অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৭

অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৭

ভাঙা বৌদ্ধ মন্দিরের চত্বরে সময় আর কাটতে চায় না বিশাখার। কাল সন্ধ্যায় দেশাখ ওকে এখানে আসতে বলেছিল। সেই কখন এসেছে ও। সব কাজ ফেলে রেখে মা-কে ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছে, ভাই-বোনেরাও কেউ টের পায়নি। 

অথচ দেশাখের পাত্তা নেই, যা রাগ হচ্ছে, ভাবছে চলে যাবে এখুনি। পরক্ষণে মন নরম হয়ে যায়। দেখা না করে যাওয়া ওর নিজের পক্ষেই সম্ভব নয়। দেশাখ ছাড়া আর কোনো আনন্দই নেই ওর জীবনে। চারদিকে শুধু অভাব, এক বেলা খেলে আরেক বেলা জোটে না। সারা বছরে একটা কাপড় কেনা হয় না। মনটা সবসময় বিষণ্ণ থাকে, শুধু দেশাখের সান্নিধ্য ওকে মাতিয়ে রাখে। মাঝে মাজেই বিশাখার মনে হয় বিষণ্ন হতে হতে ও যখন কুঁকড়ে যায় তখন দেশাখ আবার ওকে উজ্জীবিত করে। দেশাখই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে, নইলে ও হয়তো মরে যেত। ইদানীং বাবার অসুখ ওকে আরও হতাশ করে দেয়। 

আস্তে আস্তে কেমন ভয় করতে থাকে বিশাখার। কতকাল আগের বৌদ্ধ মন্দির কে জানে, এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। লোকজন ইচ্ছেমতো ইট-কাঠ খুলে নিয়ে কাজে লাগাচ্ছে। রাজা কোনো গরজ করে না। ব্রাহ্মণ মন্ত্রীর হাতে দেশের শাসন ছেড়ে দিয়ে নিজে বিলাসে মেতেছে। এসবের দিকে নজর দেবার সময় কই? এ ধরনের তিনটে মন্দির আছে, সব ভাঙা। পুবদিকের দেয়াল ঘেঁষে বিরাট বকুলগাছ গজিয়েছে। চত্বরের সিমেন্ট ফেটে গিয়ে ঘাসে ছেয়ে গেছে। বুনোফুলের গন্ধ ভুরভুর করছে। সামনের ভাঙা দেওয়ালটার পাশে চমৎকার একটা সাদা ফুলগাছ আছে। বেশ বড়ো গাছটা, ফুলের নাম জানে না ও, অথচ ওর খুব প্রিয়। দেশাখ ছোটো ছোটো গুচ্ছ ফুলের এক থোকা পেড়ে ওর খোঁপায় গুঁজে দেয়। ফুলের মৃদু গন্ধ বিশাখাকে দুঃখের কথা ভুলিয়ে দেয়। ও ম্রিয়মাণ হতে থাকে। সব কিছুর আকর্ষণ আস্তে আস্তে কেমন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আজ বোধহয় আর দেশাখ আসবে না। ফিরেই যেতে হবে। হঠাৎ করে বিশাখার চোখ ছলছল করে। ও হাঁটুর ওপর মুখ গোঁজে এবং ঘাসের মাথা ছিঁড়ে দূরে ছুঁড়ে মারে। বেশ খানিকটা দূরে গাছের মাথায় তিনটে চিল উড়ে উড়ে কর্কশ শব্দে ডাকে। বিশাখার চিবুক বেয়ে জল গড়ায়। 

তখন চত্বরের পেছনের ভাঙা দেয়াল টপকে দেশাখ ঢোকে। কাঁধের ওপর দু-জোড়া ঘুঘু, ফাঁদ পেতে ধরেছে। আসার পথে এক সজারুর পেছনে অনেকক্ষণ তাড়া করেছিল, কিন্তু মারতে পারেনি। সেজন্য আসতে দেরি হয়ে গেল। ও নিঃশব্দে বিশাখার পেছনে এসে দাঁড়ায়। আচমকা ঘুঘুর পাখা ঝাপটানির শব্দে ভয় পেয়ে পেছন ঘুরে দেশাখকে দেখেই জড়িয়ে ধরে। ঘুঘুর পায়ের আঁচড় লাগে ওর কপালে। পরমুহূর্তে নিজেকে সরিয়ে নেয় বিশাখা। ঘাড় থেকে ঘুঘু জোড়া নামাতে নামাতে দেশাখ বলে, ‘দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় বুঝি? একটুও তর সয় না? 

‘বুনো, জংলি।’ 

দেশাখ হো-হো করে হাসে। বিশাখা একটু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করে। 

‘ইস্, দেখি দেখি কপালে রক্ত বেরিয়েছে।’ 

‘না, দেখতে হবে না।’ 

বিশাখা দেয়ালের কাছে সরে যায়। 

‘রাগ করলে তোমাকে খুব সুন্দর দেখায় কিন্তু।’ 

‘থাক, আর তোষামোদ করতে হবে না।’ 

‘ঠিক আছে এই আমি গম্ভীর হলাম, একটি কথাও বলব না।’ 

দেশাখ পিঠের ওপর থেকে তিরধনুকের বোঝা নামায়। অন্যসময় হলে এ কাজ বিশাখা করত। আজ ও চত্বরের আর এক পাশে বসে আঙুল কামড়াচ্ছে এবং আড়চোখে দেশাখকে দেখছে। দেশাখ গভীর মনোযোগে ঘুঘু দেখে, যেন আগে কোনোদিন এ পাখিটি দেখেনি। ওর মুখে কোনো ভাবান্তর নেই, ধরে নিয়েছে যে এখানে বিশাখা নেই। ফলে ভালোবাসা নেই এবং চুমু খাওয়াও নেই। আরও রাগ হয় বিশাখার। এখানে আর কিছুতেই থাকবে না, চলে যাবে। ভাঙা দেয়ালটা টপকে পেরুতে যাবে তখন দেশাখ এসে হাত ধরে। 

‘ছাড়ো আমি চলে যাব।’ 

‘কিছুতেই না।’ 

‘তুমি একটা—’ 

‘কী বলো? থামলে কেন?’ 

‘তোমার সঙ্গে কথা বলব না।‘

‘বলবে, বলবে। একশো বার বলবে। ওই সাদা ফুল সাক্ষী।’ 

দেশাখের বুকের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বিশাখা ওর বুকের ধুকপুকানি শোনে। মুহূর্তে ওলটপালট হয়ে যায় সব অনুভূতি। দেশাখ ওর কড়ে আঙুল নিজের আঙুলে ঠেকিয়ে বলে, ‘ভাব?’ 

‘ভাব।’ 

‘দুজনে শব্দ করে হেসে ওঠে।’ 

‘এই বুকের খাঁচায় তুমি আমার ঘুঘু।’ 

‘না কক্ষনো না। আমি ঘুঘু হতে পারব না।’ 

‘তাহলে কী?’ 

‘তোমার তিরধনুক।’ 

‘ও বাবা একদম গোড়ায় হাত। ঠিক বলেছ তুমি। একদিকে আমার খাওয়া-পরা, অন্যদিকে প্ৰেম। দুটোই জরুরি। এমন সুন্দর কথা তুমি কী করে বললে বিশাখা? এখন তোমাকে কী উপহার দেই বলো তো?’ 

‘হুঁ চালাকি। সব বুঝি।’ 

‘কথা ওই একটাই। তোমাকে উপহার দিলে তা আমার ভাগেও আসে।’ 

দুজনে ঘাসের ওপর বসে পড়ে। দেশাখের মনে হয় ইদানীং বিশাখা বেশ একটু ভারী হয়েছে, চেহারায় লাবণ্য এসেছে, চোখে গভীর কালো স্নিগ্ধতা। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দৃষ্টি ছায়াচ্ছন্ন হয়ে আসে, ফিরে যেতে মন চায় না। বিশাখা ওই সাদা কেতু ফুলের মতো সুগন্ধীময় এবং পবিত্র, ও যেন সব মলিনতার ঊর্ধ্বে। দেশাখ ওর হাত নিজের মুঠিতে তুলে নেয়। পাতলা লম্বা আঙ্গুলগুলো চকচকে পাখির পালকের মতো পিচ্ছিল। আঙ্গুলগুলো মুখে পুরে মৃদু কামড় দেয় ও। বিশাখা চোখে চোখ রেখে হাসে। দেশাখের মনে হয় সাজে না কেন বিশাখা। সাজলে হয়তো ওকে অন্যরকম দেখাত। কানে কুণ্ডল, গলায় গুঞ্জারমালা, হাতে কেয়ূর ও শঙ্খবলয়, কটিদেশে মেখলা, পায়ে মল। কাঁচা হলুদে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে গাত্রবর্ণ, চন্দনের গন্ধ আসবে মৃদু। আহ্ একদম নতুন মেয়ে হয়ে যাবে বিশাখা। তখন দেশাখ চিনতে ভুল করত, সংকোচে কথা বলত না। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে থাকত ও। তখন বিশাখা নিজেই হেসে এগিয়ে আসত। গলা জড়িয়ে ধরে বলত, ‘আমি তোমার বিশাখা। আমায় চিনতে পারছ না?’ 

‘ও মা তুমি নিজে নিজে হাসছ কেন?’ 

দেশাখ জোরে হেসে বলে, ‘ভূতে পেয়েছে।’ 

‘যাহ্ সত্যি কথা বলো। কার কথা ভাবছ?’ 

‘বলব না।’ 

‘থাকগে বোলো না। আমিও শুনব না।‘

‘বাবা আচ্ছা শক্ত মেয়ে তো! আমি ভেবেছিলাম গাল ফুলাবে, কাঁদবে, আমি বসে বসে মান ভাঙাব। দিলে তো সব মাটি করে।’ 

দেশাখ টান টান হয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। কেতু গাছের ছায়া ওর সারা শরীরে। দুজনেই এই ফুলগাছটা ভালোবাসে। গন্ধ ওদের পাগল করে দেয়। বিশাখা দেশাখের চুলের গভীরে হাত ডোবায়। 

‘এই গাছটার ফুল সাদা কেন দেশাখ?’ 

‘খারাপ কী?’ 

‘লাল হলে ভালো হত।’ 

‘আমি অত ভাবি না, যা আছে তাই আমার ভালো লাগে। যারা গীত লেখে তারা এইসব নিয়ে মাথা ঘামায়। ধরো এই কেতু ফুল গাছটা যদি গাছ না হয়ে বায হত তাহলে কি আমরা এখানে আসতাম?’ 

বিশাখা সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কেবলই বলতে থাকে, ‘তুমি যাই বলো, ফুলগুলো লাল হলে আমার বেশি ভালো লাগত।’ 

‘ঠিক আছে বাপু, ঠিক আছে। পরজন্মে আমি লাল ফুল হয়ে তোমার জন্য এই গাছে ফুটব।’ 

‘তাহলে আমি কাকে ভালোবাসব?’ 

‘তাই তো? তুমি আর কারও হও এটা আমি চাই না। দরকার নেই ফুল হবার, জনম জনম তুমি আমার।’ 

দেশাখ বিশাখার ভালোবাসার পবিত্র ফুল হয়ে ওর সমস্ত শরীর ঢেকে দেয়। সে আবরণে বিশাখা এক অহংকারী মরালী, সরোবরে অনবরত ডানা ঝাপটায়, সে প্রকাশ অনাবিল আনন্দের বিহ্বলতা। কড়া রোদ কেতু ফুলের সমস্ত ডালপাতা ভেদ করে ওদের উত্তপ্ত করে দেয়। সময়ের কোনো হিসেব দু-জনের কেউই রাখে না। ওরা যখন একান্তে নিজেদের পায় তখন এমন করে ধরে রাখে সময়। ভুলে যায় অরণ্য, শিকার, ধানখেতে শামুক কুড়োনো। ভুলে যায় অভাব আর দারিদ্রের দাঁত খিঁচুনি। তখন ওদের আকাঙ্ক্ষা বনবন ছোটে, ছুটতে ছুটতে বন পেরোয়, নদী পেরোয়, পাহাড় পেরোয়। তখন বিশাখার কণ্ঠ বিজনে ঘুঘুর ডাকের মতো মাদকতায় ভরা। দেশাখ সে কণ্ঠস্বরের মায়াবী আকর্ষণে পথ ভোলে। তারপর জোড়া ঘুঘুর অস্থির পাখা ঝাপটানিতে দু-জনে ভাঙা বৌদ্ধ মন্দিরের চত্বরে ফিরে আসে। 

‘দেখছ পাখিগুলো কেমন রেগে গেছে?’ 

‘বন্দি বলে আমাদের সুখ সইছে না।’ 

‘পাখি মারতে তোমার খারাপ লাগে না?’ 

‘একটুও না।’ 

বিশাখা ওর হাত দুটো ঠেলে দিয়ে সরে বসে। চেঁচিয়ে বলে, ‘একটুও না? কেমন নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছ।’ 

‘নিষ্ঠুর কেন? ওকে না মারলে তো আমাকে মরতে হবে। ওকে মারি বলেই তো আমি বেঁচে আছি।’ বিশাখার মনটা হঠাৎ বিষণ্ন হয়ে যায়। দেশাখের কথাগুলো ওর ভালো লাগে না। এতটা ক্রূরভাবে না বললেও পারত। ওর চেহারায় অন্যকিছু আঁচ করে দেশাখ আবার বলে, ‘পাখি আমি ভালোবাসি বিশাখা। জানো অনেকদিন গেছে যখন চমৎকার কোনো পাখি আমি মারতে পারিনি। কথা বলছ না যে?’ দেশাখ ওকে কাছে টেনে নেয়। যেন ও এখুনি ওকে না জানিয়ে অন্য কোথাও উধাও হবে, খুঁজে পেতে দেশাখের কষ্টের শেষ থাকবে না। আর সে আশঙ্কায় ওর অনুভূতি শিউরে ওঠে। আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় ওকে। কেতু ফুলের মাথা থেকে রোদ অনেক সরে গেছে। পুরো চত্বরে আশ্চর্য স্নিগ্ধতা। 

‘তোমার বাবা কেমন আছে বিশাখা?’ 

‘বাবার অসুখ ভালো হচ্ছে না। বাবা বোধহয় বাঁচবে না।’ 

‘মিছে ভাবছ, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ 

‘মিছে নয়, সত্যি। মা রোজ কাঁদে। কবরেজের কাছে গেলে মুখটা যেন কেমন করে। মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে থাকতে ভয় করে।’ 

‘ভয় কেন? তোমার জন্য আমি তো আছি।’ 

‘তুমি কত দিক সামলাবে? আচ্ছা দেশাখ আমরা এত গরিব কেন?’ 

দেশাখ তিক্ত কণ্ঠে বলে, ‘আমরা গরিব বলেই তো রাজার গোলায় ধান। রাজদরবারে উৎসব। পথে জুড়িগাড়ির চটক।’ 

‘আমরা কি কোনোদিন ধনী হতে পারব না? হাত ছড়িয়ে খেয়ে-পরে আমোদ করতে পারব না?’ 

‘নিশ্চয় কোনোদিন পারব। তার জন্য চেষ্টা করতে হবে। তোমাকে আমি তিরধনুক চালাতে শেখাব বিশাখা।’ 

‘সত্যি? তাহলে বেশ হবে, আমিও তোমার সঙ্গে শিকারে যাব।’ বিশাখা উৎসাহে সোজা হয়ে বসে। ‘কবে থেকে আমাকে শেখাবে? এসো আজ থেকে।‘

ভাঙা বৌদ্ধ মন্দিরের চত্বর আজ অন্যরকম হয়ে যায়। ভালোবাসা শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, শক্তি গৌরবে। দেশাখ বিশাখার হাতে হাত রেখে স্বপ্ন দেখে বিরাট এক ধনুক-বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে ও।

শান্ত সন্ধ্যা, মন্দিরে আরতির ঘণ্টা বাজে। সুলেখা বারান্দায় বসে চুল আঁচড়ায়। ঘন চুলের রাশিতে চিরুনি ঢুকতে চায় না। গতকাল খড়িমাটি দিয়ে মাথা ধুয়েছিল, তাই চপচপে তেল দিয়ে চুল একদম ভিজিয়ে রাখে। আঁধার হয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই সুলেখার। যখন যে কাজে মন দেয় তখন অন্য সব কিছু ভুলে যেতে পারে ও। দেশাখ কুয়োতলায়, মনের আনন্দে গায়ে জল ঢালছ। একজোড়া ঘুঘু খাঁচায় পুরে রেখেছে ও। একটার চামড়া খুলে সুলেখাকে দিয়েছে রাতের রান্নার জন্য। রাতে রাঁধতে ইচ্ছা করে না ওর। কুপির আলোয় রান্নাঘরে কাজ করতে ভয় লাগে। সেজন্য ঝামেলা না থাকলে সব সময় বিকেলে রান্নাবান্না সেরে রাখে। যেহেতু দেশাখ বলেছে সেজন্য ঘুঘুটা এখনই রাঁধতে হবে। কাপড়ের পাড় ছেঁড়া সুতো দিয়ে টান টান করে চুলগুলো বাঁধে এবং খোঁপায় একটা কাঁঠালিচাপা গুঁজে দেয়। ফুলের গন্ধ নাকে নিয়ে ও রান্নাঘরে আসে। দেশাখ 

কুয়োতলা থেকে চিৎকার করে, ‘মুখ পোড়ানো ঝাল দিয়ে রেঁধো কিন্তু বউদি। তোমার ওই সাদা তরকারি হলে কিন্তু খাব না।’ 

সুলেখা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে জবাব দেয়, ‘শুধু মুখ পোড়াবে? বুক পোড়াবে না?’ 

‘পোড়াইনি আবার? সে কম্ম কবে শেষ করেছি।’ 

‘তাই নাকি? খবরটা দিও ভাই।’ 

রান্নাঘরের পেছনের আমগাছে বসে ভীষণ কর্কশ শব্দে কাক ডাকে একটা। সে শব্দে গা ছমছম করে ওর। ও ভয় কাটানোর জন্য আগুনের ওপর হাত রেখে গরম করে। দেশাখ ভিজে শরীরে ঘরে যায়। শোবার ঘর থেকে শ্বশুর সুলেখাকে ডাকে, ‘ও বউমা কাকটা তাড়াও না। অলুক্ষণে কাকটা এই ভর- সাঁঝে কেন যে চেঁচায়।’ 

‘আমার ভয় করছে বাবা। আমি পারব না।’

‘ভয় করছে? কীসের ভয়?’ 

‘কাকটা যেন কেমন করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।’ 

‘কী যে বলো—’ 

‘সত্যি বাবা, আমার ভীষণ ভয় করছে।’ 

বুড়ো আর কথা বলতে পারে না, প্রবল বেগে কাশে। দেশাখ বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। মনে মনে বলে, ‘বউদির যত আদিখ্যেতা। ঘরে থাকলে ভয় করে, লোক-দেখানো ভয়, কিন্তু বাইরে গেলে ভয় করে না, তখন অন্ধকারই বউদির ভয়ের বর্ম হয়।’ তবু সুলেখাকে সামনাসামনি কিছু বলতে পারে না। জিজ্ঞেস করে, ‘কীসে তোমার ভয় করছে বউদি?’ 

‘ওই কাকটা কেমন বিশ্রি দ্যাখো না দেশাখ। যেন হাঁ-করে আমাকে দেখছে।’ 

দেশাখ হো-হো করে হাসে। হুসহুস শব্দ করতেই কাকটা উড়ে চলে যায়। 

সুলেখা কথা না বলে রান্নাঘরে ঢোকে। 

‘ও কী বউদি চল যাচ্ছ যে? দেখলে না তোমার কাকটা কত বীর?’ 

‘নাহ্ তোমার সঙ্গে কথা বলা যাবে না।’

‘মা কোথায় বউদি?’ 

‘ছুটকিদের বাড়ি বেড়াতে গেছে।’ 

‘মা সারাদিন ঘুরতে পারে। কোথাও না গিয়ে দিন কাটে না তার।’ 

‘তা সারাদিন ঘরে বসে করবে কী?’ 

‘হ্যাঁ, তোমার মতো বউ যার, তার ঘরে না থাকলেও চলে। বাবা বোধহয় ঘুমোলেন আবার। তার তো আর কোনো কাজ নেই।’ 

‘ঘুমুবে না? কাশির জ্বালায় এমনিতেই ঘুম আসে না। এখন তো বাসক পাতার রসেও কাজ হচ্ছে না।’ 

‘আর কত কাজ হবে!’ 

‘তুমি সবার পেছনে লেগেছ কেন বলো তো?’ 

‘মোটেই লাগিনি। খোঁজখবর নিচ্ছি মাত্র।’ 

‘একদম উপযুক্ত ছেলে। শোনো, চাঙারিগুলো বানিয়ে রেখেছি। কালকে বিক্রি করতে নিয়ে যেও।’ 

‘আচ্ছা, এখন একটু ঘুরে আসি।’ 

‘কোথায় যাচ্ছ?’ 

‘ধনাদার দাবার আড্ডায়। কাল একবার ভানুমতীদের বাড়ি যাব। শুনেছ তো নাপিত ভানুমতির নখ কাটতে পারছে না।’

‘হ্যাঁ, শুনেছি। কী যে সব কাণ্ড!’ 

দেশাখ বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সুলেখার কেমন নিঃসঙ্গ লাগে। সারা বাড়িতে কেউ নেই, কেবল ঘরে রুগ্ন শ্বশুর। বাইরে সন্ধ্যা। মনের মধ্যে যন্ত্রণা। শুধু সুদাম একগুচ্ছ কার্পাস, ওর সঙ্গে থাকলে আনন্দের মুহূর্ত অন্ধকারে আকাশকুসুম হয়। আজ রাতে ওর সঙ্গে মিলন হবে। অভিসারে বেরুতে একটুও ভয় লাগে না, শুধু কাক দেখে ভয়। মনের মধ্যে যাবতীয় সংস্কার আনাগোনা করে। তাই সুদাম কেবল ক্ষণিকের আনন্দ, স্বস্তি নয়। যদি সুদাম ওর জীবনে চিরকালের হত? কাছে থাকত, পিঁড়ি পেতে খেতে বসত, আঁচল দিয়ে মুখ মুছত, যখন তখন আদর করত। কানে কানে কথা হত, কুয়োতলায় একসঙ্গে যেত, এখন কিছুই ভালো লাগে না সুলেখার। ভুসুকু ক্রমাগত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, স্মৃতি আর কতকাল থাকে? 

যাবার পর পর যেমন একটা তীব্র ব্যাকুলতা ছিল, এখন আর সেটা নেই। এখন অবসরে মনে পড়ে, বুক ভার হয়, আবার তা কেটে যায়। সুলেখা একচক্কর উঠোনে হাঁটে, অবশেষে দেশাখের ঘুঘু নিয়ে রাঁধতে বসে। লোকী আর গুণী এসে ঢোকে। ওরা দুজনে শামুক কুড়োতে গিয়েছিল দেবল ভদ্রের ধানিজমিতে। ওই জমি পাহারা দেয় নিখিল। জোয়ান ছেলে, কালো কুচকুচে গায়ের রং, যখন তখন ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসে। ধানখেতের আশেপাশে ছেলেমেয়েদের দেখলে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসে। ওরা দূরে দাঁড়িয়ে ভেংচি কাটলে ও রেগে যায়। লোকী আর গুনী দুজনে আজ ভারি খুশি। মনের সুখে শামুক কুড়িয়েছে। নিখিল ওদের তো কিছু বলেইনি উপরন্তু নিজেও ওদের আঁচল ভরে দিয়েছে। দু-জনেই শামুকগুলো ঢেলে দেয় রান্নাঘরের মেঝেতে। 

‘ইস্, অনেক পেয়েছিস তো?’ 

সুলেখার চোখ চকচক করে ওঠে। ভালো খাবার দেখলে দারুণ লোভ হয়। বহুদিন ওরা একসঙ্গে এত শামুক আনেনি। 

‘আজ ভীষণ মজা হয়েছে বউদি।’ 

ওরা দুজন হেসে গড়িয়ে পড়ে। হাসি আর থামতে চায় না। ওদের সর্ব অঙ্গে খুশির ঝিলিক। সুলেখা ওদের ধমকে ওঠে, ‘ও মা কী হল? ভূতে পেল নাকি? হাসি থামা বলছি।’ 

‘জানো বউদি নিখিল আজ আমাদের তাড়া করেনি। উঃ যা ভালো ভালো কথা বলছিল। নিখিল যে এত ভালো বুঝতেই পারিনি।’ 

সুলেখে ভুরু কুঁচকে তাকায়, ‘কী কথা বলছিল রে? নিখিলের তো ভালো কথা বলার কথা নয়। 

‘কী জানি কেমন কেমন যেন কথা। আর কেউ কোনোদিন এমন কথা বলেনি বউদি। শুনতে ভীষণ মজা লাগছিল।’ 

‘তাই নাকি? বড়ো ডেপো হয়েছিস তো তোরা। 

‘আমরা কিছু বলিনি। সব নিখিল বলছিল।’ 

‘দাঁড়া দেশাখ এলে বলব।’ 

‘কী বলবে? দোহাই বউদি দাদাকে কিছু বোলো না। আমরা নিখিলের সঙ্গে মোটেই কথা বলতে চাইনি। ও নিজেই যেচে কথা বলেছে। আমাদের কোনো দোষ নেই বউদি।’ 

লোকী গুণীর মুখ ভয়ে পাংশু হয়ে যায়। 

‘ঠিক তো?’ 

সুলেখা গম্ভীর হবার চেষ্টা করে। 

‘এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি।’ 

দুজনে একসঙ্গে সুলেখার গায়ে হাত দেয়। 

‘ঠিক আছে, যা হাত-মুখ ধো গিয়ে। 

দুজনে পালিয়ে বাঁচে। সুলেখা হেসে ফেলে। যত গম্ভীর হয়ে কথা বলুক আসলে ওর হাসি পাচ্ছিল। গিয়েছে সেই ভরদুপুরে, ফিরল সাঁঝে, নিশ্চয় কোথাও কিছু একটা করছিল। ও ওদের বয়স হিসেব করল মনে মনে। একজনের চোদ্দো আরেকজনের তেরো, দেখায় আরও কম। রোগা শরীরে বাড়বাড়ন্ত তেজ নেই। তবে চেহারা ফুলের মতো, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। কে জানে কার ভাগ্যে ওরা গিয়ে জুটবে, তবে ওর মতো ভাগ্য যেন ওদের না হয়। ও এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে শামুক গোছাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। ক-দিন ভালোই চলবে। কাল সকালে নদীর ধারে গিয়ে দু-একটা মাছ বা কাঁকড়া পেলে মন্দ হবে না। কাগনি ধানের ভাতের সঙ্গে দারুণ লাগে। 

এদিকে কুয়োতলায় দু-বোনে ফিসফিস করে। 

‘নিখিল খুব মজার লোক না রে?’ 

‘খুব।’ গুণী চটপট জবাব দেয়। ‘যা হাসাচ্ছিল আমদের, হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেছে। মা গো ভাবলে কেমন জানি লাগে।’ 

‘এই গুণী, নিখিল কিন্তু তোকে বেশি কাতুকুতু দিচ্ছিল।’ 

গুণী সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে, ‘যাহ্ আমাকে না তোকে। তুই যে বড়ো।’ 

‘মোটেই না।’ 

‘ঠিক আছে সমান সমান।’ 

‘নিখিল আজ আমাদের সঙ্গে অমন ব্যবহার করল কেন রে?’ 

‘কী জানি। 

‘আমাদেরকে বোধহয় ভালো লেগেছে।’ 

‘হবে হয়তো।’ 

‘লোকী, আমরা আবার নিখিলের কাছে যাব।’ 

‘হ্যাঁ যাব। শামুক না দিলেও যাব। শোন গুণী, এরপর গেলে বউদির কাছে বলব না কিন্তু, বউদি আবার দাদাকে বলে দেবে।’ 

‘ঠিক, এবার থেকে আমরা লুকিয়ে যাব।’ 

‘তুই কিন্তু বড্ড হাসিস গুণী। এত হাসি ভালো না।‘

‘আমি তোর মতো গম্ভীর হয়ে থাকতে পারি না।’ 

‘কখনো থাকতে হয়। নইলে লোক পেয়ে বসে।’ 

‘নিখিল তোকে বেশি আদর করছিল লোকী।’ 

‘যাহ্ কী যে বলিস।’ 

দুজনে কুয়োর ঠান্ডা পানিতে ঝপঝপ হাত-মুখ ধোয়। দু-জনের মধ্যে একটা নতুন বোধ, সুখ সুখ ইচ্ছে। এর আগে কেউ কোনোদিন কাউকে ছেড়ে কোথাও যায়নি, সবসময় একসঙ্গে ঘোরে। আজ লোকী ভাবল, ‘গুণীকে ফাঁকি দিয়ে একদিন একলা একলা নিখিলের কাছে যাব।’ গুণী ভাবল, ‘লোকীটার একদিন খুব অসুখ করুক, একা একা নিখিলের কাছে যাব।’ 

ভানুমতীর বাড়িতে পড়ার লোক জড়ো হয়ে গেছে। ভিন-গাঁ থেকে এসেছে অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। একদিকে মেয়েকে নিয়ে এই যন্ত্রনা, অন্যদিকে এত অতিথিদের খাওয়াবে কী? মনে মনে ভগবানের কাছে মরণ চায় ভানুমতির মা হরিদাসী। গত দু-দিন ধরে ভানুমতী অসুস্থ, যতবারই নাপিত ওর হাত এবং পায়ের নখ কাটতে যায় ততবারই ও প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে মাটিতে গড়াগড়ি যায়। জন্মের পর থেকে কেউ ওর হাত-পায়ের নখ কাটতে পারেনি। এখন ওর বয়স আট, নখ বেড়ে এত বড়ো হয়েছে যে, চলাফেরা করাই মুশকিল হয়ে গেছে। শরীরেও ব্যথাবেদনা লেগে থাকে। ভানুমতির জন্মের আগে ওর মা-র তিনটি সন্তান জন্মের পর পরই মারা যায়। চতুর্থবার হরিদাসীর প্রসববেদনা ওঠার আগেই ওর শাশুড়ি অনেক কষ্টে কুকুরের দুধ জোগাড় করে রাখে। একজন কবরেজ তাকে বলেছিল নবজাতকের মুখে একফোঁটা কুকুরের দুধ দিলে শিশু মরবে না। ঠাকুরমার দেয়া কুকুরের দুধ খাবার পর থেকেই ভানুমতীর নখগুলো কালো হয়ে যায় এবং অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। ওঝা-বৈদ্যি কম দেখানো হয়নি, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। 

শেষে হরিদাসী ঠিক করে যে যত কষ্টই হোক মেয়ের, নাপিত দিয়ে নখগুলো কেটে ফেলা হবে। কিন্তু ওর চিৎকারে সবার চোখ ভিজে ওঠে। নাপিত হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে। কী করবে কেউ কিছু বুঝতে পারে না। 

মাধব বলে, ‘ওর হাতটা একটা কাঠের ওপর রেখে কুড়োল দিয়ে এক কোপে নখগুলো কেটে ফেলা হোক।’ সুরেশ মাথা নাড়ে, ‘না এটা ঠিক হবে না। তার চেয়ে ও ঘুমিয়ে থাকলে—’ 

‘সে চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু ধরলেই ও চিৎকার করে জেগে যায়। 

ঠিক সেসময় ভানুমতী উঠে দাঁড়ায় এবং হিংস্র চোখে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে দৃষ্টি দেখে উপস্থিত লোকেরা ভয় পায়। হরিদাসী এসে মেয়ের সামনে দাঁড়ায়, ‘চল ঘরে যাবি? খিদে পেয়েছে?’ মায়ের কথা শুনে ওর চোখ থেকে টপটপিয়ে জল পড়ে। তা দেখে কুসুম চেঁচিয়ে বলে, ‘দরকার নেই নখ কাটার। ও যেমন আছে তেমনই থাকুক।’ উপস্থিত সবাই সে-কথা মানতে পারে না। তাদের ধারণা এমন অশুভ নখ নিয়ে ওকে আর থাকতে দেয়া উচিত নয়, গাঁয়ের অমঙ্গল হতে পারে। আশঙ্কায় বুক কাঁপে হরিদাসীর। মেয়ের বাবা সেই যে রোজগারের আশায় বেরিয়ে গেল, আর ফিরল না, তাও তো বছর তিনেক হয়েছে। সামনের বৈশাখে চার বছর হবে। হরিদাসীর দিন আর কাটতে চায় না। ভানুমতী পা ঝুলিয়ে বারান্দায় বসে থাকে। নাপিত বলে, ‘আমি আজ চলে যাই।’ 

‘তাই যাও বাবা। কাল আবার এসো। দেখি যদি কিছু করা যায়।’ 

একে একে চলে যায় অন্যরাও। হরিদাসী অতিথিদের রান্নার জন্য চাল চাইতে যায় পাশের ঘরে। ওর বড়ো বোন এককাঁদি কাঁচা কলা এনেছিল, তার কিছু আছে। কাঁচা কলার ভর্তা আর নটে শাক ভেজে ভাত দেবে অতিথিদের। 

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে ভৈরবী, ঘরে একমুঠো চাল নেই। বিকেলে দুধ বেচতে গেছে ধনশ্ৰী, এখনও ফেরেনি। এদিকে বাড়ি অতিথি এসেছে, কী যে করবে কিছুই বুঝতে পারছেন না ভৈরবী। নিজের শরীরটা ভালো নেই, পেটের ভেতর বাচ্চাটা অনবরত নড়ে, বেশি নড়লে ভৈরবী কেমন অসুস্থ বোধ করে, তখন কেবল শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। বড়ো ছেলে পলাকে পাঠিয়েছে ধনশ্রীর খোঁজে। ও এখনও ফেরেনি। ঘরে সজারুর মাংস আছে। ধনশ্রী খুব শখ করে ভৈরবীর জন্য এনেছে, ও খায়নি। পেটে বাচ্চা নিয়ে সজারুর মাংস খেলে বাচ্চা সজারুর মতো ভিতু হয়। বড়ো হলে সাহসী হয় না, শিকার করতে পারে না, যুদ্ধে যেতে চায় না। ভৈরবী মনে মনে ভাবল, এমন ছেলে জন্ম দেয়ার চাইতে না দেয়াই ভালো। ছোটো ছেলে লালা ঘরের মেঝেয় শুয়ে ঘুমুচ্ছে, বুকের হাড় ক-খানা স্পষ্ট দেখা যায় শুধু, নিশ্বাসে তা উঠছে আর নামছে। ভৈরবীর ইচ্ছা করে ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে, তখনই পলা আসে। 

‘মা, বাবা না দাবার আসরে বসেছে।’ 

‘দাবার আসর? দুধ কী হল?’ 

‘দুধ অমনি পড়ে আছে। বাবাকে কত ডাকলাম, উলটো আমাকে বকা দিল।’ 

‘বললি না তোর সনকা কাকু এসেছে।’ 

‘বললাম তো, বাবা কিছু বলল না। কেবলই দাবার চাল গুনছে।’ 

‘যা তুই খেল গে।’ 

এই এক অভ্যেস ধনশ্রীর, দাবার আসরে বসলে বিশ্বসংসার ভুলে যায়। বিভূতির বাড়ির সামনে বিরাট আম গাছের নীচে মাচার ওপর রোজ দাবা খেলা বসে, বুড়োরাই বেশি খেলে। কারও কোনো কাজ নেই, কেউ কিছু করতে পারে না, শুধু দাবার চাল গুনে গুনে ক-টা দিন পার করতে চায়। অথচ ওরা যখন খেলে বিশ্বসংসার ভুলে যায়। তখন মনে হয় না কেবলমাত্র ক-টা দিন পার করে দেয়ার জন্যই ওরা একটা অবলম্বন খুঁজে নিয়েছে। একবার চক্রধী আর সাধন পাক্কা ছয়দিন এক জায়গায় বসেছিল। কেউ কাউকে মাত করতে পারে না, ফলে ওঠেও না, শেষে পাড়ার লোক এসে খেলা ভেঙে দিয়ে দুজনকে উঠিয়ে দেয়। ধনশ্রী অবশ্য বেশিক্ষণ খেলে না, কিন্তু বসলে আর কোনোদিকে ফিরে তাকায় না। ভৈরবী প্রথম প্রথম রাগ করত, এখন আর রাগে না, রেগে কোনো লাভ হয় না। ধনশ্রী প্রতিদিন যেমন তেমনই। সংসারে খুব আসক্তি নেই, আবার অনাসক্তিও নেই, যেনতেন চললেই ধনশ্ৰী খুশি। 

‘পলা, যা দুধের ভাঁড়টা নিয়ে আয়।’ 

‘এনে কী হবে?’ 

‘দেখি আমি কী করতে পারি।’ 

পলা কথা না বলে আবার বেরিয়ে যায়। ভীষণ চঞ্চল ছেলে, কখনো হাঁটে না, দৌড়ুতে থাকে। ভৈরবী জানালার কাছে এসে বসে। পলা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে। ওর ছোটো শরীর আরেকটা টিলার আড়ালে চলে যায়। দূরের বাড়িগুলো ছবির মতো, বিকেল প্রায় শেষ, একটু পর সন্ধ্যা হবে। মাত করতে না পারলে কিংবা না হারলে মিটমিটে আলোয় খেলেই যাবে ধনশ্রী। বউ ছেলে অতিথি কারও কথা মনে করেই উঠবে না। কেউ হাত ধরে টেনে উঠিয়ে দিলে উঠবে, দেখবে তখন মধ্যরাত, সব পাখির ডাক থেমে গেছে। ভৈরবীর বুক কেমন করে, কোথাও যেতে ইচ্ছা করে, কোথায় নিজেও জানে না। কখনো মনে হয় ওই দূরের বনে, কখনো ডোম্বির নৌকায় চড়ে নতুন কোনো জায়গায়। পেটের ভেতরে আবার নড়াচড়া, ভৈরবী চমকে ওঠে, যেন ছিড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়, বেরিয়ে আসার জন্যে ছটফট করছে। নিজেকে সামলে নেয়, মুখে একদলা থুতু উঠে আসে, এবার যেন একটু বেশি খারাপ লাগছে। আগে এমন হয়নি। ভৈরবী জোরে জোরে শ্বাস নেয়, বাতাসে মহুয়ার গন্ধ টের পায়। মনে হয় এখন ধনশ্রী পাশে থাকলে সময় এমন বিষণ্ণ থাকত না, হয়তো অন্যরকম হত। ও গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে। 

‘মা, নাও। বাবা টেরই পায়নি যে আমি এটা নিয়ে এলাম।’ 

‘খেলতে বসলে কি তোর বাবার হুঁশ থাকে?’

‘আচ্ছা মা, বাবা কেমন করে সব কথা ভুলে যায়? তুমি তো কিছু ভোলো না।‘

ভৈরবী কিছু না বলে হাসে। 

‘বড়ো হলে আমিও বাবার মতো হব। ভুলে যাওয়া বড্ড মজা।’ 

‘কে বলেছে?’ 

‘কেউ বলেনি। আমি জানি।’ 

‘পাগল।’ ভৈরবী ছেলের মাথায় হাত বুলোয়। ‘তুই ঘরে থাক পলা, লালাকে দেখবি, আমি এক্ষুনি আসব।’ 

‘আমার ভয় করে মা।’ 

‘কিছু ভয় নেই সোনা। আমি যাব আর আসব।’ 

ভৈরবী দুধের ভাঁড় নিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রসবের সময় বেশি নেই, ভার শরীর নিয়ে তাড়াতাড়ি 

হাঁটতে পারে না। পা শিথিল হয়ে যায়, চলতে চায় না। কোনোমতে কামোদের দোকানে আসে, দোকানে ক্রেতা নেই। কামোদ নিজের মনে হিসেব কষে। 

‘কামোদদা?’ 

‘বুঝেছি। অতিথি এসেছে তো?’ 

‘না বললেই সব বোঝো। এমন বোঝো বলেই তো বেঁচে আছি।’ 

কামোদ চোখ বড়ো করে বলে, ‘সত্যি কি আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি ভৈরবী?’ 

ভৈরবী অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে বলে, ‘এই দুধটা রেখে কিছু চাল দাও।’ 

‘দুধ কে খাবে?’ 

‘তুমি?’ 

‘আমি কেন দুধ খাব? আমার কি অসুখ করেছে?’ 

‘এত কথা ভালো লাগে না কামোদদা। ঘরে ছেলেরা একলা, তাড়াতাড়ি দাও।’ 

‘যদি না দেই?’ 

‘ইস কী শুরু করলে। আমি জানি তুমি রোজ দুধ খাও। ঘরে দুধ না থাকলে তুমি বউদির সঙ্গে রাগারাগি করো।’ 

‘আজ থেকে আর খাব না।’ 

‘তোমার পায়ে পড়ি কামোদদা। একটু পরে অতিথিরা ঘরে ফিরবে। রান্না না হলে কী লজ্জা পাব।’ 

‘এমন করে সংসার করতে তোমার রাগ হয় না ভৈরবী?’ 

কামোদের গম্ভীর কণ্ঠ ভৈরবীর কানে খট করে বাজে। কথা না বলে চুপ করে থাকে। কামোদও আর কথা বাড়ায় না। ছোটো একটা হাঁড়ি এগিয়ে দেয়, ‘এর মধ্যে ঢেলে দাও।’ 

ভৈরবী দুধ ঢেলে দেয়, হাত কাঁপে, ছিটকে পড়ে দুধ। 

‘তোমার শরীর দুর্বল হয়ে গেছে।’ 

‘কী করব বলো।’ 

ভৈরবী মাথা নীচু করে রাখে। কক-কক শব্দে একটা পাখি উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। কামোদ চাল মেপে দিলে ও আর একটি কথাও বলে না, পোঁটলাটা বুকের কাছে ধরে ফিরে যায়। দিনেরবেলা হলে নদীর ধার থেকে হেলেঞ্চা নিয়ে আসত, এখন সে উপায় নেই। সজারুর মাংসের সঙ্গে অনেক কাঁচামরিচ দিয়ে শাক ভেজে দিতে পারত অতিথিকে। এই দিতে না পারার জন্য ওর মনখারাপ হয়ে যায়। ধনশ্ৰী শাকপাতাই বেশি পছন্দ করে, মাংস খুব একটা খেতে চায় না। আয়োজনের সামর্থ নেই, তবু ভৈরবীর কত কী রাঁধতে সাধ হয়। রান্নার মতো সুখ আর কিছুতে নেই, ভাবতে ভাবতে ঘরে এসে পৌঁছোয় ও।

ভৈরবী চলে যাবার পর কামোদের হিসেবে ভুল হয়, কিছুতেই আর মন বসে না। ছোটোবেলায় 

ভৈরবীর সঙ্গে খুব ভাব ছিল। ওরা দুজনে অনেক ঘুরেছে টিলা থেকে টিলায়, বনেজঙ্গলে রান্নাবাড়ি খেলেছে, ফুল কুড়িয়েছে। সেসব কথা এখন মনে রাখেনি ভৈরবী, নয় বছর বয়সে ওর বিয়ে হয়ে যায়। ভৈরবীর বিয়ের দিন লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিল ও, খুব কষ্ট হচ্ছিল। কাউকে কিছু বলতে পারেনি। ভৈরবী বড়ো ভালো, ওর বউ হলে বেশ হত, দু-জনে হাসিখুশিতে সংসার করত। তপতী ওকে বড্ড জ্বালাতন করে, সংসারে অভাব তপতির সহ্য হয় না। অকারণে কামোদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, যা-তা বলে চিৎকার করে গালাগালি করে, মুখে কোনো কথা আটকায় না। তপতী কেন ভৈরবী হয় না? ভৈরবীর মতো শান্ত সুবোধ ধৈর্যশীলা। স্বামীর ভালোবাসায় যার অগাধ বিশ্বাস। সব আচরণে অকুণ্ঠ সমর্থন। কামোদের মাথা ঝিমঝিম করে। দোকানের কেনা-বেচা ভালো লাগে না। ও ও ঝাঁপ আটকিয়ে ভেতরে চলে যায়। 

অতিথি খাইয়ে, ছেলেদের ঘুম পাড়িয়ে রাত জেগে বসে থাকে ভৈরবী। ধনশ্রীর ফেরার নাম নেই। রাত কত হল কে জানে, চারদিকে সাড়া নেই। কিছুক্ষণ আগেও হঠাৎ হঠাৎ মানুষের গলা পাওয়া গেছে, এখন সেটাও বন্ধ। চাঁচর বেড়ার গায়ের ওপর চাঁদের আলোর লুটোপুটি, আকাশে মেঘ নেই একটুও। দোরগোড়ায় বসে থাকে ও, ঘুম আসে না। শরীর যতই খারাপ লাগুক ধনশ্ৰী না এলে কিছুতেই ঘুম আসবে না। এটা একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। ধনশ্রীর সঙ্গে ওর বয়সের ব্যবধান ষোলো বছরের মতো, কিন্তু কোনো বিরোধ নেই। ধনশ্রী অসম্ভব ভালো। ভৈরবীও নিজে থেকেই সুখ সৃষ্টি করে নিয়েছে। তবু মাঝে মাঝে কেমন নিঃসঙ্গ লাগে, কামোদের কথা মনে হয়। ছোটোবেলায় ওকে ছাড়া কামোদের চলত না। সব খেলার সাথিদের বাদ দিয়ে ওর সঙ্গে খেলতে চাইত সারাক্ষণ। ওর সঙ্গে কত উজ্জ্বল মুহূর্ত কাটিয়েছে। সেইসব স্মৃতিকে ভৈরবী এখন ভয় পায়। কখনোই ট্রাঙ্কে গাদানো কাপড়ের মতো ভাদ্রের রোদে মেলে ধরে না। সংগোপনে জমিয়ে রেখেছে। ধনশ্রী ওকে ভীষণ ভালোবাসে, বিশ্বাস করে, ওকে ছাড়া চলতে পারে না এক মুহূর্তও। কোনোদিন অবহেলা করেনি, অকারণে রাগারাগি করেনি, সেইজন্যে ধনশ্রীর গণ্ডির বাইরে যেতে পারে না ভৈরবী। মনটা এদিক ওদিক করলেও আবার লক্ষ্মী ছেলের মতো ফিরে আসে আপন জায়গায়। ধনশ্রীর যা একটাই দোষ, দাবা খেলতে বসলে সব কথা ভুলে যায়, তার জন্যে রাগ নেই ভৈরবীর। যা কিছু প্রতিকূল তাকে মেনে নেয়াই ওর স্বভাব। বিরোধ এড়ানোই ওর কাম্য। শ্মশান থেকে শেয়ালের ডাক আসছে, কোনো করুণ কান্নার বিলাপধ্বনি একটানা আসতেই থাকে। বুকটা কেমন করে ভৈরবীর। কামোদের কথা মনে হয়। সংসারে কামোদের কোনো সুখ নেই, তপতী যন্ত্রনা দেয়। দূর ছাই, কামোদের জন্য কী দায় পড়েছে। যত্তসব বাজে ভাবনা। ওর ছেলে আছে, স্বামী আছে, সংসার আছে। চাঁচর বেড়ার বাড়ি আছে। বাড়ির সামনে লাউয়ের ঝাপ আছে, কচি লাউয়ের ডগায় সাদা ফুল—বিশাল প্রশান্তি। আর কিছু চায় না ভৈরবী। আর তখুনি ধনশ্রীর উঁচুকণ্ঠের গান শুনতে পায় ও। রাতে একলা পথ চলতে হলে এমনি করে গান গাইতে গাইতে আসে ধনশ্ৰী। নইলে নাকি গা ছমছম করে। গান ওকে সঙ্গে দেয়, নিজেকে একলা মনে হয় না। 

দোরগোড়ায় ভৈরবী দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায় ধনশ্রী। ধপ করে ওর পাশে বসে পড়ে। 

‘এখনও জেগে আছ বউ? খাওনি তো?’ 

ভৈরবী মাথা নাড়ে। ধনশ্রী মাথাটা ওর ঘাড়ে ঘঁষে নেয়। 

‘খেলতে বসলে সব ভুলে যাই বউ। রাগ করেছ?’ 

‘না।’ 

‘সত্যি?’ 

ধনশ্রী ভৈরবীকে বুকে জড়িয়ে চুমু খায়। 

‘লক্ষ্মী বউ, সোনা বউ। আজ শরীরটা কেমন?’ 

‘ভালো। জানো মনে হয় সময় আর বেশি নেই।’ 

‘এবার একটা মেয়ে হলে ভালোই হয়।’ 

ধনশ্রী গদগদ স্বরে কথা বলে। আবেগে গলা জড়িয়ে আসে। 

‘খাবে না? চলো? ঘুম পেয়েছে।’ 

দুজনে উঠে ঘরে আসে। হরিণের চামড়ার আসনটা ধনশ্ৰী বিছিয়ে নেয়। কলসি থেকে জল ঢালে। ভৈরবী ঠান্ডা ভাত বাড়ে মাটির বাসনে, সজারুর মাংস তুলে দেয় ধনশ্রীর পাতে। হাঁড়িয়া এনে সামনে রাখে। ধনশ্রীর খাওয়া হলে সেই বাসনে নিজের ভাত মাখিয়ে নেয়। ঢকঢক করে হাঁড়িয়া খেয়ে ভৈরবীকে বুকে জড়িয়ে ঘুমোয় ধনশ্রী, কিন্তু ঘুম আসে না ভৈরবীর। ধনশ্রীর বুকের উত্তাপও ঠান্ডা হয়ে যায়। অন্ধকারে চোখ মেলে কান পেতে থাকে। যদি কোনো সুকণ্ঠী পাখির ডাক শোনা যায়। সেই শৈশবের স্মৃতির মতো। হঠাৎ মনে হয় তপতী কেন ভালো মেয়ে হয় না। না, জীবনকে জটিল করে তোলার কোনো ইচ্ছে ওর নেই। বিশেষ করে ধনশ্রীর মতো সহজ সরল লোকের সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছে। ভৈরবী ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। না, ওর কোনো দ্বিতীয় ভুবন নেই। ভৈরবী এক এবং অভিন্ন থাকতে চায়। 

শিল্পিত প্রসাধন নিয়ে রাতের এক প্রহর পার করে দেয় শবরী। কাহ্নুপাদ আসে না, অপেক্ষায় অপেক্ষায় শিথিল গুঞ্জার মালা, ময়ূর-পালক। একসময় সব কিছু টান দিয়ে কুটিকুটি করে ফেলে ও। লক্ষ্মীবিলাস শাড়ি মেঝেতে গড়ায়, কত যত্ন করে পরেছিল। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চন্দনের ফোঁটায় নিজেকে সাজিয়েছিল। পায়ের পাতা থেকে শুরু করে মেজাজটা রাগতে রাগতে ক্রমাগত ওপরের দিকে ওঠে। ইচ্ছে করেই পায়ে আজ নূপুর পরেনি শবরী। মনে করেছিল কাহ্নপাদের কাছে আজকের অভিসার হবে শব্দহীন। শব্দের একটা চমক আছে, মনের মধ্যে ময়ূর-নৃত্যের আমেজ আনে। শব্দহীন হলে কেমন লাগে সেটাই আজ অনুভব করতে চেয়েছিল ও। সারা দিনের আয়োজন যেন ব্যঙ্গ করছে শবরীকে। রাত্রি দু-প্রহরও শেষ হয়, তবু আসে না কাহ্নুপাদ। শবরীর বিবাহিত জীবনে এমন আর কোনোদিন হয়নি। সারা দিন যেখানেই থাকুক না কেন সন্ধ্যার সময় ঠিক ঠিক ঘরে ফেরে। কেবল রাজসভায় গীত পড়ার দিন ফেরেনি। বলেছিল, সারারাত মাঠে শুয়েছিল। মরে যেতে ইচ্ছে করছিল দেখে ঘরে ফেরেনি। সেটাই বিশ্বাস করেছিল শবরী কিন্তু আজ কী হল? আজ কেন ঘরে ফিরল না কানু? চাঁচর বেড়ার আগল বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। ধাতুর খাটে একা। লক্ষ্মীবিলাস শাড়ি শবরীর যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়। বাইরে প্রবল হাওয়া এদিক ওদিক ছোটে। চাঁচর বেড়ার সঙ্গে তার শর্তহীন ইয়ার্কি। 

শেষ রাতের কিছু আগে ঘরে ফিরে আসে কাহ্নুপাদ। 

শবরী আজ প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে নেই। টিলার গায়ে হাঁড়িয়ার গন্ধ নেই। কিছুতেই আগল খোলে না শবরী। এমনটি হবে জানা ছিল কাহ্নুপাদের, এখন সাধ্যসাধনা করে শবরীর মান ভাঙাতে হবে। দেবকির ঘরে আজ অনেক মদ খেয়েছে কাহ্নুপাদ। নেশায় বুঁদ হয়েছিল, ভাগ্য আজ ওর অনুকূলে কাজ করেছে। রামক্রী ছিল না বলে দেবকী যত্ন করেছে অনেক। রামক্রী পাঁচ ক্রোশ দূরে মামার বাড়িতে গিয়েছে। দরজার ওপর সাংকেতিক চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল দেবকী। ঘরে কাহ্নুপাদ একা খদ্দের। ওর আকাঙ্ক্ষাকে আজ ও বাধা দেয়নি। কিন্তু সীমা টানা আছে দেবকীর। সে দাগের এক পা এপাশে আসতে দেয় না কাউকে। দোকানের সামনে দিয়ে ঘরে ফেরার সময় নিজেই ডেকেছিল কাহ্নুপাদকে। হেসেছিল অকারণ উচ্ছ্বাসে, ইঙ্গিতও ছিল সে হাসিতে। 

‘যাচ্ছ কোথায়?’ 

‘যাব আর কোন চুলোয়, ঘরে যাচ্ছি। তা ভর-সন্ধ্যায় ডাকছ কেন?

‘বসবে নাকি?’ 

‘অনুমতি দিলে ঘরে ফিরবে কোন শালা?’ 

‘এসো।’ 

দেবকীর হাসিতে বুকটা তোলপাড় করে উঠেছিল। শবরীর কথা মনে ছিল না ঠিক সেই মুহূর্তে। তারপর দেবকী সাংকেতিক চিহ্নটা খুলে নিয়েছিল দরজা থেকে। 

‘ও কী, সন্ধ্যাতেই দোকান বন্ধ করে দিলে?’ 

‘দেই যাতে কেউ বিরক্ত না করে।’ 

‘তার মানে আজ আমি একলা?’ 

‘কোনোদিন নাকি তোমার নেশা জমাতে পারি না, আজ নেশা জমিয়ে দেব। 

ভীষণ নেশা জমিয়েছিল দেবকী, সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। আধো-অন্ধকার ঘর, মিটমিটে আলোতে দীর্ঘ ছায়া কাঁপে। দেবকী রহস্যময়ী নারী। মোমের মতো নরম শরীর, হাতে বেলের খোলে পানীয়। সে-মুহূর্তে কাহ্নুপাদ একজন চিত্রশিল্পী হয়ে গিয়েছিল। ও যেন একমনে এঁকে যাচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি। দ্রুত ওর মগজে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নীলাভ দেবকী, পরনে সাদা শাড়ি, খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা, পটভুমিতে আলো-আঁধারি রাত্রি। ওর মনে হয়েছিল ওর চোদ্দোপুরুষের জনম সার্থক হয়ে গেল। এখন ওর সামনে সৃষ্টির দুয়ারই খোলা। এজন্যই শবরীর কথা ভুলে গিয়েছিল ও। হয়তো এমনটি হওয়া উচিত হয়নি, ও ভাবল এবং নিজেকে শাসন রাখে এই বলে যে একজীবনে সব উচিত না বলে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হতে হয়। গুঞ্জার মালা, ময়ূর-পালক তো উপলক্ষ্য মাত্র, ভালোবাসাই সব। ভালোবাসাই তো সব সৌন্দর্যের দরজা খুলে দেয়। এ সত্য কাহ্নুপাদের চাইতে কে আর বেশি জানে। তবু এমনটি হয়েছে। ও উপেক্ষা করতে পারেনি। তার জন্য ওর কোনো গ্লানি নেই। শবরী বিমুখ হয়েছে, দরজা বন্ধ, হাজার ডাকলেও খুলবে না। ও পেছন ফিরে দাঁড়ায়। এখন আর কোনো নেশা নেই কাহ্নুপাদের। শুধু দেবকীর সঙ্গ উপলব্ধি করে কাহ্নুপাদের শরীর ঝাঁকিয়ে ওঠে। ও টিলা বেয়ে নামতে থাকে। শবরীর দরজা আজ বন্ধই থাক। চারপাশে তাকায় ও, রাত বেশি নেই। কাহ্নুপাদ মাথাটা ঝাঁকিয়ে নেয়, আর কোনো স্নায়ুর চাপ নেই। বেশ ঝরঝরে লাগছে। গান গাইতে ইচ্ছা করে কাহ্নুপাদের, কিন্তু কিছু মনে আসে না। কোথায় যাবে ও? একটাই জায়গা আছে তা হল মল্লারীর ঘর। গোটা পল্লি একটা সমুদ্র, তার মধ্যে মল্লারীর ঘর সবুজ দ্বীপ, অনবরত হাতছানি দেয়। মল্লারীর সামনে দাঁড়ালে কোনো গ্লানি হয় না, কোনো অপরাধবোধও কাজ করে না। চাঁদের আলোয় পিপুল গাছের দীর্ঘ ছায়া মাটির বুকে চমৎকার আলপনা। কাহ্নুপাদ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে।

তখনই ডোম্বির ঘর থেকে একজন লোক বেরিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। রাত আর বেশি নাকি নেই। দাঁড়াবে না ফিরে যাবে ভাবার ফাঁকে ডোম্বি বের হয় ঘর থেকে। ঘাড়ে গামছা, হাতে ঘড়া। কাহ্নুপাদ এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। চমকে ওঠে ডোম্বি। অপ্রস্তুতের হাসি হাসে। চট করে নিজেকে সামলে নেয়। 

‘তুমি? কী যে ভাগ্য আমার।’ 

‘কোথায় যাচ্ছ?’ 

‘একটা ডুব দিয়ে আসি। সারারাত যা গরম গেল। একটুও ঘুমুতে পারিনি।’ মিথ্যা বলতে গিয়ে বুক কেঁপে ওঠে। কাহ্নুপাদের সামনে সত্যি কথা বলার সাহস নেই ডোম্বির। সঙ্গে সঙ্গে ও কাহ্নুপাদের পায়ের কাছে বসে পড়ে পায়ের ওপর হাত রাখে। 

‘তুমি রাগ কোনো না কানু। বামুনগুলোকে সবদিন ঢুকতে দেই না। যেদিন কড়ি থাকে না, উপোস করতে হয় সেদিন কেবল দেই। তুমি রাগ করেছ কানু?’ 

কাহ্নুপাদ কথা বলতে পারে না। শুধু ভালোবাসার কথায় ডোম্বির কি পেট ভরে? পেটের জন্য ডোম্বিকে কড়ি জোগাড় করতে হয়। সারারাত না ঘুমিয়ে জোগাড় করে ও। কাহ্নুপাদের মন কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। 

‘আমার মনের মধ্যে একটা প্রতিশোধের আগুন আছে কানু।’ কাহ্নুপাদ চমকে ওঠে। ‘মানে?’ 

‘ওরা তোমাকে গীত পড়তে দেয়নি। আমাদেরকে বড্ড অপমান করে। 

‘কী করবে?’ 

‘সে আমার মনে আছে।’ 

‘মল্লারী!’ 

‘তোমার গলা কাঁপছে কেন?’ ডোম্বি শব্দ করে হাসে। হাসিতে ভেঙে পড়ে। 

‘এত হাসি ভালো না। 

‘বাবা! দাদাঠাকুরের মতো উপদেশ দিচ্ছ। তুমি আমার ঘরে বসো। আমি চট করে একটা ডুব দিয়ে আসি।’ 

‘না বসব না। বসতে ভালো লাগে না।’ 

‘কী করবে?’ 

‘আমার যদি অনেক কড়ি থাকত মল্লারী?’ 

‘তাহলে বুঝি পথে পথে ছিটিয়ে বেড়াতে?’ 

‘না পথে নয়। ভালোবাসা বাঁচাতাম। 

‘মা গো গীতের কথা হয়ে গেল। 

ডোম্বি আবার হাসতে আরম্ভ করে। কাহ্নুপাদ জোরে নিশ্বাস টানে। চাঁচর বেড়ার বাড়িগুলো অন্ধকার থেকে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠছে, ভোর হচ্ছে। এ সময়টা ওর চমৎকার লাগে। একটু পর বনমোরগের ডাক ভেসে আসবে। কতদিন শবরীকে নিয়ে এ সবুজ ঘাস পায়ে দলেছে। 

‘চলো আমিও নদীর দিকে যাই মল্লারী।’ 

‘তাই চলো।’ 

দুজনে নদীর দিকে হাঁটতে থাকে। 

‘আমাদের সাধ্যমতো সাধ মেটে না কেন কানু?’ 

‘আদায় করে নিতে পারি না বলে।’ 

‘ঠিক বলেছ। কেবল পিছু হটি বলেই তো ঠকে যাই।’ 

‘আচ্ছা মল্লারী, তোমার ঘর বাঁধতে সাধ হয় না?’ 

‘না।’ 

‘কেন?’ 

‘একবার তো দেখলাম সাধটা কেমন? এই তো ভালো আছি। হাত পায়ে বেড়ি নেই। তা ছাড়া—’ ডোম্বি কথা শেষ না করে আবার হাসে। 

‘তা ছাড়া কী?’ 

‘ঘর বাঁধলে কি তোমাকে পেতাম?’ 

‘আমাকে না পেলেই বা কী?’ 

‘তোমাকে পাওয়া ভাগ্য।’ 

ডোম্বি আবার হেসে গড়িয়ে পড়ে, হাসি যেন থামতে চায় না। 

ডোম্বি হাসতে হাসতে নদীর জলে নামে। তখন কাকভোর, কেউ কোথাও নেই, শান্ত নদী থিরথির। দূরে বনের মাথায় আলো আভা। ডোম্বি সাঁতরে অনেক দূরে যায় আবার ফিরে আসে। ডুব দিয়ে কোথায় গিয়ে যে ওঠে হদিস করা মুশকিল। কাহ্নুপাদের মনে হয় মল্লারীর সঙ্গে জলের একটা সখি ভাব আছে। ও যেখানেই যাচ্ছে জলের বুকে সে সখ্য ছলকে উঠছে। অন্য কেউ হলে জল বুঝি এত অত্যাচার সইত না। ইচ্ছেমতো জল আছড়েপিছড়ে তছনছিয়ে ডাঙায় ওঠে ডোম্বি। কাহ্নুপাদের কাছ থেকে ইশারায় বিদায় নিয়ে ভিজে শরীরে ছপছপিয়ে চলে যায়। যতদূর দেখা যায় চেয়ে থাকে কাহ্নুপাদ। একা একা ঘাটে বসে থাকে ও। দু-একজন করে লোক আসা যাওয়া করছে। কাকভোরের নদী যেন সুগন্ধময়। কাহ্নুপাদের মনে হয় সত্যি বুঝি নদীর গা থেকে গন্ধ আসছে। প্রাণভরে শ্বাস নিলে ফুসফুসে ভিজে শরীরের ছপছপ শব্দ হয়। নদীটাকে যদি বুকের মধ্যে পুরে রাখা যেত তাহলে বেশ হত। তখন শবরীর কথা মনে হয়। এতক্ষণে শবরীর ঘুম ভেঙেছে, ময়ূরের গলা জড়িয়ে ধরেছে, না, হয়তো ধাতুর খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। কাল রাতে শবরী ওকে ঘরে নেয়নি। ও রাগ করেছে, রাগে শরীরকে কষ্ট দিয়েছে শবরী। কাহ্নুপাদ এক মায়াবীর আশ্রয়ে দুঃখ ভুলতে চেয়েছিল, না ঠিক দুঃখ নয়, আসলে নিজেকে টুকরো টুকরো করে দেখা। একজন সৃষ্টিশীল লোক এভাবেই নিজেকে টুকরো করে। সে টুকরো থেকে বেরোয় পবিত্র সাদা ফুল, কাহ্নুপাদ যাকে অস্তিত্বের অংশ মনে করে। না, সব সময় সেটাও খুব প্রয়োজনীয় উপাদান নয়। জীবনের আরও অনেক জটিল ও গভীর ব্যাপারস্যাপার আছে। তা কখনো হরিণ-পোড়া আগুন হয়ে প্রবল বাতাসে শনশন করে। দগ্ধীভূত করে চৈতন্য এবং শিখা প্রোথিত করে চৈতন্যের গভীরে। তখন নিজেকে ঠিক রাখা কঠিন, লড়তে হয় প্রবল পরাক্রমে। হার অথবা জিত—এই শক্তি এখন ওকে নিক্ষিপ্ত করেছে আকাশেপাতালে, পাথরে কিংবা গনগনে লাভাস্রোতে। ওর মুক্তি নেই। সমস্ত শরীর ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসছে মাংসপেশি। দেবকী ওর জন্য ক্ষণিকের ঘিয়ের আলো, আনন্দ দেয়, যন্ত্রণা বাড়ায় এবং নিজের সঙ্গে মুখোমুখি করে। এই মুহূর্তে ওর ইচ্ছে করছে নদী পেরিয়ে দূরের কোথাও যেতে, কিন্তু ঘাটে পারাপারের কেউ নেই। বারুয়া মাঝিও না, কাজেই আরও কিছুক্ষণ বসতে হবে। তখুনি দৌড়তে দৌড়ুতে ছুটকি আসে। ছুটকির চেহারায় দেবকীর ছাপ আছে। দেবকীর মতো ওর আদলেও ভীষণ টান, দেখলে কাছে বসিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করে। 

‘কাকু তুমি বুঝি সারারাত ঘুমোওনি? 

‘কেন রে?’ 

‘নইলে এত ভোরে এখানে কেন?’ 

‘আসতে নেই বুঝি?’ 

‘কেন? আমি চাই না আমার আগে কেউ আসুক।’ 

কাহ্নুপাদ অবাক হয়। 

‘আমার ইচ্ছে আমি সবার আগে এই ঘাসের ওপর পা রাখি। আর কেউ মাড়িয়ে গেলে খুব খারাপ লাগে।’ 

‘সেজন্যে বুঝি এত ভোরে বেরিয়েছিস?’ 

‘ঠিক বলেছ।’ 

‘মা বকে না?’ 

‘মা টেরই পায় না। অনেক রাত পর্যন্ত মদ বেঁচে মা সকালে উঠতে পারে না। সেজন্যেই তো আমার এত মজা। জানো কাকু আমার মদ বেঁচতে একটুও ভালো লাগে না।’ 

‘কী করতে ইচ্ছা করে?’ 

‘কেবল ঘুরে বেড়াতে। বড়ো হলে আমি ঘরে থাকব না। পথে পথে ঘুরে বেড়াব। আচ্ছা কাকু এই রাস্তাটা কতদূর গেছে?’ 

‘কতদূর? অনেক দূর।’ 

‘দূর ছাই, অনেকদূর তো আমিও জানি। কতদূর বলো না?’ 

‘চোখ বুজে চিন্তা করে নে। যতদূর তোর মন চায় ততদূর।’ 

‘তুমি কিছু জানো না। কতজনকে জিজ্ঞেস করি কেউ বলতে পারে না। কেউ কিছু জানে না।’ 

‘বড়ো হলে তুই কী হবি ছুটকি?’ 

‘তোমার মতো গীত লিখব। হাড়ের মালা পরে গান গাইব, আর সারা দেশে ঘুরে বেড়াব। এই দেশটাকে প্রাণভরে দেখব’ 

‘দেশের জন্য কী করবি?’ 

‘একটি টোল খুলব। ছেলেমেয়েদের পড়াব। ওদেরকে তোমার মতো করে গড়তে চাইব।’ 

‘কেন রে?’ 

‘তুমি যে সবার ভালোর জন্য কথা বলো। তোমার মতো সবাই মিলে কথা বললে আর আমাদের দুঃখ থাকবে না। যাই ঘুরে আসি। মা আবার উঠে আমাকে খুঁজবে।’ 

ছুটকি বড়ো শিমুল গাছটার আড়ালে চলে যায়। 

হয়তো এখুনি ছুটবে ওই দূরের টিলার দিকে। কাহ্নুপাদ আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে। বুকের ভেতর এক বিশাল পৃথিবী গড়ে তুলেছে ছুটকি, সে পৃথিবীর কোনো সীমানা নেই। একটু পরে ছুটকি সত্যি সত্যি ছুটতে থাকে, ছোট্ট শরীরটা অস্পষ্ট হতে হতে মিলিয়ে যায়। ও আর বসে থাকতে পারে না। বারুয়া মাঝি ঘাটে এসেছে। নদী পার হয়ে চলে আসে কাহ্নুপাদ, বনের দিকে হাঁটতে থাকে, গাছের ছায়া মন্দ লাগে না। হঠাৎ করে গতরাতের কথা মনে হয়, শবরীর ওপর বুনো রাগ একগুঁয়ে হয়ে ওঠে। একগাদা পাখির বিচিত্র শব্দ, মাটির সোঁদালো গন্ধ, ঝোপঝাপের ওত-পাতা ভঙ্গি দেখতে দেখতে কাহ্নুপাদ মায়া হরিণের ছোট্ট বাচ্চা আবিষ্কার করে। কাহ্নুপাদকে একটুও ভয় পায় না। ঝোপের কাছে একটা দুটো লাফ দেয়। কিছুদূর গিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কাহ্নুপাদও দু- পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, যেন দুজনের মধ্যে মজার খেলা জমে উঠেছে। সেই অবাক-করা চোখের ওপর চোখ পেতে রাখে কাহ্নুপাদ। মনের মধ্যে দারুণ হুটোপুটি। যদি ধরতে পারত, নিয়ে গিয়ে পুষত। কিন্তু তা হবার নয়। রাজার আইনে ওরা কেউ হরিণ পুষতে পারে না। টের পেলে কেড়ে নিয়ে যায়। আর তখুনি বাচ্চাটা মায়ের ডাক শুনে দৌড়তে দৌড়ুতে চলে যায়। কাহ্নুপাদ বিশাল কড়ুই গাছের ছায়ায় বসে পড়ে, হলুদ পাপড়ি ঝরে পড়ে টুপটাপ। একটু দূরে অনেক ময়ূর-পালক ছড়িয়ে থাকে, একটা নিয়ে গালে বুলোয় ও। শবরী প্রায়ই ময়ূর-পালক খুঁজতে বনে আসে, গুঞ্জার ফুল নিয়ে যায়, দ্বিতার বিচি সংগ্রহ করে মালা গাঁথে। শবরী কি এখন আসবে? বনের ছায়ায় স্নিগ্ধ বাতাসে ঘুম আসে কাহ্নুপাদের। ভাবতে থাকে, শবরী ওর তুলসীতলার প্রদীপ, ঘর আলো করা, যে ঘর একজন কবির সৃষ্টিশালা। এখানে মালমশলা জমা হয় তারপর নির্মাণ চলে—ঠুকঠাক হাতুড়ি বা কাস্তে ছেনি নয়—ঘাম ঝরে মগজের ভেতর, প্রাণ প্রায় ভূর্জপত্র। ও ঘুমিয়ে পড়ে পরম নিশ্চিন্তে। 

বারুয়া মাঝির কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে কাহ্নুপাদকে খুঁজতে বেরোয় শবরী। শরীরের কোথাও শিল্পিত পরিচর্যা নেই। খোঁপায় শুকনো ফুলের মালা, পায়ে বাসি আলতা, চন্দনের গন্ধ নেই কোথাও। রাত জাগা চোখে ক্লান্তি, কেমন বিবর্ণ দেখায় শবরীকে। গত রাতে কানুকে দরজা না খোলার জন্যে এখন প্রচণ্ড অনুতাপ হচ্ছে। রাগ পড়ে যাবার পর কেবলই ভোরের প্রতীক্ষা করেছে। কখনো কানুর উপর এত দীর্ঘ রাগ ও করেনি। তাই নিজেকে আর সামলে রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে ছুটে গিয়ে কানুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, ‘মান ভাঙো কানু। আমি আর রাগ করব না।’ নৌকায় বসে পানিতে পা ডুবিয়ে রাখে ও। চোখে মুখে জ্বালা, আঁজলা ভরে জলের ছিটা দেয়। কিছুই ভালো লাগে না। কানুর ওপর অভিমান হয়। কানুও তো অপেক্ষা করতে পারত। তা না করে সরসর করে নেমে চলে এল। এখন কোথায় কে জানে? 

বনে বনে ঘোরে শবরী। সুন্দর ময়ূর-পালক পেলে আঁচলে জড়িয়ে রাখে। একগুচ্ছ গুঞ্জার ফুলও নিয়েছে। এখন ইচ্ছে করছে সব কিছু ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলতে, অহেতুক বোঝা যেন। কানুকে না পেলে এ সবেই বা কী হবে। খোঁপা খুলে গেলে শুকনো ফুল ঝরে যায়, এলোমেলো চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে থাকে। অর্জুনের বিচি নরম পায়ে শক্ত ঠেকে, কখনো ব্যথা পায়। মায়া হরিণের দিকে তাকিয়েও দেখে না। গঙ্গাফড়িং উড়ে এসে ঘাড়ে বসে। অন্যমনস্ক হয়ে যায় শবরী। বন আজ আর ভালো লাগে না। ঝোপঝাড় কেটে বনটা উদোম মাঠ করে ফেলতে ইচ্ছা করে। কানুকে না পেলে আজ ওর চুলোয় আগুন জ্বলবে না। না খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দেবে। এখন যদি দুটি খরগোশ পেয়ে যায়, তাও ছুঁয়ে দেখবে না। ওর রসনায় আজ আর জল নেই। অন্যমনস্কতায় খেয়াল করেনি যে দেশাখ ওর থেকে খানিকটা দূরে তিরধনুক তাক করে বসে আছে, লক্ষ্য ওর দিকে, মুখে মিটিমিটি হাসি। হঠাৎ করে চমকে চেঁচিয়ে ওঠে শবরী। 

‘কী করছ?’ 

‘শিকার করছি?’ 

‘কী?’ 

‘বনে কেমন সুন্দর মায়া হরিণ এসেছে। আগে কখনো দেখিনি এমন প্রাণী।’ 

‘শিকার করতে পারবে?’ 

‘খু-উ-ব।’ 

খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে শবরী। 

‘ওঠো ওঠো, আর বীরত্ব দেখাতে হবে না। শিকার তো ধরে নিয়ে খাঁচায় পুরেছ। আর কত?’ 

‘একটায় কিছু হয় না বউদি। অনেক দরকার, দেবে অনুমতি?’ 

‘ইয়ার্কি হচ্ছে?’ 

দেশাখ শবরীর কাছে এসে দাঁড়ায়। 

‘তোমাকে যখন দেখেছি বউদি, আজ নিশ্চয় ভালো একটা কিছু মারতে পারব।’ 

‘উলটোটাও তো হতে পারে? আজ তুমি কিছু নাও পেতে পারো?’ 

‘অলুক্ষনে কথা বোলো না। ওইসব কথা সইতে পারি না। যদি কিছু না পাই তাহলে গুষ্টিসুদ্ধ উপোস।’ 

‘নাও বাপু কথা ফিরিয়ে নিলাম। উপোসে কাজ নেই। আজ যেন শিকারের বোঝায় বাড়ি ফিরতে কষ্ট হয়।’ 

‘হ্যাঁ, এই তো এমন করে বলবে।’ 

‘এই সাতসকালে কেন এসেছি জিজ্ঞেস করলে না তো?’ 

‘তুমি যা খুশি তা করতে আসো আমার কী? চলো তোমাকে একটা মজার জিনিস দেখায়।’ 

‘না আমার শখ নেই। 

‘চলো না, ঠকবে না।’ 

দেশাখ শবরীর হাত ধরে টানে। কাটা ঝোঁপে শবরীর হাত কাটে, পায়ে ব্যাথা পায়, কিন্তু দেশাখ হিড়হিড় করে টানছে। 

‘নাহ্ তোমার সঙ্গে পারব না? এবার ছাড়ো। যথেষ্ট হয়েছে।’ 

দেশাখ কথা বলে না। গম্ভীর মুখে হাঁটে। ওর হাতে তিরধনুক। পিঠে পাখি ধরার ফাঁদ। শবরীকে একটা ঝোপের দিকে ঠেলে দেয়। 

‘ওই ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে দ্যাখো বউদি? বুঝবে দেবরটা কেমন কাজের হয়েছে। আমি চললাম।’

এতক্ষণে শবরী সব বুঝতে পারে। নিশ্চয় কানু আছে ওখানে। কথাটা একবারও মনে হয়নি। ভেবেছিল দেশাখ হয়তো কোনো ফাঁদে-পড়া পাখি দেখাবে। ঝোপের আড়ালে দু-পা গিয়ে থমকে দাঁড়ায় ও। কড়ুই গাছের বিরাট ছায়ায় চিতপাত শুয়ে ঘুমোচ্ছে কাহ্নুপাদ। হাতের মুঠোয় ময়ূর- পালক। সব গ্লানি ঘুচে গেল শবরীর। ওই ময়ূর-পালক ক-টাই শবরীর জন্যে ভালোবাসা। ঘুমন্ত কাহ্নুপাদকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে, শবরীর ভালোবাসায় সিক্ত নতুন মানুষ। কাহ্নুপাদের রচিত গীত কি ওই ঘুমন্ত প্রশান্তির চেয়ে সুন্দর? কী নির্বিবাদ, দ্বিধাহীন। শবরী হাঁটু মুড়ে কাহ্নুপাদের পাশে বসে, ঘুম ভাঙায় না, থাক ঘুমোক ও। ঘুম ভাঙার পর শবরীকে দেখলে হাত বাড়িয়ে যে দৃষ্টিতে ছুঁয়ে দেখবে সেটা ভাবতে শবরীর বুকটা কেঁপে ওঠে। আর এজন্যই কাহ্নুপাদ ওর কাছে প্রতিদিনের হয়েও নতুন। 

তখনই ও চুলের গোছা গুছিয়ে ময়ূর-পালক গুঁজে নেয়। ঘাসের লম্বা ডাঁটায় গুঞ্জারের মালা গাঁথে। বাতাসে বার বার এলোমেলো হয় চুল। কড়ুইয়ের হলুদ ফুলের পাপড়ি উড়ে আসে। পাপড়ি কুড়িয়ে কপালে টিপ পরে, নাকে নাকছাবি। শবরী একদৃষ্টে কাহ্নুপাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। যেন চোখ খুলে কাহ্নুপাদ ওকে দেখে চিৎকার করে বলে উঠবে, ‘আহা এ কী অলৌকিক আনন্দ! সৃষ্টির নতুন জোয়ার। এখনই সময় নতুন গীত লেখার।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *