অন্যান্য রচনা
নাটক : ল্যাজারাস এবং তার প্রিয় মানুষ
চরিত্র সমূহ
ল্যাজারাস
মেরি, তার বোন
মার্থা, তার বোন
ল্যাজারাসের মা
ফিলিপ, একজন শিষ্য
একজন পাগল
দৃশ্য
ল্যাজারাসের গৃহ-সংলগ্ন বাগান। তার মা এবং বোনেরা।
সময় : সোমবার পড়ন্ত বিকাল; কবর থেকে নাজারেতের যিশুর পুনরুত্থানের পরদিন।
পর্দা উঠলে দেখা যাবে : মঞ্চের ডানদিকে মেরি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মার্থা মঞ্চের বামদিকে তাদের বাড়ির দরজার কাছাকাছি তাঁতে বসে আছে। মঞ্চের বামদিকে একটু নিচে বাড়ির কোনায় বসে আছে পাগল লোকটি দেয়ালে হেলান দিয়ে।
মেরি : (মার্থার দিকে ঘুরে) তুমি কোনো কাজ করো না। দু’একদিনের ভেতরে অনেক বেশি কাজও তুমি করোনি।
মার্থা : আসলে তুমি আমার কাজ নিয়ে ভাবছ না। আমার অলসতা তোমাকে ভাবিয়েছে, কাজ সম্পর্কে আমাদের শিক্ষক কী বলেছিলেন। আহ্ আমার প্রিয় শিক্ষক।
(একটা গভীর দীর্ঘ নীরবতা। কিন্তু তার ভেতরে পাগল লোকটা কথা বলছিল। তারা তা শুনতে পেলনা)
মেরি : খুবই দেরি হচ্ছে।
মার্থা : হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি খুবই দেরি হচ্ছে।
(এমন সময় তাদের মা ঘরের দরজা দিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করবেন)
মা : সে এখনও ফেরেনি?
মার্থা : না, মা, এখনও ফেরেনি।
(এবার তারা তিনজনই পাহাড়ের দিকে তাকাল)
পাগল : তিনি নিজে কখনও ফিরবেন না। তোমরা হয়তো দেখে থাকবে তার সবকিছুই হল একটা শ্বাস-প্রশ্বাস যা একটা শরীরের ভেতরে যুদ্ধ করছে।
মেরি : আমার মনে হয় এখনও সে অন্য জগৎ থেকে ফেরে নাই।
মা : যিশুর মুত্যু তাকে গভীরভাবে পীড়িত করেছে এবং গতকাল পর্যন্ত এক মুঠোর বেশি খাবার সে খায়নি এবং আমি জানি রাতে সে ঘুমায় না। যিশুর মৃত্যুর কারণেই তার এমন হয়েছে।
মার্থা : না, মা, তা নয়। অন্যকিছু, অন্যকিছু যা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না।
মেরি : হ্যাঁ, হ্যাঁ, অন্যকিছু একটা। আমি জানি। এইসব দিনগুলিতে আমি এসব জেনেছি, যদিও আমি তা ব্যাখ্যা করতে পারি না। তার চোখগুলি খুবই গভীর। সে আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালে মনে হয় সে আমার ভেতর দিয়ে কাউকে দেখছে। সে খুবই কোমল কিন্তু সেই কোমলতা অন্য কারও জন্য— এখানকার কারও জন্য নয় এবং সে চুপচাপ, যেন তার নীরবতার কারণ হচ্ছে মৃত্যু সিলমোহর করেছে তার ঠোঁটদুটিকে।
(আবার কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা)
পাগল : প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ভেতরে দিয়ে তাকায় অন্যকে দেখার জন্য।
মা : (নীরবতা ভাঙলেন) সে কি ফিরে আসবে! অনেকগুলি সময় সে ঐ পাহাড়ের ভেতরে কাটিয়েছে। তার এখানে আমাদের সঙ্গে থাকা উচিত।
মেরি : মা, বহুদিন হয়ে গেছে সে আমাদের সঙ্গে নেই।
মার্থা : শুধুমাত্র তিন দিন ছাড়া সে সবসময়ই আমাদের সঙ্গে আছে।
মেরি : তিনদিন? তিনদিন। হ্যাঁ মার্থা তুমি ঠিক বলেছে। এটা ছিল শুধুমাত্র তিনদিন।
মা : আমি চাই আমার ছেলে বাড়ি ফিরে আসুক।
মার্থা : সে খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবে। তুমি মোটেও চিন্তা করোনা।
মেরি : (অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে) কখনও কখনও আমার মনে হয় সে পাহাড় থেকে কখনও ফিরে আসবে না।
মা : যদি সে কবর থেকে ফিরে আসে তাহলে আমি নিশ্চিত সে পাহাড় থেকেও ফিরে আসবে এবং আমার কন্যারা, চিন্তা করো সেই একজন সম্পর্কে যে আমাদেরকে তাঁর জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে।
মেরি : আহ কী রহস্যময় এটা এবং কী বেদনার।
মা : হায়, চিন্তা করো তাদের সম্পর্কে যারা তাঁর প্রতি প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতা দেখাল, যিনি আমার ছেলেকে আমার বুকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
(নীরবতা)
মাৰ্থ : কিন্তু ল্যাজারাসের উচিত নয় এতক্ষণ পাহাড়ের ভেতরে থাকা।
মেরি : স্বপ্নের ভেতরে যে-কোনো মানুষের জন্য সহজ অলিভকুঞ্জের ভেতরে পথ হারিয়ে ফেলা। আমি একটা জায়গা চিনি যেখানে ল্যাজারাস বসতে এবং বসে বসে স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করত। আহ্ মা, জায়গাটা খুবই সুন্দর, একটা ছোট্ট নদীর ধারে। তুমি যদি জায়গাটা না চেনো তাহলে তুমি তা খুঁজে পাবে না। সে আমাকে একবার সেখানে নিয়ে গিয়েছিল এবং আমরা দুটো পাথরের ওপর বসেছিলাম শিশুর মতো। তখন ছিল বসন্ত এবং আমাদের চারপাশে অসংখ্য ফুটে থাকা ফুল। শীতকালে আমরা প্রায়ই ঐ স্থান সম্পর্কে কথা বলতাম এবং প্রতিবারই যখন সে ঐ জায়গা সম্পর্কে কথা বলত তখন তার চোখে একটা অদ্ভুত আলো দেখতে পেতাম।
পাগল : হ্যাঁ, সেই অদ্ভুত আলো যা তার ছায়াকে ছুঁড়ে দিত অন্য আলোর দিকে।
মেরি : মা, তুমি জানো ল্যাজারাস সবসময়ই আমাদের কাছ থেকে দূরে থেকেছে যদিও সে আমাদের সঙ্গে ছিল।
মা : তোমার অনেক কথাই আমি বুঝতে পারি না। (বিরতি) আমি চাই আমার ছেলে পাহাড় থেকে ফিরে আসুক। (বিরতি) যাই দেখি তরকারিটা বোধ হয় পুড়েই গেল।
(দরজা দিয়ে মায়ের প্রস্থান)
মার্থা : আমার ইচ্ছা তুমি যা বলো তা যেন আমি পুরোপুরি বুঝতে পারি মেরি। যখন তুমি কথা বলো তখন মনে হয় অন্য কেউ কথা বলছে।
মেরি : (সামান্য অদ্ভুত কণ্ঠে) জানি বোন, জানি। যখনই আমরা কথা বলি তখনই কেউ একজন আমাদের ভেতর দিয়ে কথা বলে। (দীর্ঘ বিরতি। মেরি তার চিন্তার ভেতরে ডুবে আছে। তাকে দেখে মনে হয় সে দূরবর্তী কোনো মানুষ। আধা-ঔৎসুক্য নিয়ে মার্থা তাকে লক্ষ্য করতে থাকে। ল্যাজারাস প্রবেশ করে। সে পাহাড় থকে ফিরে এসেছে। সে বাড়ির কাছাকাছি একটা কাঠবাদাম গাছের নিচে ঘাসের ওপর বসে পড়ে)
মেরি : (তার দিকে দৌড়ে যায়) আহ, ল্যাজারাস, তুমি খুব ক্লান্ত এবং চিন্তিত। তোমার এত বেশি হাঁটা উচিত হয়নি।
ল্যাজারাস : (যেন সে উপস্থিত নেই এরকমভাবে কথা বলছে) হাঁটাহাঁটি, শুধুই হাঁটাহাঁটি এবং কোথাও না-যাওয়া, অনুসন্ধান করা এবং কিছুই না-দেখা। তবে পাহাড়ের ভেতরে একা থাকা খুবই চমৎকার।
পাগল : ভালো, এটা হল অন্য পাহাড়ের কাছাকাছি একটা সুন্দর জায়গা।
মার্থা : কিন্তু তুমি ভালো নেই এবং সারাদিন তুমি আমাদের ভেতরে নেই এবং আমরা তোমার ব্যাপারে খুবই চিন্তিত। এখন তুমি ফিরে এসেছ এবং আমরা তাতেই খুশি। কিন্তু আমাদেরকে এখানে একা ফেলে গিয়ে আমাদের সুখকে তুমি দুশ্চিন্তায় পরিণত করেছ।
ল্যাজারাস : (পাহাড়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে) আমি কি অনেকক্ষণ তোমাদের ছেড়ে গেছি? কী অদ্ভুত, পাহাড়ের ভেতরে কয়েক মুহূর্ত থাকাকে তোমরা আলাদা হওয়া বলছ? আমি কি প্রকৃতঅর্থেই এক মুহূর্তের বেশি পাহাড়ের ভেতরে ছিলাম?
মার্থা : তুমি সারাদিন পাহাড়ের ভেতরে ছিলে।
ল্যাজারাস : চিন্তা করতে, কেবলই চিন্তা করতে! একটা পুরো দিন পাহাড়ের ভেতরে! কে তা বিশ্বাস করবে?
(নীরবতা। মা প্রবেশ করেন বাড়ির দরজা দিয়ে)
মা : প্রিয় পুত্র আমার। তোমার ফিরে আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি যদিও খুব দেরি করে ফেলেছ এবং এখন পাহাড়ের ওপরে জড়ো হচ্ছে ধোঁয়াশা, আমার ভয় করছিল তোমার কথা ভেবে।
পাগল : তারা ধোঁয়াশা সম্পর্কে ভীত। ধোঁয়াশা হচ্ছে তাদের শুরু এবং শেষ।
ল্যাজারাস : হ্যাঁ, আমি পাহাড় থেকে তোমার কাছে ফিরে এসেছি। দয়া করো তাকে। দয়া করো সবকিছুকে
মা : এর অর্থ কী ল্যাজারাস? দয় করো সবকিছুকে?
ল্যাজারাস : কিছু না মা, কিছু না
মা : তুমি অদ্ভুতভাবে কথা বলো, আমি তোমার কথা বুঝতে পারি না ল্যাজারাস। তোমার ফিরে আসা সম্পর্কে তুমি সামান্যই বলেছ। কিন্তু তুমি যা বলেছ তা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছে।
মার্থা : হ্যাঁ অদ্ভুত।
(বিরতি)
মা : এখন এখানেও জড়ো হচ্ছে ধোঁয়াশা। চলো আমরা বাড়ির ভেতরে যাই, চলো মেয়েরা, চলো।
(মা ল্যাজারাসকে চুম্বন করলেন এবং বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন)
মার্থা : হ্যাঁ, বাতাস কনকনে ঠাণ্ডা। আমাকে এখনই তাঁত ও লিনেনগুলো ভেতরে নিয়ে যেতে হবে।
মেরি : (ল্যাজারাসের পাশে গিয়ে ঘাসের ওপর বসে এবং মার্থাকে বলে) এপ্রিল মাসের এরকম সন্ধ্যা তাঁত বোনার জন্য মোটেই সুবিধার নয়। আমি কি তোমাকে এগুলো ভেতরে নিতে সাহায্য করব?
মার্থা : না, না, আমি নিজেই পারব। আমি সব সময়ই একা একা এসব করেছি। (মার্থা তাঁত নিয়ে বাড়ির ভেতরে গেল, তারপর ফিরে এসে লিনেনের কাপড়গুলো নিয়ে আবার বাড়ির ভেতরে চলে গেল। হঠাৎ করেই জোরে বাতাস বয়ে গেল। দুলে উঠল কাঠবাদাম গাছ এবং পাপড়ির একটা স্রোতপ্রবাহ নেমে এল মেরি ও ল্যাজারাসের ওপর
ল্যাজারাস : বসন্ত আমাদেরকে স্বস্তি দেবে এমনকি বৃক্ষরাও কাঁদবে আমাদের জন্য। পৃথিবীর ওপর যা আছে তার সবকিছু যদি জানতে পারে আমাদের পতন এবং আমাদের মর্মপীড়া তাহলে তা আমাদেরকে দয়া দেখাবে এবং কাঁদবে আমাদের জন্য।
মেরি : কিন্তু বসন্ত আমাদের সঙ্গে আছে এবং যদিও তা দুঃখের অবগুণ্ঠনে অবগুণ্ঠিত, যদিও এটা বসন্ত। করুণা সম্পর্কে কথা বোলো না। বরং চলো আমরা আমাদের বসন্ত ও বেদনাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করি এবং চলো মধুর নীরবতার ভেতরে আমরা বিস্মিত হই তাঁকে দেখে যিনি তোমাকে জীবন দিয়েছিলেন, যদিও প্রাকৃতিক রীতিতে উৎপন্ন করেছিলেন নিজের জীবন। সুতরাং করুণা সম্পর্কে কথা বোলো না ল্যাজারাস।
ল্যাজারাস : করুণা, যাকে আমি হৃদয়ের ক্ষুধা ও আকাঙ্ক্ষার হাজার হাজার বছর থেকে ছিঁড়ে নেব। করুণা, যাকে আমি হাজার হাজার বসন্তের পর এই শীতে পরিণত করেছিলাম।
মেরি : ভাই আমার, তুমি কী বলতে চাও? কেন তুমি হাজার হাজার বসন্তের কথা বলো? তুমি মাত্র তিন দিন আমাদের থেকে দূরে আছ। মাত্র তিনদিন। কিন্তু বস্তুতপক্ষে আমাদের দুঃখ ছিল তিনদিনের তুলনায় অনেক বেশি।
ল্যাজারাস : তিনদিন? যেন তিন শতাব্দী, তিনটি অপরিমেয় কাল। সময়ের সবটুকু! একজনের সঙ্গে আমার আত্মা সময়ের সবটুকুকে ভালোবেসেছিল সময় শুরু হওয়ার আগেই।
পাগল : হ্যাঁ, তিনদিন, তিনটি শতাব্দী, তিনটি অনন্তকাল। বিস্ময়কর হল তাদের সবসময় পরিমাণ ও পরিমাপ করা হবে। এটা সবসময়ই হচ্ছে একটা সূর্যঘড়ি এবং একজোড়া তুলাদণ্ড।
মেরি : একজনের সঙ্গে তোমার ভালোবাসা ছিল সময় শুরুর আগেই? ল্যাজারাস, কেন তুমি একথা বলছ? এটা একটা স্বপ্ন, যে স্বপ্ন তুমি দেখেছিলে অন্য এক বাগানে। আমরা এখন এই বাগানে, জেরুজালেম থেকে নিক্ষেপ করা একটা পাথর। আমরা এখন এখানে এবং তুমি ভাল করেই জানো ভাই, আমাদের শিক্ষক জীবন এবং ভালোবাসার এই জাগরণের ভেতরে আমাদের সঙ্গে থাকবেন এবং থাকবে তাঁর অত্যন্ত উৎসাহী শিষ্যরা তাঁর মহিমার জীবন্ত সাক্ষ্য হয়ে।
ল্যাজারাস : এখানে কোনো স্বপ্ন নেই, নেই কোনো জাগরণ। তুমি, আমি এবং এই বাগান হচ্ছে একটা মোহ, বাস্তবতার একটি ছায়া। জাগরণ হচ্ছে সেখানে, যেখানে আমি ছিলাম আমার প্রিয় মানুষ এবং বাস্তবতার সঙ্গে।
মেরি : (উঠে দাঁড়াল) তোমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ?
ল্যাজারাস : (উঠে দাঁড়াল) আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ
পাগল : হ্যাঁ, হ্যাঁ। তার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ? কুমারী মহাশূন্য, প্রতিটি মানুষেরই অত্যন্ত প্ৰিয়।
মেরি : কিন্তু কোথায় তোমার সেই প্রিয় মানুষ? কে তোমার প্রিয় মানুষ?
ল্যাজারাস : আমার জমজ হৃদয় যাকে আমি অনুসন্ধান করেছিলাম এখানে এবং তা খুঁজে পাইনি। তারপর মৃত্যু, সেই পাখাযুক্ত দেবদূত এসেছিল এবং আমার আকাঙ্ক্ষাকে নেতৃত্ব দিয়েছিল তার আকাঙ্ক্ষার কাছে এবং আমি তার সঙ্গে বসবাস করেছিলাম ঈশ্বরের হৃদয়ে। আমি তার কাছাকাছি হয়েছিলাম এবং সেও আমার কাছাকাছি হয়েছিল এবং আমরা একজনে পরিণত হয়েছিলাম। আমরা ছিলাম একটা বলয় যা সূর্যালোকে জ্বলজ্বল করে এবং আমরা ছিলাম নক্ষত্রদের ভেতরে একটা সংগীত। সবকিছু মেরি, এই সবকিছু এবং তারও বেশিকিছু, একটি কণ্ঠস্বর, গভীরতা থেকে উঠে আসা একটি কণ্ঠস্বর, একটি পৃথিবীর কণ্ঠস্বর আমাকে আহ্বান জানায় এবং সেই কণ্ঠস্বর, যা ছিল অবিচ্ছেদ্য এবং হাজার হাজার বছর আমার অত্যন্ত প্ৰিয় মানুষের সঙ্গে মহাশূন্যের ভেতরে সেই কণ্ঠস্বরের ক্ষমতা আমাকে রক্ষা করতে পারবে না যা আমাকে পেছনে আহ্বান জানায়।
মেরি : (আকাশের দিকে তাকায়) হে আমাদের নীরব সময়ের আশীর্বাদকৃত দেবদূতেরা আমাকে এসব উপলব্ধি করতে সাহায্য করুন। মৃত্যুর আবিষ্কৃত এই নতুন ভূমিতে আমি বহিরাগত হতে চাই না। প্রিয় ভাই আমার, আরও কিছু বলো, বলে যাও। আমি বিশ্বাস করি আমি তোমাকে অনুসরণ করতে পারি।
পাগল : যদি পারো তবে তাঁকে অনুসরণ করো হে নারী। কচ্ছপ কি হরিণকে অনুসরণ করবে?
ল্যাজারাস : আমি ছিলাম একটা নদী এবং আমি অনুসন্ধান করেছিলাম সমুদ্র যেখানে আমার প্রিয় মানুষ বসবাস করে এবং যখন আমি সমুদ্রে পৌঁছেছিলাম তখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পাহাড়ে পাথরখণ্ডের ভেতর দিয়ে আবার দৌড়ানোর জন্য। আমি ছিলাম একটা গান নীরবতার ভেতরে বন্দি, যা ছিল আমার প্রিয় মানুষের হৃদয়ের জন্য একটা আকাঙ্ক্ষা এবং যখন স্বর্গের বাতাস আমাকে মুক্ত করেছিল এবং আমাকে উচ্চারণ করেছিল সবুজ বনভূমির ভেতরে তখন আমাকে দখল করে নিয়েছিল একটা কণ্ঠস্বর এবং আমি আবার নীরবতায় পরিণত হয়েছিলাম। অন্ধকার মাটির গভীরে আমি ছিলাম একটা শিকড়, তারপর আমি পরিণত হয়েছিলাম ফুলে, তারপর মহাশূন্যের ভেতরে একটা সুগন্ধ হয়ে বেড়ে উঠেছিলাম আমার প্রিয় মানুষকে আলিঙ্গন করতে এবং আমি ধরা পড়েছিলাম এবং আমাকে জড়ো করেছিল মানুষের হাত এবং আমি তৈরি করেছিলাম একটা শিকড়, অন্ধকার মাটির ভেতরে একটা শিকড়।
পাগল : যদি তুমি একটা শিকড় হও, তাহলে শাখায় আঘাত করে যে ঝড় তা থেকে তুমি পালাতে পারো। একটা স্রোতস্বিনী নদী হওয়া আরও ভালো, এমনকি সমুদ্রে পৌঁছানোর পরও। অবশ্যই পানির জন্য এটা আরও ভালো হয় যদি তা উপরের দিকে দৌড়ায়।
মেরি : (স্বগতোক্তি) আহ্ অদ্ভুত, কী অদ্ভুত! (ল্যাজারাসকে) কিন্তু ভাই আমার, স্রোতস্বিনী নদী হওয়া ভালো এবং সেই গান হওয়া ভালো নয়, যা এখনও গাওয়া হয়নি এবং মাটির অন্ধকারে একটা শিকড় হওয়া খুবই চমৎকার। আমাদের শিক্ষক এসব জানতেন এবং তিনি তোমাকে আহ্বান জানিয়েছিলেন আমাদের কাছে ফিরে আসতে যেন আমরা জানতে পারি জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে কোনো অবগুণ্ঠন নেই। তুমি কি দেখ নাই ভালোবাসার ভেতরে একটি শব্দ উচ্চারিত হয় যা বিভিন্ন উপাদানকে একত্রে বহন করে আনতে পারে, মোহ যাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছিল—তাকে কি মুত্যু বলা হয়? বিশ্বাস করো এবং আস্থাবান হও, কারণ শুধুমাত্র বিশ্বাসই হচ্ছে আমাদের গভীতর জ্ঞান যার ভেতরে তোমরা স্বস্তি খুঁজে পেতে পারো।
ল্যাজারাস : স্বস্তি। স্বস্তি দাও প্রতারকদের যারা মারাত্মক! স্বস্তি দাও তাদেরকে যারা আমাদের বিচারবুদ্ধিকে প্রতারণা এবং আমাদেরকে সময়ের দাসে পরিণত করে। আমি স্বস্তি পাব না। আমি আক্রান্ত হব আবেগজনিত তীব্র অনুভূতিতে। আমি আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষের সঙ্গে শীতল শূন্যতার ভেতরে পুড়ে যাব। আমি থাকব আমার সঙ্গীর সঙ্গে বন্ধনহীন শূণ্যতায় যা আমার অন্য সত্তা। মেরি, হে মেরি একসময় তুমি আমার বোন ছিলে এবং আমরা জানতাম একে অন্যকে, এমনকি যেখানে আমাদের নিকটতম আত্মীয়রাও আমাদেরকে জানত না। এখন আমার কথা শোনো। মনোযোগ দিয়ে শোনো আমার কথা।
মেরি : আমি শুনছি ল্যাজারাস।
পাগল : সমস্ত পৃথিবীকে শুনতে দাও। আকাশ এখন মাটির সঙ্গে কথা বলবে, কিন্তু মাটি তোমার ও আমার মতোই বধির।
ল্যাজারাস : আমরা ছিলাম মহাশূন্য, আমার প্রিয়জন এবং আমি এবং আমরা সবাই মহাশূন্যে ছিলাম। আমরা ছিলাম আলোর ভেতরে এবং আমরা সবাই ছিলাম আলোর ভেতরে। প্রাচীন আত্মার মতো আমরা যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়েছিলাম যা জলের ওপরের মহাশূণ্যে চলাচল করে এবং এটা ছিল চিরকালের জন্য সেই প্রথম দিন থেকে। আমরা তাকে ভালোবেসেছিলাম যা শুভ্র নৈঃশব্দের হৃদয়ে বসবাস করে। তারপর বজ্রের মতো একটি কণ্ঠস্বর ও গণনাহীন বল্লমের মতো একটি কণ্ঠস্বর ইথারকে বিদ্ধ করেছিল এবং কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল— ‘ল্যাজারাস সামনে এগিয়ে এসো?’ সেই কণ্ঠস্বর ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েছিল মহাশূন্যে এবং আমি বন্যার স্রোতের মতো ভাটার স্রোতে পরিণত হয়েছিলাম, একটি গৃহ বিভক্ত হয়েছিল, ভাড়া দেওয়া হয়েছিল একটা পোশাক, একটি যৌবন যা খরচ করা হয়নি, একটা সুউচ্চ দালান যা পতিত হয়েছিল এবং এই পাথরের ভেতর থেকেই তৈরি হয়েছিল সীমারেখা। একটা কণ্ঠস্বর কেঁদে উঠেছিল, বলেছিল, ‘ল্যাজারাস, সামনে এসো।’ আমি অবতরণ করেছিলাম আকাশের অট্টালিকা থেকে একটা সমাধির ওপর একটা সমাধির ভেতরে, এই শরীর হচ্ছে একটা সিলমোহকৃত গুহা।
পাগল : মরুযাত্রী দলের শিক্ষক, কোথায় তোমার উট এবং তোমার লোকজন? এটা কি সেই ক্ষুধার্ত মাটি যা তাদেরকে গিলে ফেলেছিল? এটা কি ছিল সাইমুম ঝড়, যা ঢেকে দিয়েছিল তাদেরকে বালি দিয়ে? না! নাজারেতের যিশু তাঁর হাত উত্তোলন করেছিলেন, নাজারেতের যিশু উচ্চারণ করেছিলেন একটি শব্দ এবং এখন আমাকে বল, কোথায় তোমার উট এবং কোথায় তোমার লোকজন এবং কোথায় তোমার অর্থভাণ্ডার? এই চিহ্নহীন বালিতে কিন্তু চাঁদ প্রতিদিনই আবার উঠবে।
মেরি : আহ্, এটা একটা স্বপ্নের মতো যে-স্বপ্ন পাহাড়ের ওপরে দেখা হয়েছে। আমি জানি, ভাই আমার, আমি জানি, তুমি যে পৃথিবী পরিদর্শন করেছ সেই পৃথিবী আমি কখনও দেখি নাই। যদিও তুমি যা বলছ তার সবই অদ্ভুত মনে হচ্ছে। এটা একটা গল্প যা কেউ একজন বলেছিল একটা উপত্যকার উল্টোদিকে এবং আমি তার সামান্যই শুনতে পেয়েছিলাম।
ল্যাজারাস : উপত্যকার উল্টোদিকে সবকিছু খুবই আলাদা। সেখানে কোনো ওজন যা পরিমাপের ব্যাপার নেই। তুমি তোমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষের সঙ্গে আছ।
(নীরবতা)
ল্যাজারাস : হে আমার প্রিয় মানুষ। মহাশূন্যে হে আমার প্রিয় সুগন্ধ। পাখাগুলি, যা আমার জন্য প্রসারিত হয়েছিল। আমাকে বলো, আমার হৃদয়ের স্থিরতার ভেতরে আমাকে বলো, তুমি কি আমাকে অনুসন্ধান করো এবং এটা কি ছিল তোমার বেদনা আমার কাছ থেকে পৃথক হওয়ার কারণে? এটা কি ছিল একটা সুগন্ধ এবং পাখাগুলি বিস্তৃত হয়েছিল মহাশূন্যে? এখন আমাকে বলো, হে আমার প্রিয় মানুষ, সেখানে কি দ্বৈত নিষ্ঠুরতা ছিল, তাঁর কি একজন ভাই ছিল অন্য জগতে যে তোমাকে আহ্বান জানিয়েছিল জীবন থেকে মৃত্যুতে এবং তোমার কি মা, বোন ও বন্ধুরা ছিল যারা এটাকে মনে করত অলৌকিকতা? সেখানে কি দ্বৈত নিষ্ঠুরতা ছিল যা সুখী অবস্থার ভেতরে অভিনয় করে?
মেরি : না, না, ভাই আমার। সেখানে শুধুই একটি পৃথিবীর একজন যিশু। সবকিছুই আছে তবে একটি স্বপ্ন তোমার প্রিয় মানুষের মতো।
ল্যাজারাস : (আবেগজনিত তীব্র অনুভূতিসহ) না, না! যদি তিনি একটা স্বপ্ন না হন তাহলে তিনি কিছুই নন। যদি তিনি না জানতেন জেরুজালেমের ওপরে কী, তাহলে তিনি কিছুই নন। যদি তিনি মহাশূন্যে আমার প্রিয়জনকে না চেনেন তাহলে তিনি শিক্ষক নন। হে আমার বন্ধু, যিশু, আপনি একবার আমাকে এক কাপ মদ দিয়েছিলেন টেবিলের উল্টোদিকে বসে এবং বলেছিলেন, ‘আমার স্মরণে পান করো।’ আপনি একটুকরো রুটি তেলে চুবিয়ে আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা খাও, পাউরুটির এই অংশটা আমার ভাগের।’ হে আমার বন্ধু আপনি আপনার হাত রেখেছিলেন এবং ডেকেছিলেন ‘পুত্র’ বলে। আমার মা এবং বোনেরা বলেছে, ‘তিনি তোমাকে ভালোবাসেন ল্যাজারাস’ এবং আমি আপনাকে ভালোবেসেছিলাম। তারপর আপনি চলে গিয়েছিলেন আকাশে আরও সৌধ নির্মাণ করতে এবং আমি গিয়েছিলাম আমার প্রিয় মানুষের কাছে। এখন আমাকে বলুন, আমাকে বলুন কেন আপনি আমাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন? আপনি কি আপনার সজ্ঞান হৃদয়ের ভেতরে উপলব্ধি করেননি যে আমি আমার প্রিয় মানুষের সঙ্গে ছিলাম? আপনার কি তার সঙ্গে দেখা হয়নি লেবাননের পাহাড়চূড়ার ওপরে দীর্ঘ ভ্রমণের সময়? অবশ্যই আপনি তার প্রতিমূর্তি দেখেছিলেন আমার চোখের ভেতরে যখন আমি আপনার কাছে আসতাম এবং দাঁড়াতাম আপনার সম্মুখে সমাধির দরজায়। সূর্যে কি আপনার অত্যন্ত প্রিয় কেউ নেই এবং আপনি আপনার চেয়ে ও বৃহত্তর কাউকে পেয়ে যাবেন যে আপনাকে পৃথক করবে তাঁর থেকে এবং পৃথক করার পর আপনি কী বলবেন? এখন আমি আপনাকে কী বলব?
পাগল : তিনি আমাকে ফিরে আসার আদেশ দিয়েছিলেন কিন্তু আমি তা পালন করি নাই এবং তারা আমাকে পাগল বলে।
মেরি : ল্যাজারাস, আকাশে কি আমার একজন প্রিয় মানুষ আছে? আমার আকাঙ্ক্ষা কি একটা অস্তিত্বকে সৃষ্টি করেছিল এই পৃথিবীরও ওপরে। আমার অবশ্যই তার সঙ্গে থাকার জন্য মারা যাওয়া উচিত। ভাই আমার আমাকে বলো, আমারও কি সঙ্গী আছে? যদি তাই হয়, তাহলে বেঁচে থাকা এবং মারা যাওয়া কত আনন্দের এবং আবার বেঁচে ওঠা এবং আবার মারা যাওয়া। যদি কোনো প্রিয় মানুষ আমার অপেক্ষায় থাকে সবকিছু পূর্ণ করে দিতে যা আমার আকাঙ্ক্ষা এবং আমিও তার সবকিছু পূর্ণ করে দেব যা তার আকাঙ্ক্ষা।
পাগল : আকাশে একজন প্রিয় মানুষ আছে। প্রতিটি মানুষের হৃদয়ই একটা অস্তিত্ব তৈরি করে আকাশে।
মেরি : (নিজেকে বলছে) আকাশে কি আমার একজন প্রিয় মানুষ আছে?
ল্যাজারাস : আমি জানি না। যদি তোমার অত্যন্ত প্রিয় কেউ থাকে তাহলে তা হচ্ছে একটা অন্য সত্তা, অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে এবং তোমার উচিত তার
পাগল : সঙ্গে মিলিত হওয়া, নিশ্চয়ই সেখানে কেউ থাকবে না তোমাকে তার কাছ থেকে আলাদা করতে।
তিনি এখন এখানে এবং তিনি তাকে আহ্বান জানাতে পারেন। কিন্তু অনেকের মতোই তিনিও সেই আহ্বান নাও শুনতে পারেন।
ল্যাজারাস : (মঞ্চের মাঝখানে এসে দাঁড়াবে) অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো প্রতিটি ঋতুর জন্য অন্যান্য ঋতুকে অতিক্রম করতে এবং তারপর অপেক্ষা করো সেই ঋতুগুলির জন্য যা অন্যেরা অতিক্রম করে যাবে। পর্যবেক্ষণ করো সবকিছুর শুরুটা মনোযোগ দিয়ে সমস্ত কণ্ঠস্বর শুনতে এবং জানতে, যা তারা গলিয়ে ফেলে নীরবতার জন্য এবং সবকিছুই রক্ষা করবে তোমার হৃদয়ের কণ্ঠস্বরকে, যা কেঁদে উঠবে, এমনকি ঘুমের ভেতরেও।
পাগল : ঈশ্বরের সন্তানেরা মানুষের সন্তানদের বিয়ে করেছিল। তারপর তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছিল। এখন মানুষের সন্তানেরা ঈশ্বরের সন্তানদের জন্য প্রতীক্ষা করে। আমি তাদের সবাইকে করুণা করি- মানুষের সন্তানদেরকে এবং ঈশ্বরের সন্তানদেরকে।
(নীরবতা)
মার্থা : (দরজায় আবির্ভূত হল) কেন তোমরা বাড়ির ভেতরে আসছ না ল্যাজারাস? মা, সন্ধ্যের খাবার তৈরি করেছে। (একটু অধৈর্য হয়ে) যখনই তুমি আর মেরি একসঙ্গে থাকো তখন তুমি শুধুই কথা বলো এবং কেউ বোঝে না তুমি কী বলো।
(মার্থা কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে চলে গেল)
ল্যাজারাস : (নিজের সঙ্গে কথা বলছে এবং মার্থার কথা সে শোনেনি) আহ্, আমি নিজেকে খরচ করে ফেলেছি। পরিণত হয়েছি বর্জ্যে, আমি ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত। তুমি কি আমাকে কিছু খাবার ও একটু মদ দিতে পারবে?
মেরি : (তার কাছে গেল এবং একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরল) হ্যাঁ ভাই, হ্যাঁ। মা আমাদের জন্য সন্ধ্যার খাবার তৈরি করেছে।
পাগল : সে চেয়েছে সেই রুটি যা তারা সেঁকতে পারে না এবং সেই মদ যা তারা বোতলে ভরেনি।
ল্যাজারাস : আমি কি বলেছিলাম আমি ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত? আমি তোমাদের রুটির জন্য ক্ষুধার্ত নই, তৃষ্ণার্ত নই তোমাদের মদের জন্য। আমি তোমাকে বলছি আমি কোনো বাড়িতে ঢুকব না যতক্ষণ আমার প্রিয় মানুষের হাত আমাকে দরজা পর্যন্ত নিয়ে না যায়। আমি ভোজের টেবিলেও বসব না সে আমার পাশে না-বসা পর্যন্ত।
(ঘরের দরজায় মা আবির্ভূত হলেন)
মা : ল্যাজারাস, এখনও তোমরা কুয়াশার ভেতরে? আর মেরি, তুমিও। কেন তোমরা ভেতরে আসছ না? মোমবাতি জ্বেলেছি, টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে আর তোমরা বাইরে হড়বড় করে কথা বলছ আর অন্ধকারে কথা চিবোেচ্ছ।
ল্যাজারাস : আমার নিজের মা একটা সমাধির ভেতরে আমাকে প্রবেশ করতে বলেন। তিনি আমাকে খাবার খাওয়াবেন, পান করাবেন এবং তিনি আমাকে আদেশ করবেন সেইসব কাফন ঢাকা মুখের ভেতরে বসতে এবং গ্রহণ করতে অনন্তকাল বিবর্ণ হাত থেকে এবং জীবন উত্তোলন করতে মাটির কাপ থেকে।
পাগল : সাদা পাখিগুলি, যারা উত্তরদিকে উড়ে গিয়েছিল যেখানে সূর্য সবকিছুকে ভালোবাসে, যারা তোমাকে ধরে রাখে মধ্য বাতাসে এবং কে তোমাকে ফিরিয়ে এনেছিল? এটা ছিলেন তোমার বন্ধু নাজারেতের যিশু। তিনি তোমাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন কোনোরকম করুণা প্রদর্শন ছাড়াই, কারণ যারা পাখাহীন, তারা তাদের সঙ্গে থাকেত পারবেনা। আহ্, সাদা পাখিগুলি, এখানে এখন ঠাণ্ডা এবং তোমরা কাঁপছ। উত্তরের বাতাস তোমাদের পালকের ভেতরে হাসছে উচ্চহাসি।
ল্যাজারাস : তোমরা থাকবে একটা ঘরের ভেতরে ছাদের তলায়। তোমরা থাকবে চার দেয়ালের মাঝখানে এবং তাতে থাকবে একটা দরজা এবং একটা জানালা। তোমরা থাকবে এরকম জায়গায় এবং তোমরা থাকবে দূরদৃষ্টি ছাড়া। তোমাদের মন হচ্ছে এখানে এবং আমার আত্মা হচ্ছে সেখানে। তোমরা সবাই এই পৃথিবীর ওপর আছ, আমার সবকিছু আছে মহাশূন্যের ভেতরে। তোমরা চুপিসারে চলাফেরা করো গৃহের ভেতরে আর আমি পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াই। তোমরা সবাই দাস এবং তোমরা পূজা করো তোমাদেরকেই। তোমরা ঘুমাও কিন্তু স্বপ্ন দ্যাখো না, তোমরা জেগে ওঠো কিন্তু পাহাড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটো না। গতকাল আমি চিন্তিত ছিলাম তোমাদের সম্পর্কে এবং জীবন সম্পর্কে এবং আমি খুঁজে পেয়েছিলাম অন্য এক পৃথিবী, যাকে তোমরা মৃত্যু বল, এবং আমার মৃত্যু ছিল আমার আকুল আকাঙ্ক্ষার বাইরে। বর্তমানে, এখানে এই মুহূর্তে তার বিরুদ্ধে বিদ্ৰোহ করছি যাকে তোমরা বলো জীবন।
মার্থা : (সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল যখন ল্যাজারাস কথা বলছিল) কিন্তু শিক্ষক দেখেছেন আমাদের দুঃখ ও বেদনা এবং তিনি আহ্বান জানিয়েছেন তোমাকে আমাদের কাছে ফিরে আসতে এবং তোমরা বিদ্রোহ করেছ। আহ্, কোনো কাপড়, বিদ্রোহ করছে তার তাঁতির বিরুদ্ধে? কিরকম একটা বাড়ি যে বিদ্ৰোহ করছে তার নির্মাতার বিরুদ্ধে!
মেরি : তিনি আমাদের হৃদয়কে জানেন এবং তিনি ছিলেন আমাদের প্রতি উদার এবং যখন আমাদের মায়ের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে এবং তার চোখে দেখতে পান একটি মৃত পুত্র, সমাহিত, তখন তার বেদনা তাকে ধরে রাখে এবং এক মুহূর্তের জন্য তিনি ছিলেন স্থির এবং নীরব। (বিরতি) তারপর আমরা তাঁকে অনুসরণ করেছিলাম তোমার সমাধি পর্যন্ত।
ল্যাজারাস : হ্যাঁ, এটা ছিল আমার মায়ের বেদনা এবং তোমাদের বেদনা; এটা ছিল করুণা, আত্মকরুণা, যা আমাকে ফিরিয়ে এনেছিল। আত্মকরুণা কী পরিমাণ স্বার্থপর এবং কতখানি গভীর। আমি বলি যে আমি বিদ্রোহী। আমি বলি, যে দেবতাদের উচিত নয় বসন্তকে শীতে পরিণত করা। আকুল আকাঙ্ক্ষার ভেতরে আমি পাহাড়ে চড়েছিলাম এবং তোমাদের বেদনা আমাকে এই উপত্যকায় ফিরিয়ে এনেছিল। তুমি চেয়েছিলে একটি পুত্র এবং একটি ভাই সারাজীবন তোমার সঙ্গে থাক। তোমার প্রতিবেশীরা চেয়েছিল একটা অলৌকিকতা। তুমি এবং তোমার প্রতিবেশীরা, তোমাদের পিতা ও পূর্বপুরুষের মতো একটা অলৌকিকতার স্পর্শ পেতে চাইবে এবং তোমরা বিশ্বাস করতে পারো জীবনের খুবই সাধারণ বিষয়গুলিকে। কী পরিমাণ নিষ্ঠুর তোমরা এবং কী পরিমাণ কঠোর তোমাদের হৃদয় এবং তোমাদের চোখে রাত্রি কী পরিমাণ অন্ধকার। কারণ তোমরা নবীদের টেনে নামিয়েছ তাদের মর্যাদা থেকে তোমাদের উল্লাসের ভেতরে এবং তারপর তোমরা নবীদেরকে হত্যা করেছ।
মার্থা : (মৃদু তিরস্কারের ভঙ্গিতে) তুমি আমাদের বেদনাকে বলেছ আত্মকরুণা। তোমার বিলাপ আত্মকরুণা ছাড়া আর কী? শান্ত হও এবং মেনে নাও এই জীবন যা ঈশ্বর তোমাদেরকে দান করেছেন।
ল্যাজারাস : তিনি আমাকে জীবনদান করেননি, তিনি তোমাদেরকে দান করেছিলেন আমার জীবন। তিনি আমার জীবন গ্রহণ করেছিলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষের কাছ থেকে, দান করেছিলেন তোমাদেরকে, একটা অলৌকিকতা তোমাদের চোখ ও কান খুলে দেবার জন্য। তিনি উৎসর্গ করেছিলেন আমাকে, যেমন উৎসর্গ করেছিলেন নিজেকে। (আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন) পিতা, তাদেরকে ক্ষমা করুন। তারা জানে না তারা কী করছে।
মেরি : (আতঙ্কিতভাবে) এটা হচ্ছেন তিনি, যিনি সেইসব কথা বলেছিলেন ক্রুশে ঝুলন্ত অবস্থায়।
ল্যাজারাস : হ্যাঁ, এইসব কথা তিনি বলেছিলেন আমার জন্য, যেমন বলেছিলেন নিজের জন্য এবং সেইসব অপরিচিত মানুষের জন্য যারা বুঝতে পারে এবং যারা বুঝতে পারে না। এইসব কথা তিনি কি তখন বলেন নাই যখন তোমরা কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছিলে তাঁর কাছে আমার জীবনের জন্য? এটা ছিল তোমাদের আকাঙ্ক্ষা, যা তাঁর ইচ্ছা নয় এবং তাঁর আত্মাকে নির্দেশ দিয়েছিল সিলমোহরকৃত দরজার সম্মুখে দাঁড়াতে এবং অনন্তকালকে প্ররোচিত করতে আমাকে উৎপন্ন করতে তোমাদের কাছে। এটা ছিল একজন পুত্র ও একজন ভাইয়ের জন্য প্রাচীন আকাঙ্ক্ষা যা আমাকে ফিরিয়ে এনেছিল।
মা : (ল্যাজারাসের কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখেন) ল্যাজারাস, তুমি ছিলে আমার অনুগত ও স্নেহময় পুত্র। তোমার কী হয়েছে? আমাদের সঙ্গে থাকো এবং ভুলে যাও সেইসব যা তোমাকে বেদনা দিয়েছে।
ল্যাজারাস : (হাত উপরে তুলে) আমার মা, ভাই ও বোনেরা হচ্ছে তারা, যারা আমার কথা শোনে।
মেরি : এগুলি সব তাঁর কথা।
ল্যাজারাস : হ্যাঁ এবং তিনি এসব কথা বলেছিলেন আমার জন্য এবং একই সঙ্গে নিজের জন্য এবং সেইসব মানুষের জন্য যাদের মাটি আছে মায়ের জন্য এবং পিতার জন্য আকাশ এবং তাদের সবার জন্য যারা স্বাধীন অবস্থায় জন্মায় মানুষ থেকে, দেশ থেকে এবং প্রজাতি থেকে।
পাগল : হে আমার জাহাজের চালক, বাতাস তোমার পাল পূর্ণ করে দিয়েছে এবং তুমি সাহসী হয়ে উঠেছ সমুদ্রের প্রতি এবং তুমি অনুসন্ধান করেছিলে আশীর্বাদকৃত ক্ষুদ্র দ্বীপগুলি। কেন সেই অন্য বাতাস তোমার গতি পরিবর্তন করেছে এবং কেন তুমি এই তীরভূমিতে ফিরে এসেছিলে? এটা ছিলেন নাজারেতের যিশু যিনি বাতাসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মিলিত হতে এবং তারপর পালটা পূর্ণ করে দিতে যেখানে খালি আছে এবং যেখানে পূর্ণ আছে সেখানে খালি করে দিতে।
ল্যাজারাস : (হঠাৎ করেই সে সবাইকে ভুলে যায় এবং দুহাত প্রসারিত করে উপরের দিকে তাকায়) হে আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ! তোমার চোখে ছিল ভোরবেলা এবং সেই ভোরবেলার ভেতরে ছিল একটি গভীর রাত্রির নীরব রহস্য এবং একটি পরিপূর্ণ দিনের নীরব প্রতিশ্রুতি এবং আমি ছিলাম পরিপূর্ণ ও সম্পূর্ণ। হে আমার প্রিয়জন, এই জীবন, এই অবগুণ্ঠন এখন আমাদের মাঝখানে। আমার কি অবশ্যই উচিত এই মৃত্যুর ভেতরে বেঁচে থাকা এবং পুনরায় মারা যাওয়া যেন আবার আমি বেঁচে উঠতে পারি? অবশ্যই সময়কে দীর্ঘয়িত করা প্রয়োজন যতক্ষণ সমস্ত সবুজ জিনিসগুলি হলুদ না হয় এবং তারপর আবার তা নগ্ন হয়? (বিরতি) আহ্, আমি তাকে অভিশাপ দিতে পারি না। কিন্তু কেন, সমস্ত মানুষের ভেতরে কেন আমার উচিত প্রত্যাবর্তন করা? কেন সব মেষপালকের ভেতর থেকে আমারই উচিত মরুভূমিতে ফিরে যাওয়া সবুজ চারণভূমির ঘাস শেষ হয়ে যাবার পর?
পাগল : যদি তুমি তাদের ভেতরে থেকে থাকো যারা অভিশাপ দেবে, তাহলে তুমি অল্প বয়সে মারা যাবে না।
ল্যাজারাস : নাজারেতের যিশু এইমাত্র আমাকে বললেন, কেন তুমি আমার উদ্দেশে এসব করছ? এটা কি আরও ভালো ছিল, আমার মাটিতে শায়িত হওয়া, বিনয়ী এবং ধীরগতিসম্পন্ন একটি পাথর যা আপনার মহিমার উচ্চতার দিকে নেতৃত্ব দিচ্ছে? মৃতদের ভেতর থেকে যে-কেউ সেবা দান করে থাকতে পারে আপনাকে মহিমান্বিত করতে। কেন আপনি এসব প্রেমিক বা প্রেমিকাকে আলাদা করেছেন তাদের অত্যন্ত প্রিয় মানুষের কাছ থেকে? কেন আপনি আমাকে আহ্বান জানান একটা পৃথিবীর দিকে যা আপনি চিনেছিলেন আপনার হৃদয়ের ভেতরে- আপনি কি তা পরিত্যাগ করবেন? (তারপর সে শব্দ করে কেঁদে ফেলল) কেন, কেন, কেন, আপনি আমাকে আহ্বান জানিয়েছিলেন অনন্তকালের জীবন্ত হৃদয় থেকে জীবন্ত মৃত্যুর দিকে? হে নাজারেতের যিশু, আমি আপনাকে অভিশাপ দিতে পারি না। আমি আপনাকে আশীর্বাদ করব। (নীরবতা। ল্যাজারাসকে এমন দেখাচ্ছে যেন সে নিঃশেষিত হয়েছে। তার মাথা ঝুঁকে পড়েছে বুকের ওপর। ভয়াবহ নীরবতার একটি মুহূর্ত কেটে যাবার পর সে আবার তার মাথা তুলল এবং তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর সে কাঁদতে লাগল গভীর ও শিহরিত কণ্ঠে এবং কাঁদতে কাঁদতে বলল), নাজারেতের যিশু! বন্ধু আমার। আমরা দুজনেই ক্রুশবিদ্ধ হয়েছি। আমাকে ক্ষমা করুন, ক্ষমা করুন আমাকে। আমি আপনাকে এখন আশীর্বাদ করি এবং চিরদিনের জন্য।
(সেই মুহূর্তে এক শিষ্য প্রবেশ করল পাহাড়ের দিক থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে)
মেরি : ফিলিপ।
ফিলিপ : তাঁর উত্থান ঘটেছে। মৃত অবস্থা থেকে আমাদের শিক্ষকের উত্থান ঘটেছে এবং তিনি এখন গালীলের দিকে চলেছেন।
পাগল : তাঁর উত্থান ঘটেছে, কিন্তু তিনি আবার ক্রুশবিদ্ধ হবেন এবং হাজার বার ক্রুশবিদ্ধ হবেন।
মেরি : ফিলিপ বন্ধু আমার, তুমি কী বলো?
মার্থা : (ফিলিপের দিকে এগিয়ে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল) তোমাকে আবার দেখে আমি যে কী খুশি হয়েছি তা বলার নয়। কিন্তু কার উত্থান ঘটেছে? কার সম্পর্কে তুমি কথা বলছ?
মা : (ফিলিপের দিকে এগিয়ে গেলেন) ভেতরে এসো পুত্র। আজ রাতে তুমি আমাদের সঙ্গে খাবে।
ফিলিপ : (স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে) আমি বলছি, আমাদের শিক্ষকের উত্থান ঘটেছে মৃত অবস্থা থেকে এবং তিনি গালীলে চলে গেছেন।
(একটা গভীর নীরবতা নেমে এল)
ল্যাজারাস : এখন তোমরা সবাই আমার কথা শোনো। মৃত অবস্থা থেকে যদি তাঁর উত্থান ঘটে থাকে তাহলে তারা তাঁকে আবার ক্রুশবিদ্ধ করবে, কিন্তু তারা শুধুমাত্র তাঁকেই ক্রুশবিদ্ধ করবে না, যখন আমি তাঁর কথা ঘোষণা করব, তখন তারা আমাকেও ক্রুশবিদ্ধ করবে।
ল্যাজারাস : শোনো আমার মা ও বোনেরা, আমি তাঁকে অনুসরণ করব যিনি আমাকে জীবন দান করেছিলেন এবং অনুসরণ করব তিনি আমাকে মৃত্যু না-দেওয়া পর্যন্ত। হ্যাঁ, আমিও ক্রুশবিদ্ধ হব এবং আমার ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর এই প্রথার সমাপ্তি ঘটবে।
(নীরবতা)
ল্যাজারাস : আমি এখন তাঁর আত্মা অনুসন্ধান করব এবং মুক্ত হব আমি। যদিও তারা আমাকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবে কিন্তু আমি বন্ধনের ভেতরে থাকব না যদিও এক হাজার মা এবং হাজার হাজার বোন আমার পোশাকের প্রান্ত ধরে রাখবে কিন্তু আমি তাদের হাতের ভেতরে থাকব না। আমি থাকব পুবের বাতাসের সঙ্গে, পুবের বাতাস যেখানে যায় এবং আমি সূর্যাস্তের ভেতরে অনুসন্ধান করব আমার প্রিয়জনকে যেখানে আমাদের সবগুলি দিন শান্তি খুঁজে ফেরে। আমি সন্ধান করব আমার প্রিয়জনকে সেই রাত্রির ভেতরে যেখানে সমস্ত সকালগুলি ঘুমায় এবং সমস্ত মানুষের ভেতরে আমি হব একজন যে জীবনে দুবার কষ্টভোগ করেছে এবং মারা গিয়েছে দুবার এবং দুবার চিনেছে অনন্তকাল।
(ল্যাজারাস তার মায়ের মুখের দিকে তাকায়, তারপর বোনদের মুখের দিকে তাকায়, তারপর ফিলিপের মুখের দিকে তাকায়, তারপর আবার মায়ের মুখের দিকে তাকায়। তারপর নিদ্রাচরের মতো সে ঘুরল এবং পাহাড়ের দিকে দৌড়াতে লাগল। সে অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রত্যেকেই স্তম্ভিত এবং শিহরিত হল)
মা : হে আমার পুত্র, আমার কাছে ফিরে এসো।
মেরি : হে আমার ভাই, তুমি যাচ্ছ কোথায়। প্রিয় ভাই আমার, আমাদের কাছে ফিরে এসো।
মার্থা : (যেন সে নিজের সঙ্গে কথা বলে) বাইরে খুবই অন্ধকার। আমি জানি সে পথ হারিয়ে ফেলবে।
মা : (আর্তনাদ করে উঠল) ল্যাজারাস, প্রিয় পুত্র আমার।
(নীরবতা)
ফিলিপ : তিনি সেখানে গেছেন যেখানে আমরা সবাই যাব এবং তিনি আর ফিরবেন না।
মা : (মঞ্চের পেছনের দিকে শেষপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল, যেখান থেকে ল্যাজারাস অদৃশ্য হয়েছে) ল্যাজারাস, ল্যাজারাস, পুত্র আমার, আমার কাছে ফিরে এসো। (তিনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠেন)
(নীরবতা। ল্যাজারাসের দৌড়ানোর শব্দ দূরে মিলিয়ে যায়)
পাগল : এখন সে চলে গেছে এবং এখন সে তোমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন তোমাদের দুঃখ অনুসন্ধান করে অন্য দুঃখকে। (একটু থেমে) নিঃস্ব ল্যাজারাস, ধর্মযুদ্ধের প্রথম শহীদ এবং তাদের ভেতরে সবচেয়ে মহৎ।
.
তোমার এবং আমার চিন্তা
তোমার চিন্তা হল একটি গাছ যার শিকড় প্রচলিত প্রথার মাটির গভীরে পৌঁছে গেছে এবং গতিশীলতার ক্ষমতার ভেতরে বেড়ে উঠেছে যার শাখাগুলো। আমার চিন্তা হচ্ছে মহাশূন্যের ভেতরে একটা মেঘ। এটা ফোঁটায় পরিণত হয় যেভাবে তারা ঝরে পড়ে, তৈরি করে একটা নদী, যা সমুদ্রের দিকে যেতে যেতে গান গায়। তারপর তা বাষ্প হয়ে উড়ে যায় আকাশে। তোমার চিন্তা হচ্ছে একটা দুর্গ, যা না পারে প্রবল বেগে প্রবাহিত হতে, না পারে বজ্রের মতো চমকাতে। আমার চিন্তা হচ্ছে গাছের একটা কোমল পাতা, যা সবদিকে দোলে এবং দোলার ভেতরে সন্ধান করে আনন্দ। তোমার চিন্তা হচ্ছে একটা প্রাচীন অন্ধবিশ্বাস যা তোমাকে পরিবর্তন করতে পারে না এবং তুমিও পারো না তাকে পরিবর্তন করতে। আমার চিন্তা হচ্ছে নতুন এবং সে আমার স্বাদ গ্রহণ করে, আমিও তার স্বাদ গ্রহণ করি সকাল ও সন্ধ্যায়।
তোমার চিন্তা তোমার এবং আমার চিন্তা আমার।
তোমার চিন্তা তোমাকে বিশ্বাস করতে অনুমতি দেয় দুর্বল ও শক্তিশালীর অসম প্রতিযোগিতা এবং জটিল মানুষের সাধারণ রসিকতা। আমার চিন্তা আমার ভেতরে সৃষ্টি করে ভূমি কর্ষণের আকাঙ্ক্ষা আমার নিড়ানি দিয়ে এবং ফসল তোলার আকাঙ্ক্ষা কাস্তে দিয়ে এবং আমার গৃহ নির্মাণ করে পাথর এবং বালি ও সুরকির মিশ্রণ দিয়ে এবং বয়ন করে আমার পোশাক উল এবং লিনেনের সুতো দিয়ে। তোমার চিন্তা তোমাকে তাড়া করে ফেরে সম্পদ ও বিশিষ্টতাকে বিয়ে করতে। আমার চিন্তা আদেশ দেয় স্বনির্ভর হতে। তোমার চিন্তা ওকালতি করে খ্যাতি এবং চাকচিক্য প্রদর্শনের। আমার চিন্তা আমাকে পরামর্শ দেয় এবং আমার কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করে তাকে দুঃস্কর্ম থেকে দূরে রাখতে এবং বালির কণার মতো মনে করতে অনন্তকালের তীর্থভূমির ওপর। তোমার চিন্তা তোমার হৃদয়ে ধীরে ধীরে ঔদ্ধত্য ও কর্তৃত্ব সঞ্চার করে। আমার চিন্তা আমাকে রোপণ করে আমার ভালোবাসার ভেতরে শান্তির জন্য এবং আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে স্বাধীনতার জন্য। তোমার চিন্তা জন্ম দেয় হীরাখচিত চন্দনকাঠের আসবাবপত্রসহ প্রাসাদ ও রেশমিসূতা দিয়ে তৈরি বিছানার স্বপ্ন। আমার চিন্তা কোমল স্বরে আমার কানে কানে বলে,
শরীর ও আত্মার ভেতরে পরিচ্ছন্ন থাক যদি তোমার মাথাকে বিশ্রাম দেবার কোনো জায়গা নাও থাকে। তোমার চিন্তা তোমাকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তোলে পদবি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য। আমার চিন্তা আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে ভদ্র পেশা গ্রহণ করতে।’
তোমার চিন্তা তোমার এবং আমার চিন্তা আমার।
তামার চিন্তা হচ্ছে একটা সমাজবিজ্ঞান এবং একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অভিধান। মামার চিন্তা হচ্ছে সাধারণ ও স্বতঃসিদ্ধ। তোমার চিন্তা সুন্দরী নারী, কলুষতা, শুদ্ধতা, ‘তিতা, বুদ্ধিমান এবং নির্বোধ সম্পর্কে কথা বলে। আমি দেখি প্রতিটি নারী প্রতিটি মানুষের মা, বোন এবং কন্যা। তোমার চিন্তার বিষয় হল চুরি, অপরাধ ও গুপ্তহত্যা। মামার চিন্তা ঘোষণা করে চোরেরা হচ্ছে একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রাণী। অপরাধীরা হচ্ছে স্যদের বংশধর এবং গুপ্তঘাতকেরা খুনিদের স্বগোত্রীয়। তোমার চিন্তা বর্ণনা করে মাইন, বিচারালয়, বিচার এবং শাস্তি। আমার চিন্তা ব্যাখ্যা করে কখন মানুষ একটা আইন তরি করে, যা সে ভঙ্গ করে অথবা মান্য করে। যদি কোনো মৌলিক আইন থাকে চাহলে তার সম্মুখে আমরা সবাই একজন। যে সংকীর্ণমনাদের ঘৃণা করে সে নিজেই ংকীর্ণমনা। যে তার তাচ্ছিল্যের বড়াই করে, সে মূলত তাচ্ছিল্য করে মানবতাকে। তামার চিন্তা শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, যাজক ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমার চিন্তা কথা বলে প্রেম ও স্নেহপ্রবণ, আন্তরিক, সৎ, স্পষ্টভাষী, দয়ালু এবং ধর্মযুদ্ধে জীবন ৎসর্গকারীদের সম্পর্কে। তোমার চিন্তা ওকালতি করে ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও সলাম ধর্মের। আমার চিন্তার ভেতরে সর্বময় ঈশ্বরের প্রেমময় হাতের আঙুল ছাড়া আর কছু নয়। তোমার চিন্তার ভেতরে রয়েছে ধনী, দরিদ্র এবং ভিক্ষুকেরা। আর আমার চিন্তা ঘাষণা করে জীবন ছাড়া আর কোথাও কোনো ধনী নেই, প্রত্যেকেই ভিক্ষুক এবং নিজে ছাড়া জীবনের কাছে আর কোনো দাতার অস্তিত্ব নেই।
তামার চিন্তা তোমার এবং আমার চিন্তা আমার।
তামার চিন্তা অনুসারে, জাতির বিশালত্ব শুয়ে থাকে তার রাজনীতি, দল, তাদের সম্মেলন জাট ও চুক্তির ভেতরে। কিন্তু আমার চিন্তা ঘোষণা করে যে জাতির গুরুত্ব শুয়ে থাকে চার কাজের ভেতরে- কাজ শস্যক্ষেতে, আঙুরবাগানে, তাঁতে, চামড়া কারখানায়, পাথরের কোয়ারীতে, কাঠের কারখানায়, প্রতিষ্ঠানে এবং ছাপাখানায়। তোমার চিন্তা জাতির গৌরবকে ধরে রাখে তার বীরদের ভেতরে। এটা গায় প্রশংসাসঙ্গীত রামেসিস, মালেকজান্ডার, সিজার, হানিবল এবং নেপোলিয়নের। কিন্তু আমার চিন্তা দাবি করে নফুসিয়াস, লাও-টিসি, সক্রেটিস এবং প্লেটো, আবি তালেব, আল গাজ্জালি, দালালউদ্দিন রুমী, কোপারনিবাস এবং লুই পাস্তুরের মতো প্রকৃত বীরদের। তোমার চন্তা ক্ষমতা দেখতে পায় সেনাবাহিনী, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, উড়োজাহাজ এবং বিষাক্ত ঠ্যাসের ভেতরে। কিন্তু আমার চিন্তা ঘোষণা করে যে, ক্ষমতা শায়িত থাকে তার প্রস্তাব ও ত্যতার ভেতরে। দস্যু কতদিন দুঃখ-কষ্ট ভোগ করবে সেটা কোনো বিষয় নয়; সর্বশেষে স নিঃস্ব হবে। তোমার চিন্তা প্রয়োগবাদী ও আদর্শবাদীর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে, পার্থক্য তৈরি করে আংশিক ও সম্পূর্ণের ভেতরে, মরমীসাধক ও বস্তুবাদীর ভেতরে। মামার চিন্তা উপলব্ধি করে যে, জীবন হল একজন এবং এর ওজন, পরিমাপ ও ক—তোমার ওজন, পরিমাপ ও ছকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। তোমার চিন্তা যাকে।নে কর একজন আদর্শবাদী, হতে পারে সে একজন বাস্তববাদী মানুষ।
তামার চিন্তা তোমার এবং আমার চিন্তা আমার।
তোমার চিন্তা ধ্বংসাবশেষ ও জাদুঘর এবং মমি ও পাথরে পরিণত হওয়া বস্তুর প্রতি আগ্রহী। কিন্তু আমার চিন্তা আকাশে স্থির হয়ে ভেসে থাকে চির নবায়িত কুয়াশা ও মেঘের ভেতরে। তোমার চিন্তা আরোহণ করে খুলির সিংহাসনে। তুমি এতে গর্ব অনুভব করো, তুমি তাকে মহিমান্বিত করে থাকো। আমার চিন্তা বিস্মিত হয় অস্পষ্ট ও দূরবর্তী উপত্যকাগুলিতে। তোমার চিন্তা তূর্যধ্বনি তোলে যখন তুমি নাচো। আমার চিন্তা তোমার নৃত্য ও গীত থেকে মৃত্যুর নিদারণ যন্ত্রণা অধিক পছন্দ করে। তোমার চিন্তা হচ্ছে পরচর্চার চিন্তা এবং মিথ্যা আনন্দের। আমার চিন্তা হচ্ছে তার চিন্তা যে তার নিজের দেশ হারিয়েছে, যে নিজ জাতির ভেতরে বহিরাগত এবং যে নিঃসঙ্গ তার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের ভেতরে।
তোমার চিন্তা তোমার এবং আমার চিন্তা আমার।
ইতিহাস এবং জাতি
লেবাননের পাহাড়গুলির পাদদেশে পড়ে থাকা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পাথরের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীর পাশে বসেছিল এক মেষপালিকা। তার চারপাশে শুকনো ঘাসের ওপর চরে বেড়াচ্ছিল তার কৃশকায় ভেড়ার পাল। সে দূরবর্তী গোধূলিবেলার দিকে তাকাল, যেন তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছিল ভবিষ্যৎ। অশ্রুজল তার চোখকে অলংকৃত করেছিল শিশিরভেজা ফুলের মতো।
সূর্যাস্তের পর, পাহাড় এবং সেই ছোট ছোট টিবিগুলো নিজেদেরকে মুড়ে নিল ছায়ার ভেতরে এবং ইতিহাস দাঁড়াল তরুণীর মুখোমুখি। সে একজন বৃদ্ধ মানুষ, যার সাদা চুলগুলো তার কাঁধ ও বুকের ওপর পড়েছিল বরফের মতো এবং সে একটা ধারালো কাস্তে ধরে রেখেছিল তার ডান হাতে। সমুদ্রের গর্জনের মতো কণ্ঠস্বরে সে বলল, ‘তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক সাইরিয়া।’
কুমারী গোলাপফুল শিহরিত হল আতঙ্কে এবং সে জিজ্ঞাস করল, ‘ইতিহাস তুমি আমার কাছে কী চাও?’ সে তার ভেড়াগুলোর দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘সেই স্বাস্থ্যবান ভেড়াগুলোর ভেতরে এগুলিই অবিশিষ্ট আছে, যারা একসময় এই উপত্যকা পূর্ণ করে রেখেছিল। তোমার লোলুপতার কারণে এসব হয়েছে। এখনও কি তুমি এসেছ তোমার লোভকে তৃপ্ত করতে?
‘তুমি পায়ে মাড়িয়ে যাওয়ার পর এই উর্বর সমতলভূমি নিষ্ফলা ধুলায় পরিণত হয়েছে। আমার পশুরপাল একসময় এখানে চরে বেড়াত এবং প্রচুর দুধ দিতে, বর্তমানে এখন শুধুই কাঁটাযুক্ত গোক্ষুর গাছ যা কঠিন এবং শুকনো
‘হে ইতিহাস আমাকে আর পীড়িত কোরো না। তোমার দৃষ্টি আমরা জীবনকে তীব্রভাবে ঘৃণা করেছে এবং তোমার কাস্তের নিষ্ঠুরতা হল আমার মৃত্যুকে ভালোবাসার কারণ।
‘আমাকে পরিত্যাগ করে যাও আমার নির্জনতার ভেতরে আমার দুঃখের পেয়ালা নিঃশেষিত হওয়ার জন্য- যা আমার শ্রেষ্ঠ মদ। ইতিহাস তুমি পশ্চিমে যাও যেখানে জীবনের বিবাহ-উৎসবের ভোজ উদযাপিত হচ্ছে। এখানে আমাকে বিলাপ করতে দাও যে মৃত্যু আমার জন্য তুমি প্রস্তুত করেছ তার কারণে।’
পোশাকের নিচে কাস্তেটা লুকিয়ে ফেলার পর ইতিহাস তার মুখের দিকে তাকাল স্নেহময় পিতার মতো এবং বলল, ‘হে সাইরিয়া, যা আমি তোমার কাছ থেকে নিয়েছি তা আমার নিজস্ব উপহার। এখন জেনে রাখো সহোদরা জাতি হচ্ছে তোমার গৌরবের অংশ। আমার অবশ্যই তাদেরকে সেইসব দান করা উচিত যা আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। তোমার দুরবস্থা হল মিশর, পারস্য ও গ্রিসের মতো, কারণ তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে কৃশকায় পশুর পাল এবং শুকনো চারণভূমি। হে সাইরিয়া, যাকে তোমরা মর্যাদাহানি বলো তা হল একটা অপরিহার্য ঘুম, যেখান থেকে তোমরা শক্তিকে তুলে আনবে। পুষ্পগুচ্ছ ফিরে আসে না জীবনের কাছে মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যাওয়া ছাড়া এবং ভালোবাসা বেড়ে ওঠে না পৃথকীকরণ ছাড়া।’
বৃদ্ধলোকটি তরুণীর কাছে এল, দুহাত প্রসারিত করল এবং বলল, ‘আমার সঙ্গে হাত মেলাও, হে নবীদের কন্যা।’ তরুণী বৃদ্ধের দিকে তাকাল অশ্রুজলের পর্দায় পেছন থেকে এবং বলল, ‘বিদায়, ইতিহাস, বিদায়’ এবং বৃদ্ধ উত্তরে বলল, ‘আবার আমাদের দেখা না- হওয়া পর্যন্ত সাইরিয়া, আবার দেখা না-হওয়া পর্যন্ত।’
বৃদ্ধলোকটি বজ্রের মতো দ্রুত মিলিয়ে যাওয়ার পর মেষপালিকা তার মেষগুলোকে আহ্বান জানাল এবং নিজের পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে বলল, ‘আবার তার সঙ্গে আমার দেখা হবে?’
নতুন সীমান্ত
আজকাল মধ্যপ্রাচ্যে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ধারণা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় এবং তা হল : নতুন ও পুরাতন। পুরোনো ধারণাগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে, কারণ তারা দুর্বল এবং নিঃশেষিত। মধ্যপ্রাচ্য হচ্ছে একটা জাগরণ যা সুখনিদ্রাকে উপেক্ষা করে। এই জাগরণ বিজয় অর্জন করবে কারণ সূর্য হচ্ছে এর নেতা এবং ভোরবেলা হচ্ছে এর সেনাবাহিনী।
মধ্যপ্রাচ্যের শস্যক্ষেত হচ্ছে একটা বিশাল সমাধিক্ষেত্র, বসন্তের যৌবন এখানে দাঁড়িয়ে সমাধির বাসিন্দাদের আহ্বান জানায় উত্থিত হতে এবং নতুন সীমান্তের দিকে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যেতে, যখন বসন্ত তার প্রশংসাগীতি গায়, শীতের মৃতরা জেগে ওঠে, সরিয়ে ফেলে তাদের কাফন এবং কুচকাওয়াজ করে সামনে এগোয়।
মধ্যপ্রাচ্যের দিগন্তে একটা নতুন জাগরণ, এটা বেড়ে উঠছে এবং প্রসারিত হচ্ছে। এটা গ্রাস করছে সমস্ত সংবেদনশীলতা, চিৎকার করছে উচ্চ ও তীক্ষ্ণস্বরে এবং অর্জন করছে মহৎ হৃদয়ের সমস্ত সহানুভূতি।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের দুইজন প্রভু। একজন সিদ্ধান্তগ্রহণকারী, নির্দেশদানকারী, সম্মানিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ। সে হচ্ছে একজন ক্ষমতাশালী দৈত্য যে তার নিজের শক্তি সম্পর্কে জানত, নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে ছিল আস্থাশীল এবং নিয়তিতে বিশ্বাসী।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে দুজন মানুষ : একজন হচ্ছে অতীত এবং একজন হচ্ছে ভবিষ্যৎ। এর কোটা তুমি? কাছে এসো। তোমাকে ভালো করে দেখতে দাও এবং তোমার ঘুম ও চরিত্র দেখে নিশ্চিত হতে দাও তুমি তাদের একজন যে আলোর ভেতরে এগিয়ে আসছে অথবা যাচ্ছে অন্ধকারে দিকে।
এসো এবং আমাকে বলো তুমি কে এবং কী?
তুমি কি একজন রাজনীতিবিদ? জানতে চাইছ তোমার দেশ তোমার জন্য কী করতে পারে অথবা একটি ঈর্ষা, জিজ্ঞাসা করছে তুমি তোমার দেশের জন্য কী করতে পারো? যদি তুমি প্রথমজন হও তাহলে তুমি হচ্ছ পরজীবী আর যদি দ্বিতীয়জন হও তাহলে তুমি হলে মরুভূমিতে একটি সবুজ উদ্যান।
তুমি কি একজন ব্যবসায়ী? জীবনের প্রয়োজনে সমাজের চাহিদাকে কাজে লাগাচ্ছ একচেটিয়া ব্যবসা এবং মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার কারণে? অথবা একজন আন্তরিক ও কঠোর পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী মানুষ যে কৃষক ও তাঁতির ভেতরে বিনিময়কে সহজ করতে পারে? তুমি কি চাহিদা ও সরবরাহের মাঝখানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তিযুক্ত মুনাফা দাবি করছ? যদি তুমি প্রথম ব্যক্তি হও তাহলে তুমি একজন অপরাধী, তা তুমি প্রাসাদে অথবা কারাগারে বসবাস করো না কেন?। আর যদি তুমি দ্বিতীয় ব্যক্তি হও তাহলে তুমি একজন পরোপকারী মানুষ, জনগণ তোমাকে ধন্যবাদ জানাক অথবা অভিযুক্ত করুক।
তুমি কি একজন ধর্মীয় নেতা, বয়ন করছ জনগণের অবজ্ঞা থেকে তোমার শরীরের জন্য একটা পোশাক, তাদের হৃদয়ের সাধারণত্ব থেকে তৈরি করছ একটা রাজমুকুট এবং ভান করছ খারাপদেরকে ঘৃণা করার, স্রেফ তাদের আয়ের ওপর বেঁচে থাকতে? অথবা তুমি কি একজন ধার্মিক, যে ব্যক্তির ধর্মানুরাগের ভেতরে দেখতে পায় একটি প্রগতিশীল জাতির ভিত্তিভূমি এবং একটা গভীর অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে সে দেখতে পায় তার আত্মার গভীরতায় একটা মই অনন্ত আত্মার দিকে উঠে গেছে, যা পরিচালিত করবে পৃথিবীকে যদি তুমি প্রথমজন হও, তাহলে তুমি একজন নব্যতান্ত্রিক, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী এমনকি তুমি যদি সারাদিন উপবাস করো এবং সারারাত প্রার্থনা করো তারপরও। আর যদি তুমি দ্বিতীয়জন হও তাহলে তুমি হলে সত্যের উদ্যানের ক্ষুদ্র উদ্ভিদ, যদিও এর সুগন্ধ মানবতার নাসারন্ধ্রের ওপর হারিয়ে যায় অথবা এর সুগন্ধ বেড়ে ওঠে সেই বিরল বাতাসের ভেতর যেখানে ফুলের সুগন্ধ সংরক্ষিত হয়।
তুমি কি একজন সাংবাদিক যে তার ধারণা ও আদর্শ বিক্রি করে দাসের বাজারে, যে জনগণের দুর্দশার মধ্যে জীবনযাপন করে একটা বাজপাখির মতো যা শুধুই অবতরণ করে ভঙ্গুর মৃতদেহের ওপর? অথবা তুমি কি একজন শিক্ষক সেই প্লাটফর্মের ওপর যার সামনে শহরের লোক এসে জড়ো হয়? অভিজ্ঞতা অর্জন করছ জীবন থেকে এবং ধর্মোপদেশের মতো তা উপস্থাপন করছ জনগণের সম্মুখে যা তুমি শিখেছ? যদি তুমি প্রথমজন হও তাহলে তুমি স্পর্শকাতর এবং ক্ষতবিক্ষত। আর যদি হও দ্বিতীয়জন তাহলে তুমি একটা গন্ধতরু এবং একটা ওষুধ।
তুমি কি একজন গভর্নর যে নিজের সম্মান হানি করে সেইসব মানুষের সামনে যারা তাকে নিয়োগ করেছে এবং সম্মান হানি করেছে তাদের যারা শাসন করে, যারা কখনও হাত তোলে না তা পকেটে না-পৌঁছানো পর্যন্ত এবং একটা পদক্ষেপও গ্রহণ করে না লোভ ছাড়া? অথবা তুমি কি একজন বিশ্বস্ত ভৃত্য যে শুধুই জনগণের কল্যাণে সেবাদান করে? যদি তুমি প্রথম ব্যক্তি হও, তাহলে তুমি হলে একটা অশ্রুজল জাতির মাড়াইখানায়, আর যদি তুমি দ্বিতীয়জন হও তাহলে তুমি এর শস্যভাণ্ডারের ওপর একটা আশীৰ্বাদ। তুমি কি একজন স্বামী যে তার স্ত্রীর ক্ষেত্রে যা যা অনুমোদন করে না কিন্তু নিজের জন্য তা অনুমোদন করে? গোগ্রাসে খায় তার প্রিয় খাদ্য স্ত্রীর সঙ্গে বসে একটা শূন্য ডিশের সামনে? অথবা তুমি একজন সঙ্গদানকারী, হাতে হাত ধরা ছাড়া যার কোনো কর্মকাণ্ড নেই? যদি তুমি প্রথমজন হও তাহলে তুমি হচ্ছ একটা গোত্রের সর্বশেষ পোশাকটি, যারা এখনও পশুর চামড়া পরিধান করে এবং গুহা পরিত্যাগের বহু আগেই যারা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং তুমি যদি দ্বিতীয়জন হও তাহলে তুমি হচ্ছ সেই জাতির নেতা ভোরবেলায় যে যাত্রা শুরু করে ন্যায়বিচার ও প্রাজ্ঞতার আলোকরশ্মির দিকে।
তুমি কি আত্মপ্রশান্তিতে পরিপূর্ণ একজন অনুসন্ধানী লেখক, যে তার মাথা রেখেছে ধূলিমলিন অতীতের উপত্যকায় যেখানে অতিক্রান্ত সময় বাতিল করেছে তার সর্বশেষ পোশাক এবং অপ্রয়োজনীয় ধারণাগুলি? অথবা তুমি একজন স্বচ্ছ চিন্তাবিদ, পরীক্ষা করে দেখছ সমাজের জন্য কী উত্তম ও প্রয়োজনীয় এবং অতিবাহিত করছ তোমার জীবন সেইসব নির্মাণ করতে যা প্রয়োজনীয় এবং ধ্বংস করছ যা ক্ষতিকর? যদি তুমি প্রথমজন হও তাহলে তুমি দুর্বল ও বোকা এবং যদি তুমি দ্বিতীয়জন হও, তাহলে তুমি হচ্ছ ক্ষুধার্তের জন্য রুটি এবং তৃষ্ণার্তের জন্য পানি।
তুমি কি একজন কবি, যে খঞ্জনী বাজায় আমিরের দরজায় অথবা তুমি কি এমন কেউ যে বিয়ের সময় ফুল ছুঁড়ে দেয় এবং মুখে উষ্ণ পানিভর্তি স্পঞ্জ নিয়ে মিছিলের সঙ্গে হাঁটে, অথবা তোমার কাছে কোনো উপহার আছে যা ঈশ্বর তোমাকে দান করেছেন, যার ওপরে তুমি স্বর্গীয় সুর বাজাও যা আমাদের হৃদয়কে উত্থিত করে জীবনের সৌন্দর্যের দিকে? যদি তুমি প্রথমজন হও, তাহলে তুমি একজন বাজিকর যে ডেকে আনে আমাদের আত্মাকে, যা তোমার সংকল্পের বিপরীতধর্মী। আর যদি দ্বিতীয়জন হও তাহলে তুমি হলে আমাদের হৃদয়ের ভেতরে একটা ভালোবাসা এবং আমাদের মনের দূরদৃষ্টি।
মধ্যপ্রাচ্যে এখন দুটি মিছিল চলছে : একটা মিছিল হচ্ছে বৃদ্ধলোকদের যারা পিঠ বাঁকা করে বিলাপ করছে, তারা এখন শ্বাসপ্রশ্বাসের বাইরে এবং তাদের পথ হচ্ছে পাহাড়ের নিচে।
অন্য মিছিলটা হচ্ছে যুবকদের, এমনভাবে তারা দৌড়াচ্ছে যে তাদের পাগুলি পাখাযুক্ত এবং তারা উৎফুল্ল যেন তাদের কণ্ঠনালিতে সংগীতের তার বাঁধা রয়েছে, অতিক্রম করছে বাধাগুলি যেন সেখানে চুম্বক আছে যা তাদেরকে পাহাড়ের পাশে উত্তোলন করে এবং মন্ত্রমুগ্ধ করে তাদের হৃদয়কে।
তুমি কোন্টা এবং কোন্ মিছিলে তুমি হাঁটো?
নিজেকে জিজ্ঞাসা করো এবং ধ্যান করো রাত্রির স্থিরতার ভেতরে, খুঁজতে থাকো, যদি তুমি গতকালের দাস হও অথবা স্বাধীন হও আগামীকালের জন্য। আমি তোমাদেরকে বলি যে গতকালের শিশুরা যুগের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে হেঁটে বেড়াচ্ছে, যা তারা তৈরি করেছে নিজেদের জন্য। তারা টানছে একটা পচে যাওয়া দড়ি যা দ্রুত ছিঁড়ে যেতে পারে এবং এ কারণে তারা ভুলে যাওয়া নরকের ভেতরে পড়ে যেতে পারে। আমি বলি যে, দুর্বল ভিত্তি নিয়ে তারা গৃহের ভেতরে বসবাস করছে যেভাবে ঝড়ো বাতাস বয়ে যায় এবং তাদের গৃহ তাদের মাথায় ভেঙে পড়বে এবং তা পরিণত হবে তাদের সমাধিতে। আমি বলি যে, তাদের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা, তাদের কথা, তাদের কলহ, তাদের নির্মাণ, তাদের গ্রন্থ এবং তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড কিছুই নয়, শুধুমাত্র একটা শৃঙ্খল যা তাদেরকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, কারণ তারা ভার বহন করার ক্ষেত্রে খুবই দুর্বল।
কিন্তু জীবন আগামীকালের শিশুদেরকে আহ্বান জানায় এবং দৃঢ় পদক্ষেপে তাকে অনুসরণ করে এবং উঁচু করে তোলে তার মাথা। তারা হল নতুন সীমান্তের ভোরবেলা, কোনো ধোঁয়াই তাদের চোখে অবগুণ্ঠন তৈরি করবে না, শৃঙ্খলের কোনো শব্দই তাদের কণ্ঠস্বরকে ডুবিয়ে দেবে না। তারা সংখ্যায় কয়েকজন মাত্র, কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে একদানা শস্য ও একগাদা খড়ের ভেতরে। কেউ তাদেরকে চেনে না কিন্তু তারা প্রত্যেককে চেনে। তারা হল পর্বতশিখরের মতো, যা একে অন্যকে দেখতে ও শুনতে পারে-গুহার মতো নয় যা দেখতে ও শুনতে পায় না। তারা হল ফসলের বীজ, ঈশ্বর যা শস্যক্ষেতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, ভেঙে ফেলছে সিমের বিচি এবং এর চারাগাছের পাতা বপন করছে সূর্যের মুখোমুখি। এটা বেড়ে উঠবে একটা পরাক্রমশালী বৃক্ষে, এর শিকড় প্রবেশ করবে মাটির হৃদয়ে এবং শাখাগুলি উঁচু হয়ে উঠবে আকাশের দিকে।
কহলীল জিবরানের জীবনপঞ্জি
১৮৮৩ কহলীল জিবরান লেবাননের বিসাররী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শহরটি ওয়াদি কাদিসার (পবিত্র উপত্যকা) প্রান্তে পবিত্র সিডার গ্রোভ অঞ্চলের কাছাকাছি জিবরানের মা কামিলেহ ছিলেন ইস্তিফান রাহমে নামক একজন যাজকের কন্যা। কামিলেহ বিধবা থাকাকালীন অবস্থায় কবির পিতা খলীল জিবরানকে বিয়ে করেন। তার প্রথম স্বামীর নাম ছিল হান্না আবদ-এস-সালাম রাহমে। সেই পক্ষের এক ছেলে ছিল, নাম বুট্টোস। জিবরানের জন্মের সময় তার বয়স ছিল ছয় বছর।
১৮৮৫ জিবরানের প্রথম বোন মিরিয়ানা-এর জন্ম হয়।
১৮৮৭ জিবরানের দ্বিতীয় বোন সুলতানার জন্ম হয়।
১৮৯৫ জিবরান, তার সৎভাই বুট্টোস, তার মা ও দুই বোন অভিবাসী হয়ে আমেরিকায় যান এবং বস্টনের চায়না টাউনে থিতু হন। সে-সময় জিবরানের বাবা রয়ে যায় লেবাননে।
১৮৯৭ জিবরান লেবাননে ফিরে আসেন এবং আল হিকাম স্কুলে অধ্যয়ন শুরু করেন। পাঠ্যতালিকার বাইরে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সে-সময় তিনি লেখাপড়া করেন এবং প্রাচীন আরবি সাহিত্যের ভেতরে ডুবে থাকেন। তিনি নিজেকে সাম্প্রতিক আরবি সাহিত্য-আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত করেন।
১৮৯৯ বিসাররীতে থাকার সময় এবছর গ্রীষ্মকালের ছুটিতে জিবরান একজন সুন্দরী যুবতীর প্রেমে পড়েন। কিন্তু এই সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। জিবরানের প্রথম প্রেম ব্যর্থ হয় এবং তিনি কিছুটা হতাশ হন। একই বছর শরতে তিনি প্যারিস হয়ে বস্টনে ফিরে যান এবং কয়েক বছর পর এই ব্যর্থ প্রেমের বর্ণনা পাওয়া যায় তার দ্য ব্রোকেন উইংস গ্রন্থে।
১৯০২ জিবরান আবার লেবাননে ফেরেন এক আমেরিকান পরিবারের গাইড ও দোভাষী হিসেবে, কিন্তু বোন সুলতানার মৃত্যু এবং মায়ের ভীষণ অসুস্থতার সংবাদ শুনে দ্রুত বস্টনে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
১৯০৩ মার্চ মাসে তার সৎভাই বুট্রোস মারা যায় এবং একই বছর জিবরান ও তার ছোটবোন মিরিয়ানাকে রেখে তার মা মারা যান জুন মাসে। তার মা, সৎভাই ও বোন সুলতানা প্রত্যেকেই মারা যায় যক্ষ্মায়।
১৯০৪ এসময় জিবরান চিত্রশিল্পী হিসেবে পাশ্চাত্যের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে শুরু করেছেন। ফ্রেড হল্যান্ড ডে নামে একজন বহুল পরিচিত আলোকচিত্র শিল্পী তাঁর পৃষ্ঠপোষক হয়ে জানুয়ারি মাসে নিজের স্টুডিওতে কবির পেন্টিং এবং ড্রইং-এর এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। ফেব্রুয়ারি মাসে তার ছবির দ্বিতীয় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় কেমব্রিজ স্কুলে। এটি একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—ম্যারি হাসকেল নামে এক মহিলা এর মালিক এবং পরিচালক যিনি কালক্রমে জিবরানের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। এই কেমব্রিজ স্কুলেই এমিলি মিচেল নামে ফরাসি-বংশোদ্ভূত এক সুন্দরী মহিলার সঙ্গে জিবরানের পরিচয় ঘটে। কেউ কেউ বলে থাকেন জিবরান তার প্রেমে পড়েছিলেন।
১৯০৫ জিবরানের প্রথম আরবি গ্রন্থ ‘আল মুসিকা’ প্রকাশিত হয়।
১৯০৬ জিবরান চার্চ এবং ‘আরা’ (আল মুরুজ—নিম্ফ অব দ্য ভ্যালি)-এর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক রচনা প্রকাশ করেন যা তাকে বিদ্রোহী এবং বিপ্লবী হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়।
১৯০৮ আল আরওয়াহ আল মুতামারিদাহ (স্পিরিট বেরেলিয়াস) প্রকাশের ব্যবস্থার পাশাপাশি জিবরান তখন ফালসাফাত আল-দ্বীন ওয়াল তাদাইয়ুন (দ্য ফিলজফি অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড রিলিজিওসিটি) গ্রন্থের ওপর কাজ করছিলেন। এই গ্রন্থটি কোনোদিনই প্রকাশিত হয়নি।
ম্যারি হাসকেলের বদান্যতায় জিবরান প্যারিস ও লন্ডন ভ্রমণ করেন এবং চিত্রকলা সম্পর্কে অর্জন করেন গভীর জ্ঞান। ম্যারি হাসকেল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিশাল চিত্রশিল্পী ও চিন্তাবিদ হিসেবে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য জিবরানকে সাহায্য করার।
প্যারিসে থাকার সময় জিবরান ইউরোপীয় সাহিত্যের সংস্পর্শে আসেন এবং সমকালীন ইংরেজি ও ফরাসি লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি বিশেষ করে উইলিয়াম ব্লেকের রচনার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন, যে তাঁর চিন্তা ও শিল্পকর্মকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। এছাড়া তিনি জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিটশের ‘দাস স্পোক জরাথ্রুস্ট’ দ্বারাও প্রভাবিত হন।
১৯০৯ জিবরান প্যারিসে তাঁর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। এই প্যারিসেই তার আল-হিকাম স্কুলের পুরোনো সহপাঠী ইউসুফ আল-হুয়াইক-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। ইউসুফও চিত্রকলার ছাত্র। প্যারিসে তাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়। দুজনে মিলে তখন তারা চিত্রকলার আধুনিক ধারার সঙ্গে নিজেদের পরিচিত করানোর চেষ্টা করছেন। যাহোক তারা দেখতে পান, কিউবিজম-এর প্রতি তাদের মৃদু সহানুভূতি ছিল, যা তাদের একজন প্রাচীন প্রথার প্রতি বিশ্বস্ততা পুনঃসমর্থনের পরিবর্তে উন্মত্ত বিপ্লব বলে বর্ণনা করেছেন। তারা ফারসি ভাস্কর অগাস্টি রোডিন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যদিও তা ছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। জিবরানের ছবিতেও রোডিনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্যারিসে জিবরানের শিক্ষক ছিলেন মাইদ্রি লরেন্স, যার ছবি জিবরান মোটেই পছন্দ করতেন না। অবশেষে তিনি শিক্ষককে বাদ দিয়ে নিজে নিজেই আঁকতে শুরু করেন। এ বছরই লেবাননে তাঁর পিতা মারা যান।
১৯১০ জিবরান, আমিন রিহানি ও ইউসুফ আল হুয়াইক লন্ডনে একত্রিত হন এবং আরব-বিশ্বের সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর উদ্ভব ঘটানোর জন্য অনেক পরিকল্পনা করেন। এসব পরিকল্পনার মধ্যে একটা ছিল বৈরুতে থিয়েটার হাউস প্রতিষ্ঠা। অক্টোবর মাসে জিবরান বস্টনে ফিরে আসেন এবং ম্যারি হাসকেলকে বিয়ে করার প্রস্তাব পান। ম্যারি হাসকেল বয়সে তার চেয়ে দশ বছরের বড় ছিলেন, জিবরান তার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।
১৯১১ অটোমান শাসন থেকে আরববিশ্বকে মুক্ত করার তীব্র আন্দোলনকালে জিবরান আল-হালগাল ধাহাবাইয়া (দ্য গোল্ডেন সার্কেল) নামে একটা আধা-রাজনৈতিক সমিতি গঠন করেন। কিন্তু এই গোল্ডেন সার্কেল আরব-অভিবাসীদের কাছে তেমন জনপ্রিয়তা না-পাওয়ায় প্রথম সভার পরই এই সমিতি বন্ধ হয়ে যায়। জিবরান পোট্রেট আঁকার মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করতে শুরু করেন।
১৯১২ জিবরান বস্টন থেকে নিউইয়র্কে এসে একটা স্টুডিও ভাড়া করেন পঞ্চম ও ষষ্ঠ এভিনিউ-এর মাঝখানে ৫১, ওয়েস্ট টেথ স্ট্রিটে। তাঁর এই স্টুডিওকে জিবরান বলতেন ‘সন্ন্যাসীর আশ্রম’। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জিবরান এখানেই ছিলেন। তার আত্মজীবনীমূলক রচনা দ্য ব্রোকেন উইংস প্রকাশিত হয়, যে গ্রন্থের ওপর তিনি কাজ করেছেন ১৯০৩ সাল থেকে।
মে জিয়াদাহ-এর সঙ্গে সাহিত্যবিষয়ক মত বিনিময় এবং প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মে জিয়াদাহ একজন লেবানীয় লেখক যিনি মিশরে বসবাস করতেন। তারা শুধুমাত্র চিঠির মাধ্যমে পরস্পরকে চিনতেন এবং জানতেন। এই সম্পর্ক কুড়ি বছরেরও বেশি স্থায়ী হয়। তারা যে অন্তরঙ্গতা অর্জন করেছিলেন এবং বোঝাবুঝির যে-পর্যায়ে পৌছেছিলেন তা অভিনব এবং জিবরানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
১৯১৪ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ১৯০৪ সাল থেকে প্রকাশিত গদ্যকবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়। তিনি এই সংকলনের নাম দেন এ টিয়ার অ্যান্ড এ স্মাইল। ডিসেম্বর মাসে নিউইয়র্কের মট্রেস গ্যালারিতে তার পেন্টিং ও ড্রইং-এর এক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
১৯১৭ জিবরানের ছবির দুটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। একটা নিউ ইয়র্কের নোয়েডলার গ্যালারিতে এবং অন্যটি বস্টনের ডল অ্যান্ড রিচার্ডস গ্যালারিতে।
১৯১৮ ইংরেজিতে লেখা জিবরানের প্রথম গ্রন্থ দ্য ম্যাডম্যান প্রকাশিত হয়। ১৯১৯ ‘টুয়েন্টি ড্রইংস’ শিরোনামে জিবরানের একটা ড্রইং-এর সংগ্রহ প্রকাশিত হয়। ভূমিকা লেখেন এ্যলিস র্যাফেল। একই বছর প্রকাশিত হয় দ্য প্রোসেশন্স। এটা একটা দার্শনিক তত্ত্ব বিষয়ক কবিতা, জিবরানের নিজের ছবি দিয়ে যার অঙ্গসজ্জা করা হয়। এগুলির মধ্যে তাঁর কিছু শ্রেষ্ঠ ড্রইং রয়েছে।
১৯২০ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ১৯১২-১৯১৮ পর্যন্ত প্রকাশিত জিবরানের গদ্যকবিতা ও ছোট ছোট বর্ণনামূলক রচনার সংকলন ‘আল-আওয়াছিফ’ প্রকাশিত হয় দ্য টেম্পেস্টস শিরোনামে। একই বছর ইংরেজিতে লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ দ্য ফোররানার প্রকাশিত হয়। জিবরান, আল-রাবিতা আল কালামিয়া (আররাবিতাহ) নামে একটা সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নিযুক্ত হন। এই পরিষদের সদস্য ছিলেন অভিবাসী, আরব লেখকরা, যেমন—আবদ-আল-মাছিহ হাদ্দাদ, নাসিব আরিদা, মিখাইল নাইমি, রাশিদ আইয়ুব, নাদরা হাদ্দাদ, উইলিয়াম কাটসফ্লিস, ইলিয়াস আবু মাদি ও ওয়াদি বাহুত।
১৯২১ জিবরানের নাটক ইরাম ধাত আল ইমাদ (ইরাম, সিটি অব লফটি পিলার) প্রকাশিত হয়। নাটকটি আরবিতে লেখা। অতীন্দ্রিয়বাদকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এই নাটকে।
১৯২২ জানুয়ারি মাসে বস্টনের ওমেনস সিটি ক্লাবে জিবরানের আরও একটি ছবির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
১৯২৩ জিবরানের আলবাদাই ওয়াল তারাইফ (বিউটিফুল অ্যান্ড রেয়ার সেইং) প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ তিনি নিজের স্কেচ দিয়ে সজ্জিত করেছেন (সতেরো বছর বয়সে কল্পনা থেকে আঁকা ছবি)। স্কেচগুলি হচ্ছে আরবের বিখ্যাত দার্শনিক ও কবিদের, যেমন, ইবনে সীনা আল গাজ্জালি, আল খানসা, ইবনে আল-ফরিদ, আবু নুয়াজ, ইবনে আল-মুগাফা এবং অন্যান্যরা।
এবছরই জিবরানের সবচেয়ে সফল রচনা দ্য প্রফেট প্রকাশিত হয়।
১৯২৬ জিবরানের বালি ও ফেনা (স্যান্ড অ্যান্ড ফোম) প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটির কিছু
অংশ প্রথমে আরবিতে লেখা হয় এবং পরে তা ইংরেজিতে অনূদিত হয়।
১৯২৮ জিবরানের দীর্ঘ রচনা জেসাস দ্য সান অব ম্যান প্রকাশিত হয়।
১৯৩১ মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগে জিবরানের দ্য আর্থ গডসগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। জিবরান ১০ এপ্রিল শুক্রবার নিউইয়র্কের সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘ অসুস্থতায় ভোগার পর মারা যান। মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের জন্য মৃতদেহ পরীক্ষা করে বলা হয়, ‘লিভার সিরোসিস, সেইসঙ্গে একটা ফুসফুস যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিল।’ তার মরদেহ দুদিন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-কক্ষে রেখে দেওয়া হয় এবং তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানায় তাঁর হাজার হাজার ভক্ত।
তারপর মরদেহ বস্টনে নিয়ে যাওয়া হয়—সেখানে চার্চে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হলে মরদেহ লেবাননে ফেরত পাঠানোর অপেক্ষায় একটা ভল্টে রাখা হয়। মরদেহ আগস্টের ২১ তারিখে বৈরুত বন্দরে এসে পৌঁছায়। একটা জাঁকালো সংবর্ধনার পর জিবরানের মরদেহ বিসাররীতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই স্থায়ী অপেক্ষার স্থানে, সেই ‘মার সারকিস’-এর সন্ন্যাসীদের আখড়ার ভজনালয়ে। মার সারকিসের কাছেই লেবানন সরকারের উৎসাহ ও আনুকূল্যে বিসাররীর লোকেরা একটা স্থায়ী জিবরান যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে।
মৃত্যুকালে জিবরান দুখানা গ্রন্থ রেখে যান যা তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। একটা হচ্ছেওয়ান্ডারার—এ গ্রন্থের কাজ তিনি শেষ করে গিয়েছিলেন—১৯৩২ সালে তা প্রকাশিত হয় এবং অন্যটি দ্য গার্ডেন অব দ্য প্রফেট—এ গ্রন্থটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। বারবারা ইয়ং নামে আমেরিকান এক মহিলা কবি এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ করে ১৯৩৩ সালে তা প্রকাশ করেন। তিনি দাবি করেছেন জিবরানের জীবনের শেষ সাত বছর তিনি তাঁর সঙ্গী ছিলেন।