অন্যান্য গদ্য
১.
কবিতা আমার আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র— কবিতা আমার ভালোবাসার বকুল— প্রতিরোধের হাতিয়ার— খুব ভোরে ঘুম ঘুম চোখে মায়ের চুমু। খুব রাতে নেশাক্রান্ত চোখে যখন বাড়ী ফিরতাম বাবা বিষণ্ন কণ্ঠে বলতো ‘খোকা নষ্ট হয়ে যাসনে’। কবিতা আমার এই দুঃখিত রাতে বুকের ভেতরে বাবার সেই স্নেহময় হাত। আমার চৈতন্যের মাঝে আমি এই কবিতাকে শানিত করি। শ্রমিকের মাংশল পেশীর মতো আমার শব্দ, আমি মনে করি যে কোনো বিপ্লবের জন্যে অন্তত মুক্তির জন্যে কবিতাই রচনা করতে পারে প্রথম সোপান। আমি তাই অন্য কোনো ব্যবসা না কোরে কবিতা লিখি। কবিতার জন্য, কবিতার জন্য আমি যে কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত। কবিতার জন্য আমি আমাকেও খুন করতে প্রস্তুত। কারন কবিতা আমার প্রেম, আমার হাতিয়ার, আমার বউ— কবিতা আমার মা।
লক্ষ মানুষের কাছে আমার প্রতিশ্রুতি, আমার সন্তানদের প্রতি আমার প্রতিশ্রুতি— আমি কবি নই, শব্দ-শ্রমিক।
২.
নিসর্গ-ভাবনা
মানুষহীন, শুধু নদী-জল, বৃক্ষ, ফুল পাখিকে আমি নিসর্গ বলি না। নিসর্গ বললে আমি বুঝি এক খরস্রোতা নদীর পাড় ভাঙছে। প্লাবনে ভাসিয়ে নিচ্ছে দুই পাড়ের জনপদ, জনপদের সংসার, সংসারের মানুষ। খরা, ঝড়, মহামারী, অনাহার আর অকালমৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে মানুষ। পাঞ্জা লড়ছে কিছু-মানুষের তৈরি করা বৈষম্য আর কষ্টের সাথে। নিসর্গ বললে আমি বুঝি অঘ্রানের আকাশে ঘোলা চাঁদ, আদিগন্ত ফসল ভরা ধান ক্ষেত। শিশির— আর সেই ফোঁটা-ফোঁটা শিশিরের মতো লুকোনো কান্না, পরিশ্রমের ঘাম।
নিসর্গ বললে আমার চোখ জুড়ে ভেসে ওঠে শ্রাবনের কালো আকাশ, বুকের ভেতরে জমা কষ্টের মতো। মাটি চিরে এগিয়ে যাওয়া লাঙলের ফলা, কাদাজলে খাওয়া কৃষকের কর্কশ পা। নিসর্গ বললে আমি দেখি ফাল্গুনের রাতে অরন্যে চিতল হরিন, বাঘের তাড়া-খাওয়া খরগোশ আর তাড়া-খাওয়া মানুষের মুখ।
নিসর্গ বলতে আমি ওই পাড়ভাঙা নদী, খরায় চৌচির মাঠ, অঘ্রানের চাঁদ, ধানক্ষেত, ওই নুনে-ধরা মানুষের হাড়, ওই পাঞ্জা-লড়া মানুষের হাত, ওই শিশির, ওই বাঘের উদ্যত থাবা, ওই শ্রাবনের কালো আকাশকে বুঝি।
৩.
মুসলমান পিতা মাতার ঔরসে আমার জন্ম। ইসলামি পারিবারিক এবং উত্তরাধিকার সূত্রে আমি আমার পরিবারের সাথে এখনো যুক্ত। ব্যক্তি বিশ্বাস এবং জীবন আচরনে আমি ইসলাম ধর্মের অন্তর্গত নই। আমি নিজেকে মুসলমান নয়, মানুষ বোলে পরিচয় দিয়ে থাকি। খুব ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলবার জন্যে আমাকে প্রচুর পরামর্শ, অলৌকিক প্রলোভন, নির্দেশ ও প্রহারের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
শীতের শেষ রাতে প্রার্থনার জন্যে ঠান্ডা পুকুরের পানি দিয়ে প্রক্ষালন কখনোই আমি মেনে নিতে পারতাম না। আমার ভীষন খারাপ লাগতো।
এখনো আমার অধিকাংশ সকাল ঘুমের ভেতরেই কাটে। রাত্রি আমার সুখ। রাত্রি আমার নেশা।
8.
রিক্ত হতে হতে একদিন আমরা স্বপ্ন দেখলাম। আমাদের মনে হলো— হাতিয়ার প্রয়োজন। অস্ত্র চাই। কারন অস্ত্রের বিরোধিতা একমাত্র অস্ত্র দিয়েই সংগত, অন্য কিছু দিয়ে নয়। তিরাশির পয়লা ফাল্গুনের পর মনে হলো আমরা রনাঙ্গনের ভেতরে আছি। আমাদের এখন সংগঠিত হতে হবে এবং সংক্রামিত করতে হবে স্বপ্নবান অস্ত্রের আকাংখা।
কিন্তু কি রকম যেন গোলমেলে আর ঘোলাটে হয়ে পড়লো পরের দিনগুলো। অভিজাত পাড়া থেকে কিছু গাড়ি অন্য অভিজাত পাড়ায় যাতায়াত করলো। কিছু টেলিফোন বাজলো। হ্যালো বেতবুনিয়া! টেলেক্স!! টেলেক্স!!!
কিছু চমৎকার ডিনার টেবিলের সামনে জমা হলো কিছু অশ্লীল চমৎকার মানুষ— যাদের প্রত্যেকের তর্জনীই ভয়ংকর পারমানবিক ক্ষমতা ধারন করে।
কেমন ঝিমিয়ে গেল সব। মিছিলের প্রথম সারির ছেলেটির সাথে একসাথে আবেগপ্রবহন হতে হতে টের পাই ওর ঘরে ফেরার ইচ্ছা জেগেছে।
তাহলে কি যে-যার ঘরে যাবো বোলে আমরা রাস্তায় বেরিয়েছিলাম? তাহলে আমাকে যে-সমতার কথা বলা হয়েছে তার মানে কি এইভাবে অধিকাংশ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়া?
আমি তো আমাদের সবটুকু সম্পদের সমান ভাগাভাগি চাই। মেধা ও শ্রমের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে মানুষের মর্যাদা, আমি বিশ্বাস করি।
৫.
‘বিভীষন’ (?) সমীপে
গত ২১ বৈশাখ ১৩৯০ তারিখ দৈনিক ইত্তেফাকের রূপবানী পাতায় জনৈক আবু সাইমুম-এর একটি প্রকাশিত চিঠি আমার দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। চিঠিটি টেলিভিশন সংক্রান্ত। টেলিভিশনে যে ভীষন কান্ডগুলো প্রায়শই ঘটে থাকে তা ‘বিভীষনে’র চেয়েও বি-ভীষন, পত্র-লেখকের সাথে এ ব্যাপারে আমি প্রায় একমত। কিন্তু কেন যে ‘আয়না’ নামক অনুষ্ঠানটির ‘অকথ্য অশ্রাব্য’ ভাষা পত্র-লেখককে বিস্মিত, বিব্রত ও বিক্ষুব্ধ করেছে তা আমার বোধগম্য হলো না। আমাদের শতকরা পঁচাশি জন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যে শব্দ, বাক্য ও কথা ব্যবহৃত হয়, জীবন যাপনের কারনে যে ভাষায় আমাদের কথা বলতে হয় তা কিছু সংখ্যক বিত্তবান ও সুবিধাভোগী শ্রেনীর কাছে ‘অরুচিকর অশ্রাব্য অমার্জিত’ মনে হতে পারে। মনে হওয়া স্বাভাবিক।
টেলিভিশন আমাদের পয়সায় চলে। কাজেই এই প্রচার মাধ্যমটিতে আমাদের জীবন, আমাদের সমাজ-সমস্যার ছবি অবশ্যই থাকতে হবে। আমাদের অর্থাৎ শতকরা পঁচাশি জন মানুষের। গুটিকয় সুবিধাভোগী বিত্তবান প্রানীর নাকি কান্না বা বিকৃত নর্তন কুর্দনের জন্যে আমরা দেশি ও বিদেশি মুদ্রায় টেলিভিশনের খরচ জোগাতে রাজী নই। ‘পেটের সাথে সম্পর্কিত’ ও রকম সহস্র ‘চে’-এর ভিতর দিয়ে আমাদের দৈনিক আসা যাওয়া, থাকা— বেঁচে থাকা। তার মাত্র দুই একটি ‘চে’র কথা যদি প্রকাশিত হয়ে পড়ে তবে এতো খারাপ লাগে কেন? এতো অশ্রাব্য লাগে কেন? এদেশের শতকরা পঁচাশি জন মানুষের পরিবারে এরকম প্রচুর ‘চে’র ব্যবহার হয়ে থাকে। পরিবারের আবাল- বৃদ্ধ-বনিতা এই অশ্রাব্য জীবনেই বাস করে। পত্র-লেখকের যদি এই একটি মাত্র ‘চে’- তেই এতোখানি বিবমিষা জেগে থাকে তো আমার অনুরোধ আপনি বমি করুন। এবং আপনার মূল্যবান অর্ধজীর্ন খাদ্যের মনোরম বমিতে আপনি রঞ্জিত করুন আপনার মহান রুচিবোধ।
আমরা চাই অধিকাংশ মানুষের জীবনের খাঁটি ছবিগুলো প্রকাশিত হোক। সামান্য হলেও নাট্যকার সেলিম আল দীন ও প্রযোজক নাসির উদ্দিন ইউসুফ তা করতে চেষ্টা করেছেন। আয়নার নাট্যকার, প্রযোজক ও অভিনেতাদের জন্যে রক্তিম শুভেচ্ছা।
৬.
দজ্জাল এসেছিলো
আপনারা জানেন, কেতাবে পড়েছেন— দুনিয়ায় একদিন খর দজ্জাল আসবে ধর্মভীরু মানুষকে প্রতারনা করতে। দেখতে তারা মুমিন মুসল্লির মতো, তারা খুব মিষ্টি ভাষায় কথা বলে। তারা আল্লার নামে শেরেকি করবে। তারা বেহেস্ত দ্যাখাবে। তারা ভয় দ্যাখাবে যে, তাদের কথা যারা শুনবে না তারা দোজখে যাবে। এরা সেই দজ্জাল- শয়তানের পান্ডা বাহিনী। কদিন আগেই এরা এসেছিলো, এরা এখনো আছে। আল্লার নামে তারা ভোট চেয়েছে। তারা বেহেস্তে যাবার টিকিট দিয়েছে।
এরাই সেই দজ্জাল।
কেতাবে এদের যেভাবে শাস্তি দেবার নির্দেশ আছে— সেই ব্যবস্থা কার্যকর করুন।
—বাঙালি সমাজ
৭.
জাতীয় কবিতা উৎসবের জন্ম-বৃত্তান্ত
১৪ই জানুয়ারি। বসার ঘরে আমি আর তসলিমা নাসরিন আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কের কিভাবে ইতি টানা যায়, এই নিয়ে শান্ত আলাপে মগ্ন। অনেকদিন থেকেই সম্পর্কটি ভালো যাচ্ছে না আমাদের। কেচ্ছা কেলেংকারি না ঘটিয়ে সুস্থভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া যায় কিনা আমরা তারই পথ খুঁজছিলাম।
কলিংবেল বেজে উঠলো। বন্ধু মোহন রায়হান এবং অনুজ কবি তারিক সুজাত হৈ হৈ কোরে ঘরে ঢুকলো। মোহনের সাথে মতাদর্শগত কারনে অতীতে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিলো সম্প্রতি আমরা উভয়ে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। কুশল বিনিময়ের পর ‘এশীয় কবিতা উৎসবে’র প্রসঙ্গ তুললো মোহন। খামার থেকে সপ্তাহ খানেক আগে ঢাকা ফিরেই আমি এ খবর পেয়েছি। খোঁজ নিয়েছি কারা কারা যোগ দিচ্ছে। এশিয়া উৎসবের বিকল্প কিছু একটা করার চিন্তা মাথায় এলেও কবিতা-লিখিয়ে সব তরুনের মনোভাব তখনো জানতে পারিনি।
তিন জনেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেল্লাম এশিয়া কবিতা উৎসবকে চ্যালেঞ্জ কোরে আমরা জাতীয় কবিতা উৎসব করবো। সারা দেশ থেকে কবিরা ঢাকা এসে উৎসবে যোগ দেবে। ঠিক হলো ১৫ তারিখ সকাল দশটায় টিএসসিতে তরুনদের নিয়ে বোসে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। রাত এগারোটার পর মোহন ও তারিক চ’লে যাওয়ার সময় আমার ব্যক্তিগত সমস্যাটিও ওরা সাথে কোরে নিয়ে গেল। মাথায় এখন একটি চিন্তা— জাতীয় কবিতা উৎসব!
[অসমাপ্ত]