে যাও।’

মা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কী বলছিস মুনা! এই বয়েসে ডিভোর্স নিতে বলছিস!’

আমি বলি, ‘কম বয়েসেই নেওয়া উচিত ছিল। তখন পারোনি বলে এখনও পারবে না তা তো হয় না।’

মা মাথা নামিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘আমি জেনেছি তো অনেক পরে। তোর বয়স তখন সবে দশ বছর। পরপর তিনদিন তোর বাবা রাতে বাড়ি ফিরল না…থাক ওকথা আজ তোর বাইশ বছর বয়স। এতদিন যখন সহ্য করেছি বাকি দিনগুলো করে নেবে।’ কথা শেষ করে মা মাথা নিচু করেই থাকল।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তুমি মাথা নামাচ্ছ কেন? তুমি তো অপরাধ কিছু করনি। অপরাধ করেছে বাবা। আর আমার বয়স বাইশ হয়েছে তো কী? সন্তানের বয়স বাইশ হলে কি বিবাহবিচ্ছেদ নিষেধ? কলকাতায় আমি আর তুমি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকব। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। এখন না হয় ঘর ছোট, পরে বড় কোয়ার্টার পাব।’

মা বলল, ‘ছিঃ বাবার সম্পর্কে ওভাবে বলছিস কেন? আমাকে জানায়নি মানেই কী অপরাধ করেছে?’

আমি বললাম, ‘অবশ্যই করেছে। যাক, তুমি আমার সঙ্গে চলো।’

মা বলল, ‘খেপেছিস? তোর বাবাকে কে দেখবে?’

আমি রেগে গিয়ে বলি, ‘তুমি ভাবছ কেন? বাবা তো তোমার কথা ভাবছে না।

মা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘কে বলল ভাবে না? আমার সবদিকে নজর রাখে। তুই তো দেখেছিস। জ্বর হলে রাতে জাগে। একসময়ে যাই করুক, মানুষটা আমাকে ভালোবাসে।’

এবার আমার মাথায় আগুন চড়ে যায়। বলি, ‘বাবা ভালোবাসে বলছ কেন? বল, তুমি ভালোবাস।’

মা বিড়বিড় করে বলে, ‘হয়তো তাই।’

আমি নিজেকে সামলাই। পৃথিবী অদ্ভুত একটা জায়গা। সে চারপাশের ভালোবাসার জাল ছড়িয়ে রেখেছে। কে কখন সেই জালে আটকে যাবে কেউ জানে না। আমি সেদিন এগিয়ে গিয়ে মায়ের কাঁধে হাত রেখেছিলাম।

‘মা, এসব আদিখ্যেতার কথা ছাড়ো। তুমি আমার সঙ্গে চলো। আমার মতোই মাঝেমধ্যে এখানে চলে আসবে। বাবার কাছে কদিন থাকবে। পুরোনো ঘটনা নিয়ে এভাবে রাগারাগি করলে তোমার একদিন বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’

মা হেসে বলেছিল, ‘আর কী ক্ষতি হবে? তুই চিন্তা করিস না, আমি আর রাগ করব না। উঠি এবার। তোর বাবার অফিসের সময় হয়ে গেল। তবে তুই বাবাকে এসব নিয়ে কখনও কিছু বলবি না। তুই আমাকে কথা দে মুনা।

আমি ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেছিলাম, ‘আমার বলবার কী দরকার? তুমি তো পাড়া মাত করে বলো। বলো না?’

মা বলল, ‘আমি বলি বলি, তুই কোনোদিন বলবি না। মেয়ের মুখ থেকে শুনলে ও দুঃখ পাবে।

আমি বললাম, ‘দুঃখ পাবার মতো কাজ করলে দুঃখ তো পেতেই হয়।’

মা গম্ভীর হয়ে বলে, ‘না তুই বলবি না। আমি মরে গেলেও নয়। কথা দে, আমাকে ছুঁয়ে কথা দে।’

আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, ‘ছুঁতে হবে না, কথা দিচ্ছি। তবে তুমিও চেঁচামেচি বন্ধ করো মা। যখন এক সঙ্গেই থাকবে, বাবা যা করেছে চুপ করে ভুলে যাও।’

মা বিড়বিড় করে বলে, ‘আমি তো মেনে নিয়েছি, মাঝেমধ্যে কী যে হয়…মনে পড়ে যায়। এতদিন পরেও…।’

আমি বলি,’থাক। আর ঘ্যান ঘ্যান করো না।’

আমি বুঝেছিলাম, মাকে বাবার থেকে আলাদা করা যাবে না এবং মা আবার পুরোনো কথা মনে করে রাগ করবে। আমি কাজে ফিরে গেলাম। হাসপাতালে ইন্টার্নদের কামাই করবার উপায় নেই। সব ঝামেলা তাদের ঘাড়ে। ডাক্তার হওয়ার আনন্দ অনেক। মানুষকে বাঁচানোর মতো আনন্দ আর কীসে আছে? তারপরে খাটুনির মধ্যে পড়লে মনে হয়, কেন মরতে ডাক্তার হতে গেলাম?

আমি যে ভয় পেয়েছিলাম, তাই হল। মা আবার রাগল এবং অসুস্থ হয়ে পড়ল। বাবা বাড়িতে ছিল। সেরিব্রাল অ্যাটাক। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ। নাইট ডিউটি দিতে দিতে খবর পেলাম। বাবা টেলিফোন করে হাঁউমাউ করে উঠল।

‘তোর মা চিৎকার করতে করতে মরে যাচ্ছে। এখনই তোর কাছে নিয়ে যা। নইলে বাঁচবে না।’

বাবাকে শান্ত হতে বললাম। রাতে অতদূর থেকে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। রাতটার জন্য বাড়ির কাছের মিউনিসিপালিটির হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললাম। সকালে একটা ব্যবস্থা হবে। এদিকে আমার হাসপাতাল ছাড়বারও উপায় ছিল না। এমারজেন্সিতে ডিউটি। সেদিন ডাক্তার বলতে আমরা দুজন। আমি আর আসিফ। সিনিয়র আছেন ডক্টর সেন। তাকে চট করে পাওয়া মুশকিল। কল বুক পাঠিয়ে ঘুম থেকে তুলতে হয়। আসিফ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বলল, ‘তুই যা আঁখি, আমি সামলে নেব।’

এটা একটা অসম্ভব কথা ছিল। পেশেন্টের চাপ ছিল খুব। এমারজেন্সিতে পেশেন্টপার্টি ‘দেরি’ মানে না। একটু এদিক ওদিক হলে হামলা শুরু করে দেয়। ভাঙচুর, মারধোর। আসিফকে একা ফেলে যাওয়া যাবে না। সকালে ডিউটি শেষ হলে আমি আর আসিফ দুজনেই ছুটলাম। অ্যাম্বুলেন্স নিয়েই গিয়েছিলাম। মিউনিসিপালিটি হাসপাতাল থেকে সরিয়ে কলকাতায় আমার হাসপাতালে নিয়ে এলাম। স্যাররা দেখে বললেন, ‘ক্রিটিকাল’। তাই হল। মাত্র সাতদিনও মাকে রাখতে পারলাম না।

মা চলে যাওয়ার পর, বাড়ি শান্ত হল ঠিকই, কিন্তু শক্তসমর্থ বাবা হয়ে পড়ল অসুস্থ। তারপর তো হার্ট অ্যাটাক। আমি যতটা পারি আসা যাওয়া করি। কতদিন পারব জানি না। শুনছি বদলি হতে হবে। শুক্রবার রাতে বাড়ি চলে আসি। সোমবার আবার ভোরের ট্রেনে উঠি। দেরি হলে আসিফ আমার ডিউটি ধরে দেয়। ওই বা কতদিন পারবে? আসিফ না থাকলে আমার যে কী হত, আমি জানি। এক গলা জলে পড়ে যেতাম। পড়ে হাবুডুবু খেতাম। ডাক্তার হওয়া বেরিয়ে যেত।

সেদিন রাতেই বাবাকে ওষুধ নিয়ে বললাম।

‘এটা কী করছ বাবা, ওষুধ বন্ধ করে দিচ্ছ কেন?’

বাবা বলল, ‘আমি বন্ধ করিনি। আমার শরীর বন্ধ করেছে। তারা আর ওষুধ খেতে চাইছে না।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কথাটার মানে কী? শরীর কেন বন্ধ করবে!’

বাবা বলল, ‘মানে আমি পুরো বলতে পারব না। তবে আমার মনে হচ্ছে, আমার শরীর ওষুধ থেকে এবার ছুটি চাইছে।’

খুব রাগ হয়, তারপরেও আমি শান্ত ভাবে বলি,’বাবা, এটা কি যুক্তির কথা হল?’

বাবা বলল, ‘না, হল না। অসুস্থ শরীরে ওষুধ বন্ধ করা ঠিক নয়। তার ওপর বাড়িতে একজন ডাক্তার আছে। তার নজরদারি আছে।’

আমি বললাম, ‘তুমি নিজেই বুঝতে পারছো, তারপরেও এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছ কেন?

বাবা অল্প হেসে বলল, ‘যুক্তি নেই বলে। কোনো কোনো সময় যুক্তি নেই এমন কাজ করতে ভালো লাগে। তুইও নিজেও কি করিস না?’

আমি চুপ করে থাকি। বাবা বলতে থাকে।

‘মানুষ যেমন যুক্তি মেনে চলে, তেমন আবার যুক্তি মেনে চলেও না। সেই কারণেই সে মানুষ। নইলে তার নাম হত কম্পিউটার। সে প্রোগ্রামের বাইরে যেত না।’

আমার রাগ হল। এই মানুষটা কি শুধু বিরক্তই করে যাবে? মাকে করেছে, এখন আমাকে করছে। অসুস্থ মানুষের ওপর রাগ করবার কোনো মানে হয় না। ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘তোমার জন্য ওষুধ বন্ধ করাটা সুইসাইডের। আত্মহত্যার সমান বাবা।’

বাবা আবার হাসল। বলল, ‘তাহলে তো একটা যুক্তি পাওয়া গেল মুনা। আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করছি।’

আমি চুপ করে রইলাম। তর্ক করে লাভ নেই। বুঝিয়েও হবে না। বাবাকে অ্যান্টি ডিপ্রেশন ড্রাগ দিতে হবে। লুকিয়ে খাবারে মিশিয়ে দিতে হবে। উশীদিকে বুঝিয়ে দেব।

বাবা বলল, ‘আমি মৃত্যুকে খানিকটা পথ করে দিচ্ছি।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কীসের পথ করে দিচ্ছ?’

বাবা বলল, কাছে আসবার পথ।’

না বাবার মাথাটা সমস্যার দিকেই গেছে। বললাম, ‘লাভ কী?’

বাবা হেসে বলল, ‘লাভ আছে। মুনা, তুই লেখাপড়া শিখে ডাক্তার হয়েছিস, জীবনের পক্ষ নিয়েছিস। কীভাবে জীবনকে রাখা যায় তাই নিয়ে সবসময় ঘাঁটাঘাঁটি করিস। মৃত্যুর কথা তোরা বুঝবি না।’

আমি আর পারলাম না। খানিকটা রেগেই-বললাম, ‘না, বুঝব না। তোমার কথা মনে রাখব বাবা। এরপর লেখাপড়া করে মৃত্যুর জন্য চিকিৎসা করব।’ বাবা শান্ত গলায় বলল, ‘মুনা, তুই রেগে যাস না। কোনো কোনো সময় মৃত্যুকে অ্যালাও করতে হয়।’

ওই যে আবার গলার আওয়াজ। ফিসফিস করে কেউ কথা বলছে। আমি গত সপ্তাহে বাড়ি আসতে পারিনি। আইসিসিইউ ট্রেনিং ছিল। কেয়ার ইউনিটে তো একসঙ্গে অনেকজনকে ঢোকানো যাবে না, তাই আমাদের ব্যাচ ভাগ করা হয়েছে। আসিফ আমার ব্যাচে পড়েনি। ভাগ্যিস পড়েনি। সে এর মধ্যে একদিন বাড়িতে এসে বাবাকে দেখে গেছে। বাবা অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলেছে।

‘এবার তোমরা বিয়ে কর আসিফ ‘

আসিফ লজ্জা পেয়েছে। বলেছে, ‘আর একটু গুছিয়ে নিই।

বাবা বলেছে,’ডাক্তারদের গোছানোর শেষ হয় না। টাকা পয়সা হয়, কিন্তু জীবনের দামি মুহূর্তগুলো চলে যায়। আমি আঁখিকে বলব।’

আসিফ তাড়াতাড়ি বলে, ‘আর কটা দিন যাক মেসোমোশাই। আপনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপরে ওসব হবে।’

বাবা হেসে বলে, ‘মাই সন, আমি আর সুস্থ হব না। যাওয়ার আগে একটা ভালো ছেলের পাশে মেয়েটাকে দেখে যাই।’

আসিফ আমাকে যখন বাবার কথা রিপোর্ট করছিল, তখনও তার মুখেও একটা লজ্জা লজ্জা ভাব দেখেছি। আমি খেপানোর জন্য বললাম, ‘তুই রাজি হয়ে গেলেই পারতিস।’

আসিফ বলল, ‘ধ্যুস, কী যে বলিস।’

আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, ‘ধ্যুস কেন? তুই আমাকে বিয়ে করবি না?’ অতিরিক্ত ভালো ছেলে হলে কী হবে, আসিফ পাজিও আছে। চান্স পেলেই আমার পিছনে লাগে। বলল, ‘আমি কি তাই বলেছি?’

আমি বললাম, ‘মুখে না বললেও, তোর মতলব সেরকমই মনে হচ্ছে।’

আসিফ বলল, ‘চল আজই বিয়ে করব। দেখি তোর সাহস।’

আমি বললাম, ‘বিয়ে করবার মধ্যে সাহসের কী দেখলি?’

আসিফ বলল, ‘এই তো পিছিয়ে যাচ্ছিস।’

আমি টেবিলের ওপর রাখা স্টেথোস্কোপ তুলে নিয়ে বললাম, ‘চল্‌। কাছাকাছি রেজিস্ট্রি অফিস কোথায় রয়েছে? গুগল সার্চ কর।

আসিফ নির্বিকার ভাবে বলল, আজ বিয়ে করার সময় নেই। ওপিডি রয়েছে। কাল, না কালও নয়, শনিবার বিয়ে করব। এখন খাব, খিদে পেয়েছে।’

আমি বললান, ‘থাক, তোকে বিয়ে করতে হবে না। তবে সুন্দরী, বিদূষী পাত্রী হাতছাড়া হয়ে গেলে আমাকে দোষ দিতে পারবি না। বাবার যখন এত ইচ্ছে তখন বিয়েটাই সেরে নেব ভাবছি। তোকে ফার্স্ট চান্স দিয়েছিলাম, ইউ মিসড। আমার কিছু করার নেই। নে, স্যান্ডুইচ খাওয়া। আইবুড়ো স্যান্ডুইচ।’

আমি এবার এসেছি শুধু বাবাকে দেখতে নয়, বিয়ের কথাও বলব। বহরমপুর থেকে আসিফের আব্বা, ফুপা আসবে। বদলির আগে বিয়ে করে নেব বলে আমরা ঠিক করেছি।

কিন্তু এখন কথা বলছে কে?

আলো একটু একটু করে ফুটছে। আমি চাদর সরিয়ে উঠে পড়লাম। যদিও বাড়ি এলে আমার কিছুতেই বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। মনে হয় সারাদিন গড়াই।

খাট থেকে নেমে পায়ে চটি গলাতে গিয়ে থমকে গেলাম। থাক। আগে গিয়ে দেখি কে কথা বলছে। পা টিপে টিপে দরজার পিছনে দাঁড়ালাম। দরজাটা বারান্দায় যাবার। পাশের ঘরই বাবার। সেখান থেকেও বাড়ির পুব দিকের এই হাফ সার্কেল বারান্দায় বোরোনো যায়। বারান্দা ঠাকুর্দা বানিয়েছিলেন। শৌখিন মানুষ ছিলেন। সামনে একটুকরো জমিতে একসময়ে বাগান ছিল। এখন বেশিটাই আগাছা।

দরজার ফাঁকে চোখ রেখে অবাক হলাম। নিঝুম ভোরের বারান্দায় বসে রয়েছে বাবা। বাবাই কথা বলছে। একা কথা বলছে। মাথা নামানো, হাত দুটো চেয়ারের হাতলে রাখা। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, বাবার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছে, তার সঙ্গে কথা বলছে। অথচ বহুদিন হয়ে গেল বাবার সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসে না।

এখন কটা বাজে? পাঁচটা? নাকি সাড়ে পাঁচটা? আমি দরজার ফাঁকে কান রাখলাম। বাবার গলা একটু স্পষ্ট হল। ছেঁড়া ছেঁড়া কথা।

‘তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছ সুপ্রভা? পারোনি তো? ভেরি গুড। কী করে পারবে? আমার অপরাধ তো কম নয়। শুধু একটা বিয়ে তোমার কাছে গোপন করেছিলাম এমন তো নয়, সেদিন তোমার অসুস্থ হয়ে পড়বার পিছনেও ছিলাম আমি। সেই অর্থে আমি তোমাকে খুনই করি সুপ্রভা। আই কিলড ইউ। সেদিন তোমাকে উত্তেজিত করি। তুমি রাগতে থাকো…আরো রাগতে থাকো। আমি তাই চাইছিলাম… চাইছিলাম, তোমার রাগ চরম উঠুক এবং চিরকালের জন্য শেষ হোক। আহ্, আমাকে বাধা দিও না সুপ্রভা, বলতে দাও। কেউ শুনছে না, তোমার মেয়ে ঘুমোচ্ছে। আমি সেদিন ভেবেছিলাম, উত্তেজিত হয়ে তুমি ছাদে উঠে ঝাঁপ দেবে, নয়তো গায়ে আগুন… রান্নাঘরে কোরোসিন ছিল। তার বদলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে। সুপ্রভা, বিশ্বাস করো আমি তোমার মৃত্যুই চেয়েছিলাম… এত বছর ধরে গাল শুনতে ভালো লাগছিল না…তোমাকে লুকোলেও ওই মেয়েকে তো আমি ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম সুপ্রভা, তাকে তোমার আড়ালে রেখেছি, কিন্তু ভালো তো বেসেছি…সুপ্রভা, আমার ভালোবাসা কত তীব্র সেকথা তোমার থেকে বেশি আর কে জানে? তাই না? আমি আমার অপরাধের শাস্তি নিজে নেব বলেই ঠিক করেছি। আমি সব ছেড়ে তোমার কাছে ফিরে যাব। লোক জানানো আত্মহত্যা করে আঁখিকে লজ্জায় ফেলব না, আমাকে অন্যভাবে মরতে হবে। তাই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করেছি। ধীরে হলেও ঠিক একদিন…।’

বাবা থামল। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত লাগছে। চেয়ারে হেলান দিল। আমি সরে এলাম দরজা থেকে। আমার শরীর কাঁপছে। পা টিপে নিজের ঘরে এসে দরজা দিলাম। খাটে বসে ফুঁপিয়ে উঠে বললাম, ‘মা, এই অপরাধী বাবাকে নিয়ে আমি কী করব? কী করব আমি? তুমি আমাকে বলে দাও।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *