অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ১১

অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ১১

পরদিন সকালে ডোম্বিকে ফাঁসি-গাছে ঝুঁলিয়ে দেয়া হল। চারদিক থমথম করছে। ভয়ে কেউ ঘর থেকে বের হয় না। দেশাখ নদীর ঘাটে বসে থাকে। কী করবে বুঝতে পারে না। নিমাই এসে ওর কাঁধে হাত রাখে। বলে, ‘দেশাখদা চলো তিরধনুক নিয়ে বনে যাই। হাত কেমন নিশপিশ করছে। 

‘আজ থাক নিমাই।’ 

‘কেন?’ 

‘ডোম্বির জন্যে মন কেমন করছে? আমারা কেউ ডোম্বির মতো সাহসী হতে পারলাম না।’ 

‘চলো ডোম্বির লাশ নিয়ে আসি।’ 

‘দেবে না তো।’ 

‘জোর করে আনব।’ 

‘সেটা আমিও ভেবেছি। কিন্তু লাভ কী? তাহলে হয়তো কানুদাকেও মেরে ফেলবে। কানুদাকে আমাদের ভীষণ দরকার নিমাই।’ 

‘ঠিক বলেছ। কানুদাকে ছাড়া আমরা কেমন একা হয়ে যাই।’ 

দু-জনে বসে থেকে নদীর বয়ে যাওয়া দেখে, আকাশ দেখে, দূরের বন দেখে এবং দু-জনে একসঙ্গে লক্ষ করে আজ কোনো খেয়া পারাপার নেই। ডোম্বির নৌকা বাতাসের ধাক্কায় এপাশ ওপাশ করে। রাজার আইন ফাঁসি-গাছে তিনদিন ঝুলিয়ে রাখা হবে ডোম্বির লাশ। 

সেদিনই কাহ্নুপাদকে বের করে নিয়ে আসা হল চুনের ঘর থেকে। ঠিকমতো হাঁটতে পারে না, মাথা টলে। দ্বাররক্ষী ওকে ধাক্কা দিয়ে দরজা দিয়ে বের করে দিতে দিতে বলে, ‘তোমাদের একটাকে তো শেষ করা হয়েছে। এবার তোমার পালা।’ 

কাহ্নুপাদ দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিতে নিতে আঁতকে ওঠে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। তবু জোরে শ্বাস নিয়ে বলে, ‘কাকে শেষ করা হয়েছে?’ 

‘ওই যে মেয়েলোকটা নৌকা বাইত? সাহস কত, বামুনের গায়ে ছুরি বসিয়ে মেরে ফেলেছে। বাপের জন্মেও এমন কথা শুনিনি। কী যে শুরু করেছে এরা। ত 

কাহ্নুপাদের মনে হয় ও পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেয়েছে। হাতের কাছে শক্ত অবলম্বনও। না খাওয়ার ফলে শরীরটা কেমন ঝামিয়ে গেছে। কেবল এদিকে ওদিকে লোপাট খায়। এতক্ষণে কাহ্নুপাদ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ডোম্বির হাসি বুকের ভেতরে বাজে, ‘কী গো কানু বড্ড ভয় পেয়েছিলে বুঝি? আর কেউ না থাকুক আমি তো আছি তোমার কাছে। একটুও ভয় পেয়ো না তুমি।’ 

রাজদরবারে যাবার পথে দূর থেকে ডোম্বির লাশ দেখতে পায় ও। কাহ্নুপাদ চোখ ফেরাতে পারে না। অবিকল তেমনই আছে ডোম্বি। একটুও বদলায়নি। চোখ ঠিকরে আসেনি, জিহ্বা ঝুলে পড়েনি। দড়ি, কাছি, বইঠা হাতে সেই দুর্বিনীত অথচ মোহন ভঙ্গি, যাকে বুকের ভেতর রেখেও কোনোদিন বোঝা যায় না। যার সাহসের থই পাওয়া মুশকিল। কান্নায় ভেঙে পড়ে কাহ্নুপাদ। 

‘হয়েছে আর অত ঢং দেখাতে হবে না। একটু পরে তো তুমিও ওর সঙ্গী হবে।’ 

রক্ষীর গুঁতো খেয়ে স্থির হয়ে যায় কাহ্নুপাদ। চোখের সামনে সব কিছু সাদা লাগে। 

দেবল ভদ্র গর্জন করে ওঠে, ‘না ওকে ফাঁসি-গাছে ঝোলানো হবে না। ওকে মেরে ফেলব না। ওর শাস্তি হবে তিলে তিলে। ধুকে ধুকে মরবে ও। ওর হাতদুটো কেটে ফেলো। গীত লেখার সাধ বুঝুক।’ 

তারপর আর কিছু মনে নেই কাহ্নুপাদের। জ্ঞান ফেরার পর দেখে শবরী ওর মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। 

‘এখন দিন না রাত?’ 

‘বিকেল হয়েছে।’ 

‘ও।’ 

‘ওগো, এখন কেমন লাগছে?’ 

কাহ্নুপাদ কথা বলে না। শবরী মুখ হাঁ করিয়ে দুধ দেয়। কখনো তা গলা দিয়ে নেমে যায়। কখনো ঠোঁটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথা তুলতে পারে না কাহ্নুপাদ। জগা কবিরাজ ওর কেটে ফেলা হাতের মাথা গাছগাছালির ওষুধ দিয়ে বেঁধে দিয়েছে। এরই মাঝে অনুভূতি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। শুধু মনে হয় ওর চারপাশে অনেক লোক, অনেক কথা, অনেক গুঞ্জন। আজ সবাই ওর কাছাকাছি এসে গেছে। সবাই কাহ্নপাদের কথা বুঝতে পারছে। কাহ্নুপাদ জানে না যে পর পর দুটো ঘটনায় ওর আশেপাশের লোকজন বড়ো দ্রুত বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। একসময় সবাই চলে গেলেও দেশাখ চুপচাপ বসে থাকে। অজ্ঞান অবস্থায় রাজার লোক কাহ্নুপাদকে নদীর ধারে ফেলে গেলে ওরা ওকে নিয়ে আসে। বারুয়া মাঝি ওদের খবর দিয়েছিল। ঠিক সময়ে ওরা খবর পেয়েছিল, দেরি হলে হয়তো কাহ্নুপাদকে বাঁচানো যেত না। সেই থেকে দেশাখের মুখে কথা নেই। ওর মনে হয় ওর বুকের গুহার মুখে কেমন করে যেন একটা বড়ো পাথর পড়ে গেছে। সেটা ঠেলে কিছুতেই কথা বেরিয়ে আসতে পারছে না। দেশাখ বোবা হয়ে থাকে। কাহ্নুপাদের আঙুলগুলো নেই। নইলে সেগুলো জড়িয়ে ধরলে দেশাখ একটা অবলম্বন পেত।

সন্ধ্যার দিকে চোখ খোলে কাহ্নুপাদ। দেশাখ ওর মুখের উপর ঝুঁকে আছে। 

‘কেমন লাগছে কানুদা?’ 

একটু ভালো। 

‘চুপচাপ শুয়ে থাকো। সব ঠিক হয়ে যাবে। জগা কবিরাজের ওষুধ তো নয় যেন ধন্বন্তরি।’ 

‘এতদিনে আমার ভুল ভাঙল দেশাখ। আমি এখন বুঝতে পারছি যে শুধু রাজদরবারেই কোনো ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। ওরা যতই সংস্কৃতের বড়াই করুক ওটা কারও মুখের ভাষা নয়। বাঁচিয়ে রাখবে কে? আমাদের ভাষা আমাদের মুখে মুখেই বেঁচে থাকবে রে দেশাখ।’ 

‘ঠিকই বলেছ কানুদা।’ 

‘বংশপরম্পরায় আমাদের মুখের ভাষা নদীর মতো বইবে। কোনোদিন তা মরে-হেজে যাবে না।’ 

কাহ্নুপাদ হাঁফায়, কথা বলতেও কষ্ট। 

‘ওগো আর কথা না। তুমি ঘুমোও।’ 

কাহ্নুপাদ চোখ বোঁজে। বড়ো করে শ্বাস নেয়। জগা কবিরাজের ওষুধে কাজ হয়েছে। ব্যথা এখন অনেক কম। দেশাখ আস্তে উঠে আসে। 

‘আজ রাতে তুমি আর আমি সারারাত কানুদার পাশে বসে থাকব বউদি। আমরা কেউ ঘুমুব না।’

‘ঘুম কি আর আসবে!’ 

‘আমি একটু ঘুরেফিরে আসি বউদি। দেখি নিমাই ওরা কী করছে। ওদেরকেও ডেকে নিয়ে আসি। খুব সজাগ থেকো বউদি!’ 

দেশাখ চলে গেলে শবরীর কেবল কান্না পায়। অনেক রাতে শবরীর কান্নায় ঘুম ভেঙে যায় কাহ্নুপাদের। 

‘কাঁদছ কেন সই?’ 

শবরী আঁচলে চোখ মোছে। 

‘আমার কিছু হয়নি সই। এখন থেকে আমি বলব আর তুমি লিখবে। দেবল ভদ্র ইচ্ছে করলেই কি আর আমার গীত লেখা বন্ধ করতে পারবে? তুমি আমার কাছে এসে ঘুমোও।’ 

ঘুম আসে না শবরীর। কাহ্নুপাদ আবার ঘুমিয়ে যায়। শবরী কাঁথাটা কাহ্নুপাদের গলার কাছ পর্যন্ত টেনে দেয়। কপালের চুলগুলো সরিয়ে দেয়। কানু একদম শুকিয়ে গেছে। গালের হাড় ঠেলে বেরিয়েছে। অনেকদিন ঘুমোয় না কানু। শবরীর আশ্রয়ে এখন নির্বিবাদে ঘুমোচ্ছে। শবরীর হৃদয় ফুঁসে ওঠে। ‘কানুকে কেউ আর আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবে না।’ শবরী জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়, যে-কোনো সময় কানু উঠতে পারে। 

রাত কত বুঝতে পারে না শবরী। আজ পূর্ণিমা, চাঁদের আলোয় ভেসে গেছে প্রান্তর। এমন ফুটফুটে জ্যোৎস্না ও অনেকদিন দেখেনি। হঠাৎ করে শবরীর খুব ভালো লাগে। দেশাখ এখনও আসছে না কেন? কোথায় গিয়ে আটকে গেল? তখুনি মৃদু কোলাহল ওর কানে আসে। আস্তে আস্তে সেটা বাড়ে। শবরী ভালো করে খেয়াল করে। পুব পাড়ার ওদিকে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। শবরীর ভয় হয়। কিছু বুঝতে পারে না। ও দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ায়। ঠিকই ধরেছে, বাড়ি পুড়ছে। চড়চড় শব্দে বাঁশ ফাটছে। তবে কি রাতের অন্ধকারে রাজার লোক ওদের ওপর হামলা চালাল? শবরীর হাঁটু কাঁপে ঠকঠক করে। ও দরজার কাছে বসে পড়ে। ছুটতে ছুটতে দেশাখ আসে। ‘বউদি?’ 

‘কী হয়েছে দেশাখ?’ 

‘রাজার লোকেরা আমাদের বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দিচ্ছে।’ 

‘কী হবে?’ 

শবরী কেঁদে ফেলে। 

‘পারো কেবল ফ্যালফ্যাল করে কাঁদতে। এখন কান্নার সময় না কি বউদি? নিমাই, অরুণ আরও বাকি সবাইকে লাগিয়ে দিয়ে এসেছি। ওরা অন্ধকার থেকে তির ছুঁড়ে ওদের অনেকগুলোকে ঘায়েল করেছে। তবে ওদের সঙ্গে আমরা পারব না। ওরা তো অনেক। তাই আমি ছুটে এসেছি কানুদার জন্যে। কানুদাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।’ 

‘কোথায় যাবে?’ 

‘বনের কাছাকাছি যে বড়ো টিলাটা আছে ওখানেই আমি সবাইকে যেতে বলেছি। লোকজন ওইদিকে দৌড়চ্ছে। নিমাই আগে ব্যাপারটা টের পেয়েছিস। দেখেছিল ওরা দলে দলে আসছে। আমরা অনেক জায়গায় খবর দিতে পেরেছি। 

‘যাদের খবর দিতে পারোনি তাদের কী হবে?’ 

‘জানি না।’ 

দেশাখের গলা ভার। 

‘দুঃখ এই যে ওদের সঙ্গে আমরা বেশিক্ষণ লড়তে পারলাম না বউদি। তবে প্রতিশোধ আমরা নেবই। আর কথা না। তাড়াতাড়ি চলো বউদি। কানুদাকে ধরো।’ 

‘জিনিসপত্র?’ 

‘বেঁচে থাকলে ওগুলো আবার হবে।’ 

দু-জনে কাহ্নুপাদকে নিয়ে দৌড়তে থাকে টিলার দিকে। চারদিক আগুন, একটা একটা করে বাড়ি পুড়ছে। মানুষের চিৎকার, কান্না ইত্যাদি অনেক শব্দ ভেসে আসে ওদের কাছে। 

ওরা সবাই টিলার কাছে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। কারও মুখে কথা নেই, বাচ্চারাও চুপ। মাথার ওপর ছাউনি নেই। বিশাল আকাশ অন্ধকারে ঢাকা। ওরা কতজন আসতে পেরেছে কেউ জানে না। ওরা কারও মুখ দেখতে পায় না। ওরা পরস্পরের নিশ্বাসের শব্দ পায় কেবল। বাতাসে কীসের গন্ধ ভেসে আঁশে। কাহ্নুপাদ নাক টান করে। তারপর বুকটা ধক করে ওঠে। 

‘কানুদা?’ 

‘কী রে দেশাখ?’ 

‘কানুদা কীসের গন্ধ? 

‘চামড়া পোড়ার গন্ধ। 

কাহ্নুপাদ নির্বিকার উত্তর দেয়। গলার স্বর একটুও কাঁপে না। 

‘কানুদা?’ 

দেশাখের কন্ঠ চিরে যায়। 

‘কেউ হয়তো আরামের ঘুম ঘুমিয়েছিল দেশাখ। জানতেও পারেনি। তাই আগুনে ছাই হয়ে গেছে। ভিড়ের মধ্যে নারীকন্ঠের কান্নার শব্দ ওঠে। 

‘তোরা কেউ দুঃখ করিস না দেশাখ। আমাদের তেমন একটা জায়গা একদিন হবে। আমরাই রাজা হব। রাজা-প্রজা সমান হবে। আমাদের ভাষা রাজদরবারের ভাষা হবে। তেমন দিনের জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে দেশাখ।’ 

ভিড়ের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়। সকলেই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। দম আটকানো উৎকণ্ঠা এক-ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে নড়াচড়া করছে। 

কাহ্নুপাদ দম নিয়ে আবার বলে, ‘একটা ছোট্ট ভূখণ্ড আমাদের দরকার। সে ভূখণ্ডটুকু সবুজ, শ্যামল আর পলিমাটি ভরা হলেই হয়। সে ভূখণ্ডের দক্ষিণে থাকবে একটা সুন্দর বিরাট বন আর তার পাশ দিয়ে বয়ে যাবে সাগর।’ 

কাহ্নুপাদ থামতেই দেশাখ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আহ্ কানুদা কেমন করে যে মনের কথা বলো। তুমি না থাকলে আমরা স্বপ্ন দেখতেই পারি না। ত 

তখুনি চামড়া-পোড়া গন্ধটা বাতাসের প্রবল ঝাপটায় ওদের সবার নাকেমুখে গলগলিয়ে ঢোকে। সে গন্ধ প্রাণভরে বুকে টেনে হো-হো করে হেসে ওঠে ভুসুকু, ‘কাহ্নিলা রে আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *