১
উঁচু বোল্ডারসারি ঘিরে রেখেছে জায়গাটাকে, খানাখন্দে ভরা এক চিলতে খোলা জায়গা; পাশে দীর্ঘ পাহাড়ী ঢল নেমে গেছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে। জায়গাটাকে কাউ-হাউস বলে সবাই, কারণ ক্ৰীকের পাড়ের ছোট ছোট গুহায় লুকিয়ে থাকে কিছু গরু। সঙ্কীর্ণ ট্রেইল ধরে হঠাৎ উপস্থিত হলেন বাবা। আমি তখন তৃণভূমিতে খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছি কয়েকটা বলদকে, মাছির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ওগুলো।
বাড়ি এসো তো, বয়। ট্যাপ এসেছে। পশ্চিমে কোথায় নাকি ভাল জমি আছে-তাই বলছে ও সবাইকে।
বাবার কণ্ঠে পরিষ্কার আগ্রহ। ট্যাপ এডলে এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে, শুধু এটাই ওঁর জন্যে বড় সুসংবাদ। আমার জন্যেও। কথাগুলো বলার পর দাঁড়ালেন না বাবা, ঘোড়া ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরলেন।
ল্যাসো গুটিয়ে পমেলের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলাম আমি, স্যাডলে চেপে র্যাঞ্চহাউসের দিকে এগোলাম।
মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম।
আমাদের টেক্সাস হাউস-এর পোর্চে ভিড় জমে গেছে তখন। ট্যাপ এডলেকে ঘিরে ছোটখাট একটা ভিড় চোখে পড়ল। বিশ গজ দূরে পোর্চের এপাশে আরও কয়েকজন নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে কোন বিষয় নিয়ে।
ব্যাপারটা নতুন নয়, কারণ কিছুদিন ধরে এ নিয়ে বিস্তর তর্ক, আলোচনা আর পরামর্শ চলছে। সবাই বুঝতে পারছে দেয়ালে ঠেকে গেছে আমাদের পিঠ। একটা কিছু করতে হবে। হয় এখানে থেকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে রক্তসংগ্রাম করে টিকে থাকতে হবে, নয়তো টেক্সাস ছাড়িয়ে আরও পশ্চিমে সরে যেতে হবে নতুন কোন বসতির খোঁজে।
ট্যাপ এডলে দীর্ঘদেহী যুবক। সাতাশ-আটাশ হবে বয়েস। শৈশব আর কৈশোর একসঙ্গে কেটেছে আমাদের, যদিও আমার চেয়ে ছয় সাত বছরের বড় ও। কঠিন, বেপরোয়া যুবক; রোমাঞ্চপ্রিয় এবং কিছুটা হলেও ছন্নছাড়া স্বভাবের। কাউহ্যান্ড হিসেবে প্রথমসারির। অস্ত্রে দারুণ দক্ষ।
লোকজনের ভিড়ের মধ্যেও ঠিক নজরে পড়ে ট্যাপকে। ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা ও, একশো নব্বই পাউন্ড ওজন। ঝালর দেয়া ঝলমলে নীল শার্ট পরনে, নিপুণ ভাবে ইস্ত্রি করা নিচের দিকে দু’পাশে বোতামের সারি; আর রয়েছে শটগান চ্যাপস, লাল ব্যান্ডানা, স্প্যানিশ বুট এবং বড়সড় ক্যালিফোর্নিয়া স্পার। সব মিলিয়ে চোখ ধাঁধানো উপস্থিতি।
এখনও মুক্তো বসানো হাতলের সেই সিক্সশূটারটা শোভা পাচ্ছে। ওর হোলস্টারে। পিস্তলটা ছিল এক বন্দুকবাজের, ট্যাপের হাতে খুন হয় সে।
ট্যাপ আমাদের বন্ধু, এবং এক হিসেবে আমার ভাইও বটে।
সব ক’জনের মাথা ছাড়িয়ে গেছে ও। দূর থেকে চোখাচোখি হলো আমাদের। নির্লিপ্ত কিন্তু সাবধানী দৃষ্টি ওর চোখে। এ চাহনি পরিচিত আমার, কিন্তু আজই প্রথম এভাবে আমাকে মাপছে ও। চাহনির মত অর্থটাও জানি আমি: বিরোধিতা বা অসহযোগিতার আশঙ্কা করছে ও! কেউ ওর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, সন্দেহ হওয়া মাত্র ট্যাপের চোখে এ চাহনি ফুটে ওঠে।
ড্যানি? ড্যান, বয়! ভিড় ঠেলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল ও, একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আরিব্বাপস্! তুমি দেখছি সত্যিই পুরুষ মানুষ হয়ে গেছ! ভাবতেই পারিনি এতটা লায়েক হয়েছ!
স্যাডল ছেড়ে ট্যাপের হাত চেপে ধরলাম। টের পেলাম দৃঢ় মুঠিতে আমার হাত চেপে ধরেছে ও, চাপ দিচ্ছে। মনে পড়ল নিজের বাহুবলের ওপর কতটা অহংকার বোধ করে ট্যাপ। সেকেন্ড খানেক সমানে সমান চাপ প্রয়োগ করলাম, তারপর হাত শিথিল করে দিয়ে ইচ্ছেমত চাপ দিতে দিলাম ওকে, যেহেতু ট্যাপকে পছন্দ করি আমি এবং নিজের জোর প্রমাণ করার খায়েশ নেই আমার।
ট্যাপ এডলের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে খানিক বিস্মিতই হলাম, কারণ চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছি আমরা-ওর দিকে তাকাতে এতটুকু চোখ তুলতে হলো না আমার। অথচ আগে কত লম্বা মনে হত ওকে!
ব্যাপারটা বোধহয় ট্যাপকেও বিস্মিত করেছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, দৃষ্টি নিচু হয়ে গেল ওর, আমার কোমর হয়ে ঊরুতে গিয়ে ঠেকল; কিন্তু এই মুহূর্তে নিরস্ত্র আমি। রেঞ্জে কাজ করার সময় কোন কাউবয় কোমরে পিস্তল বহন করে না। স্ক্যাবার্ডে রাইফেল আর পমেলের সঙ্গে ঝুলন্ত খোপে ছুরি রেখে এসেছি।
পশ্চিমে যাচ্ছি আমরা, ড্যানি! আমার কাঁধে হাত রেখে বলল ট্যাপ। ঘুরে বাড়ির দিকে এগোলাম আমরা। পোর্চের এক কোণে রাস্টি বুচার্ড আর টিম অটম্যানের সঙ্গে কথা বলছেন বাবা। জায়গাটা আমি নিজে দেখে এসেছি। ঘাস বা পানির অভাব নেই।
সকৌতূহলে আমাদের দুজনকে দেখছেন বাবা। অবশ্য শুধু বাবাই নন, পোর্চের অন্ধকার কোণে দাঁড়ানো কার্ল ক্রকেটের নজরও আমাদের ওপর। ওর সবুজ চোখে অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য। দীর্ঘ ধূসর চুলের রাশি ছড়িয়ে আছে কাঁধের ওপর, মেয়েদের মতই সযত্নে আঁচড়ানো; স্প্যানিশ হ্যাটের ব্রিমের নিচে চোখজোড়ায় মাপা, সতর্ক এবং কঠিন চাহনি।
কার্ল ক্ৰকেট আমার বন্ধু। হাতে গোনা কিছু বন্ধু আছে ওর, কারণ স্বল্পভাষী, নিঃসঙ্গ এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষের বন্ধুর সংখ্যা সাধারণত কমই থাকে। মাঝারি উচ্চতা, কিন্তু প্রশস্ত কাঁধের কারণে খাটো দেখায় ওকে। লাগসই স্প্যানিশ জ্যাকেট আর বাকস্কিনের বেল বটম ব্রীচে মন্দ লাগছে না ওকে।
এর আগে ট্যাপের সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি কার্লের-ব্যাপারটা উদ্বিগ্ন করে তুলল আমাকে, কারণ ওরা দু’জনেই কঠিন মানুষ এবং অপছন্দ বা অসন্তোষ প্রকাশ করতে গিয়ে প্রায়ই ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে ফেলে ট্যাপ।
তাহলে যাচ্ছি আমরা? বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে?
হ্যা…পশ্চিমে যাচ্ছি আমরা, ড্যান।
টিম অটম্যান আমাদের প্রতিবেশী। ছোট্ট একটা আউটফিটের মালিক হলেও প্রায়ই আমাদের হয়ে কাজ করে। দোহারা গড়নের গম্ভীর চেহারার মানুষ। সৎ। এটাই বোধহয় মোক্ষম সময়, মন্তব্যের সুরে বলল সে। কারণ তৃণভূমিতে ঘাসের সাইজ ছোট হয়ে গেছে, আর প্রতিবেশীরাও আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে।
জায়গাটা কত দূরে?
ছয়শো মাইলের মত, বেশিও হতে পারে। নিউ মেক্সিকোয়। যত দেরি হবে যেতে, ভাল জায়গার দখল পাওয়ার সম্ভাবনা ততই কমে যাবে।
কত গরু নিয়ে যেতে পারব আমরা, ড্যান? জানতে চাইলেন বাবা।
ইদানীং আমার মতামতের যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি, মনোযোগ দিয়ে শোনেন সব কথা; যদিও এখনও তিনিই এই আউটফিটের সর্বেসর্বা। বাবাও জানেন এটা, কিন্তু আমার বিচার-বুদ্ধির ওপর আস্থা আছে ওঁর, বছর দুই আগে গরুর ব্যবসা আমার ওপর ছেড়ে দেয়ার পর থেকে সেই আস্থার পরিমাণ বেড়েছে বৈ কমেনি।
ট্যাপ এডলের চোখে বিস্ময় দেখতে পেলাম। স্বাভাবিক, এখনও আমাকে একটা বাচ্চা ছেলে মনে করে ও। স্রেফ দুধের বাচ্চা। ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে আমার পরামর্শ চাইবেন বাবা।
হাজার তিনেক হবে বোধহয়। তবে বেশি ধরে নেয়াই ভাল। টিমের নিজস্ব তিনশো গরু রয়েছে, রাস্টিরও এরকম হবে। সব গরু রাউন্ড-আপ করার পর…তিন হাজার তো হবেই।
এত বিশাল গরুর পাল! অথচ তুলনায় আমাদের লোকজনের সংখ্যা কম হয়ে যাবে, চিন্তিত ভঙ্গিতে মন্তব্য করল ট্যাপ!
তিনটে ওয়্যাগন থাকবে। আর ঘোড়ার পাল তো আছেই।
ওয়্যাগন? প্রতিবাদ করল ট্যাপ। ওয়্যাগন নেয়ার পরিকল্পনা তো আমি করিনি!
পরিবার আছে আমাদের, বলল টিম অটম্যান। তাছাড়া সবারই টুকিটাকি জিনিসপত্র নিতে হবে।
কি কি নিতে হবে, ট্রেইলের সম্ভাব্য সমস্যা, লোকসংখ্যা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো এবার। করালের রেইলে শরীর ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি, টুকরো টুকরো কথা কানে আসছে, কিন্তু মনোযোগ দিচ্ছি না তেমন। এ ধরনের যাত্রায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কথা বা আলোচনা হয়, কোন কাজে আসবে না এসব। সিদ্ধান্তটা শেষপর্যন্ত আমাকেই নিতে হবে। যা ভাল মনে হবে, তাই করব।
এ ধরনের ফলাফলহীন আলোচনায় নির্দিষ্ট কোন বিষয় থাকে না, যদিও, বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে কিছু কিছু ধারণা হতে পারে। বহু আগে, প্রথম যখন পশ্চিমে যাওয়ার কথা উঠেছিল, এ নিয়ে ভেবেছি আমি এবং মোটামুটি একটা পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছি। কার্ল গম্ভীর স্বভাবের বা মিতভাষী হলেও সুবিবেচক, খুঁটিনাটি কয়েকটা ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে আমাকে।
বড়জোর বারোজন লোক পাব আমরা, কাজের তুলনায় নেহাত কম। গরুর পাল ট্রেইলে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সামলাতে তেমন সমস্যা হবে না, চার-পাঁচজন ক্রুই তখন ড্রাইভ পরিচালনা করতে পারবে, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত গরু সামলানোর কাজটা সত্যিই কঠিন হবে। বয়স্ক অনেক গরু ঝোঁপঝাড়ে অনেক দিন থাকায় প্রায় বুনো হয়ে পড়েছে, চেনা এবং অভ্যস্ত রেঞ্জ ছেড়ে হঠাৎ সরতে চাইবে না এখন।
আমাদের নিজস্ব কিছু সমস্যাও দেখা দেবে, যদিও পরস্পরের পরিচিত সবাই। লোকালয় ছাড়িয়ে কোমাঞ্চি এলাকা পেরোতে হবে, ওখানেই বিপদের যত ভয়।
দারুণ ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা। সর্বস্ব হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে আমাদের।
এখানেই থাকতে পারি আমরা, মাটি কামড়ে লড়তে পারি; কিন্তু টিকে থাকার সম্ভবনা একেবারে ক্ষীণ। এখন আর লড়াই করার মত সামর্থ্য নেই বাবার, যদিও দু’জন মানুষের সমান সাহস আছে ওঁর। মেক্সিকান বা ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধ করে মানসিক ভাবে এমনিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ফাইভ কাউন্টিতে বড় হয়েছেন বলে ফিউড কি জিনিস ভাল করেই জানেন। বোঝেন এই রক্তারক্তি ব্যাপার দিনকে দিন চলতে থাকবে, একজন একজন করে খুন হয়ে যাবে, অথচ রাসুলিঙের সমস্যার আশু কোন সমাধান হবে না।
পাঁচ-দশটা গরু একজন মানুষের জীবনের চেয়ে কখনোই বড় হতে পারে না। কিন্তু দুদিন পরপর পাঁচ-দশটা করে গরু চুরি হতে দেখলেও ভাল লাগবে না কারও। গত এক বছরে অন্তত কয়েকশো গরু খোয়া গেছে আমাদের।
বাবার মত আমিও মনে করি রাসলারদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে বরং অন্য কোথাও চলে যাওয়াই শ্রেয়। তাই ট্যাপ এডলে প্রস্তাবটা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিয়েছেন বাবা।
এখানেও ঝুঁকি আছে। রুক্ষ দুর্গম ট্রেইল পাড়ি দিয়ে ছয়শো মাইল যেতে হবে। পদে পদে রয়েছে বিপদের আশঙ্কা। খরা, রোদ আর পানির অভাবে মারা পড়তে পায়ে অসংখ্য গরু, হয়তো দেখা যাবে অর্ধেক পথ যাওয়ার আগেই বেশিরভাগ গরু মারা গেছে। ইন্ডিয়ানদের হাতে খুন হয়ে যেতে পারি আমরা কিংবা আমাদের পাল কেড়ে নিতে পারে ওরা।
আসলে কোন কাজে ঝুঁকি নেই? নিঠুর পশ্চিমে নিঃসঙ্গ ও কঠিন জীবনে অভ্যস্ত মানুষ আমরা, জানি কঠোর পরিশ্রম ছাড়া এখানে কিছু অর্জন করা অসম্ভব; নেহাত একঘেয়ে আর কষ্টকর এই জীবনও আনন্দমুখর হয়ে ওঠে প্রাণের জয়গানে-ক্যাম্পের মামুলি গল্প আর গলা ছেড়ে গাওয়া গান অফুরন্ত প্রাণপ্রবাহ ছড়িয়ে দেয় সবার মধ্যে, ক্লান্তি বা অবসাদ ঘুচিয়ে দেয়, আরও একটা কষ্টকর ও কর্মচঞ্চল দিন কাটানোর উদ্যম যোগায়…স্বপ্ন দেখায়।
আনন্দ নিজে তৈরি করে নেয় পশ্চিমের মানুষ, এখানকার মাটিতেই রয়েছে আনন্দের উৎস। জীবিকার পদ্ধতিও আনন্দ যোগায় মানুষকে। খাবার, পরিধেয় বস্ত্র, বাড়ি, করাল, বার্ন-সবই নিজেরা তৈরি করে নেয়। একসঙ্গে থাকছে এমন সব মানুষ অন্যের সামর্থ্য, সাহস বা সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে।
এটা এমন এক দেশ, যেখানে নিজের ঘোড়ায় নিজেকে ব্ল্যাডল পরাতে হয়, যার সমস্যা তাকেই মোকাবিলা করতে হয়। লড়াই যার যার নিজস্ব। একজন মানুষের বিচার তার কাজে। প্রয়োজনের সময় কাজটা সে করতে পারল কিনা, এতেই তার দক্ষতার বিচার! সাফল্য ব্যর্থতার হিসেব খুব সহজ।
আমি ড্যান ট্রেভেন। কাউহাউস ক্রীকের তীরে এক কেবিনে জন্ম। আমার জন্মের মুহূর্তে আনন্দ করার উপায় ছিল না বাবার, বরং নিজের এবং সবার প্রাণের জন্যে লড়াই করছিলেন তিনি। বাবা আর ফ্রেড চাচা মারকুটে ইন্ডিয়ানদের কোন রকমে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। মা-র জঠর থেকে এই পৃথিবীতে এসে প্রথমে গানপাউডারের কটু গন্ধ নাকে নিয়েছি আমি, শুনেছি বাফেলো গানের কান ফাটানো গর্জন। সন্তান জন্ম দেয়ার আনন্দ নিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন মা, ছেলেকে স্তন্যদান বা মানুষ করার সৌভাগ্য তার হয়নি। মা মারা যাওয়ার পর এক মেক্সিকান মহিলার যত্নে বড় হয়েছি আমি।
আমার যখন ছয় বছর চলছে, ফোর্ট ওঅর্থে বাবার সঙ্গে পরিচয় হয় ট্যাপের মা-র। বিধবা এই মহিলাকে বিয়ে করে পশ্চিমে নিয়ে আসেন বাবা, সঙ্গে ট্যাপও আসে।
যদূর মনে পড়ে সুন্দরী ছিলেন আমার দ্বিতীয় মা। ট্যাপ বা আমার মধ্যে কখনও পার্থক্য করেননি, সাংসারিক কাজেও অনীহা ছিল না ওঁর। কিন্তু কিছুদিন যেতেই পশ্চিমের রুক্ষ জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হলেন বেচারী। সামান্য এক ড্রিফটারের সঙ্গে চলে গিয়ে পশ্চিমকে বিদায় জানান তিনি। সেই থেকে ট্যাপ আমাদেরই একজন।
মা-কে হারিয়ে মোটেও দুঃখী বা বিষাদগ্রস্ত মনে হয়নি ট্যাপকে। সবসময় নিজের ওজন নিয়ে চলাফেরা করত সে, বলা যায় তারও বেশি। ওর আচরণে মনে হত এখানেই জন্মেছে। মাত্র তেরো বছর বয়সে পূর্ণবয়স্ক লোকের কাজ করত, এ নিয়ে অহঙ্কারও করত। একজন যুবক বা তরুণের সঙ্গে বালকের পার্থক্য আসলে দৃষ্টিভঙ্গি বা বড়জোর দায়িত্ববোধের-কোন ছেলে যদি সাফল্যের সঙ্গে পূর্ণবয়স্ক পুরুষের দায়িত্ব পালন করে, এ নিয়ে গর্ব বোধ করার অধিকার আছে তার।
যাই আমরা করি না কেন, বয়সে বড় হওয়ায় নেতৃত্ব বরাবরই ওর হাতে থাকত। স্কুলে পড়ার সময় প্রায়ই মারামারি হত তাগড়া ছেলেদের সঙ্গে; কুলিয়ে উঠতাম না যখন, সবসময় আমার পাশে এসে দাঁড়াত ট্যাপ।
সতেরো বছর বয়সে প্রথম বাড়ি ছাড়ে ও। অ্যারিজোনার বিগ থিকেটের এক আউটফিটে কাজ করার পর বছর খানেক বাদে যখন বাড়ি ফিরে এল, বয়স্কদের মত কোমরে পিস্তল, ঝোলাতে দেখলাম ওকে। অবশ্য ও পৌঁছা’র আগেই গুজব শুনেছি-কেডো লেকের কাছাকাছি এক লোক নাকি খুন হয়েছে ওর হাতে।
এরপর থেকে বাড়ি এলে প্রচুর খাটত ও, কোন কাজে গাফিলতি করত না; নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত, কারও ব্যাপারে কখনও নাক গলাত না-একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট একজন মানুষ যেন। বাবা খুব কমই কথা বলতেন ওর সঙ্গে, মাঝে মধ্যে হয়তো দু’একটা মন্তব্য করতেন বা নির্দেশ দিতেন; মন দিয়ে শুনত ট্যাপ, কিংবা শোনার ভান করত। কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকত সে, এবং প্রতি বছর যখন ফিরে আসত, প্রতিবারই আরও সমর্থ, পোড়-খাওয়া আর দুর্দান্ত মনে হত ওকে।
এবার পাক্কা তিন বছর পর ফিরেছে ট্যাপ। বলা যায় মোক্ষম সময়ে এসেছে-যখন ওকেই সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল আমাদের। বেপরোয়া সেটলারদের উৎপাত চলছে বেসিনে, প্রায়ই গণ্ডগোল হচ্ছে। আরও পশ্চিমে সরে গিয়ে মুক্ত জমি ক্লেইম করার এখনই সময়।
এখানে তেমন কিছুই রেখে যাব না আমরা। একেবারে শুরুতে, বাবা যখন প্রথম..এসেছিলেন, ইন্ডিয়ানদের হামলার ভয়ে কেউই একা থাকার সাহস করত না; কাছাকাছি থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সবাই। তাদের কেউ মারা গেছে, কেউ খুন হয়েছে, কেউ এলাকা ছেড়ে ভেগেছে কিংবা জমি বেচে চলে গেছে। দেশটা এভাবেই বদলে গেছে। আর এখন রেঞ্জের দখল নিয়ে কামড়াকামড়ি লেগে গেছে। পরিস্থিতি এত খারাপ যে হয়তো শিগগিরই লড়াই বেধে যাবে।
নতুন বসতি করতে আসা অনেকেরই নিজস্ব গরু নেই। মাংসের প্রয়োজনে আমাদের গরু জবাই করেছে ওরা। ওদের বাচ্চা আর মহিলারা খিদেয় কষ্ট পাবে, শুধু এ কারণে ব্যাপারটা মেনে নেন বাবা। কিন্তু আরও সাহসী হয়ে উঠল ওরা-সমস্যারও শুরু হলো তখন থেকে শুধু মাংসের চাহিদা মিটিয়ে ক্ষান্ত হয়নি সেটলাররা, বরং গরু সরিয়ে বেচতে শুরু করল।
দু’বার হাতে-নাতে ওদের ধরেছি আমি, গরু ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি; কিন্তু নিরস্ত হবে কি, উল্টো আড়াল থেকে আমার উদ্দেশে কয়েকবার গুলি করেছে ওরা।
দিনকে দিন পশ্চিমে আসছে মানুষ। ভাল-মন্দ সব ধরনের মানুষই আসছে। আগে দেখেছি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করত এরা, নিজের যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকত, কিন্তু আমাদের নতুন প্রতিবেশীরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাতের-আমাদের উপার্জন থেকে নিজেদের জীবিকা নির্বাহের পথটাই যৌক্তিক মনে হয়েছে ওদের কাছে। এভাবেই ঝামেলার শুরু।
একসময় পরিকল্পনা ছিল প্রত্যেকের নিজস্ব জমি থাকবে আমাদের, নির্দিষ্ট সীমানা থাকবে; কিন্তু শুরু থেকে কাউ-হাউসে যেভাবে বসতি করেছে সবাই, তাতে নির্দিষ্ট কারও সীমানা নিরূপণ করা সম্ভব ছিল না। হলোও না।
পশ্চিমে চলে যাওয়ার আলোচনা জোরেসোরে শুরু হলো, এবং তখনই ট্যাপের আগমন। পশ্চিম অর্থাৎ নিউ মেক্সিকোর ওদিক থেকেই এসেছে ও।
খামারের প্রতিবেশি আগ্রহী বাবা, ফসল ফলাতে পারলেই আনন্দ পান, ইদানীং তাই গরুর ব্যাপারে একা আমিই মাথা ঘামাই।
‘মিথ্যে বলব না, যাত্রাটা সত্যিই কঠিন হবে,’ বলছে ট্যাপ। কিন্তু সারা বছরের মধ্যে এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। শিগগিরই যদি যাত্রা করি, তাহলে ট্রেইলে ঘাস আর পানি, দুটোই পর্যাপ্ত পাওয়া যাবে।
‘আর ওখানে পৌঁছলে?’ জানতে চাইল অটম্যান।
‘এত ভাল ঘাস কোথাও দেখিনি আমি। আর পানির কথা কি বলব! নিউ মেক্সিকোর পেকোস অঞ্চলে থামতে পারি আমরা, কিংবা কলোরাডোয় চলে গেলেও অসুবিধে নেই’।
তুমি কি করতে বলো? অটম্যান সাবধানী মানুষ, প্রশ্নটা করার সময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ট্যাপের দিকে।
আমি পেকোসের ধারে-কাছে বসতি করার পক্ষে। বস্ক রেডোন্ডো নামে একটা পাহাড়ী উপত্যকা আছে। ওখানে বসতি করাই ঠিক হবে।
আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ইলেন অটম্যান, ট্যাপের ওপর স্থির হয়ে আছে ওর অনুসন্ধানী দৃষ্টি। দারুণ ব্যাপার, তাই না? মুগ্ধ স্বরে জানতে চাইল মেয়েটা। ও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে বলে সত্যিই খুশি হয়েছি আমি।
এই প্রথম, সামান্য হলেও ঈর্ষা বোধ করলাম। যদিও সেটা খুবই ক্ষীণ, কারণ আমি নিজেও ট্যাপ এডলের ভক্ত, ওকে পছন্দ করি, সমীহের চোখে দেখি। সম্ভবত ইলেনের দৃষ্টিভঙ্গিও অনেকটা আমারই মত।
ট্যাপ এডলে অবশ্যই ভিন্ন ধাতের মানুষ-সব বিচারেই। দামী কাপড় ওর পরনে, এত দামী কাপড় কেনার সামর্থ্য আমাদের নেই। দারুণ সুন্দর একটা চেস্টনাট ঘোড়ার মালিক, স্যাডলটাও কারুকাজ করা-এই প্রথম দেখলাম এমন জিনিস। সবচেয়ে বড় কথা, সবকিছুতে নিজস্ব ধরন আছে ওর, সবার চেয়ে সে যে আলাদা, বুঝিয়ে দিতে কখনও কার্পণ্য করে না ট্যাপ।
ট্যাপ আত্মবিশ্বাসী মানুষ। নিজের সম্পর্কে নিশ্চিত। ওর চলাফেরায় এক ধরনের দৃঢ়তা রয়েছে যা আমাদের নেই। কখনোই অনিশ্চয়তায় ভোগে না সে, নিজের প্রত্যাশা বা চাহিদা সম্পর্কে সচেতন এবং জানে সেটা কিভাবে পেতে হবে। মাঝে মধ্যে আমার মনে হয়-সেজন্যে ক্ষীণ অপরাধবোধও হয় যে হয়তো ভুল করছি-অন্যদের ভাবনা বা অনুভূতি সম্পর্কে মোটেই পরোয়া করে না সে। সবকিছুর পরও, যে-যাত্রার পরিকল্পনা করেছি আমরা, সঙ্গী বা গাইড হিসেবে ট্যাপের তুলনা হয় না।
ইলেনের ব্যাপারটা ভিন্ন। মাঝে মধ্যে হাঁটতে বেরিয়ে গল্প করেছি আমরা, কয়েকবার রাইডও করেছি একসঙ্গে। পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া আছে আমাদের, তা বলা যাবে না; কিন্তু এ কথা সত্যি যে চৌহদ্দিতে ও-ই সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। টেক্সাসের এই পাহাড়ী অঞ্চলে ইলেন অটম্যান যে অনেকেরই কাঙিক্ষতা তাতে কোন সন্দেহ নেই।
টিম অটম্যানের তিন সন্তানের মধ্যে ও-ই বড়। অন্য দুজন ছেলে-একজনের চোদ্দ চলছে, অন্যজনের দশ।
দৃশ্যত, ট্যাপের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে ইলেন। সম্ভবত ট্যাপও। মেয়েদের ব্যাপারে শুধু আগ্রহী নয়, রীতিমত সিরিয়াস ও, অনায়াসে মানিয়ে নিতে পারে যে-কোন মেয়ের সঙ্গে; ঠিক ঠিক পটিয়ে ফেলে।
ঘুরে আমার দিকে তাকালেন বাবা। এদিকে এসো, ড্যান। তোমার পরামর্শ দরকার আমাদের।
আমি দু’পা এগোতেই হেসে উঠল ট্যাপ, সবল, ভারী একটা হাত রাখল আমার কাঁধে, তবে কথা বলল, বাবার সঙ্গে: কি ব্যাপার, ট্রভেন? বাচ্চাদের পরামর্শ নেয়া শুরু করলে কবে থেকে?
ট্যাপের কণ্ঠে ক্ষীণ তাচ্ছিল্য থাকলেও গ্রাহ্য করলেন না বাবা। মানুষটা তিনি এমনই। দরকার না পড়লে, সাধারণত তর্ক এড়িয়ে যান। গরুর ব্যাপারে আমার চেনা যে-কোন লোকের চেয়ে ড্যানের জ্ঞান অনেক বেশি, শান্ত, মৃদু স্বরে উত্তর দিলেন তিনি। এবং এই ড্রাইভও নতুন নয় ওর কাছে।
তাই? সন্দিহান সুরে জানতে চাইল ট্যাপ, বিস্মিত। সত্যি ট্রেইল, ড্রাইভে গেছ?
হ্যাঁ। গত বছর বেক্সটার স্প্রিং হয়ে এক পাল গরু নিয়ে ইলিনয়সে গেছি।
বেক্সটার স্প্রিং? দাঁত কেলিয়ে হাসল সে। নিশ্চই গন্তব্যে পৌঁছার আগেই অর্ধেক গরু খুইয়েছ? বেক্সটার স্প্রিংয়ের আশপাশের বেয়াড়া আউটলদের সম্পর্কে জানি আমি।
উঁহু, ড্যানের পালের ক্ষতি করতে পারেনি ওরা, জানাল অটম্যান। সব গরু নিয়ে বহাল তবিয়তে ইলিনয়সে পৌঁছেছে ও, ভাল দামে বেচেছে।
দারুণ! আমার কাঁধে চাপ দিল ট্যাপ। পুরানো দিনের মত, দু’জনে মিলে অজেয় টীম হব আমরা, তাই না, বয়? আহ্, বাড়ি ফিরে এসে সত্যিই কাজের কাজ করেছি! ঘাড় ফিরিয়ে করালের দিকে তাকাল সে, ইলেন দাড়িয়ে আছে ওখানে। হঠাৎ বলল: তো, তোমরা জানো কি কি দরকার হবে আমাদের। সবকিছু গোছগাছ হলে ড্রাইভের দায়িত্ব নেব আমি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে রেইলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ইলেনের কাছে চলে গেল ও। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল টিম অটম্যান। মুখ যতই নির্বিকার দেখাক, বহুদিন ধরে তাকে চিনি আমি, জানি ব্যাপারটা অনুমোদন করছে না সে। মিনিট খানেক পর, আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল অটম্যান। অন্যরাও একে একে সরে পড়তে শুরু করল। কেবল আমি আর বাবাই রয়ে গেলাম।
ট্যাপ তো ফিরে এল। কেমন দেখলে ওকে?
ভালই হয়েছে ও আসায়। পানির উৎসগুলো চেনা আছে ওর, ক্রু হিসেবেও দক্ষ ট্যাপ। বিশ্বাস করো; বাবা, ড্রাইভের সময় প্রতিটি লোকের সাহায্য দরকার হরে আমাদের।
হ্যাঁ, হবে, চিন্তিত স্বরে বললেন বাবা, দেখে মনে হলো আরও কিছু বলবেন।
বাবা গম্ভীর প্রকতির মানুষ, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতে অনভ্যস্ত। জানি আরও কিছু বলার থাকলে, শিগগিরই বলবেন। কোন একটা বিষয়ে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে ওঁকে, ভুরু কুঁচকে ভাবছেন কি যেন। মিনিট খানেক পর, হঠাৎ জানতে চাইলেন: এলসির কথা মনে আছে তোমার, ড্যান?
এলসি এডলে ট্যাপের মা। খুব মনে আছে ওঁকে। আসল মা-কে কখনও দেখিনি আমি, এলসি এডলেকেই মা বলে জানতাম। অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক হলেও সত্যি, কখনও সত্যিকার মা বলে মনে হয়নি ওঁকে…আমাদের বাড়িতে অতিথি মনে হত ওঁকে, যেন, কিছুদিন থাকবেন আমাদের সঙ্গে, তারপর চলে যাবেন নিজের পথে। তবে ট্যাপ বা আমার প্রতি কখনও অবহেলা করেননি মহিলা; এবং এতদিন পরও, নিশ্চিত বলতে পারি, আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে নিশ্চয়ই অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছেন।
হ্যাঁ, মনে আছে।
পশ্চিমে টিকে থাকার মানসিকতা ছিল না…আসলে পশ্চিমে আসাই ঠিক হয়নি ওর।
আমি প্রায়ই ভাবতাম কেন পশ্চিমে এসেছিলেন উনি। সুন্দরী ছিলেন, হাল ফ্যাশনের কাপড় পরতে আর আয়েশী জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। হয়তো পুবে থাকলেই সুখী হতেন।
চরিত্রই আসল, ড্যান…সেটা ঘোড়া, কুকুর, পুরুষ কিংবা মেয়েমানুষই হো।।
আর কিছু না বলে সরে গেলেন বাবা।
ঘোড়া নিয়ে করালের কাছে চলে এলাম। স্যাডল-ব্রিডল খুলে করাল-বারের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলাম। বাবার শেষ কথাটা মনে মনে উল্টে-পাল্টে দেখলাম, কেবলই মনে হচ্ছে গভীর কোন তাৎপর্য আছে। বাবার ধাতই এমন, মুখে যতটা বলেন তারচেয়ে বেশি চেপে যান-উহ্য থেকে যায়। বারবারই ভাবছি ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন তিনি।
আসন্ন ড্রাইভের প্রাক্কালে এ নিয়ে বা অন্য কোন বিষয়ে ভাবার সুযোগ আসলে নেই।
বসন্থ এখন…দারুণ গরম্। খরা চলছে। শীতের সময় বেশ কয়েকবারই বৃষ্টি হয়েছে, হর্সহেড ক্রসিং হয়ে পেকোস অঞ্চলের ট্রেইলে পর্যাপ্ত পানি থাকার কথা।
করাল-রেইলের.. সঙ্গে হেলান দিয়ে ড্রাইভে আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা বিচার করছি। আশপাশে কোথাও আছে ইলেন আর ট্যাপ, কিন্তু এ মুহূর্তে কেবল ঘোড়ার ব্যাপারে ভাবছি আমি। অন্তত পঞ্চাশ ষাটটা ঘোড়া দরকার হবে। টিম অটম্যান এবং রাস্টি বুচার্ডের সব ঘোড়া সহ, সব মিলিয়ে হয়তো ত্রিশটা হবে, তারমানে অন্তত বিশটা ঘোড়র ঘাটতি থেকে যাবে।
দুটো ওয়্যাগন আর হার্নেস মেরামত করতে হবে। কোমাঞ্চিদের হামলা ঠেকাতে প্রচুর কার্তুজ দরকার হবে। পানি জমিয়ে রাখার জন্যে আরও কয়েকটা ব্যারেল দরকার।
আমার পাশে এসে দাঁড়াল কার্ল ক্ৰকেট, রোল করা সিগারেট কুঁকছে। মেক্সিকানদের অভ্যাস এটা, তবে অনেক টেক্সানও দেখাদেখি অভ্যাসটা রপ্ত করে নিয়েছে। আমাদের বেশিরভাগই সিগার টানতে অভ্যন্ত।
তাহলে ও-ই ট্যাপ এডলে, অস্বাভাবিক সোজাসাপ্টা স্বরে বলল কার্ল।
ওর দিকে তাকালাম। অনেক দিন ধরে চিনি বলেই জানি যখন এভাবে কথা বলে, হয় অসন্তষ্ট নয়তো বিরক্ত ও। একটা ব্যাপার পরিষ্কার: ট্যাপ এডলেকে পছন্দ হয়নি ওর। অথচ আমি চাই পরস্পরকে পছন্দ করুক ওরা।
ছোটবেলায় একসঙ্গে বহুদিন কেটেছে আমাদের, কার্ল। আমার সৎ ভাই ও।
শুনেছি।
ওর মা চলে যাওয়ার পর, বাবা ওকে থাকতে দিয়েছেন। আপন সন্তানের মতই দেখেছেন।
ইয়ার্ড বরাবর ওপাশে তাকাল কার্ল। ইলেন আর ট্যাপের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, হাসছে ওরা।
মা-র সঙ্গে কি কখনও দেখা হয়েছে ওর?
যতদূর জানি কখনও দেখা হয়নি।
পিস্তলটা দারুণ মানিয়েছে ওকে, তাই না?
হ্যাঁ…এবং জিনিসটা চালাতে পারে ট্যাপ।
সিগারেটে শেষ টান মেরে দু’আঙুলে ছুঁড়ে মারল সে। সাহায্য দরকার হলে জানিয়ো আমাকে। …আরও ঘোড়া দরকার হবে তোমার।
আশপাশে বুনো ঘোড়া চোখে পড়েছে নাকি?
লিয়ন নদীর কাছাকাছি দেখেছি। ধরার চেষ্টা করবে?
বুনো ঘোড়া ধরে পোষ মানানোর ক্ষেত্রে কার্ল ক্রকেটের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ঘোড়া-শিকারী বলে সুনাম আছে ওর। কিন্তু ঘোড়া ধরে পোষ মানাতে অনেক সময় লাগবে। অত সময় নেই আমাদের অনেক আগেই ড্রাইভে যাত্রা করা উচিত ছিল।
কার্ল কখনও কারও অধীনে কাজ করেনি। স্বাধীনচেতা মানুষ। দরকার পড়লে সাহায্য করে আমাদের, পাঞ্চার হিসেবে টপহ্যান্ড, অথচ বিনিময়ে একটা ডলারও নেবে না। ব্যাপারটা দুর্বোধ্য, কিন্তু কেউই কৌতূহল প্রকাশ করেনি। কারণ টেক্সাসে কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করে না লোকজন। যার যার দৃষ্টিভঙ্গি বা ব্যক্তিগত বিষয় একেবারেই তার নিজস্ব।
টম জেপসনকে দলে ভেড়াতে পারলে ভাল হত, চিন্তিত সুরে বললাম আমি। বেশ কিছু ঘোড়া আছে ওর। ওকে ড্রাইভে নিতে পারলে উপকার হবে আমাদের।
তোমার কাছ থেকে প্রস্তাব পেলে খুশি হয়েই যোগ দেবে ও
জেপসন। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। ওর র্যাঞ্চের অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল। এত ভাল জায়গা ছেড়ে যাবে কেন ও?
হয়তো রোজিটার কারণে।
হ্যাঁ, এটা একটা সম্ভাবনা বটে। টম জেপসনের জায়গাটা ছোট, তবে যে-কোন বিচারে বেসিনের সেরা জায়গা। রেঞ্জের সব গরু হৃষ্টপুষ্ট। রোজিটার জন্যে হলেও এ জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া স্রেফ বোকামি হবে, কারণ পরিণতিতে সবকিছু হারানোর আশঙ্কা রয়েছে টমের। রোজিটা জেপসন সুন্দরী এবং কাক্ষিতা, স্ত্রী হিসেবেও গুণী, কিন্তু অন্য পুরুষের প্রতি ওর আকর্ষণ কখনও কমবার নয়। সবচেয়ে খারাপ ব্যবহার হচ্ছে, পুরুষদের চোখ আটকে রাখার মত সবকিছুই আছে ওর, এবং রোজিটা নিজেও এ ব্যাপারে দারুণ সচেতন।
কোন একদিন ওর কারণে মারা পড়বে কেউ।
সেক্ষেত্রে টমই মারা পড়বে।
সিধে হলো কার্ল। সূর্য ওঠার আগেই চলে আসব আমি। কমবয়েসী গরু রাউন্ড-আপ করব দুজনে মিলে। কুকুরগুলোকে নিয়ে আসব সঙ্গে।
গরু দাবড়ানোয় দক্ষ কয়েকটা কুকুর আছে ওর..ব্রাশ-পপিঙে বা ঝোঁপঝাড় তল্লাশির সময় একেকটা তিনজন কাউহ্যান্ডের সমান কাজ করতে সক্ষম।
ঘোড়ার কাছে গিয়ে স্যাডিলে চাপল, কার্ল ক্ৰকেট। সমীহ আর নীরব বিস্ময় নিয়ে ওকে স্যাড়লে চড়তে দেখলাম। এই দৃশ্যটা শতবার দেখেছি, কিন্তু কখনোই একঘেয়ে বা বিরক্তিকর লাগে না। এত অনায়াসে, নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে স্যাডলে চড়ে ও, দেখে বিশ্বাসই হয় না। মানুষ হিসেবে কার্ল কর্মঠ, বিশ্বস্ত এবং দায়িত্বশীল; যে-কেউ আনন্দ পাবে ওর সঙ্গে কাজ করে। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সারা জীবনে ওর মত নির্ভরযোগ্য সহকর্মী পাইনি আমি।
করালের পাশ দিয়ে ঘুরপথে এগোল ও, যাতে ট্যাপ এডলেকে পাশ কাটিয়ে যেতে না হয়। কার্ল মোড় ঘুরতে মুখ তুলে সেদিকে তাকাল ট্যাপ।
ব্যাপারটা ট্যাপও ধরতে পেরেছে, কারণ সহজ পথ অর্থাৎ বাড়ির সামনে দিয়ে না গিয়ে বেশ খানিকটা ঘুরে করালের পাশ দিয়ে যাচ্ছে কার্ল ক্ৰকেট। স্থির দৃষ্টিতে তাকে যেতে দেখল ট্যাপ, দৃষ্টিপথে ইলেনের বাধা এড়ানোর জন্যে দু’পা পাশে সরে গেল।
বাড়ি থেকে খাবারের সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। মিসেস অটম্যানের রান্না সত্যিই ভাল।
বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখলাম ইলেন আর ট্যাপ কথা বলছে এখনও। ট্যাপের নিচু স্বরের কি,একটা কথায় সহাস্যে মাথা নাড়ল ইলেন। বুঝলাম স্বল্প সময়ের মধ্যেই ইলেনকে পটিয়ে ফেলেছে, ট্যাপ, ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু এবং স্পর্শকাতর মনে হলো আমার কাছে। যত যাই হোক, ইলেনকে পছন্দ করি আমি, এবং সবাই জানে সেটা।
মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল ট্যাপ, কিন্তু কথা বলল ইলেনের সঙ্গে। কি জানো, ইলেন, আমি ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছি না আমাদের ছোট্ট ড্যান তাগড়া জোয়ান হয়ে গেছে। অথচ এই কদিন আগেও দুধের বাচ্চার মত আমার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াত ও।
খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ল ইলেন।
অনুভব করলাম নাকে-মুখে রক্ত উঠে এসেছে আমার। উঁহু, সব জায়গায় তোমার পিছু লেগে থাকতাম না আমি, ট্যাপ। মনে আছে, সেবার ব্রাজোসে তোমার পিছু পিছু যাইনি?
যেন চড় খেয়েছে, মুখটা বেদান হয়ে গেল ট্যাপের। কড়া কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু তার আগেই ওর আস্তিনে হাত রাখল ইলেন। তোমরা তো পুরানো বন্ধু…ভাইও বলা চলে। উঁহু, অযথা তর্ক করার দরকার নেই।
ঠিকই বলেছ, ইলেন, বলে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লাম আমি।
দরজায় আমাকে দেখে চোখ তুলে তাকাল মিসেস অটম্যান, তারপর আমাকে ছাড়িয়ে গেল মহিলার দৃষ্টি-ইলেন আর ট্যাপকে দেখল। তোমার ভাই তো বেশ সুদর্শন, হালকা সুরে বললেও বলার ঢঙে মনে হলো এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বেশ গভীর।
পরের তিনদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বেগার খাটলাম আমরা। ট্যাপ, কার্ল, রাস্টি এবং আমি ঝোঁপঝাড়ে ছড়িয়ে থাকা কমবয়েসী গরু রাউন্ড-আপ করলাম। এদিকে টম জেপসনের সঙ্গে কথা বলার জন্যে গেছেন বাবা। দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ওয়্যাগন মেরামত করল টিম অটম্যান।
ক্রীকের ধারে ঝোঁপঝাড় আর বুনো লতাপাতায় ঘেরা কিছু গুহা আছে। গুহার কারণেই জায়গাটার নাম কাউ-হাউস। গরু খেদানোর সময় দারুণ কাজে এল কুকুরগুলো। দশজন কাউহ্যান্ডের কাজ কমিয়ে দিয়েছে ওরা।
স্যান এন্টোনিয়োয় ছোটখাট একটা পাল নিয়ে গিয়েছিল জেফ মুর, বেন টিল্টন আর চার্লি হীখ। ফিরে এসে আমাদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছে ওরা। বেশ দ্রুত এগিয়ে চলল রাউন্ড-আপের কাজ।
সুযোগ পেলেই পশ্চিমে যাওয়ার ট্রেইল সম্পর্কে ট্যাপকে জিজ্ঞেস করেছি আমি। ক্যান্সাস-মিসৌরি হয়ে ইলিনয়সের ড্রাইভে গিয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। কিন্তু ওটা তুলনামূলক সহজ ট্রেইল।
কর্ন পেষা বেশ ঝক্কির কাজ। বিরক্তিকর এবং একঘেয়েও বটে। দুই যাতার একটা কর্নমিল আছে আমাদের। কর্ন থেকে ময়লা বানাতে হলে অন্তত দু’বার পিষতে হবে। কাজটা আয়াসসাধ্য বলে পুরুষদেরই করতে হলো।
ড্রাইভে যাত্রা করার আগে যতটা সম্ভব কর্ন পিষে ময়দা তৈরি করে নিতে চাই আমরা। কারণ যাত্রাপথে হয়তো কর্নমিল ব্যরহার করার সুযোগ হবে না। কর্ন পেষার পাশাপাশি মাংসের জার্কি তৈরির কাজও চলছে পুরোদমে। কারোই দম ফেলার সুযোগ নেই।
কেনা কাপড় পরার দিন ছিল না তখন। আমরাও ঘরে তৈরি সুতীর কিংবা বাকস্কিনের কাপড় পরতাম। যার যার কাপড় তার নিজেরই তৈরি করে নিতে হত। শার্টের আস্তিন বা ট্রাউজারের হাঁটুতে থাকত সরু ঝালর, পানি যাতে দ্রুত সরে যায়। পুবের বেশির ভাগ লোক মনে করে এসব ঝালর মূলত বাহারের জন্যে। আসলে মোটেই তা নয়।
ঘরে তৈরি সব কাপড়ই সুতী বা উলের। লেই বসিয়ে পরে হাতে বুনতে হয়, সুতার ক্ষেত্রে বীজও আলাদা করতে হয়। সবাই যার যার মোকাসিন বা বুট তৈরি করে নেয়, অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি মেরামতের ক্ষেত্রেও তাই; কখনও কখনও একেবারে কাঁচামাল থেকে তৈরি করতে হয়।
কাউ-হাউসের কাছাকাছি ঝোঁপঝাড়ে ঘেরা জায়গাটার বাতাস গুমট। আঁকাবাঁকা ক্ৰীকের উঁচু তীরে গুহাগুলোর অবস্থান। ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে থাকে, গরুগুলো। কাজটা কঠিন, ভাপসা গরমে অতিষ্ঠ হওয়ার দশ, আর অপরিসর জায়গা বলে দড়িও ব্যবহার করা যায় না।
বিশাল একটা ডোরাকাটা বলদ গাছের ফাঁকে ঢুকে পড়ল হঠাৎ, এস্তা হরিণীর মত ছুটতে শুরু করল। পিছু নিয়েছে আমার স্টিলডাস্ট গেল্ডিং। ধেয়ে আসা বড়সড় একটা ডাল এড়িয়ে গেলাম মাথা নিচু করে, কিন্তু ছোট একটা সপাটে আঘাত করল মুখে; সঙ্গে সঙ্গে চোখে পানি চলে এল। ছয় ফুট উঁচু ঝোঁপের দিকে ছুটছে বলদটা, স্টিলডাস্টও পিছু ছাড়ছে না। মাথা নিচু করে এগোচ্ছি আমি, তারপরও নাকে-মুখে গাছের ছোট ছোট শাখার সংঘর্ষ হচ্ছে, কাঁটা বিঁধছে চ্যাপসে। ঝোঁপের ওপাশে খোলা জায়গায় একটা ল্যারিয়েট বের করে ছুঁড়ে দিলাম। বলদের শিঙে মালার মত জড়িয়ে গেল ফাসটা।
এবার প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল ওটা, কোন কিছুরই পরোয়া করছে না। কিন্তু ঘোড়ার কৌশল আর শক্তির কাছে হার মানতে হলো ওটাকে। দুটো চক্কর খাইয়ে মাটিতে আছড়ে ফেললাম বলদটাকে। মুহূর্ত খানেক মাত্র, ঝট করে উঠে দাঁড়াল ওটা, ছুটে এসে মারমুখী আক্রমণ চালাল, বলদটা বিশাল, যোলো হাতের চেয়েও বেশি উঁচু হবে, ওজন অন্তত আঠারোশো পাউন্ড•••এ মুহূর্তে দারুণ খেপে গেছে।
মাথা নিচু করে ছুটে এল ওটা। শেষ মুহূর্তে পাশ কাটিয়ে গেল স্টিলডাস্ট। আর মি. বলদ প্রপাত ধরণীতল! ভারসাম্য হারিয়ে ধুলোয় আছড়ে পড়ল ওটা।
সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল বলদটা সারা শরীর কাঁপছে, রক্ত লাল চোখে তাকাল চারপাশে। এ মুহূর্তে, এতই খেপে আছে যে সামনে যাই পড়বে, সেটার সঙ্গে লড়াই করবে। কিন্তু কোন সুযোগ দিলাম না ওটাকে। ঘোড়াকে তুমুল বেগে ছুটিয়ে দিলাম। দড়িতে টান পড়তে পিছু পিছু ছুটতে বাধ্য হলো ওটা।
খোলা জায়গায় পালের কাছে আসার পর দড়িতে ঢিল দিলাম। ছোটাছুটিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বলদটা, লড়াই করার খায়েশও মিটে গেছে। বাঁধন খুলে দিতে গরুর দলে ভিড়ে গেল ওটা।
রাউন্ড-আপ মানেই অমানুষিক খাটুনি। গরম, ঘাম বা ধুলোর অত্যাচারের মধ্যে বেয়াড়া বলদের পেছনে পাল্লা দিয়ে ছুটতে হয়, ঘোড়াগুলোর নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। একটা একটা করে বলদকে ঝোঁপ থেকে বের করে আনছি আমরা, খোলা জায়গায় এনে করালে আটকে রাখছি। বুড়ো কয়েকটা মসিহর্ন অবশ্য তেমন সমস্যা করছে না। অন্য গরুর সঙ্গে থাকতে পারলেই সন্তুষ্ট এরা, জায়গা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
ডোরাকাটা বলদটা ঝোপে ফিরে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে, কাউ হাউসে নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে। ওটাকে খেদিয়ে অন্য গরুর সঙ্গে ভিড়ে থাকতে বাধ্য করলাম।
পিস্তলবাজ হোক আর ভবঘুরে হোক, রাউন্ড-আপ বা পাঞ্চিঙে ট্যাপ সত্যিই দক্ষ। আমাদের যে-কারও সমান খাটছে ও।
পুবাকাশে ফ্যাকাসে আভা দেখা দেওয়ার আগেই বেডরোল ছেড়ে উঠে পড়ি আমরা, সূর্য উঠতে উঠতে চলে যাই ঝোঁপঝাড়ের গভীরে। একদিনে তিন-চারটে ঘোড়া বদল করি প্রত্যেকে, কিন্তু লোকের বদল হয় না কখনও। মটরশুটি আর মাংস জোটে সকালের নাস্তায়; দুপুরেও তাই; মহিলারা যদি খোশমেজাজে থাকে তাহলে রাতে কেক বা সরগ্যাম জোটে-কর্ন থেকে তৈরি হয় জিনিসটা।
তৃতীয়দিন সকাল হলো ধূসর আকাশে মেঘে ছেয়ে, কিন্তু কেউই খেয়াল করিনি আমরা। দুটো দিন হাড়ভাঙা খাটুনি গেছে, অথচ হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। সাধারণত বাড়িতে ঘুমই আমি। টেক্সাস হাউজের একটা অংশে বাবা আর আমি থাকি, অন্য পাশে অটম্যানরা থাকে। বুচার্ডের বউ-বাচ্চাদের জন্যে দুটো কামরা ছেড়ে দিয়েছি আমরা, বাইরে অন্যদের সঙ্গে থাকছি দু’দিন ধরে।
বেডরোল গুটিয়ে মাথায় হ্যাট চাপালাম। কাউহ্যান্ডরা ঘুম থেকে উঠে সবার আগে হ্যাট চাপায় মাথায়। তারপর পায়ে বুট গলিয়ে দিলাম।
মেয়েরাও উঠে গেছে। রান্নাঘর থেকে বাসন-কোসনের শব্দ আসছে। বেড়রোল ছেড়ে পানির কলের কাছে চলে গেল ট্যাপ, একটা বালতিতে পানি ভরে হাত-মুখ ধুলো। আমিও পরিষ্কার হয়ে নিলাম। খেয়াল করলাম বরাবরের মতই মেজাজ খিচড়ে আছে ওর-সকালে যা হয়–আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা ভিন্নরকম-সকাল সবসময় সুন্দর, সতেজ এবং একটা দিনের শুরু। শুভ মুহূর্ত। তবে এ নিয়ে ওর সঙ্গে তর্ক করার ইচেছ নেই।
বাড়িতে ঢুকলাম নাস্তা করার জন্যে। আজকের আয়োজন ভিন্ন-মাংস আর মটরশুটি ছাড়াও ফ্রায়েড পেঁয়াজ রয়েছে।
সঙ্গে সর্বক্ষণ ব্রিডল রাখি আমি, জ্যাকেটের ভেতরে পুরে রাখি যাতে খানিকটা উষ্ণ থাকে ওটা। ঠাণ্ডা বা বৃষ্টির দিনে আগুনে খানিক সেঁকে নিই, তাহলে ব্রিডল পরার সময় চমকে ওঠে না ঘোড়া। আজ অবশ্য তেমন ঠাণ্ডা পড়ছে না, তবুও সাতসকালে যাতে ঘোড়ার মুড খারাপ হয়ে না যায়, সেজন্যে জ্যাকেটের ভেতরে রেখেছি ওটা। ঘোড়ার মতিগতির ওপর সারাদিনে কাউহ্যান্ডদের কাজ নির্ভর করে অনেকাংশে।
অবশ্য এমনিতেও খোশমেজাজে থাকবে না ঘোড়াটা..কখনও ছিলও না।
দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেয় বসে পড়েছি আমরা। ইলেন খাবার পরিবেশন করছে। সামনে এসে বড়সড় বাটি থেকে থালায়, খাবার তুলে দিচ্ছে। ট্যাপের থালায় খাবার তুলে দিতে একটু বেশি সময়ই যেন লাগল ওর।
নীরবে খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেললাম আমরা। শেষে আমার পাশে চলে এল কার্ল, সিগারেট রোল করার সময় জানতে চাইল: কখনও লিয়নের ওদিকে গেছ?
না।
আমি আর তুমি যাব…একটু চক্কর দিয়ে আসি। কি বলো?
কিন্তু এখানে তো অনেক কাজ! ওখানে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে তো…।
আমি যাব, মাঝখানে বলে উঠল ট্যাপ। ও কি বলতে চাইছে জানি আমি।
কাগজের কিনারায় জিভ চালিয়ে ভিজিয়ে নিল কার্ল। কি মনে হয়, অন্যমনস্ক সুরে জানতে চাইল সে। গরু নিয়ে আমাদের চলে যেতে দেবে ওরা?
গরুগুলো তো আমাদের, তাই না?
অবশ্যই। হয়তো সারা রেঞ্জ চষে বেড়ালে ওদের দু’একটা গরু পাওয়া যাবে। অথচ প্রথম থেকেই তোমাদের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে ওরা। কিন্তু এখন ওরা জেনে গেছে ড্রাইভের পরিকল্পনা করছ তোমরা, ঝোঁপঝাড় থেকে সব গরু রাউন্ড-আপ করছ।
তো?
ড্যান, হয়েছে কি তোমার, বলো তো? ত্যক্ত স্বরে জানতে চাইল ট্যাপ। বুঝতে পারছ না পারলে প্রতিটা গরু চুরি করবে ওরা, আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে প্রয়োজনে লড়াইও করবে? আচ্ছা, ক’জন লোক আছে আমাদের?
এখন? নয়-দশজন হবে হয়তো।
ওরা ক’জন? ত্রিশজন তো হবেই।
চল্লিশের কাছাকাছি, শুধরে দিল কার্ল। লিয়নের তীরে প্রচুর ট্র্যাক দেখলাম। আমাদের চেয়েও দ্রুত রাউন্ড-আপ করছে ওরা, উত্তরের বুনো এলাকায় গরু সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তাহলে আগে বরং ওগুলো ফিরিয়ে আনাই উচিত।
উঠে দাঁড়াল ট্যাপ দেরি করা ঠিক হবে না, শুকনো স্বরে বলল সে, তারপর আমার দিকে ফিরল। পিস্তল নেই তোমার? থাকলে সঙ্গে নাও। দরকার পড়বে।
যুক্তি আছে ওর কথায়। যাদের নিয়ে আলাপ করছি আমরা, কিছু রুগ্ন চেহারার ঘোড়া আর লক্কড়ঝক্কড় মার্কা ওয়্যাগন নিয়ে এখানে এসেছিল ওরা। দু’একজনের গাভী ছিল..অথচ দিব্যি চলে গেছে। ওদের। আমাদের গরু জবাই করে মাংসের চাহিদা মিটিয়েছে, তারপর বিক্রিও করেছে। রেঞ্জের উন্নয়নে সামান্য ভূমিকাও নেই ওদের কারও। দক্ষিণ আর পুবের কোন এলাকা থেকে এসেছে ওরা-অলস কিন্তু দারুণ সুযোগসন্ধানী অকৃতজ্ঞ কিছু মানুষ।
পেছনে তিক্ত অতীত ফেলে এসেছে ওরা। কেউ এসেছে মিসৌরী বা আরক্যান্সাস থেকে, কারও আদি নিবাস ফাইভ কাউন্টি, যেখানে বহু বছর ধরে রক্তক্ষয়ী ফিউড লেগে আছে। বাবা নির্বিরোধী শান্তিপ্রিয় লোক বলেই এ ব্যাপারে কখনও কঠিন হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি; তাতেই বাড় বেড়েছে ওদের। উদারতা আর সহানুভূতিকে দুর্বলতা মনে করেছে।
বাবাকে কিছু বলার দরকার নেই, বললাম আমি। অস্ত্রও আগের মত চালাতে পারেন না।
আড়চোখে আমার দিকে তাকাল ট্যাপ, যেন বলতে চাইছে, তুমিও কি চালাতে পারো নাকি? ব্যাপারটা গ্রাহ্য করলাম না। কারও ক্ষমতা সম্পর্কে অন্যরা সন্দিহান হলে তার ক্ষমতা বাড়ে-কমে না। প্রয়োজনের সময়ে সেটা প্রমাণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমাদের গোছগাছ করতে দেখে এগিয়ে এল টিম অটম্যান। এই এক লোক, কোন কিছুই ওর চোখ এড়ায় না। কিভাবে যেন জেনে যায়, অথচ সাধারণত নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে। কারও ব্যাপারে নাক গলায় না, কিন্তু চোখ-কান সর্বক্ষণ সজাগ রাখে। সতর্ক থেকো, ছেলেরা, সংক্ষেপে শুধু এই বলল অটম্যান।
রওনা দেয়ার আগে বেন টিল্টনের সঙ্গে কথা বললাম, নির্দেশ দিলাম অন্যদের যেন কাউ-হাউসের আশপাশে ব্যস্ত রাখে। প্রায় সবাই জানে একটা কিছু ঘটবে, বা ঘটতে যাচ্ছে; কিন্তু কেউই এ নিয়ে মন্তব্য করল না।
প্রথমে পশ্চিমে এগিয়েও দিক বদলে পরে উত্তরে এগোলাম আমরা।
কারা ওরা; জানো তুমি? কার্লকে জিজ্ঞেস করলাম।
হর্নার আউটফিট। ম্যাক, বিলি আর ওয়েব। সাঙ্গপাঙ্গের অভাব নেই ওদের। যত সব হারামখেকোর দল এসে জুটেছে কাউ-হাউসে!
নীচ কিন্তু কঠিন বেপরোয়া লোক ওরা। বিতাড়িত মানুষ সাধারণত ধাক্কা খেতে পছন্দ করে না। এরা তারচেয়েও খারাপ। নোংরা, জঘন্য গরু চোর আর খুনী। বেশ কয়েকবারই রেঞ্জে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি ওদের কয়েকজনকে।
ওয়েব লোকটা বাঁ-হাতি, বললাম আমি।
ঝট করে আমার দিকে তাকাল ট্যাপ। তো, একটা তথ্য বটে! জরুরী খবর।
পিস্তল উল্টো করে ডান দিকে ঝোলায় ও, বাঁট সামনের দিকে থাকে। প্রয়োজনে দু’হাতেই ড্র করতে পারে।
লিয়ন নদীর কাছাকাছি গিরিখাতে ওদের ট্রেইল খুঁজে পেলাম। অনুসরণ করতে সমস্যা হচ্ছে না। প্রায় বিশটা গরু তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওরা-দু জন মানুষ। একেবারে সহজে এগোচ্ছি, কারণ ট্র্যাক লুকানোর কোন চেষ্টাই করেনি ওরা; বরং যেন চাইছে ট্র্যাক ধরে ওদের পিছু নিক,কেউ, বুঝুক গরু উদ্ধার করতে গেলে কি বিপদ বা ঝামেলায় পড়তে হবে।
ঘোড়াকে হটিয়ে প্রতিটি ঢাল পেরোলাম আমরা, পাহাড় বা রীজ পেরোনোর আগে চারপাশ ভাল করে দেখে নিচ্ছি। যতটা সম্ভব নিচু এলাকা ধরে চলছি, ট্রেইল যাতে না-হারিয়ে ফেলি সে-ব্যাপারেও পুরোপুরি সচেতন।
সমস্ত গরু নিয়ে যদি চলে যাই আমরা, এলাকা ছেড়ে ভাগতে বাধ্য হবে সুযোগসন্ধানী লোকগুলো কিংবা না-খেয়ে মারা পড়বে। উঁহু, তেমন কিছু হবে না। চাইলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারবে ওরা, মাংসের চাহিদা মেটাতে পারবে যে-কোন রেঞ্জে। সমস্ত টেক্সাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য গরু, বেশিরভাগ রেঞ্জে নির্দিষ্ট সীমানাও নেই। মোষ শিকারের মতই, মাংসের প্রয়োজনে একটা গরু জবাই করলে কেউই কিছু মনে করবে না।
শুধু মাংসই নয়, গরুর চামড়া বা চর্বিও উপকারী। বাজার নেই, তাই গরুর চাহিদা কেবল মাংসের যোগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কেউ কেউ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে লুইসিয়ানা, সেভপোর্ট বা অ্যালাবামায় গরু নিয়ে গেছে, প্রচুর দামেও বিক্রি করেছে; কিন্তু এতদূর পথ পাড়ি দেয়া সত্যিই কঠিন। পশ্চিমে গরুর দল ক্রমশ স্বাস্থ্য হারাচ্ছে, আগের মত বনে-বাদাড়েও খুঁজে পাওয়া যায় না।
এটা উঠতি পশ্চিম, একসময় অনাবিকৃত ছিল; কিন্তু এখন বসতি গড়ার চেষ্টা করছে মানুষ। আমাদের পশ্চিমে কোন লোকালয় নেই, আছে জনমানবহীন বিস্তৃত বুনো অঞ্চল। এ পর্যন্ত টেক্সাসের পশ্চিমে যাওয়ার সাহস কেউই করেনি, কেবল দুঃসাহসী এক কৃষক ফোর্ট বেল্কন্যাগ থেকে চার মাইল পশ্চিমে বসতি করেছিল। জায়গাটা আমাদের এখান থেকে কিছুটা উত্তর-পশ্চিমে।
পর্যাপ্ত ঘাস আছে, এমন জায়গায় থাকতে পছন্দ করে গরুর দল। এখান থেকে পুবের জমি ছাড়াও নদী-তীরবর্তী নিচু এলাকায় প্রচুর ঘাস রয়েছে। পশ্চিমে, কলোরাডো নদীর তীরে কিছু গরু চোখে পড়েছে কার্লের, প্রায় বুনো হয়ে পড়েছে ওগুলো, কোন ভাবে চলে গেছে ওখানে। আমার জানা মতে ওদিকে কোন লোকই থাকে না।
ঠাণ্ডা, আর্দ্র সকাল। আকাশে ভারী মেঘের আনাগোনা। বাতাস ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে-অনাগত বৃষ্টির পূর্বাভাস। হাতে জরুরী কাজ থাকা সত্ত্বেও আমরা চাইছি বৃষ্টি হোক। বৃষ্টি হলে ওঅটরহোল আর বেসিনগুলো ভরে যাবে, কচি ঘাস গজিয়ে উঠবে কিংবা সতেজ হয়ে উঠবে তৃণভূমি। শিগগিরই ঘাস আর পানির ওপর নির্ভর করবে আমাদের জীবন এবং ভবিষ্যৎ।
হঠাৎ রাশ টেনে ঘোড়া থামাল কার্ল। ড্যান, এদিকে দেখো!
ট্রাক জরিপ করলাম আমরা। পুব দিক থেকে আরও দুই’রাইডার যোগ দিয়েছে আগের দু’জনের সঙ্গে। ঘোড়ার খুরের চাপে দেবে গেছে ঘাস, এখনও সোজা হয়নি-সম্ভবত মিনিট কয়েক আগে এসেছে লোকগুলো।
কাকতালীয় হতে পারে, ট্র্যাক দেখে মন্তব্য করল ট্যাপ।
মানে? জানতে চাইলাম।
কিংবা কেউ হয়তো জানাতে এসেছে আমরা অনুসরণ করছি। ওদের!
সিগারেট রোল করছে কার্ল, কোন মন্তব্য করল না।
কে করতে পারে এমন জঘন্য কাজ? প্রতিবাদ করলাম। আমাদের কেউ নয়!
আমার মত বয়েস হোক তোমার, সংক্ষেপে বলল ট্যাপ। তাহলে শিখবে যে দুনিয়ায় কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। দু’জন লোককে অনুসরণ করছিলাম আমরা…অথচ আকাশ থেকে এসে পড়েছে আরও দুজন।
দ্বিগুণ সতর্কতার সঙ্গে এগোলাম আমরা। ট্যাপ অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ। চালচুলোহীন ওসব নেস্টরদের খবর দেয়ার দরকার পড়েনি আমাদের কারও। অথচ ওরা এখন চারজন, আর আমরা তিনজন। লোকের হেরফের নিয়ে ভাবছি না, তবে উদ্বিগ্ন হওয়ার মত ব্যাপার বটে। ওরা যদি সত্যিই আমাদের আসার খবর পেয়ে থাকে, তাহলে আরও লোক থাকতে পারে।
আচমকা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ট্যাপ, ঢালু পথে ঘোড়া ছুটিয়েছে কার্ল-সরে যাচ্ছে আমাদের কাছ থেকে। ও কি করছে? জানতে চাইল সে।
চিহ্ন খুঁজতে গেল। দূর থেকে ওদের উপস্থিতি টের পেতে চাইছে। চাঁদের আলোয় ক্যাপরকের ওপর একটা কূনকেও ট্র্যাক করতে পারবে ও।
ও কি থাকবে শেষপর্যন্ত? মানে…গোলাগুলির সময় কেটে পড়বে না তো?
থাকবে। ওর চেয়ে লড়াকু লোক দেখোনি তুমি, ট্যাপ।
স্থির দৃষ্টিতে কার্লের দিকে তাকিয়ে থাকল ট্যাপ, কোন মন্তব্য করল না। স্যাডলে সিধে হয়ে বসল ও, সতর্ক, মাথা উঁচু, যে-কোন ঝামেলার জন্যে তৈরি। স্যাডলে বসার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে ঝামেলা হলে সামাল দিতে অভ্যস্ত। অথচ একটা সময় ছিল-আমাদের ছেড়ে যাওয়ার আগে-কঠিন সমস্যা হলে ঘাবড়ে যেত ও, কিন্তু তারপর এত বেশি সমস্যায় পড়েছে যে এসব ওর কাছে মামুলি ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।
- কূন (Coon) আমেরিকার ভালুক জাতীয় প্রাণি বিশেষ
আচমকা ধোয়ার গন্ধ পেলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে গরুও চোখে পড়ল। প্রায় তিনশো গরু, সবই আমাদের। ছোট্ট উপত্যকার কোণে-আগুনের কাছাকাছি বসে আছে চারজন লোক। কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম আমরা। একজন ছাড়া কেউই উঠে দাঁড়াল না।
সাবধান, ট্যাপ, নিচু স্বরে সতর্ক করলাম ট্যাপকে। আরও লোক থাকতে পারে।
ক্রীকের ধারে জড়ো করা হয়েছে সব গরু। সিকি মাইল হবে জায়গাটার পরিধি। দু’ধারে কটনউড এবং উইলোর সারি; এখানে সেখানে কিছু মেস্কিটও রয়েছে। উইলোর ঝাড় এত ঘন যে ক্রীকটাও ঠিকমত চোখে পড়ছে না। আড়ালে কেউ লুকিয়ে থাকলে বোঝার উপায় নেই।
কাছাকাছি ঘোড়া পিকেট করেছে ওরা। সবকটাকে খুঁটিয়ে দেখলাম। ট্যাপ, পাঁচটা ঘোড়ার শরীর ভেজা।
চারজনের মধ্যে ওয়েব হর্নার, বাড সটক্লীফ আর টাটল নামে শীর্ণদেহী এক লোর্ককে চিনতে পারলাম। চতুর্থজনের চুল ব্লন্ড, শার্টের কলারের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। লোকটার চিবুক মুখের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হলো। চাহনি অশুভ ওর, ঝামেলাবাজ এবং নীচ লোক।
ওই গরুগুলোর গায়ে আমাদের ব্র্যান্ড, মৃদু স্বরে বললাম আমি। ওগুলোকে নিয়ে যাব আমরা।
তাই? এখনই নেবে? ঔদ্ধত্যের স্বরে জানতে চাইল ওয়েব হর্নার।
হ্যাঁ, এবং একটা নোটিশও দিয়ে যাচ্ছি তোমাদের। আর কোন গরু পাবে না তোমরা, এমনকি মাংসের জন্যেও নয়।
অনেক জায়গার দখল নিয়েছ তোমরা, মন্তব্য করল ওয়েব। সব গরুর অধিকার কিভাবে পেলে? নিজেরাই কি পয়দা করেছ ওগুলো? উঁহু, ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তোমরা শুধু ছাপ্পড়-মেরেছ।
ভুল করছ। শুরুতে এখানে কোন গরুই ছিল না, আমার বাবা নিয়ে এসেছেন। প্রাকৃতিক নিয়মেই সংখ্যাটা বেড়েছে। কিন্তু সেজন্যে মাথার ঘাম পায়ে ঝরাতে হয়েছে আমাদের।
অথচ খালি হাতে এখানে এসেছ তোমরা, কোন কিছু গড়ার বা তৈরি করার চেষ্টা করোনি। শুধু মানবিক কারণে তোমাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছি, আমরা চাইনি কেউ খিদেয় কষ্ট পাক-বিশেষ করে বাচ্চারা-অথচ এখন তোমরা চুরি করছ।
তাই? বেল্টের ভেতর আঙুল গুঁজে দিল হর্নার, আয়েশী ভাব ফুটে উঠল ভঙ্গিতে। এবার আমার কাছ থেকে একটা কথা শুনে নাও। এখান থেকে চলে যেতে চাইছ তোমরা। বেশ, যাও। কিন্তু গরু নিয়ে যেতে পারবে না।
ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লোকটার ওপর অতিরিক্ত ভরসা করছ না? ঝোলার বেড়াল বের করে দিলাম। ওর কথা ভুলে যাওয়াই মঙ্গল। তোমাদের সাহায্য করতে পারবে না সে।
সামান্য বিস্ফারিত হলো হর্নারের চোখজোড়া। জিভ চালিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল বাড সটক্লীফ। ব্লভ লোকটার একটা চুলও নড়েনি, স্থির দৃষ্টিতে ট্যাপ এডলের দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় আগে কোথাও, দেখেছে ট্যাপকে।
জানি না কি ভাবছ তোমরা, কিন্তু তোমাদের জায়গায় থাকলে স্যাড়লে চেপে কেটে পড়তাম আমি। ফিরে গিয়ে চুরি করা সব গরু খেদিয়ে দিতাম রেঞ্জের দিকে।
কেন ভাগব বা গরু ফিরিয়ে দেব? জানতে চাইল হর্নার, নিজেকে ফিরে পেয়েছে। গরুগুলো এখন আমাদের জিম্মায় আছে, অথচ
তোমাদের হাতে কিছুই নেই। লোকবলও কম তোমাদের।
বেশি লোকের দরকার হয় না আমাদের, বলল ট্যাপ। কাজ সারার জন্যে এই যথেষ্ট।
ট্যাপের দিকে সরে গেল হারের দৃষ্টি। তোমাকে তো চিনলাম না!
মাথা নাড়ল ও। বলতে পারো ড্যানের সৎ ভাই আমি। ওই স্টকে আমারও ভাগ আছে। গোলাগুলি করে যদি ওগুলোর দখল নিতে হয়, একটুও আপত্তি নেই আমার।
চিনি ওকে, হঠাৎ মুখ খুলল ব্লন্ড। ওর নাম ট্যাপ এডলে। নসেজের ওদিকে দেখেছি ওকে।
তো?
বন্দুকবাজ ও, ওয়েব।
ওয়েব হর্নারের সমস্ত মনোযোগ এখন ট্যাপের ওপর ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে লোকটা। এক পাশে কিছুটা সরে গেল বাড সাইক্লীফ, ছড়িয়ে পড়তে ইচ্ছুক। আমার প্যাটার্সন রিভলভিং রাইফেলটা পড়ে আছে স্যাডলের ওপর, ট্রিগারে চেপে বসেছে আঙুল। সাইক্লীফ নড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্যাটার্সনের মাজলও অনুসরণ করল, তাকে…
পরিস্থিতি দেখে ঘাম জমতে শুরু করল সাইক্লীফের কপালে। হর্নারের ওপর স্থির হয়ে আছে ট্যাপের দৃষ্টি।
জানি ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে আছে ওদের একজন, কিন্তু কার্ল ক্রকেটের ওপর ভরসা করছি যে লোকটার গতি করবে ও। অন্য কেউ করলেও অন্তত আমি করছি। হয়তো অতিরিক্ত বা অনুচিত হচ্ছে সেটা, কারণ একজনের পক্ষে এ পরিস্থিতিতে কিছু করা সত্যিই কঠিন; অথচ এদিকে আমাদের সামনে চারজন বেপরোয়া লোক।
ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলো, বিদ্রুপের স্বরে পরামর্শ দিল ট্যাপ। সময় কিন্তু নেই। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে হয়তো জানে বেঁচে যেতেও পারো।
জিভ দিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করল ওয়েব হর্নার। দেখতে হলো না, অবচেতন মন থেকে টের পাচ্ছে ওর বুক বরাবর ধরা আছে ট্যাপের বন্ধুকের মাজল; ট্যাপ যদি ওর চেয়ে ফাস্ট হয়, নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় ওর লাশ পড়ে যাবে আজ।
এদিকে ঘোড়াকে দু’কদম পিছিয়ে এনেছি আমি, ফলে সাটুক্লীফ আর ব্লন্ড লোকটাকে একইসঙ্গে নজরে রাখতে সুবিধে হলো। ঘোড়া, নিয়ে কেটে পড়ো সবাই, বললাম আমি। আর যদি লড়াই করতে চাও, যে-কোন সময় শুরু করতে পারো, আপত্তি নেই আমাদের।
হঠাৎ ঝোঁপের কিনারায় এসে দাঁড়াল কার্ল ক্ৰকেট। যে-কোন সময় কাজ শুরু করতে পারো তোমরা, হালকা সুরে জানাল সে। আড়ালে লুকানো কাউকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
ঘামছে ওরা। তিনজনের বিরুদ্ধে চারজন এখন। আমার রাইফেল একজনের বুক বরাবর নিশানা করা। বাড সাইক্লীফ যথেষ্ট পোড় খাওয়া মানুষ, কিন্তু নায়ক হওয়ার খায়েশ নেই ওর। বসন্তের এই সুন্দর সকালটা বড় ভাল লাগছে ওর। মিনিট কয়েক আগেও জঘন্য ভাষায় আবহাওয়াকে গালাগাল করছিল, অথচ এ মুহূর্তে বছরের যে কোন সকালই ওর কাছে অপূর্ব মনে হচ্ছে বোধহয়।
ওকে খুন করেছ তুমি? কার্লের উদ্দেশে জানতে চাইল হর্নার।
আমাদের কাজে নাক গলাতে পারবে না সে, জবাব এল।
মিনিট খানেক নীরবতায় কেটে গেল, কেউই কিছু বলছে না। সামান্য একটা মিনিট, কিন্তু বড় দীর্ঘ মনে হলো। তারপর ঘোড়াকে এক পা আগে বাড়ালাম আমি, রাইফেলের নিশানা সাইটক্লীফের বুক থেকে এক চুলও নড়ল না তোমাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, নির্লিপ্ত স্বরে বললাম আমি। এটা প্যাটার্সন রিভলভিং রাইফেল। পয়েন্ট ফাইভ-সিক্স ক্যালিবারের পাঁচটা গুলি আছে এতে।
ওয়েব…? নার্ভাস বোধ করছে সাইক্লীফ, প্যাটার্সনের মাজল থেকে ওর দূরত্ব মাত্র বিশ ফুট। নার্ভাস হওয়ার মত যথেষ্ট দূরত্ব।
বেশ, না হয় দুদিন অপেক্ষা করলাম! চাপা অসন্তোষের সুরে বলল ওয়েব হর্নার। চল্লিশজন আছি আমরা, এবং এই গরুগুলো চাই আমাদের। আপাতত নিয়ে যেতে পারো তোমরা-কিন্তু ধরে রাখতে পারবে না।
ওয়েব? ট্যাপের কণ্ঠ শুনে ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে গেল আমার সবকটা চুল। আমি আর তুমি-সমানে সমান। অন্যরা এসবের বাইরে থাকুক।
আরে? এমন কিছু বলেছি নাকি? স্পষ্ট আতঙ্ক ফুটল হর্নারের স্বরে।
একটু আগেই তো, বললে চল্লিশজন, একেবারে শান্ত স্বরে বলল ট্যাপ। আমি বলছি উনচল্লিশজন…স্রেফ ঊনচল্লিশজন। একজন খালাস হয়ে যাবে!
আকাশে হাত তুলল বাড সাইক্লীফ। শীর্ণদেহী লোকটা এত দ্রুত পিছিয়ে গেল যে লগের একটা খুঁটিতে হোঁচট খেয়ে ধপাস করে পড়ে গেল। কিন্তু ওঠার সাহস হলো না তার, হাত-পা ছড়িয়ে ওভাবেই পড়ে থাকল।
স্থির ভাবে, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ব্লন্ড লোকটা। ও-ই শুরু করেছে, চড়া, স্বরে ঘোষণা করল সে। আমি এতে নেই। ওদের দু’জনের ব্যাপার এটা।
পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে ওয়েব হর্নার, মুখোমুখি হয়নি বরং ট্যাপের দিকে খানিক পাশ ফিরে আছে-ডানদিকে। ডান কোমরে ওর পিস্তল, কোল্টের বাঁট থেকে ডান হাত বেশ দূরেই আছে। দেখো, মেকী আপসের সুরে বলল সে। অযথা ঝামেলার কি দরকার… বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর হাতে।
ট্যাপের গুলি বিধল ওর বুকে দুটো। ভোতা শব্দে ঘাসের গালিচায় আছড়ে পড়ল ওয়েব হর্নারের লাশ।
ধন্যবাদ, ড্যানি। ভাগ্যিস, ওর বাম হাতের ব্যাপারে সতর্ক করেছ আমাকে! নির্লিপ্ত স্বরে বলল ট্যাপ। জানা না থাকলে হয়তো ভুল করতাম। ব্যাটার ডান হাতের দিকে নজর রাখলে ঠিক ওর, মত পড়ে থাকতে হত এখন?
সব গরু জড়ো করে ফিরতি পথ ধরলাম আমরা। কেউ কিছু বলল, একটা শব্দও উচ্চারণ করল না।
ঊনচল্লিশজনের কথা ভাবছি আমি, বিশেষ করে হর্নারের দুই ভাই সম্পর্কে। খবরটা পাওয়া মাত্র ছুটে আসবে ওরা। ভাই হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাইবে।
সুতরাং যত জলদি রওনা দেয়া যায় ততই মঙ্গল-উটকো কিছু ঝামেলা এড়ানো যাবে।