অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ৩
একটি ছোলঙ্গ সুতোয় বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছে দেশাখ। অরুণ ওটা বার বার দুলিয়ে দেয়। দোলানো ছোলঙ্গটাকে তিরবিদ্ধ করে হাতের তাক ঠিক করে ও, একটুও এদিক-ওদিক হয় না। যত জোরেই দুলুক না কেন দেশাখ ঠিক সেটাকে বিদ্ধ করে ফেলে। প্রতিদিন ও অনুশীলন করে, শরীর দিয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে। পেশিবহুল বাহু টানটান হয়ে থাকে। অরুণ মুগ্ধ চোখে ওকে দেখে।
‘তোমার মতো হাতের তাক আর কারও নেই দাদা, ইস তুমি কী সুন্দর পারো!’
‘তোকেও শেখাব, শুধু ধৈর্য আর সাহস চাই।’
‘আমিও তোমার মতো শিকারি হব। শিকারে উত্তেজনা আছে, আমি সেটা চাই। জানো দাদা ছুটকি না শিকার দু-চোখে দেখতে পারে না।’
দেশাখ ওর কথায় খুব মনোযোগ দেয় না। একমনে লক্ষ্য ঠিক করে। এ সময়ে কথা বলা ও একদম পছন্দ করে না।
‘অরুণ ছোলঙ্গটা এবার গড়িয়ে দে।’
অরুণ ফলটা দড়ি থেকে ছিঁড়ে মাটিতে গড়িয়ে দেয়। ও জানে দেশাখ গড়িয়ে যাওয়া ফলটাকেও তিরে গাঁথবে। অরুণ বেশ জোরেই ফলটা গড়িয়েছে, কিন্তু দেশাখ অবলীলায় সেটা তিরে গাঁথে। সাধনায় ওস্তাদ ও, প্রতিদিনের এই একাগ্রতাটুকু আছে বলেই হাত নষ্ট হয়নি। ও ফলসহ তিরটা উঠিয়ে নিতেই সুলেখার ডাক শোনে।
‘ও দেশাখ এবার যাও ভাই, বেলা হয়ে যাচ্ছে। রোদ উঠলে আবার নিজেই বিরক্ত হবে এবং পূর্বপুরুষসহ আমাকে উদ্ধার করে ছাড়বে।’
‘আমি আর কী উদ্ধার করব? নিজেই তো উদ্ধার হয়ে আছ।’
সুলেখা কথা বলে না। দেশাখের স্বভাব জানে। শিকারের বাইরে কোনো কাজ খুব একটা করতে চায় না। তার ওপর মনমতো না হলে সবাইকে গালাগাল করে। ওর রুক্ষ চেহারায় কোথাও কোনো মায়াদয়া নেই বলেই মনে হয়। মোটা ঠোঁটের ওপরে ঘন গোঁফ দেখলে ভয়ই করে। সুলেখার ডাকে আঙিনায় ফিরে বাঁশের তৈরি চাঙারিগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে বাঁশের দু-মাথায় দুটো অংশ ঝুলিয়ে দেয়। বাঁশটা কাঁধে ফেলে এখুনি শহরের দিকে রওনা দিতে হবে। বেচে কিছু কড়ি পেলে এবং তা দিয়ে চাল কিনতে পারলে তবে খাওয়া। নইলে সবাই উপোস দেবে। গতদিন শিকারে একটা সজারু আর কয়েকটা ঘুঘু পেয়েছিল, তা বেচে মা-কে আর বউদিকে একজোড়া কাপড় এনে দিয়েছে। তাই এখন ঘরে খাবার নেই। কাগনি ধানের চাল এসেছে বাজারে, একদিনও কেনা হয়নি। বাড়িতে আটজন লোক, পঙ্গু বাবা, বৃদ্ধ মা, তরুণী দুই বোন, ছোটো ভাই, বড়োভাইয়ের বউ সুলেখা। বড়োভাই পরের নৌকায় বাণিজ্যে গেছে; নিজের বাণিজ্য নয়, কড়ি রোজগারের জন্য অন্যের নৌকায় খাটতে যাওয়া, কবে ফিরবে কেউ জানে না, কোনো খবরও নেই। সংসারের সবাই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। কেবল সুলেখা চাঙারি বোনে বলে কিছুটা রক্ষা। তা ছাড়া কেউ একটা কড়ি আনতে পারে না। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে দেশাখের। সব ছেড়েছুড়ে একদিকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়, কেবল অভাব আর অভাব। কখনো স্বপ্ন দেখে দেশাখ, রাজা যদি একদিন কিছু জমি দান করে দেয়; পরক্ষণে নিজেকে শাসন করে, ছোটোলোকের আবার স্বপ্ন দেখা? মুরোদ নেই এক কড়ির, লজ্জাও করে না। এজন্য সুলেখা বলে, ‘তুমি একদম শুকনো কাঠের মত নীরস। এত কঠিন যে কী করে থাকতে পারো?’
দেশাখ সোজা জবাব দেয়, ‘বেশি ছেঁদো কথা আমার ভালো লাগে না। আমি কাজের মানুষ হতে চাই।’
বোঝাটা যখন কাঁধের ওপর উঠিয়ে নেয় তখন কচি বাঁশের পাত দিয়ে তৈরি ঝকঝকে চাঙারিগুলো সূর্যের সোনালি আলোয় চিকচিক করে। তখন মনে হয় কাজ করতে খারাপ লাগে না ওর, শুধু অভাব আর দারিদ্র্য বড়ো বেশি যন্ত্রণাদায়ক। কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কখনো নিজের দশাসই শরীর নিয়ে বিব্রত বোধ করে। মনে হয় আরও অনেক কিছু পারা উচিত, কিন্তু পারছে না কেন? বাধাটা কোথায়?
রওনা করার আগে সুলেখা সামনে এসে দাঁড়ায়।
‘তোমার দাদার একটু খবর নিও।’
শহরে যাবার সময় হলে সুলেখা সব সময় এই এক কথাই বলে। যাদের নৌকায় ভুসুকু বাণিজ্যে গেছে তাঁদের লোকজনও জানে না নৌকা কবে ফিরবে। বাণিজ্য মানেই অনির্দিষ্টকালের যাত্রা। ভাগ্য ভালো হলে নির্ঝঞ্ঝাটে ফিরে আসা যায়, নইলে একদিকে যেমন রয়েছে ঝড়বৃষ্টির ভয় তেমনই অন্যদিকে আছে জলদস্যুদের উৎপাত। সামনে পড়লে নিঃস্ব করে। বাধা পেলে গলা কেটে নদীতে ফেলে দেয়। এসব ভাবতে ভাবতে দেশাখ জামা গায়ে দেয়। হাতকাটা ফতুয়া, নীল রঙের। শহরে যাবে বলে সুলেখা হয়তো খড়িমাটি দিয়ে কেচে রেখেছে, নইলে বেশিরভাগ সময় ওর জামা নোংরাই থাকে। বিশেষ করে ঘামের গন্ধ ওকে কষ্ট দেয়। শহর থেকে ফিরে সুলেখাকে মিথ্যা কথা বলতে হবে। সুলেখাও জানে দেশাখের পক্ষে খবর আনা সম্ভব নয়। তবুও দেশাখকে একই কথা বলবে ও এবং দেশাখ একই উত্তর দেবে। এই নিয়ে সুলেখার সঙ্গে ওর একটা মনগড়া সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে, চতুরালিতে দুজনেই ওস্তাদ। কেউ কারও কাছে হারতে রাজি নয়। দেশাখ মনে মনে হাসে, দাদাকে ছাড়া বউদির দিন যেন আর কাটে না। তার শারিরিক মানসিক পারিপার্শ্বিক ভুসুকুর জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে। একটু পর সুলেখা এসে ওর হাতে এক টুকরো হরিণের মাংস গুঁজে দেয়, কবেকার মাংস দেশাখও জানে না। একসঙ্গে বেশি মাংস পেলে লবণ-হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করে শুকিয়ে রাখা হয়। দরকারমতো বের করে গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে ভুনা করে সুলেখা।
‘এটা খেয়ে যাও ভাই। আর কিছু নেই।’
সুলেখার ‘আর কিছু নেই’ কথায় দেশাখের সংকোচ হয়। পরের ঘরের এই মেয়েটি ওদের সংসারে কষ্ট করছে। বাপের বাড়ি গেলেও বেশিদিন থাকে না।
‘ভাবছ কী? নাও?’
‘না থাক, বাবাকে দিও।’
‘না, না তুমি খাও। তুমি এতদূর হেঁটে যাবে, পথে কষ্ট হবে। বাবাকে আমি অন্য কিছু দেব। বাবার জন্য তোমার ভাবতে হবে না।’
‘কী দিতে পারবে তা তো জানি।’
দেশাখ হাত বাড়িয়ে মাংসের টুকরো নেয়। মুখে পোরার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসে বাপের কাশির শব্দ। ওর মা বুকে তেল মালিশ করে আর গালি দেয়। দেশাখ নির্বিকার মাংস চিবোয়। এসবে ও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে, এ নিত্যদিনের ঘটনা।
শুনতে পায় মা-র খনখনে কণ্ঠ, ‘মরেও না বুড়ো, মরলে তবু হাড় জুড়োয়। এ জ্বালা আর সইতে পারি না।’
বাবার উত্তর ওরা কেউ শুনতে পায় না। প্রবল কাশির তোড়ে ভেসে যায় তার সুখদুঃখ। যৌবনে বাবা ভীষণ রাগী ছিল। মা-কে মারত, পান থেকে চুন খসলে সইতে পারত না। একদিন রাগ করে দেড় বছরের ভুসুকুকে ছুঁড়ে মেরেছিল উঠোনের ডাঁটা খেতে। সে শোক ওর মা আজও ভোলেনি। আজ মা সুযোগ পেয়েছে, কথার শাণিত চাবুকে প্রতিশোধের মাসুল ওঠাচ্ছে।
‘ওকে না নিলে আমাকে উঠিয়ে নাও ভগবান।’
দেশাখ ও সুলেখা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। আসলে দুজনের প্রয়োজন দুজনের কাছে ফুরিয়েছে। বাবা অথর্ব বলে মুখ খোলে না, মা-র শরীরে কিছু শক্তি আছে বলেই গালাগাল করে। বাবাকে সহ্য করতে পারে না। ভাবনার মাঝে দেশাখের চকিতে মনে হয়, অথচ সুলেখা ভুসুকুর বাড়ি ফেরার আশায় উদগ্রীব হয়ে আছে। কেন? ভুসুকু জোয়ান, উপার্জন করতে পারে, সুলেখার সবরকম প্রয়োজনে লাগে এজন্য কি? দেশাখ উত্তর খুঁজে পায় না। হঠাৎ করে সুলেখাকে প্রশ্ন করে, ‘দাদাকে তুমি খুব ভালোবাসো, না বউদি?’ দেশাখের প্রশ্নে সুলেখার মুখ লাল হয়ে ওঠে, উত্তর দেয় না। যাবার জন্য ওকে তাড়া দেয়।
‘তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যাও, রোদও চড়চড়িয়ে উঠছে।’
‘যাচ্ছি। কিন্তু জানি, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তুমি মা-র মতো দাদাকে গালাগাল করবে, জোর করেও ভালোবাসতে পারবে না। আমার বউও আমার সঙ্গে এমন করবে।’
সুলেখা হেসে বলে, ‘বাবা, অত ভবিষ্যৎবাণী করতে হবে না।’
দেশাখ মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে যায়, দ্রুত চলতে থাকে। সুলেখা আনমনে সেদিকে তাকিয়ে থাকে, মনখারাপ হয়ে যায়। দেশাখ কেমন অনায়াসে কথাগুলো বলে গেল। সবার জীবনেই কি এমন ঘটে? হয়তো সত্যি, হয়তো নয়, কে জানে। বছর দেড়েক ধরে ভুসুকু ওর কাছে নেই, কিছুই ভালো লাগে না। দেশাখ রোজগার করেই দায় সারে, তা দিয়ে সংসার চলুক আর না চলুক সে নিয়ে ও ভাবে না। অথচ এই অভাবের সংসারকে দু-হাতে বেড় দিয়ে রাখতে হচ্ছে ওকে। সকলের দাবি ওর কাছে। অরুণ এসে আঁচল ধরে টানাটানি করে, ‘খিদে পেয়েছে বউদি?’
সুলেখা অরুণের দশ বছরের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর চেহারায় ভুসুকুর আদল আছে।
‘খিদে পেয়েছে বউদি?’
‘খিদে পেয়েছে তো আমি কী করব?’
‘বা রে, তুমি না করলে কে করবে?’
সুলেখা হেসে ফেলে, ‘আয়।’ ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে ঘরে ঢোকে।
‘তুমি না থাকলে আমাকে কেউ খেতে দিত না বউদি।’
অরুণের চোখ ছলছল করে ওঠে। সুলেখা ওর কপালে চুমু দেয়, ‘পাগল। একজনের জন্য কি সব কিছু আটকে থাকে রে? ঠিকই দিন চলে যায়।’
‘মিছে কথা। তুমি না থাকলে আমার দিন যেত না। আমি পালিয়ে যেতাম। জলদস্যুর নৌকায় উঠে দস্যু হয়ে যেতাম। বড়ো হলে আমি দাদাকে খুঁজতে যাব বউদি।’
‘ও কি আসবে না? কবে আসবে?’
সুলেখার বুক গুমরে ওঠে। অরুণকে সে-কথা বলা হয় না। বোঝে এইসব দায়িত্বের জন্য ও এই সংসার থেকে নড়তে পারে না। ভুসুকু যাবার পর বাবা তো ওকে কতবার নিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু ও একবারে যেতে পারে না, ক-দিন বেড়িয়ে আবার চলে আসে। যাবার কথা উঠলে দেশাখসহ আর সবাই এমন অসহায়ভাবে ওর মুখের দিকে তাকায় যে তখন আর কিছুই করার থাকে না ওর। কেউ ওকে জোর করে না, যেতে দেবে না বলে শাসায় না তবু কোথায় যেন কী একটা বন্ধন আছে, অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা সেটা।
গতরাতের হাঁড়িয়ার তলানিটুকু শ্বশুরকে দেয় সুলেখা। বৃদ্ধ বড়ো আগ্রহে টেনে নিয়ে কয়েক চুমুকে শেষ করে ফেলে। সুলেখা আবার সবার মুখে কী দেবে সে চিন্তা করতে থাকে। অরুণ একমুঠি পান্তা এক সানকি পানির মধ্য থেকে সপসপ করে খাচ্ছে, আর সবাই উপোস। লোকি আর গুনি বারান্দার কোণে চুপচাপ বসে আছে। ওরা বড়ো লক্ষ্মী, কখনো কিছু চায় না, বরং এদিক-সেদিক ঘুরে এটা- ওটা জোগাড় করার চেষ্টা করে। কোঁচড়-ভরতি শাক আনে, ফল-পাকুড় খোঁজে, কখনো অন্যের গাছ থেকে কিছু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে বকা খায়, এখন সবই ওদের গা-সওয়া। সুলেখা ওদের ডেকে বলে, ‘তোরা নদীর ধার থেকে একবার ঘুরে আয়।’
এর অর্থ দুজনই বোঝে। জেলেরা যেখানে বড়ো জাল ফেলে মাছ ধরে সেখানে ওরা প্রায়ই ঘোরাফেরা করে। কখনো ট্যাঁকে গুঁজে মাছ নিয়ে আসে, কাঁকড়া পেলে তো কথাই নেই। জাল থেকে ছাড়া পেলে কাঁকড়াগুলো ছুটতে থাকে। দু-বোনে সেগুলো ধরার চেষ্টা করে। পেলে শাড়ির আঁচলে বেঁধে ফেলে। তারপর ছুটতে ছুটতে ঘরে ফেরে। অনেক সময় অন্যেরা কেড়ে নেয়। যেদিন আনতে পারে সেদিন ওদের আনন্দ আর ধরে না। সুলেখা যত্ন করে রাঁধে। আর দু-বোন কুয়োতলার ঠান্ডা ছায়ায় বসে গায়ে পানি ঢালে, কাদা ধুয়ে ফেলে। ওদের উত্তেজনা ফুরোয় না, সম্ভব-অসম্ভব হাজার কথায় ভরিয়ে রাখে সময়। আজও সুলেখার ইশারা পেয়ে দুজনে ছুটে বেরিয়ে যায়। সুলেখা সংসারের নিত্যকাজে মন দেয়।
এই এক অবস্থা ধনশ্রীর চাঁচর বেড়ার ঘরেও, ভৈরবী গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তিন বছর আর দু-বছরের ছেলে দুটো একটানা কাঁদছে। ওদেরকে কোলে নিতেও ইচ্ছে হয় না ওর। ভাবে, কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে শক্ত করুক নিজেদের। মায়ের আদর দিয়ে ও কি আর ওদের ধরে রাখতে পারবে? নগরের বাইরের এই কাদা-গড়াগড়ির জীবনে শক্ত না হলে ওদের সামনে সবটাই অন্ধকার। যে অন্ধকারে তলিয়ে গেছে ভৈরবী নিজেই। ভোরে গোরু দুয়ে তিন সের দুধ পেয়েছে ধনশ্রী, বিক্রি করে চাল আনবে। কখন ফিরবে কে জানে, খেয়ালি মানুষ। দাবার আড্ডায় মজে গেলে সারা দিনে হয়তো আর ফিরবে না। একদিকে অভাব আর অন্যদিকে স্বামীর খামখেয়ালি, এ দুইয়ের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ করতে হয় ওকে। ও একেই ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে, আক্ষেপ নেই, প্রতিবাদ নেই। ভীষণ মনখারাপ হলে নিজের মধ্যে গুমরে মরে। নিজেকে পীড়ন করেই ও আনন্দ নিংড়ায়। শান্ত স্বভাব ভৈরবীর, কথা বলে কম, যখন বলে তখন সুন্দর করে বলে। সেজন্য সবাই পছন্দ করে। ছেলে দুটো একটানা কাঁদছে, ভৈরবী আনমনে তাকিয়ে থাকে। অতিথি এসেছে দুজন, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়। ধনশ্রীর দূর-সম্পর্কের ভাই। একমুঠো চাল নেই ঘরে যে সেদ্ধ করে দেবে। ভয় হয় ওর, অতিথিদের অভুক্ত রাখলে পাপ হবে। ধনশ্রী কখন ফিরবে? কত বেলা পর্যন্ত ও অপেক্ষা করবে? ও মনে মনে প্রার্থনা করে, বিধাতার কাছে ক্ষমা চায়। হঠাৎ করে নিজের নিরুপায় অক্ষমতার জন্য রাগও হয়। একমাত্র কামোদের কাছে যেতে পারে, চাইলে সের খানেক চাল বাকিতে দেবে। কেন দেয় কামোদ? পুরোনো ভালোলাগার জন্যই তো। সে অধিকার কি ভৈরবী এখন খাটাবে? পরক্ষণে ঝেড়ে ফেলে সব নীতিবোধ। ছোটো ছেলেটাকে কাঁধে নিয়ে বড়োটার হাত ধরে বেরিয়ে যায়। অতিথিরা ঘরে নেই, এক্ষুনি হয়তো আবার ফিরে আসবে।
বেশ ভিড় কামোদের দোকানে। ভৈরবী এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এসেছে বাকি নিতে, সুতরাং খদ্দের সব বিদেয় না হলে কোনো কথা বলাই সম্ভব নয়। কামোদের সঙ্গে দু-বার চোখাচোখি হয়েছে। ওর চোখে ভৈরবীর জন্য ভাষা থাকে, ভৈরবী তা বুঝতে পারে কিন্তু উত্তর দিতে জানে না। আবেগের প্রকাশ ও আবেগ দিয়ে ফিরিয়ে দেয় না। ও বোঝে না কেন এমন হয়। ছোটোবেলা থেকে কামোদের সঙ্গে বড়ো হয়েছে ও। কামোদ ওকে ভালোবাসত, চেয়েছিল বিয়ে করতে। কিন্তু ভৈরবীর বাবা পাত্র হিসেবে কামোদকে পছন্দ করেনি, বরং গালাগাল করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। ভৈরবীর নিজের কোনো ইচ্ছে-অনিচ্ছে ছিল না। বাবা যা করেছে সেটাকে ও ভালো বলে মেনে নিয়েছে। এই মুহূর্তে সে-কথা মনে পড়লে ও ক্রমাগত সংকুচিত হতে থাকে। কামোদের অবস্থা এখন ভালো। ও নিজের সঙ্গে জেদ করে অনেক কিছু করেছে, অন্তত ঘরে চাল বাড়তি থাকে। ভৈরবী চাইলে কামোদ কখনো ফিরিয়ে দেয় না, তাই দোকানে অনেক বাকি। ধনশ্রীর সাধ্য হয় না শোধ করার। ওই দাবার আড্ডায় মন না থাকলে হয়তো অনেক কিছু করতে পারত। বেশি কিছু না পারুক নিজের সংসার ঠেকাতে পারত, ভৈরবীর যন্ত্রণা কমত কিন্তু ও জানে ওই নেশা ছাড়া ধনশ্রী অচল। খেলা ছাড়তে বললে ও সংসার থেকে পালিয়ে যাবে। সুতরাং মানসম্মানের তোয়াক্কা না করে সব সামলাতে হয় ভৈরবীকে। ঘরে অতিথি বলেই লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে আসতে হয়েছে ওকে। ও জানে অতিথিকে উপোস রাখলে সবচেয়ে বড়ো পাপ হবে। ও চোখ বুজে মনে-প্রাণে ভগবানকে ডাকে। হরিপালকে বেশ কড়া ভাষাতেই ফিরিয়ে দিল কামোদ, কিছুতেই বাকি দেবে না, বড্ড লোকসান হচ্ছে। ভৈরবীর মনে হয় ও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, পা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। বড়োটি বাড়ি ফেরার জন্য টানাটানি করছে। ও একবার ভাবে ফিরে যাবে, পরক্ষণে অতিথির চেহারা ভেসে ওঠে। যার ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাঁর আর শরম কী! বিদেয় হয়ে যাবার পরও অনেকক্ষণ কথা বলতে পারে না ভৈরবী। কামোদ এক সের চাল মাপতে মাপতে বলে, জানি কী বলবে? কিন্তু খদ্দের বিদেয় না করে তো কথা বলতে পারি না।
‘জানি কামোদদা। কী করব বলো, ঘরে অতিথি।’
‘হাঁড়িতে ভাত নেই, নিত্য অতিথি! এ জ্বালা তোমার জুড়োবে কবে বলো তো?’
‘ছিঃ ছিঃ কামোদদা ওকথা বলতে নেই।’
ভৈরবী মনে মনে শিউরে ওঠে। ওর মনে কি পাপপূণ্য বোধ নেই? এমন কথা বলে কী করে? ওর ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে কামোদ আর কথা বলে না। এই অবুঝ নিষ্পাপ মহিলাকে দুঃখ দিয়ে লাভ কী? ও ওর মতো পাপপূণ্য নিয়েই চলুক। চালটা পোঁটলা বেঁধে ভৈরবীর দিকে এগিয়ে দেয়। ভৈরবী ভাবে কামোদ কি এখনও ওর ওপর রাগ করে আছে? কে জানে, কোনোদিন তো কিছু বলে না। বলে না কেন? কেন মুখ ফিরিয়ে রাখে না?
চালের পোঁটলা ভৈরবীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে হেসে বলে, ‘অনেক বাকি তোমাদের।’
ভৈরবী এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘ও এলেই তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব।’
‘না, ধনাদাকে আর পাঠাতে হবে না। তোমার কাছে আমার বাকিই থাক।’
ভৈরবীর হাত কাঁপে। কামোদের চোখের ভাষা তীব্র হয়ে উঠেছে, ওর পালানো দরকার। পোঁটলাটা আঁচলের নীচে নিয়ে দ্রুত হাঁটে। কামোদ অন্যমনস্ক হয়ে ভাবে, নিত্যদিন অভাব তবু মুখের হাসিটি কখনো মিলিয়ে যায় না ভৈরবীর। কামোদের বুক হুঁ-হুঁ করে ওঠে, এমন একটা মেয়েকে বউ করার সাধ ছিল ওর। স্বপ্ন দেখেছে কত!
‘এক কড়ির তেল দাও কামোদদা?’
‘তেল?’
‘হ্যাঁ, কী ভাবছ? এমন ভ্যাবলাকান্ত হয়ে থাকলে কি দোকান চলবে?’
‘তেল দিয়ে কী রাঁধবে?’
‘সে কি আর আমি জানি? জানে বউ।’
‘তাই তো।’
কামোদ হেসে ফেলে। খদ্দের চলে যায়। কামোদ কিছুতেই নিজের স্বস্তি ফিরে পায় না। ভৈরবী দোকানে এলেই সেদিন ওর পুরো দিন নষ্ট।
ঘরে ফিরে ভৈরবী চাল সেদ্ধ বসায়। এতক্ষণ কেমন একটা দুঃখ ভাব ছিল মনের মধ্যে। সারাটা পথ গলার কাছে কী যেন আটকে ছিল। কেবলই মনে হয়েছে কোনোদিন যদি বড়ো সরপুঁটির দোপেঁয়াজা করে সামনে বসিয়ে কামোদকে খাওয়াতে পারত। শুধু একদিন যদি এমন ঘটনা ঘটত ওর জীবনে! কেন এমন আকাঙ্ক্ষা এতবড়ো হয়ে ওকে আচ্ছন্ন করে? ওর স্বামী আছে, সন্তান আছে। না, এতবড়ো পাপের কথা ও কিছুতেই ভাববে না। টগবগে ভাতের দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করে। উঠোন থেকে লাউ আর বেগুন তুলে এনে কাটতে বসে। মন খুশিতে ভরে ওঠে। অতিথিকে গরম ভাত আর গরম তরকারি দিতে পারবে, এই মুহূর্তে ভৈরবী এর বেশি কিছু আর ভাবতে পারে না। ওর চাওয়া খুব কম, বড়ো অল্পে তৃপ্ত হয়ে যায়। ছেলে দুটোকে গরম ভাত দিয়ে বসিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে চোখে জল আসে ওর। মনে হয় জীবনে আর কোনো কিছু চাইবার নেই, বড়ো কিছু চাইতে ভয় করে ওর, ভয় হারাবার। পেয়ে ধরে না রাখতে পারার ভয়ও আছে ওর মনে। কেন যে এমন হয় ও বোঝে না। আর অনেক কিছু বোঝে না বলেই ওর জীবনের জটিলতা কম। দুঃখবোধও কম এবং অনায়াসে বেদনা কাটিয়ে উঠতে পারে।