দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

অপরাজিতা

অপরাজিতা

সংসারে জয়পরাজয় আছে। জীবনযুদ্ধে কারা অপরাজেয়। কারা কখনও হার স্বীকার করেন না, বা হারোনো যায় না। প্রথম হল স্ত্রী। আমাদের ওয়াইফদের কখনও কোনও ভাবেই হারানো যায় না। তাঁর সঙ্গে তো মল্লযুদ্ধ সম্ভব নয়। উচিতও নয়। স্ত্রীর সঙ্গে হবে বাক্যযুদ্ধ। দু-পক্ষ কথার ধারালো তরোয়াল নিয়ে লড়বেন। সব শেষে দেখা যাবে স্বামী বেচারাই কাত। পরাজিত করার পাশুপাত অস্ত্রটি বিয়ের রাতেই তাঁর হাতে আমরা গদগদ হয়ে তুলে দিয়ে আসি। সেটি হল, আমরা পুরুষেরা, সেজেগুজে, চুনোট করা ধুতি, পাঞ্জাবি পরে, গাঁটছড়া বেঁধে তাঁকে আদর করে শাঁখ বাজাতে-বাজাতে সারা পাড়াকে জানান দিয়ে নিয়ে আসি। বরযাত্রীরা হলেন সাক্ষী। খাল কেটে কুমির নয়, জীবনবৃত্তে আনা হল স্ত্রী। বউভাতের দিন তাঁকে সাজিয়ে গুছিয়ে, ফুলের মুকুট পরিয়ে, ডেকরেটারের ডেরা থেকে সিংহাসন ভাড়া করে এনে তাঁকে বসানো হল। তিনি রানির মতো ঘণ্টাচারেক বসে রইলেন তাঁর সভাসদ পরিবৃত হয়ে। উপার্জন করলেন শদেড়েক শাড়ি। গোটা পঞ্চাশ নানা মাপের বাংলা উপন্যাস। গোটাদুই টেবিল ফ্যান। গোটাছয় ঘড়ি। সাত-আটটা টেবিল ল্যাম্প। সরবত কত খাওয়া হবে তার ঠিক নেই, তিন-চারটে সরবত সেট, টি-সেট। কাষ্ঠখণ্ডের ওপর আঁকা দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পকর্ম, কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ। যিনি দিয়ে গেলেন তাঁর দূরদৃষ্টির প্রশংসা করতেই হয়; কারণ মাসপয়লা না হতেই সংসার ক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র হবেই। কারোর পিতার ক্ষমতা নেই ঠেকায়। দাম্পত্য কলহ অতি শাস্ত্রসম্মত। শ্লোকই বলছে—’অজাযুদ্ধে, ঋষিশ্রাদ্ধে, প্রভাতে মেঘডম্বরে, দাম্পত্য কলহে চৈব বহ্বারম্ভে লঘু ক্রিয়া।’ ছাগলের লড়াই, খুব খানিকটা ঢুঁসোঢুঁসি হল। এ সামনের দু-পা তুলে, ও সামনের দু-পা তুলে শিং-এ শিং-এ ঠাস। মিনিটপনেরো। তারপর দুজনেই বসে বসে শিবনেত্র হয়ে জাবরকাটায় মগ্ন। শিং সুড়সুড় তখন কমে গেছে। ঋষিশ্রাদ্ধ। ওই একই ব্যাপার। মহাঘটা। দিগ্বিদিক থেকে সবাই আসছেন। স্তোত্রপাঠ। ষাঁড়ের ডাক। ভোজনের বেলায় মালসা ভোগ। সকালে আকাশ কালো করে মেঘ এল। হুড়হুড়, গুড়গুড় মেঘের ডাক। সামান্য ঝোড়ো বাতাস, দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে গেল। ভয়ের হল, ‘মেঘযুদ্ধে, নৃপশ্রাদ্ধে, সায়াহ্নে মেঘাড়ম্বরে সাপত্ন কলহে চৈব লঘ্যারম্ভে বহুক্রিয়া।’ দুটো ভেড়া যদি ঠুসঠাস শুরু করে, সরে আসাই ভালো। ক্রমশ তাদের পারস্পরিক দূরত্ব বাড়বে। একজন তেড়ে যাবে আর একজনের দিকে। শিং-এ শিং-এ ঠোকাঠুকি। রক্তারক্তি। চলবে যতক্ষণ না একটা শেষ হচ্ছে। রাজার শ্রাদ্ধও সেই রকম। আয়োজন একটু-একটু করে বাড়তে-বাড়তে শেষে রাজসূয়। শেষবেলার মেঘ। অল্প-অল্প জমতে-জমতে, অবশেষে প্রলয়। অত:পর দুই সতীনের লড়াই। এর কুটুস, ওর কুটুস। এ হাত দেখায় তো ও দেখায় পা। শেষে চুলের মুঠি ধরে দুজনের গড়াগড়ি। আমরা ছেলেবেলায় দুই সতীনের লড়াই দেখেছি। সত্যি-সত্যি নয়। কাঁধে ঝোলা নিয়ে এক মহিলা আসতেন পাড়ায়। খ্যানখেনে গলায় হাঁকতেন, ‘দুই সতীনের লড়াই দেখবে, বাত ভালো করবে, দাঁতের পুকা বের করবে।’ আঙুলে দুটো পুতুল কায়দা করে ধরে, ধুম ঝগড়া আর লড়াই।

তার মানে স্বামী-স্ত্রী হল অজ আর অজা। খুব খানিক ব্যাব্যা হল। পাড়া জানাজানি হল। স্বামী রাগ সংযত করতে না পেরে একটু ভাঙাভাঙি করলেন। বাথরুমের দরজা দমাশ করে বন্ধ করলেন। বাথরুমে ঢোকা মানে স্বামীর পরাজয়। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনীর পেছনে হাঁটার মতো। গৃহ শান্ত। পরস্পরের বাক্যলাপ বন্ধ। মুষ্টিযুদ্ধে যেমন হয়, মার খেতে-খেতে একজন যখন আর পারে না তখন একপাশের দড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে, দুহাতে মাথা আড়াল করে, সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন প্রতিপক্ষ সংযত হতে বাধ্য। স্বামী-স্ত্রীর বাক্যযুদ্ধে বাথরুম হল সেই বকসিং রিং-এর বাইরে নিরাপদ অঞ্চলের মতো। পারিনি। হেরে গেছি। পালিয়ে এসেছি বাবা। তোমার যা বলার বাইরে বলো বাবা, আমি জলের শব্দ শুনি। ভক্তিমূলক গান গাই।

ভাঙাভাঙির ব্যাপারে স্বামীরা মহা হিসেবি। সাবধানী। আমি একবার রাগ দেখাবার জন্যে ভাবলুম, টিভিটা ভেঙে ফেলি। সেদিন আমি ঠিক করেছিলুম, অ্যাট অ্যানি কস্ট জিতবই জিতব। টিভির সামনে আসতেই ভেতরের কম্পিউটার মন জানিয়ে দিলে, অনেক দাম। প্রায় দশ হাজার। দশ হাজার টাকায় রাগ দেখানো ঠিক হবে না। আর একটু কমের ওপর দিয়ে যাও। শেষে আমি ভাঁড়ারে ঢুকে, হাতল ভাঙা, কানা ভাঙা একটা কাপ তুলে নিলুম। কাপটা চায়ের জগৎ থেকে ছুটি পেয়ে গেছে। হাতে নিয়ে চিন্তা করতে লাগলুম, কোথায়, কোন দিকে ছুঁড়ব! তারপরে বুঝলুম, আমার মতো হিসেবি রাগীর পক্ষে ভাঙচুর করা সম্ভব নয়। তখন আমি রেগে গৃহত্যাগ করলুম। রাস্তায় বেরিয়ে মনে হল, যাই কোথায়! এই ভর সন্ধেবেলা। অফিস ছাড়া তো ত্রিভুবনে আমার কোনও যাওয়ার জায়গা নেই। আর অফিস তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আবার খুলবে সেই কাল সকালে। তখন আমি বাড়ির উলটোদিকের ল্যাম্পপোস্ট-এর তলায়, পোস্টারের মতো দাঁড়িয়ে রইলুম। পাড়ার পরিচিতরা পাশ দিয়ে যেতে-যেতে হাসি মুখে জিগ্যেস করতে লাগলেন—’একী এমন রাজবেশে এখানে দাঁড়িয়ে কেন?’ তখন নিজের পোশাক সম্পর্কে খেয়াল হল। পরনে পাজামা, স্যান্ডো গেঞ্জি, হাওয়াই চপ্পল। এই বেশে, কপর্দকশূন্য অবস্থায় গৃহত্যাগ করতে চেয়েছিলুম। গৃহত্যাগ করতে হলেও স্ত্রী-সাহায্য চাই। কাপড়-জামার আলমারির চাবি তার কাছে। টাকাপয়সা তার কাছে। আমার পুরো রাজত্বটাই তাকে দান করে বসে আছি। এর মধ্যে একজন রসিকতা করে গেলেন, ‘কি মশাই, এখন এখানে দাঁড়িয়ে। এখন তো স্কুল ছুটির সময় নয়!’

তখন খেয়াল হল, সকালে এই ল্যাম্পপোস্টটা রোজ কদম গাছের ভূমিকা পালন করে। মেয়েদের স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বংশীধারী নয়, সাইকেলধারী কৃষ্ণরা দাঁড়িয়ে থাকে। মহা বিপদে পড়ে গেলুম। নিজেকেই নিজে সাজা দিয়ে বসে আছি। কেউ এখন ডেকে ঘরে না তুললে পেছতেও পারছি না। এই অবস্থায় এগোনোও অসম্ভব। শেষে রাত ন’টার সময় দোতলার বারান্দা থেকে স্ত্রী হাঁক মারলেন—’এই যে, চলে এস, রান্না হয়ে গেছে।’ আকাশ থেকে দৈববাণী হল। আমি গৃহপালিত গন্ডারের মতো আমার আস্তাবলে ঢুকে শ্বাস ছেড়ে বাঁচলুম। ওই শিক্ষার পর আমি আর গৃহত্যাগের ঝুঁকি নিই না। কারণ সংসারে একবার ঢুকলে দেহত্যাগ না হলে গৃহত্যাগ অসম্ভব?

স্ত্রীর সঙ্গে বাগযুদ্ধে পেরে ওঠা দু:সাধ্য; কারণ উকিল মরে স্ত্রী হয়। যেমন প্রখর স্মৃতিশক্তি তেমনি আর্গুমেন্ট করার ক্ষমতা। আমরা রাগের মাথায় বলি, রাগ পড়ে গেলে সব ভুলে যাই। ‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলার’ মতো স্ত্রীরা আমাদের কোনও কথাই ফেলেন না। ঠিক সময়ে সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেন। ‘মনে আছে চিত্রার বিয়ের দিন তুমি কি করেছিল?’ আমার কিচ্ছু মনে নেই। কে চিত্রা! কে স্বরূপবাবু! এরপর আসে সেই মোক্ষম কথা—’কিছুই ভুলিনি। সব মনে রেখেছি। দুনিয়া হল আরশির মুখ দেখা। যেমন দেখাবে তেমনি দেখবে।’

শেষ কথাটি শোনামাত্রই মনটা কেমন হয়ে যায়! সর্বনাশ! আমরা তাহলে সংসারে সারা জীবন বিষের চাষ করি! আমার স্ত্রী হলেন ওয়ার্ড-ব্যাঙ্ক। সবকথাই সেখানে ফিকসড ডিপোজিট। সুদে বাড়ছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *