অন্যমনস্ক চোর
তোমরা কখনও অন্যমনস্ক চোর দেখেছ? আমি একবার দেখেছিলুম। সেই কথাই বলি।
আমাদের কলকাতার বাসায় তখন কেউ নেই। গরমের ছুটি হওয়াতে সবাই দার্জিলিং বেড়াতে চলে গেছে। একশো আট ডিগ্রির জ্বালায় আমি একা বসে ছটফট করছি। অথচ আমার কলকাতা ছাড়বার জো নেই– আই এ পরীক্ষার একগাদা খাতা দেখতে হচ্ছে।
সেদিন রাতে কিছুতেই ঘুম আসছে না। একে তো প্রায় সাড়ে বারোটা অবধি খাতা দেখেছি মাথার মধ্যে বানান আর ব্যাকরণের ভুলগুলো পোকার মতো কিলবিল করছে। তায় অসহ্য গরম– ঘুরন্ত পাখাটাও যেন আগুন বৃষ্টি করছে।
অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে সবে একটু ঝিমুনি এসেছে, হঠাৎ শুনতে পেলুম, ধ্যাৎ, সিন্দুকটা গেল কোথায়?
ভাবলুম স্বপ্ন দেখছি, তক্ষুনি আবার কানে এল : ড্রেসিং টেবিলটাও উড়ে গেল নাকি?
আর সন্দেহ নেই ঘরে কেউ ঢুকেছে। পুরো চোখ মেলে পরিষ্কার দেখলুম, জানালার কাছে কে দাঁড়িয়ে।
মাথার পাশেই টিপয়ের ওপরে টেবল ল্যাম্প ছিল। সুইচ টিপে সেটা জ্বাললুম। যা ভেবেছি তাই, ঘরে চোর ঢুকেছে। সাদা বেনিয়ান আর ধুতিপরা একটা বেঁটে মতো লোক– জানালার পাশটিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে। চোর চোর বলে চেঁচাতে যাব, তার আগেই লোকটা হাতজোড় করে বললে, কিছু মনে করবেন না স্যার আপনার ঘুমের ডিসটার্ব করলুম। একটু ভুল হয়ে গেছে।
লোকটার কথার ভঙ্গিতে ভয় কেটে গিয়ে ভারি আশ্চর্য লাগল আমার। বললুম, তার মানে?
সে বললে, এটা তো বাহান্ন নম্বরের বাড়ি নয়?
আমি বললুম, না– বাইশ নম্বর।
লোকটা বললে, দেখলেন তো, ঠিক ধরেছি। বাহান্ন নম্বরের জানালা বেয়ে উঠলেই ডানদিকের দেওয়ালে লোহার সিন্দুক- এই তার নকল চাবি। বলে সে আমাকে একটা ছোট চাবি দেখালে। তারপরে বলে চলল, আর লোহার সিন্দুকের পাশেই হল ড্রেসিং টেবিল- আজ রাতে গিন্নিমা সিনেমা থেকে ফিরে তার টানায় গয়নাগুলো খুলে রাখবেন। ঘরে ঢুকেই আমি টের পেয়েছি, সব গড়বড় হয়ে গেছে। ভালো কথা, এটা প্যারীচাঁদ লেন তো?
আমি বললুম, না– পটলডাঙা লেন।
-ওই দেখুন রাস্তাতেও গণ্ডগোল। ধ্যাৎ ভালো লাগে নাকি? কী বিচ্ছিরি ভুল দেখুন তো?
লোকটার কথাবার্তা অদ্ভুত লাগছিল। মাঝরাতে জানালা বেয়ে ঘরে ঢুকে এ আবার কী রসিকতা শুরু করলে। বললুম, ব্যাপার কী হে, তোমার মাথা খারাপ নাকি?
-মাথা খারাপ হতে যাবে কেন স্যার? আমাকে দেখে কি তাই মনে হচ্ছে? আমি চোর।
-চোর!
অত অবাক হয়ে গেলেন কেন?– লোকটা প্রায় আমাকে ধমকই লাগিয়ে দিলে, একটা : রাত্তিরবেলা আপনার ঘরের জানলা দিয়ে চোর ঢুকবে না তো ডাকপিয়ন ঢুকবে নাকি? কী যে বলেন কিছু মানে হয় না।
আমি বললুম, অ, বুঝেছি। বাহান্ন নম্বর প্যারীচাঁদে চুরি করতে গিয়ে বাইশ নম্বর পটলডাঙায় ঢুকেছে!
–ইয়া, ঠিক ধরেছেন এবারে। কিন্তু কী ল্যাঠা বলুন দিকি? এতটা জানালা বেয়ে উঠেছি, জলের পাইপের ঘষায় হাঁটুর ছাল উঠে গেছে বুকের ভেতর হাঁফ ধরছে; এখন কি আর প্যারীচাঁদ লেনে যেতে ইচ্ছে করে? আপনার ঘরে একটু বসব স্যার? জিরিয়ে নেব একটুখানি?
আমার বেশ লাগছিল চোরটাকে। বললুম, তা বসতে পারো।
বলেই আমি হাঁ-হাঁ করে উঠলাম।
আরে, আরে– ওটা কিসের ওপর বসছ?
কিন্তু ততক্ষণে যা করবার তা করে ফেলেছে। টুলের পাশে কুঁজোটা ছিল, ভুল করে টুল ভেবে চেপে বসতে গেছে কুঁজোয়– আর তক্ষুনি পড়ে গেছে মুখ থুবড়ে। কুঁজো ভেঙে চৌচির। ঘরময় জল!
বোকার মতো একগাল হেসে উঠে দাঁড়াল, ভিজে জবজবে।
আমি রেগে বললুম, এটা কী হল শুনি?
লোকটা গাল চুলকে বললে, আপনার একটু ড্যামেজ করে ফেললুম স্যার! কিছু মনে করবেন না। নিজেও একদম ভিজে গেছি।
বললুম, টুলটা টেনে ভালো করে দেখে বোসো। আবার রেডিওটার ওপরে চাপতে যেয়ো না।
সে বললে, না স্যার, বার বার কি আর ভুল হয়? একটা ঝাঁটা দিন– ঘরটা সাফ করে ফেলি! এই যে পেয়েছি বলে সে আমার ছাতাটা তুলে নিলে।
আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললুম, রাখো– রাখো– ওটা ঝাঁটা নয়, ছাতা। খুব হয়েছে, তোমার আর ঘর সাফ করবার দরকার নেই।
লোকটা লজ্জিত হয়ে টুলটার ওপর বসে পড়ল। বার কয়েক কান-টান চুলকে বললে, একটা বিড়ি খাব স্যার? কিছু মনে করবেন না?
–মনে করব কেন– খাও না।
বলতেই বুক-পকেট থেকে টিনের কৌটো আর দেশলাই বের করলে। তারপর একটা দেশলাইয়ের কাঠি মুখে দিয়ে বিড়িটাকে দেশলাইয়ের গায়ে ঘষতে লাগল।
ধ্যাৎ– ধরছে না! কী যাচ্ছেতাই দেশলাইয়ের কাঠি।
আমি বললুম, কী পাগলামো হচ্ছে শুনি? ভালো করে তাকিয়ে দেখো তো, কী ঘষছে।
-এঃ হে, তাই ধরছে না! বলেই সে বিড়িটা ফেলে দিলে। তারপর ফস করে দেশলাই ধরিয়ে নিজের মুখের কাঠিতে ঠেকাল। সেটা ফড়াং করে জ্বলে উঠতেই চমকে এক লাফ।
–ইস–নাকটা পুড়ে গেল স্যার! উঃ-উঃ
বললুম, বিড়ির বদলে দেশলাইয়ের কাঠি ধরালে নাক পোড়েই।
–তাই তো দেখছি।–লোকটা ব্যাজার হয়ে উঠল; দুত্তোর, বিড়ি আর খাবই না। বলে সে রেডিওটার ওপর চেপে বসতে গেল।
–আরে, আরে–ওটায় নয়–টুলে বোসো। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম।
–ঠিক ধরিয়ে দিয়েছেন স্যার!–লোকটা আপ্যায়িত হল : আর একটু হলেই রেডিওটা সুদ্ধ আমি আছাড় খেতুম। কিন্তু নাকটা খুব জ্বলছে- বুঝলেন। বোধ হয় ফোঁসকা পড়বে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, ফোঁসকা পড়াই উচিত তোমার– যেমন কাণ্ড! এত ভুলো মন নিয়ে চুরি করো কী করে?
নাকের ডগায় হাত বুলোত বুলোতে সে বললে, ওই জন্যেই তো মধ্যে-মধ্যে ভারি মুস্কিল হয় স্যার! মাস ছয়েক আগে কী কাণ্ড করেছিলম– জানেন? ভিড়ের মধ্যে ট্রামে উঠেছি–পকেট মারব। একজনের পয়সা বাঁধা রুমালটা তুলে নিয়ে যেই ট্রাম থেকে লাফিয়ে পড়েছি– সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বললে, পকেটমার পকেটমার! লোকে তাড়া করলে– আমিও টেনে দৌড়। রাস্তার ডান দিকের গলি ভুল করে বাঁ দিকে ছুটলুম সোজা কোথায় ঢুকলুম গিয়ে–জানেন? থানার মধ্যে!
থানার মধ্যে?
–তাতে দুঃখু ছিল না স্যার! আসলে গোলমালটা হল অন্য জায়গায়। যেরুমালটা অন্যের পকেট থেকে নিয়েছি ভেবেছিলুম– সেটা আমারই রুমাল। ভিড়ের ভেতর অন্যের ভেবে নিজেরই পকেট মেরেছি। তাতে ছোট-ছোট আলুভাজার মতো পাঁচটা নয়া পয়সা বাঁধা ছিল।
-বলো কী।
লোকটা উত্তেজিত হয়ে বললে, একটা পাহারাওয়ালার কী আস্পর্ধা স্যার আমাকে বললে, পাগল করাচি চলে যা।
বললুম, করাচি নয়–রাঁচি।
লোকটা বললে, একই কথা স্যার! তা আমার খুব রাগ হল। পাহারাওয়ালাকে বোঁ করে একটা ঘুষি মেরে বললুম, জানিস আমি চোর, তবু তুই আমাকে পাগল বলিস! তোর ইচ্ছে হয়, তুই করাচি যা। আমি চোর, আমি হাজতে ঢুকব। এই বলে জোর করে হাজতে ঢুকতে যাচ্ছি, সবাই মিলে আমায় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বের করে দিলে। আর সেই পাহারাওয়ালাটা ঘুষি খেয়েও দাঁত রকুটে হাসতে লাগল।
আমি মাথা নেড়ে বললুম, ভারি দুঃখের কথা।
লোকটা বললে, এই জন্যেই তো মন খারাপ হয়ে যায় স্যার! অত কষ্ট করে চোর হয়েছি- এখন পাগল বললে কি ভালো লাগে, বলুন তো? অথচ আসবার সঙ্গে সঙ্গেই সে কথা বলে আপনি আমায় দুঃখ দিলেন।
আমি বললুম, বুঝতে পারিনি, তাই বলেছি, কিছু মনে কোরো না। তা চুরিচামারিতে কিছু হয়?
একেবারে কিছু হয় না– তা বলব না স্যার! এই তো কদিন আগে এক ঢাকাই মহাজনের বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছিলাম। সামনে ক্যাশবাক্স ছিল, আমি ভুল করে। আর-একটা কী ধরে টান দিলুম। দড়িতে বাঁধা ছিল, টানের চোটে ছিঁড়ে এল। বেশ ভারি শক্ত– গোলগাল। বার করে আনতে মনে হল, সেটা যেন আমাকে কামড়াবার চেষ্টা করেছ। ব্যাপার কী- ক্যাশবাক্স কামড়ায়? অনেক ক্যাশবাক্স দেখেছি, গলা বের করে। কামড়াতে চায় এমন তো দেখিনি। আলোয় এনে দেখি- ধ্যাৎ একটা কচ্ছপ। পরদিন দিলুম রাস্তার একটা লোককে বেচে আটগণ্ডা পয়সা দিলে। একটা অবশ্য সীসের সিকি– তা হোক, চারগণ্ডা পয়সা তো পেলুম। কিছু লাভ তো হলই, কী বলেন?
বললুম, যাঁ– কিছু লাভ হল বই কি।
লোকটা বললে, তবেই দেখুন কাজটা নেহাত মন্দ নয়। উঃ- নাকটা বেজায় জ্বলছে। একটা বিড়ি খাই–কী বলেন?
বললুম, তা খাও। তবে এবার আর মুখ পুড়িয়ো না।
না স্যার, বার বার কি ভুল হয়।– বলে পাশের পকেট থেকে একটা মানিব্যাগ বের করে সে হাতের উপর উপুড় করলে। বিড়ি বেরুল না– ছোট-ছোট আলুভাজার মতো পাঁচটা নয়া পয়সা পড়ল।
— কী মুস্কিল-বিড়িগুলো গেল কোথায়?
লোকটার বোকামি দেখে আমার গা জ্বলে উঠল। বললুম, ওটা মানিব্যাগ। ওর মধ্যে বিড়ি কী করে আসবে?
–তা বটে–এটা মানিব্যাগ লোকটা সেটাকে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল; সেই রুমাল নিয়ে কেলেঙ্কারি হওয়ার পর একটা ব্যাগ কিনেছি। বুক-পকেটে রাখি। যতই মনের ভুল হোক স্যার নিজের বুক পকেট কেউ মারতে পারে না। পারে স্যার?
একমাত্র তুমিই পারো বোধ হয়।
না স্যার, তিন মাসের মধ্যে আমিও পারিনি। কিন্তু বিড়ি একটা না-খেলেই নয়। বলে, আবার বিড়ি খুঁজতে যাচ্ছে, হঠাৎ ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে টং টং করে তিনটে বাজল।
–অ্যা–তিনটে? কী সর্বনাশ।–
-সর্বনাশ কেন?
বাড়িতে বলে এসেছি যে। তিনটের মধ্যে না ফিরলে তারা ভাববে আমাকে পুলিশ ধরেছে। আপনি একটু উঠুন না স্যার।
-কেন?
–আমাকে থানায় দিয়ে আসবেন।
এবার আমার ভারি রাগ হল। রাত দুপুরে এ কী জ্বালাতন! একটু ঘুমুতে পেলুম না– এখন আবার থানায় দৌড়োই বললুম, তুমি বাড়ি যাও– আমার আর হাড় জ্বালিয়ো না।
লোকটা মিনতি করে বললে, একবারটি চলুন না স্যার, ধরিয়ে দিয়ে আসবেন। আমি বাড়িতে বলে এসেছি–।
ধৈর্য আর কতক্ষণ থাকে। আমি হঠাৎ বেদম চিৎকার করে উঠলুম : গেট আউট-বেরোও–বেরোও বলছি
সেই চিৎকারে বিষয় চমকে লোকটা জানালা বেয়ে টপ করে লাফিয়ে পড়ল। কেঁউ করে একটা কাতর আর্তনাদ উঠল বুঝলুম, নেড়ী কুকুরের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে। ভুল করে আবার জ্বালাতে না আসে, এই ভেবে শক্ত করে জানালাটা এঁটে দিলুম।
সকালে দেখি, টেবিলের ওপর পাঁচটা আলুভাজার মতো নয়া পয়সা আর মানিব্যাগটা পড়ে আছে। আমার চশমার খাপটা পাওয়া গেল না যাওয়ার সময় মানিব্যাগ ভেবে সেইটে নিয়েই পালিয়েছে।