অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ২

অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ২

প্রতিদিনই পল্লির ভেতর দিয়ে অনেকটা পথ পেরুতে হয় কাহ্নুপাদকে। দু-ধারে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, একটু দূরে বাজার। সূর্য ওঠার আগে থেকেই লোকজন বাড়ির সামনে প্রতিদিনের কাজ শুরু করে। আজও পাড়া জেগে উঠেছে, সবাই কাজে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। বেশিরভাগ লোকই চাষাবাদ করে, কেউ কার্পাস বোনে। বাকিরা চাঙারি বানায়, নয়তো শিকার করে। পুবদিকের বাড়িগুলোর সামনে বাচ্চাদের হইচই বেশি। ছেঁড়া একটা জাল বেড় দিয়ে ওরা মুরগি ধরার চেষ্টা করছে, এটা ওদের খেলা। তবে খেলতে খেলতে ওরা শিকারের তালিম নেয়। তারপর পাকা হয়ে বনে রওনা দেয়। বাচ্চাদের এইসব খেলা কাহ্নুপাদের ভালো লাগে। ছোটো থেকেই নিজেদের প্রস্তুত করা উচিত বলে ও মনে করে। অলস সময় কাটানো ওর একদম পছন্দ নয়। ছুটকিকে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাহ্নুপাদ অবাক হয়। 

‘কী রে তুই দাঁড়িয়ে রয়েছিস যে?’ 

‘শিকার আমার ভালো লাগে না কাকা। ওরা জীবগুলোকে বড়ো কষ্ট দেয়। আমার মায়া লাগে। সইতে পারি না।’ 

কাহ্নুপাদ থমকে ওর মুখের দিকে তাকায়। ছেলেটার টানা টানা বড়ো চোখে বিষাদ, ও যেন সবার চাইতে একটু আলাদা। ও ভাবুক, কখনো উদাসীন, যা ওর বয়সের সঙ্গে মানায় না। হয়তো ওর আলাদা কোনো চেতনা আছে, যা ওকে অন্যকিছু করার প্রেরণা দেয়। এজন্য কাহ্নুপাদ ছুটকিকে ভালোবাসে। ওর মাথায় হাত রেখে বলে, ‘তোকে তো কিছু কাজ শিখতে হবে ছুটকি।’ 

‘কেন, আমি চাঙারি বানানো শিখছি। দেশাখ কাকা বলেছেন, আমার হাতে নাকি চাঙারি সুন্দর হয়। বড়ো হলে এই পল্লিতে আমার মতো কেউ আর বানাতে পারবে না। ত 

‘তাই নাকি? খুব ভালো।’ 

কাহ্নুপাদ ওর পিঠ চাপড়ে দেয়। 

‘তুমি কোথায় যাচ্ছ কাকা?’ 

‘কেন, কাজ করতে।’ 

‘আমি একদিন তোমার সঙ্গে রাজদরবারে যাব।’ 

‘গিয়ে কী করবি?’ 

‘ঝাড়বাতি দেখব, রাজার সিংহাসন দেখব।’ 

‘ওসব দেখে আমাদের কী হবে ছুটকি?’ 

‘তুমি বোধহয় আমাকে নিতে চাও না?’ 

‘না, তা তো বলিনি।’

ও হেসে ছুটকির ঘাড়ে হাত রাখে। ছুটকি ওর পিছু পিছু হাঁটছে। দুধ দোহানোর জন্য পিঠা হাতে দাঁড়িয়ে আছে ধনশ্রী। গোয়াল থেকে গোরু বের করছে ভৈরবী। ওদের ছয়টা গোরু, দুধ বিক্রি করে ধনশ্রী। খুব একটা রোজগার নেই, তবু কিছুতেই অন্য কাজ করতে চায় না। রাতদিন দাবার নেশা, খেলায় জমে গেলে ওঠায় কারও সাধ্যি। কাহ্নুপাদকে দেখে পিঠা হাতে এগিয়ে আসে। 

‘তোমার মতো একটা কাজ আমাকে জুটিয়ে দাও না কানুদা।’ 

‘তুমি কি পারবে কাজ করতে?’ 

‘কেন পারব না, একশোবার পারব।’ 

‘তাহলে দাবা খেলবে কে?’ 

ধনশ্রী হো-হো করে হাসে। 

‘ঠিকই বলেছ। আসলে আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না।’ 

‘হবে না তা নয়। দাবা খেলাটা চাকরি হলে তোমাকে দিয়ে অনেক কিছু হত।’ 

‘সবই কপাল কানুদা, কপালে না থাকলে কিছু হয় না।’ 

ভৈরবী গোরু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাছুরগুলো ডাকছে। কাহ্নুপাদ সেদিকে ইশারা করে, ‘তোমার ডাক পড়েছে ধনাদা?’ 

‘হ্যাঁ, যাই। পারলে বিকেলে একবার এসো।’ 

‘দেখি।’ 

কাহ্নুপাদ আর দাঁড়ায় না। তাড়াতাড়ি হাঁটে। 

চাঙারি বোনার বাঁশের পাতগুলো ঘরের সামনে জড়ো করে রাখছে দেশাখ। ওর বউদি সুলেখা বড়ো দ্রুতহাতে চাঙারি বোনে। দেশাখ ওগুলো নিয়ে শহরে বিক্রি করে আসে। এর বাইরে তিরধনুক ছাড়া ও আর কিছু বুঝতে চায় না। শিকারে ওর তুখোড় হাত, বনে বনে পাগলের মতো ঘোরে। শিকার শুধু ওর জীবিকা নয়, জীবিকার অতিরিক্ত অন্যকিছু। ও কাহ্নুপাদকে দেখে বাঁশের চিকন গোছা ফেলে ছুটে আসে। 

‘মনে আছে তো কানুদা যে আমরা আগামী হপ্তায় হরিণ শিকারে যাব?’ 

‘হ্যাঁ, খুব মনে আছে।’ 

‘সব ব্যবস্থা ঠিক করে রেখেছি। 

‘আচ্ছা।’ 

‘তোমার যা ভুলো মন! রোজ রোজ মনে না করালে চলে না। 

‘তোরা আমাকে কী ভাবিস বল তো?’ 

‘তুমি কবি, তাই তুমি আমাদের মাথার মণি। তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি কানুদা।’ 

কাহ্নুপাদ হো-হো করে হাসে। ছুটকি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। 

‘এমন করে হাসছ যেন আজব কথা বলেছি।’ দেশাখ কৃত্রিম রাগ দেখায়। ‘ঠিক আছে যাই। আমার আবার শহরে ছুটতে হবে। ঘরে হাঁড়ি ঠনঠন।’ দেশাখ বুড়ো আঙুল দেখায়, তারপর দ্রুত কাজে চলে যায়। 

কাহ্নুপাদও দ্রুত পা চালায়। ওরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। পথে বেরুলে এর-ওর সঙ্গে কথা না বলে উপায় নেই। সবাই ওর আপন, সবাইকে নিয়ে ওর ভাবনা। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে। ও জানে একটুখানি হাসিমুখে কথা বললেও ওদের ক্ষুধার জ্বালা একটুক্ষণের জন্য কমে যাবে। এটুকু থেকেই বা অন্যদের বঞ্চিত করে লাভ কী? ওরা ওকে ভালোবাসে। ও কবিতা লেখে বলে মনে করে ও ওদের চাইতে আলাদা। বিপদে-আপদে ওর কাছেই ছুটে আসে সবাই। ও কি পারবে ওদেরকে নেতৃত্ব দিতে? কাহ্নুপাদ আপন মনে হাসে। সব কিছুই আপন নিয়মে চলে, নিয়মটাকে শুদ্ধ রাখতে পারাটা কঠিন, এর জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। 

ছুটকি ওর চিন্তায় বাধা দিয়ে বলে, ‘কাকা তুমি কেমন করে লেখো? আমারও লিখতে ইচ্ছা করে। ‘ঠিক আছে লিখবি, বড়ো হয়ে নে।’ 

পথের পাশে কামোদের মুদির দোকান। কামোদ দোকান খোলেনি। ও একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে। বেশ খানিকটা এগুলে রামক্রির মদের দোকান, সেটাও বন্ধ। রামক্রির বউ দেবকি একাই একশো। মদের দোকানে রামক্রির না থাকলেও চলে। দেবকি একাই মদ চোলাই থেকে আরম্ভ করে খদ্দের আপ্যায়ন এবং কড়ির হিসেব রাখা সবই অবলীলায় করে। দেবকিকে খুব পছন্দ কাহ্নুপাদের। সবসময় মুখে হাসি লেগেই থাকে, কখনো কেউ ওকে রাগতে দেখেনি। দেবকি দারুণ সতেজ, স্নিগ্ধ। শবরীর সৌন্দর্য ধনুকের ছিলার মতো টানটান, শাণিত। কিন্তু দেবকি অসম্ভব নমিত, দৃষ্টি আঁকড়ে রাখে, ব্যাকুল করে, শবরীর মতো উদ্দাম করে না। অথচ বার বার ফিরে আসতে ইচ্ছা করে, যেন বকুল ছায়া, স্নিগ্ধ এবং গন্ধময়। 

গত রাতের হাঁড়িয়া কাহ্নুপাদের মাথার মধ্যে এখনও ক্রিয়া করে। খোঁয়ারির এই সময়টা ওকে দুর্বল করে রাখে। কোনো কিছু ভালো লাগে না তখন, অথচ দেবকির কথা ভাবতে খারাপ লাগছে না। কেন এমন হয়? দেবকির সঙ্গে তেমন কিছু সম্পর্ক নেই, অথচ ওর কথা ভাবতে ভালো লাগছে, ভেবে আনন্দ পাচ্ছে। আসলে ও কখনো এমন করে সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ও বোঝে না কেন এমন হয়। প্রচণ্ড শূন্যতা মন জুড়ে হা-হা করে। ও বুঝতে চায় কোন পথে এগুলে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারবে। 

‘কাকা তুমি কী ভাবছ?’ 

কাহ্নুপাদ চমকে ফিরে তাকায়, ‘কই কিছু না রে।’ হেসে ছুটকির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এই ছেলেটা ওর খুব ভক্ত, একবার জুটে গেলে আর সঙ্গ ছাড়তে চায় না। ও রাজদরবারে যেতে চায়, কিন্তু কাহ্নুপাদ তো জানে ছুটকি যেতে পারবে না। রাজার প্রহরীরা ওকে ঢুকতে দেবে না। জন্মগতভাবে ওখানে ঢোকার অধিকার অর্জন করেনি ও। ওকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। নগরের বাইরে ওর মতো শত শত লোককে কেমন নির্বিবাদে আলাদা করে দিয়েছে ওরা। ওদের জন্য দেশের রাজার কোনো দায়ভার নেই। নিজেদের দারিদ্র্যের কথা স্মরণ করলে কাহ্নুপাদের ভেতরে এক প্রবল তাড়না হয়। রাজসভায় কত ঐশ্বর্য, কত বিলাস, কত অনাচার, কোনোকিছুই লেখাজোখা নেই। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা ওকে নিয়ে যে নাক সিঁটকানো ভাব দেখায় সেটা মোটেই ওকে স্বস্তি দেয় না, গ্লানি ওকে মরমে মারে। ধর্মেকর্মে, আচার-অনুষ্ঠানে বিধিনিষেধের আইনকানুনের হোতা সেজে আছে ব্রাহ্মণরা। এদের প্রতাপকে অস্বীকার করে কার সাধ্য! ভেতরে যত ক্ষোভ, যত জ্বালাই থাক না কেন কাহ্নুপাদকে স্বীকার করে নিতে হচ্ছে এই ব্যবস্থা। ইচ্ছে করলেই ও এর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারে না। পায়ে লাগানো আছে হাজার বেড়ি। 

ভাবতে ভাবতে কাহ্নুপাদ যখন নদীর ঘাটে এসে পৌঁছোয় বেলা তখন বেশ চড়চড়িয়ে উঠেছে। ঘাটের ওপর পা ছড়িয়ে একা বসে গুনগুনিয়ে গান গাইছে ডোম্বি। সবাই ওকে ডোম্বি বলে ডাকলেও কাহ্নুপাদ ওর নাম দিয়েছে মল্লারী। অদ্ভুত প্রাণবন্ত মেয়ে। নৌকা যেমন অবলীলায় দ্রুত বায়, তেমনই গাইতে পারে, নাচতে পারে। এমন সরেস মেয়ে এ অঞ্চলে একটিও নেই। মল্লারী মন্দিরার মতো বাজে না, সে ধ্বনি মৃদু নয়। প্রাণের গভীরে ধীর লয়ে সঞ্চারিত হয় না। মল্লারীর কোথাও মৃদুমন্দতা নেই, ও নদির উত্তাল স্রোতের মতো ঊর্মিমুখর, নিমেষে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কাহ্নুপাদকে আসতে দেখে ও উঠে দাঁড়ায়। 

কাহ্নুপাদ ছুটকিকে বলে, ‘ছুটকি, তুই ঘরে যা।’ 

‘না।’ 

‘কী করবি?’ 

‘এদিক ওদিক ঘুরব। বনের দিকেও যেতে পারি।’ 

‘বেশি দূরে যাসনে যেন।’

বলতে বলতে ও লাফিয়ে নৌকায় ওঠে। নৌকা দুলে উঠলে নদীর বুকে পানি ছলকায়। মল্লারী কাছি গুটিয়ে বইঠা হাতে নেয়। কাহ্নুপাদ পাটাতনের ওপর বসে। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে, ওর কপালে ঘাম চিকচিক করে। হাঁটুর ওপর কপালটা ঘষে নিয়ে ও ঘাম মোছে। বলে, ‘আমি বুঝি প্রথম খ্যাপ?’ 

‘তুমি না এলে আমার খ্যাপ সাঁইত করবে কে?’

‘সাঁইত হয় কী করে? আমার কাছে তো কড়ি নাও না।’ 

‘তুমি নৌকায় উঠলেই হয়। তোমাকে নিয়ে নৌকা বাইতে পারলে আমার কড়ির চেয়ে বেশি পাওয়া হয়।‘

‘বেশ কথা বলতে শিখেছ।’ 

‘তোমার সঙ্গে থাকলে না শিখে উপায় আছে? তোমার মতো কথা বলতে না পারলে আমাকে তোমার ভালো লাগবে কেন?’ 

‘তোমাকে ভালো লাগার অনেক গুণ আছে।’ 

‘সত্যি?’ 

‘হ্যাঁ গো, সত্যি।’ 

‘কী গুণ বলো দেখি?’ 

‘সে মেলা, কয়টা বলব?’ 

‘যে কয়টা মনে আসে তাই বলো?’ 

‘যেমন গাইতে পারো, নাচতে পারো, নৌকা বাইতে পারো, ভালোবাসতে পারো এবং কবির মনে শক্তি যোগাতে পারো।’ 

‘মা গো এত?’ মল্লারী হেসে গড়িয়ে পড়ে। ‘কিন্তু আমি তো নিজের কিছুই দেখি না?’ 

‘কেউ কেউ নিজেরটা দেখে না। সেটা অন্যের দেখার জন্য। অন্যে দেখে সুখ পায়।’ 

‘আচ্ছা, এ নইলে কবি। কবি মানেই অপরেরটা লুকিয়ে দেখার অভ্যেস।’ 

মল্লারী ঠোঁট ওলটায়। কাহ্নুপাদ মৃদু হেসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। নৌকা মাঝনদীতে, তীরে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ও দু-কান ভরে শোনে। ও চারদিকে তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয়, আনন্দে চোখে জল আসে। বিধাতা ওদের জন্য প্রাণভরে ঢেলে দিয়েছে, কিন্তু রাজসভায় গেলে টের পায় কিছুই ওদের জন্য নয়। সব ওদের যারা উঁচু বর্ণের, ওরা ভোগ করবে, খাবে, ফেলবে, ছিটোবে। যেটুকু কাঁটাকুটো তা ওদের জন্য—যারা নীচু জাতের, যাদের শরীরে নীল রক্ত নেই। ওইটুকু চেটেই ওদের খুশি থাকতে হবে, কোনো কিছুই চাইতে পারবে না। 

‘কী ভাবছ কানাই?’ 

‘কিছু না।’

‘মাঝে মাঝে তুমি কী যেন ভাবো।’ 

‘কই না তো? তুমি বেশি দেখতে পাও।’ 

‘আমাকে ফাঁকি দিও না। তোমার মুখ দেখলে আমি সব টের পাই।’ 

কাহ্নুপাদ কথা না বলে হাসে। কাকে বলবে ও মনের কথা? ভেতরটা যে অনবরত ক্ষয়ে যায়। 

‘আমার জন্য একটা গান লিখবে বলেছিলে, আমি গাইব।’ 

‘লিখছি, শেষ হয়নি। তোমার কণ্ঠে নিজের গান শুনতে কী যে সুখ মল্লারী, জগৎসংসার ভুলে যাই।’ কাহ্নুপাদের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা। প্রশংসায় মল্লারীর চেহারা অন্যরকম হয়ে যায়। ওর সব কিছু কানুর ভালো লাগুক এটুকুই তো ও চায়, আর কিছু না। কাহ্নুপাদ দৃষ্টি ফেরায় না, মল্লারী মুখ নত করে। লম্পট ব্রাহ্মণরা রাতের অন্ধকারে ওর কাছে আসে, দিনেরবেলায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। পল্লির লোকগুলোও তেমন, বাঁকা চোখে তাকায়। কেবল কাহ্নুপাদ ওকে সম্মান করে, ভালোবাসে। প্রথম যেদিন কাহ্নুপাদ ওর গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিল, বলেছিল, ‘সবাই তোমাকে ডোম্বি ডাকে আমার ভালো লাগে না, আমি মল্লারী ডাকব।’ 

ও খুশি হয়ে বলেছিল, ‘সবার আড়ালে ডেকো। 

মল্লারীর সুগঠিত বলিষ্ঠ দু-বাহুর দিকে তাকিয়ে থাকে কাহ্নুপাদ। কী অবলীলায় নৌকা বায় ও! যেন জিনিসটা ওর আজন্মের দখলে, ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে, একটুও এদিক-ওদিক হয় না। ওর ভঙ্গিটি মোহনীয়, স্বচ্ছন্দে পারার এই আশ্চর্য গুণ কাহ্নুপাদকে বিহ্বল করে, মনে মনে ও এই শক্তির কাছে নতজানু হয়। 

‘সারা দিন নৌকা বাইতে তোমার খারাপ লাগে না মল্লারী?’ 

ও প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকায়, ‘মোটেই না। খেয়া পারাপার ছাড়া আর কীই-বা করার আছে আমার? অন্য কাজ তো জানি না। তা ছাড়া সারা দিন তো বাইতে হয় না, যখন খ্যাপ জোটে তখন।’

‘বেশ কাজ। নদীর বাতাসে শরীরও ভালো থাকে।’ 

‘হয়েছে, কবরেজি কোরো না।’ মল্লারী মৃদু হাসে, ‘খেয়া পারাপার না করলে তোমাকেই বা রোজ রোজ পেতাম কোথায়?’ 

‘নিজের গরজেই আমি তোমার কাছে আসতাম মল্লারী।’ 

ও আর এ কথার উত্তর দেয় না। ঘাটে এসে নৌকা বাঁধার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কাহ্নুপাদ লাফ দিয়ে নেমে যায়। পায়ে কাদা লাগলে নদীর জলে ধুয়ে ফেলে। 

‘অমন তাড়াহুড়ো করে লাফ না দিলেই পারতে?’ 

‘তাতে কী? কাদাই তো লেগেছে, পড়ে তো যাইনি।’ 

‘কখন ফিরবে?’ 

‘সবার মুখে কেবল ফেরার কথা। যদি বলি ফিরব না? ফিরতে আমার ভালো লাগে না।’ 

ডোম্বি তাকিয়ে থাকে, জবাব দেয় না। কাহ্নুপাদ আর দাঁড়ায় না। দ্রুত পা বাড়ায়। বেলা উঠেছে, পৌঁছোতে সময় লাগবে। অবশ্য রাজার বাড়ির ঘুম এখনও কারও ভাঙেনি। ডোম্বি দড়িদড়া গুছিয়ে নেয়, কাছি খোলে আবার। পারাপারের জন্য লোক এসে ঘাটে দাঁড়িয়েছে। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয়, আজকের সকালটা প্রসন্ন। এমন ভাবার কোনো কারণ নেই, তবু মনে হয়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *