অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৮

অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৮

কার্তিকের শুরু, হিমে কুঁকড়ে যায় শরীর। ভোরের কুয়াশা নদীর ওপর দুধের ঘন সরের মতো, দু-হাত দুরেও কিছু দেখা যায় না। বেলা করে ঘাটে আসে ডোম্বি। কাঁথা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করে না। মালসায় কয়লার আগুন রেখে ঘরটা গরম রাখে। ঘরের এই ওমের সঙ্গে বাইরের অনেক তফাত। বাইরে বেরুলেই নাক-কান দিয়ে পিনপিনে হিম ঢুকে গিয়ে ভেতরটা জমিয়ে ফেলে। ওর বেশ কষ্ট হয়। বারুয়া মাঝি তো সূর্য ওঠার পরও কানমাথা চাদরে মুড়ে রাখে। তবুও এ মাসটা ডোম্বির ভীষণ পছন্দ, আরও পছন্দ এ মাসের সুখরাত্রিব্রত উৎসব, গাঁয়ের সবারই প্রিয় উৎসব। ভোরে বাড়ি বাড়ি অতিথি অৰ্চনা হয়। কপালে চন্দনের ফোঁটা, একটি সুগন্ধী ফুল আর হাতের তালুতে দই—এ দিয়ে সবাইকে বরণ করা হয়। এর আগের দিন সন্ধ্যায় রাজাবাড়িতে গাঁয়ের সবার নিমন্ত্রণ থাকে। খাওয়ার আগে পায় কর্পূর মেশানো সুগন্ধী জল, খাওয়ার শেষে মশলাযুক্ত পানের খিলি, মাঝখানে কাগনি ধানের ভাতের সঙ্গে দই আর রাই সরিষার তৈরি ভীষণ ঝাল দেয়া ছাগলের মাংস। খাবার জন্য সারা বছর সবার প্রতীক্ষা থাকে, যত ইচ্ছে পেট পুরে খাওয়া যায়। সন্ধ্যে হতেই দলে দলে বেরিয়ে যায় নারী-পুরুষ-ছেলেমেয়ে। এক দল খেয়ে এলে আর এক দল যায়। এই একটা দিন বারুয়া মাঝির পারাপারের কড়ি আসে রাজকোষ থেকে। ডোম্বি এ দিন নৌকা বায় না। এ দিনটি কেন ওর প্রিয় ভাবতে গিয়ে ডোম্বির মনে হয়, এ উৎসবের বড়ো আকর্ষণ চন্দনের ফোঁটা, সুগন্ধী ফুল আর হাতের তালুর দই। চৈত্র মাসের কাম উৎসবও ওর এত প্রিয় নয়। এ উৎসবের পবিত্রতা আছে, মনকে ভগবানের কাছে নিয়ে যায়, সবার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করতে ভালো লাগে। নাচ, গান, বাদ্যে গাঁ মুখরিত হয়। গত বছর কানুকে একটা চমৎকার চুমকুড়ি ফুল দিয়েছিল। তা ছাড়া কপালে চন্দনের ফোঁটা দিতে কী যে আরাম। মনে হয় সব কিছু এক অন্যরকম নদী হয়ে বইছে, সে নদীর জলে আশ্চর্য গন্ধ, দিগবিদিক মাতিয়ে রাখে। ডোম্বি সে নদীতে একলা নৌকা বায়, ঢালু কূলে গুন টানে। কেউ আর কোথাও নেই। এ বছর কানুর জন্য একটা গোলাপ রেখেছে। অনেক কষ্ট হয়েছে জোগাড় করতে। বেশির ভাগ বাড়িতেই তো জবা থাকে। দেখতে দেখতে দিনটি এসে যায়। 

ভোররাতে শবরীর ঘুম ভেঙে গেলে ও কানুকে জড়িয়ে ধরে। আগের দিন রাতে চন্দন ঘষে রেখেছে। দুটো খুব সুন্দর হলুদ আর লাল মেশানো শুন্দা ফুল খুঁজে এনে কলাপাতায় করে শিশিরে রেখে দিয়েছে, দই বানিয়েছে। 

কাহ্নুপাদ বুকের নীচে বালিশটা টানতে টানতে বলে, ‘আজ সোহাগটা একটু বেশি মনে হচ্ছে?’ 

‘কেন কখনো কি কম দেখেছ?’ 

‘হুঁ, অনেক দেখেছি। কখনো কমতে কমতে এতই কমে যায় যে—’ 

শবরী মুখ চেপে ধরে। 

‘দ্যাখো মিছে কথা বোলো না।’ 

‘মিছে বুঝি?’ 

‘তা নয়তো কী? ঠিক আছে মিছে না হলে আজকে আরও কিছু হোক।’ 

‘হুঁ এজন্যেই ভণিতা।’ 

কাহ্নুপাদ মিটমিটিয়ে আসে। বুকের নীচ থেকে বালিশটা সরিয়ে দেয়। শবরীর ঘন কালো একরাশ 

চুল বিছানায় ছড়িয়ে পড়ে। ধাতুর খাটে দুজন মানুষ শান্ত হয়ে যাবার আগে ভাবে, কানুটা সাংঘাতিক, হুটোপুটিতে অস্তাদ। কানু ভাবে, শবরী সব ব্যাপারগুলো নিখুঁত বোঝে। রাজা ওকে রাজদরবারটা সাজিয়ে তোলার কাজ দিতে পারত। ভোরের আঁধার ছুটতে না ছুটতে পটহ মাদল বেজে ওঠে, দ্রিম দ্রিম। যেন ঘোষনায় মুখরিত, আজ সুখরাত্রিব্রত, পুরবাসী ওঠো, জাগো। 

দু-দিন কোনো কাজ নেই। কেবল নাচ, গান, হল্লা। রাজবাড়িতে নেমন্তন্ন খাওয়া। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের দল ছুটে আসে। উদ্দাম নাচে ডোম্বি, ও আজ ঘাটে যাবে না, নৌকা বাইবে না, জায়গায় জায়গায় নাচবে। ধাতুর খাটে শুয়ে থেকে কাহ্নুপাদ ভাবে, ডোম্বি দিনভর নাচে বলেই সুখরাত্রিব্রত আকাঙ্ক্ষিত। ওর কাছ থেকে পাওয়া ছোট্ট একটি ফুল সারা বছর ওকে গন্ধ দেয়। এই ছোটখাটো সুখের অনুভূতিগুলো বাঁচিয়ে রাখার সহায়ক। শবরী ভাবে, আজ কানুর দরবারে যেতে হবে না। কানু সারা দিন ঘরে থাকে বলে সুখরাত্রিব্রত এত সুন্দর। আজ সারা গায়ে চন্দন লেপে দেব। নাচের মাঝে মাঝে ডোম্বির মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, কাল ভোর ছাড়া কানুর কপালে চন্দন দেয়া যাবে না। এই উন্মুখ প্রতীক্ষাটুকু আছে বলেই ওর সব কিছু সার্থক মনে হয়। 

বাজনার শব্দে সবাই পথে নেমে আসে। ডোম্বির নাচের ফাঁকে ছোটো ছেলেমেয়েরা গান গায়। গাইতে গাইতে পথে চলে। দেশাখের চঞ্চল চোখ বিশাখাকে খোঁজে। বিশাখাকে নিয়ে দূরের পাহাড়ে যাবে, আজ কোনো কিছুতে মানা নেই। তিরধনুকে বিশাখার হাত বেশ পাকা হয়ে উঠেছে। এত তাড়াতাড়ি শিখতে পারবে দেশাখ নিজেও ভাবেনি। বিশাখার আজ ঘুঘু মারার পরীক্ষা, কিন্তু ওকে কোথাও খুঁজে পায় না। ও কি এখনও ঘর থেকে নামেনি? গতবছর দুজনে সন্ধ্যায় বাজি ধরেছিল যে কে আগে নামতে পারে। বিশাখার সঙ্গে দেশাখ কোনোদিন পারেনি। তখন ও রেগে যেত, ‘তুমি কি রাতে ঘুমোও না?’ 

‘ঘুমোই। কিন্তু ঠিক সময় আমার ঘুম ভাঙে। আমি মন্ত্র পড়ে ঘুমাই।’ 

‘কচু।’ 

দেশাখ ভেংচি কাটে। বিশাখা খিলখিল শব্দে হাসে। 

‘রাগলে তোমাকে ভালো দেখায়।’ 

দেশাখ বিশাখার চুল টেনে ধরে। 

‘উঃ ছাড়ো।’ 

‘আগে বলো সামনের বার আমার আগে আসবে না?’ 

‘ঠিক আছে আসব না। 

কিন্তু বিশাখা কোনোবার সে-কথা মনে রাখেনি। প্রত্যেকবার আগে এসে হাজির হত। কিন্তু আজ কী হল? এখন অবশ্য ও আগের মতো চঞ্চল নেই, অনেক গম্ভীর হয়ে গেছে। শরীর ভারী হয়েছে, চোখে বুনো দৃষ্টি ঝলসে ওঠে। দেখলে আবেগ উথলে ওঠে। দেশাখ তখন দলছুট হয়ে বিশাখার বাড়ির দিকে যায়। কার্তিকের এই হিমেল ভোরের সুখরাত্রিব্রতের উৎসবে ওর মন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। জীবনের অনেক গোঁজামিল এখন ওকে ভাবায়, কিন্তু প্রতিকারের পথ খুঁজে পায় না বলে মেজাজ খিঁচড়ে থাকে। বিশাখাদের বাড়ি পর্যন্ত যেতে হয় না। মাঝপথে ওর সঙ্গে দেখা হয়। বিশাখা ছুটতে ছুটতে আসে। 

‘আজ তুমি জিতে গেছ?’ 

বিশাখা তড়বড়িয়ে কথা বলে। দেশাখকে অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে যাবার ফলে কিছুটা বিহ্বল। দেশাখ একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘুম থেকে উঠে আসার দরুন আশ্চর্য সতেজ। কোনো বিষণ্ণতা যেন ওর পবিত্রতা নষ্ট করেনি। 

‘তোমার আজ দেরি কেন বিশাখা?’ 

‘কাল রাতে বাবার অসুখ ভীষণ বেড়ে গিয়েছিল। আমি মা কেউই ঘুমোইনি। ভোররাতে একটু শুয়েছিলাম, তাই ঘুম ভাঙেনি।’ 

‘বাবা এখন কেমন?’ 

‘ভালো। মা বললেন আমাকে উৎসবে যেতে। উঃ তোমাকে এখানে না পেলে আমার যে কী খারাপ লাগত।’ 

‘দেখলে তো তোমার মনের কথা আমি সব টের পাই। চলো।’ 

‘অ মা উলটো দিকে যাচ্ছ যে?’ 

‘না, উৎসবের দলের সঙ্গে আমরা থাকব না। তুমি আর আমি সারাদিন একসঙ্গে কাটাব।’ 

‘সত্যি খুব মজা হবে।’

দুজনে হাত ধরে পাহাড়ের দিকে হাঁটতে থাকে। 

‘দেশাখ তোমাকে না পেলে আমার দিনগুলো অন্যরকম হত।’ 

‘কেমন?’ 

‘আমি তা জানি না। বোধহয় খারাপ। জানো মাঝে মাঝে মনে হয় আমার জন্যে কোথাও কোনো আনন্দ নেই।’ 

‘থাক এসব কথা ভাবতে নেই।’ 

‘শুধু তোমার কাছে এলে সব কিছু অন্যরকম হয়ে যায়।’ 

‘দ্যাখো বিশাখা আমরা অনেকদূর চলে এসেছি।’ 

‘সত্যি তো পটহ মাদলের শব্দ আর নেই। 

‘তোমার ভালো লাগছে না?’ 

‘হ্যাঁ।’ 

‘চলো দৌড়াই?’ 

‘না আস্তে আস্তে যাব। দৌড়ালে তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়।’ 

‘তবে থাক।’ 

‘আজ আমরা কী করব দেশাখ।’

‘খেলব।’ 

‘কী খেলা।’ 

‘মিছেমিছি খেলা।’ 

দেশাখের মনে হয় বিশাখার শরীরে নতুন ঘাসের গন্ধ ভোঁ-ভোঁ দৌড়োচ্ছে। একটু পর ওরা একটা বড়ো টিলার আড়ালে চলে যাবে। আর সেখানে গেলেই সব কিছু থেকে আড়াল হয়ে যাবে ওরা। তখন বিশাখার শরীরের ভোঁ-ভোঁ করা গন্ধটাকে দেশাখ ধরে ফেলতে পারবে। 

পটহ মাদলের ঝংকারে ডোম্বির উদ্দাম নৃত্য সমগ্র পল্লি মাতিয়ে তোলে। কেউ আর ঘরে নেই, সবাই পথে নেমে এসেছে। যার যা ইচ্ছেমতো হাসছে, গাইছে, নাচছে। ফূর্তির শেষ নেই। কারও ঘরেই আজ রান্না হবে না। ফলমূল, বাসি খাবার যা সামান্য কিছু খেয়ে দুপুর কাটিয়ে দেবে। তারপর বিকেল পড়লেই ছুটবে রাজবাড়ির দিকে। কাহ্নুপাদ পথের ধারে দাঁড়িয়ে থেকে অবাক হয়ে দেখছে ডোম্বির প্রাণশক্তি। একটুও ক্লান্তি নেই, যেখানে সেখানে নেচেই চলেছে। শবরী কোথায় যেন বেরিয়েছে। কাহ্নুপাদ ঘুরে ফিরে আবার ঘরে চলে আসে। পাখির পালকের কলমটা বেড়া থেকে নামিয়ে লিখতে বসে। মনে হয় লেখার জন্যে মনের ভেতরে অনুকূল পরিবেশ। ডোম্বির উদ্দাম নাচের ছন্দের মতো পংক্তি আসছে। 

ভবনির্বাণে পড়হ-মাদলা 
মন বপন বেণি করণ্ডকশালা।। 
জঅ জঅ দুন্দুহি-সাদ উছলিআঁ 
কাহ্ন ডোম্বি-বিবাহে চলিআ।। 

এ পংক্তিটা লিখে হেসে ফেলে কাহ্নুপাদ। মনের বিচিত্র আনাগোনায় কখনো মুগ্ধ হয়, কখনো শঙ্কিত। কলম ছেড়ে ঘরে পায়চারি করে। বাজনা খুব মৃদু শব্দে আসছে। শবরী যে কোথায় গেল? জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কুক্কুরীপাদ এখন ওখানে কী করছে? ইদানীং লুইপা আর বিরুআ বেশ ভালো গীত লিখছে। ওদের কয়েকটা গীত কাহ্নুপাদ দেখেছে। ওদের উপলব্ধি তীক্ষ্ণ, নিজেদের পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। ওদের লেখা গভীর প্রত্যয়নিষ্ঠ। কাহ্নুপাদের এই ভেবে ভালো লাগে যে ওর চারপাশের মানুষগুলো ধারালো হয়ে উঠছে। ভাবতে ভাবতে নিজের ভেতরের আবেগটা মুহূর্তে চনচনিয়ে ওঠে। ও আবার হরিণের চামড়ার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে। 

ডোম্বি বিবহিআ অহারিউ জাম। 
জউতুকে কিঅ আনতু ধাম।। 
অহণিসি সুরঅ পসঙ্গে জাঅ। 
জোইণিজালে রএনি পোহাঅ।। 

পংক্তিগুলো গুনগুনিয়ে গায় কাহ্নুপাদ। সুরটা ঠিক করে। ভেবে পায় না কী করে লিখে ফেলল যে, ডোম্বিকে বিয়ে করে পুনর্জন্ম হল। হ্যাঁ, আরেক জন্মে ও ওকে চাইবে। কখনো কারও সঙ্গে এমন দেরিতে সখ্য গড়ে ওঠে যে তখন আর সময় থাকে না। তখন কেবলই বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস আসে, কেবলই পিছন ফিরে তাকাতে হয়। ও বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘যার এত দুর্বার আকর্ষণ তাকে উপেক্ষা করা সহজ নয়। শেষের পংক্তি দুটোর জন্যে ওকে আর ভাবতে হয় না। 

ডোম্বিএর সঙ্গে জো জোই রত্তো। 
খণহ ন ছাড়অ সহজ-উন্মোত্ত 

ডোম্বির সঙ্গে যে যোগী অনুরক্ত হয়, ক্ষণমাত্রও সে সেই ডোম্বিকে ছাড়ে না। পুরো গীতটা লেখার পর শরীর কেমন অবশ লাগে, উঠতে ইচ্ছে করে না। হরিণের চামড়ার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে থাকে। মনে হয় বুকের নীচ দিয়ে ভীষণ শীতল এক জলের রেখা গড়িয়ে যাছে। 

কার্তিকের দুপুর কবুতরের বুক হয়ে ওম ছড়ায়। গায়ের কুটোটুটো ঝেড়ে উঠে বসে বিশাখা। অর্জুনের গাছের কালো গোটাগুলো সবখানে ছড়িয়ে আছে। দেশাখ অনেকগুলো জড়ো করেছিল। এখন একটা দুটো করে এদিক ওদিক ছুঁড়ে মারে। কনুইতে ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে আছে ও। বিশাখা নখ দিয়ে মাটি খুঁটে। আনত দৃষ্টিতে ঘাসের বেগুনি ফুলের স্নিগ্ধতা। সংসার মানেই কেবল বাবার অসুখ নয়। এ বোধ থেকে ছাড়া পাবার দরুন ওর দৃষ্টি, নিশ্বাস, বুকের ওঠানামা আমূল পালটে যায়। অকারণে দেশাখে চুল ধরে টানে। 

‘আমি আর এখান থেকে বাড়ি ফিরব না।’

‘ইস এ যেন আমার রাজ্য? যেমন খুশি তেমন চাইলেই হল আর কী?’ দেশাখ কপট ভেংচিতে বিশাখার পায়ের আঙ্গুল ধরে নাড়া দেয়। 

‘এটা যদি আমাদের বাড়ি হত?’ 

‘আবার মিছে ভাবনা!’ 

‘ভাবতে দোষ কী।’

‘কষ্ট বাড়ে। মিছেমিছি নিজেকে কষ্ট দেয়া হয়।’

‘আমরা কেন নিজেদের ইচ্ছেমতো থাকতে পারিনা। রাজার আইন কেবল আমাদের পিছু পিছু ছোটে।’ 

তখনই দেশাখের বুকে গোল ওঠে। ও বুঝতে পারে বহুলোক একসঙ্গে হইচই করছে সেখানে। ওর একটা স্বপ্ন আছে। সেজন্যে ও তৈরি হচ্ছে। প্রতিক, মিহির, খিন্তি, বিপিন, অরুণকে ধনুক ছোঁড়া শেখাচ্ছে। আস্তে আস্তে আরও বাড়বে, বাড়তে বাড়তে হাজার হবে। তখন ও ডাক দেবে, ভয়ানক একটা ডাক। সে হাঁকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সকলে ছুটবে ওর পিছু পিছু। সকলে জানবে লক্ষ্যটা কোথায়, লক্ষ্যটা কী। বিশাখা থাকবে ওর পাশে। বিশাখা চমৎকার শিখেছে। 

‘এই, কী ভাবছ?’ 

বিশাখা ওকে নাড়া দেয়। ও ভীষণ ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। খুশির সীমাপরিসীমা নেই। 

‘বিশাখা?’ 

দেশাখ গম্ভীর হয়ে ডাকে। 

‘কী বলো?’ 

‘ধরো এই বনটা আমাদের রাজ্য। গাছপালা, পশুপাখি সব প্রজা, তুমি আমার রানি।’

বিশাখা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। 

‘হাসছ যে?’ 

‘বা রে আমি রানিই তো। এটা আবার বলতে হবে নাকি?’ 

‘ওহ্ খুব বিশ্বাস। যদি না করি।’ 

‘তোমার মুণ্ডু কাটা যাবে।’ 

‘সত্যি পারবে?’ 

দেশাখ ওকে কাছে টানে। ‘আমার ওপর তোমার এমন জোর যেন সব সময় থাকে বিশাখা।’ বিশাখা কিছুটা আদুরে গলায় বলে, ‘কিন্তু রাজা রানি এসব আমার একটুও ভালো লাগে না। তুমি রাজা অন্য কাউকে বানিয়ে দিও। তুমি আমি যেমন আছি তেমন থাকব। বনে বনে ঘুরব আর পাখি ধরব। যেমন খুশি তেমন, কেউই শাসন করতে আসবে না। 

দেশাখ কথা বলে না, ঘাসের ডগা চিবুতে থাকে। 

‘কী পছন্দ হল না?’

‘বনে বনে ঘুরলেই চলবে না। প্রজাদের সুখশান্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বুঝলে রানি?’ 

‘রানি নয়, বলো রাজমহিষী।’ 

দেশাখ ঘাসের ডগা ছুঁড়ে ফেলে। সুর্যের খরখরে তেজ অর্জুন গাছের মাথায়, বনটা নিথর। এতদূরে পটহ মাদলের শব্দ নেই। স্বপ্ন দেখতে দেখতে এক বিশাল প্রান্তরে এসে যায়। বিশাখা আর কোথাও নেই। সে প্রান্তরে বুকের ওপর একশো একটা ঘোড়া দৌড়ে যায়। নড়ে উঠে আবার শান্ত হয় বিশাখা, মনে মনে প্রার্থনা করে অর্জুন গাছের ছায়াটা রাতের আঁধার হোক, ডালপালা চাঁচর বেড়ার ঘর, কিন্তু বেশি ভাবতে পারে না। দেশাখ ওকে দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে নেয়। সময়ের গতি ওরা রুখতে পারে না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। ওদের মনের ইচ্ছে দুপুরটা একটু থামলে পারত।

দুপুরের পর থেকেই ডোম্বি নৌকা নিয়ে বসে। বারুয়া মাঝি ওর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে মেয়ের বাড়ি গেছে। একবেলা নেচে এখন শান্ত ডোম্বির মন। ভালই লাগছে বিনে কড়িতে পার করতে। আজ আর কোনো পারাপার নয়। সবার যাত্রা একদিকে। ছোটোরা বেশি খুশি, লাফিয়ে লাফিয়ে নৌকায় ওঠে। 

‘মাসি আজ আর আমাদের মানা করতে পারবে না।’ 

ডোম্বি হাসে। অনেকদিন কাউকে নৌকায় ওঠায় না। কেউ এলে ভাগিয়ে দেয়। নইলে ওরা বড্ড জ্বালাতন করে। ডোম্বি লক্ষ করে সকলের চোখেমুখে চকচকে খুশি। সামান্য খেয়ে, না খেয়ে, আধ পেটা খেয়ে যাদের দিন কাটে তাদের জন্য এ উৎসব বিরাট আয়োজন। লোক পার করতে করতে শেষ বিকেল হয়ে যায়, তবু কানু আসে না। ডোম্বি কেমন অবসন্ন বোধ করে। তবে কি কানু যাবে না? পরক্ষণে খুশি হয়। হাত-পা ছড়িয়ে নৌকার ওপর বসে পড়ে। কানু নিশ্চয় যাবে না, না যাওয়াই ভালো। যাদের হাতে এত অপমান একদিনের ওই অন্ন কি সে ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারে? তখুনি বিশাখাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে ঘাটে আসে দেশাখ, ও নিজেও যাবে না। বুকটায় চড়চড় আওয়াজ হয়। রাই সরিষা আর দইয়ে রাঁধা ছাগ-মাংসের আকর্ষণ গতবার পর্যন্ত ছিল। এবার আর নেই। মনে করলেই শরীরে বমির ভাব হয়। ডোম্বিকে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকতে দেখে খুশি হয়। অন্তত কথা বলার লোক পাওয়া গেল। জানে ঘরে ফিরে কাউকে পাবে না। সবাই এতক্ষণে চলে গেছে। বিশাখাও যাবার জন্যে ছটফট করছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত দেশাখের যুক্তি মেনেছে। ও লাফিয়ে 

নৌকায় উঠে বসে, মৃদু ঢেউয়ে নৌকা এপাশ ওপাশ করে। ডোম্বি নিজেকে গুছিয়ে নেয়। 

‘কাছি খুলব?’ 

‘না।’ 

‘যাবে না?’ 

‘না।’ 

‘খাবে কী?’ 

‘নদীর জল।’ 

ডোম্বি খিলখিলিয়ে হাসে। 

‘বাবা কথা তো না যেন একদম খটখট শব্দ।’ 

‘শুনলে কি প্রাণ জুড়ায়?’ 

‘একদম না।’ 

‘তাহলে আর কী? তা ছাড়া তোমাকে খুশি করা কার সাধ্যি। এক কানুদা কেবল পারে।’ 

অন্ধকারে ডোম্বির মুখে আলো ছলকে যায়। 

‘কে বলল তোমাকে?’ 

‘বলবে আবার কে? চোখে দেখলে সব বুঝি। বলো সত্যি কি না?’ 

‘অত কথা জানি না।’

‘জানো সবই, বলবে না।’

‘আজ সারাদিন কোথায় ছিলে? দেখলাম না যে?’ 

‘আমার কথা কি তোমার মনে হয়?’ 

‘বা রে হবে না কেন?’ 

‘কী জানি বাপু, তোমার কি আর অন্য দিকে চোখ দেবার সময় আছে?’ 

ডোম্বি উত্তর দেয় না। দেশাখের কথাগুলো মনের মধ্যে নেড়েচেড়ে উপভোগ করে। দেশাখের কথাগুলো যদি সবদিক দিয়ে সত্য হত! যদি সামাজিক জীবনে শবরী না হয়ে মল্লারী হত কাহ্নুপাদের সঙ্গী! না বেশি কিছু ভাবতে ভালো লাগে না। কষ্ট বাড়ে, একটা বাজে কষ্ট। 

‘তুমি যাবে না কেন দেশাখ?’ 

‘তুমি তো যাওনি?’ 

‘তাই তো বলি অন্ধকারে কথা বলে কে? ঠিকই ভেবেছি যে তোমরা।’ 

‘কানুদা তুমি? তুমি যাওনি?’ 

কাহ্নুপাদ লাফিয়ে নৌকায় ওঠে। দেশাখ সরবে বলে, ‘তাহলে আমরা অনেকে যাইনি?’ 

‘অনেক নয় দেশাখ। গুটিকয়েক।’ 

‘সামনে সুখব্রতরাত্রি উৎসবে কেউ যাবে না কানুদা।’ 

‘না গেলে রাজার লোক ধরে নিয়ে যাবে। নইলে যে দুঃস্থ খাওয়ানোর পুণ্য পাবে না রাজা।’ 

কাহ্নুপাদ তীক্ষ্ণস্বরে হেসে ওঠে। কেউ আর কথা বলতে পারে না। দেশাখ জানে এটাই চরম কথা। না গেলে রাজার লোক বেঁধে নিয়ে যাবে। পুণ্য অর্জনের এমন মহান সুযোগ কিছুতেই ছাড়বে না। পাড়াটা আজ একদম সুনসান। কুকুরের ডাকও কোথাও নেই। ফিকে চাঁদের আলো চারদিকে। টুকরো টুকরো মেযের ইতস্তত ভ্রমণ। বাতাস নেই। কেমন দমধরা গুমোট ভাব। কাহ্নুপাদ চিতপাত শুয়ে পড়ে দেশাখের গা ঘেঁষে। 

‘ঘরে ভালো লাগছিল না তাই বেরিয়ে এলাম, ভাবিনি তোমাদের পাব।’ 

‘আমরা কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করিনি তবু আমরা এক জায়গায় এসে গেলাম কী করে কানুদা?’ 

‘লক্ষ্য যখন এক হয় তখন কেউ কাউকে ডাকে না রে দেশাখ। সবাই আপনা-আপনি এসে জড়ো হয়।’ 

‘হবে হয়তো।’ 

দেশাখ সাহসী কণ্ঠে বলে। নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে দেয়। গুনগুন করে গান গায় মল্লারী। তিনজনে কেউ আর কোনো কথা বলে না। অথচ একই ভাবনায় তিনজনের হৃদয় মুহূর্তে মুহূর্তে একে অপরের মধ্যে ঢুকে যায়। কখনো ডোম্বির হৃদয় কাহ্নুপাদের হয়, কখনো দেশাখের হৃদয় ডোম্বির। কখনো কাহ্নুপাদের হৃদয় দেশাখের। তিনজনের সচল আনাগোনায় তারা অনুধাবনের একই লক্ষ্যে ক্রমাগত ছুটতে থাকে। হঠাৎ করে ডোম্বি কোমর থেকে একটা ছুরি টেনে বের করে। 

দেশাখ চমকে তাকায়। 

‘ওটা কী?’ 

‘চেনো না?’ 

ডোম্বি জোরে হাসে। কাহ্নুপাদ লাফ দিয়ে উঠে বসে। ডোম্বির হাতটা মুচড়ে ধরে। 

‘এটা দিয়ে কী হবে?’ 

‘আমার বুকে একটা প্রতিশোধের আগুন জ্বলে।’ 

‘কী বলছ ডোম্বি?’ 

‘এত কথা জানতে চাও কেন দেশাখ?’ 

ডোম্বি আবার হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। নদীর বুকে ছপ ছপ শব্দ, একটা নৌকা চলে যাচ্ছে। কাহ্নুপাদ অন্ধকারেও যেন মল্লারীর দৃষ্টি দেখতে পায়। তীব্র সে দৃষ্টি আগুনের চাইতেও বেশি, আগুনের চাইতেও সর্বনাশী। কাহ্নুপাদ দেখল দেশাখের হাতে তিরধনুক, ডোম্বির হাতে ছুরি আর ওর হাতে কলম। পরিবেশটা কেমন সুন্দর ভাবে ঘণীভূত হচ্ছে। তারপর ফাটবে, ফেটে চৌচির হবে। আস্তে আস্তে ডোম্বির হাসি থেমে যায়। ওপরপারে লোক এসেছে, ওকে ডাকছে। দেশাখ আর কাহ্নুপাদ লাফ দিয়ে পাড়ে নামে। ডোম্বি কাছি খুলে নৌকা বায়। 

কাহ্নুপাদ এবং দেশাখ এলোমেলো হাঁটতে থাকে। দুজনে মগ্ন হয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে। হঠাৎ করেই শুনতে পায় বিলাপের ধ্বনি আসছে। 

‘কে দেশাখ?’ 

‘জানি না তো। চলো দেখি।’ 

দুজনে এগোয় এবং ভানুমতীদের বাড়িতে এসে থামে। ভানুমতির মা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। সুখব্রতরাত্রি উৎসব-সন্ধ্যায় মারা গেছে ভানুমতী। মেয়েটি ওর লম্বা লম্বা নখগুলো নিয়ে নিথর ঘুমিয়ে আছে। ওগুলো কেউই কাটতে পারেনি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *