অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৫

অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৫

ব্রাহ্মণ মন্ত্রী দেবল ভদ্র বৌদ্ধ রাজা বুদ্ধমিত্রের অপরিহার্য অঙ্গ। দেবল ভদ্র ছাড়া কোনো রাজকাজ চলে না। বৌদ্ধ রাজা বেদ-বিরোশি হলেও আর্য-সংস্কারের বিরোধী নয়। ব্রাহ্ম্য সমাজের সঙ্গে আপোস করেছে বুদ্ধমিত্র। সে কারণে তার রাজসভায় ব্রাহ্মণ মন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে অনেক রাজকর্মচারী নিযুক্ত রয়েছে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা এখানে নিত্যদিন আসর বসায়। স্বভাবতই বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের ক্রিয়াকর্মের হোতা হয়ে ওঠে তারা। সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের গভীরে এ শিকড় প্রোথিত হয়ে যায়, আর এ আধিপত্যের শিকার হয় নিম্নবর্ণের মানুষ। 

বুদ্ধমিত্র দেবল ভদ্রকে নিষ্কর জমি দান করেছে, মাইলের পর মাইল সে জমির বিস্তার, বিশাখাদের বাড়ির পাশের টিলার গা ঘেঁষে এ জমির সীমানা শুরু, শেষ যে কোথায় দেবল ভদ্র নিজেও হদিস করতে পারে না। চন্দ্র-সূর্য-চাঁদ-তারা যতদিন স্থির থাকবে ততদিন পর্যন্ত দেবল ভদ্র বংশপরম্পরায় এ জমি ভোগ করবে, যে রাজাই আসুক রাজকোষে তাদেরকে কোনো রাজস্ব দিতে হবে না। অবশ্য রাজা বুদ্ধমিত্র এজন্য দানপুণ্যের একষষ্ঠ ভাগের অধিকারী হয়েছে, তাই তার লাভ, নরকের দ্বার বুদ্ধমিত্রের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। দেবল ভদ্রকে যথেষ্ট সমীহ করে বুদ্ধমিত্র, আচারে এবং অনাচারে দু-ভাবেই দেবল ভদ্র এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। ফলে আধিপত্য এবং অর্থ দুই-ই এখন তার হাতের মুঠোয়। 

বুদ্ধমিত্র এবং দেবল ভদ্র দুজনেই ইন্দ্রিয় কর্তৃক শাসিত হতে বড়ো বেশি ভালোবাসে, জীবনকে তারা বোঝে ভোগে, সে ভোগ যেভাবে যে পথে যে উপায়েই হোক না, কোনো আপত্তি নেই। এ ছাড়া জীবনের আর সব ফাঁকি, ওই ফাঁকিতে পড়লে জীবনকে কেউ আর ভোগ করতে পারে না। তাঁদের দুজনের জীবনদর্শন আশ্চর্যভাবে মিলে যায়, তাই কোনো বিরোধ নেই। স্থায়ী নর্তকী মাধবী আছে রাজদরবারের জন্য, কিন্তু তাতেও হয় না। রাতের অন্ধকারে চর আসে তাঁদের সুখের উপকরণ খুঁজতে। এ ছাড়া বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠান তো লেগেই আছে। পানীয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যায় অনেক মেয়ের শরীরের কলস, বিরামহীন এ আকাঙ্ক্ষা। জীবনের এ উৎসবকে বহুবিধ বর্ণ আর সঙ্গীতে সাজাতে দক্ষতার সীমা নেই দেবল ভদ্রের, কী যে সঞ্জিবনী শক্তি ক্রিয়া করে তার নিপুণ আকাঙ্ক্ষায়। আয়েশের বিশ্রম্ভ আলাপে বসে অন্ধকারের আকাশ হাতড়ে চাঁদ খোঁজে দেবল ভদ্র। এসব অনাচারের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে আপত্তি করে পণ্ডিত সুধাকর ভট্ট—জ্ঞান, অনুশীলন এবং শাস্ত্ৰ- আলোচনা ছাড়া জীবনের আর কোনো অর্থ যার জানা নেই। কিন্তু সুধাকর ভট্টকে পরোয়া করার মতো লোক দেবল ভদ্র নয়, তবে মাঝে মাঝে সমীহ করে। সুধাকর ভট্টের ব্যক্তিত্ব অসাধারণ, অস্বীকার করার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও সমীহ না করে উপায় নেই। বুদ্ধমিত্র এই পণ্ডিতকে শ্রদ্ধা করে, সেজন্য মন্ত্রীর জোর সবসময় খাটে না, অনেক কিছুই চুপচাপ হজম করে নিতে হয়। 

রাজসভার এ ধরনের পরিবেশ কখনো ভীষণ শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে ওঠে কাহ্নুপাদের জন্য, বলির পাঁঠার মতো ছটফট করে কেবল। ব্রাহ্মণরা সবসময় কোণঠাসা করে রাখে ওকে। মুখটি খুলবার জো নেই, অথচ ও নিজে একজন কবি, সে-কথাও ভুলতে পারে না। ভেতরে প্রকাশের আকাঙ্ক্ষা যখন তীব্র হয় তখন ওই রাজসভা তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করে কাহ্নুপাদের। ও প্রবলভাবে অনুভব করে যে ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিতদের রাশভারী সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি ওর লৌকিক ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, এ ভাষাতেই কথা বলে ওর মতো শত শত জন। ওরা ওকে নিয়ে যত হাসাহাসি এবং বিদ্রুপ করুক না কেন, ওই ভাষাই কাহ্নুপাদের বুকের ভাষা, সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই, নেই নাড়ির টান। সেজন্য মাথাব্যথাও নেই, যতই পবিত্র এবং রাজসভার ভাষা হোক না কেন। শাস্ত্ৰ আলোচনার পাশাপাশি মাসে একটা-দুটো গীতের আসর বসে। দেবল ভদ্রকে অনেক অনুনয় বিনয় করা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত একটাও গীত পড়ার অনুমতি পায়নি ও, উপরন্তু ব্যঙ্গ করেছে মন্ত্রী, ‘ছুঁচোর কেত্তন’ বলে ওকে ভাগিয়ে দিয়েছে। বলেছে, লৌকিক ভাষা অগ্রাহ্য, অকথ্য। ‘নম্নেচ্ছিতবৈ, নাপাভাবীতবৈ’। এটা ম্লেচ্ছ ভাষা, এই ভাষা ব্যবহার করলে অপরাধ হয়, যদি কেউ ব্যবহার করে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কাহ্নুপাদ ভেবে পায় না যে রাজদরবার আর পুজো-অর্চনা ছাড়া যে ভাষার কোনো ব্যবহার নেই তার এত মূল্য কীসের? মাথায় তুলে রাখলে তো তার প্রবহমানতা থাকে না। বরং ওদের মুখের ভাষাই মুখে মুখে ঠিক থাকবে, বিস্তৃত হবে এক জন্ম থেকে আরেক জন্মে। ভাবতে গিয়ে ওর মাথায় ঝিম ধরে, দেবল ভদ্রের টুটিটা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। নিজের মুখের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে, তখন কাহ্নুপাদের মুখের কালো রং বেগুনি হয়ে যায়। 

রাজসভায় আগামীকাল নৃত্যগীতের আসর বসবে সন্ধ্যায়। ফুল-লতা-পাতা-আলপনায় উৎসব-প্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছে। ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলবে গোধূলির পর। দেবল ভদ্রের উৎসাহের শেষ নেই। স্থায়ী নর্তকী মাধবী ছাড়াও আরও পাঁচজন তরুণী এসেছে। তাই আজ সারাদিনের ছুটি। গতকাল কাহ্নুপাদ দেবল ভদ্রের অলক্ষে বুদ্ধমিত্রের কাছ থেকে কথা আদায় করেছিল যে আজকের উৎসবে ওর লেখা গীত ও রাজসভায় পড়বে। বুদ্ধমিত্র রাজি হয়। আনন্দে দিশেহারা কাহ্নুপাদ ছুটতে ছুটতে বাড়ি আসে, ভাবতে পারেনি যে বুদ্ধমিত্র এত সহজে রাজি হবে। ফেরার পথে নৌকায় ডোম্বির সামনে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে, ‘কাল আমার গীত রাজসভায় পড়ব মল্লারী।’ 

‘সত্যি?’ মল্লারীর বইঠা নদীর বুকে জোর শব্দ ওঠায়। 

‘এতদিনে আমাদের ভাষার মর্যাদা হবে মল্লারী। আমি দেখাব ওদের ওই বড়ো বড়ো তালের মতো শব্দগুলো কেবল ভাষা নয়। আমাদের ভাষা ঝরঝরে, প্রাণবন্ত। আমাদের ভাষা সজীব। কী বলো মল্লারী?’ 

‘হ্যাঁ, ঠিক। যখন তোমার গীত গাই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তখন আমার চোখ দিয়ে জল ঝরে।’ 

‘মাঝে মাঝে তাই ভাবি মল্লারী যে দরকার নেই ওই রাজসভার। তোমার মতো হাজার জনের কণ্ঠই তো আমাদের সব, কিন্তু পারি না, যখন ওরা অবজ্ঞা করে তখন ওদের ঘাড়ে পা রেখে আমার ভাষার শক্তি দেখাতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে নিজের ভাষাটা ওদের সামনে মুকুটের মতো মাথায় পরি। এ ভাষায় যে নদীর স্রোত আছে তা ওদের জানা দরকার। এটা আমাকে করতেই হবে মল্লারী।’ 

একটানা কথা বলার আবেগে, উচ্ছ্বাসে কাহ্নুপাদের বুক হালকা হয়ে যায়। যতক্ষণ এসব ভাবে ততক্ষণ বুকের মধ্যে ভারী বোঝা জমে থাকে। ও নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে দেয়। 

‘তোমার হাতে জাদু আছে কানু, মুখের ভাষা তুমি বুকের ভাষা করে দাও। কেমন করে পারো?’

ও মৃদু হাসে, ‘কী জানি, জানি না তো।’ 

আনমনে দূরের বনে তাকিয়ে থাকে। মনে হাজার ভাবনা। 

‘রাজা তোমার কথায় রাজি হল কেন কানু? নেশার ঘোরে বলেনি তো? 

‘না গো না। রাজা খুব ভালো।’ 

আনন্দের আতিশয্যে কাহ্নুপাদ বিচারবুদ্ধিহীন সরল শিশু হয়ে যায়। কোনো কিছু তলিয়ে বিচার করতে গিয়ে নিজের সৃষ্টির উৎস রুদ্ধ করতে চায় না। ওর মগজে এখন অনেক পংক্তি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে। 

ডোম্বি কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলে, ‘কী জানি আমার ভয় করে।’ 

‘ও কিছু না।’ কাহ্নুপাদ হেসে উড়িয়ে দেয়। এক কোষ জল তুলে ডোম্বির দিকে ছুঁড়ে মেরে বলে, ‘ভয় কেন বলো তো?’ 

‘আমরা যে ছোটো জাত। আমাদের তো সবটাতে অপরাধ।’

ডোম্বির কণ্ঠে ঈষৎ ব্যঙ্গ। কাহ্নুপাদ কথা বলতে পারে না, এর উত্তর ওর নিজেরও জানা নেই। এ নিয়ে ভাবলে ওর মাথা গরম হয়, কিন্তু উপায় খুঁজে পায় না। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নিজের লোকজনদেরও জোরেসোরে কিছু বলতে পারে না। ওদের বিশ্বাস এটাই সত্য, যেমন সত্য চাঁদ- সূর্য, তেমন ছোটোলোক হওয়াটা ওদের নিয়তি। নিয়তির বিরুদ্ধে কথা বলতে নেই। কিছু বললে সব চারদিক থেকে হা-হা করে ছুটে আসে, বলে, ছোটো মুখে বড়ো কথা মানায় না। বলে, বড়ো কথা বললে ভগবান সইবে না। কাহ্নুপাদ ওদের বোঝাতে পারে না, ওদের যে নির্যাতন সইতে হয় এটা ভগবান সয় কী করে? ওরাই কি কেবল ভগবানের পুত্র, এরা কি কেউ নয়? তা না হলে ওদের জন্ম কেন? তাই ওকে চুপ করে থাকতে হয়, অপেক্ষা করে সময়ের, সময় হয়তো এদের চোখ খুলে দেবে। নৌকা কূলে ভিড়লে কাহ্নুপাদ লাফ দিয়ে নেমে যায়, ঘরে ছোটে, আজ ওর ভেতরে প্রবল উত্তেজনা। সন্ধ্যার অনেক বাকি, শবরীর প্রসাধন প্রায় শেষ, ও ময়ূরের মতো পেখম ধরেছে কেবল। 

কাহ্নুপাদ হুড়মুড়িয়ে ঢোকে, ‘আহ্ এই মুহূর্তে তোমাকে এমন সাজেই চাইছিলাম সই!’ 

শবরী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, এমন সময়ে কাহ্নুপাদকে আশা করেনি; কানুকে একদম অন্যরকমও লাগছে, যেন ও ঘোড়া ছুটিয়ে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে, এলোমেলো চুল কপালে লুটিয়ে আছে, উদ্দীপ্ত চেহারা, গরম নিশ্বাস আসছে নাকের রন্ধ্রপথে। 

কাহ্নুপাদ ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, ‘দেখছ কী সই?’ 

‘তুমি যেন তুমি নও’, শবরীর কণ্ঠে বিস্ময়। 

‘আমি এখন তোমার অন্য কানু।’ 

‘হ্যাঁ, তা তো দেখছি। অন্যসময় হলে এতক্ষণে রেহাই দিতে না আমাকে। 

‘আজ তোমাকে ছোঁব না সই। এই মুহূর্তে তুমি আমার মুখের ভাষা। আজ তোমায় আমি পুজো দেব। 

‘কী বলছ কানু?’ 

‘কাল রাজসভায় আমার গীত পড়ব।’ 

‘সত্যি?’ 

‘হ্যাঁ সই। আজ আমার সাধনার রাত।’ 

শবরী হেসে মাথা নাড়ে, ‘তাই হবে। আমিও তোমার সঙ্গে রাত জাগব।’ 

মধ্য যামিনী পেরিয়ে যায়, ঘুমুতে পারে না কাহ্নুপাদ, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে শবরী, কাহ্নুপাদ ওকে ঘুমুতে বলেছে, কিন্তু ও রাজি হয়নি। হরিণের চামড়া বিছিয়ে তার ওপর উপুড় হয়ে লিখছে কাহ্নুপাদ, পছন্দ হয় না। ছিঁড়ে ফেলে, আবার লেখে। শেষরাতের দিকে হরিণের চামড়ার ওপর ঘুমিয়ে পড়ে। 

দু-জনেরই ঘুম ভাঙে বেশ বেলায়, জানালা দিয়ে আলো এসে ভরে আছে ঘর। শবরী নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। ঘুম ভাঙতেই ওর মনে হয়েছিল যে ওর চাঁচর বেড়ার বাড়িতে আজ উৎসব, কানুকে সারাদিন বাড়িতে পাবে, শবরীর খুশির সীমা নেই। কাহ্নুপাদ নদী থেকে স্নান সেরে এসে লিখতে বসেছে, ওর চুলের মাথায় জল, চেহারায় রাত জাগার ক্লান্তি নেই। শবরী রান্নার জোগাড় করছে। কানুর প্রিয় কচ্ছপের মাংস রাঁধবে, প্রচুর মশলা, দই, রাই সরিষায় সে ব্যঞ্জনের গন্ধ টিলার গায়ে ম-ম করবে। ভাত, গম, গুড়, মধু, ইক্ষু, তালরস গাঁজিয়ে মদ তৈরি করা ছিল, আজ তা কানুর সামনে দেবে। নালিতা শাকের ঝোল করবে, সঙ্গে মুসুরির ডালের বড়া। ওর মনে হয় প্রিয়জনকে কেন্দ্র করে এ উৎসবকে আপন মনে ভরিয়ে রাখা যায়, এখানে লোকের আগমন চলে না, একাকী খুশির এই ভীষণ আবেগে শবরী মগ্ন হয়ে থাকে। কাহ্নুপাদের মনের সঙ্গে যার বিন্দুমাত্র যোগ নেই। রান্নাবান্না শেষ করে বেড়ার গায়ে মেঝেতে আলপনা আঁকে শবরী। তারপর হাতে পায়ে কাঁচা হলুদ মাখে, একটু পরে দিঘল চুল ছেড়ে দিয়ে নাইতে যায়। পায়ে মল নেই, তবু মনে হয় ওর প্রতি পদক্ষেপে ঝুমঝুম শব্দ হচ্ছে। 

এদিকে কাহ্নুপাদ তখন ক্রমাগত নিজের ওপর বিরক্ত হচ্ছে। কোনো পংক্তিই পছন্দ হয় না, পুরোটা তো পরের ব্যাপার। কখনো মনে হয় নিজের জ্বালার কথা উচ্চস্বরে বলে, পরক্ষণে চুপসে যায়, তাহলে ওরা ওকে মেরে ফেলবে। মৃত্যুকে ওর ভয় নেই, কিন্তু এখন যে কত কিছু করার আছে বলে মনে হয়? ও দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। কুক্কুরীপাদ এজন্য বলে, ‘রুখের তেগুলি কুম্ভীরে খাঅ।’ সরাসরি বলতে পারে না বলে কুক্কুরীপাদ এমন আবরণ দিয়ে বলে। চমৎকার কথা বলে কুক্কুরী। ওদের জীবনের গাছের তেঁতুল ওই দেবল ভদ্রের মতো হোঁতকামুখো কুমিরে খায় বলেই তো ওদের এত যন্ত্রণা। সমাজে ঠাঁই নেই, মুখের ভাষার দাম নেই, ঘরে নিত্য অভাব। নইলে এত ধান, এত কার্পাস, নদীতে পুকুরে মাছ—কীসের অভাব ওদের? সব ওই রাজার গোলায় যায়, ছোটোলোকদের জন্য কেবল নেড়াকুটা। আর কী? এতেই তো ওদের বর্তে যাওয়া উচিত। প্রচণ্ড ক্রোধে ও একবার লিখে ফেলে ডোম্বির কথা— 

নগর বাহিরেঁ ডোম্বি তোহোরী কুড়িআ 
ছই ছোই যাইসি ব্রাক্ষ্ম নাড়িয়া 

দু-পংক্তি লিখে পরক্ষণে তা কেটে দেয়। দরবারে বসে এই কথা বললে ওরা ওখানেই ওকে টুটি ছিঁড়ে মেরে ফেলবে। যত অনাচার সব ওদের জন্য শুদ্ধ, ছোটোলোকেরা তা বলতে পারবে না। সেজন্য কুক্কুরীপাদের মতো ভাষার আবরণ খোঁজে কাহ্নুপাদ। 

তিনি ভুঅন মই বাহিঅ হেঁলে 
হাঁউ সুতেলি মহাসুহ লীডেঁ! 

না, হচ্ছে না। একথা লিখে কী হবে? তিনি ভুবন আমার দ্বারা অবহেলায় বাহিত হল, মহাসুখ লীলায় আমি লিপ্ত রয়েছি। যন্ত্রণাটা তত তীব্রভাবে প্রকাশিত নয়, আরও তীব্র করা চাই। আবার কাটাকাটি শুরু হয়। শবরীর ভেজা চুল থেকে জল ঝরছে, পরিপাটি আঁচড়িয়েছে চুল। তোরঙ্গ থেকে ধোয়া শাড়ি বের করেছে, পায়ে আলতা। বেলা বয়ে যায় তবু কাহ্নুপাদের লেখা শেষ হয় না। শবরী ময়ূরটাকে খেতে দেয়। তখন মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে কাহ্নুপাদ একটু স্থির হয়, আর অস্থির হবে না বলে ঠিক করে। আগের একটা লেখা ভীষণ পছন্দ হয়, ওটাকেই ঠিকঠাক করে নেয়। 

আলিএঁ কালিএঁ বাট রুন্ধেলা। 
তা দেখি কাহ্নু বিমনা ভইলা।। 
কাহ্নু কাঁহ গই করিব নিবাস। 
জো মন গোঅর সো উআস।। 

হ্যাঁ, এটাই হবে। ভীষণ অন্ধকারে পথ রুদ্ধ, তা দেখে কাহ্নু বিমনা হল। কাহ্নু কোথায় গিয়ে নিবাস করবে, যারা মনোচোর তারাই উদাস। এর সঙ্গে আরও ছয় পংক্তি দিব্যি এসে যায়, ও চটপট লিখে ফেলে, কয়েকবার পড়ে, তারপর খুশি হয়ে যায়। কিন্তু খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, ভাবে ভাষার আবরণ না রাখতে হলে ওর রচনা আরও তীব্র হত, বুকের জ্বালা উজাড় করে কথা বলতে পারত। ও বিষণ্ন হয়ে থাকে। 

খাবার নিয়ে অপেক্ষা করে শবরী। বাতাসে ব্যঞ্জনের গন্ধ ভাসে। মনটা ক্রমাগত দমে যেতে থাকে। এত আয়োজন, এত যত্ন যার জন্য সে একবারও ফিরে তাকালো না। মন খারাপ করা নিরুৎসাহ শবরীকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এ পর্যন্ত তিনবার ডেকেছে কানুকে, হুঁ-হাঁ করা ছাড়া কোনো কথা বলেনি কানু, যেন কোনো খিদে নেই, খাবার কথা একদম ভুলে গেছে। বাইরে বৈশাখের বাতাসের দাপট, অনেক দূর থেকে এসে ঝাপটা দিয়ে যায়, কার্পাসের শুকনো পাতা এসে ঘরে পড়ে। পায়ের নীচে চেপে সেটা গুঁড়িয়ে ফেলে শবরী। ছোটো জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ও, দূরে নদীর ধারে মানুষ নেই, নদী নিস্তেজ পড়ে আছে, যেটুকু স্রোত সেটুকু প্রাণের স্পন্দনমাত্র। খাঁ-খাঁ দুপুর, শবরীর কিছু ভালো লাগে না, সাদা কার্পাস ঘূর্ণিতে পড়ে পাক খায়। কাল সারা রাতই প্রায় জেগেছিল, ঘুমুলো আর কতক্ষণই-বা! এখন ঘুম পাচ্ছে, বিরক্ত লাগছে, ইচ্ছে করে শুয়ে থাকতে, দুপুর দেখতে ভালো লাগে না, দুপুর তাতানো, ঝাঁঝ এসে চোখে জল ঝরায়, চোখ জ্বালা করে। শরীর এবং মেজাজ খারাপ হয়ে থাকে। এ আয়োজন যার জন্য সে আজ শবরীর কথা ভুলে গেছে। 

দুপুর গড়িয়ে যাবার পর ওঠে কাহ্নুপাদ, মন বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। যদিও ওই গীতটা লেখার পর বেশ একটা বিশ্বাস হয়েছে নিজের ওপর, অন্তত একটা ভালো লেখা দাঁড় করাতে পেরেছে, কিন্তু দ্বিধামুক্ত হতে পারে না। পণ্ডিতের দল বাঘের মতো বসে থাকে, সুযোগ পেলেই হালুম করে ঝাঁপিয়ে পড়া কেবল। এমনিতেই ওরা কেউ ওর ওপর খুশি নয়, জোর করে নিজের দাবি জানাতে হয়, কাহ্নুপাদের স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে থাকে। শবরীর দিকে চাইবার ফুসরত নেই। ওর পায়ের আলতা, ঘরের আলপনা কোনো কিছুই তেমন করে নজরে আসে না। মৌজ করার মতো দুপুরটা আজ শীতল। 

খেতে বসেও ঠিকমতো খেতে পারে না কাহ্নুপাদ। যত্ন করে রাঁধা প্রিয় খাবারগুলো সব বিস্বাদ মনে হয়। বুকের ভেতর কী একটা আটকে আছে। ভয়, শঙ্কা ইত্যাদি নানা বোধ ওকে পিছু টেনে রাখে। মনে হয় ভীষণ একটা আগুনের পরিখা ওর পায়ের কাছে। এদিকে থালার ওপর কানুর ভাতের নাড়াচাড়ায় শবরীর চোখ ফেটে কান্না আসে, রাগও হয় নিজের ওপর। যাকে সে ভেবেছিল শ্রেষ্ঠ উপাচার কানু তাকে অবহেলা করে যাচ্ছে। ঝিমধরা অনুভূতি ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলে, ‘কিছুই খাচ্ছ না কেন তুমি?’ 

‘ধুত, ভালো লাগছে না। আজ তুমি একটুও মনোযোগ দিয়ে রাঁধোনি। 

থালাটা ঠেলে দিয়ে উঠে যায় কাহ্নুপাদ। হাঁড়িকুঁড়ি বাসনকোসনের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকে শবরী। সারাদিন দু-জনে দুটো ভিন্ন জগতে কাটিয়ে এখন কী করে একে অপরের মনের কথা বুঝবে? কারও চিন্তার সঙ্গে কাজের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না, দু-জনে নিজেদের মধ্যে কোনো সেতু তৈরি করেনি, ফলে দু-জনে দুই ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে আসে অপরিচিত মানব-মানবী হয়ে। কাহ্নুপাদ নীচ থেকে ফিরে এসে শবরীকে দেখে অবাক। 

‘ও কী, তুমি অমন করে বসে আছ কেন? কী হয়েছে তোমার সই?’ 

শবরীর চোখে জল টলমল করে। 

‘কাঁদছ?’ 

বিস্মিত হয় কাহ্নুপাদ। সারা দিনের ঘটনা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কই না কিছুই তো হয়নি, কথা কাটাকাটি না, মনোমালিন্য ঝগড়াঝাটি না। তবুও কাঁদছে কেন শবরী? হঠাৎ মনে হয় সকাল থেকে শবরীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। ও একবারও ওর কথা ভাবেনি, ওকে বুঝবার চেষ্টা করেনি, হয়তো ওকে কেন্দ্র করে ভীষণ কোনো আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটা ও পূরণ করেনি। সামান্যতম বিচ্ছিন্নতার সুযোগে জীবনযাপনের কত মূল্যবান মুহূর্ত ওলটপালট হয়ে যায়। সম্পর্কটাই এমন, অহরহ একে অপরকে বুঝতে হয়। এই মুহূর্তে কাহ্নুপাদ কবিতা লেখার মতো নিজেকে আবিষ্কার করে, এতদিন সম্পর্কের এ দিকটা ও কখনো ভেবে দেখেনি, আজ শবরীর চোখের জল নিমেষে ওর বয়স বাড়িয়ে দেয়। মনে হয় মাঝে মাঝে একে অপরের কাজ থেকে এভাবে উধাও হয়ে যাওয়াও এক চমৎকার খেলা, একঘেয়েমির সুতোটা গলায় ফাঁস হয় না। শবরীর পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে কাহ্নুপাদ, গালের ওপর গড়িয়ে পড়া পানির রেখা মুছিয়ে দেয়, শীতল ঠোঁটে চুমু খায়। 

‘কী হয়েছে তোমার সই? আমার অপরাধ নিয়ো না।’ 

‘আমার কিছু হয়নি।’ 

‘এতটা বেলা পর্যন্ত তোমার থেকে অনেক দূরে ছিলাম সই। তাই এখন বুঝতে পারছি না যে কী দোষ করেছি?’ 

‘বুঝবার মতো মন নেই তোমার।‘

‘মন?’ 

হো-হো করে হাসে কাহ্নুপাদ। 

‘মন নেই বলেই তো গীত রচনা করি, নইলে কী করতাম সই? ঠিকই বলেছ মন নেই আমার।’

কথাটা ভীষণভাবে আলোড়িত করে ওকে। মন না থাকাই ভালো, এর যন্ত্রণা অনেক, এ যে কী যন্ত্রণা তা কাউকে বোঝানো যায় না, যন্ত্রণার দায়ভার নিয়ে কাহ্নুপাদের রাতদিন হরিণ-পোড়া আগুন। শবরীর দিকে তাকায় ও। ওর সাদা মুখে জলের দাগ, খোঁপায় ময়ূর-পালক নেই, গলায় গুঞ্জার মালা নেই, হাতে কেয়ূর এবং পায়ে মলও না, নিরাভরণ শবরীর দিকে আজ ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকায় কাহ্নুপাদ। সাদা মুখটা ঘিয়ের প্রদীপের নিভু নিভু আলোর মতো উজ্জ্বল হলুদ, কাহ্নুপাদের বুক দুলে ওঠে। উৎসবের বিবর্ণ আলো যখন রহস্যময় হয়ে এক নিষিদ্ধ স্বর্গে হাতছানি দেয় ঠিক তেমনই মনে হচ্ছে শবরীকে, ও এখন উৎসবের শেষ আলোর মতো লোভনীয়। বৈশাখী বাতাস চাঁচর বেড়ার গায়ে দুপদাপ আছড়ে পড়ে, একগুঁয়ে ষাঁড় যেন, রাখালের হাতছাড়া হয়ে গেছে, কারও কথা শুনতে চায় না। তখন কাহ্নুপাদের চোখের সামনে ঘরগেরস্থালির দুপুর তার চালচিত্র হারায়, বদলে যায় হাঁড়িকুঁড়ির ঘেরাটোপ, এই মুহূর্তে শবরী তাই কাহ্নুপাদের সমস্ত আকাঙ্ক্ষার শেষ ঠিকানা। চোখের জল মুছে যায়, সাদা ঠোঁট রক্তাভ, শবরীর বুকের ভেতর সুখের হরিণ কাঁপে।

আঁধার ঘন হবার আগেই রাজসভা জমে ওঠে, ঝলমল করছে চারদিকে, চন্দনের সুবাস স্নিগ্ধ করে তোলে পরিবেশ। কাহ্নুপাদের বুক কাঁপে, বারবার সেমিজের ভেতর হাত রাখে। হ্যাঁ, কাগজটা ঠিক আছে, হারায়নি। সারা দিন ওই দশটা পংক্তির জন্য জীবনযাপন ভুলতে বসেছিল, এখন ওই একখণ্ড কাগজই ওর মতো শত শত লোকের মানসম্মান, বেঁচে থাকা। কাহ্নুপাদ একপাশে চুপচাপ বসে থাকে, আস্তে আস্তে বুকটা বিশাল হতে থাকে। কীসের ভয়? কাকে ভয়? ভয় করলে ভয় বাড়ে, না করলে সেটা বিনষ্ট হয়। ও নিজেকে শক্ত করে। দেবল ভদ্র কেমন বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুদ্ধমিত্র সিংহাসনে অটল, গম্ভীর। ওরা কেউ ওর আপনজন নয়। এই রাজসভায় ও একা লড়াই করতে এসেছে, দাবি জানাতে এসেছে। এইসব ভেবে ও নিজের অবস্থান দৃঢ় করে। পরক্ষণে রাজমহিষী এসে ঢোকেন, কী অপূর্ব। কাহ্নুপাদের চোখে পলক পড়ে না। রূপের ছটার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে মণিমাণিক্যের চাকচিক্য, পরনে মেঘডুম্বুর শাড়ি। দরবারের চেহারা বদলে যায়, সবাই উঠে রজমহিষী চন্দ্রলেখাকে প্রণাম করে। মাপা হাসি রানির ঠোঁটের কোণে। চন্দ্রলেখার জন্য কোনো জুতসই উপমা খুঁজে পায় না কাহ্নুপাদ। হঠাৎ করেই ওর সব ভালোলাগা চুপসে যায়। উৎসবের শুধু প্রথম পর্বের জন্য চন্দ্রলেখা, দ্বিতীয় পর্বে তার কোনো অধিকার নেই। যখন নর্তকীর নূপুরনিক্বণে চঞ্চল হয়ে উঠবে বুদ্ধমিত্রের সমস্ত শরীর তখন চন্দ্রলেখার জন্য দরবারের দরজা বন্ধ, তার স্থান অন্দরমহলে। সে অবস্থান সবসময় প্রতিবাদহীন, চন্দ্রলেখা নিজেও তা জানে এবং জেনেও তা সহ্য করে। এটাই আইন, কোনো কাগুজে আইন নয়, অলিখিত, উত্তরাধিকার সূত্রেই এ আইন এক রাজা থেকে আরেক রাজায় গিয়ে বর্তায়। সব রাজমহিষী অলংকারের মতো এ শর্ত মাথায় নিয়ে অন্তঃপুরে ঢোকে, নির্বিবাদে তা চলে যায় পুত্রবধূদের মাঝে। চন্দ্রলেখা মৃদু হাসছে, দেবল ভদ্রের সঙ্গে দু-একটা কথা বলছে। তার মাথার ওপর দুলছে ময়ূর-পালকের ওপর হিরেমোতির টুকরো বসানো কারুকার্যময় পাখা। ভারী শাড়ি, ভারী অলংকার এবং প্রসাধন কি চন্দ্রলেখাকে ঘর্মাক্ত করেছে? কাহ্নুপাদের ইচ্ছে করে চন্দ্রলেখার উন্মুক্ত হৃদয় দেখতে। নর্তকীর নূপুরনিক্বণের কোন অভিঘাত সেখানে তরঙ্গ তোলে? এক মুহূর্ত শবরীকে না বুঝলে ওর সব কেমন ওলটপালট হয়ে যায়, অথচ ওরা কেমন করে জীবনযাপন এক তারে বেঁধে রাখে? একটুও কি নড়ে না? হয়তো নড়ে, যার খবর ওদের মতো সাধারণ মানুষ কাছে আসে না। 

উৎসবের প্রথম অংশ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের জন্যে। জমে উঠবে শাস্ত্রালোচনা, তত্ত্বকথা, স্বরচিত গীত। উৎসব শুরু হয়, কাহ্নুপাদ উৎসুক হয়ে শোনে। সংস্কৃত ভাষার প্রবল স্রোত বয়ে যায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের ঠোঁটে ঠোঁটে। সেই রাশভারী শব্দগুলো যেন কাহ্নুপাদের ঘাড়ের ওপর প্রহরীর হাতের লাঠির প্রচণ্ড আঘাত, ঘাড় নড়াবার উপায় নেই, কান পেতে শুনতে হয়, রস উদ্ধার করার সামর্থ্য ওর নেই, আগ্রহও নেই বুঝবার, বরং বিজাতীয় ক্রোধ হয়। জীবনের সঙ্গে যার কোনো যোগ নেই তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কাহ্নুপাদের অসহ্য, বিরক্ত লাগে ওর, মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। রাত যত বাড়ে পণ্ডিতরা তত মেতে ওঠে, প্রচণ্ড তর্ক শুরু হয়, কেউ কারও কথা শুনতে রাজি নয়। চঞ্চল হয়ে ওঠে দেবল ভদ্র, স্বয়ং বুদ্ধমিত্রও। চন্দ্রলেখা চলে গেছে দরবার ছেড়ে। কাহ্নুপাদ বসে বসে হাই তোলে। বুদ্ধমিত্র দেবল ভদ্রকে কী যেন ইশারা করে উঠে চলে যায়। দেবল ভদ্রের মেজাজ অসহিষ্ণু হয়ে গেছে, উৎসবের পরবর্তী অংশের জন্যই সে এখন উন্মুখ। রাগ এসে পড়ে কাহ্নুপাদের ওপর। রুক্ষ মেজাজে খেঁকিয়ে ওঠে, ‘এত রাত পর্যন্ত বসে আছিস কেন?’ 

‘গীত পড়ব।’ 

‘গীত?’ 

দেবল ভদ্রের চোখ কপালে ওঠে, ভীষণ বিস্ময়। 

‘কার লেখা গীত?’ 

‘আমার।’ 

‘তোর? তুই কী গীত লিখিস? তুই সংস্কৃতের কী জানিস?’ 

‘সংস্কৃত জানব কেন? আমার ভাষায় লিখেছি।’ 

কাহ্নুপাদ চওড়া বুক টান করে দাঁড়ায়, কালো মিশমিশে পাথুরে গড়নের শরীরটা দ্বিধাহীন এবং ঋজু। ওর মনে হয় ওর কোনো ভয় নেই। 

‘ও ছুঁচোর কেত্তন?’ 

দেবল ভদ্রের কণ্ঠে ব্যঙ্গ। 

‘বেরো এখান থেকে, বেরো বলছি।’ 

দেবল ভদ্রের চোখে আগুন ছোটে। 

কাহ্নুপাদ মরিয়া হয়ে বলে, ‘রাজা আমাকে পড়বার অনুমতি দিয়েছেন।’ 

‘রাজা কে? এই দেবল ভদ্র সব। এখানে রাজার অনুমতিতেও কোনো কাজ হয় না। ভাগ, যতসব ছোটোলোকের কারবার। লাই দিলে মাথায় ওঠে। আবার মুখে মুখে কথা বলা হচ্ছে। শুয়োরের বাচ্চা।’ 

দেবল ভদ্র কাহ্নুপাদের ঘাড় ধরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। দ্বাররক্ষীরা বল্লম উঁচিয়ে তেড়ে আসে। কোনো কিছু বলার আগেই ও দেখতে পায় দ্বাররক্ষীর ধাক্কায় ও দরজার বাইরে এসে পড়েছে, রক্ষী দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। কাহ্নুপাদের মনে হয় আজ রাতের আঁধার খুব গাঢ় সামনে কিছুই দেখা যায় না। ও হতভম্বের মতো একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। চলে যেতে হবে এটাও যেন বুঝতে পারছে না। ওর মনে হয় ওর পায়ের নিচে শিকড় গজিয়ে সেটা মাটিতে প্রোথিত হয়ে গেছে। 

একটু পরে আবার দরজা খুলে যায়। পণ্ডিতরা একে একে বেরিয়ে আসছে। এখনও তারা ভীষণ উত্তেজিত, তর্কের শেষ নেই, চলতে চলতে কথা বলে। কাহ্নুপাদ একজন কবি, তার গাঁয়ের রং অন্ধকারে মিশে যায়, কেউই তাকে দেখতে পায় না। ও বোঝে উৎসবের প্রথম পর্ব শেষ। তখুনি তবলার বোলের সঙ্গে ঝংকৃত হয় নূপুরধ্বনি। নিভু নিভু ঘিয়ের প্রদীপে আবার নতুন সলতে পড়েছে, আলো উজ্জ্বল হচ্ছে। বুদ্ধমিত্র দরবারে আসে। কাহ্নুপাদ ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে। চারদিক অন্ধকার। চাঁদের ক্ষীণ আলোতে পথঘাট চেনা যায় না। ওর কোথাও কোনো জ্বালা নেই, নিজেকে বেশ নির্ভার মনে হয়। কাহ্নুপাদ বুকভরে খোলা মাঠের টাটকা বাতাস গ্রহণ করে। হাঁটতে হাঁটতে নদীর ঘাটে আসে ও। ওর গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছা করে। অনেকদিন আগে মা-র কণ্ঠে শোনা একটি গান বেসুরো গলায় গাইতে থাকে। ওর মনে হয় ওর কণ্ঠ পৌঁছে যাচ্ছে পাহাড়ে, নদীতে, লোকালয়ে। ওর দুঃখ ওর আর একার নয়। বরুয়া মাঝি নৌকার পাটাতনে চিতপাত শুয়ে আছে। কাহ্নুপাদকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে কাছি খুলে দেয়। কাহ্নুপাদ সটান শুয়ে পড়ে। মনে হয় শরীরের প্রতিটি জোড়ায় অসহ্য ব্যথা, প্রতিটি অঙ্গ আলাদা হয়ে যেতে চায়। এতক্ষণে বুকটা কেমন ভার মনে হয়। সেমিজের ভেতর সারা দিনের পরিশ্রম, হাত দিতেই সমস্ত শরীর চনচনিয়ে ওঠে। তীক্ষ্ণ জ্বালা ছনের শূলার মতো মুখ উঁচিয়ে থাকে। নৌকা থেকে নামার সময় টের পায় বুনো রাগ ভেতরটা তাতিয়ে রেখেছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় পা যেন মাটি স্পর্শ করছে না, স্পর্শ করছে আগুন। সোজা রামক্রী আর দেবকীর দোকানের দিকে রওনা করে। শবরীর কথা ও ভোলে না, শুধু মনে করে শবরী নয়, অন্য কাউকে চাই, অন্য কিছু চাই। যেখানে কবিতা লেখার যন্ত্রণা নেই, যারা কবিতা লেখার জন্য হরিণের চামড়া বিছিয়ে দিয়ে খাগের কলম এগিয়ে দেয় না। দোকান বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে ও প্রায় একরকম ছুটতে ছুটতে আসে। না, দোকান বন্ধ হয়নি। দরজার ওপরে সাংকেতিক চিহ্নটা এখনও টাঙানো আছে। কাহ্নুপাদ দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢোকে। দেবকী ঘড়ার মধ্যে মদ ঢালছিল, কাহ্নুপাদকে দেখে কাছে এসে দাঁড়ায়। 

‘কী ব্যাপার, এমন হুড়মুড়িয়ে ঢুকছ যে? মনে হচ্ছে খাওয়ার আগেই বেহুঁশ হয়ে এসেছ?’ 

‘এখনও হইনি, হব বলে এসেছি।’ কাহ্নুপাদ দেবকীর কাঁধে হাত রাখে। পাশের ঘরে রামক্রীর গলা শোনা যাচ্ছে, হয়তো ছেলের সঙ্গে কথা বলছে, হয়তো ছুটকির হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। ও দেবকীর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘এখানে এলে বেহুঁশ না হয়ে কী উপায় আছে? তোমার মুখের দিকে চাইলে নেশা অর্ধেক হয়। আর হাতের মাল যে খায় 

‘বোসো, বোসো। কেবল আদিখ্যেতা, অত সয় না বাপু।’ 

কাহ্নুপাদ হো-হো করে হাসে। বলে, ‘খুশি হওনি বলো তো? আসলে সবই সয় কেবল মুখে স্বীকার করতে চাও না। যাকগে, দ্যাখো ঘড়া আর নল দেবে কিন্তু, তোমার ওই বেলের খোলে আজ আর চলবে না।’

‘আচ্ছা গো আচ্ছা, বুঝতে পারছি জিভ পর্যন্ত শুকনো করে এসেছ। তা কোথায় মরতে গিয়েছিলে? ডুবে আসতে পারোনি।‘

দেবকীর মধুর বাক্যবাণে কাহ্নপাদের বিছুটির জ্বালা কমে যায়। ও মিটিমিটি হাসে, হাসে দেবকীও। তারপর ঘরের কোণ থেকে নতুন ঘড়া আনে, নতুন নলও। 

‘সব যে নতুন দেখছি?’ 

‘তোমাকে কি পুরোনো দেওয়া চলে? নাও গিলতে শুরু করো।’ 

কাহ্নুপাদ ওর হাত ধরে মৃদু আকর্ষণ করে। 

‘বোসো না একটু কাছে।‘ 

‘ধুত! তুমি একটা ইয়ে—’ 

দেবকী ঝট করে হাত ছাড়িয়ে নেয়। ওপাশের ঘর থেকে রামক্রী সাড়া দেয়। 

‘কে এসেছে দেবী? কানুদার গলা যেন?’ 

‘হ্যাঁ গো সেই। বেলের খোলে হচ্ছে না তার, ঘড়া নিয়ে বসেছে।’ 

‘ও বাবা, তা দাও, ভালো করে দাও, যেন আর উঠতে না পারে।’ 

‘থাকবার জায়গা দিলে উঠব না কিন্তু রামক্রী। জানোই তো মানুষের স্বভাব, বসতে পেলে শুতে চায়।’ 

‘ওদিকে বউদির কী হবে?’ 

‘চুলোয় যাক।’ 

দেবকী তর্জনী তুলে শাসন করে, ‘বলতে পারলে?’ 

‘ও কিন্তু কানুদার মনের কথা নয় দেবী।’ 

দেবকী মুখ ঝামটা দেয়, ‘মনের কথা না হলেও বলতে পারবে না।’ 

‘এই নাকে খত দিলাম, আর বলব না। 

‘কানুদাকে ভালো করে দিও দেবী। ওকে তো আর মাতাল করতে পারবে না তুমি।’ 

কাহ্নুপাদ উচ্চহাসিতে ঘর ভরিয়ে বলে, ‘ঠিক বলেছ দাদা, গলা পর্যন্ত ভরলেও পা টলে না কিন্তু। 

‘সে কি আর আমি জানিনে। খাও, খাও, বেশি করে খাও।’ 

কাহ্নুপাদ রামক্রীর সঙ্গে আর কথা বলে না। কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে হাতে তাল ঠোকে। চোখের ইশারায় দেবকীকে ডাকে, দেবকী মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ওর পিঠের ওপর ঘন কালো চুল ছড়িয়ে আছে। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরনে। এক পেঁচে শাড়িতে ওকে দারুণ লাগছে। ওর গলার জুঁই ফুলের মালা থেকে মৃদু গন্ধ আসছে। কাহ্নুপাদ চোখ বুজে গান গাইবার চেষ্টা করে। 

এক জাতীয় গাছের সরু বাকল শুকিয়ে গুঁড়ো করে তা দিয়ে মদ চোলাই করে রামক্রী আর দেবকী। নারকেল, ভাত, তাল ও কাজঙ্গ গেঁজিয়েও মদ তৈরি করে এরা। এক একটার এক-একরকমের স্বাদ, এক-একরকম দাম। খদ্দের পছন্দমতো মদ খায়। সারি সারি চৌষট্টি ঘড়া সাজিয়ে রাখে ওরা। বড়ো বড়ো ঘড়া। চৌষট্টির বেশিও রাখে না, কমও না। ওদের বিশ্বাস চৌষট্টির কম-বেশি হলে ব্যাবসা ভালো চলে না। মদ বিতরণের দুটো পন্থা আছে ওদের। এক, ছোটো ছোটো ঘড়া আর নল। দুই, সমান আকারের বেলের খোল। এর বাইরে অন্যকিছুতে ওরা খদ্দেরকে মদ দেয় না। প্রকাশ্যে মদ বিক্রি করে, এর বিরুদ্ধে দেশের কোনো আইন নেই। রাতের বেলা সব ঘড়া ভরে রাখে দেবকী। দিনের বেলা কোনোদিন একদম সময় পায় না। কোনোদিন আবার ফাঁকাই যায় দোকান। দোকানের পেছনে ওদের ঘর, সেখানে রান্নার অবসরে খদ্দেরের পদশব্দের জন্য উন্মুখ থাকে দেবকী। খদ্দের লক্ষ্মী, ফিরে গেলে অকল্যাণ হয়, ব্যাবসায় ক্ষতি। ঘড়াগুলো আবার ভরতি করে ঠিকঠাক মতো সাজিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে কাহ্নুপাদের সামনে এসে দাঁড়ায় দেবকী। 

‘কী গো আর পারবে?’ 

‘পারব তো অনেক কিছু, কিন্তু চাইলে তো দেবে না তুমি।’ 

‘বেশি ঢং দেখিয়ো না। হেঁয়ালি রাখো।’ 

‘আর এক ঘড়া দাও বউদি। এই অমৃত রেখে ওঠার কোনো ইচ্ছে নেই।‘

কাহ্নুপাদের মাথার মধ্যে দরবারের উৎসব শুরু হয়, অসংখ্য নূপুরের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে ও। প্রদীপের মৃদু আলোয় পুরো ঘরে আলো-আঁধারি। দেবকীকে চন্দ্রলেখার মতো মনে হয়, ও যেন পেখম মেলে বসে আছে। ওর সাদা শাড়ি থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে ঘিয়ের প্রদীপের দ্যুতি, শাড়ির লাল পাড় হিরের অলংকার হয়ে বেষ্টন করে আছে দেবকীর অঙ্গ। একটু পর দেবকী পাশের ঘরে চলে গেলে নেমে আসে অন্ধকার। মদ খাওয়ার পরও জ্বালা জুড়োয় না কাহ্নুপাদের। ও ক্ষিপ্ত হয়, ভাবে, এই দহন ওর প্রয়োজন, হয়তো এই দহন থেকেই বড়ো কিছু রচনা হবে। এ অপমান ওকে শক্তি দেবে, উদ্বুদ্ধ করবে। আর এক ঘড়া মদ খাওয়ার পরও ওর পা টলে না, মাথায় একটা চাপ কেবল। ধুত, নেশা হয় না কেন? জমজমাট নেশা। মদটা ওর বোধহয় ঠিকমতো বানাতে পারেনি। তবু যাহোক রামক্রী আর দেবকী আছে বলেই রক্ষা, নইলে গোটা পল্লি খরার মাঠঘাটের মতো বুক উদোম করে রাখত, সেই ফুটোয় সেঁধিয়ে যেত কাহ্নুপাদের মতো অনেকের সাধ-আহ্লাদ। কাহ্নুপাদের মনে হয় দেবকী নিজেই চিকন-বাকলের চোলাই করা মদ। ওর ছিপছিপে শরীরের বাঁকে বাঁকে নেশা জমে থাকে, দেখলে তৃষ্ণা কণ্ঠে এসে আটকে যায়। 

ওকে হাঁ-করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে ওঠে দেবকী, ‘অমন ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছ যে?’ 

‘তোমার মদে নেশা হয় না কেন দেবকী?’ 

‘শুধু তোমার হয় না, আর সবার হয়।’ 

‘আমার জন্য একটু আলাদা বানাও না? পারবে?’ 

‘না বাপু ক্ষমা করো। আলাদা মদ আমি বানাতে জানি না।’ 

‘জানো কেবল ইয়ে—’ 

কাহ্নুপাদ মুখ-খিস্তি করে, পকেট হাতড়ে কড়ি খোঁজে, কড়ি নেই। তারপর ঈষৎ হেসে বলে, ‘বাকির খাতায় লিখে রাখো, সুদে আসলে একসঙ্গে দেব।’ 

‘তোমার বেলায় সব সই।’ 

‘তাই নাকি?’ 

কাহ্নপাদের চোখের পাতা নেচে ওঠে। দেবকি খিলখিলিয়ে হাসে। হাসি শুনে পাশের ঘর থেকে আসে রামক্রী, ‘কী হল কানুদা?’ 

‘তোমার কানুদাকে বাকির খাতায় রাখছি।’ 

‘ভয় নেই তোমার, সব আমি একসঙ্গে শোধ দেব রামক্রী।’ 

‘ভুলো না আবার।’ 

‘ভুলতে চাইলে কি তোমরা ভুলতে দেবে!’ 

রামক্রীও খোঁচা দেয়, ‘কড়ির কথা ভোলা কি সহজ? না কি ভুললে ব্যাবসা চলে?’ 

কাহ্নুপাদ নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। দরজার উপর থেকে সাংকেতিক চিহ্ন সরিয়ে নেয় দেবকী। কাহ্নুপাদ শেষ খদ্দের। রাত অনেক হয়েছে, আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কাহ্নুপাদ ঘাড় ফেরাতেই দেবকী দরজা বন্ধ করে দেয়। 

ফুরফুরে বাতাস গায়ে এসে সুড়সুড়ি দেয়, যেন এতক্ষণ কাহ্নুপাদের অপেক্ষায় ছিল, দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসেছে। এ আরামটুকু উপভোগ করে হাঁটতে মন্দ লাগে না ওর। এতক্ষণে নিজেকে কিছুটা নির্ভার মনে হচ্ছে। দেশাখের বাড়ির পেছনের ছোটো টিলাটার বাঁক ঘুরতেই চাপা হাসি কানে আসে কাহ্নুপাদের। ও কান খাড়া করে, কে হতে পারে? ও দু-পা এগোয়, দেখে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোর একটুখানি অংশ পড়েছে ওদের ওপর, ঘাসের ওপর কাত হয়ে শুয়ে কথা বলছে, চিনতে পারে কাহ্নুপাদ। এত বড়ো ঘন কালো চুল এ তল্লাটে আর কারও নেই, এলো খোঁপা ভেঙে লুটিয়ে আছে পিঠের ওপর, চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। কাহ্নুপাদ দেখেই চিনতে পারে, সুলেখা আর সুদাম। ও পিছিয়ে আসে। মনে পড়ে অনেকদিন আগে ভুসুকু বাণিজ্যে গিয়ে আর ফেরেনি, কোনো খোঁজও নেই। কেউ জানে না বেঁচে আছে কি না, কোনোদিন ফিরবে কি না। এমন করে মাঝে মাঝে কেউ পল্লি থেকে উধাও হয়ে যায়, সারাজীবনে আর ফিরে আসে না। হয়তো জলদস্যুদের হাতে পড়ে, ওদের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করলে ওরা মাঝনদীতে ছুঁড়ে মারে। নয়তো কোনো বিপদে নিহত হয়, কিংবা রাজার লোক বিনা কারণে বন্দি করে নিয়ে যায়, গুদাম ঘরে আটকে থেকে শুকিয়ে মরে যায়, একদিন সকালে কেউ হয়তো কঙ্কালটা বের করে ফেলে দেয়। কাহ্নুপাদের বুক ভেঙে শ্বাস পড়ে, ভুসুকুর কি তেমন কিছু হল? সেজন্যই সুলেখা জুড়ি বেছে নিয়েছে। সুদাম নিরীহ লোক, চমৎকার ধান রোপণ করতে পারে, তাই মৌসুমে ওর দারুণ কদর। কাহ্নুপাদ আবার হাঁটতে থাকে, গুনগুনিয়ে গান গায়, শিস বাজায়। চারদিক নীরব নিঝুম, নদী থেকে শব্দ আসছে। চাঁচর বেড়ার বাড়িগুলোতে আলো নেই, ভুতুড়ে অন্ধকারে ওগুলো টুকরো টুকরো, অথচ সব মিলিয়ে একটা চমৎকার ধারাবাহিকতা আছে, যা জীবনের উত্থান-পতন, চলাচল, বয়ে যাওয়া। আজ কিছুতেই নিজের বাড়ির পথ চিনতে পারে না কাহ্নুপাদ, বেমালুম ভুলে যায়। এই ভুলে যাওয়া ইচ্ছাকৃত, একটুক্ষণের জন্য গত্বাঁধা জীবনের বাইরে খোলা হাওয়ায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। 

আপনমনে চলতে চলতে এক সময় চমক ভাঙে ওর। ডোম্বির বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে, আর তিনটে বাড়ি পেরুলেই হল, এরপর আর কোনো বাড়ি নেই। বিস্তির্ণ পতিত জমি, বাবলা কাঁটা বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। যখন-তখন ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে বৈঁচি কুড়োতে আসে। রাখাল ছেলে গোরু ছেড়ে দিয়ে সামান্য উঁচু গাছের নীচে ঘুমোয়। অনেকদিন বিকেলবেলা কাহ্নুপাদ এই মাঠে দাঁড়িয়ে সুর্যাস্ত দেখেছে। লাল হয়ে ওঠা আকাশটায় ডিমের কুসুমের মতো গোল হয়ে ওঠে সূর্য, তার পর টুপ করে চলে যায় আড়ালে। ও বুকের কাছে হাত জোড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে, এই দৃশ্য দেখার আনন্দ একদম ওর নিজস্ব। এই মুহূর্তে পিপুল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় ও। নিজেকে প্রশ্ন করে, আজ আমি ঘরে ফিরছি না কেন? উত্তর আসে, সবসময় ঘর ভালো লাগে না। জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘরে নয়, বাইরে নিতে হয়, হাজার মানুষকে সাথি করে নিতে হয়। তাহলে কী করবে? রাজসভা থেকে যে যন্ত্রণা নিয়ে ফিরেছি তার দায়ভার এই লোকালয়েরও। আমি উপলক্ষ্য মাত্র, কিন্তু বহন করতে হবে সবাইকে। আমার মুখের ভাষার অবমাননা আমাদের সবার। আমার উচিত সবাইকে ডেকে ডেকে এ কথা বলা। এই পিপুল গাছ তুই সাক্ষী, বল তুই আমার পক্ষে। মল্লারী তুমি সাক্ষী, নিশিন্দা তুমিও। ওই নদীটাও, ধনাদার গোরুও, দেশাখ তোর তিরধনুকও। কাহ্নুপাদ শব্দ করে হাসে, যেন শবরী বলছে—খুব হয়েছে, এবার থামো, আমরা সবাই তোমার সঙ্গে আছি। পিপুল গাছের ওপর একটা শামকুকড়া ডাকে। কাহ্নুপাদ জানে মল্লারী একা থাকে। রামলালের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বছর দুই আগে। রামলাল দক্ষিণপাড়ায় ঘর বেঁধেছে নতুন করে, বউর নাম মঙ্গলি, শ্যামলা কিশোরী, রামলালের সঙ্গে বয়সের অনেক তফাত। মুখে রা-টি নেই, কেবল ডাগর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। মল্লারী আর ঘর বাঁধেনি, বলে একা থাকতেই সুখ। সারাক্ষণ ভালোবাসাহীন পুরুষমানুষের মন জোগানো ওর ধাতে সয় না। নৌকা বেয়ে রোজগার করে, নাচে, গান করে। রাতের অন্ধকারে লোক আসে ওর ঘরে, কড়ি দিয়ে কিনে নিয়ে যায় এক রাত্রির সুখ, তাতে মল্লারীর মুখে হাসি ফোটে না কিন্তু পেটে ফোটে জুঁই ফুলের মতো সাদা ভাত- ফুল। ও খুব পষ্টাপষ্টি কথার মেয়ে, বোঝে পেটে না সইলে কোথাও সয় না, তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দেয় মনকেমন-করা যন্ত্রণা। গোটা পল্লিতে ওর মতো প্রাণবন্ত মেয়ে আর একটিও নেই, উপরন্তু সুন্দরী, সুগঠিত, কালো পাথরে আলো ছিটকে পড়ে। এমন চমৎকার দেহের বাঁধুনি কমই দেখা যায়। ও কারও পরোয়া করে না, কাউকে ভয় পায় না, একটা নিযেধ-ভাঙা সাহস আছে ওর মধ্যে। অথচ যখন ভালোবাসে, প্রাণের সমস্ত আবেগ দিয়ে ভালোবাসে, বেঁচে থাকার জন্য নিজেই মনের মধ্যে সাহস জমিয়ে রেখেছে। চাঁচর বেড়ার বাড়ি তুলেছে, কার্পাস লাগিয়েছে, ময়ূর পোষে, হরিণের মাংস খায়, চোত-বোশেখে পোলো দিয়ে মাছ ধরে, উঠোনে লাউ-কুমড়োর মাচা আছে। রামলাল ওকে আঘাত দিয়েছে, অপমান করেছে, কিন্তু সেটাকেই জীবনের শেষ বলে মেনে নেয়নি ও। রামলালকে ছাড়াও জীবনকে ভাবতে পারে। এখন রামলালকে ও উপেক্ষা করে। কাহ্নপাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে তর্ক হয় রামলাল প্রসঙ্গে। কাহ্নুপাদ যখন বলে, ‘রামলাল তোমার সব কেড়েকুড়ে নিয়ে গেছে’ তখন ও প্রবল প্রতিবাদে মাথা ঝাঁকায়, ‘মিথ্যে কথা। চোর আর কতটুকু নিতে পারে বলো যদি আমি নিজ থেকে সব দান না করি।’ 

কাহ্নুপাদ অবাক হয়ে তাকায়, ভারি শক্ত মেয়ে, পরাজয়কে কখনো স্বীকার করবে না। কাহ্নুপাদ হেসে বলে, ‘ভাঙবে তবু মচকাবে না।’

ও জোর প্রতিবাদ করে, ‘মোটেই তা নয়, আমি মচকাইও না। যে মনটা তুমি দেখতে পাও না সেটা যে কীসের আমিও জানি না। কোনো কিছুতেই গলে না, আগুনেও না।’ 

বড়ো সাহসের কথা 

মল্লারী তরঙ্গ তুলে হাসে। ওর আত্মবিশ্বাস কাহ্নুপাদকে অভিভূত করে। আর এসব গুণের জন্যই আকৃষ্ট হয়। বোঝে যে এ প্রাণশক্তির অপচয় হতে দেয়া যায় না। এক সময় মল্লারীর খুব কাছে গিয়ে নীচু স্বরে বলে, ‘তোমার মন কি ভালোবাসায়ও গলে না?’ 

‘গলে কি না পরীক্ষা করে দেখিনি।’ 

কাহ্নুপাদ মুহূর্তে হাঁটু গেঁড়ে সামনে বসে যায়, ‘ঠিক আছে পরীক্ষা প্ৰাৰ্থনীয়।’ 

‘হয়েছে, হয়েছে, ওঠো।’ 

মল্লারীর শরীরের বাঁকে বাঁকে হাসি তরঙ্গ তোলে। কাহ্নুপাদের চোখের সামনে মাঠ-নদী-আকাশ একাকার হয়ে যায়। 

মল্লারীর কথা যখন ভাবে তখন তার মধ্যে আত্মস্থ হয়ে যায় কাহ্নুপাদ। 

দেবকীর মদে যে নেশা জন্মাতে পারে না, মল্লারীর চিন্তা তা পারে, একদম অন্য ভুবনে নিয়ে যায়। এমন মানুষই তো চায় যার সৌন্দর্যের সঙ্গে মেশে মানসিক শক্তি। নয়তো সৌন্দর্য না থাক, যদি থাকে মনের গভীরতা, যদি বুঝতে পারে এবং বোঝাতে পারে। রাখিবন্ধন না হোক যদি সে পাশে থাকে এইটুকুও তো লাভ। পিপুল গাছের ডালে বাতাসের সরসর। আর দুটো ঘর পেরুবে কি না তা ভাবতে থাকে কাহ্নুপাদ। তখনই নিঃশব্দে এগিয়ে আসে ও, শব্দ করে হাসে। 

‘এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছ যে?’ 

‘মল্লারী?’ 

‘না, অন্ধকারের পেতনি নই, মল্লারীই। ঘরের বাইরে বসেছিলাম, দেখলাম গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছ। প্রথমে ভেবেছিলাম অন্য কেউ, কিন্তু খুব ঠাহর করে দেখার পর বুঝলাম তুমিই।’ 

‘ঘরের বাইরে বসে রয়েছ কেন? ভয় নেই?’ 

আবার খিলখিল হাসি দিগবিদিগ ছুটে যায়। চাঁচর বেড়ার বাড়ি তা আটকাতে পারে না। 

‘আমার কী আছে যে ভয় পাব?’ 

‘আর কিছু না হোক, অন্ধকারে সবাই তো ভূতের ভয় পায়।’ 

উত্তরের বদলে হাসি, হাসি আর থামতে চায় না। 

‘তা এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে না ঘরে যাবে?’ 

‘এই তো বেশ, কার্পাস গাছগুলো হাওয়ায় কেমন দুলছে দ্যাখো?’

‘ও তুমি দ্যাখো। ওসব তোমার জন্য। আমি কি গীত লিখি?’

‘মল্লারী?’ কাহ্নুপাদের কণ্ঠে চাপা আর্তনাদ! 

‘কী হয়েছে কানু?’ 

‘মল্লারী, দেবল ভদ্র আজ আমাকে ভীষণ অপমান করেছে।’ 

‘কেন? গীত পড়োনি?’ মল্লারীর দু-চোখের পাতায় ঝিলিক। 

‘আমি ছোটোলোক, মুখের ভাষায় গীত লিখি, সব ছুঁচোর কেত্তন। দেবল ভদ্র আমাকে দরবার থেকে বের করে দিয়েছে।’ 

‘তুমি কী করলে?’ মল্লারীর কণ্ঠে চাপা ক্রোধ। 

‘কিছু করিনি।’ 

মল্লারী তেড়ে ওঠে, ‘কিছু করলে না? মাথা ফাটিয়ে দিতে পারলে না? 

‘তাহলে কি আমাকে আস্ত রাখত?’ 

‘না রাখলে মরতে, আমরা সবাই জানতাম তুমি মুখের ভাষার জন্য মরেছ। কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যদি আসবে তবে গেলে কেন ওখানে?’ 

‘মল্লারী?’ 

মল্লারী সমান তোড়ে বলে, ‘পারো কেবল অবাক হতে, আমি যা বলি মনের কথা বলি, একটুও ফাঁকি নেই। মরলে কী হয় কানু? যাকে তুমি প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসো তার জন্য মরতে পারো না?’ 

কাহ্নুপাদের বুকের গভীর থেকে শব্দটা উঠে আসে প্রতিজ্ঞার মতো। বলে, ‘পারি, আমি পারি মল্লারী।’ 

‘জানি তুমি পারো, তোমার জীবনের বিনিময়ে হলেও তোমাকে পারতে হবে।’ 

‘এই তোমার মাথা ছুঁয়ে শক্তি নিলাম।’ মল্লারী কাহ্নুপাদের ঘাড়ে হাত রেখে বলে, ‘তোমাকে যে অপমান করেছে তার প্রতিশোধ আমি নেব। কিছুতেই ছেড়ে দেব না।’ 

‘আহ্ মল্লারী’, কাহ্নুপাদ ওকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। পিপুল গাছের হাজার পাতা নড়ে ওঠে। বাতাস মল্লারীর প্রতিজ্ঞা নিয়ে ছুটে যায়, ছড়িয়ে যায় লোকালয়ে, সব মানুষের ঘুমন্ত চেতনায় প্রোথিত হয় প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা। 

কাহ্নুপাদ ওর ঘাড়ে মুখ রেখে বলে, ‘মাঝে মাঝে তোমাকে আমার ভয় লাগে মল্লারী।’ 

‘কেন?’ 

‘তোমার শক্তি আছে, সাহস আছে, ভয় নেই। তাই মনে হয় কখনো তুমি বুঝি ভীষণ—’ 

‘বলো না? থামলে কেন?’ 

‘না, থাক। সব কথা বলা ঠিক নয়।’ 

খিলখিল করে হেসে ওঠে ও। বলে, ‘অর্ধেক কথা পেটে, অর্ধেক কথা মুখে। এ না হলে কি কেউ আর গীত লিখতে পারে?’ 

‘বেশ বলেছ।’ 

দু-জনেই হাসে। কার্পাস ফুলগুলো মুখ উঁচিয়ে আছে আকাশের দিকে। মাঝে মাঝে দূরের বন থেকে বাঘের গর্জন ভেসে আসে। দু-জনের সঘন নিশ্বাসের মতো মহুয়ার গন্ধ তীব্র হয়ে ওঠে। 

‘মল্লারী।’ 

‘কী?’ 

‘ঘুমুবে না?’ 

‘তুমি না এলে ঘুমুতাম, এখন ঘুমুব না।’

‘চলো তাহলে নৌকা করে নদীতে বেড়াই।’ 

‘এখন?’ 

‘রাত আর বেশি নেই, সময়টা ভালো। এই সময়টা আমার খুবই প্রিয়। কতদিন এই সময়ে নদীর পাড় ধরে হেঁটে গেছি অনেকদূর।’ 

কাহ্নুপাদ মল্লারীর হাত নিজের মুঠিতে নেয়। দু-জনে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ঘাটে আসে। নদীর বুকে ঝিরঝিরে বাতাস। লাফিয়ে নৌকায় ওঠে ওরা, কাছি খুলে দেয় মল্লারী। নিস্তব্ধ নদী হালকা অন্ধকারে মিশে একাকার হয়ে আছে, যেন নদীটা দিগন্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, কোনো কূল নেই। আজ নৌকা বাইতে একদম নতুন লাগে মল্লারীর, প্রথম দিনের বইঠা হাতে নেওয়ার মতো নিষিদ্ধ আনন্দ। আজ শুধু বেড়ানো, পারাপার করা নয়, কড়ি চাওয়া নয়। পাটাতনে চিতপাত শুয়ে থাকে কাহ্নুপাদ। মল্লারীর সুডৌল হাতের সঙ্গে কথা বলে বইঠা, সে উচ্ছ্বাস নদীর জলের ছপছপ শব্দ। ওই শব্দ কাহ্নুপাদকে বিষণ্ণ করে দেয়। ও ভাবে দু-পাশে নদীর তীরে, আবাদ জমি, বনবনানী, সব কিছুর মধ্যে পৃথিবীটা যেন একটা নদী। নদীর ঢেউয়ের মতো দিনরাত এখানে সুখ-দুঃখ, হাসি- কান্না, জীবন-মৃত্যু উঠছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে, তাই পৃথিবীরূপী এই নদী গহন, গম্ভীর এবং ভয়ংকর। নিজের ঠাঁই টিকিয়ে রাখার জন্য সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। এই নদী পার হওয়া কঠিন। এই দার্শনিক ভাবনা মাথায় করে একটা কবিতার পংক্তি কাহ্নুপাদের মগজে আসি আসি করেও আসে না, বারবার ছুটে যায়। তখন ও মল্লারীকে দেখে, মনে হয় নদীর মেয়ে মল্লারী, নদীতে ওর জন্ম। ওর মা নৌকা করে বাপের বাড়ি যাবার সময় মাঝনদীর বুকে ও হয়ে যায়। কে জানে মরণও হয়তো এখানে আছে, মল্লারী তাই চায়ও। বলে, ‘ডুবে মরলে বেশ হয়। ভেসে যেন না উঠি, শেষ ঘুমটা এক্কেবারে নদীর তলে গিয়ে ঘুমুব, মাছেরা খেলা করবে চারপাশে, শ্যাওলা জমবে পায়ের পাতায়, হাতের মুঠোয় থাকবে রুপোলি বালি, কপালে কাদামাটির টিপ, চোখে জলের কাজল।’ কাহ্নুপাদ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তুমিও কবি মল্লারী। এমন সুন্দর ছবি আঁকতে পারো।’ 

ও হেসে বলেছিল, ‘মরলে পুড়িয়ো না, দেহটা নদীতে ভাসিয়ে দিয়ো।‘

বর্তমানে নদীর মতো জীবন ওর, তবে সে নদীতে চড়া পড়েনি। সুখ-দুঃখের স্রোতের প্রবাহে ও সে নদীকে উত্তালমুখর করে রেখেছে, গভীর খাদে বয় তার জীবনের প্রবল স্রোত, চড়া পড়ার সম্ভবনা নেই। নিজেকে জিইয়ে রাখার শক্তি ওর আছে। 

কাহ্নুপাদ মল্লারীর কাছে গিয়ে বসে, ও হাসে। বলে, ‘ডুবে গেলে আমার দোষ নেই।’ 

‘যাক ডুবে, এসো দু-জনে সহমরণে যাই। তোমার সঙ্গে মরার খুব সাধ আমার।’ 

‘ঠিক বলছ কানু?’ 

‘একটুও মিথ্যে নয়।’ 

খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মল্লারী। মাঝে মাঝে ওর এই হাসি কেমন তীব্র তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। অন্ধকার নদীর গম্ভীর রূপ ওই হাসির সঙ্গে বেমানান। 

নৌকা অনেকদূর এসে গেছে, প্রতিদিনের পরিচিত লোকালয় অনেক পেছনে। গাঢ় অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে, মাঠে শস্য নেই, উদোম মাঠে গভীর শূন্যতা। কাহ্নুপাদ আরামে চোখ বোজে। 

‘একটা গান গাও মল্লারী।’ 

‘গান? কোনটা?’ 

‘যে গানটা প্রথম শিখেছিলে।’ 

মল্লারী গুনগুনিয়ে শুরু করে, 

এবংকার দৃঢ় বাখোড় মোড়ি 
বিবিহ বিঅপক বান্ধণ তোড়িঅ 
কাহ্নু বিলসই আসবমাতা 
সহজ নলিনীবন পসি নিবিতা। 

কাহ্নুপাদ একমনে গান শোনে, নিজের লেখা পংক্তিগুলো মল্লারীর কণ্ঠে আশ্চর্য বদলে যায়। ও যেন আর এক স্রষ্টা, নতুন করে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছে। কয়েকটা পংক্তি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকক্ষণ ধরে গায় ও, যেন ছাড়তে ইচ্ছে করে না, যেভাবে হোক প্রাণের কাছে কেবল ধরে রাখা। কাহ্নুপাদের মনে হয় মাত্র কয়েকটা পংক্তি অথচ কী তার ক্ষমতা, সমস্ত পরিবেশ বদলে দিয়েছে। দু-কূলের আছড়ে পড়া নদীর জল সে সুরের রেশে যেন মাথা কুটে মরছে। বড়ো একটা মাছ নৌকার কাছাকাছি ঘাঁই মেরে গেল। অনেকদূরে কালো পিঠ উঁচিয়ে ভাসছে শুশুক। মল্লারী গাইতে গাইতে তন্ময় হয়ে গেছে, চোখে জল। কাহ্নুপাদের মন উদাস হয়ে যায়, বুক হাঁ-হাঁ করে। চারদিকে সবাই আছে অথচ কেউ নেই, সঙ্গীর অভাব ওকে এক ভয়াবহ নিঃসঙ্গতায় বন্দি করে রাখে, ও নিজের হাতে তৈরি বেড়িতে আটকা পড়েছে। পালিয়ে আসার জন্য ছটফট করে, হঠাৎ করে ওর মনে হয় এখানে আর ভালো লাগছে না, অন্য কোথাও যাবার সাধ এখন। এই নদী ওকে আর সঙ্গ দিতে পারে না। এই নৌকা, দাঁড়, এর চালক কেউ আর ওর জন্য যথেষ্ট নয়। কাহ্নুপাদের মন অন্যকিছু পাওয়ার জন্য খাঁ-খাঁ করে। ঠিক সেই মুহূর্তে নৌকা দুলে ওঠে, গান থেমে যায় মল্লারীর, নিজেকে সামলে নেয়, চোখের জল মোছে। 

‘এজন্য আমি নৌকায় গাইতে চাই না।’

কাহ্নুপাদ কথা বলে না, দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ও জানে দূরটাই ও কাছে আপন, যত কাছে যাবে ততই সে জায়গা অপ্রিয় হয়ে উঠবে। তারপর আবার একসময়ে ফিরে আসবে নিজের বলয়ে, সে বৃত্ত তখন অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠবে। এই দলছুট মনোভাব ওকে স্বস্তি দেয় না। 

‘অনেক দূরে এসে পড়েছি কানু?’ 

কাহ্নুপাদ ওর দিকে না তাকিয়ে বলে, ‘চলো ফিরে যাই।’ 

‘ফিরতে আমার মন চায় না।’ 

‘এখন আমার অন্য কিছু ভালো লাগছে না মল্লারী। 

‘কেন?’ 

‘জানি না, আমার মাঝে মাঝে এমন হয়। 

‘ও।’ 

মল্লারী নৌকা ঘোরায়। এতক্ষণের সমস্ত আনন্দ কর্পূরের মতো উবে যায়। ম্লান ছায়া ভাসে দৃষ্টিতে। কাহ্নুপাদ সেটা লক্ষ করে না। মল্লারীর হাত ধরে বলে, ‘বইঠা আমাকে দাও, আমি বাইব।’ 

‘তা হলেই হয়েছে, ঘরে আর ফিরতে হবে না।‘

‘দিয়েই দ্যাখো না।’ 

‘না থাক তুমি বসো। বাইতে আমার কষ্ট নেই।‘

‘পারব, দাও।’ 

‘এত সহজে সব কিছু হলে তো সবাই সব কাজ পারত। তাহলে এক-একজনে এক-একটা করে কেন?’ 

‘বড়ো শক্ত কথা, ঠিক আছে হার মানলাম।’ 

মল্লারীর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কাহ্নুপাদ আর বেশি কথা বলতে সাহস পায় না। আসলে সুরটা ও নিজেই কেটে দিয়েছে, সেটাকে আর কিছুতেই ফিরিয়ে আনা যায় না, যতক্ষণ না যন্ত্রটা আপনাআপনি বাজে। তবে ভরসা এই যে, মল্লারী বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকে না, অল্প সময়ে আবার নিজের মধ্যে টুং করে ঘা দেয়, তারপর চমৎকার বেজে ওঠে। কাহ্নুপাদ নৌকার অপর দিকে গিয়ে বসে। আঁধার কেটে গেছে, নরম আলো ছড়িয়ে আছে উদোম মাঠে, দূরের টিলা পুরো দেখা যায় না, বনমোরগের ডাক ভেসে আসছে। কর্দমাক্ত দু-তীরে আছড়ে পড়ে জল, কেঁপে যায় তীরভূমি, যেন অনাদিকালের স্পর্শ শিহরণ তোলে। কাহ্নুপাদ হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে, কখনো মল্লারীর দিকে তাকায়, চোখাচোখি হয়, আবার দৃষ্টি ঘুরে যায়, যেন অনেক আগে দু-জনের গভীর জানাশুনো ছিল, এখন কেউ আর কাউকে চিনতে পারছে না, প্রাণপণে চেনার চেষ্টা করছে, চিনতে গিয়ে বুকের বোঁটা ছিঁড়ে রক্ত ঝরছে টুপটাপ। কাহ্নুপাদ নিশ্বাস ফেলে ভাবল, এটাই হয়তো জগতের নিয়ম। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *