অন্য এক মাতালের গল্প
প্রত্যেক শুক্রবার কিশোর তারকেশ্বরে যায়।
না, কোনও ধর্মকর্ম করতে সে যায় না। ভোলাবাবার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস, যত কাজই থাক তারকেশ্বরে গেলে অন্তত একবার সে মন্দিরের দেওয়ালে মাথা ছুঁইয়ে আসে। কিন্তু সে শুক্রবার শুক্রবার তারকেশ্বরে যায় ব্যবসার খাতিরে। তারকেশ্বরের কাছেই ময়নাপাড়ায় তার কোন্ড স্টোরেজ, পাশাপাশি দুটো। একটা বাবা তারকেশ্বরের নামে–দি নিউ ভোলাবাবা কোল্ড স্টোরেজ।
প্রথমে অবশ্য এটার ভোলাবাবা কোল্ড স্টোরেজ নামই দিয়েছিল কিশোর, কিন্তু পরে জানতে পারে যে আশেপাশে আরও তিনটি ভোলাবাবা কোল্ড স্টোরেজ, ভোলেবাবা কোল্ড স্টোরেজ ভোলেবাবা কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে। তখন সে বাধ্য হয়ে নাম পালটিয়ে দি নিউ ভোলাবাবা কোল্ড স্টোরেজ নামকরণ করে।
দ্বিতীয়টির নাম নিয়ে কিশোরের অবশ্য কোনও অসুবিধেই হয়নি।
অসুবিধে হওয়ার কথাও নয়। কিশোরের প্রাণাধিকা পত্নী শ্যামা শতকরা একশোভাগ লক্ষ্মী। শ্যামার সঙ্গে পরিণয়ের পর থেকেই কিশোরের রমরমা।
তার একটা কারণ অবশ্য শ্যামার কৈশোর এবং যৌবন ইতিহাস খুব প্রাঞ্জল ছিল না, কিন্তু শ্যামার বাবার টাকা ছিল। কিশোর এসব কিছু না ভেবেচিন্তে শুধু শ্যামার রূপসুধা পান করে এবং শ্যামার পিতৃদেবের দশ লক্ষ টাকার নিরভিমান পণ গ্রহণ করে শ্যামার পাণিগ্রহণ করেছিল।
তারপর থেকে পরম আনন্দে কেটেছে তার দিন।
শুধু দিন নয়, কিশোরের রাতও পরম আনন্দে কেটেছে। রঙিন দেশলাই কাঠির মতো একেক সন্ধ্যায় কখনও সবুজ, কখনও লাল–একেক সায়াহ্নে গাঢ় নীল অথবা ঝকঝকে সাদা আলোর রেশনাই। শ্যামা তাকে অনেক দিয়েছে।
সুতরাং দ্বিতীয় কোল্ড স্টোরেজটির নামকরণ যখন কিশোর করল শ্যামা কোল্ড স্টোরেজ তার মন ও হৃদয় আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠল।
শুধু একটা অসুবিধে হয়েছিল, স্বয়ং শ্যামা সজোর প্রতিবাদ জানিয়েছিল, আমার বন্ধুরা আমাকে বলত গরম হাওয়া, আর তুমি আমাকে কোল্ড স্টোরেজ করে দিলে?
কিশোর সরল প্রকৃতির মানুষ। এতশত কথার কায়দা বোঝে না। দুটো আলুর কোল্ড স্টোরেজে মাসে পাঁচ-পাঁচ দশ হাজার টাকা, সন্ধ্যাবেলা আধ থেকে এক বোতল রঙিন রাম, তারপরে গৃহে শয়নে-স্বপনে শ্যামাসুন্দরী–এই তার জীবনের পরমার্থ।
আজ শুক্রবার। তারকেশ্বর যাচ্ছিল কিশোর। আজকাল লোকজনদের মোটেই বিশ্বাস করা যায়, তাই সপ্তাহের শেষ দিকটা নিজেই তারকেশ্বরে এসে হিসেবনিকেশ করে, টাকা আদায় করে দেনাপাওনা মেটায়।
কোল্ড স্টোরেজের লাগোয়া তার একটা সুন্দর বাংলো মতন ঘর আছে, সেখানে রাত্রিযাপন করে। কলকাতা থেকে আসার সময় দু-চার বোতল রাম সঙ্গে নিয়ে আসে। ব্যবসা চালাতে গেলে স্থানীয় মাস্তানদের, থানার বাবুদের একটু খুশি রাখতে হয়।
শনি-রবিবার কোল্ড স্টোরেজের আলুভাজা আর রাম। বিশ্রাম-ফুর্তিও হয় আবার পাবলিক রিলেশনও হয়।
কিন্তু আজ কিশোরের তারকেশ্বর যাওয়া হল না। দক্ষিণ আফ্রিকায় গণধর্ষণের প্রতিবাদে কোন্নগরের সুহৃদ বান্ধব সঙেঘর সদস্যরা বোমা, লাঠি নিয়ে রেললাইনের ওপরে বসে পড়েছে। শ্রীরামপুর থেকে এস ডি ও সাহেব পুলিশ সাহেব এসে অনেক বুঝিয়েছেন, তারা কথা দিয়েছেন যে ভবিষ্যতে যাতে এরকম আর কখনও না হয় তা তারা দেখবেন এবং নিশ্চয়ই এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করবেন।
কিন্তু সুহৃদ বান্ধব সঙেঘর সদস্যরা অদম্য। বিকেল চারটে পাঁচ মিনিট থেকে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা, তারা ঠিক চারটে বাজতে পাঁচ মিনিটে সুহৃদ বান্ধব সঙ্ঘ জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে দিতে রেললাইন পরিত্যাগ করল।
এর পরেও তারকেশ্বরে যে যাওয়া যেত না তা নয়। ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যেই রেল চলাচল প্রায় স্বাভাবিক হল। কিন্তু বহুক্ষণ রেলকামরার গুমোটে আটকে থেকে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। সে রেলগাড়ি থেকে লাইন বরাবর কিছুটা হেঁটে তারপর একটা রিকশা নিয়ে জি টি রোডে এসে একটা প্রাইভেট ট্যাকসি ধরল।
কিশোরের নিজের একটা নতুন লাল মারুতি ভ্যান আর পুরনো ফিয়াট আছে। কিন্তু গাড়ি-টাড়ি নিয়ে সে কলকাতার বাইরে বেরোতে চায় না, তার অনেক ঝামেলা। জি টি রোডে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ট্রাফিক জ্যাম, মোড়ে মোড়ে চাঁদার খাতা।
আজকের ট্রেন ঝাঞ্ঝাটটা একটু অস্বাভাবিক, এমন সাধারণত হয় না। যা হোক, প্রাইভেট ট্যাকসিতে উঠে সে প্রথমে তারকেশ্বরেই যাওয়ার কথা বলল, কিন্তু ট্যাকসিওয়ালা বলল যে এ গাড়ি কলকাতার, সে কলকাতায় ফিরছে, তারকেশ্বর যেতে পারবে না। একটু দোনামোনা করে অবশেষে বাধ্য হয়েই কিশোর কলকাতা ফিরে যাওয়া সিদ্ধান্ত করল।
সন্ধ্যাবেলার জি টি রোডের ভিড়ে ভরতি রাস্তায় ফুঁকতে ধুকতে মন্থরগতিতে ট্যাকসি কলকাতার দিকে রওনা হল।
কিশোরের হাতে একটা শান্তিনিকেতনি চামড়ার ব্যাগে সপ্তাহ শেষের খোরাক দু-বোতল রাম, একটা ভোয়ালে আর একটা টুথব্রাশ রয়েছে।
হাওড়া শহরের মুখে জি টি রোডের একটা বাঁক যেখানে দীর্ঘ ঊকারের (ূ) জটিলতা নিয়েছে, অথচ বান মাছের লেজের মতো সূক্ষ্ম হয়ে গেছে, সেখানে ট্যাকসিটা রীতিমতো আটকে গেল গাড়ির জটলায়। কিশোর চারদিক পর্যবেক্ষণ করে বুঝল ঘণ্টাখানেকের আগে এ জট খোলার কোনও সম্ভাবনা নেই। তবে সান্ত্বনার কথা এই যে হাতের ব্যাগে দু-বোতল পানীয় রয়েছে।
লোডশেডিং চলছে। সন্ধ্যা বেশ জমাট হয়ে এসেছে। ধুলো, ধোঁয়া, গরম, অন্ধকার। কিশোর ধীরে ধীরে ব্যাগ খুলে একটা বোতলের ছিপি খুলে অল্প অল্প করে গলায় ঢালতে লাগল। একবার ড্রাইভার পিছন ফিরে তাকাতে দ্বিতীয় বোতলটা তার হাতে ধরিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে গরম, গাড়িতে ঘামতে ঘামতে বসে থাকা, ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করা–কোনও বোধই আর রইল না। ড্রাইভারের অবস্থাও তদ্রুপ। দুজনে ধীরে ধীরে চুক চুক রাম খেয়ে চলল।
এরপর রাত তখন প্রায় একটা। কখন যে ট্রাফিকের জট খুলেছে, ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে কলকাতার ভিতর চলে এসেছে, কিছুই হুশ হয়নি কিশোরের।
এখন একটু জ্ঞান হতে সে উঠে বসল। গাড়ির পিছনের সিটে সে, আর সামনের সিটে ড্রাইভার। ড্রাইভার এখনও বেহুঁশ।
জানলার বাইরে মেঘলা আকাশে ভাঙা চাঁদ উঠেছে। জায়গাটা বোধহয় লেকের কাছাকাছি কোথাও হবে। একটু চোখ কচলিয়ে নিয়ে দরজা খুলে গাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াল কিশোর। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। আশেপাশে একটু তাকিয়ে কিশোর ধরতে পারল, জায়গাটা শরৎ বসু রোড আর সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে লেকের মুখোমুখি।
গাড়িতে ওঠার পরে কিশোর ড্রাইভারকে বলেছিল শরৎ বসু রোডে তার বাড়ি। ড্রাইভার যে এত মদ খাওয়ার পরেও কোনও দুর্ঘটনা না করে এতদূরে আসতে পেরেছে সেটা ভাগ্যের কথা। তবে শরৎ বসু রোডের ওই মাথায় পদ্মপুকুরের পাশে একটা দোতলা বাড়িতে থাকে কিশোর, সে জায়গাটা এখান থেকে খুব কাছে নয়।
সামনের সিটে ড্রাইভারকে দুবার ধাক্কা দিয়ে তোলার চেষ্টা করল কিশোর। লোকটা দুবার হু হু করে, তারপর সিটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে গাঢ় নিদ্রায় নিমগ্ন হল। চাঁদের আলোয় কিশোর দেখতে পেল ওর পায়ের কাছে রামের বোতলটা পড়ে রয়েছে, তাতে এক-তৃতীয়াংশ পানীয় এখনও বর্তমান। কিশোরের নিজের বোতলটাও পিছনের সিটে রয়েছে কিন্তু সেটা খালি, তাতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
ড্রাইভারের পায়ের কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে বোতলটা তুলে নিল কিশোর। ড্রাইভার বোধহয় কিছু টের পেয়েছিল, ওই আচ্ছন্ন অবস্থাতেই মৃদু বাধাদানের চেষ্টা করল। কিশোর তার হাত ছাড়িয়ে বোতলটা বগলে নিয়ে টালমাটাল চরণে বাড়ির দিকে রওনা হল।
এখান থেকে নাক-বরাবর মাইল দুয়েক রাস্তা যেতে হবে। এটুকু রাস্তা মাতালের পক্ষে কিছুই। নয়, বিশেষ করে হাতের বোতলে এখনও যখন একটু পানীয় আছে। একটাই ভয়, হঠাৎ পা জড়িয়ে পড়ে না যায়। কিন্তু গাড়িতে ঘুমিয়ে নেশাটা এখন একটু ধাতস্থ হয়েছে। সুতরাং বোতল থেকে অল্প অল্প পানীয় গলায় ঢালতে ঢালতে বাড়ির পথে ভালই এগোল কিশোর।
এক সময়ে কিশোরের খেয়াল হল যে তার হাতের বোতল শূন্য হয়ে গেছে এবং সে নিজের বাড়ির সামনে এসে গেছে।
কিশোরের কাছে বাড়ির সদর দরজার একটা ডুপ্লিকেট চাবি থাকে। এই মাতাল অবস্থাতেই সেটুকু খেয়াল আছে তার। পকেট হাতড়িয়ে চাবিটা বার করল কিশোর, ভাগ্যিস গাড়ির মধ্যে পড়ে যায়নি, শান্তিনিকেতনি ব্যাগটা তো গাড়িতেই রয়ে গেল।
কিশোরের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। পরের বারের মদটা না খেলেই ভাল হত। তার হাত পা টলছে, কিছুতেই চাবি দিয়ে বাড়ির দরজাটা খুলতে পারছিল না কিশোর। বার বার চাবির মুখটা পিছলে পিছলে যাচ্ছিল।
হঠাৎ পিছন থেকে একটা পুলিশের কালো গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে নেমে এল লম্বাচওড়া হৃষ্টপুষ্ট গুম্ফমান এক হিন্দুস্থানি জমাদার। জমাদারজির গায়ে লংক্লথের ঢোলাহাতা পাঞ্জাবির সঙ্গে মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরা পায়ে কালো পামশু।
জমাদার সাহেব নেমেই প্রথমে কিশোরের হাত থেকে বোতলটা ছিনিয়ে নিলেন এবং সেটা শুন্য দেখে একটু রেগে সেটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তারপরে ঘাড়ের পেছন থেকে কিশোরের জামার কলারটা ধরে হুমকি দিলেন, এই মাতাল, এত রাতে হচ্ছেটা কী? চল, থানায় চল।
পুলিশ বুঝতে পেরে কিশোর একটু থমকিয়ে গেল, তারপর হেঁচকি তুলে বলল, জমাদারসাহেব, বাড়িতে ঢুকব, তাই দরজাটা চাবি দিয়ে খুলছি… বলে হাতের চাবিটা তুলে দেখাল।
জমাদারসাহেব অবাক হলেন, বাড়ি? দরজা? কেয়া বোলতা তুম?
কিশোর করজোড়ে বলল, হুজুর, এই আমার বাড়ির সদর দরজা আর দোতলায় ওই যে দেখছেন আলো জ্বলছে, ওটা আমার শোয়ার ঘর।
একটা খারাপ গালাগাল দিয়ে কিশোরের কলার ধরে শক্ত হাতের মুঠোয় একটা জোরে ঝকানি দিলেন জমাদার সাহেব।
ঝাঁকুনি খেয়ে কিশোরের মাথা থেকে কিছুটা অ্যালকোহল নেমে গেল। সে দেখতে পেল যে সে এতক্ষণ ধরে বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টটায় চাবি লাগানোর চেষ্টা করছিল এবং পোস্টের ওপরের বালবটাকে ভাবছিল তার দোতলার শোয়ার ঘরের আলো, যেটা জানলা দিয়ে রাস্তা থেকে দেখা যায়।
একটু সম্বিৎ ফিরে এসেছে কিশোরের। কিন্তু এখন জমাদারসাহেব তাকে ঘাড়ে ধরে পুলিশভ্যানের দিকে ঠেলা শুরু করেছে। সে কাকুতিমিনতি করতে লাগল, জমাদার সাহেব, ছেড়ে দিন। এই দেখুন, সত্যি এই সামনের দোতলা বাড়িটা আমার।
কিশোরের কথা শুনে জমাদারসাহেবের মনে হল, হয়তো লোকটা মিথ্যে কথা বলছে না। তা ছাড়া এত রাতে থানায় মাতাল নিয়ে যাওয়া সেও এক হাঙ্গামা। সুতরাং দেখা যাক সত্যিই এই সামনের বাড়িটা এই মাতালটার কিনা। তাহলে এটাকে ছেড়ে দিয়ে থানায় গিয়ে ঘুমনো যায়, রাতও অনেক হয়েছে।
জমাদারসাহেবের বজ্রমুষ্টি কিঞ্চিৎ শিথিল হতে কিশোর নিজের সদর দরজার দিকে এগোল। কর্তব্যপরায়ণ জমাদার সাহেব কিন্তু পিছু ছাড়লেন না।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পিতলের যুগ্ম নেমপ্লেটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল কিশোর, তারপর নিজের বুকে হাত রেখে বলল, ওই যে প্রথম লাইনে লেখা দেখছেন মি. কে কে পাল, ওই কে কে পাল কিশোরকুমার পাল হলাম আমি। আর নীচের লাইনে মিসেস এস পাল মানে মিসেস শ্যামা পাল হলেন আমার পত্নী।
আত্মপরিচয় শেষ করে দরজায় চাবি লাগিয়ে ঘোরাল কিশোর, দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে সিঁড়ির নীচের বাতিটা সুইচ টিপে জ্বালালো কিশোর। জমাদারসাহেব ইতস্তত করছিলেন, কিশোর তাঁকে অনুরোধ করল, আসুন, ভেতরে আসুন স্যার।
জমাদারসাহেব ভেতরে আসতে সামনের দেওয়ালে একটা বড় ফটো দেখিয়ে কিশোর বলল, এটা হল আমার শ্বশুরমশায়ের ছবি, মিস্টার পরেশচন্দ্র দাশ, আয়রন মার্চেন্ট, লোহাপট্টিতে নিজের গদি আছে।
আর সরেজমিন করার ইচ্ছা নেই জমাদারসাহেবের কিন্তু কিশোর তাকে জোরজার করে। দোতলায় তুলল। দোতলায় উঠে ছোট বারান্দা পেরিয়ে শোবার ঘর।
এবার একটা ছোট নাটক হল।
কিশোরের বউ শ্যামাসুন্দরীর চরিত্র বিয়ের আগে যেমন ছিল, বিয়ের পরেও তাই রয়েছে। মোটেই বদলায়নি। কিন্তু সে তার চরিত্রদোষের কথা ঘুণাক্ষরেও কিশোরকে টের পেতে দেয় না। তবু অত্যন্ত সেয়ানা হওয়া সত্ত্বেও আজ সে একেবারেই আঁচ করতে পারেনি যে, তার স্বামী যার সোমবার সকালে ফেরার কথা সে শুক্রবার রাত কাবার হওয়ার আগেই ফিরে আসবে।
শোয়ার ঘরে আলো জ্বলছিল, বড় ডাবল বেডের খাটে শ্যামা শুয়েছিল। সহসা ঘরের মধ্যে কিশোর ও জমাদারসাহেবের প্রবেশ। শ্যামা এবং শ্যামার সঙ্গী দুজনেই পরস্পরের কণ্ঠলগ্ন হয়ে ঘুমে অচেতন, কেউ কিছু টের পেল না।
শয়নঘরের ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দেখে জমাদারসাহেব বেরিয়ে আসছিলেন, তাকে হাতে ধরে দাঁড় করাল কিশোর, তারপরে বিছানার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই যে দেখুন, বালিশের ওপর খোলা চুল, নীল শাড়ি পরা ওই হল শ্যামাসুন্দরী আমার ওয়াইফ, আর ওর পাশে ওর গলা জড়িয়ে শুয়ে ওই হলাম আমি, কিশোরকুমার পাল, এই বলে কিশোর নিজেকে নির্দেশ করল।
অবস্থা কিছু বুঝতে না পেরে কিশোরের হাত ছাড়িয়ে জমাদারসাহেব তোবা তোবা করতে করতে এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় কালো গাড়িতে উঠে বসলেন। হুশ করে ধোঁয়া ছেড়ে ভ্যানটা চলে গেল।
জমাদারসাহেবকে আরও কিছু বোঝানোর জন্যে তার পিছু পিছু কিশোর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসেছিল। কিন্তু জমাদারসাহেব রণে ভঙ্গ দেওয়ায় সে বিফলমনোরথ হয়ে সিঁড়ির নীচের আলো নিবিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে দোতলায় উঠে গেল। তারপর গুটিসুটি হয়ে শ্যামাসুন্দরীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ আর ঘরের মধ্যে কথাবার্তা শুনে একটু আগেই শ্যামাসুন্দরীর ঘুম ভেঙেছিল। এমন বিপদে সে আর কখনও পড়েনি। সিঁড়ি দিয়ে কিশোর যখন নেমে গেল সে ভেবেছিল এখনকার মতো কিশোর বিদায় হল, পরে যদি আজকের ব্যাপারে কোনও কথা তোলে, ঝেড়ে অস্বীকার করবে। বলবে, মাতাল অবস্থায় কী না কী দেখেছ, তার ঠিক নেই।
কিন্তু এখন কিশোর এসে পাশে শুয়ে পড়ায় শ্যামাসুন্দরী বিচলিত বোধ করতে লাগল। তবু ভাল যে এপাশে শুয়েছে, ওপাশের লোকটার ওপরে গিয়ে পড়েনি!
কিশোরের মাথার মধ্যে কী সব এলোমেলো চিন্তা ঘুরছিল। একটু আগে সে কী একটা দেখেছে যেটা মোটেই ঠিক নয়। সে শ্যামাকে একটা ধাক্কা দিল, শ্যামা জবাব দিল, উ!
কিশোর শ্যামাকে বলল, ওগো আমাদের বিছানায় তোমার পাশে আর কেউ কি শুয়ে আছে?
এ প্রশ্ন শুনে শ্যামা ধমকিয়ে উঠল, কী-যা তা বলছ! মদ টেনে টেনে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে!
ধমক খেয়ে একটু চুপসিয়ে গেল কিশোর। কিন্তু তবুও তার মনের মধ্যে সন্দেহের কাটা খোঁচা দিতে লাগল। সে বালিশ থেকে একটু মাথা উঁচু করে নীচে পায়ের দিকে তাকিয়ে ভাল করে গুনল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ওগো, বিছানায় যদি আর কেউ না থাকবে তবে নীচের দিকে ছটা পা দেখা যাচ্ছে কী করে?
এ কথায় চতুরা শ্যামাসুন্দরী কপাল চাপড়িয়ে কেঁদে উঠল, ছিঃ ছিঃ, আমার নামে এই অপবাদ! আমি দুশ্চরিত্রা? আমি মিথ্যাবাদী?
বোকা বনে গিয়ে শ্যামাসুন্দরীর মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে কিশোর স্বীকার করল যে সে অনেক মদ খেয়েছে সন্ধ্যা থেকে, প্রায় দেড় বোতল। সুতরাং তার ভুল হতেই পারে। মাতালে তো সব জিনিসই বেশি বেশি দেখে। হয়তো চারটে পা-কেই সে ছটা পা দেখেছে, নেশার ঘোরে গুনতে ভুল করেছে।
শ্যামাসুন্দরী এখন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল, তুমি কী করে আমাকে দুশ্চরিত্রা ভাবলে! এসব মদ খেয়ে নেশার ঘোরে অনুমানের কথা নয়, তুমি একবার খাট থেকে নেমে আমাদের পা-গুলো গুনে এসো, তারপরে আমাকে বলল।
কিশোরের তখন মাথা টলছে তবু স্ত্রীর আদেশে খাট থেকে নেমে পায়ের কাছে গিয়ে খুব সতর্ক হয়ে বেশ কয়েকবার পায়ের সংখ্যা গুনল। বলা বাহুল্য, প্রত্যেকবারই পায়ের সংখ্যা দাঁড়াল চার। এক, দুই, তিন, চার–এইভাবে বারকয়েক গুনবার পরে কিশোর বলল, ওগো, আমাকে মাপ করে দাও। সত্যিই নেশার ঘোরে আমি পা গুনতে ভুল করেছিলাম। ঠিক দুজনার চারটে পা-ই রয়েছে। বিছানায়।
তারপর খাটের নীচে বসে অনুতপ্ত কিশোর সামনের পা-দুটো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। সে পা-দুটো যে কার কে জানে!