অপদেবতা

অপদেবতা

এ্যাই বিশে, শ্লা এখানে কি করিস বে দিন রাত?

এ্যাই? —কর্কশ স্বরে তেলিয়া গর্জে ওঠে লোকটার দিকে চেয়ে।

বিশ্বনাথ ওরফে বিশের চেহারাটাও বিচিত্র ধরনের। শীর্ণ চেহারা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ, তার বেশীর ভাগই পাকা, দু চার গাছি কাঁচা থেকে মুখে আলো আঁধারির ভাগ এনেছে, লম্বাটে মুখ, মাথাটার চুলগুলো উস্কোখুস্কো।

তেলিয়ার ধমকে বিশে নাটমন্দিরের ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে বসে। তেলিয়ার ভরাটি মুখ, দেড়খানা চোখের দিকে চাইল। তেলিয়া সব সময়ই মদের নেশায় ফিট হয়ে থাকে, একটা চোখ ট্যারা, সেই ট্যারা চোখের চাহনিটা কেমন বীভৎস ঠেকে। পরনে কালচে রং-এর জিনস, পেছনের পকেট থেকে চ্যাপটা বোতলটা বের করে বসল নাটমন্দিরে। এখানে যেন তার মৌরসীপাট্টা।

তেলিয়ার পায়ের জুতোটাও খোলা হয়নি, বোধহয় খেয়াল নেই। তেলিয়ার চ্যালা বুলেট ততক্ষণে মাটির ভাঁড়ে ধাবা থেকে আনা মাংসটা বের করে দেয়। মদের অনুপানই ওটা।

বিশে ওর পায়ে জুতো দেখে বলে— ইকি গো, দেবস্থান, বাবা কপালেশ্বর শিবের ঠাঁই, জুতো পরেই এসেছ? খোল—

তেলিয়া কিছু বলার আগেই বুলেট বলে শানা ঢ্যামনার কি ধম্মোজ্ঞান গো? বলে জুতো খোল—

তেলিয়া বলে, বাবা কপিলেশ্বরের এঁড়ে। ভাগ ব্যাটা। যা এখন আমাদের দরকারী কাজ আছে, টিক টিক করিস না।

বিশে জানে এর পর কি হবে এখানে এই গভীর রাতে। ওরাই কিছুদিন থেকে মন্দিরে আনাগোনা শুরু করেছে। নানা কিছু হয় শুনেই বিশ্বনাথ কৌতূহলী হয়ে ওঠে। ওই সব নোংরা কাজ এখানে কেউ করুক তা চায় না বিশু।

কিন্তু এবার তেলিয়া পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে সেটা হাতে লুফতে লুফতে বলে—গেলি?

পায়ে পায়ে সরে আসে বিশ্বনাথ বেগতিক দেখে। এরপর রাত গভীরে গাছগাছালি ঘেরা এই মন্দির চত্বরে ওদের লোকজনের আনাগোনা চলবে। সকালে মন্দির চত্বরে নাটমন্দিরে দেখা যাবে মদের বোতল মাংসের হাড় ছিটিয়ে পড়ে আছে ওদের পাশবিকতার চিহ্ন হিসাবে।

সেগুলোকে সাফ করে বিশুই ভোরের মুখে। মন্দিরকে ওই শয়তানের দল যেন কলুষিত করে তুলেছে। কিছু বলার নেই, বলেও কোন ফল হয়নি। মন্দিরের বংশ পরম্পরায় পুজো করে আসছে পাশের গ্রামের চাটুয্যেরা। এখন পূজারী বংশী চাটুজ্যেকেও বলেছে বিশু ওদের কথা। বংশী চাটুজ্যে সব শুনে বলে দিনকাল ভাল নয় রে, ওদের ঘাটাস নে, তুই বরং ভোর ভোর ওসব ময়লা সাফ সুতরো করে ফেলবি। যা পুজোর ফুল ঠিকঠাক আছে কিনা দেখ গে। আরতি শুরু করতে হবে।

বিশু চুপ করে যায়। সে জেনেছে বংশী চাটুজ্যেও সব জানে, তবে কেন জানে না বিশু চাটুজ্যে ওদের নিষেধও করে না। মন্দিরে ভক্তদের আনাগোনা বাড়ে। মন্দিরে বংশী চাটুজ্যে টিকি নেড়ে ঘণ্টা বাজিয়ে আরতি শুরু করে আর মাঝে মাঝে পিছনে নাটমন্দিরের দিকে চেয়ে নেয়। মন্দিরে লোক সমাগম বিশেষ করে মায়েরা, মেয়েরা বেশী এলে চাটুজ্যে তার শীর্ণদেহ নিয়ে আরতির কাঁসর ঘণ্টার তালে নৃত্যটাও বেশ জমিয়ে করে, কম সমাগম হলে কোনমতে ব্যাজার মুখে আরতি সারে।

আর বিশুই শাঁখ বাজায়—আরতির সমাপ্তি শঙ্খ। শীর্ণ হিলহিলে বুক—তবু ওই বুকে যে এত জোর আছে তা বোঝা যায় না। বোঝা যায় সেই শক্তির বহর ওর শঙ্খধ্বনিতে। ভরাটি শব্দটি বায়ুস্তর বিদীর্ণ করে একটানা গর্জে ওঠে। দূর গ্রাম বসতির মানুষও ওই শঙ্খধ্বনি চেনে। গৃহস্থ ওই ধ্বনি শুনে নমস্কার জানায়। দূরের দেবতাকে চাষী হাল চালানো থামিয়ে নমস্কার জানায়। ঘরের মেয়ে বৌরাও প্রণাম করে। বিশের শাঁখ তখনও বেজে চলেছে। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে সেই শব্দটা।

একটানা বিশ-পঁচিশ বছর ধরে বিশে বাবা কপালেশ্বরের মন্দিরে পড়ে আছে। সংসারে বিশের সবই ছিল একদিন। কিন্তু ওলাওঠা মহামারীতে বাবা মা মারা যেতে বিশেও পথে দাঁড়ায়। জমি জারাত সামান্যই তাও দেখাশোনার অভাবে যেতে বসেছে, তার কাকাই একদিন জানায়

—ওই দুবিঘে জমি আর বসতবাড়ি তোর বাবা আমার কাছে হাজার টাকায় বন্ধক রেখেছিল। তা তুই টাকা ফেরৎ দে, তোর জমিজারাত দখল করার ইচ্ছা আমার নেই। সুদেমূলে বাইশশো পঞ্চান্ন টাকা হয়েছে। তা পঞ্চান্ন টাকা ছেড়েই দিলাম, বাকি টাকা দে, বাড়ি জমি তোরই থাকবে।

বিশে যেন আকাশ থেকে পড়ে।

—কি কি গো? এসব কথা তো বাবা কুনদিন বলেনি।

কাকা তোরঙ্গ থেকে একখানা দলিল বের করে বলে—পড়ে দ্যাখ, সরকারী ছাপ মারা দলিল।

বিশের কাকা কোর্টের মুহুরী। আইন কানুন সব তার নখদর্পণে। তাই বিশে আর কথা বলে না। তার কিছুদিন পরই কাকা বাড়ি জমি সব দখল করে। কোথায় যাবে জানে না ছেলেটা।

প্রত্যন্ত গ্রাম, চারিদিকে লাল বন্ধ্যা মাটি, পলাশের ঝোপ। ওদিকে দামোদরের বিস্তীর্ণ বালুচর, এদিকে শালবনের শুরু। এই গ্রামকে যেমন বাইরের লোক চেনে না, এ গ্রামে মানুষরাও সহজে কেউ এই নিরাপদ গণ্ডী ছেড়ে গ্রামের বাইরে যেতে সাহস করে না। বিশেষ করে বিন্দুদের মত ছেলেরা লেখাপড়াও তেমন শেখেনি।

যারা লেখাপড়া শিখেছে তাদের অনেকেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে শহরে, কিন্তু বিশেদের বাইরে যাবার সাহস নেই।

সব তার হারিয়ে গেল। গ্রামের বাইরে বাবা কপালেশ্বরের মন্দির। সামনে একটা বেশ বড় দিঘী। ওদিকে শালবনের শুরু।

জনবসতি এসে থেমেছে মন্দিরের ওপাশে। বট, অশ্বত্থ, শাল নানা গাছগুলোর মাঝে মন্দিরটা উঠেছে অতীতে উড়িষ্যাশৈলীর কারুকার্য নিয়ে, সুউচ্চ মন্দিরের মাথায় বিশাল একপাথরের কারুকার্যকরা আমলক, চৌপল কাটা দেওয়াল, সামনে নাটমন্দির।

মন্দিরের মধ্যে সিঁড়ির মত করা চারিদিক, ধাপে ধাপে নেমে গেছে। বেশ কিছুটা নামলে তবে শিবলিঙ্গ, হয়তো ওই বিশাল দিঘীর সঙ্গে মাটির নীচে কোন যোগসূত্র আছে। সেই পথে জল এসে লিঙ্গকে বেষ্টিত করে রাখে। সারা এলাকার মানুষের কাছে জাগ্রত দেবতা শিবলিঙ্গ। কেউ বলে উনি নাকি পাতাল ফুঁড়ে আবির্ভূত হয়েছেন।

এককালে জমিদারী প্রথা যখন চালু ছিল তখন মহা সমারোহেই নিত্য পূজা, ভোগ সব চলত। তখন চাষীবাসীর ঘরে অভাবের নগ্ন মূর্তিটা তত প্রকট হয়নি, তাই তারা দেবতার উদ্দেশ্যে আনত ধান চাল নানা ফসল, প্রণামীও দিত। ভক্তি ছিল। সকলের মনে ছিল শান্তির স্পর্শ।

বিশে ছেলেবেলাতেও দেখেছে সেই আড়ম্বর, তখন চৈত্রমাসের গাজনে বিরাট উৎসব হত। দশদিন ধরে বিরাট মেলা বসত। সারা এলাকা আলোয় ঝলমল করত। আকাশ বাতাস মুখরিত করে জয়ধ্বনি উঠত—

জয়বাবা কপালেশ্বর নাথমুনি মহাদেব।

প্রচুর লোক ভক্ত জমত। তাতে জাত বিচার ছিল না। বাবার কাছে সব সন্তানই সমান। বহু মানুষ এই দিঘীর জলে স্নান করে, ভিজে কাপড়ে এই কাঁকুরে কঠিন মাটিতে সাষ্টাঙ্গ হয়ে শুয়ে শুয়ে দন্ডি কেটে মন্দিরে আসত। মেলায় দোকানে স্তূপাকার হয়ে রকমারী খাবার থাকত।

ক্রমশ জমিদারী চলে যেতে দেবতার জমিদারীও চলে গেল। চাটুয্যেবংশের বোলবোলাও উবে গেল। বংশীর দুই দাদা লেখাপড়া শিখে দেশ ছেড়ে চলে গেল। সেই অবস্থাও আর নাই। মন্দিরের ভক্তরাও কোথায় হারিয়ে গেল। বংশী চাটুয্যে স্কুলে ক্লাস সেভেনে উঠতে বার কয়েক হোঁচট খেয়ে পড়া ছেড়ে জমি জায়গা সামান্য যা আছে তাই দেখাশোনা করে। আর সকাল সন্ধ্যা পৈত্রিক বিগ্রহ এই বাবা কপালেশ্বরের সেবা করে। বিগ্রহ এখন নিগ্রহে পরিণত হয়েছে। লোকজনও আসে কম। দেশের হালই বদলে গেছে। দেব ভক্তিটক্তি মন থেকে মুখে গেছে মানুষের।

খরা—অনাবৃষ্টি এদিকের নিত্যসঙ্গী। রুক্ষ লাল কর্কশ মাটি, কাছিমের পিঠের মত উঠে গেছে বন্ধ্যা প্রান্তর বনভূমি। আগে তবু সবুজ শালবন ছিল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে, এখন শালগাছ আর নেই, মরা মরা কিছু পলাশগাছই টিকে আছে। চৈত্রমাসের গাজনের সময় ঘুমন্ত মন্দির এলাকা যেমন জেগে ওঠে তখন ওরাও সেজে ওঠে লাল ফুলের সাজ নিয়ে। সেই ফুল ঝরার পর আবার শূন্যতা জাগে সেখানে, মন্দিরও জনশূন্য হয়ে থাকে।

কিন্তু বিশুই থেকে যায় একা এই মন্দির চত্বরে।

বাবা মা মারা যাবার পর কাকাও তার বাড়ি জমির দখল নিয়ে পথে বের করে দিল। কোথায় যাবে সে?

নির্জন নাটমন্দিরে এসে বসে থাকে। পূজার পর বংশী চাটুয্যে ভোগ রান্না করে—দায়সারা গোছের ব্যাপার। নাটমন্দিরের ওদিকে একটা ভোগরান্নার ঘরও আছে। সেটা বন্ধ হয়েই থাকে। বারান্দায় একটা উনুনে কাঠকুটো জ্বেলে সামান্য পরমান্ন ভোগ দিয়েই দুটো ফুল বেলপাতা ছড়িয়ে এবেলার মত কর্তব্য শেষ করে চলে যায় বংশী চাটুয্যে। ছেলেটা তারপর একাই মন্দিরের চাতালে বসে থাকে। ছায়া নামে চারিদিকে, বাইরের মাঠে—প্রান্তরে, খরা রোদ লেলিহান শিখায় নৃত্য করে। এখানে একটা প্রশান্তি বিরাজমান। তেষ্টার জলও রয়েছে দিঘীতে। পাখীর ডাকে মুখর শ্যাম সবুজ। এখানে যেন মানুষের লোভী হাত নেই। এক নিবিড় প্রশান্তির রাজ্য। ওই উনুনে মাটির মালসায় চাল-আলু কারও বাগানের কলা সেদ্ধ করে খেয়ে নেয় বিশে। তারপর নাটমন্দিরে শুয়ে পড়ে।

সন্ধ্যার আগে আসে বংশী চাটুজ্যে—একা তার আসতে ভয় করে। বংশীকে দেখে বলে, এ্যাই কাঁসর ঘণ্টাটা বাজা। বাবার আরতির সময় ওসব বাজাতে হয়।

বিশু কাঁসর বাজাতে থাকে। স্তব্ধ প্রান্তরের মাঝে ওই বনঘেরা পরিবেশে বেজে ওঠে কাঁসর, আরতি করে চাটুজ্যে; সে আবার হেপো রুগী। বুকের জোর নেই, এমনিতেই বুকটা হাপরের মত ওঠা নামা করে, শাঁখ বাজাবার মত দম তার নেই। কি ভেবে চাটুজ্যে বড় শাঁখটা এগিয়ে দেয়, বলে—বাজাতে পারবি? বাজা—

বিশু ত বামুনের ছেলে। বাবা মা থাকতে তার উপনয়নও দিয়েছিলেন কবে মনে পড়ে না, তবে সংস্কারবশে গলায় মলিন কগাছি সুতো এখনও রয়েছে। সুতরাং মন্দিরে ঢোকার অধিকারও তার আছে। শাঁখটা তুলে নিয়ে বাজায় বিশু প্রথমে আস্তে তারপর পুরো দমে বাজাতে থাকে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে গাঁয়ে। এসময়, ঘরের বৌ ঝিরা সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালে, শাঁখ বাজায়। তারাও সচকিত হয়ে ওঠে, গ্রামপ্রান্তের ওই ছায়াঘেরা মন্দির থেকে শাঁখের একটানা শব্দ ওঠে বেশ দীর্ঘদিন পর। বংশী চাটুজ্যে তো শাঁখ বাজাতে পারে না। তাই মন্দিরে নীরবেই আরতি হত।

এখন সন্ধ্যায় সকালে কাঁসর ঘণ্টা বাজে। একটানা বাজে ওই বড় শাঁখটাও। গ্রামের মানুষের কাছে মন্দিরের অস্তিত্বের কথা, দেবতার পরিচয় যেন ঘোষিত হতে থাকে।

ক্রমশ সকালে-সন্ধ্যায় কিছু মানুষজন আসে। দেবতার ভোগের জন্য সিধেও আসতে থাকে। চাল-ডাল-আনাজপত্র, প্রণামীও পাঁচ দশ টাকা পড়তে থাকে।

বংশী চাটুয্যে দেখে এখন এই মন্দিরের হাল ফিরিয়েছে বিশে। বিশের কাছে এই দেবতা, দেবস্থানই যেন তার জীবনের পরম একটা নির্ভর হয়ে ওঠে। ওই মন্দিরে যেন পাথরের দেবতার অন্তরালে একটি জাগ্রত শুভচেতনাই রয়েছে যে মানুষের মনের জ্বালাকে প্রশমিত করতে পারে শান্তির স্পর্শে। দেখেছে বিশু সেই দেবতাই যেন মানুষের মনে শুভ শক্তি দেন—সব অন্যায়কে সহ্য করার, প্রতিবাদ করার সাহস দেন।

বিশু দেখেছে কতদিন নিস্তব্ধ তারাকীর্ণ রাত্রে এই মন্দির চত্বর, বনভূমি কি অপরূপ রূপে সেজে ওঠে। বাতাসে জাগে কত সুবাস। পাখীর কাকলিতে যেন অদৃশ্য সেই মঙ্গলময় দেবতার বন্দনাগান ফুটে ওঠে, আকাশের আঙিনায় হাজারো তাজাফুল ফোটে তারই পূজার জন্য।

বংশী চাটুয্যেও দেখছে ভক্তরা যা সিধে দেয়, তাতেই ভোগ হয়ে যায়। আর মন্দিরও এখন বিশের জন্য ঝকঝকে তকতকে হয়ে উঠেছে। ভোর থেকে বিশে ওই দেবতার কাজে লেগে যায়। মন্দির চত্বর ঝাঁট দিয়ে সাফ করে। ফাঁকা জায়গাতে সে এর মধ্যে টগর, গন্ধরাজ, জবাগাছও লাগিয়েছে। দিঘী থেকে জল এনে মন্দির, নাটমন্দির ধোয়, গাছে জল দেয়, ধূপ ধুনো জ্বালে। এদিকে বংশীও এসে পড়ে, ক্রমশ দুদশ জন ভক্ত আসে। কেউ সিধে দেয়। ভাল রকম সিধে। বংশী বলে—

বিশে, ভোগটা রান্না কর।

বিশে স্নান করে রান্নার কাজে হাত লাগায়। বংশী ততক্ষণে পুজো সেরে এবার আসে প্রার্থীদের বাবার স্বপ্নাদ্য মাদুলি, চানজলও দেয়। এতে নাকি অনেকের রোগও সারে। মনস্কামনা পূর্ণ হয়, কি হয় তা জানে না বংশী তবে বেশ জেনেছে এতে তার ভালই রোজগার হয়। অনেকের রোগও সারে। কেন তা জানার দরকার নাই বংশীর। সে আরও জোরে জোরে জয়ধ্বনি দেয়।

জয় বাবা কপালেশ্বর।

বংশী চাটুয্যে এখন দু পয়সার মুখ দেখেছে। মন্দিরের প্রণামীও পড়ছে বেশ। মন্দির পতিত পড়েছিল তাই মানুষ আসেনি। সেই পতিত-পরিত্যক্ত মন্দির আর দেবতাকে জাগ্রত করেছে ওই বিশুই। বংশী দুপুরের ভোগের কিছু আর রাতের শীতল প্রসাদ চিঁড়ে, বাতাসা, মুড়কি কলা এসবের কিছু খায়। বিশে মাইনের কথা বলে না। বলে এ জীবনে তো কিছুই হল নাই গো, তবু বাবার সেবা করে যাই, যদি আসচে জন্মে কিছু সুখশান্তি মেলে।

প্রণামী ধুতি গামছাও পড়ে বেশ। বিশেষ করে চৈত্রমাসের গাজনে তো ভালই আয় হয়। তার থেকে দু একখানা ধুতি গামছাও পায় বিশে।

এইভাবেই কোনমতে এই কপালেশ্বরকে জাগ্রত রেখেছিল বিশে। ভোরবেলাতে তার শাঁখ বাজত—আরতির কাঁসর ঘণ্টা বাজত। গৃহস্থদের ঘুম ভাঙত—আবার রাতে বাজত একটানা শাঁখ, কাঁসর, ঘণ্টা। স্থানীয় মানুষের জীবনের ছন্দে মিশে গেছল এই সুর, শব্দ, দেব অস্তিত্বের অনুভূতি। এই নিয়েই চলছিল বাবা কপালেশ্বরের মন্দিরের নিঃসঙ্গ জীবন।

হঠাৎ এই বিস্তীর্ণ প্রান্তর, বনভূমিতে গড়ে উঠতে শুরু করল বিশাল কোলিয়ারি। ওদিকে বিস্তীর্ণ দামোদরের বালিচরে শুরু হল ব্যারেজ গড়ার কাজ। ওদিকের রেল স্টেশনের সঙ্গে যাতায়াত চলবে বারোমাস। বর্ষায় দুর্গম দুস্তর পারাবার হয়ে ওঠে এই দামোদর। বাইরের জগতের সঙ্গে তখন আর কোন যোগাযোগ থাকে না। এদিকে বনভূমি—সামান্য জনবসতি তখন যেন নির্জন নিঃসঙ্গতার মাঝে নিজের অস্তিত্বটুকু নিয়ে কোনমতে টিকে থাকে মাত্র।

এতদিন ওই শাল পলাশের বনভূমি বন্ধ্যাপ্রান্তর অবহেলিত অবজ্ঞাত হয়ে পড়েছিল, এবার সেখানে জেগেছে প্রাণের সাড়া। বড় বড় বুলডোজার, বিশালাকায় আর্থমুভার, ক্রেন—নানা কিছু যন্ত্র বসছে। ওদিকে উঠছে টানা ব্যারাক মত ঘরগুলো, তাঁবুও পড়েছে অনেক। রাতারাতি তিনমাইল দূরের পিচরাস্তার সংযোগকারী রাস্তাও গড়ে উঠছে, ট্রাক ট্রাক ইট, সিমেন্ট, লোহা আসছে, ওদিকে তৈরি হচ্ছে অফিসঘর।

আর অনেক লোকজনও এসেছে, এর মধ্যে ঘুমন্ত গ্রামও জেগে উঠেছে। ওই মাঠের ধারে বেশ কিছু গ্রামের লোক চালা তুলে পান সিগ্রেট চা বিস্কুটের দোকান, কেউ মুদিখানা, মনোহারী, কেউ বা চালার নীচেই ভাতের হোটেল বানিয়েছে।

কয়েক শো লোক নানা কাজে এখানে ব্যস্ত। মজুর, যন্ত্রপাতির মেকানিক অপারেটার, অফিসকর্মী অনেক এসেছে। তাদের চা-জলখাবার, খাবার এসব চাই, তাই দোকানপত্র ভালই চলছে, এতদিন এই গ্রাম আশপাশের গ্রামের লোকের রোজগারের উপায় বলতে ছিল সামান্য চাষের জমি। তাও আকাশমুখী। ছটি মাস কিছু চাষবাস হয় তখন কয়েক মাস কাজ পায় স্থানীয় কিছু মানুষ। তারপর বেকার রোজগারও নেই, হা অন্ন করে ঘুরত, কাজও মিলতো না।

সেই মানুষগুলোর দিন বদলেছে। এখন কাজের লোক খুঁজছে কোম্পানি, কাজ করলে নগদ চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা হাতে পাচ্ছে। যার বাড়িতে তিনচার জন মানুষ তারা দিন শেষে এখন ভাল টাকা পাচ্ছে যা ছিল তাদের স্বপ্নেরও অতীত।

আর অনেকে দোকানপত্র করেও বেশ টাকা পাচ্ছে। চাষীর আনাজপত্র নগদ পয়সায় চড়া দামে বিকোচ্ছে। ফলে জায়গাটার রূপই বদলে গেছে। আর কটা টাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে যে কাজগুলো এতদিন করেনি, এখানকার মানুষেরা তাও করতে শুরু করল। বাইরের কিছু মানুষ এসে পড়েছে। গাঁয়ের পবিত্র লোহার, মতি মোষ এতদিন মদ টদ বানাত, তবে খুবই গোপনে নিজেদের জন্য। এখন বাইরে থেকে এসে একেবারে কোলিয়ারির ওদিকে রাস্তার ধারে ধাবা করেছে নন্দন সিং। তার কয়েকখানা ট্রাক এখানে ভাড়া খাটে, সেই সুবাদে এসে ওখানে ধাবা বানিয়ে রুটি তড়কাও বেচত। তারই ট্রাকে খালাশির কাজ করে তেলিয়া, মন্টারা। আরও অনেক ট্রাকই এখানে খাটছে। সেই সব গাড়ির ড্রাইভার, খালাসীর দল এক আধটু নেশা করে।

রতনে রতন চেনে। তাই তারা এই পাণ্ডববর্জিত জায়গাতেই পবিত্র, মতি ঘোষদের মত এলেমদার লোককে খুঁজে বের করে। রসিক জনদের চিনে নিতে দেরী হয়না। নন্দন সিং ব্যবসা বোঝে। সে দেখেছে এখানে ব্যবসার অনেকপথই খোলা আছে। আপাতত, এই ব্যবসাই চালু করবে সে।

তাই পবিত্র, মতিকে বলে বড়িয়া মাল বানাতে পারবে? একদম ফাসক্লাশ দারু চাহিয়ে। সামান হম দেগা। জায়গা সামান সব কুছ, তোমাদের হিস্যা থাকবে টাকায় বিশ পয়সা। ফ্রি মাল ভি মিলেগা।

পবিত্র বলে, শেষে পুলিশ যদি ধরে?

হাসে নন্দন সিং। দাড়ি চুলকিয়ে বলে পুলিশ। হামারা ধাবামে?

যেন পুলিশের অস্তিত্বের সম্বন্ধে এই প্রথম জানতে পারল সে। তারপর ঠা ঠা করে অবজ্ঞা ভরে বলে তুম লোগ ফিকির মৎ করো। উসব হামি শাসটে লিবে। রাখো পানশো রুপেয়া আগাম।

পবিত্র, মতি কোনদিন ভাবেনি যে তাদের লুকিয়ে ছুপিয়ে মদ চোলাই-এর কাজের জন্য এত টাকা হাতে দেবে কেউ।

তারাও এবার এলেম দেখাতে থাকে। জালা জালা মদ তৈরি হচ্ছে। বোতলে প্যাক হচ্ছে। নন্দন সিং তার অনুচর তেলিয়া, মন্টাদের দিয়েই মাল বিক্রি করাচ্ছে বাইরে। ধাবাতেও মাল মিলছে।

আর সারা অঞ্চলের হঠাৎ এত টাকা হাতে পাওয়া মজুররাও খুশীতে ওই মাল গিলতে শুরু করে। পয়সা উড়ছে এখানে।

আর হাতে অনায়াসে কাঁচা টাকা আসতে অনেকের দেবভক্তিও বেড়ে যায়। তাদের মনে হয় এসব ঘটেছে বাবা কপিলেশ্বরের মাহাত্ম্যেই। তাঁর দয়াতেই এখানকার মানুষের দিন বদলেছে।

তাই তারা এবার আরও বেশি সংখ্যাতেই আসে বাবা কপিলেশ্বরের ওই সবুজ ছায়াঢাকা মন্দিরে। ইদানীং বংশী চাটুজ্যেও জেনেছে অন্যদের মত বাবা কপিলেশ্বর তাকেও দয়া করেছে, করবেও।

তাই নাটমন্দিরের চুনকাম করিয়েছে কোন ভক্ত। একটা ঘণ্টাও ফিট করে দিয়েছে। দড়িটা ধরে টানলেও ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং। বেশ ভরাটি শব্দটা দূর গ্রাম অবধি ছড়িয়ে পড়ে আরতির সময়।

ভক্তজন এখন বাবাকে ভাল টাকাই প্রণামী দেয়। আর বংশীর ওই স্বপ্নাদ্য মাদুলি ধারণ করেই মানুষের দিন ফিরেছে। তাই মাদুলির চাহিদাও বেড়েছে আর বংশী চাটুজ্যে মিডিয়ম শক্তিশালী মাদুলির দাম করেছে মাত্র একান্ন টাকা আর একস্ট্রা স্ট্রং স্পেশাল মাদুলির দাম করেছে একশো একান্ন টাকা, তাই পড়তে পাচ্ছে না।

বাবার মন্দিরের প্রণামী, পূজা-সিধে এসবও এখন প্রচুর পড়ছে। বংশী তাই ঘন ঘন জয়ধ্বনি দেয়—জয় বাবা কপালেশ্বর। তারও দিন বদলেছে। এখন সে পাকা দালান তুলছে। বাড়িতে আরও টাকার দরকার। তাই এখন সে ওই নবাগত শাঁসালো মক্কেলের সন্ধানে ঘোরে ওই কোলিয়ারি মুলুকে, আর তাই নিজের ভেকটাও বদলেছে, গেরুয়া কাপড়, গায়ের চাদরটা গেরুয়া রঙের, আর বেশ কয়েকটা মালাও গলায় দিয়ে এখন মাঝে মাঝে হুঙ্কার তোলে—জয় বাবা কপালেশ্বর।

বিশুও দেখেছে চারিদিকের এই পরিবর্তনটা। কয়েক মাস—বছর ঘুরতে না ঘুরতে সব কিছু যেন বদলে গেছে। দেখে ওই বংশী চাটুজ্যেকে। চাটুজ্যের অনেক গুণের খবর সে জানে। আর চাটুজ্যে পরের পয়সায় মদ তো খায়ই। ইদানীং দেখেছে ওই গাছগাছালির আড়ালে বেশ কিছু উটকো লোকও আসে। এখানকার নির্জন পরিবেশে বসে গাঁজার কলকেতে দম মারে, আর বংশী চাটুজ্যের সঙ্গে তাদের বেশ দহরম মহরম আছে বলেই মনে হয়। বংশীই ওদের কলকে প্রথম টেনে বাবার জয়ধ্বনি দিয়ে সেই প্রসাদী কলকে ওদের তুলে দেয়। নিজে গাঁজার দমে শিবনেত্র হয়ে বসে থাকে।

বিশে দেখেছে ইদানীং বংশী চাটুয্যের ওই বেশবাস। বলে সে—ইকি গো চাটুয্যে? ভেকধারী বোষ্টমী জানি ভেকধারী বাবার পূজারীকে তো জানতাম না?

বংশী তখন দেবতার বাসি ফুল বেলপাতা মাদুলীর খোলে ভরতে ব্যস্ত। অর্ডিনারী একান্ন টাকা আর একস্ট্রা স্ট্রং (কথাটা বংশী নিজেই প্রচলিত করেছে পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন দেখে) মাদুলীর জন্য একশো একান্ন আর মহাশক্তি একস্ট্রা স্ট্রং মাদুলীও একটা বানাবার অর্ডার পেয়েছে। তার জন্য ওই নন্দন সিং দেবে পাঁচশো এক টাকা।

সেই মহাশক্তি মাদুলীর খোলে স্রেফ পচা বেলপাতা ফুল ঠাসতে ঠাসতে বলে— বিশে, বাবাই সেদিন স্বপ্নাদেশ দিলেন, ‘বাবা বংশী অনেকদিন সংসারের পাঁকে মজলি এবার পরকালের কথাটা ভাব।’

সংসার বাহ্য, অন্তরে মনে প্রাণে আমার স্মরণ নে। তাই ওসব ছেড়ে দোব ভাবছি রে। এখন লোকহিতের জন্যই বাবার চরণে পড়ে থাকব। তাই এসব পরছি রে।

বিশে চুপ করে শোনে।

হঠাৎ কার হাসির শব্দে চাইল বিশে। দেখে সৌরভীই এসেছে। পবিত্র লোহারের বোন সৌরভীর যৌবন যেন এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখন সৌরভীর সময় নেই। ওই নতুন কোলিয়ারির কলোনিতে তাকে দেখা যায়।

নন্দন সিং-এর ধাবাতেও দেখা যায় তাকে রাতের বেলায়। এখন তার সাজপোশাকেও চাকচিক্য এসেছে। বংশী চাটুয্যের কথাগুলো শুনেছে সৌরভী। বলে সে, তুমি সাধু হলে আমার কি হবেক গো চাটুজ্যে। গাছে তুলে শ্যাষে মই কেড়ে লেবা নাকি? অ মা গ..

সারা দেহে হাসির লহর খেলে যায়। চাটুয্যে এদিক ওদিকে চাইছে, রক্ষে ভক্তরা এখনও আসেনি। তবু বলে সে—এ্যাই, দেবস্থানে এসেছিস বাবাকে পেন্নাম করে যাতো।

সৌরভী বলে বাবা চ্যালাকে তো নিত্যই পেন্নাম করছি গ, উতে হবেক নাই? তা সিংজী বলছিল—

বংশী বলে ওর যজ্ঞটজ্ঞ করে তবে মাদুলি বানাতে হবে। বলবি আজ রাতে পেয়ে যাবে।

বিশে দেখছে সৌরভীকে। দীর্ঘদিন বিশে এই নির্জন মন্দিরে পড়ে আছে বাবা কপালেশ্বরের সেবক রূপে। কত বর্ষার বর্ষণমুখর রাতে সে দেখেছে পৃথিবীর রূপ, দেখেছে চাঁদনী রাতে মন্দির—এই বনভূমির মধ্যে এই অপূর্ব মহিমাময় রূপ। দেখেছে ঈশানের মেঘে কালবৈশাখীর মত্ত ঝড়ের মাঝে সৃষ্টির আর এক করাল রূপ। সেই মহাশক্তির ইঙ্গিতেই নামে রৌদ্রদগ্ধ নিঃস্ব প্রকৃতির বুকে বর্ষার ধারা, সোনা ফসলের সম্ভাবনা। দেখেছে কত মৃত্যু, কত নবজন্মকে। মন্দিরের মহাকালের বিধানেই যেন চলেছে সব কিছু। তার বিধানেই এই নিঃস্ব গ্রামে আজ এসেছে ঐশ্বর্যের জোয়ার। এ যেন তার রহস্যময় খেলাই। মানুষ সেই মহাকালের হাতের পুতুল মাত্র। বিশের কাছে তাই মিথ্যা মেকিটা যেন সহজেই ধরা পড়ে। যেমন পড়েছে বংশী চাটুয্যের ওই ভেকটা। লোকটার প্রকৃত স্বরূপ সেই দারিদ্র্যের মাঝে ফুটে ওঠেনি, টাকার গন্ধ পেতেই বংশীও বদলে গেছে।

শুধু বংশীই নয় বিশের চোখে পড়ে সামগ্রিক রূপ বদলটাই।

দেখেছে পবিত্র লোহার এখন প্যান্ট, টেরিলিনের জামা পরে।

মতি ঘোষের হালও বদলেছে। বদলেছে গ্রামের মানুষ, ওই সৌরভীর চোখে মুখেও দেখেছে বিশে সর্বনাশের ইঙ্গিত।

বদলায়নি শুধু এই বিশ্বনাথই।

গাঁয়ের দিকেও যায় না। তার কোন চাহিদাও নেই। বাবা কপালেশ্বরই যেন তার ভার নিয়েছে, সে মন্দিরে পড়ে থাকে ওই পাষাণ দেবতাকে নিয়ে। যিনি কালেরও ঊর্ধ্বে, মহাকাল, সেই মহাকালকেই যেন প্রত্যক্ষ করে বিশে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে।

মনে হয় এই পরিবর্তন আগেও ছিল না, কালের প্রবাহে সবই হারিয়ে যায়, এই পরিবর্তনও হারিয়ে যাবে, কিন্তু এই পরিবর্তন, লালসা-লোভ মানুষের ইতিহাসে একটা কলঙ্কিত অধ্যায়ই রচনা করে যাবে। তাই এই কাল যেন এক সর্বনাশা কালই, মানুষকে সাবধান করারও কেউ নেই এই সম্বন্ধে।

এ যেন এখানকার সমগ্র মানবসমাজের এক সংকটই এসেছে।

বিশে ভাবে কথাটা। কিন্তু করার কিছুই নাই। সে তো নিবিষ্টমনে ওই পাষাণ দেবতাকেই সেবা করে। মন্দিরের ভক্তদের সেবা করে। তার জন্য ত তার কোন প্রত্যাশাও নাই। সেবার মধ্য দিয়েই সে পায় একটু তৃপ্তি। মনে হয় বাবা কপালেশ্বর তার সব প্রাপ্য চুকিয়ে দিয়েছেন, সে অন্তর মনে পরিপূর্ণ একটি সত্তা।

বংশী চাটুয্যেকে চন্দন সিং-এর দরকার। এখন তার ওই চোলাই মদের কাজ অনেক বেড়েছে। ওদিকে চন্দন সিং বনের মাঝে বেশ খানিকটা এলাকা দখল করেছে। সেখানেই তৈরি হয় ওই বস্তু। পবিত্র, মতিরা এখন ম্যানেজার। কারিগরও অনেক তৈরি করেছে তারা তালিম দিয়ে।

নন্দন সিং ওই মালের কারবারেই লাল হয়ে গেছে। ট্রাকও কিনেছে আরও দুটো। আর এক নতুন ব্যবসার সন্ধানও পেয়েছে সে।

এখানে ওই বন্ধ্যা লাল কাঁকুরে মাটির প্রায় আট দশ ফিট নিচেই রয়েছে গ্রেড বি শ্রেণীর অফুরান ভোলাটাইল কয়লা। এত কাছে যে এমন সোনার খনি আছে তা এখানকার মানুষরা জানত না। এখন সরকার থেকে খুঁড়ে ওই কয়লা হীরের সঞ্চয়কে বের করেছে। তার জন্য এত বড় কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে।

আর নন্দন সিং এর মধ্যেই চক্কর চালিয়ে গার্ড-মায় উপরওয়ালাদেরও হাত করেছে। নীচুতলার লোকদের হাতে আনতে তার মদ আর টাকাই যথেষ্ট। রাতের অন্ধকারে নন্দন সিং ওই বনের মধ্যে তার জায়গাতেই বিশাল কুয়ো খুঁড়েছে, নামেই কুয়ো, নন্দন সিং জানে ওতে জল ওঠেনা, তার তেলিয়া মন্টার দল আরও সঙ্গীদের নিয়ে ওই কুয়োতে নামে আর সেই কয়লাস্তর থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি কয়লা তোলে, সে সব মাল ট্রাকে বোঝাই হয়ে রাতাতাতি বাইরে চলে যায়।

তার জন্য ভুয়ো চালানও তৈরি করেছে নন্দন সিং, অবশ্য এইসবের জন্য তাকে লাভের একটা অংশ এদিকে ওদিকে প্রণামী বাবদ দিতে হয়।

তবে সব দেবতাকে দিয়ে তার যা থাকে সেটা অনেক।

নন্দন সিং ধাবাটা অবশ্য রেখেছে, তবে ওটার রূপ বদলেছে সে। এখন মোজাইক করা মেজে, রঙীন কাচের দরজা, দামী টেবিল চেয়ার ওদিকে সাজানো কাউন্টারে সব রকম খাবার মেলে, হিন্দী গান বাজে আর চলে এখানে বিদেশী মদ। এটা নন্দন সিং-এর পয়মন্ত ব্যবসা।

অবশ্য এর মধ্যে সৌরভীর সন্ধানও পায় নন্দন পবিত্রের মারফত।

সৌরভী—পয়লা নজরে দেখেই মনে হয় নন্দন সিং-এর—এ পারবে। নন্দন সিং নিজেই জহুরী, সে আসলি রতন চেনে। মেয়েটার চোখ কথা বলে, এ যেন চাইচাপা আগুন।

সৌরভীই বলে, এত হাঁ করে দেখছ কি গো জুল জুল করে? নজরে ধরেছে বুঝি? কিগো সিংজী? তা বাপু এমন দাড়িওলা নাগর আমার বাপু সইবে না।

নন্দন সিং বলে, তু বহুৎ সুন্দর আছিস।

—মাইরী? সত্যি বলছ না মন রেখে বলছ গো?

সৌরভীকে বলে নন্দন—তু পরে আসবি। তুর সাথে কোথা আছে। সৌরভীও ওর দলে ভিড়েছে। ইদানীং ট্রাকে বড় বড় জেরিক্যানে মাল চালান যাচ্ছে দুর্গাপুর, রাণীগঞ্জেও। সৌরভী গাড়িতে থাকলে মাল নির্বিঘ্নে ঠিকানায় পৌঁছে যায়। কোন গড়বড় হয় না। অবশ্য সৌরভীও জানে কি মন্ত্রে কাকে তুষ্ট করতে হয়, আর এই করে ভাল টাকাও পায় সে।

নন্দন সিং এখন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তাই তার দেবভক্তিও দেখাতে হয়। সৌরভীই আনে নন্দন সিংকে বাবা কপালেশ্বরের মন্দিরে। জিপটা এসে থামে সোজা মন্দিরের নিচে।

দেখছে বিশে সৌরভী ঝলমলে শাড়ি পড়ে নামছে। পিছনে নন্দন সিং। সে সন্ধানী দৃষ্টিতে দেখছে। প্রাচীন মন্দির। ওদিকে ভোগমন্দির। পাঁচিল ঘেরা দু’তিনটে পরিত্যক্ত ঘর, আগে মন্দিরের অতিথি এসে থাকত। এখন পাঁচিল ঘেরা ঘরগুলো পড়েই আছে ছায়া অন্ধকারে।

এদিকে নাটমন্দির—গর্ভগৃহ। বংশী চাটুয্যে অবশ্য নন্দন সিংকে দেখেছে। ও নাকি কোলিয়ারির মস্ত ঠিকাদার। বিরাট রেস্তোরাঁ—ট্রাকও রয়েছে ওর অনেক। দু’হাতে টাকা রোজগার করে। এমন শাঁসালো মক্কেলকেই চারে এনে ভিড়িয়েছে সৌরভী। বংশী ঘণ্টাধ্বনি করে হুঙ্কার ছাড়ে সেই গৈরিক বসন পরে।

—জয় বাবা কপালেশ্বর।

সিংজী প্রণামও করে না দেবতাকে, সে চারিদিকে দেখছে। গভীর বন এখনও রয়েছে এখানে। সামনে বিশাল দিঘি। বিশে দেখছে ওদের। এখানকার বাতাসে বিরাজ করে ফুল পাতার আর মন্দিরের ধুনিতে পোড়া ধূপের গন্ধ। বিশুই ওই ধুনিটাকে আজও প্রজ্জ্বলিত করে রেখেছে। এখানে জাগে পাখীর কলরব, ফুলের সুবাস।

হঠাৎ বিশের মনে হয় সেইসব সমবেত সুবাসটা হঠাৎ কি পূতিগন্ধে ভরে গেছে। ওই লোকগুলোর মনের অতলের পাঁকের গন্ধই ফুটে উঠেছে এখানকার সব শুচিতা ছাপিয়ে।

বিশে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে বংশীর ব্যাকুলতা। হাঁক পাড়ে বংশী চাটুয্যে— এ্যাই বিশে, কত বড় মানী লোক এসেছেন। বসতে আসন দে।

বিশে বলে বাবার নাটমন্দিরে কেউ আসনে বসে? ইকি বলছ গো? বংশীরও চমক ভাঙে। উৎসাহেব আতিশয্যে এতবড় অশাস্ত্রীয় কাজটা করতে বলছিল সে। তবু বলে, জল টল তো দিবি?

নন্দন সিংও দেখেছে বিশেকে। শীর্ণ লোকটার পরনে ছোট ময়লা একটা ধুতি, আদুর গা। মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। ওর চোখ দুটো যেন জ্বলছে। নন্দন সিং ওই লোকটাকে যেন তার অজান্তেই কিছুটা সমীহ করে। বংশী চাটুয্যে এর মধ্যে মন্দির থেকে কোন ভক্তের দেওয়া খাবা মণ্ডা শালপাতায় এনে প্রসাদ দেয় ওদের। বিশে নীরবে এক গ্লাস জল এনে দেয়।

নন্দন সিং এখানে এসেছিল দেবতার কৃপালাভের জন্যই। যেন তার কারবার ঠিকঠাক চলে। বিশে আরও অবাক হয়। দেখে বংশী চাটুয্যে এর মধ্যে নন্দন সিং এর হাত দেখে ভাগ্য গণনাও শুরু করেছে। সর্বজ্ঞ জ্যোতিষীর মত গড়গড় করে সে নন্দন সিং এর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বলছে আর খুশী হয়ে শুনছে সিংজী। তারপরই মোচড় মারে চাটুয্যে—কিন্তু সিংজী, শনি মহারাজই গড়বড় করছেন।

সিংজীর এক ট্রাক মাল ধরেছে পুলিশে। অবশ্য ট্রাকের নম্বরও ভুয়ো। ড্রাইভার তেলিয়ার দলও গড়বড় দেখে মাল ফেলে দুর্গাপুরের জঙ্গলে সেঁধিয়ে গেছে। ধরা পড়েনি কেউ। তবু লোকসান হয়েছে। তাই সিংজী বলে—শনি মহারাজকে ঠিকঠাক করে দিন মহারাজ।

চাটুয্যে এইবার টাইট দেয়—দিতে পারি, তবে সে তো যাগ যজ্ঞ করে করতে হবে। খর্চার ব্যাপার। শনি তুষ্টি যজ্ঞ—নিদেন হাজার খানেক টাকার খর্চা।

নন্দন সিং বলে—সো হামি দিবে। আসেন সনধা বেলায় সব বাতচিৎ হোবে।

আউর এ মন্দির হামি একদম ফিট করিয়ে দিবে। বাবার সেবার জন্য ভি কুছু করবে।

বংশী দেখে জালে ভিড়েছে ঘেটো রুই। এবার কায়দা করে খেলিয়ে তুলতে হবে। তাই বলে, তাহলে সন্ধ্যারতির পরই যাব ওখানে।

সৌরভী বলে, তাই এস গো চাটুজ্যে। বেশ জমিয়ে বসা যাবে আজ। যে করে হোক সিংজীর কাজটা করতেই হবে।

বংশী বলে, সবই বাবা কপালেশ্বরের লীলা। জয় বাবা কপালেশ্বর।

চলে যায় সিংজী গাড়ি হাঁকিয়ে। ধুলো ওড়ে আর পোড়া পেট্রলের তীব্র গন্ধে এই চত্বরের বাতাস থেকে সেই ফুলের ধূপের পবিত্র সৌরভ কোথায় উবে যায়।

বিশে সব ব্যাপারটা দেখেছে। তবু মুখ বুজেই থাকে।

সন্ধ্যারতি শুরু হয়। এখন বংশী চাটুয্যের আরতিও জমে ওঠে। ভক্ত ছেলেমেয়েদের ভিড় যত বাড়ে চাটুয্যেও এখন হিন্দী ফিল্মের দেখা নাচওয়ালাদের মত নেচে নেচে আরতি করে। ইদানীং ঘি দুধ আর লুকিয়ে ছাপিয়ে মদ মাংস খেয়ে শরীরে কিঞ্চিৎ তাগদ এসেছে, টাকাও আসছে এখন, সেই সিলভার টনিকের জোরে নৃত্যটা বেশ জমে উঠেছে তার। আজ মনটা আরও খুশী। নন্দন সিং-এর মত শাঁসালো পার্টি তার হাতে এসেছে। তাই ভক্তি শক্তি দুটোই বেড়ে গেছে বংশী চাটুয্যের।

আরতির পর শাঁখ বাজায় বিশু। বড় শাঁখটার একটানা শব্দ ওঠে আকাশ বাতাসে। গ্রাম মায় কোলিয়ারির নতুন কলোনির বাসিন্দারাও ওই শব্দটা চেনে। ভোরে আর সন্ধ্যায় ওই শাঁখের সুর তাদের জীবনের সঙ্গেও যেন মিশে গেছে।

তারা যে যেখানে থাকে দু’হাত জোড় করে নমস্কার জানায় বাবা কপালেশ্বর শিবকে। ওই শব্দটাই যেন মহাকালের সোচ্চার এক প্রতীক কল্যাণের ভাষা।

রাত্রি নামছে, মন্দির চত্বর জনশূন্য হয়ে আসছে, সব আলো নিভিয়ে মন্দিরে বড় প্রদীপটা জ্বেলেছে বংশী। অন্ধকার ছায়াকালো পরিবেশে মন্দির রহস্যময় হয়ে ওঠে।

বংশী বের হয়ে আসছে, সামনে বিশেকে দেখে চাইল।

মন্দিরের ভার এখন ওর হাতে। লোকটা কোন কিশোর বয়সে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল আজ যে প্রায় বৃদ্ধ হতে চলেছে। একাই এই রহস্যময় জগতে থাকে বিশে রাতের অন্ধকারে।

বিশে বলে, ওই সিংজী লোকটা ভাল নয় গো চাটুয্যে।

বংশী বিরক্ত হয়ে চাইল। বলে, তাতে তোর আমার কি?

—না গা, ও মন্দিরে সাফ সারাই করার নামে ইখানে অন্য কিছু করার মতলবে এয়েছে। বাবার মন্দিরে পাপ ঢুকিয়োনা চাটুয্যে।

বংশী চাটুয্যে ওর মাতব্বরিতে বিরক্ত হয়। লোকটাকে দয়া করে সে থাকতে দিয়েছে। অবশ্য সেও এই মন্দিরের চরম দুঃখের দিনে বুক দিয়ে আগলেছে মন্দিরকে নাহলে মন্দির পতিতই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার জন্যই ও যেন নিজেকে মন্দিরের কেউকেটা ভাবতে শুরু করেছে। চাটুয্যে বলে, বাবার কাছে পাপী তাপীরা তো আসবেই রে, বাবা যে নীলকণ্ঠ। ও তুই বুঝবি না। চললাম।

বংশীর মাথায় তখন মোটা আমদানীর ভাবনাই শুরু হয়েছে।

রাতের বেলায় এদিকটা বেশ নির্জন নিশুতি হয়ে যায়। শুধু নন্দন সিং-এর ডেরাতেই আলো জ্বলে। নন্দন সিংও বংশীর জন্য অপেক্ষা করছে।

সৌরভীও রয়েছে। নন্দন সিং-এর এখন অনেক ধান্দাই চালু হয়েছে। কিছুদিন থেকেই সে কথাটা ভাবছিল তার মদের স্টক কিছু করার জন্য একটা নিরাপদ স্থানের দরকার। শুধু মদ কেন ইদানীং তার ট্রাক কয়লা নিয়ে নেপালও যাচ্ছে আর অন্য মালের সঙ্গে নেপাল থেকে আসছে প্রচুর গাঁজা।

বাজারে এক চালান এসে ঠিক মত বিক্রী করতে পারলে লাখ কয়েক টাকা এসে যাবে।

কিন্তু ওসব মাল রাখার জন্য একটা নিরাপদ জায়গার দরকার, আর ওই নন্দন সিং-এর মনে হয়েছে যে তার জন্য ওই জঙ্গলঘেরা নির্জনে শিবমন্দির তার আশপাশের ঠাঁইগুলোই নিরাপদ, তাই ওখানেই থাবা বসাতে হবে তাকে।

সেই জন্যই বংশীকে তার দরকার। নন্দন সিংও বুঝেছে লোকটাকে কোন মন্ত্রে বশ করতে হবে। আর সে সব পথও চেনা নন্দনজীর।

বংশী এর মধ্যে একটা লাল শালুতে মুড়ে নিয়ে চলেছে সেই স্পেশাল একস্ট্রা স্ট্রং মাদুলিটা। পাতাপচা ওই মাদুলীর জন্য অবশ্য হাজার টাকা তখুনিই দেয় নন্দন সিং।

—নিন মহারাজ।

বংশী কড়কড়ে নোটগুলো ফতুয়ার পকেটে পোরে, তারপরই আসে বিলাতী স্কচের বোতল গ্লাস। সঙ্গে একটা প্লেটে চিকেন কষা। অন্যটায় দামী চানাচুর, কাজু, কিসমিস। বংশীর সামনে এমন দুর্লভ বস্তু, তবু বংশী বলে—মানে এসব—

সৌরভী বলে—প্যাটে খিদে মুখে লাজ, কি লোক মাইরী।

সিংজী শোনায়—আর বনশী বাবু, ইতো মায়ের পরসাদ আছে, বাবার সন্তানের মায়ের পরসাদে কুন দোষ না আছে। নিন খেতে পিতে বাতচিৎ হোবে। আর দিল খুলকে বাত করতে হবে তো। নিন আপনার ভি নাফা হোবে বনশী জী। পয়সা তো চাহিয়ে না?

বংশীও বুঝেছে এই দিনবদলের তালে তাকেও তাল মিলিয়ে চলতে হবে। টাকার তারও দরকার। এতদিন শুধু অভাব আর কষ্টই সহ্য করেছে এবার সেও টাকাই রোজগার করবে। অনেক টাকা।

সিংজীর কথাগুলো শুনে চলেছে। তার চোখে গোলাবী নেশার আভাস আর মনে আর এক সুন্দর স্বপ্ন। টাকা—টাকা সেও পাবে। অনেক টাকা। শুধু চোখ কান বুজে থাকতে হবে তাকে। যা করার ওই সিংজীই করবে। ফাঁক থেকে সে পাবে অনেক টাকাই। বংশী বলে কোন গোলমাল হবে না তো? গাঁয়ের লোকজন যদি জানতে পারে মন্দির থেকে আমাকে হঠিয়ে দেবে।

নন্দন সিং অভয় দেয়—সো হামি সব সালটে লিবে। কোই মালুম পাবে না বনশী। লাখ লাখ রূপেয়া বরবাদ হোয়ে যাবে হামার। উসব হামি ম্যানেজ করিয়ে লিব, তুম বেফিকির রহো জী।

নন্দন সিং জানে সূচ হয়ে ঢুকে কি ভাবে ফাল হতে হয়, তার জন্য কিঞ্চিৎ খর্চাও করতে হয়। তাই নন্দন সিং বংশীকে একটা পাঁচহাজার টাকার বাণ্ডিলও দেয়। বংশীর নেশাটা গোলাবী হয়ে ওঠে। এক সন্ধ্যায় নগদ ছ হাজার টাকা এসে গেছে আর এর পর মাসে মাসে ও বেশ মোটা টাকাই পাবে।

পরদিন থেকে কপালেশ্বর শিবমন্দিরের বুক থেকে এতদিনের জমা ময়লা সাফ করে নতুন করে চুনকাম করাতে শুরু হয়, ওদিকে বনের মধ্যে পরিত্যক্ত ভোগ মন্দির, অতিথিশালার ঘরের বাইরে ভিতরেও মিস্ত্রিরা কি সব কাজ শুরু করে।

সারা এলাকার মানুষকে বলে বংশী।

বাবা কি যে সে রে! মন্দির ভেঙে পড়ছিল। বললাম বাবা নিজে যা হয় কর, আমার সাধ্য নেই। ব্যস তেরাত্তির পরই ওই ঠিকাদার সিংজী এসে দেখি বাবার সামনে সাটপাট হয়ে পড়ে। কি কান্না! শুধোই কোন জবাব নেই। এত বড় মানুষটা কেবল কাঁদছে। বাবার চান জল মাথায় দিতে শেতল হয়ে কি বলে জানিস?

মন্দির ভর্তি নরনারী উৎকণ্ঠিত এমন নাটকীয় ব্যাপারে। বংশী বলে চলেছে—সিংজী বলে ওর নাকি রাতে ঘুম ভেঙে যায়, দেখে স্বয়ং বাবা কপালেশ্বর, হাতে ইয়া ত্রিশূল, পরনে বাঘছাল—জ্বলছে ধকধক করে তৃতীয় নয়ন। দ্যাখ গায়ে কাঁটা দিচ্ছেরে। জয় বাবা কপালেশ্বর।

বংশী ভক্তি ভরে নমস্কার জানায় বাবাকে। ভক্তরা শুধোয়,

—তারপর বাবা কি বললেন সিংজীকে?

—হ্যাঁ? বংশী দম নিয়ে বলে—সে সব কথা কি বলে ব্যাটা, তবে বুঝলাম বাবাই আদেশ দিয়েছেন তাকে মন্দির নাটমন্দির সব মেরামত করতে। বুঝলি—বাবার আদেশ তাই ব্যাটা দৌড়ে এসেছে রে। জনতাও বাবার মহিমার পরিচয় পেয়ে গদগদ চিত্তে বাবাকে প্রণাম করে। সকলেই বলে, তা সিংজী বাবার দয়া পেয়েছে গো?

মন্দির চত্বরে ওদিকের অতিথিশালার ভেতর দিনরাত কাজ চলছে। বিশে শোনে বংশী চাটুয্যের ওই সব কথা, দেখছে এখানে এখন ট্রাক ট্রাক মাল আসছে, জিপে করে আসছে তেলিয়ার দল। সেই শান্ত ফুলগন্ধ মাখা, পাখীর কলকাকলি ভরা সবুজ শ্যামল স্নিগ্ধতাটুকুও মুছে গেছে। তেলিয়া মন্টার দল ওই নাটমন্দিরে বসে মদের বোতল খোলে সন্ধ্যার পর, আনে মুরগীর মাংস, পিঁয়াজী নানা চাট। সন্ধ্যার পর ওদের আসর বসে ওখানে। বিশু দেখে দু-একদিন।

রোজ তাকে ওই সব সাফ সুতরো করে স্নান করে সকালে পুজোর যোগাড় করতে হয়। সেদিন বলে বংশীকে, মন্দিরে বসে ওই সব অখাদ্য কুখাদ্য খাবে তুমি কিছু বলবা নাই চাটুজ্যে, বাবার মন্দির।

বংশী তখন স্বপ্ন দেখছে আরও অনেক টাকাই পাবে সে। সেও সন্ধ্যারতির পর এখন যায় নন্দনের ঠেকে। ওর বিলাতী মদের স্বাদই আলাদা, মুরগীও ভাল বানায় ওর কারিগররা। এমাসেও একটা বাণ্ডিল পেয়েছে বংশী। তবে টাকাটা নষ্ট করেনি। দু বিঘে ধান জমি কিনেছে সে। আরও কিনবে।

তাই বিশের কথায় বলে—ওদের বেশী ঘাঁটাস নে বিশে, ইয়ে আমিই ওদের বলে দোব এসব যেন না করে।

বিশে বলে—তাই বোল, না হলে গাঁয়ের লোকজন দেখলে অনত্থ বাঁধাবে।

—তুই যা তো। বংশী ওকে ধমকে তাড়ায়।

ইদানীং বংশী চাটুয্যে দেখেছে তারই খুড়তুতো ভাইরা এবার মন্দিরের আয় পয় বাড়তে তাদের ভাগও নিতে চাইছে। বলে মন্দিরের পালা চালাব আমরাও ছ’মাস। বংশী দেখেছে আগে যখন বংশী কষ্টেসৃষ্টে মন্দিরের কাজ চালাত এরা উঁকি মারেনি। এখন দখল নিতে চায়, আর গ্রামের বেশ কিছু মানুষও চায় মন্দির এখন গ্রামসভা থেকেই চালান হবে। তাই বংশীও জানে তার পিছনে শত্রু রয়েছে। তবে নন্দন সিং তার কাছের মানুষ, নন্দনের জোরেই সে লড়বে ওদের সঙ্গে। তাই মন্দির সংস্কারের নামে মন্দিরের কিছুটা দখলদারী তার হাতেই দিতে বাধবে না বংশীর। সেই কারণে বংশী নন্দনের লোকদেরও চটাতে চায় না। তাই তেলিয়া মন্টারা এখন রাতে এখানে মেহফিল বসায়। ওদিকে কিসব কাজকর্মও চলছে, মন্দির ঝকঝকে করে ওরা অতিথি শালার কাজ শেষ করছে।

এবার নন্দন সিংও মাঝে মাঝে আসে, কাজকর্ম দেখে আর সাধারণ মানুষ দেখে সিংজীর বাবার প্রতি অবলা ভক্তি।

বিশের কাছে ক্রমশঃ ব্যাপারটা হেঁয়ালির মত হয়ে উঠছে। এই তেলিয়ার দল অনেক রাত অবধি এখানে থাকে, এর আগে বিশেও বলেছিল ওদের— এসব কি করছো ইখানে দেবস্থান—

হাসে তেলিয়া—দেবস্থান! তোর দেবস্থানের ইয়ে করি। দ্যাবতা কি আর আছেরে বিশে, সব শ্লা অপদেবতা হয়ে গেছে। বস চলে টলে?

বোতল দেখায়। বিশে উঠে পড়ে বলে,

—মন্দির চত্বরে এসব কোর’না।

ধমকে ওঠে মন্টা—চোপ বে। দোব কপালেশ্বরের পুষ্যিপুত্তুরের মুখে মদ ঢেলে। ফোট এখান থেকে।

বিশে সরে যায়। ওই নাটমন্দির এখন ওদের দখলে। মদ মাংস চলবে। আরও বেশ কিছু ছেলেমেয়েরা এসে জোটে। বিশে এই বনের অন্ধকারে বসে দেখে আর মনে মনে গর্জে ওঠে। মনে হয় বাবার ত্রিশূলটা নিয়েই ওদের এফোঁড় ওফোঁড় করে দোব, কিন্তু পারে না। কাতরভাবে বিড় বিড় করে সে— বাবা এইসব পাপের কি শেষ হবে না? তুমি কি নেই?

বিশের মনে হয় তাহলে এতদিন ধরে যে একটা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে সে এখানে পড়ে আছে সেটা কি সবই অর্থহীন, মিথ্যা! এতদিন ধরে সে একটা মিথ্যার পিছনেই, আলেয়ার পিছনেই ছুটেছে? এটা মানতেও কষ্ট হয় তার। বুকের মধ্যে যেন একটা ঝড়ের আবেগ পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে।

নীরবে সে কাজ করে যায়। ভোরে সব পাপকে সাফ করে, মদের গন্ধ, বাসি খাবারের গন্ধে বমি আসে। তবু বাবার দিকে চেয়ে সে মুখ বুজে একাজ করে। গাঁয়ের কিছু মানুষও টের পায় এসবের। তারাই আড়ালে বলে— রাতভোর কি হয়রে বিশে? তুই তো মন্দিরে থাকিস?

বিশে বলে, সময় হলেই সব জানতে পারবে, তখন পারবা ইয়ার পিতিকার করতে? বাবার অপমানের জবাব দিতে পারবা?

একটা শ্রেণী বলে তুই জানাবি, দেখবি কি করি! ওই চাটুয্যে খুব বেড়েছে ব্যাটা নন্দন সিং-এর দলে ভিড়েছে দেখছি। এর বিহিত করবই, তুই নজর রাখ।

বিশের তবু একটা আশা জাগে। অন্যায়ের প্রতিকার বাবা ঠিকই করবেন। তার জন্য মানুষও তৈরি হচ্ছে।

নন্দন সিংও এসব খবর রাখে। সৌরভীই জানায় একটু হুঁশিয়ার হও গো সিংজী, পিছুতে ফেউ লেগেছে। এখানেই হানা না দেয়।

নন্দন এবার তাই সব মদের স্টক, আর নেপাল থেকে আনা লাখ লাখ টাকার গাঁজা সে নিরাপদ জায়গাতেই রাখতে চায়। ক’মাসে সেই জায়গাও সে তৈরি করেছে। সেখানে গোপনে পাহারাদারির ব্যবস্থাও করেছে। ওই মন্দিরের ওদিকেই বনের মধ্যে মন্দিরের অতিথিশালার ঘরের মেজেতে গর্ত করে নীচে একটা ঘরও বানিয়েছে। বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। সেই মাটির তলার ঘরে তার ওই সব দামী মাল রাখার ব্যবস্থা করেছে। আর নাটমন্দিরে থাকে তেলিয়ার দল। ওরাই পাহারায় থাকে। দরকার মত পাচারও করে সেই মাল।

সেদিন বিশেকে ওরা ওদিকে সরিয়ে মদ নিয়ে বসেছে। বিশে দেখে রাতের অন্ধকারে ট্রাক থেকে মদের বহু জেরিক্যান নামছে। নামছে গাঁজার প্যাকেট। তীব্র গন্ধ ওঠে বাতাসে। ওরা সব রাখছে মন্দিরের গুদামেই।

বিশে চমকে ওঠে। ওই শয়তানের দলকে বংশীই আশ্রয় দিয়েছে টাকার জন্য। মন্দিরের বাইরে ছিল ফুলগন্ধময় ধূপের মিষ্ট পরিবেশ, একটি শুচিস্নাত বাতাবরণ, এখন সেখানে ওঠে মদের গন্ধ, গাঁজার তীব্র ঝাঁঝ, মন্দিরের সব শুচিতাকে ওরা শেষ করে এখানে একটা শয়তানের আড্ডাই গড়ে তুলেছে।

এ সে হতে দেবে না। ওই পাষাণ দেবতার ঘুমই ভাঙাবে সে। জাগরিত করে তুলবে এলাকার সব মানুষকে। তারাই এবার এই মন্দিরের শুচিতা রক্ষার ভার নিক, এতদিন এ কাজ সেই’ই করেছে। এবার, সারা এলাকার মানুষের চেতনাকে সেই’ই জাগ্রত করে তুলবে, জাগ্রত করে তুলবে মন্দিরের ওই বিঘ্ননাশক, মঙ্গলময় দেবতাকে যিনি এই অসুরদের ধ্বংস করবেন। বিশে কি একটা দুর্বার শক্তি নিয়েই মন্দিরের বেদী থেকে সেই বড় শাঁখটা তুলে নেয়, একহাতে শাঁখটাকে মুখের কাছে ধরেছে অন্য হাতে একটা মোটা কাঠ নিয়ে মন্দিরের আরতির সময় যে বড় জয়ঢাকটা আছে তাতে ঘা মারতে থাকে।

রাতের অন্ধকারে সেই বিকট শব্দটা ধ্বনি প্রতিধ্বনি তোলে গুম-গুম-গুম আর সেই সঙ্গে বেজে ওঠে শাঁখটা। এক টানা বেজে চলেছে শাঁখটা। গ্রাম আশপাশের মানুষ চেনে ওই দগড় আর শাঁখের শব্দ। ওটা দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সকাল সন্ধ্যায় বাজে। আজ বাজছে রাত্রির দ্বিপ্রহরে স্তব্ধতার মাঝে বেজে চলেছে ওই দগড়—দ্রিম, দ্রিম, শব্দে আর তীক্ষ্ণ জোরাল একটা আহ্বান নিয়ে ঘুমন্ত মানুষদের জাগিয়ে তোলে শাঁখের শব্দ উচ্চগ্রামে ধ্বনিত হয়ে চলেছে— আকাশ বাতাসে।

কি এক সর্বনাশের ঘোষণাই করছে ওই শব্দটা। সকলে জেগে ওঠে, দল বেঁধে বের হয়, তখনও ওই শব্দটা উচ্চতর গ্রামে বাজছে ডাকছে ওদের, ওঠ জেগে ওঠ—এসো—

শাঁখ আর ওই দগড়ের শব্দ শুনে তেলিয়ারা চমকে ওঠে। ওদের নেশা ছুটে যায়। মন্টা বলে, তেলিয়া, সারা অঞ্চলের লোক ছুটে আসছে। দেখ অন্ধকার ফুঁড়ে এ গ্রাম সে গ্রাম থেকে মশালের আলোগুলো ছুটে আসছে। শোনা যায় দূর থেকে তাদের কোলাহল।

বিশে, এই শালা, থাম। গর্জে ওঠে তেলিয়া।

বিশের সারা দেহের শিরায় শিরায় এখন দুর্বার রক্তস্রোত। ওই শব্দব্রহ্ম দিয়ে সে ঘুমন্ত দেবতা, মানুষকে জাগাবেই, তাদের কল্যাণ চেতনাকে সে প্রতিবাদের কাঠিন্যে জাগিয়ে তুলবে আজকের অসুরদের নিপাত করতে। সে বাজিয়ে চলেছে এক হাত দিয়ে ওই জয়ঢাকটাকে আর ফুঁ দিয়ে চলেছে শাঁখে। বিকট শব্দ উঠছে, এরা আতঙ্কিত। এখানে রয়েছে ওই ঘরে লাখ লাখ টাকার বেআইনী মাল। মন্দিরের মধ্যে এসব মালের সন্ধান পেলে ওই ধেয়ে আসা মশালের আগুন তাদেরই পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। সব খবর ফাঁস করে দেবে ওই বিশে।

মন্টা বলে—থাম।

কে শোনে কার কথা। বিশে আজ যেন ক্ষেপে গেছে। সে জাগিয়ে তুলবেই দেবতা মানুষকে। তেলিয়াও বিপদের গুরুত্ব বুঝে এবার লাফ দিয়ে ওর গলাটা এসে টিপে ধরে। সাঁড়াশীর মত কঠিন আঙুলগুলো ওর কণ্ঠনালীকে টিপে ধরেছে। থেমে যায় শাঁখের আতঙ্ক আনা শব্দটা। থেমে গেছে দ্রিম দ্রিম শব্দ। প্রবল চাপে বিশের শীর্ণ দেহটা লুটিয়ে পড়ে। তেলিয়া সর্বশক্তি দিয়ে ওকে থামিয়ে দেয় এবার।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চারিদিক থেকে জনতা মশাল নিয়ে ছুটে আসে। দেখে শব্দটা আর ওঠেনা। মন্দিরের চাতালে পড়ে আছে বিশের প্রাণহীন দেহটা, নাকে মুখে রক্তের ক্ষীণ ধারা।

কেউ কোথাও নেই। স্তব্ধ মন্দির প্রাঙ্গণ। নির্জন পরিবেশে পড়ে আছে বিশে। বংশীও এসেছে। সেই-ই বলে ইদানীং শালার মাথাটাই বিগড়ে গেছল হে।

রাত দুপুরে নাহলে আরতির বাজনা বাজায়। শেষ বাজনা!

একালের দেবতা—মানুষদের চেয়েও অসুররাই কৌশলী, বলশালী তাই বিশেও হার মেনে হারিয়ে গেল এই পৃথিবী থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *