অপমানের স্বাদ

অপমানের স্বাদ

তিরিশ বছর আগে যেসব রাগ বাজিয়ে ছিলেন পরিতােষ—গৌড় মল্লার, পুরিয়া ধানেশ্রী—সেই সব রাগের আটাত্তর রেকর্ড আজ খুঁজলে হয়তাে শেয়ালদা, গােপালনগর, চোরবাজারে পুরনাে জিনিসের আড়তদারদের গােলায় পাওয়া যেতে পারে। ফাটাচটা! আর পাওয়া যেতে পারে দু-চারজন ভালাে শুনিয়ের কালেকশনে। নয়তাে বেরােবার পর বছর ঘুরতে দেড়শাে-দুশাে টাকার রয়ালটিতে এসে বিক্রি থেমে যেতেই সেসব রেকর্ড এরকম হারিয়েই যায়। যা চলে না—কেউ কি তা দোকানে রাখে!

সরােদিয়া পরিতােষ সরখেল এখন এই পঞ্চান্ন ছাপান্ন বছর বয়সে ভারত উত্সব, বস্টন, ভিয়েনা, স্ট্রাসবুর্গ, রবীন্দ্রসদনে বাজানাের ফাকে-ফোকরে

একটা জিনিসই কেবল খুঁজে বেড়ান।

তা হল—কী করে সব কিছু এত সফল হয়ে উঠল? কখন থেকে এই সফল হওয়ার শুরু?

যা-ই বাজাই—যেমন-ই বাজাই—তবু কাগজে-কাগজে কেন লেখে—এমন ধ্রুপদি মেজাজ—এমন লয়কারি—ঝালার—বন্দিশ—সমে ফিরতি তেহাই নাকি

আর কারাের হয় না। আরও সব কত কথা।

ব্যাপারটা কী হল? ফিরে ফিরে ভাবতে থাকেন পরিতােষ। বাজান আর ভাবেন। সংসার করেন আর ভাবেন। এখন ডবল ক্যাসেট বেরােয় আগাম গ্রাহক নিয়ে। সেই সুবাদে প্রেসকে ডেকে অনেক কথা বলতে হয় পরিতােষের।

সে যেন বাজালেই ভালাে। স্রেফ ভালাে।

শুধুই ভালাে। ভালাে বই আর কিছু নয় ? তাহলে সেদিনের বাজানাে সেই সব রেকর্ডের ও হাল হল কেন? সেখানেও তাে ফিরতি তেহাইয়ের কিছু অভাব ছিল না।

এখন জীবন করেন আর ভাবেন। ভাবেন আর খোঁজেন। খোঁজেন আর টের পান—তাঁর বাজনা কেমন আলুনি। কী একটা নেই। কীসের একটা অভাব। কেমন যেন ঝঝ নেই। জিভে যেন কী পাচ্ছেন না। কোন একটা স্বাদ।

সেটা কিসের স্বাদ? সরােদের স্টেনলেস স্টিল বুকে তারগুলােকে বাঁ হাতের নখে চেপে ধরতে ধরতে পরিতােষ সরখেল সেই হারানাে স্বাদটা খুঁজতে থাকেন। এখানে?

নাঃ! তাহলে এখানে? নাঃ ? হল না। হল না। এখানেও না। তাহলে কোথায় ?

কালীপুজোর মুখে-মুখে শীত এসে পড়ল এবার। বিকেল এখন বিকেলের অনেক আগে চলে আসে। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এ জিনিসটা অনেকদিন পরে ধরতে পেরে ভীষণ ভালাে লাগল পরিতােষের।

কতদিন হল একদম একা, স্রেফ পায়ে হেঁটে কলকাতায় বেরিয়ে পড়া হয়নি পরিতােষের। বেরােনাে মানেই তাে গাড়ি। জানলার কাচ তােলা। যারা বাজাতে নিয়ে যায়, তাদের জনা দুই দুপাশে ভাগ হয়ে বসে।

সন্ধের মুখে গরম গরম পেঁয়াজি কিনলেন পরিতােষ। চারখানা। রাস্তায় বসে ভাজছে। শালপাতায় রাখা যাচ্ছে না এত গরম। পরিতােষ নিজেকেই বললেন, রােসাে। এখুনি ঠান্ডা হয়ে যাবে। যেন পুরনাে স্মৃতির সঙ্গে কথা বলছেন।

সত্যিই শীতের ঠান্ডা বাতাসে পেঁয়াজিগুলাে ঝপ করে ঠান্ডা হয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে বাতাস থেকে গরম ফুলকপির সিঙাড়ার গন্ধ চলতি মানুষজনের নাক বাবর ভাসতে থাকে। কী আমােদ করা গন্ধ। অনেক নতুন মানুষজন আজ সন্ধেবেলা পৃথিবীর রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। পরিতােষ সরখেল দাঁড়িয়ে পড়লেন। এদের তাে দেখা হয়নি। কবে জন্মাল সব? এখনকার বাচ্চাদের হাসি, কিচির-মিচির কিন্তু অন্যরকম। একটি দীঘল মেয়ে কোনােদিকে ভ্রুক্ষেপ করে রাস্তার মােড় পেরােচ্ছে। উল্টোদিকের দোকানের আলােয় তার ডানদিককার বুকটা ঝলক দিয়ে ফুলে ওঠা কোনাে তালের ঘূর্ণি লাগল

পরিতােষের।

এক-একটা রাগ এক-একসময় মাথার ভেতর এইরকমের রঙদার হয়ে ওঠে—এতই রঙিলা হয়ে দাঁড়ায়—যার ভেতর কলকাতার রাস্তায় মানুষজনের মুখে দেখা অবাক চাউনি, বুঝদার হাসি, খাঁটি রাগ কেমন অবলীলায় মিশে যায়। মিশে থাকে।

 সুকিয়া স্ট্রিটের মাঝামাঝি গোঁসাইবাবুর ‘বাদ্যযন্ত্রের দোকানে একটি প্রবীণ যুবক সরােদের বুকের তুন কাঠে স্টেনলেস স্টিলের পাত বসাচ্ছে মন দিয়ে।

আরও সব কারিগর—কেউ বসে নেই। বড়াে গোঁসাই তাহলে আর নেই। দুর থেকে সব দেখলেন পরিতােষ। জীবনের প্রথম সরােদ ওখানেই কেনা।

হাঁটতে হাঁটতে হরি ঘােষ লেন। ভীষণ সরু গলি। মজরুহ ওস্তাদ এখানে থাকতেন। কবেই করাচি চলে গেছেন খাঁ সাহেব। তার একটা টমটম ছিল। গলির মুখে সারা বেলা দাঁড়িয়ে থাকত। গলিটার ভেতর ঢুকে পড়লেন পরিতােষ। একদম বজলুর মুখােমুখি। ওস্তাদের সহিসের ছেলে। পরিতােষের বয়সি। মুখের বসন্তের দাগ দেখে চেনা যায়।

বাবুজি আপনি? অব তাে দুনিয়ালােগ জানতে হ্যায় আপকো ! কেমন আছ বজলু? ভালাে তাে ছিলাম। লেকিন বিবি চল বসে। আপনার? বিবি আছে। যেমন মানুষের পাশে লােক থাকে—ঠিক তেমন। আল্লাতালা সব সহি সলামত রাখে—এহি তাে মেরা দুয়া।

গলি থেকে বেরিয়ে একটুকরাে পার্কের উল্টোদিকে প্যারাডাইস রেস্তোরাঁ। আর তাে তা নেই। সেখানে এখন মেয়েদের শাঁখা পরার দোকান। পাশের অন্ধকার ড্রেনটা আছে। আছে সেই স্যাতসেঁতে গন্ধটা। পরিতােষ উঁকি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলেন— | তাঁর বিক্রি না হওয়া রেকর্ডগুলাে গাদি মেরে পড়ে আছে। তাতে ড্রেনটারই বুজে যাবার দশা। বিক্রি হয়নি যেসব আটাত্তর রেকর্ড সেদিন—সব—সব এখানে ফেলে দিয়ে গেছে দোকানিরা। জানতাম না তাে। এই ড্রেনটাই তাহলে বিফল রাগরাগিণীর আদাড়।

এখানে প্যারাডাইসে আড্ডা দিতে দিতে বেলা একটা-দুটো হয়ে যেত। প্যারাডাইস বন্ধ হয়ে যেত। তখন পরিতােষরা রাস্তায় নেমে এই ড্রেনের মুখে দাঁড়িয়ে যে যার স্বপ্ন নিয়ে ওই স্যাতসেতে গন্ধের ভেতর কথা বলত। প্রথম রেকর্ড বেরিয়েছে পরিতােষের। আটাত্তর। এক পিঠে গৌড় সারং। আরেক পিঠে বেহাগ। মােট তেতাল্লিশ কপি বিক্রি হয় এক বছরে। তাই নিয়ে কথা বলতে পরিতােষদের সব অপমান যেন বাতাস থেকে খসে খসে ওই ড্রেনে গিয়ে পড়ত। জমাট অপমানেই ড্রেনটা সব সময় থিকথিক করত। পরে বিক্রি না হওয়া রেকর্ডগুলাে দোকানিরা এসে ওখানেই ফেলে দিয়ে গেছে। অপমানের ভেতর। সেই অপমান—যাতে কিনা সবসময় একরকম জ্বালায় জ্বলে-জ্বলে রেওয়াজে ডুবে যেত পরিতােষ। একসময় ডানহাত অসাড় হয়ে যেত—তখন সেই অপমান যেন নুন। এইসময় পরিতােষ জীবনটা নিজের জিভে টের পেতেন।

সন্ধের ভিড়ে হাঁটতে বেশ আরাম লাগছে তার। এক একজন শীতে র্যাপারে কেমন জমাট—তন্ময় হয়ে যে যার স্বপ্নের দিকে চলে যাচ্ছে। চারিদিকে একেবারে খাঁটি শীত। মানুষের শহরের আলাের মাথায় আকাশ থেকে আরও খাঁটি অন্ধকার নেমে আসছে। এখানেই তাে আমি সরােদের স্টেনলেস স্টিল বুক থেকে নখ দিয়ে কুরে কুরে রাগ তুলেছি। রেওয়াজে। অপমানের নুন দিয়ে। ডান হাতে নারকেল মালার জাবা দিয়ে স্ট্রোক দিতে দিতে।

আর এখন! সবই কত অনায়াসে। এক-একটা রাস্তা এক-এক বন্ধুর কথা মনে করিয়ে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে কাসারি পাড়া। এখানে নীলকুঠী নামে একটা বাডিতে পুজোর পর আসর বসত। সেখানে কয়েক বছর বাজিয়েছেন পরিতােষ। মজলিশের জায়গাগুলাে এখন আর বিশেষ নেই। এইসব দিয়েই তাে এতবড়াে শহরটার জলছাপ থাকে মনে সব সময়। আর সেইসব আসরই উঠে গেল। বুক থেকে কলকাতা মুছে গেলে আর থাকে কী ?

 ঘুরে ঘুরে বকুলবাগানে এসে মনে পড়ল, এখানে তাে সুশীতল আর নেই। সে কবেই মরে গেছে। অথচ এই বকুলবাগানের সঙ্গে সুশীতল মিশে ছিল। ও সেই কবে বলেছিল—দেখিস পরিতােষ—একদিন তাের সরােদের খুব কদর হবে—সারা দেশ জুড়ে। তখন কেউ আমাকে ডাকেইনি। ডাকেনি বলেই আমিও দোর বন্ধ করে নাগাড়ে রেওয়াজ করেছি। কখন পশ্চিমের রােদ জানলা দিয়ে পিঠের ওপর লাফিয়ে পড়েছে। ঘামে, গরমে, জ্বালায় ডান হাতের নারকেল মালার জাবা তারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। খানিকক্ষণ পরে মনে হত মুখের ভেতর আমার জিভেই সুর উঠছে। তখন কিন্তু রােদে পিঠ পুড়ে যাচ্ছে। তবু সরে বসিনি। জাবায় স্ট্রোক দিয়ে চলেছি। জিভে নুন। সে নুন মিষ্টি।

গাঁজা পার্কের ভেতরটা জুড়ে পাতালরেলের যন্ত্রপাতি। সামনেই মােড়ের মাথায় পানদোকানির গায়ে গরম গরম চর্বির বড়া ভাজা হচ্ছে। তার জন্যেও শালপাতা হাতে টলােমলাে মানুষের সারি।

পরিতােষ বহুকাল পরে খােলা আটচালায় ঢুকে বসার আগে পয়সা গুনে দিলেন। শস্তার সােডা। বাতাবি লেবুর ভাগা। কনুই দুখানি টেবিলে রাখতেই নড়বড়ে টেবিলটা দুলে উঠল। নতুন নতুন মানুষ তাদের মুখে তাজা হাসি—সবাই খুব আনন্দ করতে এসেছে। এই নড়বড়ে টেবিলেই পরিতােষরা একসময় বন্ধুবান্ধব মিলে গ্লাস রাখত। গ্লাস দুলে উঠত। তার ভেতরকার সবটাই চলকে উঠত। তখন মনে মনে পরিতােষের বাঁ হাতের নখ সরােদের স্টেনলেস স্টিলের বুকে তারগুলােকে চেপে ধরে জায়গামতাে সব সুর নিংড়ে নিত।

আজ এখন শীতের আরাম করার মতাে ঠান্ডা ভদ্দরলােকদের পাতলুন পরা ছেলেরা গ্লাসে ঢালছে। চোখে স্বপ্ন। গলায় তেজ। হাসি। তর্কাতর্কি।

হঠাৎ মেঝের দিকে নজর পড়ল পরিতােষের। দুজন গাট্টাগােট্টা ফর্সা বুড়াে—গায়ে সাদা ফতুয়া—নীচে হাঁটু অব্দি ধুতি—মেঝেতে থেবড়ে বসে চুক চুক করে খুব সুখে গ্লাসে মুখ দিচ্ছে। ফিরে ফিরে কাগজ থেকে নুন তুলে যে-যার জিভে ছুড়ে দিল। চওড়া হাতের মাংস কিছু শিথিল। বােঝাই যায় সারাদিন হার্ড লেবারের পর দুই ঠেলাওয়ালা চুপচাপ সুখ পাওয়ার জন্যে এখানে এসেছে। মুখে কোনাে কথা নেই। ভদ্দরলােকদের ছেলেদের মতাে কথায় কথায় আস্ফালন নেই। বরং মদের কাছে প্রণত—প্রসন্ন দুই বুড়াে বেয়াকুবের মতাে বকবক না করে আনন্দের সুরেলা অদৃশ্য বাতাসে ভেসে আছে। আঃ! এই সুর যদি আমি তুলে নিতে পারতাম। জগতের তাবৎ সুর মানুষের মুখশ্রী, হাসি, অভিমান, রাগের সঙ্গে মিশে আছে। আমি কি তা তুলে নিতে পারি ?

পরিতােষ দেখলেন, দুই বুড়াে কপালের ভ্র অব্দি চাপা হাসি ছড়িয়ে দিয়ে সারা আটচালায় বসে থাকা ভদ্দরলােকদের ছেলেদের তড়পানাে তারিয়ে তারিয়ে চেখে দেখছে। সুরের পায়ের কাছে গিয়ে না বসলে এইভাবে তারিয়ে তারিয়ে চাখা যায় না। এজন্যে আমাকে কি আবার পশ্চিমের রােদে পিঠ দিয়ে রেওয়াজে বসতে হবে?—ফের যদি অপমানের নুনকে জিভের নীচে চিনতে পারি। চিনে নিতে পারি। যেমন কিনা আজ দেখলাম—গত তিরিশ-বত্রিশ বছর ধরে দোকানে পড়ে থাকা বেহাগ, গৌড় সারং—সব কিছুরই গতি হয়েছে সেই স্যাতসেতে গন্ধওয়ালা ড্রেনটায়।

রাত দশটা নাগাদ কিছু টলােমলাে হয়ে মিনিবাসে উঠলেন পরিতােষ সরখেল। বড়াে স্টপ। এখানেই মিনি প্রায় খালি হয়ে যায়। আজ রাতে অদৃশ্য বাতাসের আনন্দ খানিকটা পরিতােষের মাথায় ঢুকে পড়েছে। তিনি এই আনন্দকে সুরে বসাতে চান। তাই কেন জানি হঠাৎ বলে বসলেন, এ কী ? আমিও উঠলাম—আর আপনারাও নেমে যাচ্ছেন?

সবাই অবাক হয়ে পরিতােষের মুখে তাকাল। তারা এরকম প্যাসেঞ্জার কখনাে দেখেনি। দেখতে তাে রীতিমতাে বিশিষ্ট ভদ্রলােক। তাহলে?

নামতে নামতে এক প্যাসেঞ্জার বলল, মদের কাছে ভালাে মন্দ—সব একাকার হয়ে যায়। একথাগুলাে কানে গেল পরিতােষের। রীতিমতাে দার্শনিক কথাবার্তা। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, আমার কি কোনাে ত্রুটি হল? সবাই কি রাগ করে নেমে যাচ্ছেন?

এক মহিলা—বয়স হয়েছে—তিনি নেমে যেতে যেতে বললেন, এ সংসারে কি রাগ করলে চলে? আপনি বসুন গিয়ে বাবা—পরিতােষ টের পাচ্ছিলেন, এই মিনিবাসের কেউই সরােদিয়া পরিতােষকে সনাক্ত করতে পারেনি। তাতে তাঁর আনন্দ আরাে বেড়ে যাচ্ছে।

আমি কি কোনাে দোষ করলাম?

একথায় মিনিবাসের বাকি সবাই তার মুখে তাকাল। নতুন প্যাসেঞ্জাররা ছুটে এসে যে যেখানে পারল বসে পড়ল। ততক্ষণে মিনিবাস ছুটছে। জানলা দিয়ে হিমেল বাতাস। দুপাশে কি আলাে নেই? সারা এলাকা অন্ধকার। তার ভেতর দিয়ে আলাে ঝলমল মিনিবাস ঝমাঝম করে ছুটে চলেছে। সারাদিনের পর কিছু ক্লান্ত প্যাসেঞ্জার—এখন ঘরমুখাে। কেউ ঢুলছে। কেউ-বা একদিকে ঘাড় কাত করে ঘুম আর সময়মতাে নেমে যাওয়ার মাঝামাঝি রেখা টানছে আচ্ছন্ন দশায়।।

কন্ডাক্টর এগিয়ে এল, টিকিট?

পরিতােষ এক গাল হেসে চেঁচিয়ে বললেন, এই দেখুন—সবাই দেখে রাখুন—এই সেই লােকটি।

কন্ডাক্টর তাে অবাক। সে প্রায় বােবা হয়ে গেল। পরিতােষ বললেন, এই সেই লােকটি—যে রােজ রােজ টিকিট চায়— সবাই পরিতােষের দিকে তাকাল।

পরিতােষ হা হা করে হেসে বললেন, আজ তুমি ধরা পড়ে গেছ। রােজ রােজ টিকিট চাওয়া !

কী বলছেন? টিকিট দিন— হুঁ! টিকিট। রােজ রােজ টিকিট দেওয়ার এই খেলা তােমার কতদিনের ? আঁ? ভেবেছ—কিছুই খেয়াল রাখি না আমরা।

দিন, দিন। পয়সা দিন।

দেব তাে আজ বটেই। তার আগে শুনি কতদিন ধরে এসব চলছে? পাবলিকের তা জানা দরকার। কম কথা ! দিনের পর দিন টিকিট চাওয়া?

মেলা বকাবেন না। পয়সা দিন।

ওঃ! বাবুর বকতেও কষ্ট হচ্ছে! আর দিব্যি দিনের পর দিন টিকিট কেটে যাওয়া পাবলিকের? যা কিনা আসলে পাবলিকের পকেট কাটা।

কী বললেন?

ঠিক বলেছি ভাই। তােমার কম বয়স। এই বয়সে ধরা পড়েছ। এখনাে তােমার সংশােধনের সময় আছে। আমরা চাই তুমি সৎপথে ফিরে এস। পাবলিকের যা গেছে তা তাে আর ফিরবে না। ট্রিপের পর ট্রিপ—দিনের পর দিন—সকাল সন্ধে—সমানে পাবলিকের গাঁট কেটে গেছ। এবার ভেবে দেখ—বার বার ঘুঘু ধান খেতে পারে? একবার তাকে ধরা পড়তেই হয়! —এখানে থেমে পরিতােষ সরখেল সারা মিনিবাসের প্যাসেঞ্জারদের মুখে তাকালেন, কী বলেন আপনারা?

ততক্ষণে সব প্যাসেঞ্জারের চোখের ঘুম ছুটে গেছে। তারা থ হয়ে পরিতােষের মুখে তাকিয়ে।

পরিতােষ সরখেলের মনে হল—অনেকদিন পরে তিনি দ্রুতলয়ে এইমাত্র বাজিয়ে উঠলেন।

একজন বলল, চুর চুর মাতাল! নামিয়ে দিন মশাই।

অন্যজন বলল, নামাতে গেলে গােলমাল করবে। তার চেয়ে থানায় ঢুকিয়ে দিন গাড়ি। পুলিশই নামিয়ে নেবে।

এরপর পাবলিকের এলােমেলাে কথা—

না। থানায় ঢােকালে আজ রাতের মতাে গাড়ি সেখানেই আটকে যাবে। তার চেয়ে বরং কিছু না বলে গাড়ি টার্মিনাসে নিয়ে চলুন। মাতালের ঠিক থাকে সব। জায়গামতাে ঠিক নেমে যাবে।

কন্ডাক্টর ছেলেটির কম বয়স। সে কোনাে আপসে রাজি নয়। সে গাড়ি থামিয়ে বলল, নেমে যান।

রীতিমতাে বিস্মিত গলায় পরিতােষ বললেন, কতদূর আস্পর্ধা দেখুন। এখন আমাকেই নামিয়ে দিতে চায় ? আমিই ধরেছি কিনা?

নামুন। নামুন বলছি।

বাইরে মিনির হেডলাইটের আলােয় ধরা পড়া অন্ধকারে তাকিয়ে পরিতােষ। বললেন ওরে বাবা! এখানে নামব কী? দেখছ না টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে।

বৃষ্টি নয়। শিশির। নামুন বলছি। বলতে বলতে কন্ডাক্টর হাত ধরে একরকম জোর করে ধাক্কা দিয়ে পরিতােষকে রাস্তায় নামিয়ে দিল, যত সব মাতালের কাণ্ড ! আর সব জোটেও এসে লাস্ট স্ট্রিপে।

হুস করে মিনি বেরিয়ে গেল। চারদিক আকাশের মতােই অন্ধকার। হিমবাতাসে শিশির কুচি। মাথাটা ভার-ভার। অথচ বেশ ফুর্তি হচ্ছে। পরিতােষ সরখেল টের পেলেন—মিনি থেকে নামিয়ে দেবার সময় কন্ডাক্টর ছােকরা তাঁর পিঠে ভারী মতাে অনেকটা অপমান চাপিয়ে দিয়েছে—যা কিনা বেশ সুস্বাদু—বইতেও ভালাে লাগছে তার। ওজন সামান্য। কিন্তু জ্বালা অনেকটা।

এখন বাড়ি ফিরি কী করে? চারদিকে নদীর চরের অন্ধকার। হেডলাইট দেখে হাত তােলেন পরিতােষ। ভুস করে লরি বেরিয়ে যায়। আবার হাত তােলেন তিনি। আলােটা কাছে আসতেই লাফ দিয়ে সরে যান তিনি। গ্যারেজমুখাে বেশি রাতের বাস। ডানদিকের হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটছে। আরেকটু হলেই চাপা পড়তেন তিনি। কী যে আমােদ হত। এরা কি গ্যারেজে ফেরার সময় সারাদিন ট্রাফিক রুল মেনে মেনে ক্লান্ত দশায় একটা দুটো চাপা দেওয়ার লােভ আর সামলাতে পারে না? এই সময়টায় তাে অন্ধকার রাস্তায় এসবের কোনাে সাক্ষী থাকে না।

হাত তুলতে একটা হেডলাইট স্পিড কমিয়ে পরিতােষের কাছাকাছি এসেই আবার জোরে ছুটতে লাগল।

সেই ফাঁকে হ্যান্ডেল ধরে ফেললেন পরিতােষ। কিন্তু একী ? বাসটার ভেতরে ঢােকার দরজা যে বন্ধ। বরযাত্রী সাপ্লাই দিয়ে কোত্থেকে ফিরছে হয়তাে।

শিশিরে হাত ভিজে যাচ্ছে। বাসের হ্যান্ডেলও ভিজে। থামাও। থামাও ভাই। পড়ে যাব যে— | কে কার কথা শােনে! বাস ছুটছে তাে ছুটছেই। পরিতােষ পড়াে-পড়াে। তার ভেতরেই ড্রাইভার গলা ছেড়ে গান ধরল। বাসের আওয়াজের সঙ্গে পাঞ্জাবির গান দিব্যি সঙ্গত করে চলছে। হাত বদলে হ্যান্ডেল সামলে ধরল পরিতােষ। তার ভেতরেই গানটার রাগ মনে হল—পাহাড়ি পিলু। গড়িয়ার লােহার পুলে এসে রাস্তা না পেয়ে বাসটা প্রায় থামাে থামাে। পরিতােষ সরখেল লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়লেন। আরেকটু হলেই ব্রিজের লােহায় গিয়ে

তাে লাগত। রাস্তা পেয়েই লরির মিছিলে বাসটা মিশে গেল ফের। ড্রাইভার তখনাে গাইছে। তার পাহাড়ি পিলু থামায়নি।

ফের শুনশান রাস্তা। অন্ধকার। ফুটপাথ ঘেঁষে এক অটো। তাতে সবজিওয়ালিদের মতাে সাদা থান ঢাকা দুই মেয়েমানুষ। ড্রাইভার ছােকরা স্টার্ট দেবে দেবে।

পরিতােষ চেঁচিয়ে উঠলেন, অটোদা—অটোদা—আমায় নেবে—

ছুটে গিয়ে সবজিওয়ালিদের পাশে বসলেন, পরিতােষ। ঠান্ডা হিম বাতাসে দুই সবজিওয়ালি প্রায় কুঁকড়ে গেছে। অটো ছুটছে। একেবারেই ইয়ট প্রায়। অন্ধকারটাই এখানে সমুদ্র। পরিতােষ তার পাশের সবজিওয়ালির পিঠে হাত রাখলেন। ভারী হাত।

ঝকানি দিয়ে সবজিওয়ালি পিঠ থেকে তার হাত সরিয়ে দিল। পরিতােষ ফের হাত রাখলেন। অমনি সবজিওয়ালি চিড়বিড় করে ঠেলে উঠল। থামাও। থামাও ড্রাইভার—কোথকে এ মাতাল তুললে? | ছােকরা ব্রেক কষল। তারপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলল, নেমে যান। নেমে যান বলছি—

আমি তাে কিছুই করিনি অটোদা— সবজিওয়ালি ধমকে উঠল, ন্যাকা। অসভ্য। পিঠি হাত রাখল কে আমার ?

আমি।—বলে অবাক হয়ে তাকালেন পরিতােষ। রেখেছি—তাতে কী হল ? পিঠে ছ্যাকা লাগল ?

নেমে যান। নেমে যান বলছি।

অটোও চলে যেতে পরিতােষ হাঁটতে লাগলেন। রথতলা পেরিয়ে তবে বাড়ির রাস্তা। সেখানেও অনেকটা হাঁটতে হবে। এখন তাে রিকশা পাওয়া যাবে না। অটোর পেছনের লাল আলাের ফুটকিটা কুয়াশায় হারিয়ে গেল।

অটো খুব ভালাে অপমান করতে পারে।

খানিক হাঁটার পর প্রায় দেবদুতের মতােই একখানা সাইকেলভ্যান চলে যাচ্ছিল। হাঁটতে ভালােই লাগছিল পরিতােষের। সেই কখন বেরিয়ে পড়েছেন। তবু ভ্যানটা দেখে তিনিই চেঁচিয়ে উঠলেন, ভ্যানদা। ভ্যানদা। আমায় নেবে—

কিছু না বলে সাইকেলভ্যানটা থামল।

পরিতােষ এগিয়ে গিয়ে পেছনদিকে দুই পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসল। কোখেকে এত রাতে? | রাজপুরের পাইকারি বাজারে দু-কঁদি ডাব দিয়ে ফিরলাম।

সাইকেলভ্যানটা চলছে যেন নতুন কেনা কোনাে মারুতি। এত সুদ। যতই এগােয়—ততই অবাক হন পরিতােষ—সাইকেলভ্যান যে তারই বাড়ির রাস্তা ধরছে।

আমার কাছে যে বিশেষ পয়সা নেই ভ্যানদা— পরিতােষ চাইছিলেন, ভ্যানওয়ালা বলুক—পয়সা নেই তাে ভ্যানে উঠলেন

কেন?

তাহলে খুব জমে যায়। অন্ধকার রাতে ভ্যানওয়ালার কথার কোনাে উচিত জবাব দিতে না পেরে রাস্তার ধারে অপমানে তিনি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। ঠিক যেমনটি তিনি চাইছেন—ঠিক তেমনটি হয়ে ওঠা।

ভ্যানওয়ালা বলল, তাতে কী! আমি তাে খালি গাড়ি নিয়ে ফিরছিলাম।

পকেটে অনেক টাকা থাকতেও পরিতােষ কাচুমাচু হয়ে বলল, সত্যি কিছু নেই সঙ্গে।

তাতে কি। আমি কি চেয়েছি বাবু? পরিতােষ খুবই বিরক্ত হলেন। কিছুতেই যে লােকটা তাকে অপমান করবে । অন্ধকার নিশুতি রাতের পৃথিবী কি এমন মােলায়েম হয়ে যায়? জানা ছিল না তার।

পরিতােষ বললেন, দিনের বেলায় এসে পয়সা নিয়ে যেয়াে ভ্যানদা— বেশ। আপনি যখন বলছেন তাে নিতে আসব। বাড়ি চিনবে কী করে?

আপনাকে আমরা চিনি বাবু। ওই তাে বারান্দায় বসে একটা যন্ত্র কোলে নিয়ে সারাদিন পিড়িং-পিড়িং করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *