অপমান-বর

                   ভক্তমাল

ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ্যাতি রটিয়াছে দেশে । 
কুটির তাহার ঘিরিয়া দাঁড়ালো লাখো নরনারী এসে । 
কেহ কহে ‘ মোর রোগ দূর করি মন্ত্র পড়িয়া দেহো ' , 
সন্তান লাগি করে কাঁদাকাটি বন্ধ্যা রমণী কেহ । 
কেহ বলে ‘ তব দৈব ক্ষমতা চক্ষে দেখাও মোরে ' , 
কেহ কয় ‘ ভবে আছেন বিধাতা বুঝাও প্রমাণ করে ' । 
  
কাঁদিয়া ঠাকুরে কাতর কবীর কহে দুই জোড়করে , 
‘ দয়া করে হরি জন্ম দিয়েছ নীচ যবনের ঘরে — 
ভেবেছিনু কেহ আসিবেনা কাছে অপার কৃপায় তব , 
সবার চোখের আড়ালে কেবল তোমায় আমায় রব । 
একি কৌশল খেলেছ মায়াবী , বুঝি দিলে মোরে ফাঁকি । 
বিশ্বের লোক ঘরে ডেকে এনে তুমি পালাইবে নাকি ! ' 
  
ব্রাহ্মণ যত নগরে আছিল উঠিল বিষম রাগি — 
লোক নাহি ধরে যবন জোলার চরণধুলার লাগি ! 
চারি পোওয়া কলি পুরিয়া আসিল পাপের বোঝায় ভরা , 
এর প্রতিকার না করিলে আর রক্ষা না পায় ধরা । 
ব্রাহ্মণদল যুক্তি করিল নষ্ট নারীর সাথে — 
গোপনে তাহারে মন্ত্রণা দিল , কাঞ্চন দিল হাতে । 
  
বসন বেচিতে এসেছে কবীর একদা হাটের বারে , 
সহসা কামিনী সবার সামনে কাঁদিয়া ধরিল তারে । 
কহিল , ‘ রে শঠ , নিঠুর কপট , কহি নে কাহার ও কাছে — 
এমনি করে কি সরলা নারীর ছলনা করিতে আছে ! 
বিনা অপরাধে আমারে ত্যজিয়া সাধু সাজিয়াছ ভালো , 
অন্নবসন বিহনে আমার বরন হয়েছে কালো ! ' 

কাছে ছিল যত ব্রাহ্মণদল করিল কপট কোপ , 
‘ ভণ্ডতাপস , ধর্মের নামে করিছ ধর্মলোপ ! 
তুমি সুখে ব ' সে ধুলা ছড়াইছ সরল লোকের চোখে , 
অবলা অখলা পথে পথে আহা ফিরিছে অন্নশোকে ! ' 
কহিল কবীর , ‘ অপরাধী আমি , ঘরে এসো নারী তবে — 
আমার অন্ন রহিতে কেন বা তুমি উপবাসী রবে ? ' 
  
দুষ্টা নারীরে আনি গৃহমাঝে বিনয়ে আদর করি 
কবীর কহিল , ‘ দীনের ভবনে তোমারে পাঠালো হরি ।' 
কাঁদিয়া তখন কহিল রমণী লাজে ভয়ে পরিতাপে , 
‘ লোভে পড়ে আমি করিয়াছি পাপ , মরিব সাধুর শাপে ।' 
কহিল কবীর , ‘ ভয় নাই মাত :, লইব না অপরাধ — 
এনেছ আমার মাথার ভূষণ অপমান অপবাদ ।' 
  
ঘুচাইল তার মনের বিকার , করিল চেতনা দান — 
সঁপি দিল তার মধুর কণ্ঠে হরিনামগুণগান । 
রটি গেল দেশে — কপট কবীর , সাধুতা তাহার মিছে । 
শুনিয়া কবীর কহে নতশির , ‘ আমি সকলের নীচে । 
যদি কূল পাই তরণী - গরব রাখিতে না চাহি কিছু — 
তুমি যদি থাক আমার উপরে আমি রব সব - নিচু ।' 
  
রাজার চিত্তে কৌতুক হল শুনিতে সাধুর গাথা । 
দূত আসি তারে ডাকিল যখন সাধু নাড়িলেন মাথা । 
কহিলেন , ‘ থাকি সবা হতে দূরে আপন হীনতা - মাঝে ; 
আমার মতন অভাজন জন রাজার সভায় সাজে ! ' 
দূত কহে , ‘ তুমি না গেলে ঘটিবে আমাদের পরমাদ , 
যশ শুনে তব হয়েছে রাজার সাধু দেখিবার সাধ ।' 
  
রাজা বসে ছিল সভার মাঝারে , পারিষদ সারি সারি — 
কবীর আসিয়া পশিল সেথায় পশ্চাতে লয়ে নারী । 
কেহ হাসে কেহ করে ভুরুকুটি , কেহ রহে নতশিরে , 
রাজা ভাবে — এটা কেমন নিলাজ রমণী লইয়া ফিরে ! 
ইঙ্গিতে তাঁর সাধুরে সভার বাহির করিল দ্বারী , 
বিনয়ে কবীর চলিল কুটিরে সঙ্গে লইয়া নারী । 
  
পথমাঝে ছিল ব্রাহ্মণদল , কৌতুকভরে হাসে — 
শুনায়ে শুনায়ে বিদ্রূপবাণী কহিল কঠিন ভাষে । 
তখন রমণী কাঁদিয়া পড়িল সাধুর চরণমূলে — 
কহিল , ‘ পাপের পঙ্ক হইতে কেন নিলে মোরে তুলে ! 
কেন অধমারে রাখিয়া দুয়ারে সহিতেছ অপমান ! ' 
কহিল কবীর , ‘ জননী , তুমি যে আমার প্রভুর দান ।' 
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *