অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৯
দুটো যমজ ছেলে বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে থাকে ভৈরবী। শারীরিক এবং মানসিক কোনো দিক দিয়েই ওর কোনো শক্তি নেই। যমজ ছেলে দেখার পর থেকেই ভীষণ কান্নায় বুকটা ফাটা মাঠের মতো টুকরো টুকরো। শুক্তির মা বাচ্চা দুটো দেখছে। ধনশ্রী দরজার কাছে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। তাকে কেমন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। বুকের ভেতর কেবল একটা ‘না-না’ ধ্বনি। কিছুতেই হতে পারে না, কিছুতেই না। ছেলে হবার পর ভৈরবী ওর পা চেপে ধরেছিল।
‘তুমি বিশ্বাস করো আমি অসতী নই। আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বুঝি না। আমার আর কেউ নেই।’
ধনশ্রী ওর পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসেছিল। হাত দুটো জড়িয়ে ধরে কতবার গালে ঘঁষেছিল, ‘বউ-বউ আমি তা জানি। আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু—।’ ওই ‘কিন্তু’ কাঁটা হয়ে আছে দুজনের মনে। কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। অথচ দু-জনে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে কোনো অঘটন ঘটতে পারে না। ভোররাতের ঠান্ডা হাওয়ার প্রশান্ত আমেজেও ধনশ্রী ঘেমে নেয়ে উঠেছিল। সংসারের এই সুখ আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারবে না। ধনশ্রী গোরুর গাড়ির চাকার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ শুনতে পায়। ধুলো উড়িয়ে গাড়িটা চলে যাচ্ছে, ছইয়ের ভেতর ভৈরবী, না, চোখে আর পানি নেই, সব কান্না শেষ। মাথায় আর ঘোমটা নেই, সব লজ্জা শেষ। তখুনি উত্তেজিত অবস্থায় চেঁচিয়ে ওঠে ধনশ্রী, ‘না, এ আমি হতে দেব না বউ। কিছুতেই হতে দেব না।’ ও ভৈরবীর পাশে এসে বসে। ভৈরবী কথা বলতে পারে না। কেবল ঠোঁট নড়ে, ‘আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে জানি না গো।’ ভৈরবীর ইচ্ছে করে এই কথাটা পাড়াময় চিৎকার করে বলতে। কিন্তু কে শুনবে? ছেলেদুটো সরবে চেঁচায়। ধনশ্রী ঘরের দরজা জানালা হাট করে খুলে রাখে।
যমজ ছেলের খবর জানাজানি হলেই রাজার লোক ছুটে আসবে। অসতীর দায়ে ভৈরবীর বিচার হবে। ভৈরবীকে ত্যাগ করতে হবে ধনশ্রীর। এটাই রাজার আইন। এক নারীর গর্ভে এক সঙ্গে দু- সন্তানের জন্ম মানে দু-জনের সঙ্গে যৌনসঙ্গম। সকলেই এটা বিশ্বাস করে। আর সঙ্গত কারণেই সমাজ থেকে ব্যভিচার দূর করার জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি। রাজার দায়িত্ব সমাজকে কলুষহীন ও পবিত্র রাখা। এর আগে আরও দু-বার এ ধরনের ঘটনা হয়েছিল। সুভাষ তো বউয়ের শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিল। আর চন্দ্রদাস নিজেই আইন হয়েছিল। বউকে ইচ্ছে করে ত্যাগ করেছিল। এতবড়ো ব্যভিচার নিজেই সহ্য করতে পারেনি। ‘আমি অসতী নই’ বলে বুক চাপড়ে কেঁদেছিল চন্দ্রদাসের বউ, কিন্তু চন্দ্রদাস শোনেনি, শোনার মতো মানসিকতা তার ছিল না। কিন্তু ধনশ্রী কী করবে? ধনশ্রী যে মনেপ্রাণে বউকে বিশ্বাস করে। ও কিছুতেই বউকে ত্যাগ করবে না, কিছুতেই না।
ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও কাহ্নুপাদের কাছে ছুটে আসে।
‘এখন কী হবে কানু?’
সব শুনে দরজার ওপর বসে পড়ে কাহ্নুপাদ। কোনো কথা বলতে পারে না।
‘না, কানু আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না যে আমার বউ অসতী।’
‘তবে কেমন করে হল?’
‘জানি না, জানি না।’
ধনশ্রী অসহিষ্ণু কণ্ঠে জেদের সঙ্গে চিৎকার করে। বুকের ভেতর খচখচে কাঁটাটাকে প্রাণপণে চেপে রাখে। ওটা মাঝে মাঝেই গভীরে ঢুকে যেতে চায়।
‘আমার বউ যদি ব্যভিচার করেই থাকে তবু আমি ওকে ছাড়তে পারব না কানু।’
ভোরের ঠান্ডা বাতাসেও কাহ্নুপাদের মাথাটা গরম হয়ে ওঠে। কিছু ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না। ধনশ্রী যতই আবেগের কথা বলুক এর পেছনে যুক্তি কী?
‘আমার বউকে আমি যদি ঘরে রাখি তার জন্যে রাজার কী কানু? আমি মানিনে রাজার আইন।’ কাহ্নুপাদ চমকে ওঠে। তাই তো, ব্যভিচার ওদের জন্যে শুদ্ধ, কিন্তু আমরা না করলেও তার বিচার হবে?
‘তুমি কথা বলছ না কেন কানু?’
‘মাথা ঠান্ডা করো ধনাদা। ভেবেচিন্তে এগুতে হবে।’
‘তুমি ভাবো। আমি ঘরে যাই। ঘরে অনেক কাজ।’
কিন্তু না, শেষরক্ষা করতে পারেনি ধনশ্রী। দুজন সন্তানের জন্যে দুজন বাবা, এ যুক্তিটা এত বেশি প্রবল যে এর বিরুদ্ধে কেউ মাথা তুলতে পারেনি। পনেরো দিন সময় দেয়া হয়েছিল ধনশ্ৰীকে। কিন্তু ধনশ্রী তা মানেনি। আইন ছিল পনেরো দিন শেষ হলে পরদিন ভোরেই ভৈরবীকে গোরুর গাড়িতে উঠিয়ে বাপের বাড়ির পথে রওনা করিয়ে দিতে হবে। ধনশ্রী ইচ্ছে করলে সঙ্গে যেতে পারে। কিন্তু রাজার সে আইন মানেনি ধনশ্রী। তাই পরদিন দুপুরে রাজার লোক এসে জোর করে ধনশ্রীকে ধরে নিয়ে গেছে। প্রথমে একজন এসে ছিল, তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল। তারপর এসেছিল আরও চারজন। পাঁচজনের সঙ্গে পারেনি ধনশ্রী, যেতে হয়েছিল। আর সেজন্যেই চেঁচাতে চেঁচাতে গেছে ধনশ্ৰী, ‘আমার অসতী বউ নিয়ে যদি আমি ঘর করি তাতে রাজার কী? আমাদের ভালো রাজার দেখতে হবে না। চাই না এমন রাজা।’ বড়ো শক্ত কথা বলেছিল ধনশ্রী। কিন্তু বেশি বলতে পারেনি। পিটুনির চোটে মুখ দিয়ে গোঙানির শব্দ বেরুচ্ছিল কেবল। এই ঔদ্ধত্যে শঙ্কিত মন্ত্রী দেবল ভদ্র জনা পঞ্চাশেক রক্ষী পাঠিয়েছিল গাঁয়ে। সর্বত্র রাজার রক্ষী ঘুরে বেড়ায়। সারা গাঁ জুড়ে রাজার আইন থমথম করে। এর আগে এরকম বড়ো ধরনের কোনো ঘটনা আর ঘটেনি। লোকগুলো কেবল মাথা নীচু করে আইনই পালন করেছে, অবাধ্য হয়নি। আজ ধনশ্ৰী পুরো ছকটা উলটে দিল। কঠিন মূল্য দিতে হবে তাকে। অপরাধ অনেক। অসতী বউ ঘরে রেখে ব্যভিচার প্রশ্রয় দেবার প্রবণতা। রাজার আইন অমান্য করা। রাজার বিরুদ্ধে কথা বলা। দেবল ভদ্র এতবড়ো ধৃষ্টতা কিছুতেই সহ্য করবে না। রাজদরবারে ছিল কাহ্নুপাদ, দেখেছে দেবল ভদ্রের টকটকে মুখে আগুনের আভা আর কঠোর দৃষ্টি। পুরো গ্রাম তছনছ করে দিতেও তার বাধবে না। কাহ্নুপাদ আশঙ্কা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে দুপুরটা পার করেছে। ধনশ্রীকে চুনের ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তার ভবিষৎ অনিশ্চিত, কী হবে কাহ্নুপাদ নিজেও তা জানে না। তার চোখের সামনে সব কিছু বিপরীত ধারায় উদ্ভাসিত হতে থাকে। কোথায় যেন আপন নিয়মে একটা ফোঁকর তৈরি হচ্ছে। সেটা ঠেকাবার সাধ্য কারও নেই। দেশে বৌদ্ধ রাজা, কিন্তু অধিকাংশ বৌদ্ধমন্দির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সংস্কারের প্রয়োজনে কেউ এগিয়ে আসে না, সর্বত্র ব্রাক্ষ্মণের দোর্দণ্ডপ্রতাপ। সে প্রতাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত কাহ্নুপাদদের মতো এক শ্রেণির লোকের। বৌদ্ধ ধর্মের মায়ামমতার কথা গল্পের মতো শুনেছে ওরা। সেটা পেলে জীবনটা হয়তো অন্যরকম হত। আরও একটু স্নিগ্ধ, আরও একটু শ্যামল। বিকেলে তড়িঘড়ি করে ফেরার পথে কাহ্নুপাদের চোখে পড়ে করুণ দৃশ্যটা। বুক হু-হু করে ওঠে। গোরুর গাড়ির পেছনে ভৈরবীর ভাই, মুখ নীচু করে হাঁটছে। খবর পেয়ে দু-তিন দিন আগে এসেছে। মুখ শুকনো, উশকোখুশকো চুল, বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে ওকে। বোনকে গালাগাল করলেও ধনশ্রীর ব্যবহারে ও ভীষণভাবে আলোড়িত। দেশাখ গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। হয়তো অনেকদূর যাবে। কাহ্নুপাদ জানে ও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। কাহ্নুপাদ নিজেও পারেনি। ভৈরবী সকলের পায়ে ধরেছে। কেঁদে বলেছে, সে অসতী নয়। ও যে-কোনো পরীক্ষা দিতে রাজি। শুধু যেন ধনশ্রী ওকে ত্যাগ না করে। কিন্তু এখন রাজার চাইতে মন্ত্রীর শাসন প্রবল। তার মুখের ওপর কথা বলবে কে? ভৈরবীর অনুনয়বিনয় কাউকে স্পর্শ করেছে কাউকে করেনি। কেউ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়েছে। সেজন্যেই গোরুর গাড়ির ছইয়ে মাথা ঠুকতে ঠুকতে চলে যাচ্ছে ভৈরবী। পেছনে ধুলো উড়ছে। ওকে আর চেনা যায় না। সন্তান জন্ম দেবার পর শরীরের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল এমন একটা চরম পরিণতিতে তার শেষ কাঠামোটা ভেঙে গেছে। বড়ো ছেলে দুটোর সঙ্গে সঙ্গে ছোটো দুটোও সমানে কাঁদছে। কারও প্রতি ওর কোনো আকর্ষণ নেই। ভৈরবী যেন জাগতিক পৃথিবীর সমস্ত সুখ-দুঃখ থেকে হঠাৎ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
কয়েকদিন রাজার লোক বেপরোয়া ঘুরে বেড়ায় গাঁয়ে। কেউ যদি সামান্য কথাও এদিক ওদিক করে বলে সঙ্গে সঙ্গে ধরে নিয়ে যাবে। গাঁয়ে থমথমে পরিবেশ ভূতুড়ে হয়ে যায়। সন্ধ্যের পর কেউ আর বাইরে থাকে না। দরকার ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলে না। ভৈরবী চলে যাবার পরদিন কামোদ বউকে নিয়ে শবশুরবাড়ি গেছে। শ্বাসরুদ্ধকর এই পরিস্থিতি ওর জন্যে ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছে। ভৈরবীর বাসায় এখন আর সন্ধ্যাবেলায় বাতি জ্বলে না। শূন্য ঘর হা-হা করে। হাটুরেরা ও পথ দিয়ে ফেরার সময় চোখ তুলে চায় না। ধনশ্রী এখন বন্দি, কবে ছাড়া পাবে কেউ জানে না। কাহ্নুপাদ নিজে রাজদরবারে থেকেও কোনো হদিশ করতে পারেনি। ডোম্বি একদিন কাহ্নুপাদকে একলা পার করতে করতে বলেছিল, ‘তুমি কেমন ঝিমিয়ে গেলে কানু?’
‘ধনাদার জন্যে মনটা পোড়ে।’
ডোম্বি খিলখিলিয়ে হাসে।
‘মনকে পুড়িয়ে কষ্ট দিয়ে লাভ কী? পারলে দেবল ভদ্রের বাড়িটা পুড়িয়ে দাও।’
‘আহ্ আস্তে মল্লারী।
‘নদী আর নৌকা ছাড়া কেউ এখানে নেই। এদের অবিশ্বাস করি না। আর থাকলেই-বা কী?
ডোম্বি জোরে জোরে নৌকা বায়। কাহ্নুপাদ হাঁটুতে মাথা রেখে বসে থাকে। গুণ টানে দুজন লোক। ওদের পেশিবহুল শরীরে আশ্চর্য জোয়ানকী। সবাই যদি অমন হত? ওরা কোথায় যায়? ওদের ধরে রাখা যায় না? ওরা গাঁয়ের জোয়ান ছেলেগুলোকে শরীর গড়ার কৌশল শিখিয়ে দিত।
সুলেখা যখন দেশাখের কাছে কথাটা পাড়ল তখন নিজের কানকে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল দেশাখের। তখন রাত, ফিকে জ্যোৎস্নায় সুলেখার মুখ তেমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। রাতে খাওয়া- দাওয়ার পর সব কাজ সেরে দেশাখকে বাইরে ডাকে সুলেখা। রান্নাঘরের বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে, মুখে পান। রাশি চুল উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। ঘরের ভেতর লোকী আর গুণীর হাসাহাসির শব্দ আসে। আমড়া গাছের মাথায় বসে একটা কাক থেমে থেমে ডাকে। সব কিছু কেমন বিরক্তিকর মনে হয় দেশাখের। এমনকি সুলেখার এই ডেকে আনার ভঙ্গিটাও।
‘কেন ডেকেছ বলছ না যে?’
‘তোমার দাদার তো কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না দেশাখ।’
‘হ্যাঁ, অনেক তো খোঁজখবর করলাম।’
‘আর হয়তো ফিরবে না।’
‘তাই তো মনে হয়।’
দু-জনে কিছুক্ষণ সময় কাটায়। কাকের ডাক আর নেই। দেশাখ হাই তোলে। সারা বিকেল ছেলেদের তির ছোড়া শিখিয়েছে। এখন ভীষণ ক্লান্তি লাগছে, বসে থাকতে ইচ্ছে করে না।
‘আমার ঘুম পাচ্ছে বউদি।’
‘বলছিলাম কি আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
সুলেখার গলা কেঁপে যায়।
‘সিদ্ধান্ত?’
‘হ্যাঁ। সুদাম আমাকে বিয়ে করতে চায়।’
‘বউদি?’
‘আমি রাজি হয়েছি দেশাখ।’
‘কী বলছ?’
‘তোমার ঘাড়ে বসে আর কতকাল খাব। তোমার দাদাও ফিরবে না। ভেবেচিন্তে দেখলাম নিজের পথ করে নেয়া ভালো।’
‘আমরা কি তোমাকে অনাদর করেছি?’
‘ছিঃ দেশাখ অমন কথা আমি কোনোদিন ভাবিনি এবং তোমার এই কষ্টের উপার্জনেও আমি খুশি ছিলাম। কিন্তু কতকাল টানবে? তোমার নিজেরও তো নিয়ে করতে হবে। এখন তুমিই ব্যাপারটাকে মিটিয়ে দিতে পারো।’
‘আমি ভেবে দেখি বউদি? আমাকে সময় দাও।’
দেশাখ আর দাঁড়ায় না। একরকম দৌড়ে নিজের ঘরে চলে আসে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর ভীষণ কান্না পায়। ছেলেমানুষের মতো শব্দ করে কাঁদে দেশাখ। পাশের ঘরে শুয়ে সে কান্না শোনে সুলেখা, বুকটা কেমন করে, কিন্তু কিছুতেই পিছুবে না। এখনই উপযুক্ত সময় পথ দেখার।
শেষ পর্যন্ত সুলেখার কথাই রাখতে হয় দেশাখের। গাঁয়ের একদম শেষ সীমান্তে নিরিবিলি সংসার পাতে সুলেখা। সুদাম পাকা চাষি। চাষবাস খুব ভালো বোঝে। সংসারে অভাব কিছুটা কম। দুজন মানুষের দিন ভালোভাবেই কেটে যায়। সুলেখার মনে হয় বহুদিন অন্ধকার ঘরে বন্দি থাকার পর ও ছাড়া পেয়েছে। এখন রোদ দেখছে, বাতাস পাচ্ছে। সুদাম ভারি ভালো মানুষ। নিরীহ, গোবেচারা। সুলেখার সংস্পর্শে জীবনের নতুন বাঁকবদলে সুখী। মাঝে মাঝে দেশাখের বুক খাঁ-খাঁ করে। সুলেখার জন্যে একটা শূন্যতা অনুভব করে। শ্বাশুড়ি মুখ বেঁকিয়ে বলে, ‘গেছে ভালো হয়েছে। আপদ গেছে।’ হুলটা হজম করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সংসারের হালটা ধরে রেখেছিল সুলেখা। এখন সেটা এলোমেলো, বিধ্বস্ত। লোকী, গুণী বউদিকে ভুলতে পারে না। লুকিয়ে দেখা করতে যায়। অরুণের লুকোছাপা নেই। সোজাসুজি এখন, ‘আমার বউদি’ বলে দাবি নিয়ে উপস্থিত হয় সুলেখার কাছে। সুলেখার মাঝে মাঝে খটকা লাগে। সংসারটা ছেড়ে এসেও এখনও ওটা যেন ওরই রয়ে গেছে।
সুলেখার ঘটনা অনায়াসে সবাই ভুলে যায়। কিন্তু ধনশ্রী সবার বুকের মধ্যে একটা কালো কাঁটা হয়ে গেঁথে আছে। কেউ ভুলতে পারে না। লোকটা আর ফিরে আসেনি। কী হয়েছে কেউ কিছু জানে না। কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারে না। ভয়, পাছে কোনো অশুভ সংবাদ শুনতে হয়। কেবল বুকের নীচে খচখচ শব্দ টের পায়। যখন তখন রাজার লোক আসে। সামান্য কারণে একে ওকে ধরে নিয়ে যায়। দু-একদিন আটকে রেখে ছেড়ে দেয়, নয়তো মারধর করে। কাউকে কোনো কারণ জানাবার দরকার নেই। অপরাধ কী সেটাও জানে না। দেশাখের তিরধনুকের দলে জোয়ান ছেলে বাড়ে। নিমাই, বাদল, গৌরঙ্গ, শিবু। ওরা শিকারের নামে দূরের বনে চলে যায়। সারা দিন পর ফিরে এলে এখন আর একটুও ক্লান্তি লাগে না দেশাখের। শরীরে যেন একটা আলগা যন্ত্রের আবির্ভাব হয়েছে। সেটা থেকে অনবরত শক্তি ছুঁয়ায়। চুঁইয়ে চুঁইয়ে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দেয় অবসাদ আর ক্লান্তি। সন্ধ্যায় নিজের হাতে তিতির আর হরিয়ালের পাখ ছাড়াতে ছাড়াতে ভুসুকুর কথা মনে পড়ে। দাদাটা সেই যে গেল আর কোনো খবর নেই। যদি বেঁচে থাকে? যদি ফিরে আসে? মুহূর্তে হাতের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ভয় করে দেশাখের। একজন মানুষের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে যাবার ভয়। ধনশ্রী এ বোধটা সকলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। পরক্ষণে েিনজকে সামলে নেয়। আসলে সুলেখা যাওয়াতে পুরো সংসারের গোছানো ভাবটা নষ্ট হয়ে গেছে। মা খেয়ালখুশিমতো রান্নাবান্না করে। লোকী গুণী নিজেদের ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায়। সোহাগের কেউ নেই, শাসনের কেউ নেই। দেশাখ পাখি দুটো তৈরি করে মাকে ডাকে। মা ঘর থেকেই কোঁকাতে কোঁকাতে বলে, ‘বাতের ব্যথায় উঠতে পারছি না বাবা।’
‘রাতের খাওয়া হবে না?’
‘দুপুরে যে চারটি ভাত আছে তা ভাগ করে খেয়ে নে। রাতে তো ঘুমিয়ে থাকবি। আর রাঁধতে পারব না।’
‘পেটে খিদে থাকলে আমার ঘুম আসে না।’
দেশাখের মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। মার কাছ থেকে কোনো জবাব আসে না। অগত্যা দেশাখ কুয়োতলায় গিয়ে পাখি দুটো ধুয়ে আনে। উনুন জ্বালিয়ে ঝলসে নেয়। এর বেশি কিছু করার সাধ্যি ওর নেই। তারপর বারান্দায় বসে মনের সুখে কামড়ে খায়। ভালোই লাগে, প্রতিদিনের রাঁধা তরকারির চাইতে স্বাদটা ভিন্ন তো বটেই। সারাদিনের পরিশ্রমে পেটে ভীষণ খিদে। সুলেখা থাকলে কিছু তৈরি খাবার পাওয়া যেত। না, সে-কথা ভেবে মন খারাপ করে না ও।
একটু পর নিঃশব্দে লোকী গুণী ঢোকে। দেশাখকে বারান্দায় দেখে দু-জনের বুকের মধ্যে ভীষণ তোলপাড়। ধরা পড়ে যাবার ভয়, কিন্তু দেশাখ খাবার আনন্দে ওদের খেয়াল করে না। দু-জনের কোঁচড়ভরা শামুক। চুপচাপ ঘরের কোণে ঢেলে রেখে দু-জনে কুয়োতলায় আসে। ঝপাঝপ পানি ওঠায়। লোকী হেসে গড়িয়ে পড়ে।
‘নিখিলদার মতো মানুষ হয় না, না রে গুণী?’
‘ঠিক বলেছিস।’
‘আজ তোকে অনেকক্ষণ রেখেছিল। পাহারা দিতে আমার যা ভয় করছিল। সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল এই বুঝি কেউ এসে পড়ে।’
‘ভয় না ছাই।’
‘কেন?’
‘ভাবছিলি গুণীটা এলেই আমি নিখিলদার কাছে যেতে পারি। তোর দেরি সইছিল না।’
‘যাঃ মিছে কথা।’
‘বুঝি রে বুঝি।’
দু-জনেই শব্দ করে হাসে। তারপর ঘরে এসে দুপুরের চাট্টি ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু দু-জনে দু-পাশে শুয়ে থাকলেও ঘুম আসে না কারোই। নিখিলদার সঙ্গে কেমন একটা মজার কাণ্ড ঘটে যায়। এতদিন এতসব কথা কিছুই জানতো না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেমন জানি করে।
‘ঘুম আসছে না গুণী!’
‘আমারও আসছে না।’
আবার চুপচাপ। দু-জনের নিশ্বাস ওঠানামা করে। একে অপরের পিঠের সঙ্গে লেগে আছে। একসময় লোকী ফিসফিস করে ডাকে।
‘গুণী?’
‘বল।’
‘আমার এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে
‘ঠিক বলেছিস, আমারও।’
আবার চুপচাপ। নিজেদের ওপর বিরক্ত হয় নিজেরাই। চোখ ব্যথা করে। জোর করে আর কতক্ষণ চোখ বুজে থাকা যায়।
‘লোকী?’
‘বল।’
‘আমার খুব মনখারাপ লাগছে।’
‘আমারও।’
‘চল বাইরে গিয়ে বসি।’
‘চল।’
দু-জনে উঠে বাইরে আসে। উঠোনে আমড়া গাছের ছায়ার আলপনা। বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে থাকে ওরা।
‘এসব কথা কাকে জিজ্ঞেস করা যায় রে?’
‘চুপ চুপ। কাউকে না।
‘চল ঘরে যাই।’
‘চল।’
দু-জনে আবার ঘরে এসে শোয়। চুপচাপ। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টাতেও ঘুম আসতে চায় না ওদের।
দেখতে দেখতে হুট করে চোত মাস এসে পড়ে। এ মাসে কাম মহোৎসব হবে। শুকনো খটখটে খেতে জল ঢেলে কাদা বানিয়ে বাদ্য বাজিয়ে গান আর জোড় নৃত্য হয়। সকলের বিশ্বাস এতে পরিতুষ্ট হয়ে কামদেব প্রচুর শস্য দেবে। চৈতালি ফসলে ভরে উঠবে আঙিনা। আর শস্যের প্রাচুর্য মানেই ধন। এ উৎসবের জন্যে যুবক-যুবতীদের বাছাই করে গাঁয়ের বুড়োরা। দশজোড়া যুবক- যুবতী নাচবে, সারারাত উলঙ্গ হয়ে। ভোররাতে ফিকে আঁধারে মিলিত হবে তারা। সে মিলনের বীর্যপাত শস্যের প্রাচুর্য বয়ে আনবে। উৎসবের তোড়জোড় শুরু হয়। জমি ঠিক হয়। এক-একবার এক-এক জমিতে উৎসব হয়। চিঁড়া আর নারকেল দিয়ে তৈরি নানারকমের খাবার এ রাতের প্রধান দিক। সব বাড়িতে এক আয়োজন। যুবক-যুবতীদের সে খাদ্য পোঁটলা করে বেঁধে দেয়া হবে। ওরা উৎসবের আগে খাবে, জমিতে ছিটাবে, কামদেবের কাছে প্রার্থনা করবে। যখন পটহ মাদলে শব্দ উঠবে শুরু হবে ডোম্বির গান, তখন থেকে উৎসবের শুরু। সন্ধ্যার আলো-আঁধারি মিলিয়ে গেলে ওরা গান গাইতে গাইতে জমিতে যাবে, তেমন একটা জমির কাছে যে ফসল দেবে, জীবন বাঁচাবে। প্রাচুর্যে, ধনে, সুখে, শান্তিতে সে জীবন মহিমান্বিত হবে। প্রথমবারের মতো লোকী, গুণী এবার এ উৎসবে যোগ দেবে। দুজনের খুশির শেষ নেই। লোকী নাচবে নিমাইর সঙ্গে, গুণী শেখরের সঙ্গে। প্রতিবছরই নতুন নতুন জোড় ঠিক হয়।
বিকেলবেলা গা ধুয়ে, চুল বেঁধে, চোখে কাজল টেনে লোকী এবং গুণী অস্থির হয়ে ওঠে। মা চিঁড়ে নারকেল পায়েস রেঁধেছে। কলাপাতায় পোঁটলা করে বেঁধে নিয়েছে ওরা। বাড়িতে খাবার নিয়ম নেই ওদের। মা মনে মনে প্রার্থনা করে যেন কোনো ছেলের চোখে পড়ে যায় ওরা। তাহলে বিয়ের জন্যে কোনো ঝইঝামেলা হবে না। বুড়ো বাপ অসুস্থ। কে আর এ দায়িত্ব পালন করবে।
নাচতে গিয়ে পা যেন আর উঠতে চায় না লোকীর। কেবলই নিখিলের কথা মনে পড়ে। নিমাই না হয়ে নিখিল হলে আনন্দ হত বেশি।
‘এই লোকী সন্ধ্যারাতেই ঝিমুচ্ছিস কেন?’
নিমাই ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয়।
‘ইস তুই যেন কী?’
‘আমাকে তোর পছন্দ হয়নি?’
‘হয়েছে।’
‘না হয়নি। তোর শরীরে তেমন সাড়া নেই।
‘ছাই বুঝিস।’
লোকী ওর বুকের সঙ্গে মিশে যায়। গলার কাছে নাকটা ঘষে। নিমাই শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে উদ্দাম নেচে ওঠে, রক্তে মাতাল বন্যা। সবার এক অবস্থা। নাচটা যেন জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে গেছে। কামদেবতা তুষ্ট হলে ফসল ফলবে। সে ফসলে পেট ভরবে। নইলে উপোস। সেজন্যেই এ নাচের সঙ্গে আরও কিছু থাকে। ফসলের প্রাচুর্যের আবেগ। সেজন্যে এ নাচে ঢিলেমি সয় না। উদ্দাম হয়ে ওঠা প্রথম শর্ত। এ আসরে ওরা নতুন। কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা জড়তা ওরা কাটিয়ে উঠতে পারে না। তবু এটা একটা সামাজিক স্বীকৃতি। এতে সকলের সমর্থন আছে। এই একটা রাত ওরা নিজের করে পেয়েছে। এভাবে আর কোনোদিন পাবে না। পটহ মাদলের দ্রিম দ্রিম শব্দ ক্রমাগত বাড়ছে। সে সঙ্গে বাড়ছে ডোম্বির গলা। সেই সঙ্গে বাড়ছে শরীরের উত্তেজনা, নৃত্যের উদ্দামতা। আস্তে আস্তে নিখিলের কথা ভুলে যায় লোকী। সেই ঝিমুনিভাব আর নেই। গুণী প্রথম থেকেই শেখরের সঙ্গে জমে গেছে। মন খারাপের বালাই নেই ওর। আজ রাত এবং এই নাচের অনুষ্ঠানই ওর কাছে আনন্দের। অন্ধকারে কেউ কারও মুখ পুরো দেখতে পায় না। কেবল কতগুলো অবয়ব। তীক্ষ্ণ। ধারালো। অন্ধকার ভেদ করে তার নগ্ন দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। ডোম্বি গান গাইতে গাইতে ভাবে, আজকের অনুষ্ঠানের ছোঁড়াগুলো যেমন মরদ, ছুঁড়িগুলোও তেমন, কেউ কারও চাইতে কম না। নিজের ষোলো বছর বয়সটা কল্পনা করে বুক ফেটে শ্বাস বেরোয়। ক্রমাগত ডোম্বির জোর নিস্তেজ হতে থাকে। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। আর একটু পর ওরা চলে যাবে। তখন আর বাজনার দরকার হবে না। গানের দরকার হবে না। ছেলেমেয়ের শরীরটা আপন নিয়মে বাজবে, গাইবে।
পিচ্ছিল মাটি কাদায় থ্যাকখ্যাক করছে। বার বার পা পিছলে যায় লোকীর। নিমাই শক্ত হাতে ধরে রাখে। আশেপাশের অনেকেই সরে পড়েছে। দূরে দূরে ঘাসের উপর শুয়ে পড়েছে। শেখরের হাত ধরে গুণী চলে যাচ্ছে। তার পেছনে সুমন্ত আর পারুল। লোকীর বুকটা কেমন জানি করে। পায়ের নীচে থকথকে কাদা। এতক্ষণ কিছু মনে হয়নি। এখন শরীরটা কেমন কুঁকড়ে আসে। ভালো লাগে না। কিন্তু আজকের রাতের নাচের উদ্দেশ্য ভেবে নিজেকে শাসন করে। প্রাণপণে ভালো লাগাতে চায়। নিমাই আবার ওকে ঝাঁকুনি দেয়।
‘আমাকে তোর পছন্দ হয়নি লোকী?’
‘বার বার একটা কথা বলিস কেন বল তো?’
‘তুই যে যাবার কথা বলিস না? মাটি তৈরি না হলে কি ফসল ফলে?’
নিমাইর কণ্ঠ করুণ শোনায়।
‘আমি কি মাটি?’
‘এসব কী বলিস? সব তো জানিস।’
‘কিছু মনে করিস না নিমাই এত নাচের পর সব কেমন এলোমেলো লাগছে।’
নিমাই ওকে বুকে টেনে আদর করে। ‘তুই উর্বরা ধরণি। আমি চাষা, চাষ করি। লোকী এই জন্যেই তো এত আয়োজন। এলোমেলো লাগলে সারা বছর নষ্ট হয়ে যাবে।’
‘না রে আমি ঠিক আছি। তুই মিছে ভাবনা করিস না। চল যাই।’
‘তুই একটা পাকা চাষি হবি নিমাই।’
‘হবই তো। চাষির ছেলে চাষি হব না তো দেশের রাজা হব?’
‘হলে বেশ হত।’
‘বুঝতে পারছি তোর মনটা অন্য কোথাও বাঁধা পড়ে আছে। তাই এমন আনমনা। তোর এখানে আসা ঠিক হয়নি। দেবতা রুষ্ট হবে।’
‘দূর কী যে বলিস আবোলতাবোল।’
লোকী ভয় পায় কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দেয় এসব কথা। শব্দ করে হেসে ওঠে। নিমাইর গায়ে ঢলে পড়ে। নিমাই যদি এসব কথা কাউকে বলে তাহলে কী যে লজ্জা। কারও কাছে মুখ দেখানো যাবে না। সকলে ছি ছি করবে। লোকী সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করে। নিমাই ওকে নিয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়ে। কাছাকাছি সবাই আছে। কেউ কাউকে খোঁজে না। নেশার জমাট অবস্থা যেন। চারদিকে অন্ধকার। দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসে। উদোম মাঠে হা-হা বাতাস বয়, মৃদু অথচ শীতল। সবার মনের মধ্যে ফসলের স্বপ্ন। সবার শারীরিক চেতনায় নতুন ধানের অনুভব। নিমাই পাকা চাষির মতো চাষের কাজে মন দেয়। নরম হাতে মাটি কোপায়। আগাছা সাফ করে। তারপর ভীষণ যত্নে গাছ বোনে। নিমাই ফসলের প্রার্থনায় ওর সমস্ত শরীর মন উৎসর্গ করে দেয়। লোকী মাটি হয়ে বুকে টানে।
কাম উৎসবের পর গোটা পাড়ায় চাষের সাড়া পড়ে যায়। সুদামের এক মুহূর্তের সময় নেই। দুপুরে ঘরে ফেরে না। খাবার বেঁধে নিয়ে যায়, ফেরে সেই সন্ধ্যায়। সুলেখা একলা ঘরে বসে চাঙারি বোনে। একটুও খারাপ লাগে না। জীবনের কোথাও আর কোনো ফোঁকর নেই, সব শূন্যতা ভরে গেছে। শরীরের অন্তঃস্থলে আর একটি প্রাণের শব্দ বাজে। সুলেখা আনমনা হয়ে সে শব্দ শোনে, কে যেন দু-পায়ে টলতে টলতে ওর দিকে ছুটে আসছে। ভুসুকুর সঙ্গে পাঁচ বছর বিবাহিত জীবন যাপন করেছে। কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি। সেই অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা এখন সুলেখার ছোট্ট ঘরে দ্বিগুণ আনন্দে ফিরে আসে। যেদিন সুদামকে খবরটা দিয়েছিল সেদিন সুদাম কেমন বিব্রত, ভয়ার্ত মুখে ওর দিকে চেয়েছিল। কথা বলতে পারেনি।
‘কী হল তুমি খুশি হওনি?
‘খুশি? হ্যাঁ খুশি হয়েছি তো।’
সুদাম আড়ষ্ট কণ্ঠে কোনোরকমে কথা ক-টি বলেছিল। তারপর কেমন এলোমেলো স্বরে বলেছিল, ‘বাচ্চা হতে গিয়ে তোমার যদি কিছু হয় তাহলে আমি বাঁচব না সুলেখা।’
‘কী হবে?’
সুলেখা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।
‘যদি কোনো অঘটন ঘটে?’
‘যাঃ কিচ্ছু হবে না। ভয় করলেই ভয়। তুমি কিচ্ছু ভেবো না।’
সুলেখা জানত না সুদামের আগের বউ বাচ্চা হতে গিয়েই মারা গিয়েছিল। খবরটা সুদামকে খুশি করেনি। সন্তানে ওর তেমন আকাঙ্ক্ষা নেই। ও চায় একজন ভালো বউ আর নিরিবিলি সংসার। কাজ শেষের পর খোশগল্প। তারপর প্রশান্তির ঘুম। একদল ছেলেমেয়ের ঝইঝক্কি ওর পছন্দ নয়। তবু সুলেখার ঝলমলে মুখের দিকে চেয়ে আর কিছু বলেনি ও। একা একা বুকের মধ্যে অকারণ বেদনা বহন করা। সারাক্ষণ হারাই হারাই ভাব। চাষের কাজে মন বসে না ঠিকমতো। এদিকে সুলেখা সপ্তাহে দু-দিন পিপুল গাছের গোড়ায় জল ঢেলে তিনবার প্রদক্ষিণ করে পুজো করে। পুত্রসন্তান চায়। উপার্জনক্ষম পুত্র। বাপ-মার বুড়ো বয়সের দায়দায়িত্ব যে নিজের কাঁধে নেবে। সুলেখা পেটের সন্তানকে কেন্দ্র করে সেই অনাগত দিনের স্বপ্ন দেখে।
রাজদরবারে পাখা টানার কাজটা আর ভালো লাগে না কাহ্নপাদের। যে কাজটার জন্যে নিজেকে ধন্য মনে হত আজ সেটার ওপর ভয়ানক বিতৃষ্ণা। জীবিকার প্রশ্নে আপোশে আর মন ওঠে না। অন্ন যেন গলা কামড়ে ধরে নামে। সে জ্বালা বিষের মতো সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। মনে হয় অন্ন নয় অপমান আর অবজ্ঞার দলাগুলো থোক থোক নামছে। সারাদিন কেমন বিষন্ন হয়ে থাকে কাহ্নুপাদ। এ চাকরিটা ছেড়ে দিলে একটা অনিশ্চিত জীবনের মোকাবিলা করতে হবে। প্রতিদিন খাবার জুটবে না, দিনের পর দিন উপোসেও কাটতে পারে। তবু সমগ্র অস্তিত্ব তাতেই সাড়া দেয়। দারিদ্র্যে আপত্তি নেই, অভাব সইতে পারব। কোনো কিছুতেই এখন আর ভয় নেই। পিছু হটতে এখন ওর প্ৰচণ্ড ঘৃণা।
একদিন খাবার সময় শবরী কেমন অসহায়ের মতো তাকিয়ে ব্যাকুল হয়েছিল, ‘খাচ্ছ না কেন? রান্না ভালো হয়নি?’
কাহ্নুপাদ ম্লান হাসে। শবরীর সিঁথিটা চওড়া মনে হয়।
‘রান্না খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু ইদানীং খেতে আমার একটুও ভালো লাগে না।’
‘কেন? শরীর খারাপ? কই আমাকে বলোনি তো? আজই আমি হরিহর কবরেজের কাছ থেকে বড়ি নিয়ে আসব। বোধহয় হজমে গণ্ডগোল হয়েছে।’
শবরীর উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে তাকিয়ে কাহ্নুপাদ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না। একটুক্ষণ থেমে বলে, ‘ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দেব শবরী।’
‘কেন?’
‘ওদের ওই অপমান আর অবজ্ঞা সইতে পারছি না আমি।’
‘তাহলে খাব কী আমরা?’
‘অন্য কোনো কাজ জুটিয়ে নেব। একটু অভাব হবে, পারবে না সইতে? তুমি কী বলো শবরী?’
শবরী কথা বলে না। মুখ নীচু করে রাখে। তরকারির বাটিটা নাড়াচাড়া করে। সেই আনত মুখের দিকে তাকিয়ে কাহ্নুপাদ বোঝে যে শবরীর সায় নেই। ওই চাকরিটুকুর জন্যে তবু ভাত ভাত জোটে, না থাকলে উপোস। নিরম্বু উপোস মানতে শবরী রাজি নয়। ও চায় একটু সুখ, কিছুটা নিরুদ্বেগ দিনযাপন। শবরী মল্লারী নয়। মল্লারী হলে ওই অপমানের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তখুনি চেঁচিয়ে উঠত, ‘ওখান থেকে তুমি চলে এসো কানু। দুটো মানুষের পেট একরকম করে চলে যাবে। ও নিয়ে ভাবতে হবে না। তবু ওই অপমানের দলা গলা দিয়ে নামাতে পারব না।’ অথচ শবরী কথা বলতে পারছে না। ওর ধাতই আলাদা। কাহ্নুপাদ ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে। শবরী জল আনার ছলে সামনে থেকে উঠে যায়। কাহ্নুপাদ হাসে। তার এই মানসিক আশ্রয়টুকুর জন্যেই মল্লারীর কাছে ছুটে যেতে হয়। ও মাঝনদীতে নৌকা ঠেকানোর মতো অবলীলায় শক্ত হাত বাড়িয়ে দেয়, একটুও ভয় পায় না। শবরীর আনত মুখের সৌন্দর্য ওকে যতই বিচলিত এবং মোহিত করুক না কেন সেদিকে তাকিয়ে কাহ্নুপাদ নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারে না। তেমন বুঝলে শবরীকে রেখে ও একাই এগিয়ে যাবে, প্রয়োজন নেই শবরীর। শরীরের ভেতর কোথায় যেন একটা ইস্পাতের ফলা গেঁথে আছে, সেটা থেকে প্রয়োজনমতো আগুনের রশ্মি ঝলকায়, সে রশ্মি কাহ্নুপাদের ধ্যানধারণায় নতুন প্রলেপ দেয়, বদলে যায় কাহ্নুপাদ। অপমানের আগুনে পুড়ে ও কালো হয়ে গেছে। সেদিন সারাদিন শবরী কথা বলেনি। মুখ গুঁজে শুয়েছিল। কাহ্নুপাদ ওর ওপর রাগতে পারে না, বরং ওকে বুঝতে চায়। যে ব্যঞ্জনায় শিল্পী হয়ে ওঠে সে, একই ব্যঞ্জনায় ও শাণিত হতে পারে না কেন? যার লক্ষ্যভেদী আঘাতে এঁফোড় ওঁফোড় হয়ে যায় নির্ধারিত বস্তু?
কাহ্নুপাদ মাটিতে বসে শবরীর গভীর চুলে হাত ডুবিয়ে ডাকে ওকে, ‘ওঠো সই মিছে ভয় পেয়ো না।’
শবরীর ডাগর চোখের কালো তীরে জলের রেখা। আসলে কানু ছাড়া ও আর কিছু বোঝে না। কানুর সঙ্গে ওর তেমন কোনো ঝগড়াঝাটি হয়নি। যত মন খারাপই করুক সেটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে না শবরীর। আজও ফিক করে হেসে কাহ্নপাদের ঘাড়ে মুখ গোঁজে। নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে।
‘কানু তুমি যা করতে চেয়েছ তাই করো। দুজন মানুষের আর ভাবনা কী! কোনোমতে চলেই যাবে। এমনিতে তো আমরা রাজার সুখে নেই। আর একটু অভাব হবে এই যা। তুমি সইতে পারলে আমিও পারব। তোমার জন্যে আমি সব করতে পারি কানু।
কাহ্নুপাদের বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে ওঠে ও। নাকটা চেপে ধরে।
‘দেখছ কী? আমি সত্যি বলছি। প্রথমে মন খারাপ হয়েছিল। এখন আর আমার একটুও মনখারাপ করছে না। আমি ভেবে দেখলাম তোমার কথাই ঠিক। ধনাদাকে ওরা কী কষ্টটাই না দিল? ভৈরবীর জন্যে বুকটা আমার কেমন করছে।’
কাহ্নুপাদ শবরীর চুলে মুখ ডুবিয়ে রাখে। মনে হয় ওখান থেকে ভিন্ন ঘ্রাণ আসছে। শবরীর যে সৌন্দর্য কাহ্নুপাদকে প্রতিনিয়ত সঙ্গ দেয় তা নিয়ে শবরী দূরে সরে যায়নি, বরং কাছে এসেছে, আরও গভীরে। শবরীর নির্বিবাদ সমর্পণ ওকে আনন্দ দেয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে এটাও অনুভব করে যে শবরীর সমর্পণটা তেমন জরুরি নয়। ও সমর্পণ না করলেও কাহ্নুপাদ যা চাইছিল তা হত। ওকে কেউই পিছু টানতে পারত না। নিজের এ পরিবর্তন কাহ্নুপাদকে সাহসী করে তোলে।
নৌকার ওপর কথাটা শুনেই বইঠা থেমে যায় ডোম্বির হাতে। হাঁ-করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কাহ্নুপাদের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে রাত জাগার ক্লান্তি, কেমন বিশুষ্ক চেহারা। মনে হয় ভেতরে প্রচণ্ড ওলটপালটের ক্ষান্তিহীন আক্রোশ।
‘কী বলছ তুমি কানু?’
‘বিশ্বাস হচ্ছে না?’
‘ভালোই হয়েছে কানু। তোমাকে আমি নৌকা বাওয়া শেখাব। সারা দিন পারাপার করে যা পাব তা ভাগ করে নেব। তাতে তোমার চলে যাবে, কী বলো?’
‘সে দেখা যাবে। পেটের কথা অত চিন্তা করি না।’
‘এখন থেকে তুমি সারাদিন গীত লিখবে। এই ঘাটে বসেই লেখো। পারাপার করতে ভালো না লাগলেও আপত্তি নেই। সন্ধ্যায় তোমার কড়ির ভাগ আমি তোমাকে দিয়ে দেব।’
কাহ্নুপাদ হো-হো করে হাসে। অপ্রস্তুত হয়ে যায় ডোম্বি।
‘হাসছ যে?’
‘আমার জন্যে তোমার ভাবনা দেখে হাসছি।’
‘তোমার সবটাতে ঠাট্টা।’
‘রেগো না মল্লারী। একটা কিছু জুটিয়ে নেয়া এমন আর কঠিন কী? কাজ না পেলে বনের ফলমূল তো আছে, ভাত নাই-বা খেলাম। তবু ওই অপমান আর সয় না।’
কাহ্নপাদের দৃষ্টি ঝকমক করে। মল্লারী কথা বলে না। সেটা যে ওরও মনের কথা। শুধু কয়েকটা কথা বলে তার কি প্রকাশ হয়? কেবল হাতের বইঠা ছপছপ বায়।
দেবল ভদ্রের সামনে কথা বলতেই বাঘের মতো গর্জে ওঠে মন্ত্রী। সে জানে কাহ্নুপাদ আরও একশোজনের মতো নয়। একটু আলাদা। কাহ্নুপাদ ভাবতে জানে। ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা প্ৰকাশ করতে জানে। কেবল মাথা পেতে সব কিছু মেনে নেয় না। সেজন্যে কাহ্নুপাদের ওপর একটা রোষ আছে দেবল ভদ্রের। আছে মনের ভেতর কিছুটা ভয়ও, পাছে অপমান করে এই ভয়। তা ছাড়া কাহ্নুপাদ গীত রচনা করে সেটা আরও অসহনীয়। ছোটোলোকের বাড় সীমাহীন মনে হয়। সেটা কিছুতেই সম্ভব না। বেশি সহ্য করলেই ছোটোলোকগুলো মাথায় চড়ে বসবে। কাহ্নুপাদ তার সামনে আর কাজ করবে না বলতেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে দেবল ভদ্র। এতবড়ো কথা তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে বলার সাহস কারও নেই। ছোটোলোকগুলো কেবল হুকুম শোনার জন্যে। অন্য কোনো ধরনের কথা বলার অধিকার ওদের নেই। তাই কাহ্নুপাদের ঔদ্ধত্য ও ধৃষ্টতা অসহ্য।
দেবল ভদ্র পারলে ওর চুঁটি চেপে ধরে। ‘এতবড়ো কথা বলার সাহস তোর হল?’
‘সাহসের কী আছে? আমি আর কাজ করব না শুধু এটাই তো বলেছি।’
‘কেন কাজ করবি না শুনি?’
‘আমার ভালো লাগে না।’
‘কী? কী বললি?’
দেবল ভদ্র হিংস্র দৃষ্টিতে তাকায়। কাহ্নুপাদ আবারও বলে, ‘আমার ভালো লাগে না।’
‘তাহলে করবি কী? গীত লিখবি?’
দেবল ভদ্রের বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে দপ করে জ্বলে ওঠে কাহ্নুপাদ।
‘হ্যাঁ তাই করব। ওটাই আমার কাজ।’
‘হ্যাঁ তাই করব।’ দেবল ভদ্র চিবিয়ে চিবিয়ে বলে।
‘কাজে যা। আর যেন এ ধরনের কথা না শুনি।’
দেবল ভদ্র ওকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গটগট করে অন্যত্র চলে যায়। আজ দরবারে কীসের যেন উৎসব, সবাই ব্যস্ত। কাহ্নুপাদ নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে, বুকভরে শ্বাস নেয়। আজ থেকে ও মুক্ত, কোথাও কোনো দায়ভার নেই। নিজের ইচ্ছেমতো চলাফেরা। তবুও বুকটা থরথর করে ওঠে। দেবল ভদ্রের পরবর্তী আচরণ ওকে শঙ্কিত করে রাখে। আজ সারারাত রাজদরবারে উৎসব হবে, কাল ছুটি। তারপর? কাহ্নুপাদ সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে জোরে হাঁটতে থাকে। ভাবলে অকারণে বুক আতঙ্কিত হবে। তার চেয়ে ওই চুকিয়েবুকিয়ে দেবার চেষ্টাই ধরে রাখা ভালো। এতে শক্তিতে স্রোত বাড়ে।
পথে দেশাখের সঙ্গে দেখা। কাঁধে দুটো বনমোরগ ঝুলিয়ে গান গাইতে গাইতে ফিরছিল ও।
‘কী ব্যাপার কানুদা অমন জোরে জোরে হাঁটছ যে?’
‘কাজটা ছেড়ে দিয়ে এলাম।’
‘মানে?’
‘মানে আর কী? ওদের ওই অপমান আর সইছে না।’
‘উঃ কানুদা ঠিক করেছ। এবার আমরা একটু অন্যরকম হব। ওদের বোঝাতে হবে আমাদের ভেতরেও মানুষ আছে। কেবল ছোটোলোক নেই।’
‘আমারই ভুল হয়েছিল দেশাখ। ভেবেছিলাম রাজদরবারে নিজের লেখা গীত পড়লেই আমার ভাষার সম্মান হবে। এখন দেখছি আসলে তা নয়। কেবল রাজদরবারই কোনো ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। ওরা যতই সংস্কৃতের কদর করুক ওটা কারও মুখের ভাষা নয়। ওটাকে বাঁচিয়ে রাখবে কে? আমাদের ভাষা আমাদের মুখে মুখে বেঁচে থাকবে দেশাখ।’
‘ঠিকই বলেছ কানুদা। রাজদরবার কোন ছার! নিজেরাই নিজের ভাষার সম্মান করব। ওদের কোনোকিছুতে আমাদের দরকার নেই।’
দু-জনে আবার চুপচাপ হাঁটে। দু-জনের ভেতরেই উত্তেজনা।
‘তুমি এখন কী করবে ভাবছ কানুদা?’
‘এখনও ভাবিনি।’
‘চলো তোমাকে তিরধনুক চালানো শেখাই। তারপর দু-জনে শিকার করব। যা পাই দু-জনে ভাগ করে নেব কানুদা। তোমার হবে না তাতে?’
‘খুব হবে।’
‘তুমি যেন কিছু ভাবছ?’
‘দূর পাগল।’
খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে কাহ্নুপাদ ঠা-ঠা হাসে।
‘যাদের সম্বল নেই তাদের আবার সম্বলের চিন্তা কী রে?’
‘আমিও তো তাই বলি।’
কাহ্নুপাদ দেশাখের ঘাড়ে হাত রাখে। আশেপাশে খুব একটা লোকজন নেই। চারিদিকে বুক- চেতানো উদোম মাঠ হাঁ-হাঁ করছে। বিক্ষিপ্ত গাছ। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে। যেন অনেকদূর থেকে কেউ ছুঁড়ে মেরেছে। তাই এখানে ওখানে পড়ে আছে, কুড়োবার কেউ নেই, অযত্ন এবং অবহেলাই সই। সরু মেঠো পথে কাহ্নুপাদের পদক্ষেপ আজ অন্যরকম। দেশাখের চঞ্চলতাও বাড়ে। দু-জনের মনের ভেতর সুখের পাখি নড়চড়া করে। দু-জনেই হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, নদীটা খুব কাছে। আরও দূরে হলে ভালো হত। হাঁটতে একটুও ক্লান্তি নেই।
পরদিন ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা ছুড়ে আড়িমুড়ি ভাঙে কাহ্নুপাদ। খুব ভালো লাগছে। জানালা গলিয়ে রোদ এসেছে। কখনো এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোয় না ও। আজকের প্রসন্ন সকাল কাহ্নুপাদের জীবনের বাঁক বদলের সূচনা। ও বিছানায় শুয়ে গান গায়। তারপর সারা দিন একরকম ওঠেই না। বিছানায় গড়িয়ে, গীত লিখে দিন কাটাতে চায়। শবরীও খুনসুটি করে।
কখনো পাখির পালকের কলমটা নিজের মাথায় গুঁজে রাখে। কখনো চুলের গোছা সামলাতে সামলাতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে কাহ্নুপাদের সামনে। কাহ্নুপাদ ঘরে থাকলেই ওর আবেগটা বদলে যায়, তখন যা নয় তা করতে ইচ্ছা করে, এবং কাহ্নুপাদের কাছে তা অবলীলায় প্রশ্রয় পায়। একটা পুরো গীত লেখার আবেগে কাহ্নুপাদ এখন উদার। কোনোকিছুতেই বাধা নেই। আজ নিজেকে সত্যিকারের ছোটোলোক বলে মনে হয়, নির্ভেজাল ছোটোলোক, যে ছোটোলোকের সংজ্ঞা ওরা দিতে পারবে না। কথাটা মনে হতেই হাসে ও।
‘হাসছ যে?’
‘আজ আমি একটা আস্ত ছোটোলোক। কাজ নেই, কাম নেই, চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, রাজা নেই, মন্ত্রী নেই। কী বলো সই?’
‘ঠিক।’
শবরীও হেসে গড়িয়ে পড়ে। হাসতে হাসতে চুলোর ওপর তরকারি পোড়ার গন্ধ পায়।
‘ওই যা, সব গেল? আজ আর খেতে হবে না।’
কাহ্নুপাদ ওর হাত চেপে ধরে।
‘যাক।’
‘কেন?’
‘আজ আর খাব না।’
‘উহ্ বাবা ছাড়ো। আমাকে আর পাগল বানিও না।’
শবরী তড়িঘড়ি ছুটে যায়। তরকারি সামলায়। কাহ্নুপাদ আবার কলম নিয়ে উপুড় হয়। মনে মনে বলে, ‘কাহ্নিলা তুই একটা আস্ত হারামি। তোর মনের ঠিক-ঠিকানা নেই। কাহ্নিলা তোর জীবনটাই বরবাদ। তুই কিছু বুঝিস না, কিছু জানিস না, তবু গীত লিখতে চাস। কাহ্নিলা রে এত সাহস ভালো না।’ কয়েকটি পংক্তি লিখে আবার কেটে ফেলে। আবার লেখে,
ঘুমই ণ চেবই সপরবিভাগা।
সহজ নিদালু কাহ্নিলা লাঙ্গা।।
আত্মপর বিভেদ ভুলে ঘুমায়, সহজেই নিদ্রিত হয় কাহ্নুপাদের নগ্ন মন। নিজের আকাঙ্ক্ষাকে গীতের রূপকে নির্বিবাদে প্রবেশ করিয়ে রাখে। জ্বালা জুড়োবার এটাই সহজ পন্থা। নিজেকে এমন প্রকাশ করা যায় বলেই কলম কাহ্নুপাদ ভালোবাসে। কলমটা দাঁতে কামড়ে রাখে ও। তারপর আবার দু-পংক্তি লেখে,
চেঅণ বেওন ভর নিদ গেল।
সঅল সুফল করি সুহে সুতেলা।।
তাঁর চেতনা বেদনা নিঃশেষ, জাগতিক সমস্ত ব্যাপার বিনষ্ট করে কাহ্নুপাদ সহজানন্দে প্রবিষ্ট। এই অবস্থায় ত্রিভূবন তাঁর কাছে শূন্য, স্বপ্নের মতো অলীক; কোনো কিছুর ঘুরপাকে তাকে আর পড়তে হবে না। ‘কাহ্নিলা তুই পথ পেয়েছিস। হো-হো কাহ্নিলা তোর সামনে কোনো নদী নেই। কাহ্নিলা রে তুই একদৌড়ে দূর পাহাড়ের চূড়োয় উঠতে পারিস। তোর আর ভাবনা কী। তুই এখন আপন মনে গান গা।’ তখন ও লেখার সরঞ্জাম একপাশে ঠেলে রেখে চিৎকার করে শবরীকে ডাকে।
‘সই? সই?’
‘উহ্ কী হল?’
‘দুপুরে খাওয়ার পর আমরা বনে যাব।’
‘কেন?’
‘তোমার ময়ূর-পালক কুড়াব।’
‘সত্যি আজ তুমি যাবে?’
‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ।’
‘উহ্ কী আনন্দ। কতদিন দু-জনে একসঙ্গে বনে যাইনি।’
শবরী দ্রুত কাজ সারার চেষ্টা করে। হরিণের চামড়া পেতে খাবার জায়গা করে। জলের ভাঁড় নামায়। ভাতের সানকি আনে। আজ আয়োজন কম। মৌরালি মাছ আর নলতে শাক।
‘বাহ্ রান্নাটা খুব ভালো হয়েছে।’
‘ছাই রেঁধেছি। আয়োজন তো তেমন নেই।
‘আয়োজন কী হবে? ঘটা করে খেতে ইচ্ছে করে না। অল্প আয়োজনে তৃপ্তিটাই বড়ো কথা।’
‘তাই বলো। আজ তোমার মনে খুশির ঢল।’
‘এই ঢলটাকেই সব সময় ধরে রাখতে চাই। মন ভরা থাকলে বাইরের আয়োজন না হলেও চলে।’
শবরী কথা বলে না। রান্নাঘরে যায়। পায়ের মল ঝুমঝুমিয়ে ওঠে। বাসনে ভাত নিয়ে আসে। বাটি ভরে তরকারি। কাহ্নুপাদ আবেশ করে খায়। খাবার পর পানের রসে ঠোঁট রাঙায়। বাইরে এসে বেলা দেখে। এখনও অনেক বেলা বাকি। দুজন পাহাড়ের গা বেয়ে তড়বড়িয়ে নেমে আসে। শবরীর পোষা ময়ূরটা ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটে। মাঠ পেরিয়ে ঘাট পেরিয়ে বনে এসে নিজেকে আজ মুক্ত মানুষ মনে হয় কাহ্নুপাদের। এতদিন নিজেকে এক খাঁচার মধ্যে বন্ধ করে রেখেছিল। পাখা মেলে ওড়ার জো ছিল না, চারদিকে ছিল লোহার শিকের মতো শাসন আর চোখরাঙানি, অবহেলা আর অনুকম্পা। এখন ও ছাড়া পেয়ে নিজের ভুবনে এসেছে। ইচ্ছে মতো উড়বে, ঘর বানাবে, পাতার আড়াল তৈরি করবে। কারও পরোয়া করবে না। শবরীর হাতটা নিজের মুঠিতে নিয়ে ঝরা পাতার মর্মর তুলে গাছের ছায়ায় হাঁটে কাহ্নুপাদ। ময়ূর-পালক কুড়োনোটা ছল। নিজেকে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারটাই প্ৰধান।
পরদিন চারদিকে কেমন ঝোড়ো হাওয়া বয়। বৃষ্টি নেই। গুমোট ভাব থমথমে। ঘাটে নৌকা নেই, পথে লোক নেই, আকাশে মেঘ। বিদ্যুতের চাবুক চিরে যায়। জানালায় বসে বাইরে তাকিয়ে থাকে কাহ্নুপাদ। হঠাৎ করে দমকা বাতাসে কেঁপে ওঠে ঘরের জিনিসপত্র। জানালা বন্ধ করার জন্য চেঁচামেচি করে শবরী। কিন্তু কাহ্নুপাদ সে চেঁচামেচি কানেই তোলে না। এভাবে বসে থাকতে ওর কী যে ভালো লাগছে তা শবরীকে কেমন করে বোঝাবে? দই দিয়ে চিঁড়া মাখিয়েছে শবরী। কানুকে খেতে ডাকে। কিন্তু খাওয়ার জন্যেও ওর কোনো গরজ নেই। তাই রাগ করে শবরী ময়ূরের গলা জড়িয়ে কথা বলে। ময়ূরকে শুনিয়ে শুনিয়ে কানুর সঙ্গে আর কথা বলবে না বলে পণ করে। কাহ্নুপাদের মনে হয় একটা মানুষ যেন বাতাস ঠেলে এগিয়ে আসছে। চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু পুরো বুঝতে পারছে না। উপরন্তু ধুলোর ঝড়ে মানুষটাকে কেমন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। কাহ্নুপাদের ভেতরটা ছটফটিয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে মানুষটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে তোমাকে আমার চেনা চেনা লাগছে কেন? ভেতরের আবেগটা চাপতে না পেরে ঠাস করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায় কাহ্নুপাদ। খোলা দরজা দিয়ে জোরে বাতাস ঢোকে। উড়িয়ে নিতে চায় শবরীকে। কোনোরকমে দু- হাতে দুয়ার সামলায় ও। দেখে, কাহ্নুপাদ সাঁই-সাঁই করে নেমে যাচ্ছে। দ্রুত লোকটার সামনে গিয়ে অবাক হয়ে যায় কাহ্নুপাদ।
‘ভুসুকু তুমি?’
‘হ্যাঁ, আমি ফিরে এসেছি।’
ভুসুকু ওকে জড়িয়ে ধরে। স্বজন ফিরে পাওয়ার আবেগ ওর দু-বাহুর চাপে। কাহ্নুপাদ সে উত্তাপ অনুভব করে। ভুসুকুকে দেখে আনন্দ এবং বেদনার মিশ্র অনুভূতিতে কাহ্নুপাদ অভিভূত হয়।
‘আমরা ভেবেছিলাম তুমি বুঝি আর ফিরবে না।’
‘সেরকম অবস্থাই হয়েছিল। তবু দূরে থাকতে পারলাম কই? ফিরতেই হল। নাড়ির টান যে!’
‘রোগা হয়ে গেছ।’
‘কানুপা আমি আবার গীত লিখব। মনে হয় কতকাল যেন আমি সব কিছু থেকে দূরে সরে আছি। কানুপা ফিরে আসতে পেরে আমার কী যে খুশি লাগছে তা আমি বোঝাতে পারব না।’
‘তা তো ঠিকই ভুসুকু। নিজের জমির গন্ধ না পেলে বুক উচাটন হয়ে যায়। আমি তো অন্য জায়গায় গিয়ে একদম থাকতে পারব না। তোমার গীত শোনার অপেক্ষায় রইলাম। কোথায় ছিলে এতকাল?’
‘সে মেলা কথা। জলদস্যুর কবলে পড়েছিল আমাদের নৌকা। সর্বস্ব লুটে নিয়ে গেছে। অনেকে প্রাণে মরেছে। আমি এত বছর ওদের হাতে বন্দি ছিলাম। দাস হয়ে খেটেছি। কী যে অমানুষিক অত্যাচার সয়েছি! তারপর কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছি। একদিন বসে বসে শোনাব সেসব গল্প।’
‘সেই ভালো। আজ ঘরে যাও। দম ফেলে বাঁচো।’
‘যা ঝোড়ো বাতাস। তবু কোথাও থেমে থাকতে মন চাইল না। ছুটে বেরিয়ে এলাম। নিজের মাটির টানে উড়তে উড়তে এসেছি কানুপা। শরীরে শক্তি নেই, তবু কেমন করে যে এলাম ভেবে এখন অবাক লাগছে। মনটা কোনো বাধাই মানতে চাইল না।’
‘ভালোই করেছ। তোমাকে আমাদের মাঝে পেয়েছি এ যে কত ভাগ্য।’
‘আমার ঘরের খবর কী কানুপা?’
‘ভালো। সবাই ভালো আছে।’
‘বউটা হইতো ভেবে ভেবে সারা হয়ে গেছে। ঘরে যাই কানুপা।’
‘যাও।’
লজ্জিত হাসি হাসে ভুসুকু। ভুসুকু আর দাঁড়ায় না। পথের বাঁক বদলে নিজের বাড়ির দিকে যায়। একটু দূর থেকে বলে, ‘চেনা পথঘাটের গন্ধে আমি পাগল হয়ে গেছি কানুপা।’ কাহ্নুপাদ কথা বলতে পারে না, মোড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, হয়তো হুড়মুড়িয়ে নামবে, তবু ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে না কাহ্নুপাদের। মনে হয় বৃষ্টি নামলে ভালো, মজা করে ভিজতে পারবে। আসলে তা নয়, বিক্ষিপ্ত মনটাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য কাহ্নুপাদ বৃষ্টি চাইছে। আসলে তা নয়, ভুসুকুর গীত ওর মনের মধ্যে বৃষ্টি হয়ে নামছে। সেই কয়টা পংক্তি মনে পড়ছে, যে কয়টা পংক্তি ভুসুকু ওকে শোনানোর পর ওকে একদম অন্যরকম লাগত। মনে হত ভুসুকুর সঙ্গে ওর অনেক ব্যবধান। ও এমন লিখতে পারবেনা। সে পংক্তি এখন কী নির্মম পরিহাসের মতো ব্যঙ্গের স্বরে ধ্বনিত। ভুসুকু আরও একবার জলদস্যুর হাতে পড়েছিল, সেবার এত কষ্ট পায়নি ও। অল্প দিনেই ছাড়া পেয়ে চলে এসেছিল। তখনও বিয়ে করেনি। ফিরে আসার পর এই গীত লিখেছিল। যেন সময়টা সবদিক দিয়ে ওকে বঞ্চিত করল।
বাজ ণাব পাড়া পঁউআ খাঁলে বাহিউ
অদঅ দঙ্গালে ক্লেশ লুড়িউ।।
আজি ভুসুকুবঙ্গালী ভইলী
নিঅ ঘরিনী চণ্ডলে লেলী।।
ভুসুকুর এই গীতটা কাহ্নুপাদ কোনোদিন ভুলতে পারেনি। বজ্র নৌকা পদ্মাখালে বাওয়া হল। নির্দয় দস্যু সব লুট করে নিল। ভুসুকু আজ বাঙালি হল। নিজ গৃহিণী চণ্ডালে নিয়ে গেল। আহা, তখন কেন এমন লিখেছিল ভুসুকু, কাহ্নুপাদের বুক মোচড়ায়। ধুলোর ঝড় নেই। বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ে। কাহ্নুপাদ সে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘরে ফেরে।
‘সই, ভুসুকু ফিরেছে।’
‘ভুসুকু?’
‘ওকে দেখেই তো অমন ছুটে গেলাম।’
‘কিছু বলেছ?’
‘না আমি ওকে কেমন করে বলব। ও যে বউর জন্যে উতালা হয়ে ছুটে গেল। আমার সঙ্গে বেশি কথা বলেনি।’
শবরী কথা বলতে পারে না। শাড়ির আঁচল দিয়ে কাহ্নুপাদের মাথা মুছিয়ে দিয়ে শুকনো কাপড় এগিয়ে দেয়। কাহ্নুপাদ কাপড় না নিয়ে ভিজে শরীরে ওকে কাছে টানে।
‘আমি দূরে গেলে তুমিও কি সুলেখার মতো চলে যাবে?’
শবরী ওর মুখ চেপে ধরে। কাহ্নুপাদ হাত সরিয়ে দেয়।
‘আসলে এটাই সত্যি। অনেকদিন তো অপেক্ষা করল সুলেখা। যদি ভুসুকু কোনোদিন ফিরে না আসত তাহলে কেমন হত? সময় থাকতে নিজের পথ বেছে নিয়েছে, এটাই নিয়ম। আমরা সবাই নিয়মের দাস, কী বলো?’ কাহ্নুপাদ মুচকি হাসে।
শববী চটে ওঠে।
‘থামবে তুমি?’
‘থামতে বলছ কেন? যদি এমন হয় তাহলে তোমার পথ দেখে নিও।’
‘কানু তুমি একটা হাতি। এসব কথা শুনতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। ছাড়ো আমাকে। শুকনো কাপড় পরো।’
‘যদি না ছাড়ি?’
‘ইস আর ঢং দেখাতে হবে না। নিজে তো ভিজেছ আবার আমাকেও ভেজানো হচ্ছে।’
‘জল ভালো লাগছে না?’
‘একটুও না।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ।’
‘তবে দেখাচ্ছি মজা।’
কাহ্নুপাদ শবরীর হাত ধরে জোর করে ঘরের বাইরে টেনে আনে। শবরীর নিষেধ এবং চিৎকার শোনে না। ওকে টানতে টানতে পাহাড়ের গা বেয়ে সমতল ভূমিতে নামে। তারপর কার্পাস খেতে ঢোকে দু-জনে। আর তখনই শবরীরও ভালো লাগে বৃষ্টিতে ভিজতে। অনেকদিন পর বৃষ্টি নেমেছে। তুমুল বৃষ্টির স্রোতে ভেসে যায় আশপাশ। চারদিকে ধোঁয়ার মতো দেখায়। সে অলৌকিকে প্রবেশ করার বড়ো সাধ কাহ্নুপাদের।
পরদিন রাজার লোক এসে কাহ্নুপাদকে খবর দিয়ে যায়। দেবল ভদ্রের হুকুম, রাজদরবারে যেতে হবে। কাহ্নুপাদ চুপচাপ শোনে, কিছু বলে না। লোকটি চলে গেলে নদীর ঘাটে এসে দাঁড়ায়। বুকের জ্বালা বেশি তীব্র হয়ে উঠলে কাহ্নুপাদ কথা বলতে পারে না, গুম হয়ে যায়। এ ওর বরাবরের অভ্যেস। ডোম্বি নৌকা নিয়ে মাঝনদীতে। কাহ্নুপাদ তীরের কাদায় দাঁড়িয়ে নলখাগড়া ছেঁড়ে। দেবল ভদ্রের হুকুম এসেছে, ও জানত আসবে, তবু ও যাবে না। কালকে হয়তো জোর করে ধরে নিয়ে যাবে। তারপর শাস্তি। কী শাস্তি দেবে কে জানে। না, তবুও কিছুতেই যাবে না।
অনেকক্ষণ পর নৌকা বোঝাই লোক নিয়ে ফিরে আসে ডোম্বি। গুনে গুনে কড়ি আদায় করে। কাহ্নুপাদের সঙ্গে কথা বলার ফুরসত নেই। আবার লোক বোঝাই করে চলে যায়। আজ ঘাটে পারাপারের চাপ। ডোম্বি একাই সামলাচ্ছে। বারুয়া অসুস্থ, হাঁপানি বেড়েছে। কাহ্নুপাদ হাঁটতে হাঁটতে দেবকীর দোকানে ঢোকে। দেবকী দোকানে নেই, রামক্রী চুপচাপ বসে আছে।
‘কী খবর রামক্রীদা গালে হাত দিয়ে বসে আছ যে?’
‘মন ভালো নেই।’
‘কেন?’
‘বউর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে।’
‘ও তাই বলো, এ আর এমনকি, চুকেবুকে যাবে। তা তোমার ঘড়ায় আছে নাকি কিছু?’
‘সব খালি। ওই নিয়েই তো ঝগড়া।’
‘না দিনটাই মাটি। বউদি কোথায়?’
‘জানি না। রেগেমেগে কোথায় বেরিয়ে গেল। আমাকে কিছু বলেনি।’
‘তুমিও রেগে আছ দেখছি। ছুটকি কোথায়?’
‘ও কি ঘরে থাকে নাকি? কোথায় কোথায় ঘুরছে কে জানে?’
‘তোমার ছেলেটা খুব ভালো হয়েছে।’
‘ওই ভালো দিয়ে করে খেতে পারবে না।
‘তুমি অমন করে বোলো না। বয়স হলে ঠিক হয়ে যাবে ছুটকি। যাই গিয়ে। তোমার মেজাজ ভালো না।’
‘বোসো না। এসেই যাই যাই করছ।’
‘মালপানি নেই যখন থেকে আর লাভ কী?’
‘মনখারাপ নাকি?’
‘তোমার মতো বউর সঙ্গে ঝগড়া হয়নি আমার।’
এতক্ষণে রামক্রী হো-হো করে হাসে।
‘তুমি আছ বেশ। সুখের চাকরি।’
‘চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।’
‘তাই নাকি? করবে কী?
‘দেখি কী করা যায়।’
‘ছাড়লে কেন?’
‘ভালো লাগে না।’
‘ও মা এমন কথা তো শুনিনি। তোমার সব কাজকর্মই এমন।’
কাহ্নুপাদ হেসে বেরিয়ে যায়। আবার নদীর ঘাটে আসে। ঘাটে ডোম্বি একলা, লোক নেই। কাহ্নুপাদ লাফিয়ে নৌকায় ওঠে।
‘তোমার ভিড় তাহলে কমল?’
‘চলে গিয়েছিলে যে বড়ো?’
‘করব কী একলা?’
‘তোমার মনটা বুঝি ভালো নেই কানু?’
‘কেন?’
‘রাজার লোক এসেছিল ডাকতে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওরা হয়তো সহজে ছাড়বে না।’
‘না ছাড়ুক। বেশি আর কী করবে, কয়দিন শস্তি দেবে না হয়।’
‘ভাবনা হচ্ছে?’
‘মোটেই না। ভাবনা আবার কী। যা করেছি তা তো জেনেশুনেই করেছি।’
ডোম্বির চোখে ঝিলিক, ঝকঝকে ছুরির চমক। কাহ্নুপাদের মনে হয় ডোম্বি ওর কাছ থেকে বুঝি অনেক দূরে সরে গেছে। ওর চেহারায় আগের আদল নেই, বদলে গেছে, ধারালো হয়েছে।
ডোম্বি কোমর থেকে চকচকে ছুরিটা বের করে।
‘ওটা কী হবে মল্লারী?’
‘কী আর, দরকারের সময় কাজে লাগবে।’
‘দরকারটা কী শুনি?’
‘নতুন গীত কী লিখেছ কানু?’
‘এটা বুঝি আমার কথার উত্তর হল?’
‘ওই দ্যাখো লোক আসছে। নৌকা খুলতে হবে?’
‘খোলো। আমিও যাব।’
‘কোথায়?’
‘কোথাও না। নৌকায় বসে থাকব। তোমার সঙ্গে এপার ওপার করব।’
‘সেই ভালো।’
ডোম্বি উচ্ছ্বসিত আবেগে হেসে ওঠে। কানুকে এমন করে পাওয়ার সাধ ওর কত কালের, কখনো পাওয়া হয়নি। ডোম্বির সঙ্গে নৌকা বাইতে ভালো লাগে কাহ্নুপাদের। কত বছর ধরে এসব কাজ থেকে ও অনেক দূরে ছিল, এখন সব কিছু নতুন নতুন লাগে। এতকাল ও নিজের জায়গা ছেড়ে একটা বিদেশি জায়গায় বাস করেছে। যেখানে ওর নিগ্রহ ছাড়া আনন্দ পাবার কিছু ছিল না, যেখানে কোনো আপন পরিবেশ তৈরি হয়নি। এখন নিজের দিকে ফিরে চাইবার সময় হয়েছে।
ঘাটে লোক নেমে গেলে ডোম্বি হঠাৎ করেই বলে, ‘আজকাল একটা বামুন আমাকে বড্ড জ্বালায় কানু।’
‘কে?’
‘আগে দেখিনি। বলে দেবল ভদ্রের ভাগনে। মানা করলে শোনে না। একদিন মেজাজ খারাপ হলে সাবাড় হয়ে যাবে।’
কাহ্নুপাদ হঠাৎ করে কিছু বলতে পারে না। ডোম্বি অতিরিক্ত ব্যস্ততায় নৌকার কাছি খুলে দেয়। কাহ্নপাদের হাতে বইঠা, ছপছপ শব্দে নদীর বুকে ওঠে নামে। দূরে তাকিয়ে দেখে ভুসুকু আসছে। কাহ্নুপাদের বুক তোলপাড় করে ওঠে। ভুসুকুর সামনে নিজেকে কেমন অসহায় মনে হয়।
‘মল্লারী, গতকাল ভুসুকু ফিরেছে।’
‘কী বলছ?’
‘ওই দ্যাখো এদিকেই আসছে।’
‘না ফিরলেই বুঝি ভালো করত।’
ডোম্বি আস্তে করে বলে। হঠাৎ করেই মন বিষণ্ন হয়ে যায়। ডোম্বি যে আবেগে কাহ্নুপাদের জন্য উচ্ছ্বসিত হয়েছিল তা এক মুহূর্তে ধপ করে পড়ে যায়। তখন ভুসুকু ঘাটে এসে দাঁড়ায়। কাহ্নুপাদ কাদা বাঁচিয়ে লাফ দিয়ে নামে। ডোম্বি আবার চলে যায়। ভুসুকুর সঙ্গে কথা বলা হয়ে ওঠে না।
কাহ্নুপাদ ভুসুকুর কাঁধে হাত রাখে।
‘কী খবর ভুসুকু? সারারাত ঘুমোওনি মনে হয়।’
ভুসুকু হাঁ করে চেয়ে থাকে। রাত্রি জাগরণের ফলে লাল চোখ, বিভ্রান্ত দৃষ্টি। কাহ্নুপাদের হাত ধরে। মাথায় গোটা দুই ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘আমার সর্বস্ব লুট হয়ে গেছে কানুপা।’
‘তোমার গীত আছে।’
‘না সেটাও হারিয়েছি। আমি আর কোনোদিন লিখতে পারব না কানুপা। জলদস্যুদের হাতে বন্দি থেকে মনে হয়েছিল আমি আর কিছু করতে পারব না। এখানে এসে দেখলাম, সত্যি পারব না। আমি একদম নিঃশেষ কানুপা।’
ভুসুকু দু-হাতে মুখ ঢেকে হুঁ-হুঁ কাঁদে। কাহ্নুপাদ ওর পিঠে হাত দিয়ে নদীর ধারে ধারে হাঁটে। ভুসুকু নিজেকে থামাতে পারে না। ওর বুকটা কাঁদার জন্যে উন্মুখ হয়েছিল। কাহ্নুপাদের স্পর্শে সে মেঘ অবিরল ঝরল। আহা কান্নাটা কত ভালো। মানুষকে একদম হালকা করে দেয়। নইলে মনটার যে কী হত। অনেকক্ষণ কাঁদার পর ভুসুকু থামে। ওকে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা কাহ্নুপাদের জানা নেই।
‘আমি কেন এত কষ্ট করে ফিরে এলাম কানুপা? প্রতিটি দিন আমি কার জন্য নষ্ট করেছি? জলদস্যুর কাছে যা হারিয়েছিলাম তার জন্য তো কখনো এমন বেদনা হয়নি। এখন কেন বুকটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে? তুমি কথা বলছ না কেন কানুপা? তুমি কি বোবা হয়ে গেছ? তুমি কিছু বলো! এখানে আসার পর কেউ আমাকে তেমন কিছু বলে না। কেবলই লুকিয়ে যায়। অথচ আমি প্রাণভরে কিছু শুনতে চাই। তোমরা আমাকে কিছু বলো!’
ভুসুকু কাহ্নুপাদের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয়। কাহ্নুপাদ কিছু বলে না। কী বলবে সেটা ওর জানা নেই। ওর গলার কাছে বেদনা দলা হয়ে থাকে, কিছুতেই নড়তে চায় না। ‘না, তোমরা সবাই কেমন যেন হয়ে গেছ, অনেক পালটে গেছ। আমি আর কাউকেই তেমন আগের মতো পাচ্ছি না।’
ভুসুকু বড়ো করে শ্বাস ফেলে।
‘শুধু এই নদীর বাতাস বদলায়নি, বদলায়নি ঘাস লতা। অবিকল তেমনি আছে। যেমন করে আগে স্পর্শ দিত এখনও তেমন দিচ্ছে। কিন্তু ওরা কথা বলতে পারে না কানুপা। ওরা আমাকে কিছু বলতে পারে না।’
‘ভুসুকু, চলো ওই পাহাড়ের দিকে যাই। ওখানে কুক্কুরীপাদ আছে।’
‘তোমাদের সঙ্গ ভালো লাগছে না। আমি একলাই যেদিক খুশি সেদিক যাব।’
ভুসুকু আগে আগে চলে। কাহ্নুপাদ সঙ্গ ছাড়ে না। পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। এক সময় ভুসুকুর মন ভালো হবে। তখন ভুসুকু আবার বন্ধুর মতো কথা বলবে। ভুসুকুর গীত কেমন নির্মমভাবে ওর জীবনে সত্য হয়ে গেছে। একেই কি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে? হাঁটতে হাঁটতে লোকালয় ছেড়ে আসে ওরা। আশেপাশে আর কোনো মানুষ নেই, কেবল গাছগাছালির অসীম বিস্তার, দূরে পাহাড়। অর্জুন গাছের ছায়া ভুসুকুর নিঃসঙ্গ বুকটার কাছাকাছি হয়। শুকনো কালো বিচির খরখরে শব্দ পায়ের নীচে। হঠাৎ সেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে কাহ্নপাদের মুখোমুখি হয় ভুসুকু
‘তুমি তো আমার বন্ধু কানুপা। তুমি কবি। তুমি কেন সুলেখাকে আমার কথা শোনাতে পারোনি? কেন বলোনি ভুসুকু একদিন-না-একদিন আসবেই সুলেখা। ভুসুকু তোমাকে ভুলে যায়নি।’ কাহ্নুপাদের মনে হয় অর্জুন গাছের বাকল দিয়ে কী যেন একটা ওষুধ হয়। সে ওষুধ দিয়ে কি ভুসুকুর বেদনা কমানো যায় না? পাহাড়টা আর বেশি দূরে নয়। নির্জন পরিবেশ, ভারি চমৎকার দেখাচ্ছে চারদিক। কাহ্নুপাদের ইচ্ছে করছে একদৌড়ে পাহাড়ে চলে যেতে। ভুসুকু একগাদা অর্জুনের বিচি হাতের মুঠোয় তুলে নেয়। ইতস্তত ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারে। কখনো অনেক দূরে ছুঁড়ে দেয়। অকারণে হাসে।
‘বুঝেছি, তুমি আমার কোনো কথারই উত্তর দেবে না কানুপা!’
কাহ্নুপাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ভুসুকু আবার সামনে হাঁটতে থাকে। পাহাড়ের গুহায় কুক্কুরীপাদের আশ্রয়। দু-জনেই সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা নেই, নিশ্চয় ফলমূল কুড়োতে গেছে। কুক্কুরীপাদ যোগীর ধ্যানে নিমগ্ন, ডেকে সাড়া পাওয়া গেল না। ভুসুকু হাত ওলটায়। তারপর পা ছড়িয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়ে, নরম সবুজ ঘাস কোনো ব্যবহারে মলিন নয়। স্পর্শ শরীর ঝিম ধরিয়ে দেয়।
‘আচ্ছা কানুপা সুলেখা কি ভেবেছিল আমি মরে গেছি?’
‘তা কী করে ভাববে।’
‘তবে ও কেন অপেক্ষায় রইল না?’
‘জীবনের অনেক কিছুই আমি জানি না ভুসুকু।’
এতক্ষণে ভুসুকু শব্দ করে হাসে, প্রাণখোলা হাসি। কাহ্নুপাদের ভালো লাগে।
‘সত্যি কথা বলেছ কানুপা। জীবনের কিছুই আমিও জানি না।’
মাথার ওপর সূর্য। মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে যায়। ভুসুকু টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। রোদের এই আলো-আঁধারি আলসেমি ধরায়। শরীর ম্যাজম্যাজ করে। ঘাসের ডগা চিবুতে মন্দ লাগে না কাহ্নুপাদের।
‘ঘুম পাচ্ছে কানুপা।’
‘ঘুমোও।’
‘মনে হচ্ছে কতকাল ঘুমোইনি। এতদিনে নিজের মতো একটা বিছানা পেয়েছি। বিশেষ সময়ে সুলেখা যেমন বুকে জড়িয়ে ধরত, ঘাসটা আজ তেমন আমাকে মেয়েমানুষের সোহাগ দিচ্ছে।’
‘তুমি ঘুমোও ভুসুকু।’
ভুসুকুর এমন নিঃস্ব কন্ঠ কাহ্নুপাদের অনুভূতি অবশ করে দেয়। ও উঠে গুহার ভেতরে যায়। কুক্কুরীর ধ্যান এখনও ভাঙেনি, ও যেভাবে বসেছিল ঠিক সেভাবেই রয়েছে, একটুও নড়াচড়া করেনি। কেউ যেন ওকে আসনের সঙ্গে গেঁথে দিয়েছে। কাহ্নুপাদ সে মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে। ওই ধ্যানস্ত মূর্তি ওর বুকের ভেতরে ওলটপালট করে দেয়। ভালো লাগে না।
ভুসুকু ঘুমিয়ে গেলে ও ওকে রেখেই চলে যাবে।
কাহ্নুপাদ গুহা থেকে বেরিয়ে আসে। তখন কোঁচড়ে একগাদা ফল নিয়ে ফিরে আসে সন্ধ্যা।
‘বাবা আজ কী ভাগ্য! কার মুখ দেখে যে উঠেছি। কেমন আছ ভুসুকু?’
সন্ধ্যা কলকলিয়ে ওঠে। কাহ্নুপাদকে দেখে চেঁচায়, ‘কানুপা তুমিও?’
‘এলাম তোমাদের খোঁজখবর নিতে। তোমরা অনেকদিন গাঁয়ের দিকে যাওনি।’
‘যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি। কবে ফিরেছ ভুসুকু?’
ভুসুকু শুকনো কন্ঠে বলে, ‘তোমার কথা শুনতে ভালো লাগছে না। কিছু খাবার থাকলে দাও। পেটটা চোঁ-চোঁ করছে।’
‘বোসো আসছি।’
‘ঘুমোওনি ভুসুকু?’
‘ঘুম এল না। একটা গীত আমার মনের মধ্যে তৈরি হচ্ছে কানুপা।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ। পুরোটা হয়নি। আরম্ভটা করতে পারিনি। মাঝের একটা পংক্তি শোন;
অপনা মাংসে হরিণা বৈরী
‘বাহ্ চমৎকার। চমৎকার বানিয়েছো।’
‘বানাইনি কানুপা। আমার ভেতর থেকেই শব্দগুলো এল। ভেবে দেখলাম সুলেখার কোনো দোষ নেই। ওর যৌবনটাই ওর সঙ্গে শত্রুতা করেছে। হরিণের মাংস যেমন হরিণের শত্রু। আমরা জাল বেড় দিয়ে ধরে মারি। আসলে আমরা তো এমন করেই নিজের কাছে হেরে যাই কানুপা। কেমন করে হারলাম বুঝতে পারি না।’
‘ভুসুকু তুমি অনেক বড়ো কবি।
কাহ্নুপাদ ভুসুকুকে জড়িয়ে ধরে।
‘কী হচ্ছে দুই বন্ধুর? নাও বোসো।’
সন্ধ্যা কলাপাতার ওপর চিঁড়া আর কলা নিয়ে এসেছে। ভুসুকু দেরি না করে খাবারটা নিয়ে বসে পড়ে।
‘কতদিন যে এমন খাবার খাইনি!’
‘কী যে বলো।’
‘এমন মানে, এমন যত্নের খাবার খাইনি। এমন খাবার খেলে পেট যেমন ভরে, মনও তেমন ভরে।’
‘কীই-বা করতে পেরেছি! কেন যে লজ্জা দাও।’
সন্ধ্যা উঠে গিয়ে ঘড়ায় করে জল নিয়ে আসে।
‘তোমাকে আরও চারটে চিঁড়ে দেই ভুসুকু?’
‘না। তুমি বোসো।’
সন্ধ্যার মুখে আনন্দের হাসি। ভুসুকু তাকিয়ে থাকে। সুখ-দুঃখ কোনো কিছুতেই ওদের আর তেমন কিছু আসে যায় না। ওরা এখন সংসারের বাইরে।
‘দেখছ কী তাকিয়ে? খাও।’
‘ভালো লাগছে না।’
‘বললে যে অনেক খিদে।’
‘এখন নেই।’
‘খাও ভুসুকু। তোমার খিদে আছে।’
‘আমি আবার বাণিজ্যে যাব কানুপা।’
‘কবে?’
‘যে-কোনো দিন। নদীর বুকে ঘুরতে ভালোই লাগে। ঘরে আমার মন বসে না।’
ভুসুকু একটু খাবার মুখে দেয়।
‘কিছুই খেলে না ভুসুকু? যত্নের কথা বললে কিন্তু যত্নটা নিলে কই?’
‘বেশি যত্নে কষ্ট বাড়ে বউদি।’
ভুসুকু উঠে পড়ে।
‘চলো কানুপা।’
‘সে কী, ওর সঙ্গে কথা বলবে না?’
‘না, তোমার যোগীর ধ্যান আজ আর ভাঙবে না। আরেকদিন আসব। আজ যাই।’
‘এসো কিন্তু মনে করে। গাঁয়ে গেলে যেন শুনি না যে বাণিজ্যে চলে গেছ।’
‘না তা শুনবে না। আসব, কুক্কুরীর সঙ্গে দেখা না হলে নিজেরই খারাপ লাগবে।’
ভুসুকু আগে আগে হাঁটে, কাহ্নুপাদ পেছনে। শেষ বিকেলের আলোয় ভুসুকুর ছায়া ঘাসের বুকে লম্বা হয়ে কাঁপে। কাহ্নুপাদ আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ভুসুকুর গীতের ওই একটুখানি নিয়ে নাড়াচাড়া করে। কাহ্নুপাদের বুকে গেঁথে গেছে ওইটুকু। বড়ো চমৎকার! দারুণ তৈরি করেছে ভুসুকু।
কিছুদূর গিয়ে ভুসুকু দাঁড়িয়ে যায়। কাহ্নুপাদ এগিয়ে গেলে বলে, ‘আমার গীতের একটুখানি বানালাম কানুপা।’
‘বলো শুনি।’
তিন ণ চ্ছুপই হরিণা পিবই ণ পাণী।
হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জানী।।
‘বুঝলে কানুপা হরিণ তৃণ স্পর্শ করে না, জল ছোঁয় না। হরিণ হরিণীর নিবাস কোথায় তা জানে না।’
কথা ক-টি বলে ভুসুকু হেসে ওঠে।
‘তুমি অমন করে হেসো না ভুসুকু।’
ভুসুকু হাসতেই থাকে, অনেকক্ষণ হাসে, তারপর বুক চেপে ধরে।
‘না, আমি আর হাসব না কানুপা। বুকটায় কিছু নেই। হাসলে ব্যথা লাগে। জলদস্যুর হাতে পড়েছিলাম। নির্যাতন করেছে, কষ্ট পেয়েছি। শরীরে ব্যথা হয়েছে। কিন্তু বুকে ব্যথা হয়নি। এখন আমার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। নরক কী কাহ্নুপাদ, তুমিও জানো না, আমিও না। তবু আমার বাড়িঘর, গাছপালা, নদী নরকের মতো অসহ্য। আমি আবার চলে যাব।
‘না, তুমি যাবে না। তোমাকে আমরা যেতে দেব না।
ভুসুকু ঘুরে দাঁড়ায়।
‘কেন? যেতে দেবে না কেন?’
‘কেন যাবে? আমরা রয়েছি না? এই মাটি, নদী, আমরা সবাই তোমার দুঃখ ভুলিয়ে দেব ভুসুকু।’
‘পারবে, কানুপা পারবে?’
ভুসুকু কাহ্নুপাদের হাত আঁকড়ে ধরে।
‘পারব ভুসুকু। তুমি আমাদের সঙ্গেই থাকবে।
ভুসুকু গলা ছেড়ে হা-হা করে হেসে ওঠে। কাহ্নুপাদের ঘাড়ে হাত রাখে। শেষ বিকেলের আলোতে দুজন মানুষ খুব কাছাকাছি এসে যায়। ভুসুকু হাসতেই থাকে। হাসতে হাসতে বলে,
‘আজি ভুসুকু বঙালি ভইলী। বুঝলে কানুপা ভুসুকু আবার গীত বানাবে, অনেক গীত। একদিন সারারাত তোমাকে গীত শোনাব।’ কাহ্নুপাদ কথা বলে না। ভাবতে থাকে যে ভুসুকু বিশাল মাপের কবি। ওর গভীরতা যেমন, ব্যাপ্তি তেমন। এমন একটি মানুষকে ওদের বড়ো দরকার। জীবনের বিনিময়ে যার অভিজ্ঞতা হয় সে তো আগুনে ঝলসানো খাঁটি সোনা, তার তুলনা হয় না। ওর দু-কান ভরে শুধু বাজে, আজি ভুসুকু বঙালি ভইলী।