অন্য আর এক ছেলে – অনুবাদক: কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

অন্য আর এক ছেলে

‘নিনফারোসা বাড়ি আছে কি?’

‘হ্যাঁ, দরজায় টোকা দাও।’

টোকা দিয়ে বুড়ি মারাগ্রাৎসিয়া দরজার সামনের সরু সিঁড়ির উপর নিঃশব্দে গিয়ে বসল।

ওই সিঁড়িতেই সে বসে। সদর দরজার সামনেকার ওই ধরনের আরও নানা সিঁড়ির উপরেই তার বসবার জায়গা। ফার্নিয়া-গ্রামের হয় এ বাড়ি নয় ও বাড়ির দরজার সামনে জড়সড় হয়ে বসে, কখনও ঘুমিয়ে কখনও নিঃশব্দে অশ্রুপাত করতে করতে তার সময় কাটে। পথের কোনও লোক তার কোলে এক টুকরো রুটি কিংবা পয়সা ছুড়ে দিলে ঘুম থেকে সে বড় একটা জাগে না, চোখের জলও মোছে না, সেগুলো চুম্বন করে, ক্রস-এর চিহ্ন এঁকে হয় কাঁদে নয়তো ঢুলতে শুরু করে।

তাকে দেখলে মনে হয় বুঝি এক বস্তা পুরু তেল-চিটচিটে ছেঁড়া কাপড়। কি গ্রীষ্ম কি শীত, সর্বদা সে একইরকম— শতচ্ছিন্ন, ঘাম আর পথের ময়লার তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত। তার হলদেটে মুখের উপর রেখার ঘনজাল বোনা, চোখের পাতা খোলা, আর বীভৎস লাল। ক্রমাগত জল পড়ে-পড়ে ফুলে থাকে। কিন্তু সেই কুঞ্চিত রেখার মধ্যে, রক্ত ও অশ্রু-জলের ভিতর দিয়ে, একজোড়া উজ্জ্বল চোখ চকচক করে। সে চোখের দৃষ্টি বহুদূর প্রসারিত— সেখানে বিস্মৃত শৈশবের ছায়া। ক্ষুধিত মাছিগুলো সে চোখের উপর বসে। কিন্তু নিজের দুঃখের মধ্যে এমন গভীরভাবে ডুবে থাকে যে মাছিগুলোকে সে তাড়ায় না, এমনকী ভ্রুক্ষেপও করে না। তার শুকনো অল্প চুল মাথার উপর দু’ ভাগ হয়ে কানের পাশে জটার মতো ঝুলছে। যৌবনে যেসব ভারী গয়না সে পরেছিল তার চাপে কানের তলা দুটো ছিঁড়ে গেছে। একটি গভীর কালো ক্ষতচিহ্ন থুতনি থেকে শুরু হয়ে গলার লোল চামড়া বেয়ে নেমে ফাঁপা বুকের ভিতর অদৃশ্য হয়েছে।

যেসব মেয়েরা নিজেদের চৌকাঠের উপর বসে ছিল কেউই আর তার দিকে ফিরে চাইল না। তাদের কুঁড়ের সামনে বসে গল্প করে তারা প্রায় গোটা দিনটাই কাটিয়ে দিল। প্রত্যেকেই কোনও-না-কোনও কাজে ব্যস্ত— কেউ কাপড়ে তালি মারছে, কেউ রাঁধছে, কেউ-বা বুনছে। বাড়িগুলো একাধারে মানুষ আর পশুর বাসস্থান। যে-পাথরে রাস্তা তৈরি বাড়িগুলোর মেঝেও সেই পাথরেরই। দরজা দিয়েই শুধু আলো ঢুকতে পারে। তার একপাশে গোয়াল, সেখানে গাধা কিংবা খচ্চরগুলো মাছি তাড়াবার জন্যে সর্বদা লাথি ছুড়ছে। অন্যপাশে মনুমেন্টের মতো উঁচু হয়ে উঠেছে শোবার বিছানা। প্রত্যেক ঘরেই কফিনের মতো দেখতে পাইন কিংবা বীচ কাঠের একটি করে কালো লম্বা সিন্দুক, দুটো কিংবা তিনটে করে খড়ের গদিওলা চেয়ার, একটা করে বারকোশ আর কিছু চাষবাসের যন্ত্রপাতি। সে অঞ্চলে যেসব মহাত্মারা সাধারণের কাছে প্রিয়, ঝুলে ভরা বন্ধুর দেওয়ালের উপর তাঁদেরই আধপয়সা দামের এক-একটি ছবি টাঙানো। ধোঁয়া ও সারের বাষ্পাচ্ছন্ন পথের উপর তামাটে রঙের ছেলেরা খেলছে। কেউ সম্পূর্ণ উলঙ্গ, কারুর গায়ে বা ছোট-ছোট ময়লা ছেঁড়া শার্ট। মুরগিগুলো তাদের ভিতর সশব্দে ছুটে বেড়াচ্ছে। বাচ্চা শুয়োরগুলো কাদা মেখে ঘোঁত ঘোঁত করে স্তূপীকৃত আবর্জনার ভিতর গর্ত খুঁড়ছে।

পরের দিন সকালে দক্ষিণ আমেরিকায় যারা চলে যাবে তাদের কথাই মেয়েরা তখন আলোচনা করছিল।

একজন বলল, ‘সারো স্কোমা বউ আর তিন ছেলেকে ফেলে পালাচ্ছে।’

আর একজন খবর দিল, ‘ভিদো স্বরদিয়া তার পাঁচ ছেলে আর বউকে ফেলে চলেছে। বউটা আবার পোয়াতি।’

তৃতীয়জন প্রশ্ন করল, ‘কারমাইন রঞ্চা সত্যি নাকি তার বারো বছরের ছেলেটাকে গন্ধকের খনিতে কাজে লাগাবে বলে নিয়ে যাচ্ছে? হা ভগবান! বউটার কাছে ছেলেটাকে অন্তত রেখে যাওয়া উচিত ছিল। মেয়েটাকে কে-ই বা দেখবে এখন?’

কিছুদূরের রাস্তা থেকে চতুর্থ মেয়েটি করুণ সুরে বলল, ‘নানৎসিও লিগ্রোচির বাড়িতে সমস্ত রাত ধরে কী কান্নাটাই না সবাই কাঁদল! নানৎসিওর ছেলে নিচো যুদ্ধের কাজ থেকে ফিরে এসেই ঠিক করেছে সে-ও যাবে। কী চোখের জলটাই না ফেলছে সবাই।’

এ খবরে বুড়ি মারাগ্রাৎসিয়া কান্নার দমককে বাধা দেবার জন্যে নিজের মুখের উপর চাদরটা চেপে ধরল। কিন্তু তার শোকের তীব্রতা কমল না, ফোলা চোখের ভিতর থেকে অনর্গল জল পড়তে লাগল।

চোদ্দো বছর আগে তারও দু’টি ছেলে আমেরিকায় চলে গেছে। বলেছিল চার-পাঁচ বছর পরে ফিরে আসবে। কিন্তু সেখানে তারা উন্নতি করেছে— বিশেষ করে বড়টি। ফলে তাদের বুড়ি মাকে ভুলে গেছে। প্রত্যেক বারেই যখন নতুন একটি দল ফার্নিয়া ছেড়ে যায় নিনফারোসাকে দিয়ে বুড়ি চিঠি লিখিয়ে সেই দলের কাউকে ধরে অনুরোধ জানায় যেন সে নিজে হাতে চিঠিটা তার দুই ছেলের যে-কোনও একটিকে পৌঁছিয়ে দেয়। তারপর সেই দল যখন নিজেদের ভারী পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে সবচেয়ে কাছের ইস্টিশনে যাত্রা করে, তাদের মা-বোন বউয়ের কান্না আর হা-হুতাশের সঙ্গে যোগ দিয়ে সেই বুড়িও ধূলিমলিন দীর্ঘ পথ ধরে চলে। একবার এইভাবে যেতে যেতে সে স্থির দৃষ্টিতে লক্ষ করছিল একটি ছোকরা যাত্রী তার আত্মীয়দের সশব্দ শোকপ্রকাশে বাধা দেবার জন্যেই খুব হই-হল্লা করে ফুর্তি দেখাচ্ছে।

বুড়ির দিকে চেয়ে সে চেঁচিয়ে বলল, ‘কী গো পাগলা বুড়ি শালিখ! অমন করে দেখছ কী? আমার চোখ দুটো খসে পড়ুক, তাই চাও?’

‘না, বাপু, না। তোমার চোখ দুটোকে আমার হিংসে হচ্ছে। ওদের দিয়েই তো আমার ছেলেদের দেখবে! এখান থেকে যাবার সময় আমার যে অবস্থা দেখলে সে কথা জানিও আর বোলো আরও দেরি করলে আর তারা আমায় দেখতে পাবে না…’

পরের দিন যারা যাবে তাদের নিয়েই পাড়ায় তখনও আলোচনা চলছিল। কাছের গলিতে গাধার জিনে মাথা রেখে প্রায় চিত হয়ে এক বুড়ো নিঃশব্দে পাইপ টানতে টানতে কথাবার্তা শুনছিল। অকস্মাৎ তার কড়া-পরা হাত দুটো বুকের উপর গুটিয়ে থুথু ফেলে বলল, ‘আমি রাজা হলে সেখান থেকে ফার্নিয়ায় একটি চিঠিও আর আসতে দিতুম না।’

‘তোমার জয় হোক জাকো স্পিনা।’ একটি মেয়ে চেঁচিয়ে বলল।

‘কিন্তু পোড়াকপালি মা আর বউগুলো কোনও খবর আর সাহায্য না পেলে বাঁচবে কী করে?’

‘তারা বড় বেশি চিঠি দেয়, সে হয়েছে বিপদ’, বিড়বিড় করে বলে বুড়ো আবার থুথু ফেলল। ‘মায়েরা গতর খাটাতে পারে আর বউগুলো তো নষ্ট হলেই চলে… ছোঁড়াগুলো কেন যে সেখানকার কষ্টের কথা লেখে না তাই ভাবছি! তারা কেবল ভাল খবরগুলোই জানায়— আর তাই শুনে এখানকার মুখ্যু ছোঁড়ারা দল বেঁধে ছোটে। কে আমাদের খেতে কাজ করবে? ফার্নিয়াতে মানুষ বলতে আছে তো কেবল বুড়ো আর মেয়ে আর কাচ্চাবাচ্চা। চোখের সামনে দেখছি আমার সামান্য জমিজমা একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। শুধু একজোড়া হাত নিয়ে কী করতে পারি আমি? তবু তারা যাবে, তবু যাবেই! যাক, চুলোয় যাক। বাজ পড়ুক আহাম্মকগুলোর মাথায়।’

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা খুলল নিনফারোসা। হঠাৎ যেন সেই সংকীর্ণ পথে সূর্য উঠল। তার চকচকে কালো চোখ আর টকটকে লাল ঠোঁট। ঋ

জু অথচ মজবুত তার গড়ন, তার মধ্যে যেন বন্য এক উদ্দামতা। লাল ও হলদে বুটি দেওয়া মস্ত একটি রুমাল তার সুগঠিত স্তনের উপর গিঁট দিয়ে বাঁধা। কানে ভারী কানবালা। তার চুল কোঁকড়া কালো। মাথায় সিঁথি নেই। টেনে বেঁধে ঘাড়ের কাছে জড়িয়ে রুপোর একটি ছোরা দিয়ে গাঁথা। তার সুগোল থুতনির উপর গভীর টোল পড়ে। ফলে, তাকে দেখার নেশা আরও বেড়ে যায়, আর তার সমস্ত মুখের ভিতর চমৎকার একটি হাসিখুশি ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তার বিয়ের দু’ বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই নিনফারোসা বিধবা হয়েছিল। পাঁচ বছর আগে তার দ্বিতীয় স্বামীও তাকে ফেলে আমেরিকায় পালিয়েছে। কথাটা অবশ্য কারুরই জানবার নয়, কিন্তু এক রাত্রে গ্রামের এক মুরুব্বি ফলের বাগানের পথে আর খিড়কি দরজা দিয়ে তার কাছে গিয়েছিল। ফলে সচ্চরিত্র ঈশ্বরবিশ্বাসী প্রতিবেশীরা তার দিকে বাঁকাভাবে চাইত কিন্তু ভিতরে ভিতরে নিনফারোসার সৌভাগ্যকে হিংসেও করত। নিনফারোসার উপর তাদের আরও একটি রাগের কারণ ছিল। তার দ্বিতীয় স্বামী পালিয়ে যাওয়ার নিছক প্রতিহিংসা-বৃত্তি চরিতার্থ করতেই কতকগুলি মেয়ের নামে মিথ্যে দোষারোপ করে সে নাকি আমেরিকায় তাদের আত্মীয়দের কাছে স্বাক্ষরহীন একাধিক চিঠি পাঠিয়েছে— এই ধরনের একটি কানাঘুষোও গ্রামের মধ্যে শোনা যায়।

‘বক্তৃতাটা দিচ্ছে কে?’ গলিতে নেমে এসে সে প্রশ্ন করল। ‘ও, জাকো স্পিনা! জাকোখুড়ো, ফার্নিয়াতে কেবল আমরা, মেয়েরা, থাকলেই অনেক ভাল হত। আমরাই তা হলে মাঠ চষতুম।’

ভাঙা গলায় বিড়বিড় করে বুড়ো বলল, ‘মেয়েদের দিয়ে শুধু একটা কাজই হয়।’ বলে আবার সে থুতু ফেলল।

‘কী কাজ খুড়ো? বলো, বলতেই হবে।’

‘শুধু কাঁদা— আর, আরও একটা কাজ।’

‘তা হলে দুটো কাজ, তাই বলো! কিন্তু দেখছ তো আমি কাঁদি না।’

‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ, সে কথা আমার জানা আছে। তোমার প্রথম স্বামী মরবার পরেও তুমি কাঁদোনি।’

তৎক্ষণাৎ মুখের উপর জবাব দিল নিনফারোসা, ‘কিন্তু খুড়ো, আমি আগে মরলে সে-ও কি আর একটা বিয়ে করত না? নিশ্চয়ই করত। যাক গে সে কথা— আমাদের সবাইকার হয়ে সবচেয়ে বেশি কে কাঁদে দেখো— মারাগ্রাৎসিয়া।’

আবার চিত হয়ে শুয়ে জাকো স্পিনা বিড়বিড় করে বলল, ‘বুড়িটার জল ঝরা দরকার তাই সে চোখ দিয়েও জল ঝরায়।’

শুনে মেয়েরা হাসতে লাগল। তার ভাবনা থেকে জেগে মারাগ্রাৎসিয়া চেঁচিয়ে উঠল, ‘সূর্যের মতো সুন্দর দু’টি ছেলেকে আমি হারিয়েছি আর তোমরা আমাকে কাঁদতেও দেবে না?’

‘সুন্দর নিঃসন্দেহে। সত্যিই ভারী সুন্দর! তাদের জন্যে কাঁদা যায় বই কী’ — নিনফারোসা বলল। ‘সেখানে তারা সুখের সমুদ্রে সাঁতার দিচ্ছে আর তোমাকে এখানে ফেলে গেছে ভিখিরির মতো মরতে।’

‘তারা যে ছেলে আর আমি যে তাদের মা,’ উত্তরে বুড়ি বলল। ‘কী করে আমার দুঃখ তারা বুঝবে?’

‘আমি কিন্তু বাপু এত দুঃখ আর চোখের জলের কারণ বুঝি না,’ নিনফারোসা বলল। ‘লোকে তো বলে তুমিই তাদের যন্ত্রণা দিয়ে তাড়িয়েছ।’

আকাশ থেকে পড়ে মারাগ্রাৎসিয়া বলল, ‘আমি?’ দু’হাতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ‘আমি? কে বলেছে এ কথা?’

‘কেউ-না-কেউ বলেছে।’

‘তাদের মুখে আগুন! তাদের মুখে আগুন!— আমি? আমার ছেলেদের? আমি যে…’

বাধা দিয়ে একটি মেয়ে বলল, ‘কেন কান দিচ্ছ ওর কথায়? বুঝতে পারছ না ঠাট্টা করছে?’

কোমর থেকে তার দেহকে দুলিয়ে দুলিয়ে নিনফারোসা অনেকক্ষণ হাসল। তারপর এই নির্দয় ঠাট্টার ক্ষতিপূরণের জন্যে মিষ্টি সুরে প্রশ্ন করল, ‘ভাল কথা ঠানদি, তোমার কী দরকার বললে না তো?’

মারাগ্রাৎসিয়া বুকের ভিতর কম্পিত হাত ঢুকিয়ে বিশ্রী দোমড়ানো একটা কাগজ আর খাম বার করল। নিনফারোসাকে সেগুলি দেখিয়ে অত্যন্ত করুণভাবে রইল তাকিয়ে।

‘যদি তুমি বরাবর যে-রকম দয়া করো…’

‘কী বললে? আর একটা চিঠি?’

‘যদি তুমি দয়া করে…’

একটা বিরক্তি-সূচক শব্দ করল নিনফারোসা। কিন্তু কিছুতেই বুড়ির হাত থেকে নিস্তার নেই জেনে তাকে বাড়ির মধ্যে ডেকে নিয়ে গেল।

এখানকার অন্যান্য বাড়িগুলোর সঙ্গে এ বাড়িটার কোনও মিল নেই। দরজা বন্ধ থাকলে বড় ঘরটা প্রায় অন্ধকার হয়ে পড়ে, কারণ আলো আসবার অন্য আর একটি পথ হচ্ছে দরজার উপরকার ঝাঁঝরি দেওয়া জানালাটা। ঘরে লোহার খাট, জামাকাপড় রাখার দেরাজ, উপরে মার্বেল পাথর বসানো কয়েকটা ড্রয়ার এবং আখরোট কাঠের উপর খোদাই কাজ করা ছোট্ট একটি টেবিল। সত্যি কথা বলতে কী আসবাবপত্রগুলো নিতান্তই সাধারণ, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যায় গ্রামে সেলাইয়ের কাজ করে নিনফারোসার যা আয় তার উপর নির্ভর করে এগুলো কেনার মতো বিলাসিতা সে করতে পারে না।

সেই কুঁকড়ে যাওয়া কাগজটা ড্রয়ারের উপর রেখে দোয়াত-কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই লেখবার জন্য সে প্রস্তুত হল।

‘চটপট বলে ফেলো!’

‘আমার বাছারা’ বুড়ি বলতে শুরু করল।

‘কেঁদে-কেঁদে আমার চোখ প্রায় অন্ধ হয়ে এসেছে…’ একটি ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিনফারোসা লিখে চলল। এইসব চিঠিতে বরাবর কী যে লেখা হয় সে কথা তার কণ্ঠস্থ।

বুড়ি বলে চলল, ‘তোমাদের অন্তত শেষ দেখা দেখবার জন্যে আমার চোখদুটো ফুলে উঠেছে…’

‘থেমো না, থেমো না!’ তাড়া দিল নিনফারোসা। ‘এ সব কথা কম করে অন্তত তিরিশবার ওদের লিখেছ।’

‘তবু লেখো। জানো না কি কথাগুলো কত সত্যি? যাক, লেখো আমার বাছারা…’

‘আবার কি গোড়া থেকে শুরু করব?’

‘না। এবার অন্য কথা লিখতে হবে। গতকাল সমস্ত রাত ধরে ভেবে রেখেছি। শোনো বলি— আমার বাছারা— আমি, তোমাদের বুড়ি মা, শপথ করছি হ্যাঁ, এইবারে লেখো— ঈশ্বরের নামে শপথ করছি তোমরা ফার্নিয়ায় ফিরে এলে আমি বেঁচে থাকতে থাকতেই আমার কুঁড়েঘরটা তোমাদের দিয়ে দেব।’

হাসিতে ফেটে পড়ল নিনফারোসা। ‘ওই কুঁড়েঘরটা! তোমার ছেলেরা তো শুনি বেজায় বড়মানুষ। ওই কঞ্চির ওপর কাদা ল্যাপটানো চারটে দেওয়াল তাদের কোন কাজে লাগবে? ফুঁ দিলেই তো ভেঙে পড়বে ওগুলো!’

‘তুমি লেখো তো,’ নাছোড়বান্দার মতো বুড়ি আবার বলল। ‘নিজের দেশে চারটে ভাঙা পাথরের দাম বাইরের যে-কোনও রাজত্বের চেয়ে বেশি। লেখো, লেখো।’

‘লেখা হয়ে গেছে। আর কী লিখতে হবে বলো?’

‘এই যে বলছি— তোমাদের পোড়াকপালি মা শীতে ঠক-ঠক করছে। তার কিছু জামাকাপড়ের দরকার, কিন্তু টাকা কোথায়? তোমরা যদি দয়া করে তাকে একটা পাঁচ লিরার নোট পাঠাও তা হলে…’

‘হয়েছে, হয়েছে, হয়েছে!’ কাগজটাকে ভাঁজ করে খামে পুরতে পুরতে নিনফারোসা বলল। ‘এক্কেবারে ঠিক-ঠিক লিখে দিয়েছি। যথেষ্ট হয়েছে।’

‘ওই পাঁচ লিরার কথাটাও লিখেছ?’ এত চটপট লেখা হয়ে গেল দেখে বুড়ি বিস্মিত না হয়ে পারল না।

‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ, পাঁচ লিরার কথাটাও লেখা হয়েছে।’

‘ঠিকমতো লিখেছ তো? সব কথাগুলো?’

‘আঃ জ্বালাতন! হ্যাঁ, বলছি তো!’

‘এই বুড়িটার ওপর বিরক্ত হোয়ো না, মা,’ মারাগ্রাৎসিয়া বলল, ‘আমার কি আর মাথার ঠিক আছে? আজকাল তো ভীমরতি ধরেছে… ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।’

চিঠিটা নিয়ে সে বুকের ভিতর রাখল। নানৎসিও লিগ্রেচির ছেলের হাতে চিঠিটা দেবে বলে সে ঠিক করেছে। সান্টা ফে’র রোজারিও শহরে ছোকরা যাচ্ছে। সেখানেই তার ছেলেরা আছে। চিঠিটা পৌঁছে দেবার জন্যে বুড়ি বেরোল।

সন্ধে নাগাদ মেয়েরা যে যার ঘরে ফিরে গেল। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির দরজাই হল বন্ধ। কাঁধে মই নিয়ে যে লোকটা স্বল্পসংখ্যক কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে যায় সে ছাড়া সরু গলিতে আর কারুর সাড়াশব্দ নেই। সেইসব নিস্তব্ধ জনশূন্য অপরিষ্কার পথ এই মৃদু ম্লান আলোয় যেন আরও বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।

ঝুঁকে পড়ে বুড়ি মারাগ্রাৎসিয়া হাঁটছিল। এক হাতে চিঠিটা বুকে চেপে ধরে যেন তার ভেতর মাতৃস্নেহের উত্তাপ ভরে দিতে চায়। অন্য হাত দিয়ে সে বারবার নিজের পিঠ আর মাথা চুলকোয়। প্রতিবার নতুন চিঠি পাঠাবার সঙ্গে তার মনে নতুন আশা জেগে ওঠে— আশা হয় হয়তো এবারে তার ছেলেদের মন ভিজবে, তারা আসবে ফিরে। তার চিঠি যখন পড়বে, যখন জানতে পারবে বিগত চোদ্দো বছর ধরে সে কী পরিমাণ অশ্রুপাত করেছে, নিশ্চয়ই তখন সেই সুন্দর ও সুপুরুষ সন্তানরা তার কাতর অনুনয়কে ঠেলতে পারবে না…

কিন্তু এবারে যে চিঠিটা তার বুকে নিয়ে চলেছিল সেটা সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ খুশি হতে পারেনি। মনে হল নিনফারোসা যেন বড় বেশি তাড়াতাড়ি শেষ করেছে। বিশেষ করে শেষের দিকে, যেখানে জামাকাপড়ের জন্যে পাঁচ লিরার কথাটা আছে, সেখানটা সম্বন্ধে তার খুঁতখুঁতুনি একেবারেই গেল না। মাত্র পাঁচ লিরা! শীতে

তাদের মা কী দারুণ কষ্টই না পাচ্ছে— তার জামাকাপড়ের জন্যে ওই ক’টি টাকা পাঠানো তার ধনী ছেলেদের পক্ষে কিছুই তো নয়…

ইতিমধ্যে কুটিরের বন্ধ দরজার ভিতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগল— মায়েরা কাঁদছে তাদের ছেলেদের জন্যে; কাল সকালে তারা চলে যাবে।

‘হায় ছেলেরা,’ চিঠিটাকে আরও শক্ত করে বুকে চেপে মারাগ্রাৎসিয়া নিজের মনেই অস্ফুট আর্তনাদ করল, ‘কী করে তোরা ছেড়ে যেতে পারিস? ফিরবি বলে তোরা কথা দিস কিন্তু ফিরিস না… ওরে পোড়াকপালি মেয়ের দল, শুনিস না ওদের কথা! আমার ছেলেদের মতো তোদের ছেলেরাও কখনও ফিরবে না… কখনও ফিরবে না…’

গলির মধ্যে কার পায়ের শব্দ শুনে একটি আলোর তলায় হঠাৎ সে থেমে গেল। কে আসে?

যাক! আর কেউ নয়, গ্রামের সেই নতুন ছোকরা ডাক্তার, হালে সে এসেছে। লোকে বলছে শিগগিরই সে নাকি চলে যাবে। তাকে দিয়ে কাজ চলবে না বলে নয়, গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর লোকের সুনজরে সে নাকি নেই। গরিব লোকেরা কিন্তু তাকে দেখেই ভালবেসে ফেলেছে। দেখতে তাকে নেহাতই একটি ছোট ছেলের মতো কিন্তু বিদ্যা আর বুদ্ধিতে সে অতি বিচক্ষণ বিজ্ঞ লোক। গুজব সে-ও নাকি আমেরিকায় চলে যাবে ঠিক করেছে। তবু ভাল যে এখন তার আর মা নেই— একেবারেই সে একা।

মারাগ্রাৎসিয়া প্রশ্ন করল, ‘ডাক্তারবাবু, একটু কি সাহায্য করবেন?’

বিস্মিত হয়ে তরুণ ডাক্তার বাতির তলায় থামল। গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে একলা হাঁটতে হাঁটতে বুড়িকে সে লক্ষও করেনি।

‘কে তুমি? ওহো, তুমি… হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি নিশ্চয়ই সেই…’

তার মনে পড়ল এই ছেঁড়া কাপড়ের বস্তাকে একাধিকবার দেখেছে কোনও-না-কোনও সদর-দরজার সামনে।

‘ডাক্তারবাবু, আপনি কি দয়া করে এই ছোট্ট চিঠিটা একবার পড়ে শোনাবেন? এটা আমার ছেলেদের কাছে পাঠাতে হবে।’

‘যদি দেখতে পাই,’ বলল ডাক্তার। তার চোখ খারাপ। নাকের উপর চশমাটা সে ঠিক করতে লাগল।

বুকের ভিতর থেকে চিঠিটা বার করে নিনফারোসাকে যে কথাগুলো বলেছিল সেগুলো শোনবার জন্য মারাগ্রাৎসিয়া অপেক্ষা করে রইল— ‘আমার বাছারা’— কিন্তু না! হয় ডাক্তার লেখাগুলো দেখতে পাচ্ছে না নয়তো কী যে লেখা আছে পারছে না পড়তে।

কাগজটাকে সে চোখের খুব কাছে নিয়ে এল তারপর পথের আলো যাতে বেশি পড়ে সেজন্যে আবার নিয়ে গেল দূরে, এপিঠ দেখল, ওপিঠ দেখল, শেষটায় বলল, ‘কিন্তু এটা কী জিনিস?’

‘পড়তে পারছেন না নাকি?’ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল মারাগ্রাৎসিয়া।

কথা শুনে হাসতে আরম্ভ করল ডাক্তার।

‘কিছু না— লেখাই নেই কিছু।’ সে বলল। ‘কলম দিয়ে চারটে হিজিবিজি দাগ কাটা। এই যে, দেখো না।’

‘কী?’ ভয়ে বিস্ময়ে বুড়ি আর্তনাদ করে উঠল।

‘ঠিক তাই। দেখো একবার! কিচ্ছু নেই! একেবারে কিচ্ছুই লেখা নেই।’

‘এও কি সম্ভব?’ বুড়ি চিৎকার করে বলল। ‘কী করে সম্ভব? নিনফারোসাকে আমি বললুম, প্রত্যেকটি কথা বললুম তাকে, পরে স্বচক্ষে দেখলুম সে লিখছে।’

‘তা হলে নিশ্চয়ই সে লেখার ভান করেছিল,’ কাঁধ-ঝাঁকুনি দিয়ে ডাক্তার একটা হতাশার ভঙ্গি করল।

কয়েক মুহূর্তের জন্যে মারাগ্রাৎসিয়া যেন পাথর হয়ে গেল। তারপর সজোরে নিজের বুক চাপড়াতে চাপড়াতে সে গড়গড় করে বলে চলল, ‘হায় হায়! কী শয়তান! কী সাংঘাতিক শয়তান! কেন ঠকাল? এজন্যেই তা হলে ছেলেরা উত্তর দেয় না। চিঠির একটা কথাও তাদের কাছে পৌঁছয়নি… আমি যা বলেছি কখনওই সে তা লেখেনি… এটাই তা হলে আসল কথা! ছেলেরা তা হলে জানে না আমার অবস্থার কথা— তারা জানে না তাদের জন্যে ভেবে ভেবে আমার এই ভিখিরির হাল… আর আমি কিনা তাদের দোষ দিই… আর ডাক্তারবাবু, ওই বজ্জাত মাগিটা কিনা সবসময় আমাকে নিয়ে মস্করা করে! হা ভগবান! হা ভগবান! এক হতভাগী মা-র সঙ্গে কী করে কেউ এরকম শয়তানি করতে পারে, আমার মতো এক গরিব বুড়ি মেয়েমানুষের সঙ্গে? হায় হায়! কী শয়তানি… কী শয়তানি… হায় হায়!—’

শুনে ডাক্তারের মন সমবেদনায় ও বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল। তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল সে। বুড়ির কাছ থেকে সে জেনে নিল নিনফারোসা কে, কোথায় তার বাড়ি— যাতে পরের দিন মেয়েটাকে কষে ধমকে দিতে পারে। তার প্রবাসী পুত্রদের নীরবতাকে সে যে ক্ষমা করেছে বুড়ি কিন্তু তখনও বারবার সে কথা বলে চলেছে। তাকে ছেড়ে চলে যাবার জন্যে এতগুলো বছর ধরে সে যে দোষ দিয়েছে সে কথা মনে করে বুড়ি গভীর অনুতাপে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। ইতিপূর্বে যে চিঠিগুলো লেখা হয়েছে আর পাঠানো হয়েছে বলে তার বিশ্বাস তাদের যে-কোনও একটিও যদি ছেলেদের কাছে পৌঁছত তা হলে তৎক্ষণাৎ যে তারা বুড়ির কাছে ফিরে আসত, এতক্ষণে এ বিষয়ে সে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হয়েছে।

তারপর যা ঘটল সংক্ষেপে তা এই— ডাক্তারকে প্রতিজ্ঞা করতে হল পরের দিন সকালেই সে দীর্ঘ একটি চিঠি লিখে দেবে তার ছেলেদের।

‘যাক, যা হবার হয়েছে। আর ওরকম হা-হুতাশ কোরো না। সকালে আমার কাছে এসো। এখন নয়— এখন ঘুমুবার সময়। সকালে এসো। এখন ঘুমুতে যাও।’

কিন্তু কোনও ফল হল না। প্রায় দু’ ঘণ্টা পরে ফিরে যাবার সময় ডাক্তার দেখল পথের আলোর তলায় বসে বুড়ি অঝোরে কেঁদে চলেছে। ডাক্তার তাকে খুব খানিকটা বকুনি দিয়ে সেখান থেকে তুলল, তারপর বললে তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরে যেতে। রাত তখন অনেক হয়ে গেছে।

‘কোথায় থাকো তুমি?’

‘হায়, ডাক্তারবাবু… গ্রামের শেষে আমার একটা কুঁড়েঘর আছে। সেই শয়তান মাগিকে লিখতে বলেছিলুম আমি বেঁচে থাকতেই সে বাড়িটা ছেলেদের দিয়ে দেব— যদি তারা ফিরে আসে। শুনে সে মাগি হেসেই বাঁচে না। বাড়িটা নাকি কঞ্চির ওপর মাটি ল্যাপটানো চারটে দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমি’ —

‘হয়েছে, হয়েছে,’ আবার তাকে থামিয়ে দিল ডাক্তার। ‘এখন শুতে যাও, কাল বরঞ্চ বাড়িটার কথাও লিখে দেব। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

‘ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। কিন্তু বলছেন কী ডাক্তারবাবু? আমাকে পৌঁছে দেবেন? না-না, আপনি চলে যান। আমি একটা গরিব বুড়ি, আমার সঙ্গে আবার আসবেন কী? তা ছাড়া আমি হাঁটি খুব ধীরে ধীরে।’

বিদায় নিয়ে ডাক্তার চলে গেল। খানিকটা যেতে মারাগ্রাৎসিয়া তাকে অনুসরণ করল। যে দরজা দিয়ে ডাক্তার ভিতরে ঢুকল সেখানে পৌঁছে বুড়ি থামল, চাদরে ভাল করে ঢাকল সর্বাঙ্গ তারপর দরজার সামনেকার সিঁড়ির উপর বসল। সমস্ত রাত সেখানে সে অপেক্ষা করে কাটাবে।

ডাক্তার ভোরে ওঠে। প্রথম টহল দেবার জন্যে বেরিয়ে এসে সে দেখল, বুড়ি ঘুমিয়ে রয়েছে। দরজায় ঠেস দিয়ে সে ঘুমিয়েছিল। তাই, দরজা খুলতেই, ডাক্তারের পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ল।

‘কী আশ্চর্য! তুমি! লাগল না তো?’

‘না-না…ক্ষমা করবেন…’ তোতলাতে তোতলাতে বহু কষ্টে পায়ের উপর ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তার হাত দুটো তখনও চাদরে ঢাকা।

‘তুমি কি এখানেই রাত কাটিয়েছ?’

‘আজ্ঞে হাঁ…এ কিছুই নয়; আমার অভ্যেস আছে…’ দোষ ঢাকবার জন্য বুড়ি ব্যস্ত হয়ে উঠল। ‘আর কী করতে পারি বাছা? আমি স্থির থাকতে পারছি না…ও মাগির শয়তানির পর থেকে আমি স্থির থাকতে পারছি না…ডাক্তারবাবু, ওকে খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে! আমাকে বললেই তো পারত আমার হয়ে লিখতে সে বিরক্ত হয়। তা হলে তো অন্য কারুর কাছে যেতে পারতুম। আপনার কাছেই তো আসতে পারতুম, আপনার দয়ার শরীর…’

‘হয়েছে, হয়েছে, একটু অপেক্ষা করো,’ ডাক্তার বলল, ‘আমি ওই মহিলার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে আসি। তারপর চিঠিটা লেখা যাবে। একটু দাঁড়াও।’

গত রাত্রে বুড়ি যে দিকটা দেখিয়ে দিয়েছিল ডাক্তার দ্রুত পায়ে সেদিকেই চলে গেল।

গলির ভিতর একটি মেয়েকে সে প্রশ্ন করল নিনফারোসার বাড়ি কোনটা, পরক্ষণেই আবিষ্কার করল নিনফারোসার সঙ্গে সে কথা কইছে।

‘আমিই সে মেয়ে, ডাক্তারবাবু যাকে আপনি খুঁজছেন,’ গাল লাল করে হেসে উত্তর দিল, তারপর অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেল ভিতরে।

ছেলেমানুষের মতো সুন্দর ডাক্তারকে একাধিকবার পাশ দিয়ে চলে যেতে এর আগে সে দেখেছে। বরাবরই তার স্বাস্থ্য ভাল থাকায়, এমনকী অসুস্থতার ভান করাও সম্ভব না হওয়ায় কখনই তাকে ভিতরে ডাকতে পারেনি। তাই ডাক্তারের এই আগমনে মনে মনে সে খুশি হয়ে উঠল। গায়ে পড়ে ডাক্তার যে তার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে এ ঘটনায় বিস্মিত হল। কিন্তু ডাক্তার কেন এসেছে জানতে পেরেই মুখে তার বিরক্তির আর চিন্তার ছায়া দেখেই সে নিজে মুখের ভাব এমন নম্র মধুর করে তুলল যেন তার দিকে তাকিয়েই ডাক্তারের মন গলে যায়। তার মুখ দেখলেই বোঝা যায় ডাক্তারের অসন্তোষে কী পরিমাণ ক্ষুণ্ণ সে হয়েছে— যদিও এই অসন্তোষের কোনও মানে হয় না। ডাক্তার যতক্ষণ কথা বলল ততক্ষণ একবারও সে বাধা দিল না, মার্জিত ব্যবহার তার জানা আছে। কিন্তু যে মুহূর্তে সে কথা বলার সুযোগ পেল সেই মুহূর্তেই বলতে আরম্ভ করল:

‘আমাকে ক্ষমা করবেন ডাক্তারবাবু’— কথা বলতে বলতে তার সুন্দর কালো দু’টি চোখ আধবোজা হয়ে এল, ‘কিন্তু আপনি কি ওই পাগলি বুড়ির কথা শুনে সত্যি সত্যি আমার উপর রাগ করেছেন? এ গ্রামে সবাই ওকে চেনে ডাক্তারবাবু, আর কেউই এখন ওর কথায় কান দেয় না। আপনার যাকে খুশি জিজ্ঞেস করে দেখুন, প্রত্যেকেই বলবে তার দুটো ছেলে আমেরিকায় চলে যাবার পর থেকে গত চোদ্দো বছর ধরে ও পাগল হয়ে গেছে, একেবারে বদ্ধ পাগল। তার ছেলেরা সত্যি-সত্যিই তাকে ভুলে গেছে, কিন্তু এ কথা কিছুতেই সে মানবে না। বারবার কেবল চিঠি দিতে চাইবে। বুঝতেই পারছেন, কেবল ওকে খুশি করার জন্যই আমি চিঠি লেখার ভান করি। আর যারা চলে যাচ্ছে, তারা এমন ভান করে যেন চিঠিটা যথাস্থানে পৌঁছিয়ে দেবে। বেচারি সব কথাই বিশ্বাস করে। তার মতো সব লোক হলে পৃথিবীর কী যে অবস্থা হত একবার ভেবে দেখুন, ডাক্তারবাবু। আর জানেন, আমাকেও লোকে ছেড়ে গেছে আমার স্বামীই ছেড়ে গেছে— আমাকে। সত্যি, ডাক্তারবাবু! আর জানেন লোকটা কীরকম বেহায়া? সেখানে যে মেয়েটাকে জুটিয়েছে তার সঙ্গে নিজের একটা ছবি তুলে আমাকে আবার পাঠিয়েছে। দেখবেন সে ছবি? মাথায় মাথা ঠেকিয়ে, হাতের মধ্যে হাত দিয়ে —আপনার হাতটা দিন দেখিয়ে দিচ্ছি— হুঁ, ঠিক এইভাবে, বুঝতে পেরেছেন? যারা ছবিটা দেখবে, তাদেরই দিকে তাকিয়ে হাসছে ওরা দু’জন— অর্থাৎ আমারই মুখের ওপর হাসছে! হায় ডাক্তারবাবু… যারা যায় তাদের জন্যেই সবাই দুঃখ করে, কিন্তু যারা পড়ে থাকে কেউ ভাবে না তাদের কথা। জানেন, গোড়ায় গোড়ায় আমিও কত কেঁদেছি। তারপর কোনওরকমে শক্ত করেছি নিজেকে, আর এখন তো আমি দিব্যি আছি, এমনকী সুবিধে

পেলে ফুর্তিও করি। সংসার যে কী ধাতুতে গড়া তা তো জানতে আর বাকি নেই…’

এই সুন্দরীর বন্ধুত্বের জাদু এবং বন্ধুত্বের সহানুভূতির স্বাদ পেয়ে তরুণ ডাক্তার তো রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। চোখ নামিয়ে সে বলল, ‘কিন্তু— সম্ভবত বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্টই আপনার আছে, এদিকে এই গরিব বুড়ির…’

‘কার বললেন? তার?’ চপল সুরে বলে উঠল নিনফারোসা। ‘ইচ্ছে করলেই বাঁচবার মতো যথেষ্টই সে পেতে পারে— তার খাবার তৈরি করার, এমনকী মুখের কাছে এগিয়ে দেবার লোকেরও অভাব নেই— কিন্তু সে তা চায় না।’

‘কী বললেন?’ আবার মুখ তুলে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল ডাক্তার।

তার সুন্দর মুখে বিস্ময়ের ছায়া দেখে নিনফারোসা হাসিতে ফেটে পড়ল। আর তার সাদা সুগঠিত দাঁতের সারি দেখা গেল সেই হাসির ভিতর দিয়ে।

‘সত্যি কথাই বলছি! সে তা চায় না। তার আরও একটি ছেলে আছে— সবচেয়ে ছোট ছেলে। সে ছেলে চায় বুড়ি তার সঙ্গে থাকুক। বুড়ির যাতে কোনও অভাব অসুবিধে না ঘটে সে বিষয়েও লক্ষ রাখতে সর্বদাই সে প্রস্তুত।’

‘আর একটি ছেলে? ওই বুড়ির?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তার নাম রক্কো ত্রুপিয়া। কিন্তু তার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে বুড়ি রাজি নয়।’

‘কেন? কেন?’

‘বুড়িটা যে একেবারে উন্মাদ— বললুম না? যারা তাকে ছেড়ে পালিয়েছে তাদের জন্যেই দিনরাত কাঁদবে— এদিকে যে ছেলে হাতজোড় করে দাঁড়াবে তার কাছ থেকে খুদকুঁড়োও নেবে না… বাইরের লোকের কাছে সে হাত পাতবে হ্যাঁ, সেও ভাল— তবু নিজের ছেলের কাছে যাবে না।’

ডাক্তার মনে মনে আরও বেশি অবাক হল কিন্তু সে ভাব প্রকাশ না করে নিজের ক্রমবর্ধমান অস্বস্তিকে চাপা দেবার জন্য ভ্রুকুটি করে বলল, ‘সম্ভবত এই ছেলে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে।’

‘আমার কিন্তু তা মনে হয় না,’ নিনফারোসা বলল। ‘লোকটাকে দেখলে রাগী মনে হয় বটে, আর এ কথাও ঠিক সহজে সে খুশি হয় না— কিন্তু ভেতরটা তার ভাল। লোকটা সর্বদা কাজ নিয়েই থাকে— কাজ, স্ত্রী আর ছেলেপুলে এ ছাড়া তার জীবনে অন্য কোনও শখ নেই। যদি নিজের চোখে দেখতে চান তা হলে বেশি দূর আপনাকে যেতে হবে না। শুনুন, এই পথ ধরে প্রায় সিকি মাইল এগিয়ে যান, গ্রামের ঠিক বাইরে বাঁদিকে দেখবেন ‘স্তম্ভগৃহ’। সেটাই তার জায়গা, লোকটা চমৎকার এক খেত ভাড়া নিয়েছে। ভালই আয় হয় সেখান থেকে। সেখানে গেলেই বুঝবেন আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।’

ডাক্তার উঠে দাঁড়াল। কথাগুলো শুনে সত্যিই সে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া সেপ্টেম্বরের সুগন্ধী বাতাসে মনও তার প্রফুল্ল। বুড়িটার সম্বন্ধে সব কথাই তাকে জানতে হবে। সে বলল, ‘নিশ্চয়ই যাব।’

সেই রুপোর ছোরাটায় জড়ানো চুলগুলো ঠিক করে নেবার জন্যে নিনফারোসা তার হাতদুটো ঘাড়ের কাছে নিয়ে গেল। তার আধবোজা হাসি-হাসি চোখে নিমন্ত্রণের ইঙ্গিত এনে সে উত্তর দিল, ‘আপনার যাত্রা তবে শুভ হোক। কোনও দরকার হলেই জানাবেন।’

চড়াই উঠে এসে দম নেবার জন্যে ডাক্তার একটু থামল। দু’ পাশেই গরিব লোকের কয়েকটি কুঁড়েঘর। তারপরেই গ্রাম শেষ হয়েছে। গলিটা গ্রামের বড় রাস্তায় এসে পড়েছে। চওড়া উপত্যকার উপর দিয়ে এক মাইলেরও বেশি একেবারে সোজা এগিয়ে গেছে এই পথ, গভীর ধুলোয় ঢাকা। দু’ পাশে তার ফসলের খেত। অধিকাংশ খেতেরই ফসল কাটা হয়ে গেছে। সেখানে শুধু হলদে খড়ের গোড়াগুলো খোঁচা-খোঁচা হয়ে রয়েছে। বাঁ পাশেই চমৎকার নির্জন একটি পাইন গাছ দাঁড়িয়ে আছে বিরাট ছাতার মতো। ফার্নিয়ার যুবকদের বৈকালিক ভ্রমণের জায়গা এটি। উপত্যকার একেবারে শেষে নীল পাহাড়ের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। তার পিছনে সাদা ঘন মেঘ, ঠিক পেঁজা তুলোর মতো দেখতে, যেন ঝোপের ভিতর দিয়ে উঁকি মারছে। প্রায়ই দেখা যায় এক-একটি মেঘ দল ছেড়ে ধীরে ধীরে

আকাশে বেরিয়ে পড়ে তারপর ফার্নিয়ার পিছন থেকে ওঠা মন্তি মিরেত্তার উপর দিয়ে ভেসে যায়। তখন নীচেকার পাহাড় এক গম্ভীর লাল ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়, তারপর হঠাৎ আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সকালের গভীর প্রশান্তি মাঝে মাঝে গুলির শব্দে চুরমার হয়ে যায়। তখন সবেমাত্র লার্ক পাখিগুলো আকাশে উঠতে আরম্ভ করেছে। লার্কের ঝাঁক, ঘুঘুর ঝাঁক উপত্যকার উপর দিয়ে যখন উড়ে যায়, চাষিরা তখন গুলি করে। প্রত্যেকটি আওয়াজের পর রক্ষী কুকুরের হিংস্র চিৎকার বহুক্ষণ ধরে শোনা যায়।

চারপাশের শুকনো খেতগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে দ্রুত পায়ে ডাক্তার এগিয়ে চলল। প্রথম বর্ষণের পরেই খেতগুলো চষা হবে। অবশ্য চাষ করবার লোক বলতে গেলে প্রায় নেইই। গ্রামের চারদিকেই একটা করুণ ছন্নছাড়া চেহারা।

সামনেই নীচের দিকে সে দেখতে পেল ‘স্তম্ভগৃহ’। এ নামের কারণ হচ্ছে বাড়িটার একটা কোণ প্রাচীন এক গ্রিক মন্দিরের স্তম্ভের উপর ভর করে রয়েছে। সেই স্তম্ভের উপরের দিকটা ভাঙা আর চেহারাটাও অতি জীর্ণ। বাড়িটা আসলে কুৎসিত একটা কুঁড়ে— সিসিলির চাষিরা তাদের গ্রাম্য বাসস্থানের যে নাম দিয়েছে ‘রোবা’, এ বাড়িটা ঠিক তাই। ফণিমনসার ঘন জঙ্গলে তার পিছন দিকটা ঢাকা, সামনের দিকে রয়েছে একজোড়া ছুঁচলো আর বিরাট স্ট্ররিক গাছ।

‘কে আছ? বাড়িতে কেউ আছ কি?’ ডাক্তার গলা বাড়িয়ে হাঁক দিলে, কুকুরকে তার বড় ভয়, তাই সে মরচে-পড়া শীর্ণ গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল।

ন’-দশ বছরের একটি হৃষ্টপুষ্ট ছেলে বেরিয়ে এল। খালি পা, লালচে ঝাঁকড়া চুল রোদে পুড়ে ফ্যাকাসে। চোখদুটো তার বাচ্চা বুনো জন্তুর মতো সবুজ।

‘কুকুর আছে নাকি?’ প্রশ্ন করল ডাক্তার।

‘হ্যাঁ, কিন্তু কিছু বলবে না। ভারী শান্ত।’

‘তুমি কি রক্কো ত্রুপিয়ার ছেলে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তোমার বাবা কোথায়?’

‘ওদিকে খচ্চরের পিঠ থেকে সার নামাচ্ছে।’

‘কুটিরের সামনের দাওয়ায় বসে ছিল ছেলেটির মা। তার বড় মেয়ের চুল আঁচড়াচ্ছিল। মেয়েটির বয়েস বছর বারো। কোলে কয়েক মাসের ছোট ভাই। মেয়েটা বসে ছিল একটা ওলটানো লোহার বালতির উপর। আর একটা ছোট ছেলে সামনের জমিতে মুরগিগুলোর মধ্যে গড়িয়ে বেড়াচ্ছিল— তাকে দেখে তারা ঘাবড়াল না, শুধু সুন্দর দেখতে একটা মোরগ বিরক্ত হয়ে গলা বাড়িয়ে ঝুঁটিটা নাড়তে লাগল।

মেয়েটিকে লক্ষ করে তরুণ ডাক্তার বলল, ‘রক্কো ত্রুপিয়ার সঙ্গে একটু দরকার আছে। আমি গ্রামের নতুন ডাক্তার।’

কয়েক মুহূর্তের জন্য মেয়েটি চিন্তিত হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। তার স্বামীর সঙ্গে ডাক্তারের কী দরকার থাকতে পারে ভেবে পেল না। বাচ্চাটাকে সে দুধ খাওয়াচ্ছিল, বডিসটা তখনও খোলা রয়েছে। তার মোটা কাপড়ের শার্টটা ভিতরে ঠেলে, বোতাম লাগিয়ে, অতিথির জন্যে চেয়ার আনতে উঠল। ডাক্তার কিন্তু বসল না। মাটির উপরকার ছেলেটাকে পিঠ চাপড়ে আদর করতে লাগল। অন্য ছেলেটা দৌড়ল বাপকে ডেকে আনতে।

কয়েক মিনিট পরে শোনা গেল নাল লাগানো ভারী বুটের শব্দ, তারপর ফণিমনসার ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল রক্কো ত্রুপিয়া। তার পা দুটো লম্বা আর ধনুকের মতো বাঁকা। পিছনে একটা হাত রেখে চাষিদের স্বাভাবিক ভঙ্গিতে একটু কুঁজো হয়ে সে হাঁটে। তার বিরাট থ্যাবড়া নাক, অস্বাভাবিক লম্বা উপরের ঠোঁট, চাঁছা-ছোলা চোখ-মুখ— সব মিলে অনেকটা বাঁদুরে দেখতে। তার চুলগুলো লাল, আর ফ্যাকাসে মুখ ভরা আঁচিল। তার কোটরগত সবুজ চোখের দৃষ্টি যেমন বাঁকা, তেমনি চতুর।

কালো বোনা টুপিটাকে কপালের উপর থেকে সামান্য পিছনে ঠেলে এক হাত তুলে ডাক্তারকে সে অভিবাদন জানাল।

‘প্রণাম হই। কী আজ্ঞা বলুন।’

‘কথাটা আর কিছুই নয়,’ ডাক্তার আরম্ভ করল। ‘তোমার মা-র সম্বন্ধে গোটাকতক কথা বলতে এসেছি।’

রক্কো ত্রুপিয়ার মুখের ভাব বদলে গেল।

‘তার কি অসুখ হয়েছে?’

‘না, না,’ তাড়াতাড়ি জবাব দিল ডাক্তার। ‘সে যেমন থাকে তেমনই আছে। কিন্তু তুমি তো জানো সে কীরকম বুড়ি হয়ে গেছে, জামাকাপড় টুকরো-টুকরো, দেখবার কেউ নেই…’

ডাক্তারের কথা শুনতে শুনতে রক্কো ত্রুপিয়ার অস্বস্তি ক্রমে বাড়তে লাগল। শেষটায় নিজেকে আর সামলাতে পারল না।

‘আমাকে কি আর কিছু বলবার আছে ডাক্তারবাবু? যা আজ্ঞা করবেন তাই করব। কিন্তু আপনি যদি আমার মা-র কথাই শোনাতে এসে থাকেন তা হলে বিদায় দিন, কাজে ফিরে যাই।’

‘শোনো! তোমার দোষে যে তার এই দুর্গতি নয় সে কথা জানি,’ তাকে ধরে রাখার জন্যে ডাক্তার বলল। ‘আমি শুনেছি তুমি এমনকী…’

‘এদিকে আসুন ডাক্তারবাবু,’ কুটিরের দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে রক্কো ত্রুপিয়া অকস্মাৎ বলল। ‘বাড়িটা গরিব লোকের। কিন্তু আপনি গ্রামের ডাক্তার— হালে নিশ্চয়ই এর চেয়ে ভাল বাড়ি খুব বেশি দেখেননি। বিছানাটা দেখে যান— আমার বুড়ি মা-র জন্যে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। সে আমার মা, তাই তার সম্বন্ধে কোনও খারাপ কথা বলতে মুখে বাধে। এই দেখুন আমার বউ আর ছেলেমেয়েদের। ওদের মুখেই শুনুন আমার বুড়ি মাকে দেবীর মতো সর্বদা ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে আমি আদেশ দিয়ে রেখেছি কি না। ডাক্তারবাবু, নিজের মাকে সবসময় ভক্তি করা উচিত, নয় কি? কোন অপরাধে সে যে সমস্ত গ্রামের কাছে আমার মুখ পুড়িয়ে বেড়ায় জানি না। ভগবান জানেন গ্রামের লোকেরা আমাকে কী ভাবে… এ কথা সত্যি ছেলেবেলা থেকেই বাপের বাড়ির লোকের কাছেই আমি মানুষ আর বরাবরই মা আমার সম্বন্ধে উদাসীন বলে তাকে কখনও মায়ের মতো ভক্তি করতে শিখিনি। তবু তাকে বরাবরই ভক্তি করেছি, তার মঙ্গল কামনা করেছি। সেই হতভাগা ছেলে দুটো আমেরিকায় চলে যাবার পর এ বাড়িতে তাকে কর্ত্রী করে আনার জন্যে আমি দৌড়ে গিয়েছিলুম। কিন্তু না, তা তার পছন্দ হল না। গ্রামের মধ্যে ভিখিরি সাজতেই তার শখ হল, লোক হাসাল আর আমার মুখ পোড়াল।

‘সেই হাবাতে ছেলে দুটোর জন্যে গত চোদ্দো বছর ধরে আমাকে যে জ্বালা-যন্ত্রণায় পুড়তে হয়েছে সে কথা কখনও ভুলব না, আর আপনাকে দিব্যি গেলে বলে রাখলুম ডাক্তারবাবু, তাদের মধ্যে কেউ যদি কখনও ফার্নিয়ায় ফিরে আসে আমি তাকে নিশ্চয়ই খুন করব। এই চার ছেলে আর বউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে কথা কইছি এ কথা যেমন সত্যি, তারা ফিরলে যে খুন করব সে কথাও তেমনি সত্যি…’

রাগে কাঁপতে লাগল রক্কো ত্রুপিয়া। তার মুখ আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখ দুটো টকটকে লাল। হাত দিয়ে সে ঠোঁটের পাশেকার ফেনা মুছল।

তাকে দেখতে দেখতে সেই তরুণ ডাক্তারের মন বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। ‘বুঝলুম,’ একটু থেমে সে বলল। ‘এ কারণেই তা হলে তোমার মা এখানে থাকতে চায় না। ভাইদের এ রকম ঘেন্না করো বলেই সে আসতে চায় না এখানে। এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।’

‘ঘেন্না?’ ঘুসি পাকিয়ে পিছন থেকে হাতটা বার করে রক্কো ত্রুপিয়া হুংকার দিয়ে উঠল। ‘হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, এখন তাদের ঘেন্নাই করি। আমার আর মা-র এই দুর্দশার মূলে তারা আছে এ কথা ভেবে আমি তাদের ঘেন্নাই করি। ছেলেবেলায় তারা এখানে যখন ছিল বড় ভাইয়ের মতো সত্যিই তাদের ভালবাসতুম। প্রতিদানে আমার সঙ্গে তারা কেইন-এর মতো ব্যবহার করত। শুনুন ডাক্তারবাবু। তারা কেউই কোনও কাজ করত না, প্রত্যেকের জন্যে একা আমাকে খাটতে হত। তারা এসে বলত রাতের রান্নার কিছু নেই, মাকে উপোস করে রাত কাটাতে হবে—শুনে আমার খাবার দিয়ে দিতুম…তারা মাতাল হয়ে ঘুরত, বেশ্যার পেছনে টাকা ঢালত আর আমার ভাগ আমি দিয়ে দিতুম…তারা যখন আমেরিকায় চলে গেল আমার যথাসর্বস্ব তাদের দিয়েছিলুম—এই তো আমার বউকেই জিজ্ঞেস করুন না—তার মুখেই সব কথা শুনুন।’

‘তা হলে এর কারণ কী?’ প্রায় নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন করল ডাক্তার।

রক্কো ত্রুপিয়া শুকনো হাসল।

‘কারণ? কারণ আমার মা বলে আমি নাকি তার সন্তান নই।’

‘কী বললে?’

‘তাঁকেই শুধোন গে ডাক্তারবাবু। আর সময় নষ্ট করতে পারব না। খচ্চর বোঝাই সার নিয়ে আমার লোকেরা দাঁড়িয়ে আছে—এ সব কথা আর সহ্য হয় না। তাকেই শুধোন গে ডাক্তারবাবু। পেন্নাম হই।’

যেমন এসেছিল সেভাবেই ফিরে গেল রক্কো ত্রুপিয়া, পিছনে একটা হাত রেখে, কুঁজো হয়ে। তার দীর্ঘ পা-দুটো ধনুকের মতো বাঁকা। মুহূর্তের জন্যে ডাক্তারের দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করল, তারপর সে মুখ ফেরাল বাচ্চাদের দিকে—তারা যেন ভয়ে বোবা হয়ে গেছে। সে দেখল বউটি অস্বস্তিতে হাত কচলাচ্ছে। শেষে চোখ বুজে অসহায়ভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল:

‘ভগবানের উপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য উপায় নেই।’

গ্রামে ফিরেও ডাক্তারের এই অবিশ্বাস্য কাহিনির শেষটা জানবার কৌতূহল গেল না। তার দরজার সামনে বুড়ি বসে রয়েছে, ঠিক যেমনটি তাকে দেখে গিয়েছিল। এক রকম রুক্ষভাবেই তাকে ডাক্তার ভিতরে ডাকল।

‘তোমার ছেলের সঙ্গে কথা কয়ে এলুম। তোমার যে এখানে আরও এক ছেলে আছে সে কথা জানাওনি কেন?’

প্রথমে বিহ্বল হয়ে, পরে প্রায় ভীত ভাবেই চেয়ে রইল মারাগ্রাৎসিয়া। কপালে আর চুলের মধ্যে তার কম্পিত হাত চালাতে-চালাতে সে উত্তর দিল, ‘ও ছেলের কথা শুনলে আমার কালঘাম ছোটে ডাক্তারবাবু। দয়া করে তার কথা বলবেন না।’

‘কেন বলব না?’ রেগে প্রশ্ন করল ডাক্তার! ‘সে তোমার কী ক্ষতি করেছে? আমাকে বলতে হবে!’

‘সে কিছুই করেনি,’ তাড়াতাড়ি বুড়ি জবাব দিল। ‘সত্যি বলছি সে কোনও ক্ষতি করেনি আমার। বরং সব সময়েই সে ভাল ব্যবহার করেছে। কিন্তু আমি…আমি…দেখছেন ডাক্তারবাবু সে কথা বলতে গিয়ে আমার হাত কী রকম কাঁপছে? সে কথা আমি উচ্চারণ করতে পারব না! কারণ—কারণ—ও-লোকটা আমার ছেলে নয়, ডাক্তারবাবু!’

তরুণ ডাক্তারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।

‘কী বকছ—সে তোমার ছেলে নয়? তুমি বলছ কী? তোমার কি ভীমরতি ধরেছে, না কি পাগল হয়ে গেছ? সে কি তোমারই সন্তান নয়?’

ডাক্তারের রাগ দেখে বুড়ি মাথা নামিয়ে, রক্তাক্ত চোখের পাতা আধবোজা করে উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, বোধ হয় আমি বোকাই। পাগল? না! হা ভগবান, কেন আমি পাগল হলুম না। তা হলে তো এ জ্বলুনির হাত থেকে বেঁচে যেতুম…কিন্তু আপনি যে এখন নিতান্তই শিশু, তাই এমন কতগুলো কথা আছে যেগুলো ঠিক বুঝতে পারবেন না। আমার চুল সাদা হয়ে গেছে, বহুদিন ধরে বহু কষ্ট পেয়েছি, অনেক কিছু দেখেছি…এমন সব জিনিস দেখেছি আপনি যা ধারণাও করতে পারবেন না।’

‘কী এমন দেখেছ, কী? বলো!—’ আদেশের সুরে বলল ডাক্তার।

‘সাংঘাতিক কাণ্ড! ভয়ংকর জিনিস!’ মাথা দুলিয়ে বুড়ির শোক উথলে উঠল। ‘সেকালে আপনি জন্মাননি, আপনার কথা তখন স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ—এতদিন আগেকার কথা। তাদের আমি নিজের চোখে দেখেছি—আর তখন থেকেই আমার বুকের রক্ত জল হয়ে ঝরেছে…আপনি কি ক্যানেবার্দোর (গ্যারিবলদির নাম সিসিলির লোকেরা এইভাবে উচ্চারণ করত) নাম কখনও শুনেছেন?’

‘গ্যারিবলদি?’ বিস্মিত হয়ে ডাক্তার প্রশ্ন করল।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ক্যানেবার্দো। আমাদের দেশে এসে শহরে আর গ্রামে মানুষ আর ভগবানের প্রত্যেক বিধিব্যবস্থার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করেছিল। তার কথা কি শুনেছেন?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। তারপর! গ্যারিবলদির সঙ্গে এর কী সম্বন্ধ?’

‘সম্বন্ধ আছে বই কী মশাই। আপনি নিশ্চয়ই জানেন সেই লোকটা—সেই ক্যানেবার্দো এখানে এসেই সমস্ত শহরের সমস্ত জেলখানার দরজা খুলে দিয়েছিল। আপনি কল্পনা করুন আমাদের দেশের উপর কী অরাজকতার ঝড়ই না বয়ে গেছে—যারা পশু, যারা খুনে, যারা ডাকাত, যারা বছরের পর বছর জেলে বন্ধ থেকে একেবারে খেপে ছিল, তারা ছাড়া পেল! তাদের ভেতর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ছিল কোলা ক্যামিৎসি—ডাকাতের সর্দার সে। তার কবলে যারা পড়ত তাদের সে ফুর্তিসে মেরে ফেলত মশার মতো, মুখে বলত—এ আর কী—বারুদটা তাজা আছে কি না আর বন্দুকটা ঠিকমতো ভরা আছে কি না তারই শুধু পরখ করা হচ্ছে। খোলা জায়গায় সে থাকত। এদিক দিয়ে যাবার সময় ফার্নিয়ার ভেতর দিয়েই সে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল একদল সাঙ্গপাঙ্গ—তারা সবাই চাষি। তাদের নিয়ে সে খুশি ছিল না, দল ভারী করার জন্যে আরও অনেক লোক খুঁজছিল, আর যে তার চ্যালা হতে রাজি হয়নি তাকেই মেরে ফেলছিল। তখন সবে আমার কয়েক বছর হল বিয়ে হয়েছে, ওই দু’টি ছেলেও তখন জন্মেছিল—যারা এখন আমেরিকায়। পোজেত্তোর গোলাবাড়িতে আমরা তখন থাকতুম। আমার স্বামীতাঁর আত্মার শান্তি হোকসেটা ভাড়া নিয়েছিল। কোলা ক্যামিৎসি যাবার সময় তাকেও নিয়ে গিয়েছিলজোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আমার স্বামীকে…দিন দুই পরে দেখলুম সে ফিরে এসেছে, চেহারা একেবারে মড়ার মতো—সে যেন অন্য একটা মানুষ। তার কথা আটকে গিয়েছিল, তার চোখের মধ্যে ছিল বিভীষিকার ছায়া। বেচারা তার হাত দুটো ঢেকে ফেলল—সে হাত দিয়ে তাকে জোর করিয়ে যে কাজ করানো হয়েছিল সেই ঘেন্নায় সে হাত ঢেকেছিল। ‘ওগো!’ আমি তাকে বললুম— (তাঁর আত্মার শান্তি হোক)— ‘ওগো! তুমি কী করেছ?’ সে জবাব দিতে পারল না। ‘হ্যাঁ গো, তুমি কি ওদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছ? তোমাকে ধরলে কী হবে? তোমাকে যে খুন করবে!’ আমার মন বলল কী ঘটবে…কিছুদিন সে আমাদের সঙ্গে ছিল, হাত দুটো এইভাবে জামার ভেতর ঢুকিয়ে, মেঝের দিকে চেয়ে, উনুনের কাছ ঘেঁষে, চুপচাপ বসে থাকত—তার চোখ দুটো উন্মাদের মতো। তারপর সে বলল, ‘এর চেয়ে মরা ভাল।’ আর কিছু বলেনি। তিনদিন সে লুকিয়ে ছিল। চতুর্থ দিনে সে বাইরে বেরল—আমরা গরিব, কাজ না করলে চলে না। সে খেতে গিয়েছিল কাজ করতে। সন্ধে হয়ে এল—তবু সে ফিরল না। আমি অপেক্ষা করতে লাগলুম। হা ভগবান! কী ভাবেই না অপেক্ষা করেছি—কিন্তু তখনি জানতুম, ততক্ষণে সব ব্যাপারটাই বুঝতে পেরেছিলুম—তবু ভাবলুম, কে জানে? হয়তো তাকে প্রাণে তারা মারেনি—শুধুই হয়তো ধরে নিয়ে গেছে। ছ’দিন পরে জানতে পারলুম কোলা ক্যামিৎসি সদলবলে মন্টেলুসা ম্যানরে রয়েছে। জায়গাটা লিগুয়োরিয়ার সন্ন্যাসীদের। তারা সেখান থেকে পালিয়েছিল। প্রায় পাগলের মতোই সেখানেই হেঁটে গেলুম। ডাক্তারবাবু, সেদিন ছিল দারুণ ঝড়। সেরকম ঝড় জীবনে কখনও দেখিনি। আপনি কি কখনও হাওয়া চোখে দেখেছেন? সেদিন সত্যিই দেখতে পেতেন! মনে হচ্ছিল যেন সমস্ত খুন করা লোকের আত্মা মানুষ আর দেবতাকে ডেকে বলছে, প্রতিশোধ নাও। সেই ঝড়ের মধ্যেই চললুম আমি। আমাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে চলল। আমাকে যেন কুটিকুটি করে ফেলছিল সেই ঝড় আর আমার আর্তনাদ ঝড়ের হুংকারকে ছাপিয়েও শোনা যাচ্ছিল। আমি যেন উড়ে চললুম। অনেক উঁচুতে কালো পপলারের ঝোপের ভেতর সেই মঠে পৌঁছতে আমার ঘণ্টা খানেকও লাগল না। সেখানে পাঁচিলে-ঘেরা মস্ত একটা উঠোন ছিল। এখনও মনে আছে একপাশে ঝোপে আধঢাকা ছোট্ট দরজা দিয়ে ভিতরে যাবার পথ। গাছের শেকড়গুলো দেয়ালের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে। জোরে টোকা দেবার জন্যে একটা পাথর কুড়িয়ে নিলুম। ধাক্কার পর ধাক্কা দিয়ে চললুম, কিন্তু কিছুতেই তারা খুলল না। আমি ধাক্কা দিয়েই চললুম। শেষে তারা খুলল। হা ভগবান! কী দৃশ্য দেখলুম ভিতরে!—’

মারাগ্রাৎসিয়া দাঁড়িয়ে উঠল। আতঙ্কে তার সমস্ত মুখ কুঁকড়ে গেছে। তার আরক্ত চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। একটা হাত সে বাড়াল, আঙুলগুলো থাবার মতো শক্ত হয়ে উঠেছে। তার স্বর রুদ্ধ হয়ে এল, আর বলতে পারল না।

‘তাদের হাতে…’ অনেক পরে সে বলল, ‘তাদের হাতে…সেই শয়তানদের হাতে…তাদের হাতে…’

আবার সে থামল। কে যেন চেপে ধরল তার গলা আর দু’হাত দিয়ে কিছু ছুড়ে ফেলবার ভঙ্গি সে করতে লাগল।

শিউরে উঠে ডাক্তার প্রশ্ন করল, ‘তারপর?’

‘সেই উঠোনে তারা ভাঁটা খেলছিল…মানুষের মুন্ডু নিয়ে খেলছিল…ধুলোয় ঢাকা কালো কালো মুন্ডু…চুলের মুঠি ধরে তুলছিল তারা…আর…আর সেগুলোর মধ্যে ছিল একটা মুন্ডু, আমার স্বামীর…কোলা ক্যামিৎসি নিজেই সেটা ধরে ছিল…আমাকে সে দেখাল। বুক ফাটিয়ে গলা ছিঁড়ে আমি আর্তনাদ করে উঠলুম। এত জোরে চেঁচিয়েছিলুম যে খুনেরা পর্যন্ত শিউরে উঠল। থামাবার জন্যে কোলা ক্যামিৎসি আমার গলাটা টিপে ধরল আর তারপরেই দলের একটা লোক পাগলের মতো আক্রমণ করল তাকে। আর তাই দেখে সাহস পেয়ে চার-পাঁচজন—হয়তো দশজনই হবে—চারদিক থেকে তাকে ছেঁকে ধরল। সেই শয়তানের বর্বর অত্যাচার তারাও যথেষ্ট সয়েছিল তাই তারা বিদ্রোহ করল—আর জানেন, ডাক্তারবাবু, আমার চোখের সামনে দলের লোকের হাতে তার নিজের গলাটা কাটা পড়ল দেখে সত্যিই ভারী তৃপ্তি পেলুম!’

অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বুড়ি ঝুপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। সমস্ত দেহ তার শিউরে শিউরে উঠছে।

তরুণ ডাক্তার তাকে দেখতে লাগল। তার চোখে অনুকম্পা, বিতৃষ্ণা ও আতঙ্ক-মেশানো চাউনি। ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে এসে শান্তভাবে ভেবেও সে কিন্তু ঠিক বুঝল না এই বীভৎস গল্পের সঙ্গে তার অন্য ছেলের সম্বন্ধ কী। তাকে সে পরিষ্কার করে বলতে বলল।

‘দাঁড়ান!’ দম নিয়েই বুড়ি উত্তর দিল। ‘যে লোকটা বিদ্রোহ শুরু করে আমাকে বাঁচাতে এসেছিল তার নাম মার্কো ত্রুপিয়া।’

‘ওঃহো!’ বিস্মিত হয়ে বলল ডাক্তার। ‘তা হলে রক্কো…’

‘তারই ছেলে,’ উত্তর দিল মারাগ্রাৎসিয়া। ‘ডাক্তারবাবু, ভাল করে ভেবে দেখুন! আমার যে অবস্থা গিয়েছে তারপরেও কি ও লোকটাকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল? আমাকে পাবার জন্যে সে ঝুলোঝুলি করতে লাগল। তিন মাস ধরে তার কাছে আমাকে রেখেছিল, আমি চেঁচাতুম কামড়াতুম বলে আমার মুখ বন্ধ করে সে বেঁধে রাখত…তিনমাস পরে সরকার তাকে ধরে জেলে বন্ধ করে রাখল, সেখানেই কিছুদিনের মধ্যে মরেছিল লোকটা। কিন্তু ততদিনে আমি পোয়াতি হয়েছি। ডাক্তারবাবু, আপনার গা ছুঁয়ে বলছি আমার ভেতরটা আমি ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলুম—আমার মনে হয়েছিল আমি এক দানবের জন্ম দিতে চলেছি—তার হাত থেকে বাঁচবার কোনও উপায় নেই। মনে হল ছেলেটাকে কোনওদিন ছুঁতেও পারব না। তাকে মাই দিতে হবে এই কল্পনায় পাগলের মতো আমি আর্তনাদ করতুম। তার জন্মাবার সময় আর একটু হলেই তো মরেছিলুম। আমার মা-ই (তাঁর আত্মার শান্তি হোক) দেখাশুনো করত। ছেলেটাকে একবার দেখতেও দেয়নি। জন্মাবার পরেই তাকে সোজা তার বাপের বাড়িতে রেখে এসেছিল, সেখানেই সে মানুষ…এখন বলুন তো ডাক্তারবাবু, সে আমার ছেলে নয় এ কথাটা কি মিথ্যে?’

গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল বলে ডাক্তার প্রথমটা কোনও জবাব দিল না; শেষে বলল, ‘কিন্তু যাই হোক, সে তো তোমারই ছেলে, তার দোষ কী?’

‘কিছু না!’ বুড়ি উত্তর দিল, ‘কখনওই তাকে আমি দোষ দিইনি। সত্যি বলছি ডাক্তারবাবু, বরং তার প্রশংসাই করেছি। কিন্তু দূর থেকে দেখলেও তাকে সহ্য করতে না পারলে আমি কী করব বলুন? ডাক্তারবাবু, সে ঠিক তার বাপের মতো দেখতে হয়েছে—চেহারায়, গড়নে, গলার স্বরে। তাকে দেখলেই আমার হৃৎকম্প হয় আর কালঘাম ছোটে। আমি আর স্থির থাকতে পারি না, আমার মাথায় আগুন জ্বলে। আমি কী করব বলুন—?’

এক মুহূর্তের জন্যে থেমে হাতের উলটো পিঠে সে চোখ মুছল। তারপরেই ভয় হল যে-দল ফার্নিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তার আসল ছেলেদের জন্যে চিঠিটা না নিয়েই হয়তো চলে যাবে। তাই সাহসে বুক বেঁধে অন্যমনস্ক ডাক্তারকে সচেতন করে বলল, ‘আপনি যদি দয়া করে যা বলেছিলেন…’

ঝাঁকানি দিয়ে সেই যুবক তার ভাবনাগুলোকে যেন ঝেড়ে ফেলল। তারপর টেবিলের কাছে চেয়ারটা টেনে এনে জানাল সে প্রস্তুত। আবার সেই ঘ্যানঘ্যানে সুরে বুড়ি বলতে শুরু করল :

‘আমার বাছারা…’

—কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *