অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ১০

অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ১০

সে রাতেই কাহ্নুপাদ একটা গীত বানাবার চেষ্টা করে। 

নগর বাহিরেরেঁ ডোম্বি তোহোরি কুঁড়িআ। 
ছোই ছোই যাইসি ব্রাহ্ম নাড়িআঃ 

লিখে ওর ভালোই লাগে। এমন সরাসরি এর আগে ও আর কখনো লিখতে পারেনি। একবার লিখেছিল, কিন্তু শেষ করেনি। এখন মনে হয় সরাসরি লেখা দরকার। সরাসরি না লিখলে প্রকাশটা তীব্র হয় না। শবরী গীতটা শুনে প্রথমে থমকে থাকে। তারপর চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ঠিকই লিখেছ কানু ওই এক জায়গায় বামুনরা ছোটোলোকের শরীরের কথা ভুলে যায়। তখন সব পবিত্র হয়।’

শবরী ব্যঙ্গের হাসি হাসে। শবরীকে বড়ো ভালো লাগে কাহ্নুপাদের। শবরী কখনোই খুব একটা মনোযোগ দিয়ে ওর গীত শোনে না। আজ কাহ্নুপাদের গীত শবরীকে অন্যরকম করে দেয়। সকালে পটহ মাদল বিয়ে ডোম্বি ওই গীত গায়। বুনো উল্লাসে উন্মত্ত হয়ে ওঠে ওর কন্ঠ। দুপুরের মধ্যে পুরো পাড়াতে গীতটা গাওয়া হয়ে যায়। দারুণ উত্তেজনা সর্বত্র। জোয়ান ছেলেরা হাততালি দিয়ে পথেঘাটে গীতটা গায়। 

দেশাখ বলে, ‘কানুদা এতদিনে মনের কথা লিখেছে। 

কাহ্নুপাদকে জড়িয়ে ধরে ও। কাহ্নুপাদের চোখ দীপ্র জ্বলে। সব মেদ ঝরে গেছে। শরীরের কাঠিন্য দৃষ্টিতে ঝলসে ওঠে। 

‘ওরা তোমাকে রেহাই দেবে না কানুদা।’ 

কাহ্নুপাদ দেশাখের কাঁধে হাত রাখে। 

‘ভয় পাই না দেশাখ। এক কানু গেলে কী হবে, তোরা তো আছিস।’ 

পরদিন রাজার লোক এসে ধরে নিয়ে গেল কাহ্নুপাদকে। কাহ্নুপাদ শান্তই ছিল। হইচই করেনি। ও জানত হইচই করলে শারীরিক অত্যাচারই বাড়বে আর কোনো ফল হবে না। ওর হাতিয়ার কলম। কাহ্নুপাদ সেটাই অটুট রাখতে চায়। একটি অস্ত্র নিয়েই ওদের কাছে নতি স্বিকার করবে না। কাহ্নুপাদ শান্ত ছিল তবু কাহ্নুপাদের কোমরে দড়ি বেঁধেছিল ওরা। পিছমোড়া করে হাতও। শবরী কাঁদতে কাঁদতে নদীর ঘাট পর্যন্ত এসেছিল, এসেছিল আরও অনেকে। নদীর ঘাটে ডোম্বির চোখে জল ছিল না, ছিল আগুন, দপদপ করছিল। কাহ্নুপাদ সে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। যেন বলতে চায়, ‘এক কানু গেলে কী হবে, তোরা তো আছিস।’ 

মুখ ফুটে বলা হয় না। সামনে-পিছে রাজার লোক। ডোম্বি আজ বড়ো অশান্ত। হাতের বইঠায় উথালপাথাল আবেগের প্রকাশ। মনে মনে কাহ্নুপাদকে ছিঁড়ে ফেলতে চায়। ‘কানু তুমি এত নির্বিকার কেন? রেগে ওঠো, প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ো।’ 

ডোম্বির ঠোঁট নড়ে। কাহ্নুপাদ একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। নড়ে-ওঠা ঠোঁটের ভাষা বোঝে। ডোম্বি আমার আর তোমার মতো একজন দুজন করে সকলে যখন রেগে উঠবে তখনই ফাটার সময় হবে যে। নদী কী ভীষণ শান্ত, গর্জন নেই, ঢেউ নেই, যেন কোথাও কোনো আক্রোশ নেই। নদীর পাড়ে কত লোক দাঁড়িয়ে আছে। সবাই দেখছে রাজার লোক কাহ্নুপাদকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যে লোকটিকে ওরা ভালোবাসে, যে লোকটি ওদের মনের কথা বলতে পারে তার জন্য ওদের মনে যত বেদনাই থাক না কেন, তাকে জোর করে ধরে রাখার ক্ষমতা ওদের নেই। তবু সেই দিকে তাকিয়েই কাহ্নুপাদ তার পায়ের নীচে মাটির অনুভব পায়। সে শূন্য দাঁড়িয়ে নেই। তার জন্য শক্ত মাটি আছে। বন্যায়, ঝড়ে সে মাটি শক্ত থাকে। কাহ্নুপাদ মুহূর্তে ভয়শূন্য হয়ে যায়। 

প্রাথমিক শাস্তিস্বরূপ রাজার লোকেরা কাহ্নুপাদকে চুনের ঘরে আটকে রাখে। রাতে ঘুম আসে না ওর। চুনের গন্ধ কেমন তাও প্রকাশ করতে পারে না—মাঝেমাঝে নিশ্বাস আটকে আসতে চায়, বুক ধড়ফড় করে। চোখ জ্বালা করে, পানি পড়ে। আস্তে আস্তে নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। জমাট আঁধারে দৃষ্টি ফেলা যায় না। কাহ্নুপাদের মনের ভেতর এক একটি শব্দ কবিতার মুক্তো হওয়ার জন্যে ফোঁটায় ফোঁটায় জমতে থাকে। ওর মনে হয়, বুকের ভেতর কোথাও কোনো অন্ধকার নেই। পরদিন পিছমোড়া করে বেঁধে রাজার সামনে হাজির করা হয় কাহ্নুপাদকে। দেবল ভদ্রের গনগনে দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়েও কাহ্নুপাদের বুক একটুও কাঁপে না। ও অবিচল, নির্বিকার থাকে, যেন ওর কোনো সুখ-দুঃখ বোধ নেই। 

‘গীত লিখেছিস, আবার পাড়ার মধ্যে গেয়ে বেড়িয়েছিস? জানিস তুই দেবতুল্য ব্রাহ্মণদের যেভাবে অপমান করেছিস সে অন্যায়ের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।’ 

দেবল ভদ্রের চেহারা ভয়ানক মনে হয় ওর কাছে। পরক্ষণে তা মুছে গিয়ে ফাঁসি-গাছের দৃশ্য ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বহুবার এ দৃশ্য ওকে বিচলিত করেছিল। কিছুতেই সহ্য করতে পারত না ও। দেবল ভদ্র আবার গর্জে ওঠে, ‘মৃত্যুদণ্ড থেকে তুই এক শর্তে ক্ষমা পেতে পারিস, যদি তুই রাজার প্রশস্তি রচনা করিস এবং নগরে পল্লির সর্বত্র তা গেয়ে বেড়াবি।’ 

কাহ্নুপাদের চোখের তারা কেঁপে স্থির হয়ে যায়। ও কথা বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ও ভীষণ আশ্চর্য হয়ে অনুভব করে যে ওর হাঁটু কাঁপছে না, মাথা ঘুরছে না, চোখের সামনে থেকে আলো সরে যাচ্ছে না। ও দারুণ শক্তি অনুভব করছে। 

‘কথা বলছিস না যে?’ দেবল ভদ্র হুংকার দিয়ে ওঠে। 

‘রাজাকে আমি চিনি না।’ 

‘বলিস কী?’ 

‘আমি আমার লোকদেরই চিনি। আমি তাদের কথাই বুঝি।’ 

‘রাজার কথা তোকে লিখতে হবে কানু।’ 

‘রাজা আমার কেউ না।’ 

‘এই, একে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখ। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। ওর আরও শাস্তি দরকার।’ 

রাজার লোক কাহ্নুপাদকে টানতে টানতে নিয়ে আসে। ধাক্কা দিয়ে আবার চুনের ঘরে ফেলে দেয়। দরজা বন্ধ হয়ে গেলে ওর হাঁটুতে চিনচিনে জ্বালা শুরু হয়। বোঝা যায় কেটে গেছে, রক্ত ঝরছে। উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়ার ফলে থুতনিতেও লেগেছে। না, কাহ্নুপাদের বুকে কোনো ব্যথা নেই। কাহ্নুপাদ দেয়ালে ঠেস দিয়ে শরীরের যন্ত্রণা ভুলবার চেষ্টা করে। 

শবরীর কাছে দিন রাত সব সমান হয়ে যায়। কখনো শুকনো মুখে চাঁচর বেড়ার ঘরে বসে থাকে, কখনো একা একা ঘোরে। উশকোখুশকো রুক্ষ চেহারা কবিতার ভিন্ন আঙ্গিকে ফুটে ওঠে। কানু ছাড়া ও আর কিছু বোঝে না। সেই কানুর জন্যে কখনো শবরীর চোখে জল আসে, কখনো দৃষ্টিতে আগুন জ্বলে ওঠে। জল আর আগুন এখন শবরীর রাতদিনের সঙ্গী। শুয়ে শুয়ে পোষা ময়ূরটার সঙ্গে কথা বলে, ‘তোর কি মনে হয় কানুকে রাজা মেরে ফেলবে? না রে না, তুই একটা পাগলা। কানুকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমার এত ভালোবাসা রেখে কানু মরবে কেন? কানু মরতে পারবে না। কিন্তু শবরীর কানু মরবে না; কানুকে মারবে। ওকে ফাঁসি-গাছে ঝুলিয়ে রাখা হবে। না, তাহলে আমি রাজবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেব। দাউ দাউ আগুনে জ্বলে উঠবে ওই বাড়ির সব ঘর, পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।’ 

শবরীর চোখের আগুনে আবার জল আসে। একলা ঘরে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেয় ও। নাওয়া খাওয়া কিছুই ভালো লাগে না। কানুর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। বেড়ায় গোঁজা কলমটা লুকিয়ে রাখে। গত রাতে ও স্বপ্ন দেখেছিল যে রাজার লোক এসে পুরো ঘর তছনছ করে কলম খুঁজছে। কলমটার জন্য শবরীর উপর অত্যাচার করে। তবু কলমটি দেয়নি ও, কিছুতেই বলেনি কোথায় রেখেছে। রাজার লোকেরা শেষ পর্যন্ত ওকে শাসিয়ে চলে গেছে। ঘুম ভাঙার পর কেমন নিথর হয়েছিল শবরীর অনুভূতি। রাত কত বুঝতে পারেনি। বিছানা থেকে উঠে জানালায় দাঁড়িয়েছিল। বুকটা হু-হু করে ওঠে, ভেঙে আসতে চায়, শবরী নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। বিছানা ভালো লাগে না, ঘর ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে অনেক দূরে চলে যেতে। কানু ফিরে এলে কানুকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে ও। সেখানে মনের সুখে গীত লিখবে কানু। অনেক লোক নিয়ে আসর বসবে। সেখানে গীত পড়া হবে, গাওয়া হবে। কানুর বুকের ভাষা সবার বুকের ভাষা হয়ে মুখে মুখে ফিরবে। ওদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না। তেমন একটা জায়গা কি হবে না যেখানে ওদের মুখের ভাষার গীত লিখলে রাজার লোক মারতে আসবে না? যেখানে রাজা-প্রজা সব এক হয়ে যাবে। তেমন একটি জায়গা কি কোনোদিন হবে না? খুব বড়ো জায়গা ওদের দরকার নেই। ছোটো একটু জায়গা হলেই হয়। ওরা ঠাসাঠাসি করে থাকবে। মোটা কাপড়, মোটা ভাতে ওদের দিন কেটে যাবে। স্বপ্ন দেখে শবরী, স্বপ্ন দেখলে মন ভালো হয়ে যায়, অন্তত কিছুক্ষণ ওর কষ্ট থাকে না। 

স্বপ্ন দেখে কাহ্নুপাদ, বন্ধ কুঠরির অন্ধকারে বসে স্বপ্ন দেখা ছাড়া ও আর কিছু করতে পারে না। চুনের গন্ধে যখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, দম আটকে আসে, তখন স্বপ্ন দেখলে নিশ্বাস সহজ হয়। বুক হালকা হয়ে যায়। সারা দিনে একবার খাবার দেয় দ্বাররক্ষী। তাও পরিমাণের তুলনায় একদম কম, পেট ভরে না। ক্ষুধায় নাড়িভুঁড়ি ওলটপালট করে। কাহ্নুপাদ নির্বিকার থাকার চেষ্টা করেও পারে না। দেয়ালের গায়ে লাথি মারে, ঘুষি দেয়। হাতে ব্যথা পায়। তখন চিৎকার করে দেবল ভদ্রকে গালাগাল করে। চার দেয়ালের ফাঁকফোকরে সে গালি বাইরে যায় না, তাই কেউ ছুটে আসে না। দমাদম ঘুসি মারে না। টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে ফেলে না। অথচ কাহ্নুপাদ চায় কেউ ছুটে আসুক। দরজা খুলুক, ও আলো দেখতে পাবে। সে আলোয় দৃষ্টি ধুয়ে নেবে। চিৎকার করে এক সময় নিজের জায়গায় ফিরে আসে। আজ এক মাস চার দিন হল ওকে এ ঘরে আটকে রেখেছে। এভাবেই ওকে দুর্বল করতে চাইছে দেবল ভদ্র। সেদিনের জিজ্ঞাসাবাদের পর আর একদিনও এ ঘর থেকে বের করেনি। কাহ্নুপাদ বুঝতে পারে ক্রমাগত ওর শরীর দুর্বল হচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করে, পা কাঁপে। শরীরে শক্তি নেই যেন। অথচ সব কিছু কমে গেলেও কাহ্নুপাদের সাহস কমেনি। তা ক্রমাগত জমাট হচ্ছে এবং নিরেটও। সেখানে কোনো ছিদ্র নেই। ছিদ্রপথে ভয়ের স্রোত গলগলিয়ে ঢোকে না। আর সে-কারণেই কাহ্নুপাদের চিত্তে সুখ থইথই করে। ও চুনের ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা নতুন দ্বীপের স্বপ্ন দেখে। সে দ্বীপকে নিজেদের মতো করে কেমন করে গড়ে তুলবে সে পরিকল্পনাও করে। তিন দিন পর রাজার লোক ওকে দরবারে নিয়ে এলে দেবল ভদ্রের ক্রূর হাসি দু-কানে এসে বাজে। কাহ্নুপাদের মাথা ঝিমঝিম করে। দাঁড়াতে কষ্ট হয়। ও ধপ করে মেঝের ওপর বসে পড়ে। 

‘কী রে তেজ কমেছে?’ 

কাহ্নুপাদের মাথা মাটির দিকে। দেবল ভদ্রের দিকে তাকায় না। এভাবেই উপেক্ষা করতে চায়। ওর বার বার মনে হয় ওর পায়ের নীচে শক্ত মাটি আছে, কিন্তু দেবল ভদ্রের নেই। দেবল ভদ্রের সব প্রতাপ, ক্ষমতা, দম্ভ, অহংকার নিয়েও সে চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। 

‘এই মাথা ওঠা।’ 

কাহ্নুপাদ মাথা সোজা করে। সঙ্গে সঙ্গে বুকটাও টান হয়ে যায়। 

‘কেমন বুঝছিস? এবার আমার কথায় রাজি তো?’ 

কাহ্নুপাদ কথা বলে না। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। 

‘এই, কথা বলছিস না যে? লিখবি আমাদের রাজার কথা। লিখবি আমার কথাও। রাজা তো দয়ালু। কত মহৎ। প্রজাদের সুখের জন্য রাজার প্রাণ কাঁদে।’ 

‘না।’ 

শব্দটা কাহ্নুপাদের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। 

‘না?’ 

দেবল ভদ্র মাটিতে পা আছড়ায়। 

‘আমার মুখের ওপর না বলার সাহস তোর কোথা থেকে হল শুনি? ধরা-কে-সরা জ্ঞান করতে শিখেছিস?’ 

‘না তা কেন? আমার ভাষায় আমার লোকের কথাই হয়। রাজারাজড়ার কথা হয় না।’ 

‘ঠিক আছে মজাটা টের পাবি। একবারে মারব না তোকে, তিলে তিলে মারব। এই নিয়ে যা একে। আগামী রোববার ওর দু-হাত কেটে ফেলা হবে। তোরা ওর শাস্তির ব্যবস্তা কর।’ 

রক্ষী কাহ্নুপাদকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। 

একজন ওকে বলে, ‘কেন যে মিছেমিছি গোঁ ধরেছিস? হাত দু-খানা গেলে লিখবি কী দিয়ে?’

‘যা বুঝিস না তা বলতে আসিস না।’ 

কাহ্নুপাদ রুখে দাঁড়ায়। 

‘বাবা তেজ এখনও কমেনি। শালার মরার ভয়ও নেই।’ 

কাহ্নুপাদের হাঁটতে কষ্ট হয়। মাথার ঝিমঝিম ভাবটা তীব্র হয়েছে। কাহ্নুপাদের বমি বমি লাগছে। অন্ধকার কুঠরিতে ফিরে আসার পর কাহ্নুপাদ অবসন্নের মতো বসে থাকে। ইচ্ছে করে পেট ভরে ভাত খেতে। ইচ্ছে করে শবরীকে দেখতে। ইচ্ছে করে ডোম্বির কাছে ছুটে যেতে। দেয়ালের গায়ে মাথা ঠেক দিয়ে রেখেও কাহ্নুপাদ স্বস্তি পায় না। ওর মুখে দাড়ি গজিয়েছে, চোখের নীচে কালো হয়ে গেছে। বুকের পাঁজর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়, চোয়াল উঁচু হয়ে উঠেছে, পা সরু কাঠি। কাহ্নুপাদ বড়ো করে নিশ্বাস নেয় এবং ছাড়ে, তারপর মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। 

ডোম্বির মেদহীন ধারালো শরীর ঝকঝকে ইস্পাতের ফলা হয়ে গেছে। এখন আর শুধু নৌকা বাইতে ভালো লাগে না। মনে হয় দেশাখের কাছে তিরধনুক ছোঁড়া শিখবে। তাহলে হয়তো একটা কিছু করতে পারবে। শুধু দড়ি, কাছি আর বইঠায় কিছু হয় না। এখন হাত চায় অন্য কিছু, চায় অন্য জিনিস। ডোম্বি অন্যমনস্ক হয়ে নৌকার ওপর বসে থাকে। দেবল ভদ্রের ভাগনের মুখ ভেসে ওঠে। বড়ো জ্বালায়। রাতের অন্ধকার হলেই হুলো বেড়াল হয়ে দরজার পাশে এসে শব্দ করে। ডোম্বির মনে হয়, বড়ো গ্লানি। এ গ্লানির কথা কানু তার গীতে লিখেছে। কানু ব্যঙ্গ করেছে। অপমানে ডোম্বির বুক জ্বালা করে। আর এটা লেখার জন্যেই কানুকে ধরে নিয়ে গেছে। দপ করে জ্বলে ওঠে ও। প্রতিশোধ নিতে হবে। কোমরে গোঁজা ছুরির ওপর হাত রাখে। 

দু-দিনের মধ্যেই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে ডোম্বি। রাতের অন্ধকারে দেবল ভদ্রের ভাগনে ঘরে আসতেই মনস্থির করে। উত্তেজনার চরম মুহূর্তে ছুরিটা আমূল বসে যায় দেবল ভদ্রের ভাগনের বুকে। বাধা দেবার কোনো সুযোগই ছিল না তার। ওর বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে চকিতে ওর মনে হয় কানুও কি এমন রক্ত ছড়িয়ে মরে যাবে? বুকটা খালি হয়ে যায়। চেপে আসে নিশ্বাস ডোম্বি তর্জনী দিয়ে রক্তের রেখায় আঁকিবুকি কাটে। কানুর জন্য বুকটা ফেটে চৌচির। কানু ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। ডোম্বির বুকে শোকের পাহাড় গড়ে ওঠে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। 

ভোর হতেই ওর ঘরে লোক এসে ভরে যায়। ডোম্বি কারও দিকে তাকায় না, কথা বলে না। কেবল কাঁদে। মরার আগে কানুর সাথে একটিবার দেখা হল না। দেশাখ একরকম জোর করে ওকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে। পিপুল গাছের ছায়ায় বসিয়ে দেয়। 

‘কাঁদছিস কেন ডোম্বি? ভয় কীসের?’ 

‘ভয়?’ 

মুহূর্তে ডোম্বির চোখ জ্বলে ওঠে। 

‘ভয় পেলে আর মারব কেন? ওই বামুনের মুখের ওপর থুতু ছিটাতে ছিটাতে আমি মরতে যাব দেশাখ। শুধু বুকটা ভেঙে যায় যখন ভাবি মরার আগে কানুর সঙ্গে দেখা হবে না।’ 

‘দুঃখ করিস না। আরেক জনমে হবে।’ 

‘তাই যেন হয়।’ 

ডোম্বি আঁচলে চোখ মোছে। দেশাখ অভিভূতের মতো ডোম্বিকে দেখে। এইমুহূর্তে ওকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ডোম্বি বড়ো একরোখা, সাহসী, ডোম্বি দুর্বিনীত। এই সাহসটা সবার বুকের মধ্যে থাকলে ওদের অবস্থা অন্যরকম হত। 

গাঁয়ের লোকের মুখে কথা নেই। ঘটনার আকস্মিকতায় এবং পরবর্তী সময়ের ভয়াবহতার চিন্তায় সকলেই নির্বাক। ওরা ভাবতে পারছে না যে এরপর কী করবে? কীভাবে বাঁচবে? নিমাই বুড়ো ভিড়ের মধ্য থেকে দেশাখকে একপাশে ডেকে নিয়ে আসে। 

‘কেমন হল দেশাখ?’ 

‘কী আর? কানুদার অপমানের প্রতিশোধ নিল ডোম্বি।’ 

‘কিন্তু এখন আমরা বাঁচব তো? ওরা আমাদের শেষ করে দেবে।’ 

‘বাঁচতে না পারলে মরাই ভালো কাকা।’

‘তোদের কথাবার্তা আমি বুঝি না। তোরা পেয়েছিস কী বল তো?’ 

‘আহ্ কাকা চুপ করুন। এমনিতে গাঁয়ের লোক ভয়ে চুপসে গেছে, আপনি এমন করলে ওরা আরও ভয় পাবে।’ 

নিমাই বুড়ো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। 

‘চুপ করুন কাকা, চুপ করুন।’ 

ছেলে বুড়ো নারী সকলের চোখ ছলছল করে। 

কত পাপ জমা হয়েছে আমাদের? কী পাপে এমন হল? কান্নার রোল ওঠে। সকলেই কাঁদে। দেশাখ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কাকে বোঝাবে? এখনও যারা নিজেদের কথা ভাবতে শেখেনি তাদের কাছে দেশাখের উপদেশ অর্থহীন। ও দাঁত কিড়মিড় করে। এখন ওদের জন্যে বড়ো ধরনের একটা আঘাত প্রয়োজন। সে আঘাতে ওদের চেতনার পলকা ছায়া ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। তারপর ওরা দাঁড়াবে, কোমর সোজা করে, বুক টান করে। তার আগে নয়। ও চুপচাপ সরে পড়ে। ডোম্বির কাছে এসে দাঁড়ায়। 

‘এতদিনেও কানুকে ছাড়ল না। কানুকে কী ওরা মেরে ফেলবে দেশাখ?’ 

‘জানি না।’ 

দেশাখের গলা কেঁপে যায়। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। 

‘কানু আমাদের সবার জন্যে লড়ছে। একটা বামুন মেরে দেখালাম আমরাও মারতে পারি। আমরা শুধুই ছোটোলোক নই। এই সুখ নিয়েই আমি মরতে পারব দেশাখ।’ 

ডোম্বির মুখে ক্ষীণ হাসি। 

‘দেশাখ আমার কথা তোর মনে থাকবে?’ 

‘ডোম্বি। ডোম্বি রে।’ 

দেশাখ কথা বলতে পারে না। দেশাখের যেন কী হয়। ওর ঠোঁট কাঁপে। 

‘তোর ছেলে হলে তাকে আমার কথা বলবি দেশাখ?’ 

‘বলব রে বলব। তোকে আমরা কেউ কোনোদিন ভুলব না। আমাদের তেমন দিন এলে তোর সোনার মূর্তি বানিয়ে রাখব ডোম্বি। 

দেশাখ কান্না চাপতে দ্রুত ওর সামনে থেকে সরে যায়। ডোম্বি পিপুল গাছে ঠেস দিয়ে চোখ মোছে। রাজার লোক যখন গাঁয়ে আসে সূর্য তখন মাথার ওপর। ডোম্বির হাত দুটোই পিছমোড়া করে বেঁধে, কোমরে দড়ি দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যায়। আশেপাশে কেউ নেই, ডোম্বি একা। এতক্ষণ যারা মজা দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছিল তারা রাজার লোক আসতে দেখেই পালিয়েছে। শুধু দেশাখ অনেকদূর থেকে ওর সঙ্গে ঘাট পর্যন্ত আসে, কাছে আসতে পারে না। রাজার লোকদের শরীরে আগুন, হাতে লাঠি, মুখে গালাগালির বর্ষণ। নৌকায় ওঠার সময় ওদের একজন ডোম্বির পাছায় লাথি মারল। তাল সামলাতে না পেরে ডোম্বি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল নৌকার ওপর। একজন ওর পিঠের ওপর পা রাখল। ডোম্বি ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে পারল না। ওর হাত বাঁধা বলে আবার গড়িয়ে পড়ে গেল। দেশাখের ইচ্ছে করল ছুটে গিয়ে ডোম্বিকে বুকে তুলে নেয়। 

এই ঘটনার পর কারও চোখে ঘুম নেই। সারা পল্লিতে অখণ্ড নিস্তব্ধতা। কোনো বাচ্চা কেঁদে উঠলেও সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে যায়। এই বুঝি রাজার লোক এল। একলা ঘরে ঘুম আসে না শবরীর। ডোম্বির জন্যে মন খারাপ করে। ও কানুর জন্য প্রতিশোধ নিয়েছে এটা ভাবলেও বুক টনটন করে। রাগ হয়। ক্ষিপ্ত হয়ে বেড়ায় গোঁজা ময়ূর পালক ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দেয়। জানালায় বসে থেকে লোক দেখার চেষ্টা করে। 

কিন্তু কাউকে দেখা যায় না। একজন লোক দেখার জন্যে শবরীর বুক খাঁ-খাঁ করে। মাঝে মাঝে দেশাখ আসে। শুকনো মুখে বসে থাকে। দু-চারটে কথা হয়। দেশাখের গলা ভাঙা, ফ্যাসফ্যাস করে। 

‘কিছু ভেবো না বউদি? কানুদা নিশ্চয় ফিরে আসবে।’ 

‘কানু তো ওদের কথা শুনছে না। কানুকে ওরা মেরেই ফেলবে। 

অকস্মাৎ দু-জনের কথা ফুরিয়ে যায়। শবরী জানালার কপাটে মাথা রেখে কেঁদে ফেলে। 

আজও সন্ধ্যার দিকে দেশাখ আসে। ডোম্বিকে নিয়ে যাবার পর থেকে ও কোথাও দু-দণ্ড বসে স্বস্তি পাচ্ছে না, ছটফট করছে। অমাবস্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। শবরী ঘরে আলো জ্বালেনি। দেশাখের পায়ের শব্দে চমকে ওঠে। 

‘কে?’ 

‘আমি দেশাখ বউদি।’

‘এসো।’ 

‘আলো জ্বালোনি কেন? 

‘ভালো লাগছে না।’ 

‘তোমার মুখে এ ছাড়া কথা নেই। আলো জ্বালো দেখি।’ 

শবরী মাটির প্রদীপ জ্বালায়। মিটমিটে আলোয় অন্ধকার তেমন কাটে না। শবরী হরিণের চামড়া বিছিয়ে দেয়। দেশাখ ধপ করে বসে হাঁটুতে মুখ গোঁজে। শরীরের ভার কোথাও ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। আজ ওর হৃদয় শুধু ডোম্বির জন্যে, সেখানে আর কেউ নেই। এমনকি বিশাখাও না। সকালের ঘটনার পর থেকে ডোম্বি ওর হৃদয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে—দড়ি, কাছি, বইঠা হাতে দুর্বিনীত ভঙ্গিতে। এর বাইরে ডোম্বির অন্য কোনো ভঙ্গি নেই। 

‘দেশাখ?’ 

‘বলো।’ 

‘ডোম্বি কি আমার চাইতেও কানুকে বেশি ভালোবাসত?’ 

‘এসব কথা থাক বউদি।’ 

‘তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ?’ 

‘না তা নয়। আমি বুঝি ওদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ জানানো প্রয়োজন ছিল। ডোম্বি সেটা করেছে। কানুদা করেছে। একে একে আমরা সবই করব।’ 

‘আর আমি বুঝি ডোম্বি আমার চাইতেও কানুকে বেশি ভালোবাসত। সে-কারণে ওর জন্যে মরতে পেরেছে। আমি পারিনি।’ 

‘ডোম্বিকে তুমি চিনতে পারোনি বউদি। তোমার মন খারাপের কারণ নেই।’ শবরী কথা বলে না, দেশাখও না। বেশি কথা বলতে ওর ভালোও লাগে না। অনেকক্ষণ দু-জনের চুপচাপ কেটে যায়। 

‘কী ভাবছ দেশাখ?’ 

‘কিছু না।’ 

‘অমাবস্যার রাতে এমন অন্ধকার আর কখনো দেখিনি।’ 

‘এটা তোমার মনের ভুল।’ 

‘মনের ভুল?’ 

‘হ্যাঁ, তুমি দুশ্চিন্তায় আছ, তাই এমন ভাবছ। সব অমাবস্যার রাতই একরকম। কই তেমন অন্ধকার তো আমার মনে হচ্ছে না।’ 

‘কোনোকিছুই আমার ভালো লাগে না দেশাখ। একা একা থাকতে আমার ভয় করে।’ 

বাইরে পেঁচা ডাকে। শব্দটা দু-জনের মনের মধ্যে খট খট আওয়াজ ওঠায়, যেন ভীষণ দুঃসংবাদ বহন করে একটা ঘোড়া ছুটে আসছে। 

‘কিছু বলছ না কেন দেশাখ?’ 

‘আজ আমারও কিছু ভালো লাগছে না। আমি যাই। তোমার কিছু দরকার হলে আমাকে খবর দিও।’

শবরী কিছু বলার আগেই টিলার গা বেয়ে নামে দেশাখ। অন্ধকারে ওকে দেখা যায় না। শবরী আলো নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। দেশাখ থাকলে সময়টা ভালো কাটত। এখন শবরী কিছু করতে পারছে না। কান পেতে একটা না পেঁচার ডাক শোনে। 

দেশাখ হাঁটতে হাঁটতে বিশাখাদের বাড়ির কাছে আসে। চারদিক নির্জন, ভীষণ অন্ধকার, তবু একটুও ভয় করে না ওর। হাঁটতে ভালো লাগে। এই মুহূর্তে ঘরে থাকতে মন চায় না। ঘরে ফিরলেই ভুসুকুর মুখোমুখি হতে হয়। ভুসুকু ওর দিকে কেমন দৃষ্টিতে যেন তাকায়, মুখে কিছু বলে না, অথচ ওই চোখের ভাষা ভয়ানক তীব্র। ভুসুকুর দৃষ্টি পালটে গেছে। তেমন দৃষ্টি থাকলে মুখ দিয়ে কথা বলতে হয় না। দেশাখ ভুসুকুর সামনে থেকে পালিয়ে বেড়ায়। ভুসুকুর জন্যে ওর মন কেমন করে। কিছুদিনের মধ্যে ও হয়তো পাগল হয়ে যাবে। 

এসব ভাবনা ভাববে না বলে দেশাখ মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে টিলা বেয়ে বিশাখাদের বাড়ির দরজায় আসে। বিশাখার মা শুকনো মুখে বসে আছে। 

‘কেমন আছ মাসি?’ 

‘আর থাকাথাকি। বিশাখার বাবার শরীর ভালো না। তুমি বোসো বাবা।’ 

দেশাখ দরজার কাছেই বসে। ঘরে মিটমিটে আলো। একসাথে ভাই-বোনগুলো ঘুমুচ্ছে। বিশাখা ওর বাবার মাথার কাছে বসে আছে। বুড়ো কাশছে। 

‘আমাদের কী হবে বাবা?’ 

‘কেন মাসি?’ 

‘সকালে কেমন একটা কাণ্ড হল? এমনিতেই আমাদের অবস্থা ভালো না। তারপর সারাক্ষণ মনে হচ্ছে ওই বুঝি রাজার লোক এল। বিশাখা তো সারা দিন কিছু খায়নি, কেবলই ভয় পাচ্ছে। জানালার কাছে বসে থাকে, রাস্তা দেখে।’ 

দেশাখ চুপ করে থাকে। ভয় কোথায় নেই? ওর নিজের মনের মধ্যেও আছে। সেটা প্ৰবল নয়, সাহস রাখতে পারে। 

‘তোমার মা কেমন আছে দেশাখ?’ 

‘ভালো?’ 

‘বাবা?’ 

‘বাবা বেশি ভালো না। এখন তখন অবস্থা। বড্ড কষ্ট পাচ্ছে।’ 

‘তুমি বোসো। বিশাখা ওকে চারটে মুড়ি দে।’ 

বিশাখার মা উঠে চলে যায়। দেশাখ কী করবে বুঝতে পারে না। বিশাখার বাবার গলা থেকে ঘড়ঘড় শব্দ আসছে। দেশাখ একমনে সেটা শোনে। 

‘মুড়ি খাও।’ 

বিশাখার মুখ শুকনো। কণ্ঠ দিয়ে স্বর বেরুতে চায় না। দেশাখ হাসে। আস্তে করে বলে, ‘ভয় পাচ্ছ কেন? তোমাকে না তিরধনুক চালানো শিখিয়েছি?’ 

দেশাখ মুড়ির বাটি টেনে নিয়ে একমুঠি মুখে পোরে। বিশাখা চলে যায়। ও কথা বলতে পারে না। দেশাখের মতো বুকের পাটা ওর নেই। সাহসের কথা ওর মুখে আসে না। সেজন্যে কিছু বলতে পারে না। 

বিশাখার মা কাছে আসতেই দেশাখ উঠে দাঁড়ায়। 

‘মাসি শবরী বউদি একা থাকতে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। আজ রাতে বিশাখা তার ওখানে থাকুক। আমি বলেছি বিশাখাকে এনে দেব।’ 

বিশাখার মা চুপ করে থাকে। 

‘কিছু অসুবিধা হবে না মাসি। ভোরে উঠেই ও চলে আসবে।’ 

‘আচ্ছা নিয়ে যাও। মেয়ে বড়ো হলে কত যে চিন্তা হয়।’ 

বিশাখার মা দেশাখকে না করতে পারে না। দেশাখ বলেছে মাস দুয়েকের মধ্যে বিয়েটা হয়ে যাবে। 

দু-জনে টিলা বেয়ে নেমে আসে। 

‘দেখলে তো কেমন কৌশলে তোমাকে নিয়ে এলাম।’ 

‘মানে?’ 

‘শবরী বউদির ওখানে তুমি রাতে থাকবে সেটা ঠিক। তার আগে আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ। বউদি কিছু বলেনি। তোমাদের ঘরে বসে থাকতে খারাপ লাগছিল। ভাবছিলাম তোমাকে নিয়ে বেরুই কেমন করে। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধিটা এসে গেল।’ 

‘উঃ তুমি—’ 

‘গাল দিও না। তুমিও খুশি হয়েছ আমি জানি।’ 

দু-জনে হাসে। অন্ধকারে কেউ কারও মুখ দেখতে পায় না। শুধু হাতে হাত ধরা। দেশাখের মনে হয় সারা দিনের পর এতক্ষণে ও খোলা হাওয়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। গুমোট অবস্থাটা কেটে গেছে। 

‘বিশাখা, ইচ্ছে করছে তুমি আর আমি প্রাণখোলা হাসিতে সবাইকে মাতিয়ে তুলি। সকলের বুকের ভয় তাড়িয়ে দেই।’ 

‘তা কেমন করে হবে? আমাদের সর্বনাশ হবে।’ 

‘ঠিক আছে এখন এসব কথা থাক। তুমি একটা গান গাও বিশাখা। 

‘আমি গান জানি না।’ 

‘ডোম্বি খুব ভালো গাইতে পারত।’ 

আবার আবহাওয়া ভারী হয়ে যায়। ঘুরেফিরে প্রসঙ্গ এক। 

‘ডোম্বিকে ওরা মেরে ফেলবে দেশাখ?’ 

‘হয়তো।’ 

‘আমাদের উৎসবগুলো মাতিয়ে রাখবে কে?’ 

দেশাখ কথা বলে না। 

‘কানুদার কী হবে দেশাখ?’

‘জানি না।’ 

‘খারাপ কিছু ভাবতে আমার ভালো লাগে না।’

‘আমারও না।’ 

দু-জনে চুপচাপ হাঁটে। এই অন্ধকারে হাঁটতে ওদের ভালোই লাগে। শবরীর টিলা বেশ খানিকটা পর। চালতা গাছের কারুকাজময় ঘন পাতার আড়ালে বসে পেঁচা ডাকে। মহুয়া ফুলের গন্ধ আসছে। 

‘এখনও তোমার ভয় করছে বিশাখা?’ 

‘হ্যাঁ।’ 

‘জোরে জোরে কথা বলো ভয় কেটে যাবে।’ 

‘জোরে কথা বলতেও আমার ভয়।’ 

‘তাহলে কী করব?’ 

‘জানি না। উহ্ যা অন্ধকার।’ 

‘চলো দৌড়াই এবং প্রাণখুলে হাসি।’ 

দু-জনে হাত ধরাধরি করে দৌড়ায়। বিশাখা হোঁচট খেলে দেশাখ ওকে বুকে তুলে নেয়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *