প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

অন্নভোগ – ৯

নয় 

সকাল থেকেই পিলুর মেজাজ খারাপ। আমাকে কিছু বলবে না। যাব বাড়ি থেকে বের হয়ে বুঝবে মজা।

—যা না যা, একটাতো গেছে। তুইও যা। কে থাকতে বলেছে। আমি তোদের কে? 

আসলে পিলু বুঝতে পারে, দাদা বাড়ি নেই বলে মা’র চণ্ডীপাঠ শুরু হয়ে গেছে। শীতের সময়। বাড়িতে পিঠে পুলি হবে। চাল বাটা থেকে, মাষকলাই কিছুই বাদ যায়নি। ঠাকুরের ভোগ হবে। অথচ দাদাটা বাড়ি নেই। ইট কাটার আগে ঠাকুরকে সামান্য অন্নভোগ। 

সব ঝক্কি তার উপর 

—এই পিলু! 

বাবা হয়তো ডাকলেন। 

—যাতো সনাতনকে বলবি সের খানেক আরও খেজুরের গুড় দিতে। তোর মা-তো রণচণ্ডী হয়ে আছেন। ঠাকুরের ভোগ কার জন্য। আরে বোঝো না, কার জন্য। মানত করেছি যখন, দিতেই হয়। দেখি ঠাকুর কী করেন। কতটা খেলাতে পারেন। ইটের ভাটা হবে বোঝো না! 

সকাল থেকেই শুরু হয়েছিল। এক দণ্ড সে বসে থাকতে পারছে না। পরীক্ষা হয়ে গেছে। স্কুল নেই। বাড়িতে আর কে আছে ছোটাছুটি করবে। দাদাটি তো মজা করছেন। কার সঙ্গে পিলু তাও বোঝে না। পরীদি দাদার কবিতা নিয়েই হৈচৈ করছে। আরে মানুষটা কোথায় আছে কী খাচ্ছে, কারো মাথায় নেই। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে খেতে জানে না, তার কি না এত মেজাজ! 

সকালে উঠেই একবার যেতে হয়েছে নিবারণ দাসের আড়তে। ইট কাটা হবে। মাটি তোলার কাজের জনমজুর নিবারণ দাসেরই ঠিক করে দেবার কথা। বাবার বড় যজমান। বিষয়ী মানুষ। সব কাজে কর্মে নিবারণ দাসকে খবর দাও। কোথায় ইটের ভাটা হবে, জনমজুর কত লাগবে, সাঁওতাল মেঝেন হলে ভাল হয়—সবই নিবারণ দাসের পরামর্শে। দাদা বাড়ি নেই—অথচ বাবা কোনো কাজই করতে বাকি রাখছেন না। বাবা যে ভাল নেই সে বোঝে! যখন ভাল নেই, তখন আর ইটের ভাটা পুড়িয়ে কী হবে! কার জন্য মন্দির! নবমীর গুপ্তধন বাবা পেয়ে সব ঠাকুরের নামে করে রাখছেন। জমি জমা বাড়ি ঘর সব। নবমীর ইচ্ছে, জঙ্গলে তার স্বামীর ভিটায় যেন শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা হয়। পিলু আজ নবমী বুড়ির উপরও ক্ষেপে আছে। কৈ যখন তুলে আনি তখন তো এত বায়না ছিল না! যখের ভয়! যখ ঢুকে গেছে! যখন ঢুকে গেছে তো আমরা কী করব! 

সেই নবমীর এখন সাধ, তার ভিটায় যেন একখানা শিবলিঙ্গ স্থাপন করা হয়। 

সে শুনেই হম্বিতম্বি শুরু করেছে। নবমী তোমার এত সাধ থাকলে জঙ্গলে পড়ে থাকলেই পারতে। কে করে! 

বাবা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন।—কে করে মানে! 

পিলুও আজকাল বাবার মুখে মুখে উত্তর করে। বাবা তখন গুম মেরে যান। কখনও তার ভুল ধরিয়ে দেন। কে করে মানে ঈশ্বর করেন। নবমীর ভিটায় শিবলিঙ্গ স্থাপন হবে কী হবে না তাঁর মর্জি। তুমি বললেও হবে না, না বললেও আবার হতে পারে। 

হয়ে গেল। 

সকাল থেকে এই করে তার চোটপাট শুরু। বাবা রাজি হয়েছেন। ইটের ভাটায় আর ক’খানা বেশি ইট পুড়িয়ে নিলেই হবে। বাড়িতে এই রাজসূয় যজ্ঞ চলছে, আর তার দাদাটা কলকাতায় গা ঢাকা দিয়ে আছে। কেউ কোনো খোঁজখবর নিচ্ছে না। আজ বাড়িতে ঠাকুরের ভোগ হবে। দু-দশজনকে বলাও হয়েছে—প্রসাদ নেবার জন্য—মা সকাল থেকে লেগে পড়েছে। বৃন্দাবন করের বৌ এসে গেছে। বাড়িতে গোবিন্দভোগ আতপ চালের ভাত হবে। পায়েস হবে। পিঠে পুলি কালই করে রাখা হয়েছে। ঠাকুরকে দেওয়া হবে না, তবে যারা আমন্ত্রিত তাদের পাতে দেওয়া হবে। কাল থেকে বালতি বালতি জল তোলা, ড্রামে ভরা, নিরাপদদা সকাল থেকেই কাজে লেগে গেছে—সে চেলাকাঠ এনে ফেলছে। গর্ত করছে। উনুনে বড় কড়াই, বড় তামার ডেগ বসানোর মতো গর্ত করা হচ্ছে। আর তার দাদার কথা একবারও কেউ মনে করছে না! মাথা কী গরম সহজে হয়। একবার দাদা ফিরে আসুক, মজা বুঝবে। 

বাবা বললেন, পিলু, কাজের বাড়িতে মেজাজ খারাপ করতে নেই। মা’র কথা শুনতে হয়। দেখছিস তো কেউ বসে নেই! 

বাবা পিলুকে আজ বেশ তোষামোদ করে কথা বলছেন। সকালবেলায় স্কুলের মাঠে তার কত কাজ। সবাই এসে বসে থাকবে। একটা দড়ি যোগাড় হয়ে গেছে। দুটো বাঁশও। চাঁদা তুলে বল কেনা হয়েছে। সে না গেলে কেউ কাজে হাত দেবে না। কিছুতেই মা আজ সাইকেল তাকে হাতছাড়া করবে না। চাবিটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। সে দৌড়ে গেছে। সনতের দোকান থেকে খেজুরের গুড় এনে দিয়েছে। সাইকেলটা দিলে কত তাড়াতাড়ি হয়। সেই সাইকেলটাই হাত ছাড়া! কার মাথা ঠিক থাকে। 

আর এ-সময়ই বাবার কী মনে হল কে জানে! ডাকলেন, পিলু, শোন। পিলু রাগে ক্ষোভে থম মেরে আছে। কিছু বলছে না। বাবা বললেন, যখন ভোগ হচ্ছেই, এক কাজ করলে হয় না! তুই কী মনে করিস—একবার শহরে খবর দিলে হয় না, বিলুর বন্ধুদের। অন্ন প্রসাদ নিত তারা। 

বাবার এ-হেন বিবেচনায় পিলু আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। দাদা বাড়ি নেই, ভোজ হচ্ছে। দাদার বন্ধুরাও ভোগ খাবে। তাদের বলে আসতে হবে। সাইকেলটা সে এই অজুহাতে পেয়ে যেতে পারে। আসলে সাইকেলে তালা পড়ার পেছনে বাবার কোনো উসকানি থাকতে পারে। দিন-রাত টো টো করে বেড়ানোর স্বভাব হয়ে গেছিল। বাবা বার বার সাবধান করেও পারেননি। সাইকেলই তোমাকে খাবে। কিন্তু সে তো কথা শোনার পাত্র নয়। তাকে জব্দ করতে হলে সাইকেলে তালা না দিয়ে রাখলে চলবে না। প্রতিবেশীরা তার সাইকেল, আর ট্রাকের বাজি রেখে খেলা দেখে ফেললেই বাবার কাছে এসে নালিশ, ঠাকুরকর্তা, পিলু তো যমের সঙ্গে লড়ালড়ি শুরু করে দিয়েছে। তারপর বিশদ বর্ণনা। অভিযোগ এক দু-দিন নয়—মাঝে মাঝেই ওঠে। আজ কাজের দিন, কোনো অনর্থ ঘটলে—শুভ কাজ পণ্ড। তার চেয়ে সংসারে বাবার শুভ কাজের দাম বেশি! 

সে বলল, আমি পারব না। 

বাবা বললেন, সাইকলটা নিয়ে মুকুল নিখিল সুধীনকে অন্তত বলে আয়। ওরা তো আমার বাড়িতে অন্ন প্রসাদ কখনও গ্রহণ করেনি। গেরস্থের এতে মঙ্গল হয় জানিস। 

সাইকেলটা হাতে পাবে জেনেই সে শেষে রাজি হয়ে গেল। বলল, দাও তবে বলে আসি।

বাবা বললেন, মিমিকেও খবরটা দিস। 

বাবা একপ্রস্থ ফর্দ দিয়ে নিরাপদকে আবার বাজারে পাঠিয়েছেন। পিলু সাইকেল নিয়ে বের হয়ে গেল। সে সাঁ সাঁ করে ছুটে যেতে থাকল। এবং যাবার আগে স্কুলের মাঠে বলে গেল, আজ আর তাকে পাওয়া যাবে না। বাবা অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করেছেন। অশ্বমেধ যজ্ঞ কী সে জানে। নবমীকে বিকেলে রামায়ণ মহাভারত পাঠ করে শোনানোর দায়িত্ব মাঝে মাঝে তার উপর বর্তায়। দুলে দুলে সুর ধরে পড়তে মন্দ লাগে না। অভিমন্যু বধ পড়তে পড়তে সেও সবার সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেলে। সুভদ্রা জননী যেন আর কেউ না। তার নিজের মা’র কথা মনে হয়। উত্তরার কথা মনে হলে তার পরীদির মুখ ভেসে ওঠে। যেন পরীদিরই কাজ, দাদা যে আজ নিখোঁজ পরীদি তার জন্য দায়ী। সাজগোজ করিয়ে রণক্ষেত্রে পাঠিয়ে এখন নিজে হা হুতাশ করছে। 

কারণ সে পরীদিকে আবার দেখেছে, দাদার খোঁজ খবর না পেয়ে কেমন মনমরা হয়ে গেছে।

পরীদি নিজেও গেছিল কলকাতায়। ফিরে এসে বাবাকে সব খবর দেওয়া চাই। 

পত্রিকা অফিসে গেছে। কবিতার নিচে নাকি নাম ঠিকানা লিখে দিতে হয়। ওদের খাতা থেকে যে ঠিকানাটি দেওয়া হয়েছে, তা অপরূপার ঠিকানা। মুকুলদার বাড়ির ঠিকানায় পত্রিকা এসেছে পরীদি খবর দিয়ে গেছিল। 

তারপর পরীদি আবার খোঁজাখুঁজি করেছে কলকাতায় গিয়ে। সেখানে বেলাঘাটা বলে একটা জায়গা আছে। চাউলপট্টি রোড বলে রাস্তা আছে। পোড়ো ভাঙ্গা বাড়ি, সরকার বাড়ির মাঠ পার হয়ে বড় বড় সব পুকুর ডোবা। কুঁড়েঘর সারি সারি। তারপরই একটা খাল। হাড়ের কারখানা—কী দুর্গন্ধ। সেই বস্তিতে পরীদি খোঁজ নিতে গিয়ে মহা বিপর্যয়ে পড়ে গেছিল। খুঁজতে খুঁজতে রাত হয়ে গেছে। ঝড় বৃষ্টি, আর সেই পুকুর ডোবা নালা ভর্তি ছোট ছোট ঝুপড়ি। প্রেসের কোন কিরণ বাবু বলেছে, হ্যাঁ এই নামে তো একজন আমাদের প্রুফ দেখে। ঠিকানাটা দেখুন তো। পরীদি দেখেছে,দাদার সই। নিচে কী সব নম্বর দিয়ে লেখা চাউলপট্টি রোড। জায়গাটা যে এত দুর্গম হতে পারে, এমন আস্তাকুঁড় হতে পারে পরীদি নাকি চিন্তাই করতে পারেনি। বিলু কী নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। হাড় পোড়া দুর্গন্ধ, খাটা পায়খানা, মানুষ শুয়োর গাদাগাদি করে আছে। সেখানেও পরীদি খুঁজে এসেছে। সন্ধ্যা বলে একটি মেয়ে খবর দিয়েছে, বিশ্ববাবু কখন আসে, কখন থাকে, কখন যায় আমরা কেউ টের পাই না। তার ঘরটাও দেখিয়েছে। ঘরে কিছুই নেই। টিনের বাক্স। একটা খাটিয়া। একটা মাটির জার। জল নেই। 

পরীদি তারপর আর একা যেতে সাহস পায়নি। পার্টির দু-জন ক্যাডারকে নিয়ে খুঁজতে গেছে। গিয়ে দেখে নেই। পরদিন সকালেই নাকি ভাড়া মিটিয়ে সুটকেস হাতে নিয়ে চলে গেছে কোথায়। এমন দাদা যার, তার ভাই আর কত ভাল হবে! তুই পরীদিকে নাকের জলে চোখের জলে এক করছিস। তোর মায়া দয়া নেই! বাবার জন্য কষ্ট হয় না। মা’র জন্য! তুই অত কী রাজকার্য করতে গেলি, আমাদের কথা ভুলে গেলি! পরীদির গন্ধ পেলেই পালাস। তুই বল, পরীদির কী অপরাধ! পরীদির পার্টি করা তুই পছন্দ করিস না, নাটক করা পছন্দ করিস না। পরীদির এটা বিলাসিতা। বিলাসিতা হলে, তোর ঘরে রাতে শুয়ে ঘুমাতে পারে! আলো নেই, পাখা নেই। জানালা বাঁশের কঞ্চির। ছোট্ট জানালা। হাওয়া বাতাস কিছু ঢোকে না, থাকতে পারে! পরীদি তো আমাদের বাড়ি এলে যেতেই চায় না। 

এ-সব ভাবলেই পরীদিকে মনে হয় সেই উত্তরা—যে নারী তার যুবরাজকে যুদ্ধের পোষাক পরিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ছেড়ে দিয়েছে। মাথায় উষ্ণীষ, শরীরে বর্ম, ঢাল, তরবারি, তৃণ পিঠে। সব দিয়েছে, কেবল সপ্তরথী ঘিরে ধরলে, সে জানত না কী করে বাঁচতে হয়। ব্যূহ থেকে বের হতে হয়। দাদাও কী কোনো অদৃশ্য সপ্তরথীর বাণে জর্জরিত। না-হলে পালাচ্ছে কেন বার বার। সে পরীদিকে কী আর মুখ দেখাতে চায় না। জীবনের সেই জয়, যা সহজ লভ্য নয়, করতলগত নয়—যার জন্য সে অস্ত্রবিদ্যায় বিশারদ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, হয়তো ঠিকঠাক পারছে না, সে পাখি দেখলে মুগ্ধ দেখতে পায়, চোখ এখনও দেখতে পায় না, যতদিন না তার সেই দেখা পূর্ণ হচ্ছে, ততদিন কী অজ্ঞাতবাস চলবে! 

সে সবাইকে বলে ফিরে এল। কেন যে আজ মনে হল, সত্যি এই কাজের দিনে তার বাড়িতেই থাকা দরকার। সে না থাকলে বাবা একা। সে ফিরে এসে দেখল, পরীদি রান্নাঘরে বসে মুগের ডাল বাছছে। পরীদিকে গিয়ে বাড়িতে পায়নি। 

পরীদিকে বাড়িতে আর কেউ কিছু বলে না। তবে বোঝে পরীদিকে নিয়ে প্রচণ্ড তিক্ততা চলছে। পরীদি কোথায় বললে, এক কথা, তা তো তোমরা ভাল জানবে। সে তো আমাদের কিছু বলে যার না। সুহাসদাও নাকি একদিন ফোন করায় তার দাদামশাই বলেছিল, জানি না। বরং আমি জিজ্ঞেস করছি সে কোথায়! আমার মানমর্যাদা নিয়ে তোমরা আর কত হোলির রঙ খেলবে। সে কোথায় আছে, থাকবে, সে তো তোমরা জানবে। তোমরা তার সুহৃদ। আমরা তার শত্রু। সে কোথায় ঘোরে থাকে খায় তোমরাই আমার চেয়ে বেশি জানবে। 

পিলুর এ-জন্য আরও বেশি কষ্ট। কোথাও যেন ঠাঁই নেই। পরীদি বাড়িতে থাকে খায়, খুশি মতো ফেরে, বাড়ির কাজের লোকদের সঙ্গেই যা সম্পর্ক। পরীদির কখন কী দরকার জানে। পরীদি ইচ্ছে করলে প্রাসাদের মতো বাড়িতে নিরিবিলি, নিজের ঘরে, বারান্দায় বসে চুপচাপ যেমন দিন যাপন করতে পারে আবার তেমনি, সহসা সিঁড়ি ধরে নেমে নিজের লাল রঙের সাইকেল নিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারে। শুধু বাড়িতে খবর রেখে যায়, যেন খবরটা দাদামশাইকে দেওয়া হয়। 

এখন যে পরীদি মুগের ডাল বাছছে সেও আর এক পরীদি। পার্টি করা, নাটক করা, কিংবা ক্যাডারদের নিয়ে মিছিল মিটিং করা পরীদি যেন এ নয়। ঠিক মা’র মতো, বাবার মতো একেবারে ঠাকুর ঘরের পবিত্রতা নিয়ে বসে আছে। চাল বেছে টাগারিতে রাখছে। মাকে ডেকে বলছে, এতেই হয়ে যাবে। পিলুকে দেখে বলেছে, পিলু বসে থাকিস না। নিরাপদকে নিয়ে কলার পাতা কেটে আন। আর শোন, কলার পাতাগুলো ধুয়ে রাখ। তারপরই পরীদি রান্নাঘরে ঢুকে বলল, মাসিমা, এ কী! কাঁদছেন কেন! 

পিলু দেখল বাবা বেশ তটস্থ হয়ে উঠেছেন। কেন কাঁদছে বাবা টের পেয়ে গেছেন। কারণ বাবার সঙ্গে যা কিছু মান অভিমান ঝগড়া রাতের বেলা। দাদা বাড়ি নেই, অথচ বাড়িতে অন্নভোগের আয়োজন হচ্ছে, লোকজন খাওয়ানো হচ্ছে, কেউ পারে—বড় পুত্রটি কোথায় আছে, তার কোনো সঠিক হদিস পাওয়া যাচ্ছে না—তিনি এখন অন্নভোগ নিয়ে পড়লেন। 

পিলুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মুখ কালো হয়ে গেল। সে শুনতে পাচ্ছে, মা বলছে, কাঁদি আর সাধে মা। যার মানুষের কোনো হুঁস নেই, তার কান্না ছাড়া আর কী সম্বল আছে বল! একবার গেল, কলকাতায় কোথায় আছে খুঁজতে গেল! তোমার বাবা দাদামশাই পারতেন। নির্বিকার পুরুষ। 

বাবা বললেন, আরে পরী পাত্তা করতে পারল না, ধরেও ধরতে পারল না, আমি গেলে তো বিষম কাণ্ড হবে। 

হঠাৎ মা কেমন দজ্জাল গলায় বলে উঠল, লজ্জা করে না, যখন বলেছিলে, এমন কু-পুত্রের মুখ দর্শন করব না। তারপর পরীদির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার সোজা সরল ছেলেটার উপর এত অত্যাচার! ভগবান সহ্য করবে! পরী, তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, বিলু আমাকে বলেছে, এক বর্ণ মিথ্যা বলছি না। বলেছে, মা আমি মারিনি। মারতে পারি না। বিশ্বাস কর আর যাই করি আমি পরীকে কখনও মারতে পারি না। 

এ-কথা শোনার পর পরীদিও মুখ আড়াল করে ফেলল। দু-হাতে মাকে সামলাচ্ছে, আর মুখ নিচু করে ফেলছে। উদগত অশ্রু সামলে কেন যে পরীদিও বলছে, মাসিমা থামুন। মাসিমা, আমিও জানি ও মারেনি, মারতে পারে না। মাসিমা থামুন। 

—আমি থামব বল! নিষ্কর্মা মানুষের এত বড় কথা! তোমার দাদামশাই কী বললেন, আর তিনি বিশ্বাস করে ফেললেন। আমার ছেলে কারো গায়ে হাত তোলার ছেলে! তুমি তাকে কী না বলেছ! তুমি না গেলে ও কখনও ফেরে! সে তোমার কু-পুত্র! 

পিলু, নিরাপদদা, বৃন্দাবন করের বৌ, মায়া সবাই মা’র এই দজ্জাল স্বভাবে কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। 

—আর তুমি বাড়ি বসে ধর্ম দেখছ। বলছ, পাপ খণ্ডন হোক, পাপ খণ্ডন হোক। সহ্য হয় বল! একবার একটা চিঠি পর্যন্ত দিলে না। গেলে না। বললে না গিয়ে, চল, যা হবার হয়ে গেছে। বাড়ি চল। বসে থাকলে। উৎসব, ইটের ভাটা, মন্দির শিবলিঙ্গ কত আয়োজন, আর আমার ছেলেটা একটা আঁস্তাকুড়ে পড়ে আছে! বলে আবার হু হু করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। 

পরীদিও মা’র সামনে বসে পড়েছে। মা’র মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলছে, মেসোমশাইকে নিয়ে আমি যাব। ঠিক খুঁজে বের করব। আপনি এ-ভাবে কাঁদবেন না। কী খারাপ লাগছে বলুন তো? ঐ দেখুন পিলু মায়া সবাই কাঁদছে। আমি কাকে সামলাই। তারপরই ধমক, এই পিলু, হচ্ছেটা কী। মায়া, যা এখান থেকে—যা! 

পরীর মুখে এসে গেছিল, আপনার পুত্রটি মানুষ না অপদেবতা। কিন্তু মাসিমা কষ্ট পাবেন!

কার জন্য কাঁদছিস! সে কারও দুঃখ বোঝে পিলুকে বলার ইচ্ছে। 

পরী শেষে বললে, মাসিমা, অবুঝ হলে চলবে কেন। চিঠি কাকে দেবে! মেসোমশাই যাবে কোথায়! মেসোমশাইয়ের দোষ কী। দাদামশাইয়েরও দোষ নেই। তারা যে যার মতো বুঝেছে। কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ঐ দেখতো পিলু, কারা আসছে। এগিয়ে যা। 

কারা আসছে বলায় মা’র সম্বিত ফিরে এল। রান্নাঘরের কোণায় ঢুকে ঘটিতে জল নিয়ে বাইরে গিয়ে মুখ ধুয়ে এল। এখন পিলু কিংবা মায়া, পরী সবাই জানে, মা’র মুখে যতক্ষণ হাসি না ফুটে উঠবে ততক্ষণ, এই বাড়ির গাছপালায়ও অদৃশ্য কুয়াশা লেগে থাকবে। ভেজা আবহাওয়া – ভারি স্বভাবের হয়ে যাবে ঘর বাড়ি— অন্ধকার হয়ে থাকবে সবার ভেতরটা। একমাত্র মাসিমার মুখে হাসি ফোটাতে পারলেই আজকের অন্নভোগ সার্থক। 

বাবা হঠাৎ উঠোনে দাঁড়িয়ে বললেন, মন খারাপ করবে না। অন্নভোগ সবারই কমবেশি থাকে। তার হাত থেকে কে কবে রেহাই পেয়েছে। 

রাতের দিকে বাড়িটা কেমন নিঝুম মনে হল পরীর। সে পিলু মাসিমা বারান্দায় বসে গল্প করছিল। মাসিমা রাতে কিছু খাবেন না। পরীরও খাবার ইচ্ছে নেই। শীতের বেলা শেষ হতে সময় লাগে না। তাদের খেতে খেতে বেলা পড়ে গেছিল। অবেলায় খেয়ে রাতে আর খাবার ইচ্ছে নেই। 

মেসোমশাই বলেছিলেন, তোমার মাসিমার বুদ্ধিতেই জমিটা কেনা হয়েছিল। ভাগ্যিস কিনেছিলাম। চার পাঁচ বছরে কী দাম হয়ে গেল। 

বাবার কাছে এটা খুবই কৃতিত্বের খবর। পিলু এটা বোঝে। বাবা যে এখানে এই গভীর বনজঙ্গলের মধ্যে প্রথম ঘর বাড়ি বানান, পরীদিকে কতবার যে সে খবর দিয়েছে। পরীদিও যতবার শুনেছে, যেন এর আগে শোনেনি। তাই নাকি! এত দাম হয়ে গেল জমি! 

পরীদি যে খুবই বুদ্ধিমতী সে বোঝে। এক দাদা ছাড়া বাড়িতে পরীদির আর কোনো শত্রু নেই। রাত হয়ে যাওয়ায় আজ থেকে গেল। পিলুর এটা যে কী আনন্দের। বিকাল থেকেই পেছনে লেগেছে, পরীদি আজ যাবে না। আমি বলে আসব। তুমি থাক পরীদি। একটা তো রাত। থেকে যাও। 

আসলে এটা কেন হয় সে বোঝে না। তাদের বাড়িতে অতিথি অভ্যাগত কেউ আসে না। মানুকাকা শহর থেকে এলে, গাছের পেঁপে, আমের সময় আম, বেলের সময় বেল—যেদিনকার যা ফল ব্যাগে করে নিয়ে যায়। বাবার তখন কী আনন্দ! এটা নে, ওটা নে। আর মা’র তখন নানা অভিযোগ। গজ গজ করবে, দিয়ে দাও, সব দিয়ে দাও। এসে তো উঠেছিলে, তাড়াবার কত ফন্দি করছিল। এখন তো বলছে, ধনদা, আমার জন্য জমি দেখুন। রিটায়ার করে ভাবছি এখানেই বাড়িঘর বানাব। 

আসলে পিলুর কাছে বাবার এই জায়গা নির্বাচন নিয়ে, এক ধরনের অহঙ্কার আছে। বাবাই পারেন, বোঝেন, কেন না, এখানে না এলে সে এই গভীর বনজঙ্গলের স্বাদই পেত না। নবমীকেও আবিষ্কার করা হত না। এক সময় তো তাদের কী ভয় লাগত! বাবা বাড়ি নেই, জঙ্গলের মধ্যে বাড়িটা- চারপাশ নিঝুম, আকাশে কিছু নক্ষত্র বাদে তাদের দেখবার কেউ নেই—তখন কুকুরের বাচ্চা তুলে এনেছিল একটা—কী না দিন গেছে! 

মা কথা বলছে না। সকালে দাদার জন্য কান্নাকাটি করার পর আর কোনো অশান্তি করেনি ঠিক, তবু নিখোঁজ পুত্রটির জন্য সারা দিন এক চাপা দুঃখ বয়ে বেড়িয়েছে। 

পরীদি চলে যেত, কেবল তার মনে হয়েছে, এই পরিবারে সে যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ কিছুটা যেন অবলম্বন থাকবে। নবমী পাশে বসে ঝিমোচ্ছিল। নবমীর খুব ইচ্ছে ছিল, আজ সে তার মরদের গল্প করে। কিন্তু কেন যে বার বার মরদের কথা তুলতে গেলেই পিলু ধমকে উঠেছে।—থাম তো ডাকাতের গল্প কে শুনবে! 

পরী বলল, আজ ডাকাতের গল্পই হোক। তুই ওকে ধমকাচ্ছিস কেন। 

—ও পরীদি, শোন না! ডাকাতের গল্প কী শুনবে—বাবা, তুমি একবার একটা ল্যাংড়া গরু নিয়ে এসেছিলে না! 

ল্যাংড়া গরুটার কথা উঠতেই মাসিমা কেন হেসে ফেলল সে বুঝল না। 

মাসিমা বললেন, আর বল না, সে যা গেছে। চণ্ডীপাঠের নামে বের হতেন, ফেরার নাম থাকত না।

পরীর মনে হল, তা হলে মাসিমাও ডাকাতের গল্পই শুরু করেছেন। 

পরী বলল, কোথায় যেতেন? 

মা হেসে বলল, জিজ্ঞেস কর না, কোথায় যেত। 

বাবা বললেন, আমার তখন সসেমিরা অবস্থা বুঝলে। যে যেখানে পূজা-আর্চার খবর দিত, চলে যেতাম—সেখান থেকে আবার এক জায়গায়—বাড়িতে থেকে তো লাভ নেই। উপাৰ্জন চাই। ছ’ছটা মুখ। বোঝো। তা একবার ছেলেদের দুধ খাওয়াবার সখ হয়েছিল বলে বাবার সেই গরু আনা এবং পিলুর সড়কে দাঁড়িয়ে থেকে বাবার আবিষ্কারের কাহিনী বললে, পরী কেমন হতবাক হয়ে গেল। 

—বুঝলে পরী। কী না বলেছে তোমার মাসিমা! আমি অবলা মানুষ, বলেই পিজরাপোলে না দিয়ে গরুটা বামুনকে দান করে দিয়েছে। দুধ দিল না ঠিক, তবে কী জান, বামুনের বাড়িতে গোবরটাও তো কম নয়। ওটা ওরা বোঝে না! তখন ওটুকুই বা আমাকে কে দেয়। কত জায়গা থেকে আম জামের কলম, কাঁঠালের কলম এনে লাগিয়েছি। সারা বাড়িটায় এত যে গাছপালা তারও প্রাণ আছে জান! তোমার মাসিমা কত আমাকে বকাবকি করেছে জান! নির্বুদ্ধিতার শেষ নেই। 

নবমী বলল, আমার মরদ না, একবার জেল খেটে এল। দু সাল। আসার সময় আমার জন্য একটা টিয়া পাখি নিয়ে এসেছিল। পিলু বলল, আবার মরদের গল্প! থাম বলছি। 

একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। বারান্দার এক কোণায় জলচৌকিতে বাবা বসে আছেন। মা পরীদি মায়া মাদুরে বসে আছে চাদর গায়ে। চারপাশে বাড়িটার গাছপালার ছায়া, এই হ্যারিকেনের আলো এবং পরিবারের সবাই আজ অনুষ্ঠানের পর কেন যে এত অতীতের গল্প নিয়ে পড়েছে পিলু তা বোঝে কোথা থেকে কোথায় তারা উঠে এসেছে। নবমীকে দেখলে মনেই হবে না, তারই গুপ্তধন আজ এই গরীব বামুনের পরিবারটিকে স্বচ্ছলতার মুখ দেখিয়েছে। আসলে পিলুর ভেতর মায়া দয়া বেশি। পিলু এ জন্য কম ধমক খায়নি। এই মায়া দয়াই নবমীর কাছে নিয়ে গেছে তাকে। এই মায়া দয়াই শেষে গুপ্তধন এনে দিয়েছে সংসারে। 

নবমী বলে একটা বুড়ি আছে জঙ্গলে সবাই জানত। কী খায়, কোথায় থাকে, কী পরে, কেউ খোঁজ নিত না। ওর কঙ্কালসার শরীর শনের মতো চুল আর প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় ঘেরাফেরা—কাউকেই কাছে টানেনি। বরং দেখলে পালিয়েছে। নবমী ঠিক বুঝতে পেরেছিল পিলুকে। ঠিক মানুষকেই সে চিনেছে। পিলু না নিয়ে এলে জঙ্গলেই মরে থাকত। ওর ইট ক’খানা ইটের পাঁজার মধ্যে পড়ে থাকত। মানুষের কাজে লাগত না। পরীদি জানে না। একবার ইচ্ছে হল বলে। তারপরই বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বলি বাবা? 

বাবা বললেন, তোমার আবার কী বলার আছে! তুমি তো কোথাও পালাওনি। কাল ফিরবে বলে পক্ষকাল পরে ফেরনি। কোথাও ডাকাতি করেছ বলেও জানি না। 

বাবার এই কথায় সবাই হেসে উঠল। 

পরী ভাবল, যাক, যে চাপা কুয়াশায় ঢেকেছিল বাড়িটা তা যেন কেটে গেল। 

—বলি বাবা! 

—বল না। আমি বারণ করব কেন! 

—না ঐ যে ইট, নবমীর ঘরে ইট। 

—অ সেই কথা। পরীকে বলনি! পরী জানে না! 

পরী বুঝল না, পরী কী জানে না। 

পিলু গল্প বলার মতো যেন সব বলে গেল। পরী শুনে হাঁ। নবমী তবে তার ডাকাতের ধন ইটের মধ্যে রেখে দিয়েছিল। নবমীকে এমন প্রশ্ন করতে বলল, না না, ডাকাতের ধন হবে কেন? ও আমার গয়নাগাটি। কত যে ছেল। সব গলিয়ে রেখে দিয়েছিল। বনজঙ্গলে থাকি, কার কখন নজর যাবে— 

পরী অনেক দিন থেকে এই বাড়ির মানুষগুলির সঙ্গে মিশে আছে। নবমীকে তুলে আনার মধ্যেও মহত্ত্ব আছে—কিন্তু গুপ্তধন মেসোমশাই কিছুই নিজে ভোগ করছেন না—ঈশ্বরের প্রতি তাঁর এত নির্ভর কেমন যেন বিচলিত করে তুলল। সে এত দিন যা জেনেছে, যা পড়েছে, তার সঙ্গে মানুষের আত্মবিশ্বাস এবং ধর্মবিশ্বাসে কোনো ফারাক আছে বলে ভাবতে পারল না। সত্যি তো এ-দেশে গরীব মানুষের তো কিছুই নেই। কবে হবে তাও জানে না। কিন্তু একটা পরিবারকে এই বিশ্বাসই কী প্রবলভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে— মেসোমশাইকে না দেখলে সে টের পেত না। 

সে বলল, মেসোমশাই, আমরা একটু ঘুরে আসি। 

—কোথায়? 

—আপনার বাড়ির সবটা আমি দেখিনি। আপনার গাছপালাও না। 

বাবা তাতে খুবই খুশি। পরী বাড়ি ঢুকেছে, নবমীকে নিয়ে বনের মধ্যে গেছে। কিন্তু এই বাড়ির সব গাছপালা সে দেখেনি। কিংবা বাবা কোনো দিন বলতে পারেননি, কোথা থেকে কোন গাছের কলম এনে লাগিয়েছেন। শুধু লাগিয়েই ক্ষান্ত হননি, তার ফল খাইয়েছেন, সেখানেও শেষ ছিল না, খেয়ে যদি কেউ বলেছে, ভারি সুমিষ্টি আম, একটা কলম করে দেবেন। বাবা খুশি হয়ে কলম করে দিয়েছেন। কখনও বাড়ি বয়ে গিয়ে দেখে এসেছেন, তাঁর দেওয়া কলমের আদর যত্ন ঠিক হচ্ছে কি না! 

জ্যোৎস্না রাতে পরী গাছগুলির পাশ দিয়ে হাঁটছে, পিলু কেবল বাবার গল্প করছে। গাছপালার ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হল পরীর—মানুষ তার উত্তরপুরুষের জন্য এ-ভাবেই কিছু রেখে যায়। পরী কাঁঠাল গাছগুলির নিচে এসে দাঁড়িয়ে গেল। চারপাশে জ্যোৎস্না নেমে এসেছে। গাছপালাগুলি দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীর মতো। একজন মানুষের এর চেয়ে বড় কী আর অবলম্বন থাকতে পারে সে ভেবে পেল না। যেন বিলু কিংবা পিলু তাদের বাবার কথা এক দিন ভুলে যেতে পারে—কিন্তু গাছগুলি কোনো দিন ভুলবে না—কত যত্নে তিনি তাদের বড় করে তুলেছেন। মানুষের সৃষ্টির তো শেষ নেই। যে যার মতো কবিতা সৃষ্টি করে। 

বিলুর কবিতা মেসোমশাইয়ের ভাল লাগবে কেন?

মেসোমশাই বলতেই পারেন, কবিতা লিখে কী হয়।

পিলু বলল, পরীদি, ওদিকটায় চল! 

—কেন রে! 

—বাবার বাতাবি লেবু গাছটা দেখবে না। 

জ্যোৎস্নায় এই ভ্রমণ খুবই মধুর। আসলে তাকে নেশায় পেয়ে গেছে। যেন ইচ্ছে করলে সারা রাতই গাছপালার ভেতর এখন ঘুরে বেড়াতে পারে। বিলু পাশে থাকলে কী যে ভাল লাগত। আর সহসা কেন যে মনে হল, গাছপালার মতো চাই তার একজন সরল অকপট মানুষ। -যে বৃক্ষের মতো ছায়া দেবে। 

সে এবার বলল, চল পিলু। রাত হয়েছে। এই মায়া আয়। 

.

ঘরে মায়া আর মিমি। আলো জ্বলছে। হ্যারিকেনের অল্প আলো জ্বালা। মশারির নিচে লেপ গায়ে দিয়ে মিমি পাশ ফিরে শোয়। মায়া শুয়ে পড়েছে। মিমি মশারি গুঁজে দিল এক দিককার। তক্তপোষটা খুব বড় না। তার অসুবিধা হবার কথা। তবু মানুষের কী যে থাকে! সে পা ছড়িয়ে দিলে একটা দিকের মশারি আলগা হয়ে যাচ্ছে। বিলু আর পিলুর জন্য এই ছোট্ট তক্তপোষ। এতেই সে বছরের পর বছর শুয়ে রাত কাটিয়ে দিয়েছে। কোনো অভিযোগ ছিল না। 

কখন মনে হল, মায়া ঘুমিয়ে পড়েছে। 

তার ঘুম আসছে না। 

ঘুম আসার কথাও না। 

গাছাপালা লাগাবার মধ্যেও কবিতা আছে—ঘর বাড়ি বানাবার মধ্যেও কবিতা আছে। পূজা-আর্চার মধ্যেও আছে—নবমীর জীবনের মধ্যেও। কোথায় নেই! স্বার্থপরতার চেয়ে এই কবিতা কম কৃতিত্বের নয় এমনই মনে হল তার। বিলুকে আজ কেন জানি সত্যি স্বার্থপর মনে হল তার। তবু তার নিজের জীবনের মধ্যেও কেন এই কষ্ট, দুঃখ বিলুর জন্য সে জানে না। কিছু শেয়াল ডাকল অদুরে। কীটপতঙ্গের আওয়াজ এত গভীর হয় আগে সে জানত না। যেন এক আশ্চর্য মিউজিক সৃষ্টি হচ্ছে। এই মিউজিক মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কত দরকার, বাড়ির গাছপালার ছায়ায় হেঁটে না বেড়ালে টের পেত না। বাড়ির অন্নভোগ কত সুস্বাদু আজ মাসিমার চোখে জল না দেখলে টের পেত না। তার চোখে জল এসে গেল। 

কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মিমি জানে না। সহসা ঘুম ভেঙ্গে গেল। কেউ যেন দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকছে, পিলু। দরজা খোল। পিলু। 

কে ডাকছে। কে! মিমি কেমন ধড়ফড় করে উঠে বসল। তার বুক কাঁপছে। গলা শুকিয়ে উঠছে। কে ডাকছে, কে! 

অবিকল বিলুর গলা। বিশ্ব কী তবে ফিরে এসেছেন! 

সে ডাকল, এই মায়া ওঠ, শিগগির ওঠ। 

মায়া উঠে বসলে বলল, কেউ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

মায়া ঠিক বুঝতে না পেরে বলল, কে? 

—মনে হয় তোর দাদা। 

—দাদা। 

মিমি বলল, আস্তে। সে সন্তর্পণে নামল। হ্যারিকেনের আলোটা উসকে দিয়ে এগিয়ে যাবার সময় মনে হল, হাত পা কাঁপছে। সে পড়ে যাবে। কোনো রকমে দরজা খুলতেই দেখল, কেউ দাঁড়িয়ে নেই। কেউ না। সে বাইরে বের হয়ে এল। না কেউ না। হতাশায় তার বুক ভেঙ্গে গেল। 

চিৎকার করে বলতে পারলে, সে সান্ত্বনা পেত—বিশ্ব, আমি কী করব! 

উঠোনে হ্যারিকেনের সামনে অনাথ রমণীর মতো কে বসে! বিশ্ব কাছে এসে বলল, তুমি!

মিমি কিছুই বুঝতে পারছে না। ভৌতিক মনে হচ্ছে সব কিছু। 

তুমি এখানে! রিকশাটা ছেড়ে দিতে গেছিলাম। 

মায়া বুঝতে পারছিল না, পরীদি একা লণ্ঠন হাতে নিয়ে কোথায় গেল। বাইরে বের হয়ে অবাক। দাদা। হাতে সুটকেস। সে চিৎকার করে উঠল, বাবা, দাদা ফিরে এসেছে। 

সহসা এই ঘরবাড়িতে সব আলো জ্বলে উঠল ঘরে ঘরে। পিলু চিৎকার করে বের হয়ে এসেছে— দাদারে। মা কেবল পাগলের মতো উঠোনে এসে লণ্ঠন তুলে পুত্রের মুখ দেখতে দেখাতে বলল, এলি তবে। রাগ পড়েছে। 

বাবা বললেন, তোমাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। মুখে গোটা। দেখি দেখি। বলে বাবা লণ্ঠন তুলে কী দেখে বললেন, মায়ের দয়া হয়েছে! ও ধনবৌ, শিগগির বিছানার চাদর ওয়াড় পাল্টে দাও। গায়ে হাত দিয়ে বললেন, ইস জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে! 

মিমির মুখে কথা সরছিল না। অন্ধকারে কোথায় দূরে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। 

বাবা, দাদাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, ঠাকুরের চরণামৃত দিলেন খেতে। বললেন, ভালই হয়েছে। মহাপাপ খণ্ডন। কপালে দুর্ভোগ থাকলে কে খণ্ডাবে বল! যাক পাপ খণ্ডন হয়ে গেল। বোঝা নামল আমার। 

মিমি বলল, পিলু, রিকশাটাকে বল থাকতে। আমি যাব। 

বিশ্ব ঘরে শুয়ে টের পাচ্ছিল। মিমি আর তার ঘরে আসেনি। রাতের ট্রেনে সে প্রায় তস্করের মতো পালিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা জোর করে ট্রেনে তাকে তুলে দিয়ে গেছে। কেউ জানে না, সে সারা রাস্তায় প্রায় একজন তস্করের মতোই বসেছিল। ধরা পড়ে গেলে অনাসৃষ্টি হবে না কে বলতে পারে। তার সারা শরীরে কী ব্যথা। গলা বুজে আসছে। কথা বলতে কষ্ট। পিলু মায়া মা বাবা সবাই দাঁড়িয়ে আছে পাশে। এখন এই রোগের প্রতিবিধান নিয়েই বাবা ফাঁপরে পড়ে গেছেন। মিমি যে এ বাড়িতেই আছে কারো যেন খেয়াল নেই। 

বিশ্ব কোন রকমে পাশ ফেরার চেষ্টা করল। কোনো রকমে বলল, পরীকে ডাক। পরী এলে বাবা বললেন, যাও তোমরা। সবাইকে নিয়ে বাবা বের হয়ে গেলেন। বিশ্ব বললে, এত রাতে যাবে! 

—অসুবিধা হবে না। পিলুকে সঙ্গে নিয়ে যাব। 

—জানি। পিলু না গেলেও তুমি একা চলে যেতে পার। তোমার অসুবিধা হবে না জানি। একটাতো রাত। নাই গেলে। বলে পাশ ফিরে বিশ্ব চোখ বুজল। এ-মুহূর্তে বিশ্বর যেন এর চেয়ে বেশি কিছু বলার অধিকার নেই। এত কষ্ট শরীরে তবু সে বাড়িতে ফিরে পরীকে দেখতে পাবে আশাই করেনি। সব চেয়ে দুশ্চিন্তা ছিল পরীকে মুখ দেখাবে কী করে। সেই পরী বাড়িতে নিজেই হাজির। 

বাবা তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে আবার তার ইদানীংকার আপ্তবাক্যটি উচ্চারণ করলেন, বুঝলে কেহ আত্মাকে আশ্চর্যবৎ মনে করে—কেহ বা আশ্চর্যবৎ বলিয়া আত্মাকে বর্ণনা করে—আবার কেহ আশ্চর্য বলিয়া শোনে। কিন্তু ইহার বিষয় শুনেও কেহ ইহাকে বোঝে না। 

***

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’-র সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত 

তৃতীয় পর্ব : অলৌকিক জলযান 

চতুর্থ পর্ব : ঈশ্বরের বাগান 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *