অন্য কি
এক
লোকটা জবুথুবু হয়ে বাস থেকে নামল। ও আগে আর আমি পিছনে। নেমেই হুড়মুড় করে পড়ে গেল। আমি লোকটাকে ধরে উঠালাম। লোকটার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে আছে, আতঙ্কে। আমার দুবাহুর মধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। বয়সে প্রায় আমার মতই ইয়াং। গায়ের রং চাপা ফুলের মত ফর্সা। অত্যন্ত সুপুরুষ। মেয়েরা এমন ধরনের পুরুষকে পছন্দ করে। গায়ে সস্তা দরের জামা আর লুঙ্গি, যা তার রূপের সাথে মানাচ্ছে না। রাস্তার পাশেই একটা চায়ের দোকান, সামনে। একটা লম্বা বেঞ্চ পাতা। তাতে লোকজন বসে। এখন অবশ্য কোনও খদ্দের নেই। ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে খদ্দের না থাকারই কথা। আমি লোকটাকে ওখানে বসালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কিছু খেয়েছেন? চেহারা দেখেই মনে হচ্ছিল সে কিছু খায়নি। অন্তত দুদিন যে পেটে কিছু পড়েনি আমি নিশ্চিত।
– মাথা নেড়ে না করল সে। এই দুপুরে চা খাওয়ার চেয়ে ভাত খাওয়া ভাল। দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে। আশপাশে কোনও হোটেল আছে কিনা। দোকানি বলল, দশ মিনিট মত হাঁটলে একটা বাজার মত পাওয়া যাবে। ওখানে হোটেল আছে। ভাত রুটি সবই পাওয়া যাবে। অনেকের মনে হতে পারে, রাস্তায় কত লোকই তো কত রকম ঝামেলায় পড়ে। হঠাৎ করে এই লোকটার জন্য আমার দরদ উথলে উঠল কেন? আসলে ওর চেহারাটা এমনই বনেদি টাইপ যে মনে হচ্ছিল এমন পরিস্থিতিতে সে কখনও পড়েনি। তার প্রতি কেন যেন একটা টান অনুভব করছিলাম। আর তার আতঙ্কিত চোখের ভাষায় অজানা এক রহস্য খেলা করছিল, যা আমাকে ভীষণ টানছিল।
হোটেলে বসে গোগ্রাসে লোকটা ভাত খেল। পানি খেল। তারপর তাকে বেশ সুস্থ মনে হলো। এতক্ষণে কথা বলল সে, থ্যাঙ্কস।
লোকটা শিক্ষিত, বুঝতে পারলাম। শিক্ষিত লোকের কথার ধরন অন্য রকম। আমি ভণিতায় না গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কী, বলেন।
লোকটা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, একটা সিগারেট খাওয়াবেন?
আমি বললাম, স্যরি, আমার আগেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। এক্ষুণি আনিয়ে দিচ্ছি।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা হাইওয়ের পাশে একটা গাছতলায় এসে দাঁড়ালাম। তারপর লোকটা ওই গাছতলাতেই বসে পড়ল। আমিও বসলাম। রাস্তা ধরে সাঁই সাঁই বাস-ট্রাক বেরিয়ে যাচ্ছে আমাদের সামনে দিয়ে। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে লোকটা তার গল্প শুরু করল। কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর গল্প তার কাছে শুনব সেটা আমি আশা করিনি। তার ভাষাতেই গল্পটা তুলে দিলাম:
আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। দাদাজান নাম রেখেছেন আরমান। গ্রামে আমাদের বিশাল অবস্থা। আমার বাবাকে এক নামে সবাই চেনে। এলাকায় তাঁর প্রতিপত্তি আছে। অনেকেই তাকে ইলেকশান করতে বলেছে, কিন্তু তিনি ওসর পছন্দ করতেন না। আমাকে শহরে রেখে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বি.কম. পাশ করার পর বাবা বললেন, তাঁর ব্যবসা যেন দেখাশুনা করি। গঞ্জের বাজারে আমাদের চালের আড়ৎ। আমি আর আপত্তি করলাম না। বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করতে লাগলাম। দাদাজান বাড়িতেই থাকতেন। ফলফলাদির বাগান আছে। ফুলের বাগান আছে। তাই। দেখাশুনা করতেন। আমি ব্যবসাটা ধরে ফেলার পর বাবাও দাদাজানকে সঙ্গ দিতেন। এভাবেই দিন কাটছিল আমার। এদিকে মা এবার সুযোগ পেয়ে বসলেন। আমাকে বিয়ে করতে হবে। দক্ষিণ পাড়ার পারভীনের সঙ্গে আমার প্রেম ছিল। মাকে জানালাম সে কথা। কেউ কোনও আপত্তি তুলল না। উভয় পক্ষের কথা মত বিয়ের দিনও ঠিক হলো। কিন্তু সেই বিয়ে আর হলো না। তার আগেই আমার ভাগ্যে নেমে এল ভয়ানক বিপর্যয়।
মাছ ধরা ছিল আমার একমাত্র শখ। ভরা বর্ষায়, বৃষ্টিতে ভিজে, গভীর রাতে, যখনই সুযোগ পেতাম মাছ ধরতে যেতাম। মাছের ভাগ্যও ছিল আমার ভাল। কোনওদিনই খালি হাতে ফিরতাম না। বন্ধু-বান্ধবরা আমাকে তাই মাছকুমার বলেই ডাকে। আমার বাবারও শখ ছিল মাছ ধরার। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখতাম বাবাও রাত নেই দিন নেই, বৃষ্টি বাদল নেই, সুযোগ পেলেই মাছ ধরতেন। সে যাই হোক, বাবার ওই রোগটা আমাকেও পেয়েছে। মা আমাকে মানা করতেন। বলতেন, রাত-বিরাতে যাস না, বাবা। ওদের মাছের প্রতি বেজায় লোভ। শেষে ঘাড়-টাড় না আবার মটকে দেয়। আমি শুনে হাসতাম। আমাদের বাড়ির পাশে একটা বিশাল বাঁশ ঝাড়। তার পাশেই একটা পুকুর। সবাই ওটাকে বলে তারা পুষ্করিণী। কোনও এক রাতে নাকি ওটাতে একটা বড় তারা খসে পড়েছিল আকাশ থেকে। তখন থেকে ওটার ওই নাম।
সেই তারা পুষ্করিণীর পাড়ে কচু ঘেঁচু আর বাঁশের জঙ্গলে নাকি মেন্দির মা বলে এক পেতনী থাকত। বাবা যখন রাতে বৃষ্টির পানিতে পুকুর পাড়ে উজিয়ে ওঠা (পুকুর থেকে লাফিয়ে পাড়ে ওঠা) কৈ মাছ ধরে বাড়ি ফিরতেন, তখন প্রায়ই দেখতেন বাঁশ বাগানের কাছে জবুথুবু হয়ে বসে আছে কেউ। বাবা জিজ্ঞেস করতেন, কে গো, মেন্দির মা নাকি? মেন্দির মা জবাব দিত, ওঁ। বাবা তার থলে থেকে দুটো কই মাছ ছুঁড়ে দিতেন মেন্দির মার দিকে। যেদিন বাবা মাছ দিতেন না সেদিন নাকি স্বরে আওয়াজ হত, কীরে, মাছ দিলি না? ওই সব আমরা ছোট থাকতে শুনতাম। তাই মার ওই ঘাড় ভাঙার কথা খুব একটা আমল দিতাম না। কিন্তু এখন সব কিছু হারিয়ে বুঝতে পারছি মায়ের কথা আমল দেয়া উচিত ছিল। মায়ের কথা শুনলে আজ আর আমাকে সব হারাতে হত না… থামল আরমান। একটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ সিগারেট টানল। তারপর ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার শুরু করল।
দুই
বর্ষাকালের একদিন। সেদিন সারা দিন ধরে বৃষ্টি ঝরেছে। সন্ধ্যা হলো, রাত হলো। কিন্তু বৃষ্টির বিরাম নেই। তবে একটু কমে এসেছে। শুনেছি সোনা বিলে নানা রকম মাছ পানিতে নিত্য ঘাই মারছে। ঝাঁকে ঝাকে মাছ। বৃষ্টির পানিতে মাছেদের যেন আনন্দ। আমি আর নিজেকে ঘরে ধরে রাখতে পারলাম না। মা মানা করলেন। কিন্তু আমি শুনলাম না। ছাতা, ছিপ আর একটা চার ব্যাটারির টর্চও নিলাম। বড় একটা অ্যালিউমিনিয়ামের হাঁড়ির গলায় দড়ি বেঁধে : ওটাও নিয়ে নিলাম, মাছ রাখার জন্য। সোনা বিলের পাড়ে একটা ছাতিম গাছ আছে। ওটাই আমার বসার প্রিয় জায়গা। এর আশপাশটা ঝোঁপ-জঙ্গলে ভরা। নানা রকম গাছ। কিন্তু ছাতিম গাছের তলাটা আমি পরিষ্কার করে নিয়েছি।
চারদিক নীরব। ঝিঁঝিরাও ডাকছে না। কালো অন্ধকার। ছাতিম গাছটার তলায় পৌঁছে বিলের পানিতে টর্চের আলো ফেললাম। নিকষ কালো জলেও কয়েকটা মাছ হুটোপুটি করতে দেখে খুশি হলাম। বসে গেলাম ছাতিম গাছতলায়। বঁড়শিতে মাছের টোপ গেঁথে ছুঁড়ে দিলাম পানিতে।
টপাটপ মাছ ধরতে শুরু করে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁড়িটা প্রায় মাছে ভরে গেল। ঠিক তখনই আওয়াজটা শুনতে পেলাম। কেউ একজন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কান পাতলাম। কান্নাটা আসছে আমার ডান পাশ থেকে। আমার ডান পাশে গজ পাঁচেক দূরে একটা আম গাছ। পাশে ঝোঁপ-জঙ্গল। আমি টর্চের আলো ফেললাম ওদিকে। সাথে সাথে চমকে গেলাম। একটা মেয়ে মানুষ ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর হাতের দড়িটা ছুঁড়ে দিচ্ছে কিছুটা নিচু হয়ে থাকা আম গাছের একটা ডালে। মুহূর্তে বুঝে গেলাম, গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস নিতে যাচ্ছে কোনও হতভাগী। আমি ছিপ ফেলে দৌড়ে গেলাম তার দিকে। টেনে তাকে নিয়ে এলাম ছাতিম গাছতলায়। তখনও সে কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
তার মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারলাম না। ভাল বিপাকে পড়লাম। কে জানে কার সাথে ঝগড়া করে কিংবা কীসের দুঃখে মরতে এসেছে! এখন ফেলেও যেতে পারব না। তাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি ধরে এসেছে। বাড়িতে মা জেগে ছিলেন। দরজায় টোকা দিতেই খুলে দিলেন। আমি কীভাবে কী বলব ভেবে পেলাম না।
তারপরও সাহসে ভর করে সব কিছু খুলে বললাম। মা কতক্ষণ থ মেরে রইলেন। তারপর কুপিটা ওই মেয়ের মুখের কাছে ধরলেন। সাথে সাথে অস্ফুট একটা শব্দ করে হাত থেকে জ্বলন্ত কুপিটা ফেলে দিলেন। চমকে গেছেন ভীষণভাবে। চমকে গেছি আমিও! এমন রূপও মানুষের হয়! মা আর কিছু বললেন না। রাতটা অস্থিরতার মধ্যে কেটে গেল। মা তাকে শোবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম মার মধ্যে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরদিন সকালে মা আমাকে ফিসফিস করে বললেন, পুকুর ঘাটে আয়। আমি ঘাটে গেলে মা আমাকে বললেন, বাবা, এ কাকে নিয়ে এলি তুই! এ তো বাবা মানুষ নয়! মানুষের এত রূপ হয় না। এ অন্য কিছু। খোদা জানে কী গজব নাজিল হবে এবার আমার সংসারে! আমি মাকে বললাম, মা, এ তোমার মনের ভুল। এসব ভেব না তো। আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম
কিন্তু মা আমার ভুল যে বলেননি তার প্রমাণ পেলাম পরদিন। তার আগে বলে নিই, মার সাথে পুকুর ঘাটে কথা বলে আমি গদিতে চলে আসি। বিকেলে বাড়ি ফিরে শুনি সারাদিন ওই মেয়ে অন্ধকার কোনায় বসে থেকেছে। মা এত করে ডাকার পরও বের হয়ে আসেনি। কিছু খায়নি ও। কিন্তু সন্ধে হতে না হতেই তার মধ্যে উতলা ভাব লক্ষ করলাম। কোণ থেকে বেরিয়ে এল সে। স্বাভাবিক নিয়মে চলাফেরা করল। আমার দিকে কটাক্ষে চেয়ে একটু যেন মুচকি হাসতেও দেখলাম। আমার চোখের ভুলও হতে পারে। কিন্তু কথা বলল না, কিছু একটু খেলও না। সেদিন রাতে ভাল ঘুম হলো আমার। কিন্তু সকালবেলা বাড়ির কাজের লোক মতি মিয়ার চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের বাইরে বেরিয়েই থমকে গেলাম। চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
আমার প্রিয় কুকুরটাকে কে বা কীসে যেন বীভৎসভাবে পেট চিরে নাড়ি ভুড়ি বের করে হত্যা করেছে। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ওটা, আতঙ্কিত চোখে চেয়ে। কী এমন জন্তুর আবির্ভাব হলো এলাকায় কে জানে? ভাবতে থাকলাম আমি। কোনও কিনারা করতে পারলাম না। কিন্তু ওই আশ্রিতা মেয়ে ঘরের কোণেই রয়ে গেল। দিনের বেলাতেই সে এমন করে। মতি মিয়াকে অন্য রকম মনে হলো। সে চোখ বড় বড় করে পাগলের মত আচরণ করতে থাকল। আর বলতে থাকল, আমি দেখেছি, সব দেখেছি, কিন্তু বলব না, আমি বলব না। মতিকে ডাকলাম, মতি, ঘরে আয়, কী দেখেছিস, আমাকে বল।
সে আরও ভয় পেয়ে গেল। চিৎকার করে বলল, না, ওঘরে আমি যাব না। আমি দেখেছি, সব দেখেছি। চিৎকার করতে করতে সে বেরিয়ে গেল। রাতে সে জেগে থাকে। হয়তো কিছু দেখেছে। কিংবা কুকুরটাকে খুন করতে দেখেছে। খুনিকে।
মা আমাকে ফিসফিস করে বলল, সব ওই ডাইনীটার কাজ। ওটা যেদিন থেকে বাড়িতে এসেছে সেদিন থেকেই শুরু।
আমার জন্য আরও বিপর্যয় অপেক্ষা করছিল। মা বুঝতে পারলেও আমি বুঝিনি। কিন্তু পরদিন সকালে যখন মতি মিয়ার লাশ পাওয়া গেল তারা পুষ্করিণীর পাড়ে তখন আমি সত্যিকারের ভয় পেলাম। তারও পেটটা ছিল চিরা। দেহের বিভিন্ন জায়গা থেকে কেউ খাবলে খুবলে মাংস খেয়ে গেছে। পুলিশ-ফুলিশ, নানা ঝক্কি ঝামেলা শেষ করতে করতেই দিন শেষ হলো। গ্রামের লোকজন আমাদের বাড়িটাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। ওরা বলে আমাদের বাড়ির চারপাশে নাকি। কিছু একটা ঘুরে বেড়ায় রাতে। কিন্তু আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া মেয়েটির এদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে এখন অনেকটা স্বাভাবিক। কথাটথাও বলে। কিন্তু নিজের পরিচয় বলে না। তবে এখন আর আমাদের বাড়ির আশপাশে কোনও অঘটন ঘটে না। গোরস্থানের কবর খুঁড়ে দুএকটা লাশ কে বা কিছুতে খাবলে খেয়ে গেছে এমন খবর আসে। ওটা শেয়ালের কাজ হতে পারে, ভেবে আমরা গা করি না। এর মধ্যে আমার বিয়ে ঠিক হয়। যাকে আমি ভালবাসি তার সাথেই বিয়ে। পারভীনের সাথে।
কিন্তু বিয়ে আমার আর পারভীনকে করা হলো না। যেদিন বিয়ে সেদিন সকালে তার লাশ পাওয়া গেল বাশ ঝাড়ের মধ্যে। কেউ যেন তার দেহটা খুবলে খেয়ে গেছে! এদিকে বিয়ের কার্ড বিতরণ হয়ে গেছে। দাওয়াত দেওয়া হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি গম গম। বাবা আর দাদাজানের ইচ্ছায় আমার বিয়ে হলো ওই মেয়ের সাথে। যাকে আমি বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছি। মার ইচ্ছে ছিল না। মা তাকে তখনও ডাইনীই ভাবত।
বাসর রাত আমার হলো না। বিছানায় যেতেই আমার বউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মায়ের সাথে দেখা হতেই বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম,! কী হয়েছে, মা?
মা আমাকে বললেন, পুকুর পাড়ে আয়।
আমি গেলাম। মা বললেন, কাল রাতে বৌমাকে মাঝরাতে ঘর থেকে বের হতে দেখলাম! আমিও চুপি চুপি তার পিছু নিলাম, কিছুদূর যেতেই দেখি সে গোরস্থানের দিকে হাঁটা দিয়েছে… হঠাৎ থেমে গেলেন মা। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে থাকলেন একদিকে। তার তাকানো লক্ষ্য করে ও দেখলাম তিনি জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর আমার ঘরের জানালা থেকে আমার বউ তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে এই দিকে! আমাকে দেখেই সরে গেল সে! আমার মা-ও আমার সামনে থেকে দ্রুত সরে গেলেন।
সেদিন রাতেই খুন হলেন মা! চরম আক্রোশে কেউ তার দেহটা ছিন্নভিন্ন করেছে। পুকুর পাড়েই পড়ে ছিল তার লাশ। এবার যেন আমি একটু একটু বুঝতে পারলাম। আসলেই আমি এক পিশাচ নারীকে বিয়ে করেছি। কিন্তু আমি যে তাকে চিনে ফেলেছি, তা তাকে বুঝতে দিলাম না। আমার মা যে মারা গেল তার মধ্যে কোনও অনুশোচনা দেখতে পেলাম না। এখন বুঝতে পারলাম পারভীনকে কে মেরেছে। আমার স্ত্রী হবার জন্যই সে একাজ করেছে।
সেদিন রাতে সে আমার সাথে ভাল ব্যবহার করল। আমরা মিলিত হলাম। আমার ইচ্ছে ছিল না। মা হারানোর বেদনা মনে তখনও ছিল। যা যাবে না কখনও। মনে মনে দৃঢ় সঙ্কল্প করলাম, আজ রাতে আর ঘুমাব না। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকব। তারপর ডাইনীটা ঘর থেকে বের হলে পিছু নেব। কে বলবে এমন সুন্দর মুখের একটা মানুষ পিশাচ। আমার বিশ্বাস হতে চাইছিল না। আমাকে নিজের চোখে দেখতে হবে।
সে যখন নিশ্চিত হলো আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, বিছানা থেকে নামল। থমকে দাঁড়াল ঘরের মেঝেতে। নিশ্চিত হতে চাইছে ভালভাবে। তারপর দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। বাইরে থেকে দরজাটা ভেজিয়ে নেমে গেল সে উঠানে। আমি আরও কতক্ষণ মটকা মেরে পড়ে রইলাম। তারপর আস্তে করে নেমে এলাম নিচে। বাইরে বেরিয়ে এলাম। নিঝুম রাত। হালকা বাতাস বইছে। তার গন্তব্য আমি জানি। আজ একজনকে কবর দেয়া হয়েছে। আমি জানি তার গন্তব্য গোরস্থান। বাড়ির সীমানা ছাড়াতেই আমার সামনে দুজনকে দেখতে পেলাম। চমকে উঠলাম আমি। দাদাজান আর বাবা। ওঁরাও তা হলে পিশাচটার পিছু নিয়েছেন। মা মারা যাবার পর বাবা ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তার মনেও যে ডাইনীটাকে হাতে-নাতে ধরার ইচ্ছা ছিল তা জানতাম না। তারা বাপ ছেলে সাবধানে এগিয়ে চললেন। আরও কিছুদূর গেলেই একটা বড় তেঁতুল গাছ পড়বে রাস্তার পাশে। একটা মোটা ডাল রাস্তার উপর ঝুঁকে আছে, মাটি থেকে দশ বারো হাত উপরে।
আকাশ ছিল পরিষ্কার। রাস্তায় ঝুঁকে থাকা তেঁতুল গাছের ডালটার উপরের আকাশটা ভালভাবেই দেখা যাচ্ছিল। পরিষ্কার আকাশে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ। সে আলোতেও ওটাকে দেখতে পেলাম! সামনে থেকে বাবা আর দাদাজান থমকে দাঁড়ালেন। আমি তাদের কাছ থেকে হাত পাঁচেক দূরে একটা কাঁঠাল গাছের আড়াল নিলাম। ওটা বসে ছিল তেঁতুল গাছের ডালটায়। বিশাল দেহ। মাথার চুলগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তীব্র চোখে তাকিয়ে ছিল রাস্তার দিকে। তার চোখ দুটো হিংস্র শ্বাপদের মত জ্বলজ্বল করছিল। বাবা আর দাদাজান তার কাছে ধরা পড়ে গেছেন! খিলখিল করে হেসে। উঠল পিশাচ নারী। তার হাসিতে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ল রাতের নীরবতা। তারপর যা ঘটল তা এতদিন রূপকথাতেই শুনেছিলাম! হঠাৎ একটা হাত তীব্র গতিতে ছুটে এল বাবা আর দাদাজানের দিকে। এক থাপ্পড়ে দুজন ঢলে পড়লেন মাটিতে। বুঝতে পারলাম ওঁরা আর এই জগতে নেই। আতঙ্কে বোবা হয়ে গেলাম। আমার পা যেন পেরেক দিয়ে কেউ গেঁথে দিয়েছে। ওটা গাছ থেকে নেমে এল। আবার স্বাভাবিক রূপ দেখা গেল তার। বাবা আর দাদাজানের লাশের সামনে এসে বসে গেল। আমি জানি এখন ওটা খেতে শুরু করবে ওঁদের লাশ। আমার চোখ ফেটে জল এল। তারপর ভীত পায়ে ফিরে এলাম ঘরে। দরজা ভেজিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। মুক্তির উপায় ভাবতে লাগলাম। একদিনের ব্যবধানে মা-বাবা আর দাদাজানকে হারিয়েও ঘুম এসে গেল আমার চোখে। কখন। আমার পিশাচী বউ ফিরে এসেছে জানতে পারিনি।
পরদিন আমার বাবা আর দাদাজানের লাশ কোথাও পেলাম না। এমনকী তাদের হাড়গুলোও নয়। রাক্ষুসী ওঁদের সবটাই খেয়ে ফেলেছে নাকি? দিনে দিনে ওর ক্ষুধা বেড়েই চলেছে! আমাকে পালাতে হবে। আমার মনের কথা যেন সে বুঝে ফেলল। আমার কানের কাছে মুখ এনে হিসহিসিয়ে বলল, ওই চেষ্টাও কোরো না। তুমি পালিয়ে কোথাও যেতে পারবে না। আমি জানি তুমি কাল রাতের ঘটনা সব দেখেছ। কাউকে ওকথা বলতেও যেয়ো না। তোমাকে আমি মারব না। তোমার আশ্রয় আমার দরকার। তোমার স্ত্রী হিসেবে থেকেই আমি আমার চাহিদা মিটিয়ে যাব। আর আমার পিছু নিতে চেষ্টা করবে না, আরমান। আবারও বলছি কাউকে বলবে না। বলেছ তো মরেছ। যাও, স্বাভাবিক মানুষের মত বাজারে যাও। ব্যবসাপাতি দেখ। দুপুরে বাড়িতে আসবে আর আমি লক্ষ্মী বউয়ের মত ভাত বেড়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল ডাইনীটা।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার জানামতে। একজন ভাল তান্ত্রিক ছিল। তার নাম ছিল গোখরোনাথ। ভূত প্রেতের উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে ওস্তাদ। তার সাথে দেখা করলাম। সব কিছু বললাম। শুনে বলল, ভয় পাসনে, বেটা। ওটার ব্যবস্থা আমি করব। আজ সন্ধেবেলা যাব তোর বাড়িতে।
আমি বাড়ি ফিরে এলাম। আমাকে যত্ন করে ভাত বেড়ে দিল আমার বউ। আমি খেলাম না কিছু। সেও কিছু বলল না। মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। এদিকে সন্ধে হয়ে এল। আমি। অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু গোখরোনাথ আসছে না। আমার বউ বলল, কারও জন্য অপেক্ষা করছ মনে হচ্ছে?
আমি কিছু বললাম না। সন্ধে গিয়ে যখন রাত হব হব করছে তখন আমি ভাবলাম, না, দেখে আসা দরকার। হয়তো তান্ত্রিক আমার বাড়ির পথ ভুল করেছে। না-ও চিনতে পারে। আমি উঠন ছেড়ে বের হব তখন আমার পিশাচী বউ হেসে উঠল। বলল, গোখরোনাথকে এগিয়ে আনতে যাচ্ছ? ঠিক আছে যাও। আমি অপেক্ষা করছি। বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল।
তখনই আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম গোখরোনাথ আর নেই। এও সম্ভব!
তবু আমি পথে নামলাম। কিছুদূর এগুতেই অনেক। লোকের ভিড় দেখে এগিয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম টর্চ জেলে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক। তাদের আলো রাস্তার ওপর পড়ে থাকা লোকটার দিকে। তার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। ওই ডাইনী কেমন করে আমার বাড়ির মধ্যে থেকেও গোখরোনাথকে মেরে ফেলল? গোখরোনাথের মুখ থেকে রক্ত বের হয়ে রাস্তার মাটি কালচে হয়ে আছে। চোখ দুটোতে সীমাহীন আতঙ্ক। আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। বিষণ্ণ মনে ফিরে এলাম বাড়ি। আমি জানি রাতের বেলা ওর ক্ষমতা বেড়ে যায়। তাই রাতে পালাতে চাইলেও পারব না। পালাতে হবে দিনের বেলা। বাড়ি ফিরতেই যেন কিছু হয়নি এমনভাবে আমাকে ঘরে ডাকল সে। আমার পাশে বসল। বলল, কেন। এসব করতে যাও? তুমি আমার ক্ষমতা হয়তো জানতে না। এখন জানলে তো। আর ভুলেও এমন চেষ্টা কোরো না।
আমি কিছু বললাম না। রাতে আমার ঘুম এল না। মাঝরাতে সে বেরিয়ে গেল। শেষ রাতের দিকে ফিরে এল। আর আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকল। মুখ থেকে পচা নর মাংসের গন্ধ এল। আমার গা ঘিন ঘিন করতে লাগল, বমি আসার অবস্থা হলো। কিন্তু আমি নিশ্চুপ শুয়ে রইলাম। পরদিন সকালে যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে বেরিয়ে এলাম। যেন আমার গদিতে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছি। তারপর পালালাম। হাইওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে কাছের বাস স্টপেজে এসে বাসে উঠে বসলাম। কোথায় যাচ্ছি, সেটা বড় কথা নয়। জানতেও চাইনি। আমার একটাই উদ্দেশ্য, ওটার কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়া। তারপর আপনার সাথে দেখা… থামল আরমান। অনেকক্ষণ কথা বলার জন্য হাঁফাচ্ছে।
আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে দিলাম ওকে। সিগারেটে একটা টান দিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দিল ওটা। চমকে উঠে দাঁড়াল। বলল, ওহ, মাই গড! ও বলেছিল এই কথা যেন কাউকে না বলি। ওর আসল রূপ যেন কাউকে ফাস না করি। তা হলে আমাকেও সে খুন করবে!
আমি তার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে চারদিকে
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে হাইওয়েতে। হঠাৎ একটা গরম। হাওয়া ঝাঁপটা মারল। একটা চিৎকার শুনলাম। আরমানের চিৎকার। ঝটকা দিয়ে ওর শরীরটা দশ ফুট উপরে উঠে গেল। ঝড়ো গতিতে তার দেহটা শূন্যে ভেসে ধেয়ে গেল হাইওয়ের মাঝখানে। ধপ্ করে আছড়ে পড়ল পিচের রাস্তায়। ততোধিক ঝড়ো গতিতে ধেয়ে আসছিল একটা ট্রাক! একটা মাত্র আর্তচিৎকারই দিতে পেরেছিল আরমান। ট্রাকটা ওকে পিষে চলে গেল দ্রুত গতিতে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। কয়েকজন পথচারী দৌড়ে এল ঘটনাস্থলে। আমিও গেলাম। কেউ একজন পুলিশ স্টেশনে মোবাইল করল।
পিশাচী তার কথা রেখেছে। ততক্ষণে রাত হতে চলেছে। পুলিশের সাইরেন শোনা গেল। বেচারা আরমান পালিয়েও বাঁচতে পারল না।
আমি বাড়ি ফিরছিলাম। আরমানের গল্পটা তখনও মাথায় আলোড়ন তুলছিল। মহল্লার রাস্তায় পড়তেই গাটা ছম ছম করে উঠল। বাড়ি যেতে হলে একটা মাঠ পেরুতে হয়। ওটার কাছে আসতেই দেখতে পেলাম মাঠের পাশের চালতা গাছটার তলায় একটা মেয়ে, একটা দড়ি ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে গাছটার অপেক্ষাকৃত নিচু ডালটা লক্ষ্য করে। নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করবে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখলাম। ছুটে যেতে চাইলাম মেয়েটাকে বাঁচাতে। সহসা মনে পড়ল আরমানের কাহিনী। থমকে দাঁড়ালাম। ভয়ের একটা শীতল স্রোত অনুভব করলাম রক্তে। দ্রুত পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে। আমি চাই না আমার অবস্থাও আরমানের মত হোক!
রতন চক্রবর্তী