অপণা মাংসে হরিণা বৈরী – ১
মেঘবরন চুল শবরীর, তেমন তার গোছা। দুপুরের পর থেকে শুরু করেছে, কাঁকইয়ে ধরে না। সে চুলের গোছা সামলাতে সময়টা শেষবিকেল হয়ে যায়। হাঁটু মুড়ে বসে থাকার জন্য পায়ের পাতায় ঝিঁঝিঁ ধরেছে। খোঁপায় ময়ূর পালক গুঁজে দিয়ে ও উঠে দাঁড়ায়। প্রথমে বাম পা এবং পরে ডান পা বেশ করে ঝাঁকিয়ে নেয়, তবু ঝিম ভাবটা সহজে কাটতে চায় না। এর মাঝে মনে খুশি, পছন্দমতো সাজতে পারলেই শবরী নিজেকে সবচেয়ে সুখী মনে করে। পুবদিকের বেড়া থেকে গুঞ্জার মালা নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে দেয়। হাতে কেয়ূর। কটিদেশে মেখলা, পায়ে মল শবরীর বিশেষ সখ ঘুরেফিরে নিজেকে দেখে। সারাদিন চন্দন লেপে রাখার দরুন মুখটা এখন আশ্চর্য পেলব, গালে হাত ঘষে নিজেই অবাক হয় ও। চন্দনের মৃদু সুরভি শরীর থেকে উঠে আসে। ওর মনে হয় সৌন্দর্যচর্চা প্রার্থনার মতো, গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে না থাকলে প্রার্থনা ছুটে যায়। ছুটে গেলে ঈশ্বরকে যেমন একমনে ডাকা যায় না, তেমন সৌন্দর্যচর্চাতেও খুঁত থাকে। তখন অস্বস্তি হয় ওর। নিজেকে আর কিছুতেই সৌন্দর্যের স্রষ্টার ভূমিকায় রাখতে পারে না। কাহ্নুপাদও শবরীর সেই ত্রুটি সইতে পারে না। তাই সৌন্দর্যচর্চায় শবরীর বিরামহীন প্রচেষ্টায় ও যখন শিল্পী হয়, তখন কাহ্নুপাদ ওর সামনে নতজানু হয়। গদগদ স্বরে প্রার্থনার ভাষায় ভালোবাসার কথা বলে। বলে, ‘তুমি এক পবিত্র মন্দির শবরী। সারাক্ষণ সেখান থেকে আরতির ঘণ্টা শুনতে পাই। এ এক চমৎকার প্রার্থনার ভাষা। এর বাইরে আমি আর কোনোকিছু বুঝতে চাই না। বুঝি না ঈশ্বর, বুঝি না বেদ।’
কিন্তু একই সঙ্গে হৃদয় তার ভিন্ন কথা বলে। প্রবল যন্ত্রণায় ছটফটালে উচ্চারিত হয়, এই সৌন্দর্য অর্থহীন, যদি না বেঁচে থাকা অর্থবহ করা যায়, যদি না বেঁচে থাকার পরিবেশ নিজের না হয়, যদি না পরিবেশ প্রভুত্বের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়।
শবরী দৃষ্টি সুঁচালো করে বলল, ‘কী ভাবছ?’
‘কিছু না।’
কাহ্নুপাদ মাথা নাড়ে। শবরী তখন বাঁধ ভেঙে খিলখিলিয়ে হাসে। হাসতে হাসতে টের পায় ওর বুকের ভেতর সুখের হরিণ কাঁপে। কাহ্নুপাদের কাছ থেকে যেটুকু শোনে তাই নিয়েই ভাবে, ‘কানু কী সুন্দর করে কথা বলে। ওর মতো আর কেউ পারে না।’
টিলার ওপরের এই চাঁচর বেড়ার ঘর থেকে দূরের অরণ্য নীলাভ দেখায়। রোদ এখন নেই, শবরী চঞ্চল হয়ে ওঠে। একটু পরে কানু আসবে। এই সময়টায় ওর খুব অস্থির লাগে। পোষা ময়ূরের সঙ্গও তেমন আনন্দদায়ক মনে হয় না। ও ঘর-বার করতে থাকে। সারাদিন কাহ্নুপাদের দেখা মেলে না। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজদরবারে ওর সময় কাটে। সন্ধ্যার আগে ও ঘরে ফেরে। এ নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। মাঝে মাঝে কাহ্নুপাদ এ কাজ ছেড়ে দিতে চায়। একদিন ও হয়তো তাই করবে। ওর কখন যে কী ভালো লাগে বোঝা দায়। শবরী বোঝে রাজদরবারের কাজ অনেক সম্মানের, ছাড়বে কেন কানু? এ প্রশ্নের উত্তর ও কোনোদিনই পায় না। বিয়ের প্রথম দিকে খারাপ লাগলেও এখন ও মেনে নিয়েছে। বরং প্রতীক্ষার এ তীব্রতায় রাত্রি অন্যরকম হয়। ওর এ রাত্রির নিজস্ব রং আছে; তা কালো নয়, বর্ণাঢ্য। চাঁদের নরম আলো চাঁচর বেড়ার বাড়িটাকে উৎসবমুখর করে তোলে। টিলাজুড়ে কার্পাস ফুল ফুটে আছে। সাদা কার্পাস ফুল ছুঁয়ে শবরী টিলা বেয়ে নামতে থাকে। ওর মনোযোগ না পেয়ে ময়ূরটা আরও আগে নীচে নেমে গেছে। সাদা ফুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওটা এখন পেখম ছড়িয়ে নাচছে। বাড়ির পেছনে কঙ্গুচিনা ফলের গাছ, ফল পেকেছে। তা দিয়ে হাঁড়িয়া বানিয়েছে শবরী। ও কার্পাস গাছের পাশে পা ছড়িয়ে বসে, ঝুমঝুমিয়ে মল বেজে ওঠে। চারদিকে নীলাভ অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। বুনোফুলের তীব্র গন্ধ দিকবিহীন ছুটছে। ঝিম ধরে শবরীর মাথায়। চারদিকের পরিবেশ উৎসবের জন্য প্রস্তুত, অথচ কানু নেই। এই টিলা, অরণ্য, কার্পাস বাগান, কঙ্গুচিনা গাছের সারি কানু ছাড়া অর্থহীন। কিছুই ভালো লাগে না ওর। এখন তো সংসারে তেমন করে প্রবেশ করেনি, সন্তান নেই, বাড়তি কাজের ঝামেলা নেই, এখন তো স্বপ্নের সময়, শুধু স্বপ্ন কেটে যায় ঠিকমতো কানুকে না পেলে। ওর মনে হয় কানু ওকে ঘরগেরস্থির গৃহিনী হিসেবে দেখে না। কানুর কাছে ও আরও একটু ওপরের কিছু, যেটাকে ও ধুলোবালির আবর্জনা থেকে আড়াল করে রাখে। সেজন্যই ওর এত আয়োজন, নিরাভরণ শবরী কাহ্নুপাদের মনোযোগ ধরে রাখে না। হয়তো কাহ্নুপাদ কবি বলে এমন চায়, যে চাওয়া মানুষকে স্বপ্নের মধ্যে টেনে নেয়। যে চাওয়ার ভেতর দিয়ে কানু সবাইকে সৌন্দর্যপ্রিয় করে তোলে, সবাইকে কবি করতে চায়।
ঝিঁঝিটের একটানা শব্দ আসে। শবরীর মন খারাপ হয়ে যায়। আজ যেন একটু বেশি দেরি হচ্ছে কানুর। ও ঘাসের ওপর জোরে জোরে পা দাপায়। দূর্বায় ডুবে যায় পা। আর তখুনি ওর ইন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। ও বুঝতে পারে যে দ্রুতপায়ে কাহ্নুপাদ আসছে। শিস বাজিয়ে চলা ওর অভ্যেস এবং ওর শিসের একটা নিজস্ব ঢং আছে। যে কেউ বুঝতে পারে ওটা কাহ্নুপাদই। কানু এসে ওর হাত ধরে কার্পাস গাছের আড়ালে আসে। শবরীর শরীরের চন্দনের গন্ধ ওকে পাগল করে দেয়। ময়ূর পালক গোঁজা চুলের অরণ্যে মুখ গোঁজে। এ সবই ওর প্রিয় অভ্যেস।
অভিমানে শবরীর ঠোঁট কাঁপে, ‘আজ এত দেরি করলে যে?’
‘দেরি কোথায়? দ্যাখো পাহাড়ের মাথা থেকে সন্ধ্যার আলো এখনও মুছে যায়নি।’
‘মিথ্যে কথা। রাত নেমেছে কখন। আমার মনে হয়েছে কত রাত ধরে যেন বসে রয়েছি।’
‘প্রতীক্ষার সময় খুব খারাপ সখি। আর সেজন্যই মিলন এত মধুর। তা ছাড়া তুমি আমাকে বেশি ভালোবাসো কিনা—’
‘মোটেই না।’
শবরী মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদ করে। কাহ্নুপাদ প্রাণভরে হাসে। ও জানে শবরী মিথ্যে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে অভিমান তীব্র করে। এসবের মধ্য দিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি মুছে যায় এবং সেদিনের মতো গ্লানিটুকুও ধুয়ে দেয় শবরী। কাহ্নুপাদ পরের দিনের জন্য নিজেকে নতুন করে তৈরি করে, ভুলে যায় রাজদরবারের মেকি জৌলুস এবং আড়ম্বরের ঘনঘটা। শবরীর কাছে ফিরে এসে ও মনেপ্রাণে নিজেকে নিজের মতো করে ভাবতে চায়। বুঝতে চায় রাজদরবারের ফাঁকিটুকু। এই বোধ একটু একটু করে ওকে অনুপ্রাণিত করে। ও বুঝতে পারে নিজেরটুকু নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যেই সব গৌরব। শবরীর গলা থেকে গুঞ্জার মালা খুলে নিজের হাতে জড়িয়ে নেয় কাহ্নুপাদ। তারপর ওর কোলের ওপর মাথা রেখে টানটান শুয়ে পড়ে। পায়ের কাছে কার্পাসের ডাল নুয়ে থাকে। ময়ূরটা নেচে নেচে ঘরে ফিরে যায়। চঞ্চল হয়ে ওঠে শবরী।
‘ঘরে চলো কানু।’
‘ঘর? ঘর আবার কী? এই তো ঘর। আমি বুঝি না এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফেলে মানুষ কেন ঘরে যায়। ঘরে আমি আনন্দ পাই না সখি। মনে হয় চারপাশের বেড়াগুলো বাতাসের পথ আটকে দেবার জন্য, ফুলের সৌন্দর্য ঢেকে রাখার জন্য, অন্ধকারের মোহন আকর্ষণ উপেক্ষা করার জন্য তৈরি।’
‘সবাই তো তোমার মতো কবি নয়।’
‘একটা বিশেষ সময়ে সবার কবি হওয়া উচিত সখি। নইলে আনন্দের মুহূর্ত তেমন জমে না। জানো আমি দেশের রাজা হলে কী করতাম?
‘কী?’
‘বলতাম, যে যে কাজই করুক সকলেরই বিশেষ সময়ে কবি হতে হবে, বাধ্যতামূলক। এটাই হবে আমার রাজ্যের আইনের প্রথম শর্ত। নইলে বেঁচে থাকা অর্থহীন।’
‘ভাগ্যিস তুমি রাজা হওনি, তাই সবাই বেঁচে গেছে।’
শবরী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়, অনেক দূরে ভূতুম ডাকে একটা। কাহ্নুপাদ আনমনা হয়ে যায়। বুকের ভেতর চাপ অনুভব করে। না, রাজা নয়, ও তো সবাইকে নিয়ে তেমন একটা বিশাল ঘর চায় যেখানে ওরা নিজেরাই সব। ওদের ওপর কারও কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। এসব কথা কাউকে বলা যায় না। এসব ভাবনা ওর মাথায় প্রবল হয়ে উঠলে ও হাঁড়িয়ার তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে যায়।
তখন শবরী প্রিয় কথা বলে, ‘ওগো হাঁড়িয়া করেছি।’
‘হাঁড়িয়া? আজ হাঁড়িয়ার উৎসব। আহ্—।’
কাহ্নুপাদ উঠে বসে, ‘এখুনি নিয়ে এসো।’
শবরী দ্রুত টিলা বেয়ে উপরে উঠে যায়। কাহ্নুপাদের মগজে নেশার আমেজ। শবরীর দেহে আছে এক অপরূপ মদিরা, মৃদঙ্গের মতো বাজে। কঙ্গুচিনার হাঁড়িয়া ওই নেশাকে আরও জমিয়ে তোলে। বুকের মধ্যে মৃদঙ্গের ধ্বনি ভৈরবী রাগের লয়ে কাহ্নুপাদকে এক বিস্মৃতির তলে টেনে নিয়ে যায়। ও ক্লান্তি ভুলতে থাকে। হঠাৎ মনে হয় প্রকৃতি নীরব, উদাস। ভূতুমের ডাক নেই। এখনই সময় সৃষ্টির। কাহ্নুপাদ চুমুক চুমুক হাঁড়িয়ার সঙ্গে শবরীর শরীরে নেশার উৎসব ঘনিয়ে তোলে। জীবনের এত আনন্দ আর কোথাও নেই।
‘ওগো, আর খেয়ো না।’
শবরী কাহ্নুপাদের হাত চেপে ধরে।
‘না, না, বাধা দিও না।’
কাহ্নুপাদের কন্ঠ জড়িয়ে যায়। চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় চাঁচর বেড়ার বাড়ি, কার্পাস ফুল, কঙ্গুচিনার গাছ। কোথাও কিছু নেই। কাহ্নুপাদের চোখের সামনে ময়ূরের মতো পেখম তুলে জেগে উঠেছে শবরী। পটভূমিতে অনন্তকালের রাত্রি।
‘আর খেয়ো না গো—’
‘বাজে কথা বলতে নেই সখি। তোমার কন্ঠে বাজে কথা কেন? তুমি এত অপূর্ব কেন শবরী? কেন তোমার সব কিছুতে এমন নিপুণ শিল্পীর হাত? এমন হাঁড়িয়া আমি কখনোই বানাতে পারব না। তুমি আমাকে বাধা দিও না।’
বলতে বলতে আচ্ছন্ন হয়ে আসে কণ্ঠ। ও স্পষ্ট দেখতে পায় নিজের অস্তিত্বে আর স্থিতি নেই শবরীর। ও এখন এক চমৎকার মায়ার হরিণ, সামনে বিশাল বন। তিরধনুক হাতে নিয়ে ছুটছে কাহ্নুপাদ, কিন্তু কিছুতেই হরিণের নাগাল পায় না। ছুটে বেড়াচ্ছে বনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, পথ আর ফুরোয় না। কিন্তু পথ যত দীর্ঘই হোক না কেন ওই হরিণীকে ধরা চাই। হাঁড়িয়ার হাঁড়িতে শেষ চুমুক দেয় কাহ্নুপাদ। তারপর শবরীকে কাছে টেনে বলে, ‘জানো সখি, নেশা হওয়ার পর তোমাকে আর বউ বলে মনে হয় না, মনে হয় অন্য নারী। যে নারীর ওপর কোনো অধিকার নেই, অথচ যাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দুর্বার হয়ে ওঠে। যাকে পাওয়ার জন্য মন পাগল হয়ে যায়।’
শবরী মুখ ঘুরিয়ে বলে, ‘তুমি এমন করে কাছে রেখে আমাকে পর করো।
কাহ্নুপাদ শবরীর মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে, ‘তোমাকে কেন্দ্র করেই তো আমার সব ইচ্ছা জাগে। তোমাকে আমি কতভাবে যে দেখি সে তুমি বুঝতে পারবে না। আমি তোমাকে ত বোঝাতেও চাই না শবরী। শুধু আমার স্বপ্নের রাশ তুমি টেনে ধরবে না।’
‘তোমার এসব কথা শুনলে আমার ভয় করে। মনে হয় তুমি অনেক দূরের কেউ। তোমার নাগাল আমি পাব না।’
সাড়া নেই কাহ্নুপাদের। ও নেশায় নিমজ্জিত হয়ে গেছে। শবরী কাহ্নুপাদের চুলের ভেতর হাত রাখে। ডাকতে গিয়ে থমকে যায়, থাক বেচারা! ও দেখে কাহ্নুপাদের পুরুষালি কালো গাট্টা শরীরটা কেমন অসহায়ের মতো ঘাসের ওপর পড়ে আছে। একজন অচেনা মানুষ দেখার মতো ও কানুর দিকে তাকিয়ে থাকে। ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না যে কানুর মাথার ভেতর কেমন করে এতকিছু আসা-যাওয়া করে। শবরীর বুকের ভেতর সুখের হরিণ কাঁপে।
রাজদরবারে পাখা টানার কাজ করে কাহ্নুপাদ। রাজা বুদ্ধমিত্রের অশেষ দয়ায় কাজটা জুটেছে। নইলে ব্রাহ্মণদের প্রচণ্ড প্রতাপে তার পাশে যাবার সাধ্য কারও নেই, অন্তত অন্ত্যজ শ্রেণির লোকদের। একদিন বুদ্ধমিত্র ঘোড়ার শকটে যাবার পথে গাড়ির চাকা কাদায় দেবে যায়। কাহ্নুপাদ চালকের সঙ্গে ভীষণ পরিশ্রমে সে চাকা তোলায় সাহায্য করেছিল। রাজা খুশি হয়ে ওকে রাজদরবারে কাজ দিয়েছে। প্রথম প্রথম কাহ্নুপাদের ভালোই লাগত। অন্তত মাস গেলে একটা মাসোহারা পাওয়া যেত। কিন্তু আস্তে আস্তে ও বুঝতে পারে যে প্রতিদিন ওকে গরল হজম করতে হয়। রাজার ব্রাহ্মণ মন্ত্রী এবং পরিষদের অন্যান্যরা ব্যাপারটা সুনজরে দেখে না। সবসময় এটা-ওটা নিয়ে ওকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, পেছনে লেগে থাকে। এই অপমান ওর গাঁয়ে বিছুটির জ্বালা, কিন্তু যেহেতু রাজা ওকে স্থায়ী করেছে সেজন্য ছেড়ে চলে যাবার অধিকার নেই ওর। রাজদরবার ইচ্ছে করলে ওকে ছাড়িয়ে দিতে পারে, সেটা রাজার খুশি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটুও বিশ্রাম নেই কাজের। রাজা দরবারে না থাকলেও পাখা টানতে হয়। অন্য লোকেরা তো থাকে। পাখা টানতে টানতে কাহ্নুপাদের হাত যখন অবশ হয়ে আসে মনের মধ্যে কবিতার পংক্তি গুনগুনিয়ে ওঠে। কখনো সে পংক্তি ভালোবাসার, কখনো প্রতিবাদের। কিন্তু প্রতিবাদ সরাসরি করতে পারে না বলেই তার গায়ে আবরণ দিতে হয়। ওদের জীবনের চারদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল প্রতাপ। সে শ্বাসরোধী প্রতাপ ওদেরকে কোনোদিনই এগুতে দেয় না। কার্পাস ধুনোর মতো আনন্দ ছিন্নভিন্ন হয়। কাহ্নুপাদ বিষণ্ন হয়ে থাকে। ব্রাহ্মণ্যবাদের এই পীড়ন থেকে মুক্তি পেতে চায় কিন্তু পথ খুঁজে পায় না।
আলিএঁ কালিএঁ বাট রুন্ধেলা।
তা দেখি কাহ্নু বিমনা ভইলা।।
পাখা টানতে টানতে কাহ্নুপাদ কেবলই নিজেকে প্রকাশের পথ খোঁজে। ভেতরে ভেতরে নিদারুণ জ্বালা গনগনে হাঁপরের মুখ খুলে রাখে, ও অনবরত পোড়ে। কোথায় গিয়ে কী করবে বুঝতে পারে না।
কাহ্নু কহিঁ গই করিব নিবাস।
জো মন গোঅর সো মো উআস।।
কাহ্নুপাদ আজও হাঁড়িয়ার নেশার ভেতর যখন স্বপ্ন দেখে তখন ঠিক এ ধরনের যন্ত্রণাই তীব্র হয়ে ওঠে। ও ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে। সে অস্পষ্ট ধ্বনিতে শবরীর ঘুম ভাঙে। তখনও পুরো ভোর হয়নি। শবরী কাহ্নুপাদের গাঁয়ে ঠেলা দেয়।
‘ওগো ওঠো, কী বলছ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে?’
‘চারদিকে ভীষণ অন্ধকার, পথও বন্ধ। এগুতে পারছি না।’
‘কী ছাইপাশ যে বলো কিছুই বোঝা যায় না।’
‘আমিও বুঝি না, শুধু মাথা ভার হয়ে থাকে।’
কাহ্নুপাদ চোখ বোজে। শবরী শিথিল বসন গোছায়। আড়মুড়ি ভাঙে। দু-পা মেলে দিলে দেখে পায়ে আলতার রং ফিকে হয়ে এসেছে। ও ঘাসে পা মোছে। কাহ্নুপাদের পাল্লায় পড়ে ওকে মাঝে মাঝে এমনই খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাতে হয়। কিছুতেই ঘরে যেতে চায় না। ওর নিজেরও যে ভাল লাগে না তা নয়। শবরী কাহ্নুপাদের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে, ‘ওঠো, আলো ফুটেছে।’
‘তাতে কী? আমি উঠব না।’
‘তোমাকে কাজে যেতে হবে।’
‘কাজ?’
কাহ্নুপাদ চোখ খোলে। রাজা কিছু না বললেও মন্ত্রী দেবল ভদ্র একটুও এদিক-ওদিক সইতে পারে না। সময়মতো দরবারে পৌঁছোতে হয়। ও খোঁয়ারি নিয়ে উঠে বসে। মাথা সোজা রাখাই মুশকিল। দু-হাতে মাথার চুল ধরে ঝাঁকুনি দেয়। তারপর শবরীর আঁচল ধরে টানে।
‘চলো নদী থেকে নেয়ে আসি।’
‘আহ্ ছাড়ো।’
‘না।’
কাহ্নুপাদের হাঁড়িয়া-দৃষ্টিতে বুনো-রোদ ঝিলিক দেয় এবং তা সঙ্গে সঙ্গে শবরীর চন্দন-শরীরে লুটিয়ে পড়ে।
কাগনি ধানের ভাত রেঁধেছে শবরী। ঘরের মেঝেয় হরিণের চামড়া বিছিয়ে খেতে বসেছে কাহ্নুপাদ। সামনে ভাতের থালা, ধোঁয়া উঠছে। জলের ভাঁড় তরকারির বাটি। কাঁসার বাটিতে মৌরলা মাছের ঝোল এবং হরিণের মাংসও আছে। সামনে হিঞ্চে ডাঁটার আসনে হাঁটু মুড়ে বসে আছে শবরী। বেশিরভাগ সময় ও এই ভঙ্গিতেই বসে। হাতে কেয়ূর নেই, কটিদেশেও খালি, দিগলদাগল চুলের রাশি বেয়ে জল ঝরে। নদীতে ডুবিয়ে আসার পর ভালো করে চুল ঝাড়া হয়নি। কাহ্নুপাদ খেয়ে চলে গেলে তখন নিজেকে নিয়ে বসবে। নিরাবরণ শবরীর দীপিত সৌন্দর্য ওকে মুগ্ধ করে। হরিণের মাংস মুখে দিতে গিয়ে সেটা শবরীর মুখে গুঁজে দেয়।
আকস্মিকতায় বিব্রত হয় শবরী, ‘আহ্ কী হচ্ছে?’
‘তুমি খাও আগে, তারপর তোমার প্রসাদ আমি নেব।’
‘না, কখনো না।’
‘হ্যাঁ।’
‘পাপ হবে।’
‘পাপ? কীসের পাপ, কীসের পুণ্য? তুমি তো জানো এটাই আমার প্রার্থনা। এভাবেই আমি দেবতাকে তুষ্ট করি।’
কাহ্নুপাদের চোখে অনুরাগের শাসন। শবরী মাংসের টুকরো দাঁতে কামড়ে ধরে। মনে মনে বলে, ‘ও এমন পাগল বলেই ওর জন্যে মরে যেতেও কষ্ট হবে না।
হরিণের মাংসের ছোটো ছোটো টুকরো দিয়ে তৃপ্তি সহকারে খায় কাহ্নুপাদ। মাছের ঝোল ও চমৎকার হয়েছে। শবরী নিজে যেমন কালো পাথরে খোঁদাই করা মসৃণ মূর্তি, তেমনই তার হাতের কাজ। ওর মসৃণ পেলব ত্বকে আলো ঝলকায়, চমৎকার শরীরের গঠন, বাঁকে বাঁকে টাল খায়। ওর জুড়ি হয় না। শুধু পেট নয়, কাহ্নুপাদের মনও ভরে থাকে কানায় কানায়। খেতে ভালোবাসে ও। শবরী যতটা সম্ভব নতুন নতুন খাবার বানাতে চেষ্টা করে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে নানারকম জিনিস সংগ্রহ করে। বেতি শাক, হেলেঞ্চা, গিমা, সজনে, সরপুঁটি, চিংড়ি, শামুক, কাঁকড়া সব কাহ্নুপাদের প্রিয়। ও পাহাড়ের দিক থেকে শামুক খুঁজে আনে, কচি বেতের ডগা কেটে আনে। বেতের ডগা দু- দিন জলে ভিজিয়ে রেখে মসুরির ডালের সঙ্গে বেটে বড়া ভেজে দেয়। গুঁড়া মাছ ধনে পাতা, কাঁচামরিচ এবং মশলা দিয়ে মাখিয়ে কলাপাতায় মুড়ে মাটির খোলায় করে রেঁধে দেয়। এসব পেলে সেদিন উৎসবের মতো আনন্দ করে ভাত খায় কাহ্নুপাদ, কিন্তু সবসময় এসব করার সঙ্গতি কোথায়? ইচ্ছে থাকলেই কি তার পূরণ হয়? একটা বা দুটো, এর বেশি ব্যঞ্জন এক বেলায় রাঁধা হয় না। তখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় ওর। তবু সংসারে লোক কম বলে এইসব জোটে। একটা খরগোশ পেলে ও নিজে না খেয়ে কানুর জন্য দু-বেলা করে।
‘কী ভাবছ? নাও, এই মাংসটা আর একটু খাও।’
‘না, তোমার জন্য থাক। হরিণের মাংস তুমি বেশি ভালোবাসো।’
‘ভালোবাসলেই একলা খেতে হবে?’
‘আমার তো বেশি ভালো লাগে না।’
কাহ্নুপাদ হো-হো করে হাসে, ‘তোমার কী ভালো লাগে?’
‘এই ধরো, শুক্তো, চিংড়ি দিয়ে সাদা ডাঁটার চচ্চড়ি, ভাদাল পাতার ভর্তা, এই সব আর কি।’
‘বুঝেছি, ভালো কিছু শুধু ছল করে আমাকে খাওয়াতে চাও। খাইয়েই তোমার সুখ, না?’
‘হ্যাঁ,’ ও মৃদু হেসে মাথা নাড়ে। তারপর মাংসের টুকরো কাহ্নুপাদের থালায় তুলে দেয়।
‘হরিণের মাংস আজ শেষ হয়ে গেল।’
‘তাহলে কী হবে?’
‘তোমার ভাবতে হবে না। আজ আমি নদীর ধারে গিয়ে কাঁকড়া ধরে আনব।’
‘রোদে কষ্ট হবে যে?’
শবরী খিলখিলিয়ে হাসে, ‘পাখা টানতে তোমার কষ্ট হয় না?’
‘হলে কী? আমি সইতে পারি।’
‘আমিও পারি।’
‘তার মানে তুমি হারতে চাও না। ঠিক আছে, তপ্ত খাবার পেলে আমারই লাভ, পেটে গাদিয়ে ঘুম দেওয়া যায়।’
কাহ্নুপাদ তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। চেটেপুটে খাওয়া শেষ করে, ঢকঢক করে জল খায়। শবরী বাসনকোসন গুছিয়ে বেড়ার গায়ে হরিণের চামড়া ঝুলিয়ে রাখে। কলাপাতার ছাই দিয়ে ধোওয়া জামাটা দড়ির ওপর থেকে টেনে নিয়ে পরতে পরতে কাহ্নুপাদ বলে, ‘আজ এত খেয়েছি যে হাঁটতে কষ্ট হবে। তুমিও তো খাবারগুলো একটু সামলে রাখতে পারো? না, সব আমাকে দেয়া চাই।’
‘হয়েছে থামো, নাও।’
ও কর্পূর দেয়া পানের খিলি এগিয়ে দেয়। কাহ্নুপাদ ওকে বিদায়-সোহাগ জানায়।
‘কখন ফিরবে?’
‘ঠিক সন্ধ্যায়।’
‘সারাদিন খুব একলা লাগে।’
শবরীর দৃষ্টি ম্লান হয়ে যায়।
‘মুখটা উজ্জ্বল করো সখি, আমি যাই। এমন করে বিদায় দিলে সারাদিন খারাপ যাবে।’
শবরী জোর করে হাসে। কাহ্নুপাদ টিলা বেয়ে নেমে যায়। যতদূর দৃষ্টি যায় তাকিয়ে থাকে ও। একসময় কানু আড়াল হয়ে গেলে ও ঘরে ঢোকে। ময়ূরটা কাছে এসে দাঁড়ায়। শবরী ওটার গলা জড়িয়ে ধরে নিজেকে সামলায়।