অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৬

অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৬

খেয়াঘাট, অরণ্য, হাঁট প্রভৃতি স্থান থেকে কর আদায় করে রাজার লোকেরা। এ সব কিছুর ওপর রাজার একচেটিয়ে অধিকার এবং এটা রাজকোষের একটা নিয়মিত আয়ের উৎস। প্রতি বৎসর বিভিন্ন স্থানের কর বাবদ একটা মোটা অংশ রাজকোষে জমা হয়। সুতরাং যে উপায়েই হোক কর আদায় করতেই হয়। মাঝে মাঝে রাজার লোকেরা অন্ত্যজ শ্রেণির লোকের সঙ্গে নির্মম আচরণ করে। দু-তিন বছর কর বাকি ফেললে অথবা অন্য কোনো সামান্য অপরাধেও দশরকমের শাস্তির একটি ভোগ করতে হয়। আর এই দশরকমের শাস্তি আইন করে শুধুমাত্র ওদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। কখন যে কার ভাগ্যে পড়বে কেউ জানে না। অনেক সময় বুঝতেও পারে না কী অপরাধে কী শাস্তি হল, দেখা গেল একদিন রাজার লোক এসে ধরে নিয়ে গেল, প্রাপ্য হয়েছে নয় নম্বর শাস্তি, অর্থাৎ তিন দিন উপোস দিয়ে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা হল, কারণ জানার উপায় নেই। অনেকদিন পরে হয়তো কোনো ব্রাক্ষ্মণের সঙ্গে দেখা হলে বলল, ‘কী রে কেমন ঠুকে দিয়েছিলাম সেবার। বেটা আমার পাশ দিয়ে হাঁটিস? তোর ছায়া আমার গায়ে পড়লে পাপ হয় না?’ তখন হাঁ- করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করণীয় থাকে না। এই ভেবে মনে মনে আশ্বস্ত হয় যে তবু তো নয় নম্বর শাস্তি, এক দুই তিন হলে রক্ষা ছিল না। একবার উৎপন্ন ধানের ষষ্ঠ ভাগ রাজার গোলায় দিতে চায়নি বলে সুদামকে দু-নম্বর শাস্তি অর্থাৎ চর্ম-পাদুকার প্রহার করা হয়েছিল। তিনদিন কোনো হুঁশ ছিল না ওর, গাছ-গাছড়ার ওষুধে দীর্ঘকাল পর সুস্থ হয়েছিল সুদাম। সেই থেকে বেচারার স্বাস্থ্য যে ভেঙে গেল আর ঠিক হল না। গাঁয়ের লোককে প্রায়ই আশঙ্কায় থাকতে হয়, কোন অপরাধে কখন শাস্তি হবে কেউ টের করতে পারবে না। 

যারা সারাক্ষণ বিভিন্ন কর আদায়ের জন্যে আনাগোনা করে দেশাখ বেশ রসিয়ে এক একজনের এক একটা নামকরণ করেছে। খেয়াঘাটের কর যে আদায় করে তাকে ডাকে তারক, হাটবাজারের কর্মচারীর নাম হট্টপতি, অরণ্যের কর যে আদায় করে তাকে ডাকে অরণী। আস্তে আস্তে গাঁয়ের লোক তাদের আসল নাম ভুলে যায়। দেশাখের দেয়া নামগুলো চালু হয়ে গেছে, লোকমুখে তার বাধাহীন প্রতিষ্ঠাও রয়েছে। যাদের ওপর এসব নাম আরোপিত হয়েছে তারা প্রথমদিকে রাগারাগি করলেও এখন সে নাম মেনে নিয়েছে। শুধু মেনে নেয়া নয়, এ নামে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। খেয়াঘাটের কর আদায়কারী বলাই শর্মাকে ডোম্বি ডাকে তরপতি। ক-দিন থেকে তরপতি ওর পিছনে লেগেছে করের জন্য। ডোম্বি জানে ওর চটুল হাসির মোহিনী ভঙ্গির জন্য যথেষ্ট দুর্বলতা আছে বলাই শর্মার। এ সুযোগ ছাড়ে না ও। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু এমনি করে ঘোরাতে আমোদ লাগে। কখনো চোখ নাচিয়ে বলে, ‘আপনার কড়ি আমার কাছে এলেই এ কর শোধ হবে, নইলে শোধ দেব কী দিয়ে?’ ডোম্বির চোখের নাচুনিতে বিগলিত গদগদ বলাই শর্মাকে কেমন নির্বোধ মনে হয় ডোম্বির। রাজার লোক বলে গর্ববোধ আছে, দাপটও দেখায় যত্রতত্র। দাবা খেলতে ভালোবাসে। রাস্তার ধারে ডোম্বির নাচ দেখতে পেলে উৎফুল্ল হয়। দিনেরবেলা লোকজনের সামনে দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে দেখে, রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি ওর দরজায় দাঁড়িয়ে টুকটুক শব্দ করে। কেননা দেবল ভদ্র ব্রাহ্মণদের জন্য দুটো আইন তৈরি করেছে। এক, ব্রাহ্মণ নিম্নবর্ণের স্ত্রীলোকের সঙ্গে যে-কোনো ধরনের মেলামেশা করতে পারবে, সে যদি তার বিবাহিত স্ত্রী না-ও হয় তবে তাতে কোনো ক্ষতি নেই। এমনকি তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করলে সংসর্গ দোষ ছাড়া অন্য কোনো নৈতিক অপরাধ হবে না। দুই, অন্যের সঙ্গে বিবাহিত নিম্নবর্ণের স্ত্রীলোকের সঙ্গে ব্যভিচার করা কম দোষের হবে। তবে নিম্নবর্ণের স্ত্রীলোককে বিবাহ করা হবে অমার্জনীয় অপরাধ। 

এ আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল পণ্ডিত সুধাকর, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। তার আপত্তি ছিল এজন্য যে এভাবে ব্যভিচারকে আইনের আশ্রয়ে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে, ব্যভিচারকে নিয়মের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে, এতে লোক উচ্ছৃঙ্খল হবে। এর দ্বারা সমাজের কোনো মঙ্গল নেই, বরং ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। অট্টহাসিতে হেসে পড়ে দেবল ভদ্র বলেছিল, ‘সমাজ? সমাজ তো আমরাই। যাদের হাতে আইন তৈরি করবার ক্ষমতা আছে তারাই এ সমাজ। আমরা ভোগ করব, ওড়াব, তছনছ করব, যা খুশি তা করব, নাকি সব কীটাণুকীট।’ 

সমর্থন জুগিয়েছিল সাঙ্গপাঙ্গরা, ‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছে মন্ত্রী। আমাদের যাতে মঙ্গল হয় সে কাজই উনি করেছেন। আমাদের কল্যাণ দেখা তাঁর কর্তব্য।’ 

রেগে গিয়েছিল সুধাকর, টকটকে গৌরবর্ণের চেহারায় ভাটার মতো দু-চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে পড়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য হলেও সবাই সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দেবল ভদ্রের বুকের পাটা অন্য ধাতুতে তৈরি, কোনো কিছু তাকে বড়ো একটা স্পর্শ করে না। 

রাশভারী বয়স্ক বৃদ্ধ চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘তুমি ওই অগণিত লোককে মানুষ বলে মনে করো না দেবল ভদ্র?’ 

দেবল ভদ্র চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, ‘করি, নিশ্চয়ই করি। তবে ব্যবহার্য দ্রব্যের মতো, যখন ব্যবহারে লাগবে কাছে রাখব, যখন লাগবে না দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেব।’ 

বাঁকা হাসিতে চকমকিয়ে উঠেছিল দেবল ভদ্রের ধূর্ত চেহারা। স্বভাবে তিনি ইন্দ্রিয় শাসিত, এর বাইরে শুকনো হাঁটাহাঁটি ভালো লাগে না। অকারণে বিনয়ের ভক্তির উচ্ছ্বাসে মদত জুগিয়েছিল পারিষদ দল। দেবল ভদ্রের প্রতিটি শব্দে মাথা নাড়ার জন্য তারা আছে, আর কোনো কাজ নেই। 

রাজা বুদ্ধমিত্রের কাছে আবেদন করেছিল পণ্ডিত সুধাকর। অশীতিপর বৃদ্ধের দৃপ্ত চেহারা তাকে অভিভূত করেছিল ঠিকই, কিন্তু বুকে তেমন জোর ছিল না, কপালে চিন্তার ছায়া ফুটে উঠেছিল, কিন্তু প্রতিবাদ করেনি দেবল ভদ্রের তৈরি আইনের বিরুদ্ধে। সুধাকর জানে আপত্তি করার মতো সাহস বুদ্ধমিত্রের নেই। ব্রাহ্মণ মন্ত্রী দেবল ভদ্র বৌদ্ধ রাজা বুদ্ধমিত্রকে পরিচালিত করে। রাজকাজের সব ব্যাপারে তার দোর্দণ্ডপ্রতাপ। এককথায় সমুদয় শাসনযন্ত্র দেবল ভদ্রের হাতের মুঠোয়, কারও কোনো কথা সেখানে চলে না। বুদ্ধমিত্র মাথা হেলিয়ে বলেছিল, ‘আইন তৈরির সব ক্ষমতা দেবল ভদ্রের, আপনি তো জানেন পণ্ডিত সুধাকর।’ 

সুধাকর সমান রোষে বলেছিল, ‘তা তো জানি, তবু ভেবেছিলাম আপনারও কিছু করার ক্ষমতা আছে, আপনি দেশের রাজা। 

রাজা শব্দটা ভীষণ বিদ্রূপে বুদ্ধমিত্রের দিকে ছুঁড়ে মেরেছিল পণ্ডিত সুধাকর। সঙ্গে সঙ্গে উপায়হীন একটি অক্ষম লোকের সামনে থেকে রাগে গরগরিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, কিছু করতে না পারার গ্লানি তাকে মরমে মারছিল। মনে হয়েছিল এই অদ্ভুত একতরফা আইন তৈরির সব লজ্জা ও অপমান তার একার। কিন্তু কিছুই করতে পারল না, অন্তত রদ করতে পারলে কিছুটা সান্ত্বনা পেত। তবু ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে, নিজের বিবেককে প্রতারিত করেনি। রাজদরবার থেকে বেরিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো শকটে ওঠে সুধাকর। নগরীর পথে ধুলো উড়িয়ে শকট ছোটে, সরে যায় বাড়িঘর, গাছ, মানুষ, দিঘি এবং দেবালয় কিন্তু সুধাকরের বুক থেকে সরে না যন্ত্রণা। নিজেকে ক্ষুদ্র কীটের মতো মনে হয়, ও যে একা। দু-একজন গোপনে ওকে সমর্থন দিলেও প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস নেই। ওরা বলে, ‘আপনি যুবক হয়ে এই প্রতিবাদ করলে দেবল ভদ্র আপনাকে গুম করে ফেলত। সমাজে আপনার প্রতিষ্ঠা ও পাণ্ডিত্য এবং বয়সের জন্য ওরা আপনাকে ঘাঁটায় না।’ দেবল ভদ্রের মতো একজন লম্পট লোকের কাছে ওর পাণ্ডিত্যের পরাজয় ওকে মরমে মারে। আসলেই সমাজ এখন দেবল চন্দ্রের পায়ের নীচে, থেঁতলে যাচ্ছে পাণ্ডিত্য, সাধারণ মানুষ, মানসম্মান এবং বিবেক। নইলে এত বড়ো একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝড় ওঠা উচিত ছিল, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। মানুষগুলোর সাহস দেবল ভদ্রের পায়ের নীচে। হা-হা করে হেসে ওঠে সুধাকর। এই আকস্মিক হাসিতে চমকে পেছনে তাকায় কোচোয়ান। সুধাকর ওকে ইশারা দিয়ে জানায়, তুমি যাও। 

বাড়ি ফিরে এক গ্লাস জলও খেতে পারে না সুধাকর। গুম হয়ে বসে থাকে। বার বার নিজেকে ধিক্কার দেয়, বেঁচে থেকে কী লাভ? এতদিন যা শিখেছি তা কি মিথ্যা? কেন অন্যায়ের প্রতিবাদে কাজে লাগতে পারলাম না। প্রচণ্ড ব্যথায় মাথা ছিঁড়ে যেতে চায়। 

সুধাকরের শঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হল অনেকের ক্ষেত্রেই। যাদের এতদিন ইচ্ছে ছিল কিন্তু সাহস ছিল না তারা সুযোগের সদ্ব্যবহারে তৎপর হল। বলাই শর্মা তেমন একজন। একদিন রাতের অন্ধকারে ডোম্বির ঘরে এসে ঢুকল। ও অবাক হয়নি। আকারে ইঙ্গিতে বলাই শর্মা ক-দিন ধরে এ ইচ্ছেই প্রকাশ করছিল। ডোম্বি তেমন আমল দেয়নি, হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, আজকে বলাই শর্মাকে দেখে চটুল হাসিতে আমন্ত্রণ জানায়, ‘বাবা কী ভাগ্য আমার, তরপতি আজ আমার ঘরে। আজকাল কি রাতেরবেলায়ও কর আদায় শুরু করলেন?’ 

ডোম্বির আক্রমণে অপ্রতিভের হাসি হাসে বলাই শর্মা, এর জন্য ওর কোনো প্রস্তুতি ছিল না। তির্যক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ডোম্বির দিকে তাকালে ছলকে-ওঠা রক্ত হিম হয়ে যায়। টেনে টেনে বলে, ‘তোমার কাছে আবার কর কী? এই এলাম বেড়াতে বেড়াতে। ভাবলাম দেখি তুমি কী করছ? তা ছাড়া আমাদের সবার উচিতও সবার খোঁজখবর করা।’

বলাই শর্মার নির্বোধ হাসিতে ডোম্বি রেগে গিয়ে বলে, ‘তাই নাকি? দিনের বেলায় আমাদের ছায়া মাড়াতে ভয় পান। তা তরপতি রাতারাতি আমাদের ছায়াগুলো এমন পবিত্র হয়ে গেল কী করে?’ 

বলাই শর্মা মহা উৎসাহে বলে, ‘জানো না মন্ত্রী আইন করে দিয়েছেন যে তোমাদের সংসর্গ এখন আর দোষের নয়।’ 

‘ওমা, কী বলেন? কই শুনিনি তো? তা ভালো, আইন করে সব বেশ শুদ্ধ করে নিচ্ছেন আপনারা। আপনারা ভালোই আছেন। যা খুশি করার জন্য আপনাদের হাতে আইন তৈরির ক্ষমতা আছে।’ 

‘আহা তুমি চটছ কেন? এতে তো তোমাদের পুণ্যি হচ্ছে। তোমরা বামুনের ছোঁয়া পাচ্ছ, তোমাদের খুশি হওয়া উচিত।’ 

‘খুশি? খুশি হব কেন? আমর তো মনে হয় আমাদের ছোটোলোকদের পাপও নেই পুণ্যও নেই।’ 

বিদ্রুপের হাসিতে তিরিক্ষে হয়ে ওঠে ডোম্বি। বলাই শর্মার বুক আচমকা কেঁপে যায়। এ নারীর যেমন আকর্ষণ তেমন ভীতি, না এসে পারা যায় না, এলে ভয় করে। বলাই শর্মা আঙুল কামড়ায়। ডোম্বির হাসি থামতে চায় না। বলাই শর্মা কথা বলতে পারে না। ভয়ে চুপ করে থাকে, 

কী বলবে বুঝতেও পারে না, বেশি কথা বললে আজকের রাতটা মাটি হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কাও মনে কাজ করে। ডোম্বির ঘরে মাটির প্রদীপ জ্বলে, সলতে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। চুলোয় হাঁড়ি নেই, কয়লার আগুন গনগনে, হয়তো একটু আগে রান্না শেষ হয়েছে। আধো-অন্ধকারে ডোম্বির দীঘল দেহের মোহন ভঙ্গি বলাই শর্মার চোখের তারায় আটকে থাকে, দৃষ্টি ফেরানো কঠিন। বলাই শর্মার কণ্ঠতালু শুকিয়ে যায়। বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘কীসের পাপ? এমন শরীরের ছায়াতেই সব পুণ্য। ওহ্ মরণেও এখন সুখ!’ বলাই শৰ্মা কণ্ঠে আবেগ ঢেলে বলে, ‘এবার তোমার সব কর মাফ করে দেব ডোম্বি।’ 

‘তা তো দেবেনই। বিনে কড়িতে তো আর রাতের শয্যা বানাইনি।’ 

ডোম্বির সুরেলা কণ্ঠ রুক্ষ ও কর্কশ। 

বলাই শর্মা আমতা আমতা করে বলে, ‘ঠোঁটের যা ধার তোমার, তাতে বলাই শর্মা কেন দেবল ভদ্ৰই খুন হয়ে যাবে।’ 

আবার সেই আচমকা হাসি, শানানো ছুরির মতো ঝিলিক দেয়, সাদা দাঁত ঝকমকিয়ে ওঠে। বলে, ‘যা করি বাপু সোজাসুজি, বাঁকা পথের কাজকারবার আমার কাছে নেই। ফেলো কড়ি মাখো তেল।’ এক সময় চুলোর গনগনে কয়লা একদম ছাই হয়ে যায়। এলোপাতাড়ি বাতাসে গাছের মাথায় শনশন শব্দ। বলাই শর্মা বিদায় নেয়। নদীর কাছে যেতে ভীষণ ইচ্ছে করে ডোম্বির। নদী ওকে যেমন জন্মের পর বুকে নিয়েছে, যেমন লালন করেছে, তেমন আবার পরিশুদ্ধ করে। একটা ডুব দিয়ে উঠলে মনে হয় কোথাও কোনো গ্লানি নেই, ময়লা নেই, কাদামাটি নেই, দারুণ ঝরঝরে আর পবিত্র লাগছে। একা বিছানায় শুয়ে ডোম্বি বিড়বিড় করে, ‘নদী তুই আমার সব—মা, বাবা, বন্ধু, কেবল তুই আমার কানু হতে পারিস না।’ মুহূর্তে ও ডোম্বি থেকে মল্লারী হয়ে যায়, কানুর লেখা গান ওর কণ্ঠে উঠে আসে। অনেকক্ষণ গুনগুনিয়েও ওর আশ মেটে না। এই লোকটা ওকে পাগলের মতো টানে। পেছনের সমস্ত নাড়ির বাঁধন উপড়ে ফেলে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। 

দেবল ভদ্রের প্রবর্তিত আইন যখন ঢেঁড়া পিটিয়ে সর্বত্র ঘোষণা করা হল তখন গাঁয়ের লোক কথা বলতে পারেনি। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল অনেক। কেবল ডোম্বি গায়ে বিছুটির জ্বালা নিয়ে নৌকায় বসে চিৎকার করেছিল, ‘বেশ হল, খদ্দের বাড়ল আমার, রোজগারও বাড়বে। দেশের রাজা আমাদের ভারি দয়ালু, গরিবের দিকে দৃষ্টি আছে।’ পারাপারের লোকেরা হাঁ-করে ওকে দেখছিল। চিৎকার করছিল দেশাখও, ‘বেশ করেছে, কাজের মতো কাজ করেছে। কতকাল আর লুকিয়ে-ছাপিয়ে রাখা যায়। প্রকাশ্যে প্রতিষ্ঠিত করাই ভালো। এখন আর বাধা রইল না।’ 

জটলা করছিল অনেকেই। দেশাখের বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠস্বর সকলের মন ছুঁয়ে যায়। সবার মধ্যেই কম-বেশি অসন্তোষের গুঞ্জন। 

‘এতদিন আচার-আচরণে আমরা ছোটোলোক ছিলাম। এবার আইন করে ঘোষণা করা হল আমরা নেড়ি কুকুরের চাইতেও অধম।’ 

সবার চোখমুখে বেদনার ছায়া, কেউ প্রতিকারের ভাষা জানে না। মাথা পেতে নিতেও গ্লানি। দুঃসহ যন্ত্রণার বিশাল কাঁটা বুকের মধ্যে গেঁথে থাকে। 

দেশাখ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ইচ্ছে করছে ওই লুচ্চাটার মাথা ফাটিয়ে—’ 

‘ওরে দেশাখ চুপ কর। দেবল ভদ্রের বিরুদ্ধে কথা বললে কারও ঘাড়ে মাথা থাকবে না। কচুকাটা করবে। ঘরদোর পুড়িয়ে ছাই করে দেবে।’ 

বুড়ো নিমাইয়ের আতঙ্কিত কণ্ঠে দেশাখ চুপ করে যায়। ওরা সবাই জানে দেবল ভদ্র এক মুহূর্তে একটা বিরাট অনর্থ ঘটাতে পারে, সে কারও পরোয়া করে না। 

‘বেশি বাড় ভালো না রে। ছোটোলোকের মতোই থাক, জন্মের পাপ তো আমাদের বইতে হবে।’ 

ভিড়ের মধ্য থেকে দীপক চেঁচিয়ে বলে, ‘না কাকা সবসময় একটা কথা বলবেন না।’ 

‘তবে তোরা কী করবি?’ 

‘সেটা আমাদের ভাবতে হবে।’ 

‘বুকের পাটা বেড়েছে দেখছি।’ 

বুড়ো নিমাই দুপদাপ পা ফেলে জটলা থেকে সরে পড়ে। ছেলেদের এ ধরনের আচরণ ওর একদম পছন্দ হয় না, ওরা আগে-পিছে বুঝতে চায় না। নিমাইর পেছনে আর অনেকেই যায় যারা মনে করে ছোটোলোক হওয়াটা জন্মগত অধিকার, এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে মঙ্গল তো নেইই, উলটো পাপের পঙ্কে ডুবে মরতে হবে। 

তরুণরা অসন্তোষের হুল ফোটানো জ্বালা বুকে নিয়ে একে একে সবাই নিজ নিজ কাজে যায়। এ অপমান কারও পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। প্রতিবাদের উপায় চাই। এ কথা ক-টি প্রার্থনার সংগীতের মতো সবার মুখে। ভিড় কমে গেলে দেশাখ কাহ্নুপাদের কাছে এসে দাঁড়ায়, ‘কানুদা তুমি তো লেখো, চিন্তাভাবনা করো। আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও।’ 

‘কী?’ 

‘আমরা কেন ছোটোলোক? কী আমাদের অপরাধ? আমাদের কী নেই?’ 

কাহ্নুপদ দেখতে পায় দেশাখের উত্তেজিত চেহারায় চোয়ালটা মাটির টিলার মতো উঁচু হয়ে উঠেছে, ঠোঁট জোড়া নদীর মতো বেঁকে যায়, ওর ভুরুর ওপর বাঘের থাবা, চোখে লোহার শিক পোড়া আভা। এসব নিয়েই তো একটা কিছু রদবদল হয়ে যায়। 

দেশাখ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে, ‘কথা বলছ না কেন?’

‘আমারও তো দেবল ভদ্রের শরীর টুকরো করে দেখতে ইচ্ছে করে যে তার রক্তের রং কী? আমাদের রক্তের রং যদি লাল হয় তবে সে একই রং নিয়ে ওদের বেঁচে থাকা উচিত নয়, হয় মরুক নয় রক্তের রং পালটাক। সব জায়গায় উচ্চ-নীচের ভেদটা তফাত করে দিক।‘

‘ঠিক বলেছ। চলো একদিন সবাই মিলে রাজার কাছে গিয়ে এ আবেদন জানাই।’ 

‘তাতে লাভ? রাজা তো ওদের লোক, আমাদের কেউ না। আমাদের জন্য তার কোনো দরদ নেই।’ 

‘শুধু তাই নয়, তার কোনো বিবেকও নেই। থাকলে ন্যায় এবং অন্যায়ের ভেদ বুঝত।’

‘তুই তো বলিস আমি ভাবি কি না। ভেবে ভেবে আমি দিশেহারা হয়ে যাই রে। আমি ঠিক করেছি, চল আমরা ছোটোলোকরা আলাদা হয়ে যাই। আমাদের ভেতর থেকে একজনকে রাজা বানাই, একজনকে মন্ত্রী। তারাই আমাদের কথা ভাববে। আমাদের উপকার করবে।’ 

দেশাখ ওকে জড়িয়ে ধরে, ‘তুমি একটা সাংঘাতিক কথা বলেছ কানুদা। তাহলে আমরা রাজাকে কর দেব না।’ 

‘হ্যাঁ ঠিক।’ 

‘আমাদের এই এলাকার সব জমির মালিক হব আমরা।’ 

‘হ্যাঁ ঠিক।’ 

‘আমাদের মুখের ভাষাই হবে রাজদরবারের ভাষা।’ 

‘তা তো হতেই হবে।’ 

‘উফ কানুদা, আমরা নিজেদের একটা রাজ্য গড়ব।’ 

‘কিন্তু দেশাখ ওরা তা মানবে না।’ 

‘না মানলে লড়াই করব।‘

‘কেমন করে? আমাদের তো কিছু নেই।’ 

‘তিরধনুক আছে।’ 

‘সে আর ক-টা? কিন্তু ওদের বাহিনী আছে, অস্ত্রশস্ত্র আছে। ওদের সঙ্গে আমরা পারব না।’ 

‘সেজন্য নিজেদের তৈরি করতে হবে কানুদা।’ 

কাহ্নুপাদ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোর কাছে আমি এমন উত্তরই চাইছিলাম দেশাখ। আমাদের ছেলেরা তোর মতো হলেই আমরা লড়তে পারব। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে রে। চল রামক্রীর ওখানে যাই। আজ ওদের নতুন মদ চোলাই হবে।’ 

দু-জনে হাঁটতে হাঁটতে নিমগ্ন হয়ে যায়। দেশাখ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে শিকারের নামে তিরধনুকের একটা দল গড়ে তুলবে ও। আস্তে আস্তে সে দল এক বিরাট বাহিনী হয়ে যাবে। কাহ্নুপাদ ভাবে স্বপ্ন যত সুখকর হোক ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। ওরা ছাড়া রাজকোষে অর্থ যোগাবে কে? ধানের গোলা ভরবে কে? দেশের সব জমির মালিক রাজা। এত সহজে সব কিছু ওদের ছেড়ে দেবে না। তার জন্য প্রচুর রক্তপাত চাই, প্রচুর রক্ত! কাহ্নুপাদের মাথা ঝিম ধরে যায়। শূন্য দৃষ্টিতে সাদা মেঘ ভাসে। 

তখন পটহ মাদল বাজিয়ে কুক্কুরীপাদ নেচে নেচে পথ চলে। উলঙ্গ শরীরে ছাই মাখানো, গলায় হাড়ের মালা, জটা-ধরা চুল মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা, চোখ জবা ফুলের মতো লাল। পটহ মাদলের শব্দের সঙ্গে গলার হাড়ের ঠকঠক শব্দ মিলে বিচিত্র ধ্বনি হয়। কুক্কুরীপাদের কোনো দিকে খেয়াল নেই, যোগীর ধ্যানে মগ্ন। ও দূরের পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে। ওখানেই থাকে। সংসার পছন্দ করে না। উদ্দাম, মুক্ত ও প্রেমময় জীবন ওর কাম্য। ওকে ভালোবেসে ওর সঙ্গে বেরিয়ে গেছে সন্ধ্যা। দু-জনে পাহাড়ে থাকে, ফলমূল খায়, কখনো গাঁয়ে এসে ভিখ চায়। চিন্তাভাবনাহীন এই মুক্ত জীবনে ওরা ভীষণ সুখী। কিন্তু লোকালয়ের মানুষ ছেড়ে এই একা একা বসবাস একটুও ভালো লাগে না কাহ্নুপাদের। ও সবার মাঝে, সবার সুখে-দুঃখে থাকতে চায়। কুক্কুরীপাদ ওদের দেখে গান থামিয়ে দাঁড়ায়। 

‘কোথায় যাচ্ছ কানুদা?’ 

‘রামক্রীর ওখানে যাব। এক ঢোক গলায় ঢালব।’ 

কুক্কুরীপাদ হা-হা করে হাসে, ‘রাজার আইনে মাথা ঘুরে গেছে তো? বুঝি, সব বুঝি কানুদা।’ আবার পটহ মাদল বেজে ওঠে, কুক্কুরীপাদ গায়, 

দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই
রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ 
আঙ্গন ঘরপণ সুন ভো বিআতী।। 

কুক্কুরী গাইতে গাইতে অনেকদূরে চলে যায়। অস্পষ্ট হয়ে আসে গানের কথা, সুর। কেবল বাজনার শব্দ আসে মৃদু। কাহ্নুপাদ থমকে দাঁড়িয়েছিল। গান শুনে ওর ভুল ভাঙে। কুক্কুরী যতই দূর পাহাড়ে থাকুক, যোগী হয়ে হাড়ের মালা পরুক, আসলে দেশের অবস্থা বোঝে। নইলে এমন সুন্দর পংক্তি কেউ রচনা করতে পারে না। কাছিম দুইয়ে পাত্রে রাখা যায় না। গাছের তেঁতুল কুমিরে খায়। কুক্কুরীপাদের গানের প্রথম পংক্তি কাহ্নুপাদকে ভাবায়। কী সুন্দর করে বলা। আসলে ও যোগীর জীবনযাপন করলেও মানুষের কথা ভাবে, মানুষকে ভালোবাসে। ভালোবাসার এই সুগভীর বোধ থেকেই হৃদয়ের ভাষার এমন বাঙ্ময় প্রকাশ। ওর তখুনি মনে হল আসলে সবার বুকের গভীরে লুকিয়ে আছে লড়াইয়ের প্রস্তুতি, ডাকলেই হয়, পাহাড়, বন এবং লোকালয় থেকে ছুটে আসবে মানুষ, যোগীর ধ্যান উড়িয়ে দিয়ে, সব কাজ ফেলে। হঠাৎ করে দেশাখ দাঁড়িয়ে পড়ে, ‘আমি চলি কানুদা। তুমি একা যাও।’

‘কোথায় যাবি?’ 

‘অন্য কোথাও যাব। কিছু ভালোও লাগছে না।‘

‘ঠিক আছে, যা।’ 

ওর মন বিক্ষিপ্ত হয়েছে, ও আর কোথাও যাবে, ঘুরে ফিরে আবার নিজের মুখোমুখি হবে, আর দু- পাঁচটা ছেলেকে মনের কথা বলবে, একত্র করতে চাইবে। করুক, কাজটা ওকেই সাজে, ওর সে গুণও আছে। কাহ্নুপাদ হাঁটতে হাঁটতে খেয়াঘাটের কাছে আসে। রামক্রীর ওখানে যেতে ওরও ভালো লাগে না, বরং সবার সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি কতটা অনুকূল তা বুঝতে পারবে। খেয়াঘাটে জটলা বেঁধেছে, সবার কণ্ঠই আজ সোচ্চার হতে চায়, কিন্তু গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে পারে না। কোথায় যেন ভয়, নিমাই বুড়োর তর্জনী দেখতে পায়, ছোটোলোকরা ছোটোলোকের মতো থাক। তাই বেশি ভাবতে চায় না অনেকে, আবার নিজেদের শামুকের মতো গুটিয়ে নেয়। আর কিছুক্ষণের মধ্যে অরণ্যের কর আদায়কারী রাজার লোক দেখে সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। কাহ্নুপাদ কথা বলে, ‘কী ব্যাপার অরণীবাবু?’ 

‘ব্যাপার আর কী? এই এলাম ঘুরতে ঘুরতে। সারাদিনই তো ঘুরতে হয় এখানে নয় ওখানে। কাজটাই তো ঘোরার। 

বেশি কথা বলা অরণীবাবুর স্বভাব। কথায় একবার পেয়ে বসলে আর থামতে চায় না। নিজেও বোঝে নিজের এ অভ্যাসের ব্যাপার। তখন দাঁতে জিভ কেটে বলে, ‘আমি বড্ড বাচাল। একবার শুরু করলে আর থামতে পারি না।’ 

পান খেয়ে রাঙিয়ে রাখা দাঁতগুলো বের করে হা-হা করে হাসে, যেন প্রবল রসিকতা করেছে। পরমুহূর্তে কারও কারও দিকে চোখ পড়তে ফুঁসে ওঠে, ‘কী হে বাপু আর কতদিন ঘোরাবে? ঘুরতে ঘুরতে তো পা দুটো হারাতে বসেছি। কলুর বলদের ঘোরা এর কাছে কিছুই না। আর কিন্তু ঘুরতে পারব না বাপু, এবার না দিলে দরবারে নালিশ দেব। তখন মজাটা টের পাবে।’ 

যারা অরণ্যে শিকার করে ওরা দু-তিনজন জোড় হাতে বলে ওঠে, ‘দেব, অরণীবাবু দেব। আপনাকে আর ঘুরতে হবে না, বাড়ি বয়ে দিয়ে আসব। বড়ো খারাপ সময় যাচ্ছে, শিকারই জোটে না। শিকার করে আর দিন চালানো যায় না।’ 

‘অতশত আমি বুঝি না বাপু। আমার কাজ আমি করব, নইলে আবার আমাকে শাস্তি পেতে হবে।’

কাহ্নুপাদ পাশ থেকে বলে, ‘চাইলেই তো হয় না। ওদের দিকটাও তো দেখতে হবে।’ 

অরণী চোখ গরম করে। ‘অত দেখতে গেলে আমার চলে না। রাজার আইন এতকিছু বোঝে না। পিঠে দু-ঘা পড়লে তবে তোমাদের আক্কেল হবে। বুঝলে?’ 

কাহ্নুপাদ প্রচণ্ড ক্রোধের পরও নিজেকে শান্ত রাখে। মনে মনে বলে, ‘আক্কেল আমাদের ঠিকই হচ্ছে। টের পাইয়ে ছাড়ব।’ কিন্তু পরিবেশ সহজ করার জন্য লঘু কণ্ঠে বলে, ‘আপনার শরীর খারাপ নাকি অরণীবাবু? চোখমুখ শুকানো দেখাচ্ছে?’ 

‘তা দেখাবে না কেন বলো? এ দেশটায় কি বাস করার উপায় আছে? যতসব জঞ্জাল আমার মাথার ওপর এসে পড়েছে। গতকাল আমি আমার প্রিয়তম স্ত্রীকে ত্যাগ করেছি।’ 

‘কেন? কেন?’ 

‘আর কেন? আমার শালার ভাস্তের কন্যার নামে কলঙ্ক রটেছে। পরে শুনেছি সে কলঙ্ক মিথ্যে, কিন্তু মিথ্যে হলেও কলঙ্ক তো! সে পাপে আমার স্ত্রীও কলুষিত হয়েছে। এখন সেই কুলটা স্ত্রীকে নিয়ে কী করে ঘর করি বলো? তাই ওকে ত্যাগ করেছি। গতকাল বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। বড়ো প্রিয়তম স্ত্রী ছিল আমার। যাবার আগে আমার দু-পা জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! দেখলে পাষাণও গলে যায়, আমি তো মানুষ। কত যত্ন করত আমাকে, সংসারের সব কিছুতে সজাগ দৃষ্টি ছিল, ছেলেমেয়েগুলোর এখন যে কী হাল হয়েছে! আমার সোনার সংসার শ্মশান হয়ে গেল।’ 

অরণী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না, কেঁদে ফেলে। তার আসল নাম একটি ছিল, এখন আর চালু নেই, সবাই ভুলে গেছে। কোঁচার খোঁট দিয়ে বার বার চোখ মোছে, নাক ঝাড়ে, নাকের ডগা লাল হয়ে ওঠে। সবাই হতভম্ব, কেউ কথা বলতে পারে না, অনেকের চোখের কোণ চিকচিক করে। পেছন থেকে কেউ ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আহা রে কী কষ্ট অরণীর।’ চোখের জল ওকে সবার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। ওদের ব্যবধান ঘুচে গেছে। একটু আগের রুক্ষ, নিষ্ঠুর লোক ও এখন আর নয়। শুধু কাহ্নুপাদ একবার মনে মনে আউড়ে নেয়, ‘শালার ভাস্তের কন্যা তার দোষ…।’ নাহ্ আর ভাবা যায় না। কিছুক্ষণের মধ্যে আত্মস্থ হয় অরণী। নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে সচেতন হয়ে যায়। কিছুটা দম্ভের স্বরে বলে, ‘তোমরা হয়তো জানো না, আমার মা তেমন সৎকুলের মেয়ে ছিল না। আমার বাবা তার বাবার মতের বিরুদ্ধে নিয়ে করেছিল। আমার গিন্নি কিন্তু সৎ ক্ষত্রিয় বংশের মেয়ে ছিল। সেই দিক থেকে আমি আমার বাবার ওপর টেক্কা দিয়েছিলাম। আহা, তার ওপর আমার এমন প্ৰেয়সী! 

অরণী আবার চোখের জল মোছে। শোক যেন কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না, অথচ সংস্কার আষ্টেপৃষ্ঠে, সেটাও মানতে হয়। অরণীর এমন গভীর শোক দেখে হাসি পায় কাহ্নুপাদের। পেছন থেকে নিমাই বুড়ো দরদি গলায় সহানুভূতি দেখায়, ‘আহা বড়ো সৎ বামুন আমাদের অরণীবাবু। এমন নিষ্ঠাবান লোকের জন্যই তো সমাজটা টিকে আছে, নইলে সব ছারখার হয়ে যেত।’ 

‘বটেই তো, কতবড়ো পুণ্যের কাজ করেছেন ও।’ 

পেছন থেকে কে যেন সমর্থন জানায়। কাহ্নুপাদ খেয়াল করে অনেকেরই মুখেচোখে একটা ভক্তিভাব, যেন এমন মহৎ পুণ্য আর কিছুতেই হয় না। একই সঙ্গে সকলেই যেন একটা শোকের অংশীদার হয়ে বাক্যহারা হয়েছে। এদের নিয়ে কেমন করে আলাদা রাজ্য হবে? ওরা কি এদের বিরুদ্ধে লড়বে? হতাশা বোধ করে কাহ্নুপাদ, বুক মোচড়ায়। কিছুই ভালো লাগে না। দেশাখকে খোঁজে। না, ও এ জটলায় নেই। কেউ কথা বলছে না কেন? ভাবটা যেন কথা বলে পুণ্যের পবিত্রতা এবং স্তব্ধতা ক্ষুণ্ণ করবার সাহস কারও নেই। এক সময় অরণী নিজেই উঠে দাঁড়ায়। 

‘যাই, ছেলেমেয়েগুলো ঘরে রয়েছে। বড্ড জ্বালাতন করে, ঘরে ফিরলে মাথা খারাপ হয়ে যায়।’ 

কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসে অরণী। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে, ‘দেশাখ কই? দেখছি না তো, ওর চুল পর্যন্ত দেখা যায় না আজকাল। আমাকে কেবলই ঘোরায়। দশদিন চোরা কুঠুরি থেকে ঘুরে এলেই মজাটা টের পাবে।’ 

কেউ কোনো কথা বলে না। অরণী লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘাটে এসে দাঁড়ায়। একদল লোক নিয়ে ডোম্বির নৌকা কেবল ঘাটে এসে লেগেছে। অরণী এক কোণে সরে দাঁড়ায়। সবার নামা হয়ে গেলে লাফ দিয়ে নৌকায় ওঠে। ডোম্বির উলটো দিকে নৌকার মাথায় গিয়ে বসে। যদি কোনোক্রমে বইঠার জল এসে গায়ে লাগে অথবা ডোম্বির ছায়া পড়ে তাহলে তো বাড়ি গিয়ে আবার স্নান করতে হবে। এমনিতেই এ পাড়ায় এলে স্নান না করে উপায় থাকে না। সেজন্যই তার সবসময় এক কথা, ‘ছোটোলোকগুলোর জ্বালায় রাস্তায় হাঁটা দায়।’ ডোম্বি আবার নৌকার কাছি খুলে দেয়। অরণীবাবু উঠলে আর কাউকে নৌকায় ওঠানো যাবে না, সবসময় একলা পারাপার চায়। মনে মনে বিরক্ত হলেও ডোম্বির উপায় নেই। নইলে দরবারে ঠুকে দিলে খামোখা শাস্তি। ডোম্বি কাছিটা একপাশে গুছিয়ে রাখে। 

‘দেখিস, সাবধানে রাখ। জল ছিটাসনে। 

ডোম্বি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। বামুনদের এসব কিছুতে ও মজা পায়। আসল চরিত্র যে কী তা তো ওর চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। এরা রাতে ইঁদুর, দিনে বেড়াল। ভাবলে ঘেন্না হয়। 

‘আ মোলো হাসির কী ঘটা!’ 

‘ভয় নেই। আমার কাছি আপনাকে ছুঁয়ে দেবে না। ও লোক চেনে, আচারবিচার বোঝে।’ 

‘হয়েছে ঢং রাখ।’

ডোম্বি হাসতে থাকে। রেগে যায় অরণী। ধমক দিয়ে বলে, ‘তুই থামবি কি না বল?’ 

‘এটুকু নিয়েই তো বেঁচে আছি। তাও বন্ধ করে দেবেন?’ 

‘যতসব ছিনালিপনা। দেখলে গা জ্বলে।’ 

অরণী দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে গাল দেয়। তারপর নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। গজগজিয়ে বলে, ‘যা হাসির ছিরি, নৌকাটা না ডুবলেই বাঁচি।’ 

অরণীর মেজাজ খারাপ হয়ে থাকে। দোম্বির বইঠায় ছপছপ শব্দ হয়। আড়চোখে অরণী বার বার সেদিকে তাকায়। মেয়েলোকটা ইচ্ছে করে জল না ছিটোলেই হয়। এদেরকে বিশ্বাস নেই। ডোম্বি অবশ্য আজ আর কোনো বদমায়েশি করে না। নইলে অনেক সময় এমন কায়দা করে জল ছিটোয় যেন ওর কোনো দোষ নেই, নৌকা বাওয়াটাই এমন। ঘাটে এসে নৌকা ভিড়তেই অরণী লাফ দিয়ে নেমে যায়। দূর থেকে একটা কড়ি ছুঁড়ে দেয় ডোম্বির দিকে। নৌকার পাটাতনে সেটা ঠক করে পড়ে। ডোম্বি কুড়িয়ে নিয়ে কোমরে গুঁজে রাখে। 

ঘাটের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকা ছুটকির ব্যাপারটা ভালো লাগে না। অমন করে কড়ি দিতে ও আগে দেখেনি। তাই ডোম্বিকে জিজ্ঞেস করে, ‘অমন করে কড়ি দুটো ছুঁড়ে দিল কেন মাসি?’ 

‘আমরা যে ছোটোলোক তাই। যদি হাতে হাত লেগে যায়।’ 

‘আমরা কেমন করে ছোটোলোক হলাম মাসি?’ 

‘কী জানি, জানি না।’ 

‘আমাকে কেউ অমন করে কড়ি দিলে আমি ঘুষি মেরে তার নাক ফাটিয়ে দেব।’ 

ডোম্বি খুব আগ্রহ নিয়ে বলে, ‘পারবি ছুটকি?’ 

‘খুব পারব।’ 

‘তাই যেন পারিস ছুটকি, তাই যেন পারিস।’ 

ডোম্বি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছুটকির বড়ো বড়ো চোখের পাতায় সর্বনাশা ঝড় আবিষ্কার করতে চায়। ওদের গড়তে হবে। খেয়া পারাপারের জন্য দুজন বুড়োবুড়ি এসেছে। ডোম্বিকে আবার কাছি খুলতে হয়। ছুটকিও উঠে বসে নৌকায়। এপারে এসে কাকুতিমিনতি শুরু করে বুড়োবুড়ি। 

‘পারের কড়ি দিতে পারব না বাপু। একটাও কড়ি নেই।’ 

‘তা হবে না।’ 

ডোম্বি বুড়ির হাতের পুঁটলি কেড়ে নিয়ে খুলে ফেলে। গোটা কয়েক তিলের নাড়ু, পাঁচ সাতটা মোয়া। কয়েক টুকরো নোনা ইলিশ, পানসুপারি, এমনি হাবিজাবি কতকিছু। কিন্তু কড়ি নেই। ডোম্বি পুঁটলিটা রেখে দিয়ে বুড়ির কোমর হাতড়ায়, না নেই। ও অবলীলায় বুড়োর কোমরও খোঁজে, কিন্তু খালি। দু- জনের পা ধূলিধূসরিত, কাপড় হাঁটু পর্যন্ত ওঠানো এবং ময়লা, কারও গায়ে জামা নেই। চেহারায় ক্লান্তি, চোখে পিঁচুটি, ডোম্বির মনে হয় ওদের চামড়ার ভাঁজে বুঝি ধুলো জমে আছে। অথচ বুড়ির কপালে জ্বলজ্বলে সিঁদুর। এতকিছুর মধ্যে ওই লাল রঙের জন্য বেশ দেখাচ্ছে বুড়িকে। 

বুড়ি কাকুতিমিনতি করে, ‘পায়ে পড়ি ছেড়ে দে মা। একটাও কড়ি নেই। তিন কোশ পথ হেঁটে এসেছি। জামাইর বাড়ি যাচ্ছি, মেয়েটার অসুখ।’

‘তা যে চুলোয় খুশি সে চুলোয় যাও। কড়ি দিয়ে যেতে হবে। নইলে রেহাই নেই। জামাইর বাড়ি গিয়ে তো ঢেঁকিশাক দিয়ে নোনা ইলিশ রেঁধে খাবে। আমি কী করব? ওইসব হবে না বাপু। সারা দিন গায়ে খেটে দুটো কড়ি না পেলে কি দিন চলে?’ 

বুড়োবুড়ি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, কথা বলতে পারে না। আগে কখনো এমন হয়নি। ভেবেছিল হাতে-পায়ে ধরলে পাটনি পার করে দেবে। কিন্তু এ যে বড়ো কঠিন তা কেমন করে জানবে! একটু পর বুড়ি বলে, ‘ঠিক আছে মা তুই দু-খান মাছ আর এক আঁটি শাক রেখে দে। 

‘ঠিক আছে দাও। দুটো নাড়ুও দিও।’ 

বুড়ি তাড়াতাড়ি পুঁটলি খুলে জিনিসগুলো ডোম্বির হাতে দিয়ে নেমে যায়। ওদিকে তাকিয়ে ছুটকি বলে, ‘আচ্ছা মাসি তুমি ওদের ছেড়ে দিলেই তো পারতে?’ 

‘না রে বিনে কড়িতে পার করলে লক্ষ্মী থাকে না। 

‘কেন, কানু কাকা তো প্রায়ই কড়ি না দিয়ে নেমে যায়। 

‘তোর কানু কাকা আর ওরা বুঝি সমান হল?’ 

‘তা তো না, তবে পারাপার আর কড়ি তো সবার জন্য সমান। কানু কাকা না দিলে তোমার লক্ষ্মী থাকে?’ 

‘তোর কানু কাকা তো দিতেই চায়। আমিই নেই না।’ 

‘কেন নাও না?’ 

ডোম্বির বুকে মৃদু কাঁপন জাগে। লাল হয়ে ওঠে গাল। বলে, ‘এমনি নেই না। ইচ্ছে হয় না।’

‘আমারও কানু কাকার জন্য কিছু করতে ভালো লাগে। ওদিন গাছের পাকা ডালিমটা দিয়ে এসেছি মা-কে লুকিয়ে। আমি বড়ো হয়ে দূরদেশে গিয়ে কানু কাকার জন্য লেখার কাগজ নিয়ে আনব।’ 

ডোম্বি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ছুটকি একটুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘আচ্ছা মাসি এই নদীটা কোথায় গিয়ে বাঁক নিয়েছে?’ 

‘জানি না।’ 

‘আমার বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। জানো মাসি মনে হয় মাছ হয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যাই অনেকদূরে। দেখি কোথায় কোথায় নদী বাঁক নেয়। দেখতে ইচ্ছে করে নদীর তীরে কত মানুষ ঘর বেঁধেছে। ঘরের চালগুলোই বা কেমন? আচ্ছা মাসি?’ 

‘বল।’ 

‘নদীর পানি ঘোলা কেন?’ 

‘জানি না।’ 

‘তুমি কিচ্ছু জানো না। জানো কেবল নৌকা বাইতে।’ 

ছুটকি রেগে যায়। ওর কত কী যে জানতে ইচ্ছে করে। যেখানে আকাশটা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে সেখানে যেতে ইচ্ছে করে। বসে বসে গাছগাছালির বেড়ে ওঠা দেখতে ইচ্ছে করে। এখন আর একটি জিনিস জানার জন্য মন ব্যাকুল হয়েছে। রাজদরবারে গিয়ে রাজাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ‘আমরা কেমন করে ছোটোলোক হলাম।’ 

‘মাসি?’ 

‘তুই বাড়ি যা ছুটকি। তোর মা খুঁজবে।’

‘তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে না, তাই তো?’ 

‘তোর সঙ্গে কথা বলব কী রে? তুই তো আমার চাইতে অনেক বেশি জানিস।’ 

‘বুঝেছি বুঝেছি, আমাকে আর বোঝাতে হবে না।’  

ছুটকি জোরে জোরে নদীর পানিতে পা নাচায়। বইঠা ধরে নাড়িয়ে দেয়, তারপর চুপচাপ উঠে চলে যায়। ও হাঁটতে হাঁটতে দূরের পাহাড়ের দিকে যায়। ডোম্বি অবাক হয়, ভীষণ চালাক ছেলে তো। কেমন অবলীলায় বাড়তি কথাটুকু বুঝে যায়। পারাপারের লোক নিয়ে জলের বুকে পরম অবহেলায় নৌকা বায় ডোম্বি, যেন কোথাও কোনো দায়ভার নেই। দাঁড়ে হালে কাছিতে সর্বত্র এক সাবলীল নিরুদ্বেগ পরম সুখে খেলা করে। কেবল বিনে কড়িতে পারাপারে যত কড়াকড়ি, হাজার মিনতিতে মন গলে না। কিন্তু ছুটকি ঠিকই বলেছে, কানুকে ছেড়ে দেয় কেন? শুধু ছাড়া নয়, দিতে চাইলেও নেয় না। এর উত্তর কি কাউকে বলা যায়? আপন মনে হাসে ডোম্বি। শুধু একটি মানুষ ওকে নদীর মতো উদার করে দেয়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *