অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৪

অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৪

হরিণ শিকারের আয়োজনে মেতে উঠেছে সবাই। আজ ওরা তিন মাইল দূরের বনে হরিণ শিকারে যাবে। দেশাখের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। ও দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে। কাহ্নুপাদ, ধনশ্রী, কামোদ, রামক্রি, দেবেন, সাধন সবাই আছে। দলবেঁধে হরিণ মারতে যাওয়া এক বিশেষ উৎসবের মতো। এতে আনন্দ যেমন আছে, রোজগারও তেমন, বেশ লাগে। তিনটে শিকার হলে তো সারা পাড়া উৎসবে মেতে উঠবে। বেলা ওঠার আগেই দলেবলে রওনা করে ওরা। 

ওদেরকে একসঙ্গে ঘাটে দেখে মনে মনে হাসে ডোম্বি। আজ কাহ্নুপাদের সঙ্গে ওর খাতির নেই। এতক্ষণে একটা খ্যাপও দেয়নি, বেশ কতকগুলো কড়ি আদায় হবে চিন্তা করতেই ও উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এতক্ষণে বসে বসে ঝিমুনি ধরে যাচ্ছিল। নদীর বাতাসে মাঝে মাঝে মন কেমন হয়ে যায়, তখন শরীরে ব্যথা হয়। বুক মুচড়ে ওঠে। ওদের দেখে ডোম্বি হেসে বলে, ‘আজ ভোরে কার মুখ দেখে যে উঠেছি কে জানে? রোজগারের এমন সুবিধে রোজ রোজ কেন যে হয় না?’ 

‘হরিণের মাংসে তোকেও ভাগ দেব ডোম্বি, বিনে কড়িতে পার করে দে?’ 

দেশাখের অনুরোধে দপ করে ওঠে ও, ‘ইস আমার নাগর! বললেই দিলাম আর কি!’ 

দেশাখ মুখ খিস্তি করতে গিয়েও চেপে যায়। অপমানটা নিঃশব্দে হজম করে। যাত্রার মুখে কোনো বাদবিবাদে যেতে চায় না ও। 

‘হরিণ পাবে কি না ঠিক নেই। আগেই লোভ দেখাচ্ছে?’ 

দেশাখ চটে ওঠে, ‘অলুক্ষণে কথা বলবি না। পার করে দিবি কি না বল?’

‘কড়ি দিলেই দেব।’ 

‘এমনিতে দিবি না?’ 

‘না। আমাকে বলছ অলুক্ষণে কথা না বলতে। আর নিজেরা যে অলুক্ষণে কাজ দিয়ে যাত্রা শুরু করতে চাচ্ছ? শুভ কাজে আবার বিনে কড়ি কী?’ 

ঝাঁঝালো স্বরে কথা বলে ডোম্বি, চোখে ক্রোধ। দেশাখও সরোষে বলে, ‘ঠিক আছে তোকে উৎসবেও ডাকব না।’

মুহূর্তে চোখের রাগ উবে যায়। খিলখিলিয়ে হেসে বলে, ‘খুব ডাকবে, নইলে নাচবে কে? আর নাচ না হলে কি তোমাদের রক্ত গরম হবে, না কি আসর জমবে?’ 

কাহ্নুপাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এ ডোম্বিকে ও চেনে না। কেমন অবলীলায় এতগুলো মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কথা বলছে এবং নিজের ওপর ভীষণ বিশ্বাসে বইঠা হাতে কেমন পুরুষালি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কাহ্নুপাদকেও যেন চেনে না। ওর চোখে একবারও চোখ ফেলেনি। যেন কারও কাছে ওর কোনো দায়দায়িত্ব নেই। কামোদ নীচু স্বরে অশ্লীল গাল দেয়, জোরে দেবার সাহস নেই। তাহলে হাতের বইঠার ঘায়ে মাথা দু-ফাঁক হয়ে যাবে। অবশেষে রামক্রী একটা রফা করে। তিনজন পিছু এক কড়ি দিয়ে পার করিয়ে দেবার জন্য রাজি করায় ওকে। দেশাখ রাগে গোঁ-গোঁ করে, কথা বলতে পারে না। দু-দফায় ওদেরকে পার করে দেয় ডোম্বি। সবার আগে নৌকার ওপর লাফিয়ে ওঠে দেশাখ। ওর চোখের সামনে দূরের অরণ্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শিকারের নামে ওর স্নায়ু উদ্দাম হয়ে ওঠে। 

ডোম্বির বইঠার চাপে ছলছল শব্দ ওঠে নদীর বুকে। কাহ্নুপাদ কান পেতে শোনে। ওই শব্দ যেন ওর নিজের বুকের তল থেকে উঠে আসছে। জাগতিক সুখ-দুঃখ-ভালোবাসার আলোড়ন। মাঝনদীতে এসে ডোম্বি খিলখিলিয়ে হাসে, ‘এখন নৌকা ডুবে গেলে বেশ হয়?’ 

‘ইস ডুবলেই হল? যেন বিনে কড়িতে নৌকায় উঠেছি। আর ডুবলে আমি তোকে নিয়ে ডুবব।’

দেশাখের মুখ-খিস্তিতে সবাই হেসে ওঠে। ডোম্বি অপ্রতিভ না হয়ে আরও জোরে হাসে। সে হাসির রেশ নদীর খোলা বুকে বাতাসে তরঙ্গ তোলে। নদীর বুকে জেলেদের নৌকাগুলো ঘাপটি মেরে বসে থাকার ভঙ্গিতে মৃদু নড়ছে। ইতস্তত ঘোরা নয়, একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে এগুচ্ছে। জেলেদের চোখেমুখে উদ্বেগ, একটা বড়ো কিছু ধরার প্রত্যাশা। হাসির রেশ শেষ করে জোরে জোরে শ্বাস টানে ডোম্বি। বলে, ‘মাছের আগমন টের পাচ্ছি। মনে হয় ঝাঁক বেঁধে সব এদিকেই আসছে।’ 

‘তুই কেমন করে জানলি?’ 

‘সারা দিন নদীর বুকে থাকলে এসব টের পাওয়া যায়।’ 

‘ইস রাজসভার পণ্ডিতের মতো কথা।’ 

দেশাখের মুখ-ভেংচিতে সবাই হেসে ওঠে। কড়ি দেবার জ্বালাটা ও ভুলতে পারেনি। সুযোগ পেলেই ডোম্বিকে আক্রমণ করছে। আর ডোম্বি ওকে উপেক্ষা করছে, যেন দেশাখের মূল্যহীন এইসব কথায় ও থোড়াই তোয়াক্কা করে। 

ডোম্বি দেশাখকে উদ্দেশ্য করেই বলে, ‘যাই বলো না কেন, নির্ঘাত বড়ো কিছু পাবে ওরা। জেলেদের চোখমুখের দিকে দ্যাখো না তোমরা।’ 

কথা শেষ হতে-না-হতেই দেশাখ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘দ্যাখো দ্যাখো, কানুদা কত বড়ো একটা মাছ উঠেছে।’ 

ডোম্বি হাতের বইঠায় জোরে ঘা দিয়ে বলে, ‘এত বড়ো মাছ দু-চার বছরে দেখিনি?’ 

‘মাছ দেখতে গিয়ে তুই আবার আমাদের ডুবিয়ে দিস না।’ 

‘কেবল ডোবার কথা কেন রে দেশাখ?’ 

কাহ্নুপাদ মৃদু ধমক দেয়। তাজা মাছটার রুপালি আঁশে রোদের ঝিলিক, নৌকায় ঠেলে ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনজনে চেপে ধরে, অনবরত লেজ আছড়ায় ওটা। কামোদ জিহ্বায় শব্দ করে বলে, ‘মনে হচ্ছে আমার খিদে পেয়েছে কানুদা?’ 

ধনশ্ৰী পেটে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, ‘কাগনি ধানের ভাত আর ওই মাছের দোপেঁয়াজা, উঃ যা মজা হবে না। কবে অমন বড়ো মাছ খেয়েছি যে ভুলেই গেছি।’ 

‘তোমার জিভ থেকে জল ঝরছে না তো, ধনাদা?’ কাহ্নুপাদ হেসে বলে। 

‘ধনাদার ঝরছে কি না জানি না, কিন্তু আমি আর ঠেকিয়ে রাখতে পারছি না।’ রামক্রী বড়ো করে ঢোক গেলে। 

‘জল কিন্তু আমার জিভেও আসছে—’ 

ডোম্বি কথা শেষ করার আগে লুফে নেয় দেশাখ, ‘শুধু তোর জিভে আসেনি, ওই জল বইঠা বেয়ে নদীতে নেমেছে, ওই তো দেখতে পাচ্ছি।’ 

ডোম্বি দেশাখকে উপেক্ষা করে বলে, ‘কিন্তু ওই মাছ তো আমাদের কপালে জুটবে না। ও তো আগে রাজার হেঁসেলে যাবে।’ 

ফোড়ন কাটে সাধন, ‘অতদূর যাবে কি না কে জানে। দেবল ভদ্রের হেঁসেলে তো নির্ঘাত যাবে। 

কাহ্নুপাদ দ্রুত বলে, ‘তা যাবে। আমাদের জন্য কাঁটাও জুটবে না। তবে যতই শিকারে যাই না কেন ওই মাছ দেখলে প্রাণটা কেমন করে ওঠে, বলে বোঝানো যায় না। মাছে-ভাতে বাঙালি, এ কি আর মিথ্যে!’ 

‘ঠিক বলেছ।’ 

সবাই কলরব করে ওঠে। কাহ্নুপাদের কথায় ওরা একমত হয়। সবাই এই কথাগুলোই বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু ঠিকমতো কেউ বোঝাতে পারছিল না। কাহ্নপাদের কথায় ওদের চোখের সামনে একটা ছবি ভেসে ওঠে। সবাই এক অদৃশ্য মাছ-ভাতের উৎসবে বসে গেছে। কত মাছ, কত তার আয়োজন। ওদের কারোই মাছ-ভাতের বাইরে জীবনের চাওয়া আর খুব একটা নেই। এ দৃশ্য স্থির ছবি হয়ে আটকে যাচ্ছে সকলের হৃদয়ে। পরমুহূর্তে ছবিটি যন্ত্রণা হয়ে যায়, ফুঁড়ে যায় বুক। ওরা চাইলেই কোনো কিছু পাওয়ার অধিকার ওদের নেই। এসব ভাবতে ভাবতে নৌকা এসে ঘাটে লাগে। দেশাখ শিকারি বলেই ও চট করে বেদনা ভুলে বলে, ‘অত বড়ো মাছ যখন দেখেছি নিশ্চয়ই আমাদের যাত্রা আজ শুভ।’ 

ও লাফিয়ে নেমে যায়। ওকে আবার শিকারের উদ্দামতায় পেয়ে বসে। ডোম্বি কাছি দিয়ে নৌকা বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘শিকারের নামে দেশাখের রক্ত গরম হয়ে ওঠে।’ 

‘যেমন নাচের নামে তোমার রক্ত।’ 

কাহ্নুপাদ আস্তে করে বলে। বাকিরা নেমে গেছে। ঢেউয়ে নৌকা মৃদু দুলছে। 

‘গীত লেখা ছেড়ে দিয়ে হরিণ শিকারে যে?’ 

‘কেবল গীত লিখলে কি পেট ভরে?’ 

‘কবির আবার পেটের চিন্তা? কবির জন্য আকাশ রয়েছে, বাতাস রয়েছে, চাঁদ রয়েছে—’ 

মল্লারীর কণ্ঠে মৃদু শ্লেষ। কাহ্নুপাদ গাঁয়ে না মেখে হাঁটতে থাকে। পাড়ে গিয়ে রামক্রী কড়ি গুনে ওকে দেয়। ওরা চলে গেলে পাটাতনের ওপর বিছিয়ে ওগুলো ও আবার গোনে, তারপর কোমরে গুঁজে রাখে। ওর কোমরে কালো সুতো পাকানো আছে। ওর বিশ্বাস এটা থাকলে আয় ভালো হয়। মনে খুশি, কৌটো খুলে পান খায় এবং গুনগুনিয়ে গান ধরে, কাহ্নুপাদের কাছ থেকে শেখা গান, যা ওকে নিয়েই লেখা। এ এক আশ্চর্য ভালোলাগা। ওকে নিয়ে একজন ভাবে এবং লিখতে প্রেরণা বোধ করে ভাবতেই ওর শরীর শিরশির করে। ওর ঠোঁট নড়ে, ও গায়, 

একশো পদমা চৌষঠঠি পাখুড়ী 
তঁহি চড়ি নাচঅ ডোম্বি বাপুড়ী। 

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পংক্তি দুটো ভীষণ আবেগে গাইতে থাকে ও। গানের বাকি অংশটুকু শেখায়নি কাহ্নুপাদ। এইটুকুই গাইতে ওর ভালো লাগে, যেন সমস্ত ইন্দ্রিয় ওই পংক্তিতে নিয়ন্ত্রিত। গাইতে গাইতে ডোম্বির চোখে জল আসে, বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। মেঠো পথে একদল লোক ক্ৰমাগত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, গাছগাছালির আড়াল হচ্ছে, আবার কখনো দেখা যাচ্ছে, তারপর আর না, কেউ কোথাও নেই। পারাপারের লোক এসেছে, ডোম্বি আবার নৌকার কাছি খোলে। 

বনে ঢোকার আগে ওরা চুমুক চুমুক হাঁড়িয়া খেয়ে নেয়। ব্যবস্থাটা রামক্রীর, ওর মদের দোকান আছে। হরিণ উৎসবের নামে ও ভীষণ উত্তেজিত হয়, তাই বিনা কড়িতে সকলকে হাঁড়িয়া দেয়। ওর মতে হাঁড়িয়া না খেয়ে শিকারে নামলে শিকার তেমন জমে না, রক্ত গরম হওয়া চাই, ঠান্ডা রক্ত শিকারের জন্য উপযুক্ত নয়। কাহ্নুপাদ আর দেশাখ বেশি খায়, রামক্রী দেশাখকে ইচ্ছে করেই বেশি দেয়। শিকারে ও প্রধান ভরসা। হইহই করে ওরা যখন বনে বেড়ে দেয় তখন কাহ্নুপাদের বুক ধড়ফড় করে, কেবলই মনে হয় ডোম্বি এখন মাঝনদীতে। ও কোনো পারানির সঙ্গে কড়ি নিয়ে দর কষাকষি করছে এটা ভাবতে ওর খারাপ লাগে। বেঁচে থাকার জন্য কত কিছুই তো করতে হয়। 

‘তোমাকে একটু আনমনা দেখাচ্ছে কানুদা?’ 

‘ও কিছু না।’ 

‘নেশা বেশি হয়নি তো?’

‘পাগল।’ 

‘কী যে বলিস দেশাখ। নেশা কানুদাকে কখনো ধরে না, যদি না কানুদা নেশাকে ধরে। ‘তা ঠিক। আমরা চলি কানুদা, তোমরা ঠিকমতো এগুবে কিন্তু।’ 

দেশাখ, কামোদ, রামক্রী ও আরও কয়েকজন তিরধনুক নিয়ে গাছের আড়ালে চলে যায়। বাকি সবাই চারদিক থেকে টিন বাজিয়ে ভীষণ শব্দে হরিণ তাড়া করে, ভয়ে হরিণগুলো এদিক-ওদিক ছুটতে থাকলে ওরা মারবে। সবাই আনন্দ-উল্লাসে মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে ছুটছে, বনের কিছু অংশ ঘিরে ধরেছে—এখনও একটা হরিণও বের হয়নি, প্রাণভয়ে লুকিয়েছে যেন কোথায়। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না, বেরুতে হবেই। হাঁটতে হাঁটতে কাহ্নুপাদ একসময় একলা হয়ে যায়, ইচ্ছে করেই ও কেটে পড়েছে, ভালো লাগে না। তা ছাড়া রাজদরবারে বসে পাখা টানতে হয়, ছুটোছুটিতে ওর তেমন অভ্যেস নেই, অল্পেই হাঁফিয়ে ওঠে। এদিক-ওদিক কাউকে না দেখে একটা ঝোপের আড়ালে বসে পড়ে ও, বুক ভরে শ্বাস নেয়, হাঁফ ধরে গিয়েছে। তা ছাড়া ঘামও ঝরছে প্রচুর। ফতুয়াটা খুলে ফেলে ঘাসের ওপর মেলে দেয়, হাতের তালুতে কপালের ঘাম মুছে ফেলে। পাশের ঝোপে খসখস শব্দে তাকাতেই লক্ষ করে চমৎকার এক মায়া হরিণের বাচ্চা বড়ো বড়ো চোখের টলটলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাহ্নুপাদের বুকটা ধ্বক করে ওঠে। হরিণের মাংস ওর ভীষণ প্রিয়, সেজন্য এদের সঙ্গে আসা। বাচ্চাটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টি সরায় না। কাহ্নুপাদের মনে হয় ও বুঝি মা-কে হারিয়ে ফেলেছে। তখুনি ওকে তাড়াবার কোনো ইচ্ছে হল না কাহ্নপাদের, থিতিয়ে এল মাংস খাওয়ার লোভ। শিউরে উঠল ও নিজে নিজেই, এ জায়গায় ও না হয়ে দেশাখ হলে কী হত? পরমুহূর্তে প্রচণ্ড টিনের শব্দে বাচ্চাটি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকায়, কালো চোখের ভীরু দৃষ্টি ছলছলিয়ে ওঠে। শবরীর কথা মনে হয় কাহ্নপাদের, শবরী এমন, বিহ্বল মুহূর্তে ছলছল করে ওর সমস্ত শরীর। হাসি পায় ওর, হরিণের মাংস যতই প্রিয় হোক না কেন ও নিজে কোনোদিন শিকারি হতে পারবে না। বাচ্চাটা যে ওর কাছে আশ্রয় চাইছে, কাহ্নুপাদ অসহায় বোধ করে। দেশাখের হাত থেকে ও কিছুতেই বাচ্চাটিকে রক্ষা করতে পারবে না। বিড়বিড়িয়ে ওঠে, ‘আপন মাংসই ওর সবচেয়ে বড়ো শত্রু।’ কে ওকে রক্ষা করতে পারবে? কাহ্নুপাদ বাচ্চাটিকে ধরতে গেলে ওটা দৌড়ে পালিয়ে যায়। কোনদিকে যে গেল ও তা হদিস করতে পারে না। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পরিশ্রম করে তিনটে বড়ো হরিণ মেরেছে ওরা, দুটো দেশাখ, একটা রামক্রী। দেশাখ একই সঙ্গে আরও চারটে খরগোশ মেরেছে। কামোদ মেরেছে একটি সজারু, বাকিরা সবাই কম বেশি পাখি মেরেছে, সবার মনে খুশির ভাব। হরিণের বাচ্চাটাকে দেখে ক্ষণিকের জন্য বিভ্রান্ত হলেও কাহ্নুপাদ ভীষণ খুশি, তিনটে হরিণ কম কথা নয়। হল্লা করতে করতে ফিরে আসে ওরা। দুটো হরিণ টুকরো টুকরো করে কেটে ভাগ করে নেয়, অন্যটা রেখে দেয়। সন্ধ্যায় ওটাকে আস্ত গুড়িয়ে ওদের উৎসব হবে, পুরো পাড়া খুশিতে মেতে ওঠে। বিরাট আগুনের কুণ্ড করে হরিণ পোড়াবার আয়োজন করে, ছোটোদের উল্লাস আর চিৎকারে সরগরম হয়ে ওঠে পাড়া। সব আয়োজন ঠিকঠাক করে হাতে একটি খরগোশ দোলাতে দোলাতে পুবপাড়ার দিকে ছোটে দেশাখ, বেশ কয়েকদিন বিশাখার সঙ্গে দেখা নেই, মন ছটফট করছে, তা ছাড়া উৎসবের খবরটাও দিতে হবে ওকে। ওই পাড়াটা সবচেয়ে সুন্দর আর ছিমছাম, ছোটো ছোটো টিলার পাশে চাঁচর বেড়ার বাড়িগুলো একদম ছবির মতো। বিশাখার বাবা খুব গরিব। একগাদা ভাই-বোনের মধ্যে ও সবার বড়ো, ঠিকমতো খাওয়া জোটে না। রোগা শরীরের মাঝে জ্বলজ্বল করে চোখ জোড়া। ওই চোখের দীপ্র ঔজ্জ্বল্যে দেশাখের প্রতিদিনের অবগাহন, নেশার মতো লাগে, যেন ওই সাগর এক ভিন্ন হাঁড়িয়া। ভুলে যায় অভাবের কথা, শিকারের কথা। বিশাখার অবুঝ চেতনায় নিজেকে দেখতে ভালো লাগে দেশাখের। আর কেউ ওকে এমন করে ধরে রাখতে পারে না। বউদি একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘ওই রোগা, পুঁচকে মেয়েটার কী আছে বলো তো?’ 

‘কী আছে তা তো জানিনে।’ 

‘ওমা কেমন কথা?’ 

‘অত জানতে গেলে প্রেম হয় না বউদি।’ 

‘তাই নাকি?’ 

‘তোমরা যেন কী? মাঝে মাঝে বেশি হিসেব আমার একটুও ভালো লাগে না বউদি।’ 

‘হিসেবই তো তোমার কাজ। এই যেমন হিসেব করে তির ছোঁড়া।’ 

‘সবসময় কি আর এসব পোষায়। তাই কখনো কখনো ওটাকে মাঝনদীতে ফেলে দেই।’

‘তাই বলো।’ 

বউদির বাঁধভাঙা হাসিতে দেশাখ লজ্জা পেয়েছিল। ভাবতে ভাবতে দেশাখ বিশাখাদের বাড়ি ছাড়িয়ে চলে যায়। 

‘কোথায় যাচ্ছেন দেশাখদা?’ 

‘এই যে নিশু তোদের বাড়িতে যাচ্ছি।’

‘বা রে, বাড়ি ছেড়ে তো চলে এসেছেন।’ 

‘তাই তো, তোর দিদি কই রে নিশু?’ 

নিশু পোকা খাওয়া দাঁতগুলো বের করে হাসে, হাত দিয়ে দূরের টিলা দেখায়, ‘ওইখানে গেছে।’

‘কেন?’ 

‘শামুক খুঁজতে।’ 

‘এই অবেলায় শামুক খুঁজতে?’ 

‘বাহ্, দিদি শামুক আর নলতে শাক না আনলে যে রাতে আমাদের উপোস দিতে হবে। তিনদিন থেকে বাবার জ্বর, ঘরে একটু বার্লিও নেই। মা বসে বসে কাঁদছে।’ 

‘অ।’ 

দেশাখের বুক ভার হয়ে যায়। নিশুর বয়স হয়তো বারো হবে, দেখতে তেমন দেখায় না, মুখটা কচি পেলব। ও সংসারের খবর মুখস্থের মতো বলে যায়, ঠিক যে অনুভব করে তা নয়। ওর পোকা- খাওয়া দাঁত বের করা হাসিতে আর যাই হোক অভাবের ছোবল নেই। 

‘তুমি কি ওইদিকে যাবে দেশাখদা? তাহলে দিদিকে বোলো আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি, একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে না।’

‘ঠিক আছে যা।’ 

নিশু ছাড়া পাওয়া ছাগলের মতো লাফাতে লাফাতে চলে যায়। বিশাখা ওকে এখানে পাহারায় রেখে গিয়েছিল। দেশাখ খরগোশটা ডান হাত থেকে বাম হাতে নেয়। ভালোই হল, ওই টিলায় গেলে বিশাখাকে একা পাওয়া যাবে। পরক্ষণে মনে হয় বিশাখা অতদূরে একা একা না গেলেই পারত। কত কিছুর ভয়, বেশি ভয় রাজার লোকদের পছন্দ হলে যে কাউকে নিয়ে চলে যায়, তখন ওদের বাছবিচারের বালাই থাকে না, জাতধর্ম মাথায় ওঠে। দেশাখ একটু দ্রুত হাঁটে, মনে হয় খরগোশের ওজন অনেক বেড়ে গেছে। এই মুহূর্তে ওটা বিশাখার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, এক রাতের জন্য ওদের বাড়িতে উৎসব জমবে। ওর মা-বাবা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গোল হয়ে বসে চাঁদের আলোয় গল্প করবে। বেশ রাতে ঘুমুতে যাবে ওরা। ভাববে, অন্তত একটি দিন তো পার হল। ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে গেলে বাবা-মা হয়তো আরও দু-একটা টুকটাক কথা বলবে। 

পাহাড়ের গায়ে ধান চাষ করেছে রাজার লোকেরা। এগুলো রাজা বুদ্ধমিত্র কর্তৃক প্রদত্ত মন্ত্রী দেবল ভদ্রের নিষ্কর জমি। ওইখানে আগে বিশাখার বাবার জমি ছিল, জমি ছিল ধনশ্রী ও আরও অনেকের। একদিন দেখা গেল ওটা আর ওদের নেই, রাজা খুশি হয়ে মন্ত্রীকে দান করেছেন। কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, কেউ কোনো আপত্তিও করতে পারবে না, কেননা রাজা দেশের ভূমির একমাত্র মালিক। দেশাখের দাঁতে দাঁত লেগে হঠাৎ করে কড়কড়িয়ে ওঠে, ওরা সব ছোটোলোক, ওদের কোনো কিছুতে কোনো অধিকার নেই। পাহাড়ের গায়ে গজিয়ে ওঠা কচি ধানের চারা বাতাসে দুলছে। দেশাখ দূর থেকে দেখতে পায় বিশাখাকে, ও নীচু হয়ে শামুক খুঁজছে। এ সমস্ত ধানের খেত পাহারা দেয় রাজার লোকেরা। ধানখেতের স্যাঁৎসেঁতে মাটিতে শামুক পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি, তাই দল বেঁধে ছেলেমেয়েরা আসে শামুক খুঁজতে, তখন ধানের চারা নষ্ট হয়। পাহারাদারের হাতে ধরা পড়লে মার খায়। সেজন্য বিশাখা কখনো দলেবলে আসে না, একা একা আসে, ভাই-বোনদেরও সঙ্গে আনে না, ওরা বড্ড হইচই করে, অনেক সময় আসল কাজই ভন্ডুল হয়ে যায়।

কোঁচড়-ভরতি শামুক নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেশাখকে দেখতে পায় বিশাখা, কাদা-মাখা পা জোড়া খেতের মধ্য থেকে টেনে তুলে ঘাসে মোছে, তারপর তরতরিয়ে নেমে আসে। 

‘তুমি?’ 

‘কেন আসতে নেই বুঝি?’ 

‘যাহ্, তাই বলেছি নাকি!’

‘নইলে অবাক হলে কেন?’ 

‘বড্ড প্যাঁচাতে পারো। অবাক হয়েছি খুশিতে।’ 

‘কীসের খুশি?’ 

‘কাছে পাওয়ার খুশি। তোমাকে দেখলেই তো আমি খুশি হই, তবু কেন জিজ্ঞেস করো!’ 

‘সেটা আমার খুশি, মন চায় বলে জিজ্ঞেস করি।’ 

‘আসলে তুমি একটা সজারু।’ 

‘না, কখনো না, আমি মোটেই সজারুর মতো ভীতু নই।’ 

‘ভীতু নও, কিন্তু সজারুর মতো তোমার মনের মধ্যে কাঁটা।’ 

‘ও তাই বলো।’ দেশাখ হো-হো করে হাসে। বিশাখা ভেংচি কাটে। দেশাখ ওর হাত ধরে টিলার কোল ঘেঁষে বসে।’

‘দেখো তোমার জন্য কী এনেছি?’ 

‘খরগোশ? তুমি মেরেছ?’ 

‘তবে আর কে? মেরেছি আবার বাড়ি বয়ে নিয়ে এসেছি।’ 

‘যা মজা হবে! মা-কে বলব অনেক মশলা দিয়ে রাঁধতে। আজকে একটা দিনের মতো দিন। কী যে খুশি লাগছে!’ 

দেশাখের বুক কেমন করে। বিশাখা বড়ো অল্পে খুশি হয়, ওর ওই খুশিটুকু যদি প্রতিদিনের করে দেয়া যেত! 

‘এই কী ভাবছ?’ বিশাখা দেশাখের পিঠে হাত রাখে। 

‘তুমি এতদূর একলা একলা কেন এসেছ বিশাখা? 

‘মা কাঁদছিল, নইলে রাতে উপোস—’ 

‘ও আর বলতে পারে না।’ 

‘থাকগে এসব কথা।’

দেশাখ ওকে বুকে টেনে নেয়। শুকনো চুল সরিয়ে দেয় কপালের ওপর থেকে। পেটে আগুন নিয়ে আগুপিছু ভাবা যায় না, এটা দেশাখ বোঝে, তবু মন মানতে চায় না। বিশাখার বিষণ্নতায় ও ভীষণ অনুতপ্ত হয়, কথাটা না বললেই পারত। বিশাখাও জানে ওর এই আসাটা দেশাখেরও পছন্দ নয়, কিন্তু উপায় কী, বিশাখার গলা ধরে আসে। দেশাখ ওকে খুশি করার জন্য বলে, ‘দেখি কতগুলো শামুক পেয়েছ?’ 

‘অনেক, আমাদের দু-দিন হবে, আজকে আমার ভাগ্য খুব ভালো, শামুক আবার খরগোশ! 

দেশাখের মনে হয় ওর বোন দুটিও এমন শামুক খুঁজতে আসে, কাঁকড়া ধরতে যায়। ও বিরক্ত হয়, এই প্রসঙ্গ থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। 

‘বিশাখা আজ সন্ধ্যায় হরিণ-উৎসব।’ 

‘সত্যি?’ ও আবেগে দেশাখকে জড়িয়ে ধরে। 

‘সন্ধ্যা হয়ে আসছে, চলো এখন যাই। আমি নীচে দাঁড়াব, তুমি মা-কে বলেই চলে আসবে।’ 

বিশাখা লাফিয়ে ওঠে। সবুজ টিলাগুলো ভীষণ নির্জন, যেন টিলার ওপরের ছোটো ছোটো বাড়িগুলো প্রস্ফুটিত কার্পাস। দেশাখের শিকারে অব্যর্থ হাতের মুঠোয় বিশাখার শামুক-খোঁজা কাদা লাগা হাত। দূর পাহাড়ের দিক থেকে মৃদু হাওয়া আসছে। সবুজ টিলার পাদদেশে একজোড়া মানব-মানবীর আকাঙ্ক্ষা নদীর মতো বয়ে যায়। দুজনে কথায় হাসিতে মগ্ন হয়ে পথ চলে। 

বিশাখাকে উৎসব-প্রাঙ্গণে রেখে দেশাখ বাড়ি আসে। টিনের তোরঙ্গের নীচ থেকে বহুদিনের পুরোনো নীল জামাটা বের করে গায়ে দেয়। চুপচুপে করে দেয়া সরষের তেলে চুলগুলো চকচকে করে তোলে, জুলফি বেয়ে সে তেল গড়ায়। ভাঙা আয়না বারান্দায় নিয়ে এসে মাঝখান দিয়ে সিঁথি করে চুল আঁচড়ায়। বাবার ঘর থেকে কাশির শব্দ আসে, মা-র সাড়াশব্দ নেই, ভাই-বোনগুলো চলে গেছে উৎসব-প্রাঙ্গণে। বেরোতে গিয়ে দেশাখের বুক খচ করে ওঠে, চাঁচর বেড়ার ওই পাশে সুলেখা কেমন চুপচাপ বসে আছে, পিঠের ওপর রাশি রাশি চুলের গোছা যেমন কালো তেমন ঘন এবং লম্বা। ও থমকে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত দেখে নিজে নিজেই বলে, ‘অপূর্ব!’ অনেকদিন হল সুলেখা আর ভুসুকুর কথা জিজ্ঞেস করে না, যত দিন যায় ও ম্রিয়মাণ হতে থাকে। ভুসুকু যাদের সঙ্গে বাণিজ্যে গেছে তারা কেউ ফেরেনি, কোনো খবরও নেই। হঠাৎ দেশাখের মনে হয় অর্থহীন অপেক্ষা, ভুসুকু আর ফিরবে না। নৌকা হয়তো জলদস্যুরা নিয়ে গেছে, তরঙ্গসংকুল মাঝনদীতে ওদেরকে চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, নয়তো ঝড়ে নদীতে ডুবেছে। সুলেখা মিছেই দিন গুনছে। এই বয়স কি সুলেখা আর কোনোদিন ফিরে পাবে? না কি আনন্দে নিজেকে মাতিয়ে তোলার সুযোগ হবে? রাতদিন তো এই সংসারের পিছে খেটে মরে, তবে কেন একদিনের জন্য উৎসবে যাবে না? কেন মন খারাপ করে বসে থাকবে? 

ভাবতে ভাবতে ও এক পা দু-পা করে সুলেখার পিছে এসে দাঁড়ায়, ‘বউদি?’ 

‘বলো।’ 

সুলেখা মুখ না ঘুরিয়েই উত্তর দেয়, গলা ভারী, চোখের কোনা ভেজা। কিন্তু দেশাখকে অশ্রু দেখাতে চায় না। 

‘আমার চেহারা কি এতই খারাপ যে তাকাবে না বলে ঠিক করেছ?’ 

দেশাখ ওকে হাসাবার চেষ্টা করে, নিজেও হাসে। কিন্তু লাভ হয় না। সুলেখা একইভাবে বলে, ‘কী বলবে বলো?’ 

‘চলো।’ 

‘কোথায়?’ 

‘কেন হরিণ-উৎসবে?’ 

‘তুমি যাও।’ 

‘আমি তো যাবই, তোমাকেও নিয়ে যাব।’ 

‘বাবা-মা?’ 

‘অত সংকোচের দরকার নেই বউদি। এ সংসারে আমার ওপর কে কথা বলবে? কেউ কিছু বললে সেসব আমি দেখব। তুমি ওই বিয়ের সময়কার মেঘডুম্বুর শাড়িটা পরে নাও। আমি উঠোনে দাঁড়াচ্ছি।’ 

সুলেখা আর কোনো কথা না বলে ঘরে চলে যায়, মনে কৃতজ্ঞতা, দেশাখ যেন ওকেও ভুসুকুর বাণিজ্যের নৌকায় উঠিয়ে দিয়েছে, ও বন্দর অভিমুখে চলেছে। পটহ-মাদলের শব্দ উত্তাল হয়ে ওর দিকে ছুটে আসছে। কুয়োতলার ছোলঙ্গ গাছটায় বসে একটা কাক ডাকছে, চারদিকে ছমছমে আঁধার, ঘরের ভেতর একজন বৃদ্ধের কাশি দমকে দমকে বাড়ে, তার পাশে কেউ নেই। এক সময়ে এসব উৎসবে তার রক্ত ছলকে উঠত, এখন কি শুনতে পাচ্ছে পটহ-মাদলের শব্দ? অল্পসময়ে সুলেখা বেরিয়ে আসে, অন্ধকারে ওকে রহস্যময়ী মনে হয়। কাপড়ের খসখস শব্দ সে রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে। সুলেখাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটে দেশাখ। 

হরিণের পোড়া মাংসে ভুরভুর করছে সমগ্র পল্লি। আগুনের লাল শিখা গনগনে, সাত-আটজন মিলে ঝলসাচ্ছে মাংস। কাছেই পটহ-মাদলের ঝংকারে নাচছে ডোম্বি, কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। দেশাখ সুলেখার হাতে চাপ দেয়, ‘দেখছ ডোম্বিটা যেন কী?’ 

‘ও নইলে আসর জমে না।’ 

সুলেখা গাঢ় কণ্ঠে বলে। সে স্বরে সুলেখার দিকে চমকে তাকায় দেশাখ, বোঝে এ নারী বদলে গেছে, লাস্যময়ী হয়ে উঠেছে, ওর চোখের দীপিত বাসনার ফুলকি হাওয়াই-বাজির মতো জ্বলছে আর নিভছে। দেশাখ ওর হাত ছেড়ে দেয়, ওর ঘাড়ে মৃদু চাপড় দিয়ে ভিড়ে মিশে যায় সুলেখা। দেশাখ কিছুক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থাকে, ওর মনে হয় চারদিকের মানুষের তপ্ত নিশ্বাসে সময়টা এখন রাত নয়, যেন এক প্রচণ্ড দুপুর, একটু পর খাওয়াদাওয়া শেষ হলে উদ্দাম হয়ে উঠবে পটহ-মাদলের শব্দ, সঙ্গে জোড়া জোড়া মানুষগুলোও। ও বিমূঢ়ভাব কাটিয়ে বিশাখাকে খোঁজে। ও একমনে ডোম্বির নাচ দেখছিল, ওকে হাত ধরে টেনে অর্জুন গাছের আড়ালে নিয়ে আসে। 

বিশাখা ছটফটিয়ে ওঠে, ‘এত দেরি করেছ কেন? তোমাকে খুঁজে—’ 

দেশাখ ওকে কথা বলতে দেয় না, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে। অর্জুন গাছের আড়ালের আধো- অন্ধকারে ওরা মিশে যায়। 

খাবার সময় হয়েছে, পটহ-মাদল থেমে থেমে শব্দ করছে, তালের বাইরে এলোপাতাড়ি বাড়ি পড়ছে, ডোম্বি পা ছড়িয়ে বসে আছে, বাচ্চারা খেয়েদেয়ে চলে গেছে। দেশাখ মাংস বিতরণ করছে, সুলেখাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না ও। সবাই গোল হয়ে বসে আসর জমিয়েছে, ছোটো ছোটো হাড় এ ওর গায়ে ছুঁড়ে মারে। সঙ্গে হাঁড়িয়া আছে, নেশার এখন প্রচণ্ড গতি, ঠেকিয়ে রাখে কারও সাধ্যি। দেশাখের মনে হয় চমৎকার সেজেছে শবরী, অপূর্ব দেখাচ্ছে ওকে। বিশাখা নিজেকে সাজাতে পারে না, বোঝে না কোন জিনিসে ওকে মোহিনী মনে হবে, শবরী জানে। কাহ্নুপাদের কবিতার মতো শবরী নিজেকে সাজায়। এসব ব্যাপারে এই পল্লিতে ও-ই সেরা। দেশাখ শবরীকে একটা বড়ো মাংসের টুকরো দিতে দিতে বলে, ‘খাও বউদি নাচের সময় কাজে লাগবে। 

‘দ্যাখো কাণ্ড, আমি খেতে পারব না।’ 

‘বললেই হল? পারতেই হবে।’ 

সবাইকে দিয়ে নিজে একটা মাংসের টুকরো নিয়ে বসে। অন্যপাশে বিশাখার চোখে চোখ পড়তে দেখে ও মিটমিটি হাসছে। দেশাখ ওকে জিভ দেখায়। 

কাহ্নুপাদের পাশে বসেছে শবরী, ওর ঝকঝকে সাদা দাঁত ঝিলিক দেয়, অকারণে হাসে, কায়দা করে দাঁতের ফাঁকে মাংসের টুকরো ধরে রাখে। কখনো কাহ্নুপাদের পিঠে হাত রেখে কথা বলে। এ দৃশ্যে ডোম্বি চোখ ঘুরিয়ে নেয়, ক্রোধ দমন করার জন্য গুনগুনিয়ে গান গায়, দুম করে পা ফেলে ঘুঙুর বাজায়, বাজনাদারদের গায়ে গড়িয়ে পড়ে, মনে আগুনের জ্বালা, অসম্ভব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে রাখে। কাহ্নুপাদ ওকে যতই ভালোবাসার কথা শোনাক—গোপনে মল্লারী ডাকুক, উৎসবে শবরী সব। ডোম্বি ঢকঢক করে হাঁড়িয়া গেলে। বাঁধা দেয় নিশিকান্ত, ‘এত খেলে নাচবি কী করে? শরীর নড়বে না তো।’ 

‘নাচব না।’ 

‘নাচবিনে মানে? রাত কত বাকি—’ 

‘তাতে কী? নাকি রাতটুকু তো সবার। সবাই তো তখন জোড়ায় জোড়ায় নাচবে।’ 

নিশিকান্ত হাঁ-করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এই রমণীর নৃত্যের সঙ্গে ও বাজনা বাজায়, কিন্তু কোনোদিন ওকে বুঝতে পারে না। ও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ডোম্বির ঝাঁঝালো কণ্ঠ শিথিল হয়ে যায়, কারও ওপরই-বা রাগ করবে, রাগ করলে শরীর কিড়মিড় করে, নাচতে ইচ্ছা করে না। তাতে লাভের বদলে লোকসান। জীবনভর লোকসানের পাল্লাই ভারী হয়েছে, ও আর সে বোঝা বাড়াতে চায় না। এখন মন চায় কেবল প্রতিশোধ। কার ওপর, কীসের ওপর বুঝতে পারে না। বোঝার চেষ্টায় ও নিজেকে ক্ষয় করে। 

সুলেখা অন্ধকার হাতড়ে সঙ্গী খুঁজে পেয়েছে, বিপত্নীক সুদাম ওর সঙ্গী হয়েছে। গত বছর বউ মরেছে সুদামের, সারা দিন খেতে কাজ করে, রাজার জমিতে ধান বোনে। কারও সাতে-পাঁচে নেই, মুখে হাসি লেগেই থাকে। সবসময়ই সুদামকে পছন্দ করত ও। আজ সুযোগ পেয়ে দুজনে প্রাণভরে নাচবে বলে ঠিক করেছে। 

পোড়া মাংসের গন্ধ এখন আর বাতাসে তীব্র নয়, মৃদু। হাঁড়িয়ার নেশা সবার মগজে, কিন্তু পটহ- মাদলের ঝংকৃত শব্দে জোড়া পা চঞ্চল, উদ্দাম, কোনোদিকে খেয়াল নেই ডোম্বির, একমনে হাঁড়িয়া খায়, ওর নেশা আজ সমুদ্র হয়েছে, যত ঢালো কোনো আপত্তি নেই, ওর ঘুঙুর আর বাজে না। 

পিপুল গাছের নীচে কাহ্নুপাদ শবরীর খোঁপা খুলে দেয়, ও ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন নারী হয়ে কাহ্নুপাদকে আচ্ছন্ন করে রাখে। জোড়া জোড়া নর-নারী কেউ কারও দিকে তাকায় না, নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। দেশাখের মনে হয় চারপাশের এইসব মানুষকে ও চেনে না, ও বিশাখার মধ্যে নিজের অস্তিত্ব খোঁজে। এক সময়ে পটহ-মাদল থেমে যায়, বাতাসে মাংসের গন্ধ আর নেই, আগুন নিভে ছাই, উৎসব শেষ। খোলা আকাশের নীচে ওরা ঘুমিয়ে থাকে, শেষরাতের হিমেল বাতাস সে ঘুম আরও গাঢ় করে দেয়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *