অপদার্থ
জীবজগতে পুরুষদের মতো অপদার্থ প্রাণী আর নেই। স্ত্রীরা ঠিকই বলেন, আমি না থাকলে তোমার যে কি দশা হত। অতি সত্যি কথা। চলিত বাংলায় যাকে বলে, হাতে হ্যারিকেন—সেই দশা। আমাকে একবার বলা হয়েছিল, আজ মশারিটা খাটাও তো। খাটে মশারি টাঙাবার যে ছাউনিটা থাকে আমি সেটাকে খুলে দূর করে ফেলে দিয়েছিলুম। ঘরের শোভা নষ্ট করে। ঘরের আকাশে একটা কাঠের জ্যামিতির কুশ্রী অহঙ্কার অসহ্য মনে হয়। তার ওপর ধুলো। কোণে কোণে ঝুল। মাঝখানে বন্যাত্রাণের বিশাল ভিক্ষার ঝুলির মতো ঝুলে আছে আধ ময়লা মশারি। অনেক সময় ওইখানেই মেলে রাখা হয় তোয়ালে, রুমাল। বর্ষার সময় যাবতীয় অন্তর্বাসের আখড়া। মহিলাদের জগতে প্রয়োজনটাই বড়। ডেকরেশান নিয়ে মাথাব্যথা নেই। অনেক বাড়িতে কচি ছেলেমেয়ের ভিজে কাঁথাও ঝোলে। অনেক সময় খাটের পাশে দাঁড়িয়ে গেঞ্জি খুলতে গেলে অসাবধান হাতের আন্দোলনে কাঠের খাঁচা নড়ে যায়। অতএব আপদ বিদায়।
আমাদের খাটটা আছে ঘরের একপাশে দেওয়াল ঘেঁষে। যেদিকে দেওয়াল সেই দিকে দুটো হুক আছে। দুটো হুক থেকেই ঝুলছে দুটো ছবি, মা কালী আর মা দুর্গা। দুই দেবীর আশ্রয়ে আমাদের রাত কাটে। ওই হুকেই লাগানো হয় মশারির দুই প্রান্তের দড়ির ফাঁস। ছবির মাথার ওপর দিয়েই চলে আসে। মশারি টান-টান হলে ছবি দুটো কিচ শব্দ করে ডাইনে বামে হেলে যায়। তাতে কিছু যায় আসে না। কালী দুর্গা হেলে থাকলেও যা সোজা থাকলেও তা। পাওয়ার কিছুমাত্র কমে না। ক্যাপসুল পেটে খাড়া হয়েই ঢুকুক কি আড় হয়ে ঢুকুক, সেম অ্যাকশান।
যে দিকে দেওয়াল নেই সেই দিকে মশারির কোনও অবলম্বনও নেই। মশারির সেই দিকে লম্বা লম্বা দড়ি বাঁধা। দূরে দুটো জানালা। সেই জানালার গ্রিলে বাঁধতে হবে আর দুটো প্রান্ত। যেন ডিভিসির হাইটেনশান লাইন আসছে। আমি একটা দিক হুকে লাগালুম। আর একটা দিকও লাগালুম। দেখলুম ভীষণ টান হয়ে গেল। আর এক দিকের দড়িটা ভীষণ লম্বা। জাতিতে পুরুষ হলেও বোকা তো নই। দাড়িটাকে মাপে আনতে কতক্ষণ লাগে। একটা ফাঁস লাগিয়ে, হেঁই মারো মারো টান বলে হুকে লাগিয়ে দিলুম। টানের চাপে কোণের দিকটা অল্প একটু ছিঁড়ে গেল যেন। এদিক ওদিক তাকালুম। ধারেকাছে বউ নেই। তবে আর কী! একটু ফেড়ে গেলে কি হয়েছে। যেতেই পারে। পুরুষ জাতি মুখে যতই হম্বিতম্বি করুক নারী জাতিকে যমের মতো ভয় পায়। বউ যখন দেখতে পায়নি তখন যাক গে। মশার অত বুদ্ধি নেই যে, সারভে করে ওই ছেঁড়াটুকু দিয়েই ঢুকবে। মশা কি বৃষ্টির জল। ছাদের ফাটা খুঁজে টুপটুপ করে ঠিকই পড়তে থাকবে বইয়ের টেবিলে, আলমারির মাথায়। আর আমার বউও কিছু সেচবিভাগের ইঞ্জিনিয়ার নয় যে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ার পরও টর্চ লাইট জ্বেলে বাঁধের ফুটো দেখতে বেরোবে।
মনে-মনে বেশ তৃপ্ত হলুম, আজ একটা মশারি খাটাব, নারী জাতিকে টেরা করে দেব। অন্য দিন মশারির চাল ঝুলে থাকে। যেন মাথার ওপর নাইলনের জালি গেঞ্জি পরে কোনও ভুঁড়িওয়ালা মানুষ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আজ আর মশারির চাল বলে মনে হয় না। মনে হবে স্বচ্ছ প্ল্যাস্টিকের ছাদ। অর্কিড হাউসের মধ্যে শুয়ে থাকব দামি দুই ক্যাকটাস।
এইবার তৃতীয় প্রান্তের দড়িটা হাতে নিয়ে হাঁটা দিতে হবে জানালার দিকে। নো প্রবলেম। কিন্তু এ কি হল। প্রথমত দড়িটা খুবই ছোট। দ্বিতীয়ত মশারিটা এদিকে না এসে, ওই দিকে দেওয়ালের দিকে যেতে চাইছে। বেশ সমস্যায় পড়ে গেলুম। আমার খাট এই দিকে, মশারি মশারিকে জড়িয়ে ধরে, দেওয়াল ফুঁড়ে যেতে চাইছে পাশের ঘরে। এটা কি তাহলে পাশের ঘরের মশারি। সেই গল্পটা মনে পড়ল। পাঞ্জাবি গল্প—’আরে বুদ্ধু, এ পেরক এ দেওয়ালকা নেহি ও দেওয়ালকা। ছেলে দেওয়ালে একটা পেরেক পুঁতবে। পেরেকের মাথার দিকটা দেওয়ালে রেখে সরু দিকে হাতুড়ি মারছে। প্রায়ই ফসকে যাচ্ছে। বাবা এসে বললেন, বোকা, এ পেরেক হল ও দেওয়ালের। দু-আঙুলে পেরেকটাকে সাবধানে ধরে, যেন মাথা উলটে না যায় এইভাবে নিয়ে গিয়ে বিপরীত দেওয়ালের ওপর রাখলেন। ছেলেকে বললেন, এই দেখ বুদ্ধু, মার হাতুড়ি।’
কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পর রহস্যটা ধরতে পারলুম। কোণ উলটে গেছে। পৃথিবী এক বিদঘুটে জ্যামিতি! একটা পাশ খুলে আবার নতুন করে খাটালুম। যাক, মশারি এবার এদিকে আসছে, তবে চওড়া দিকে নয় লম্বা দিকে। তা হোক। মন্দের ভালো। দেওয়াল ভেঙে মশারি সমেত মায়ের ঘরে মাঝরাতে ঢুকে পড়ার চেয়ে খাটটাকে টুক করে ঘুরিয়ে নেওয়া ঢের সহজ। এতকাল মশারির দৌড় ছিল উত্তর দক্ষিণে, আজ যখন পূর্ব-পশ্চিমে যেতে চাইছে, যাক। বাধা দেওয়া উচিত নয়।
খাটটাকে ধরে একটু টেনেছি কি টানিনি, হাঁহাঁ করে ছুটে এলেন নারী জাতি।
‘এটা তোমার কী কেরামতি হচ্ছে?’
‘মশারিটা ঘুরে গেছে তো, তাই খাটটাকে ঘুরিয়ে নিচ্ছি।’
‘ওরে আমার বুদ্ধির ঢেঁকি রে।’
‘কেন? প্রবলেমটা কী?’
‘কোন কোণটা কোন কোণে টাঙিয়েছো দেখি, হা ভগবান। খোলো। সব দিক খোলো। এই লম্বা দড়িটায় কে এমন করে ফাঁস লাগিয়েছে?’
‘সত্য বই মিথ্যা বলিব না। আমি।’
‘উ:, তোমাকে দিয়ে একটা কাজ যদি ঠিক মতো হয়। বাপরে, কী কাণ্ড করেছে। এপাশের দড়িটাকে এভাবে জড়ালে কে?’
‘ও তোমার নিজের থেকেই জড়িয়ে গেছে! দড়ি, সুতো, তার, পুরুষ আর নারী জাতি ও তোমার গিয়ে আপনার থেকেই জড়িয়ে যায়।’
‘আপনার থেকেই জড়িয়ে যায়’? বসে-বসে খোলো।’
‘আজ সকালে নখ কেটেছি, ফাঁস খুলতে পারব না।’
‘পারব না মানে? মামার বাড়ি। খোলো। আমার যেমন ছিল, তেমন করে দাও।’
‘এসো না আজ নতুন কায়দায় শোওয়া যাক! মশারিটা না খাটিয়ে জালের মতো গায়ে জড়িয়ে নি।’
‘তুমি আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও। তোমাকে দেখলেই আমার গা জ্বলে যাচ্ছে।’
আমার মনে পড়ে গেল, অনেক দিন আগে নারীজাতির নির্দেশে, আমার তিন মাসের শিশুটিকে ঝিনুক করে এক ঝিনুক জল খাওয়াবার চেষ্টা করেছিলুম। সেই জল মুখে ঢোকাতে গিয়ে ঢুকিয়েছিলুম নাকে। আর একবার বলেছিল দরজায় তালা লাগাতে। তা আমি দুটো কড়ার বদলে তালাটা একটা কড়ায় লাগিয়েছিলুম। আবার টেনে টুনে পরীক্ষাও করেছিলুম। ফিরে এসে দেখি আমার ভায়রাভাই বসে আছে সিঁড়ির ধাপে। পুরুষ জাতি যে। দেখেও বুঝতে পারেনি, দরজাটা খোলা।