প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

অন্নভোগ – ৮

আট

সকালে পিলু আবার সাইকেল নিয়ে বের হয়ে গেল। দাদা না থাকায় সাইকেলটা নিয়ে সে যখন তখন বের হয়ে যেতে পারে। যখন খুশি ফিরতে পারে। মা বাবা কোনো ফরমাস করলে তার মেজাজ তখন আর অপ্রসন্ন হয় না। বরং সে অপেক্ষায় থাকে বাবা কী ফরমাস করবেন, মা’র কী দরকার। কাল সকালে দাদাকে বিছানায় না দেখে সাইকেলে প্রায় সারাটা দুপুর কাটিয়েছে। এটা যে কী মজা, যেন সে ঘোড়ায় চড়ে বসে—তারপর বাদশাহী সড়কে উঠে এদিক ওদিক— যেদিকে দু চোখ যায় ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারে। দাদা বাড়ি না থাকায় ধমক খাবার ভয় নেই। বাবার ধারণা শরীরের মতো যন্ত্রও বসিয়ে রাখলে ঘুণে ধরে। ঘুণে ধরা ঠিক না। চলুক, যতক্ষণ চলছে চলতে দাও। থামলেই বিগড়াবার ভয় থাকে। 

কাল সারাটা দিন পরীদিকে নিয়েই কেটে গেল। 

আজ বাকি কাজগুলো তার করা দরকার। যেমন মুকুলদাকে খবর দিতে হবে। যদি কোনো নতুন খবর টবর পেয়ে যায়। 

সে সড়কে উঠে গেলেই হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দেয়। ট্রাক সামনে। যমদূত আসছে। সে রাস্তা ছাড়ছে না। ট্রাক, বাস দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বাপের জায়গা। নিশ্চিন্তে সাইকেল চালাতে না পারলে মেজাজ আসে না। সে সড়ক ছাড়ছে না। ট্রাকটাকে পাকা রাস্তার বাইরে নামিয়ে ছাড়বে। সে পারেও। দুরন্ত গতিতে ট্রাকের সামনে হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে নেয়। বোঝো মজা! নামিয়ে ছাড়লাম শালা শুয়োরের বাচ্চা আমি! বোঝো এবার। সেও তখন মরিয়া হয়ে যায়। সেও ছেড়ে কথা বলে না। কোনো কারণে গরু ছাগল আনতে গেলে কিংবা সড়কের ধারে একা থাকলে ট্রাক দেখলেই একটা ইট কুড়িয়ে নেয়। ধাঁই করে মারে—তারপর মাঠ ধরে দৌড় আর দৌড়। ট্রাক থামতে থামতে বনজঙ্গ লের আড়ালে পড়ে যায় সে। 

বাবা একদিন শুনে তেড়ে এসেছিলেন—খুবই বিপজ্জনক খেলা। বার বার নিষেধ করছি! কখন কী হয় বলা যায়। সাইকেল নিয়ে তো বের হও না, বাড়ির আত্মাটি হাতে নিয়ে বের হও। সময় মতো না ফিরলে কত দুশ্চিন্তা তুমি বোঝো। 

এটা ঠিক। এটা তারও হয়। দাদা সাইকেলে শহরে যেত। ফিরত বেশ রাত করে। অপরূপার কত কাজ! তা ছাড়া পুলিশ মাঠে দাদাদের আড্ডা। কী নিয়ে যে দাদারা এত কথা বলে বোঝে না। ফিরতে একটু বেশি রাত হলেই সে সড়কের কাছে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায়। দুশ্চিন্তা। দাদার বেলায় এটা হত, নিজের বেলায় কেন তা হয় না বোঝে না। 

আসলে ফাঁক পেলেই তার যে সাইকেল চড়ার নেশায় পেয়ে বসে। নেশা বিষম বস্তু। বাবা বলেছেন, একবার ধরলে আগাপাশতলা ছাল চামড়া ছাড়িয়ে নেয়। তারও নেবে হয়তো। কে জানে—ট্রাকের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া, যেই টের পাচ্ছে, পেছনে ট্রাকের হর্ন, তার যে কী হয়—পাল্লা। চালাও পানসি রানাঘাট—কে পারে দেখ! কে আগে যায় দ্যাখ! হলে কী হবে শেষ পর্যন্ত তাকে রাস্তা ছেড়ে দিতেই হয়। ক্ষোভে জ্বালায় তখন তার একমাত্র ঢিল সম্বল। ট্রাক দেখলেই—মারো শালাকে। কে তার শত্রু ঠিক অবশ্য জানে না। ট্রাক না ট্রাকের ড্রাইভার। বড় হয়ে সে ভেবেছে, ট্রাকের ড্রাইভার হবে। এই একটা বাসনা আছে। কত কত সব দূর গঞ্জ, পাহাড়তলি কিংবা শস্যক্ষেত্র পার হয়ে চলে যাবে। নদী, মাঠ, সেতু পার হয়ে সে চলে যাবে। সটান বসে থাকবে—হু হু করা বাতাসে তার চল উড়বে— স্বপ্ন স্বপ্ন। সাইকেলেরই এত নেশা, আর ট্রাকের নেশা কী না জানি। 

—আরে পিলু যে! আয় আয়। 

মুকুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছিল। মুখে পেস্টের ফেনা। কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে বলে, মুখের ফেনা ফেলে এগিয়ে গেল, গেট খুলে দিল। ভোর রাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। বাগানের এখানে সেখানে জল জমে আছে। শরতের আকাশ, সকালের রোদ, রাস্তার কদমগাছ-এবং চারপাশে সবুজের সমারোহে সে বেশ প্রসন্ন। শারদীয়া অপরূপার প্রস্তুতি চলছে। বিশ্ব হয়তো কোনো জরুরী খবর দিয়ে পাঠিয়েছে পিলুকে। ওর তো মতিস্থির নেই। হয়তো কোনো লেখা পছন্দ, প্রেসে দিয়ে দাও, আবার বিকেলে ডাকে আসা কোনো লেখা পছন্দ হয়ে গেল তো ওটা ফেরত নিয়ে এস। পরে দেখা যাবে। তা ছাড়া সে যেমন ভাল নেই—চৈতালি কলকাতায় চলে যাবার পর থেকেই মনমরা, আসলে তো কাগজটা বের করার এত উৎসাহ একমাত্র চৈতালি—সেই নেই। বিশ্বও ভাল নেই। মিমির সঙ্গে বোধহয় বড় রকমের খিটিমিটি বাধিয়ে বসে আছে। কিছুতো বলে না! চাপা স্বভাবের। 

পিলু বলল, জানো মুকুলদা, দাদা না কোথায় চলে গেছে। তোমাকে কোনো খবর দিয়ে গেছে। কোথায় উঠবে! কোথায় থাকবে। 

—বলিস কী! কোথায় গেল বলে যায়নি। কখন গেল। ওর যে কী হয় মাঝে মাঝে বুঝি না। 

—না। একটা … বলেই থেমে গেল। বাবা কেন যে চিঠির কথা ফাঁস হতে দিতে চান না, সে বুঝছে না। চিঠিতে দাদা পরীদিকে জড়িয়ে গেছে। খুবই নাকি কেলেঙ্কারি ব্যাপার। দাদা তো খারাপ কিছু লেখেনি। তার জন্য পরীদিকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে—খারাপ তো লাগবেই! 

মুকুল বলল, ভিতরে আয়। কবে গেল! কখন গেল। তুই চুপ করে আছিস কেন। মেসোমশাই থানায় গেছে? এতো ভারি ঝামেলা। কত কাজ অপরূপার। না বলে না কয়ে ফের উধাও। পাগলা আছে সত্যি। কোথায় যাবে কিছুই বলে যায়নি। 

— না। 

তার এই প্রিয় বন্ধুটি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যেতেই মুকুল কেমন কষ্টের মধ্যে পড়ে গেল। দু’জনের দুটো প্রিয় সাইকেল, দই প্রিয় নারী, কবিতা চর্চা, অর্থাৎ স্বপ্ন, বিশ্ব এ-শহর ছেড়ে চলে যেতে পারল। দু’দিন দেখা নেই, ভাবাইল, আজই যাবে, কেন যে এটা হয়! যেন কোনো এক আশ্চর্য অমোঘ বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে দু’জনের মধ্যে। দু’জনে কতদিন চুপচাপ বসে থেকেছে বড় মাঠে কিংবা রেশম কুটির জঙ্গলে ঢুকে গাছপালার ছায়ায় হেঁটে গেছে—দু’হাত উপরে তুলে গলা ছেড়ে কবিতা আবৃত্তি, নিজেদের কবিতা পাঠ আর কখনও সাঁ সাঁ করে সাইকেল চালিয়ে নির্জন রাস্তায় কোনো বৃক্ষের ছায়া পেতে কী যে ভাল লাগত! সে নেই, নিখোঁজ। বুকটা কেমন তোলপাড় করে উঠল। 

—বাড়িতে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল। 

—না। 

তারপরই মনে হল সে মিছে কথা বলছে। বাবার হম্বিতম্বি—গায়ে হাত, দেবীর গায়ে হাত, এ-যে মহাপাপ। 

কিন্তু পাপের কথা তো বলা যায় না। তবে যে সে তার বাবাকেই ছোট করে ফেলবে। দাদাকেও। সে বলল, না মানে, মন কষাকষি চলছে। তুমি তো জান, আমার বাবা কি রকমের। 

—মিমি জানে। 

—হ্যাঁ কাল তো মিমিদি আমাদের বাড়িতেই ছিল। 

—তোদের বাড়িতে! 

পিলু বুঝল না, এতে দোষের কী আছে। তারা গরীব। কিন্তু পরীদি তো গরীব লোকদের খুব ভালবাসে। বাড়িতে কত দাপট তাও সে অনেকবার দেখেছে। বাবা কত করে বললেন, তা হয় না, তুমি বাড়ি যাও। পিলু সঙ্গে যাবে। অবশ্য পিলু জানে, পরীদি একাই যেতে পারে। তার দুর্জয় সাহস। 

—সকালে বাড়ি চলে গেল। পিলু বলল। 

—চল তো পরীর কাছে। বলেই মুকুল সাইকেল বের করতে গেলে বলল, পরীদিকে পাবে না। কোথায় যেন যাবে। নাটক আছে। 

মুকুল জানে পরী মহেশ নাটকে আমিনার পার্ট করে। কিছুদিন তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছিল না তাও জানে। পরেশচন্দ্রের সঙ্গে কথা চলছে। বিবাহযোগ্যা কন্যা হলে যা হয়। পরী থম মেরে বাড়িতে এতদিন বসেছিল, ভাবলেই অবাক লাগে। তবে পরী আবার বিদ্রোহ করেছে! 

মুকুল কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে গেট থেকেই দৌড়ে গেল। বারান্দায় উঠে বলল, বৌদি, শুনছ বিলুর কাণ্ড। সে নাকি আবার ভেগেছে। 

বৌদি দাদা সবাই বের হয়ে দেখল, পিলু তখনও বাগানের বাইরে দাঁড়িয়ে। 

—ভিতরে এস। ওখানে কেন! 

—না আমি যাই। সুধীনদা, নিখিলদাকে যদি কিছু বলে যায়। 

মুকুল সাইকেল বের করছে। সে কেমন জলে পড়ে গেছে। পিলুর কথাও মনে নেই। কিন্তু পিলু বলছে, যদি কিছু বলে যায়। তাকে কিছু বলল না, পরীকেও না, নিখিল, সুধীনদাদের কিছু বলে যাবে বিশ্ব সেই ছেলেই না। সে বলল, দাঁড়া আমি যাচ্ছি। 

বৌদি বলল, কিছু মুখে না দিয়েই বের হচ্ছ। পিলুকে ডাক। কিছু খেয়ে বের না হলে অশান্তি হবে। সে পিলুকে ডেকে বলল, আয়। ভেবে আর কী হবে। সেবারেও তো কোন এক ছোড়দির খবর পেয়ে মেসোমশাই বিশ্বকে আনতে চলে গেলেন। ওর যা স্বভাব, আর যা চেহারা, ছোড়দির অভাব হবে না। অযথা মাথা গরম করে লাভ নেই। 

পিলু তবু ঢুকল না। কারণ সে তো ভাল নেই—যতই এই শহর, এবং বোস্টাল জেলের পাঁচিল পার হয়ে কোনো দিগন্ত প্রসারিত মাঠে পড়ে যেতে ভাল লাগুক, সাইকেলের নেশা থাকুক—তবু দাদার জন্য আজ কেন জানি তার কিছু ভাল লাগছে না। 

—না আমি যাই। 

পিলু কিছুতেই ভিতরে ঢুকল না। দাদা যা মানুষ, যদি কোনো প্ল্যাটফরমে শুয়ে থাকে! যদি স্টেশনে এসে মনে হয়—কাজ ঠিক করেনি। বাড়ির কথা, পিলুর কথা ভাবলে, দাদা শেষে কোথাও নাও যেতে পারে। লজ্জায় হয়ত বাড়ি যেতে পারছে না। চিঠি লিখে গিয়ে কে আর ফিরে আসে। মান মর্যাদা যে খোয়া যায়। 

তার হাতে এত কাজ মুকুলদার সঙ্গে আটকে গেলে আজকের দিনটাও নষ্ট হবে। কোথায় কোথায় চলে যাবে—তারপর তার আসল কাজটাই হবে না। 

সে সাইকেলে যাচ্ছে। কে পেছন থেকে ডাকল, এই পিলু, তোর দাদা নাকি নিখোঁজ।

পিলুর মাথা গরম হয়ে যায়। কলোনির সুবোধদা। কাপড়ের দোকান আছে মীরা সিনেমার সামনে। দোকান খুলতে যাচ্ছে। খবরটা তবে বাতাসের আগে উড়ছে। নিখিলদা বাড়ি নেই। সুধীনদা বাজারে গেছে। তবে মুকুলদা ঠিক খবর দেবে। তার এখন সবচেয়ে জরুরী কাজ, দুটো স্টেশনে খোঁজ নেওয়া। পিলু বাবার নির্বিকার স্বভাব পায়নি। সে তার আয়ত্তের মধ্যে যতদিন দাদা না ফিরছে, ঘোরাঘুরি চালিয়ে যাবে। আর তার কেন যে মনে হয় স্টেশনে গেলেই দেখতে পাবে দাদা দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। কেউ ডেকে না নিয়ে গেলে দাদা যেতে পারছে না। সে গেলেই দাদা সুটকেস হাতে নিয়ে তার সঙ্গে রওনা হবে। 

এই সব আশার কুহকেই সেবারে সে রোজ গাড়ি এলেই স্টেশনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। এটা এত বেশি প্রচার হয়ে গেছিল, যে দাদা সেই ভয়ে চিঠিতে লিখে গেছে, আমার জন্য স্টেশনে গিয়ে বসে থাকিস না। মন মানে! দাদা তুই এত অবুঝ। তুই বুঝিস না, বাড়ি না থাকলে আমাদের কত কষ্ট! 

সে স্টেশনে সাইকেল তুলে প্ল্যাটফরম ধরে হেঁটে গেল। যাত্রীর ভিড়। সাড়ে আটটার ট্রেন ছাড়বে। আর সঙ্গে সঙ্গে কেন যে মনে হয় দূরে ঐ তো দাদা দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় চুল, পাজামা পাঞ্জাবি পরা। সে কাছে গিয়ে নিরাশ হয়ে গেল। দাদা না। সে উঁকি দিয়ে মুখ দেখতে দাদার বয়সী মানুষটা বলল, খোকা, কিছু বলবে। 

সে লজ্জায় পড়ে যায়। ওয়েটিং রুমের ভিতরে উঁকি দিল, তারপর মনে হল বাথরুমে থাকে যদি। সে বাথরুমের দরজা ঠেলেও দেখল। এটা তার কেন হয়। দাদা না ফিরে আসা পর্যন্ত সে বাড়িতে এখন এক দণ্ড স্থির হয়ে বসে থাকতে পারবে না। দাদা যদি না ফেরে কলকাতায় চলে যাবে। কলকাতায় গিয়ে খুঁজতে শুরু করবে। কিন্তু সে তো খুব বেশিদূর যায়নি। বাবা মাঝে মাঝে এ-দেশে এসে উধাও হয়ে যেতেন। তাঁর শিষ্য যজমান আত্মীয়রা কে কোথায় এসে উঠল খোঁজ- খবর নিতেন। বাবার তখন ট্রেনে টিকিট লাগত না। উস্বাস্তু মানুষের কাছ থেকে নাকি রেলের ভাড়া নিতে নেই—এই বিশ্বাসে বাবা সহজেই এখানে সেখানে চলে যেতে পারতেন। দু-দিনের বলে বের হতেন—ফিরতেন পক্ষকাল পরে। মা’র চোপার ভয়ে বলতেন, আর বল না নেত্যকালীর সঙ্গে ট্রেনে দেখা। সেই ধরে নিয়ে গেল। কিছুতেই ছাড়ল না। 

মাধবদির সরকাররা পূর্বস্থলীতে এসে উঠেছে। নিয়ে গেল। সেখান থেকে রানাঘাটে। হাইজাদির রাঘব ঘোষ কিছুতেই ছাড়ল না, এত বড় পাবদা মাছ, প্রায় হাতখানা মেলে ধরে পাবদা মাছের সাইজ দেখিয়েছিলেন। এ-দেশে এসে এত বড় পাবদা বাবা খাননি, পাবদা মাছ খাবার লোভেই বাবা বিনা নোটিসে থেকে গেলেন। পিলুর তখন মনে হয় বাবাও কম পেটুক না। তারপর বাবার এক কথা, রাঘব খুব আদর যত্ন করল। ছেড়ে আসি কী করে! এমন সব গল্প শুনে পিলুর মনে হয়েছিল বড় হলে রানাঘাটে যাবে। অনেক স্টেশনে কিংবা প্ল্যাটফরমে রাত্রিবাস তাদের তখন নিত্যকার ব্যাপার। সে বিছানায় উঠে বসেছিল তড়াক করে। বাবার পাবদা মাছ খাওয়ার গল্প শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে গেছিল। নানা জায়গায় তারা ঘুরেছে এ-দেশে এসে। রানাঘাট জায়গাটায় গেছে কিনা বলতেই বাবার জবাব, যাব না কেন। দেশভাগের পর রানাঘাটের উপর দিয়েই তো এলাম। 

তারপরের প্রশ্ন ছিল, রানাঘাট কতদূর। সেখানে আবার যাওয়া যাবে কি না। কারণ গেলে বড় পাবদা মাছের ঝোল খাওয়া যাবে—পিলুর এমন মনে হত। রানাঘাটে তার যাওয়া হয়নি। তিন চার বছরের উপর বনজঙ্গলে বাড়ি ঘর করার পর কোথাও আর যাওয়া যায় তাও সে এখন বিশ্বাস করে না। কিন্তু বড় হয়ে রানাঘাট যাবে—এই উচ্চাশা সে এখনও পোষণ করে থাকে। বেগে সাইকেল চালাবার সময় তার লক্ষ্য, চালাও পানসি রানাঘাট। 

যার রানাঘাটই যাওয়া হয়নি, তার পক্ষে যে কলকাতা জায়গাটা খুব নিরাপদ নয় পিলু তা বোঝে। সে কাশিমবাজার স্টেশনে ঢুকে খুঁজল। কোনো বেঞ্চিতে কেউ শুয়ে নেই। সব ফাঁকা। কেবল কিছু কাক দুরের গো-ডাউনের মাথায় কা কা করছে। সে কেমন ক্রমশই নিরাশ হয়ে যেতে থাকল। বাকি থাকল, সেই রেশম কুটির জঙ্গল। যেখানে দাদা সারাদিন একটা গাছের নিচে শুয়েছিল। পরীদিকে মেরে আসার পর জঙ্গলটায় ঢুকে গাছের ছায়ায় চুপচাপ শুয়েছিল। 

রেশম কুটির জঙ্গলটা রেললাইনের ধারে। সে সেখানে ঢুকে গেল। বড় বড় তুঁত গাছ, নীল সবুজ ঘন পাতা—রেশম গুটির চাষ। কেমন গভীর নির্জন। গাছপালার মধ্যে কোনো মানুষের সাড়া পাওয়া যায় না। তবু তার সেই আশা কুহকিনী—সে খুঁজতে খুঁজতে এক সময় চিৎকার করে উঠল, দাদারে! 

না কেউ সাড়া দিচ্ছে না। 

সে গলা ফাটিয়ে ডাকছে, দাদারে! 

না কেউ সাড়া দিচ্ছে না। 

গাছের পাতা হাওয়ায় দুলছে। ঘাসের মধ্যে কীটপতঙ্গ ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা ট্রেন চলে গেল হুইসিল দিতে দিতে। মালগাড়ির ঝাকর ঝকর শব্দ। দূরে বাসের হর্ন বাজছে। সব এত স্বাভাবিক, সব এত ঠিকঠাক, কেবল তাদের সংসারেই দাদা আগুন ধরিয়ে কোথায় যে চলে গেল! তার চোখ ফেটে জল আসছিল। সে ছাড়বে না, দাদা কী ভেবেছে! তারা মানুষ না, যা খুশি করবে। সে কেমন পাগলের মতো কেবল ডাকছে, দাদারে তুই ফিরে আয়। পরীদি তোর বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। তোর কোনো মায়া দয়া নেহ! 

পিলু আসলে দাদার এই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বিষয়টিতে এর চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে না। তার আর কোনো বড় সম্বল নেই। জ্বালা ক্ষোভের যন্ত্রণায় সে ছটফট করছিল। গাছের ডাল ভাঙছে। যা কিছু সামনে পড়ছে লাথি মেরে সরিয়ে দিচ্ছে। কাক পক্ষী দেখলে তেড়ে যাচ্ছে। তোমরা সুখে থাকবে, উড়বে-ওড়া বের করছি। আর ডাকছে, দাদারে। যেন সে দাদাকে পেলে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যেত। গাছের ডাল ভেঙে ভাল ছিল না, পাখি তাড়িয়ে ভাল ছিল না—কী ভাবে যে সে খুঁজে বের করবে! 

একদিন বাবা বললেন, বুঝলে পিলু, এটাই তোমার কুঅভ্যাস! ভাল না। দাদা ফিরে আসছে না কেন, আমরা কী করব! তোমার খোঁজার পালা শুরু হয়ে গেল। সে কী এখানে আছে! জান পৃথিবীটা কত বড়। এর সাতটা সমুদ্র আছে জান। হিমালয় পাহাড় আছে জান। পাঁচটা মহাদেশ আছে জান? কুমেরু সুমেরু আছে জান! এত বড় পৃথিবীতে লুকিয়ে থাকলে কার বাপের সাধ্যি আছে খুঁজে বের করে। সে নিজে ফিরে না এলে আমরা কিছু করতে পারি না। খোঁজাখুজি সার। তুমি বের হবে না বলে দিলাম। 

কিন্তু কে কার কথা শোনে! সে সাইকেল বের করছে। সে রেলে চড়ে বেলডাঙ্গা পর্যন্ত গেছে। ভাবদা সারগাছি গেছে। সে এই করতে করতে কতদূর যেতে পারে একবার দেখবে। কলকাতায় দরকার হলে চলে যাবে। 

মায়া বলল, ছোড়দা, যাস না। সারাদিন টো টো করে কোথায় ঘুরিস, খাওয়া নেই, তোর ঘুরতে ভাল লাগে। কষ্ট হয় না। মা কাঁদে। আমার কপাল এই। যাও একটু সুখের মুখ দেখলাম, এখন দু’জনের এই মতিগতি। কেউ কারো কথা শোনে না। 

পিলু যাবেই—অগত্যা বাবা আর কী করেন। তাঁর আজ দুর্গা নবমীর ব্রত আছে। সকাল সকাল বের হতে হবে। স্নানে যাবার উদ্যোগ করছিলেন। তখনই পিলুর মাথায় ক্যাড়া উঠে গেল। সাইকেল বের করতে দেখেই বললেন, আরে তোমার দাদা তো লিখে গেছে, তোমার এই কুঅভ্যাসটি তো তার জানা। তোমাকে কী লিখে গেছে বল! 

যেন বাবা পড়া ধরছেন। 

পিলু ছাত্রের মতো বলল, স্টেশনে গিয়ে বসে থাকতে নিষেধ করে গেছে। 

—তবে! 

খড়মের একটা বাউলি খুলে গেছে। বাবা খড়মে বাউলি ঠুকে দিতে দিতে বললেন, তবে, বুঝছ সে তোমার মতো অবিবেচক নয়। সে জানে। তাকে নিয়ে তোমার মাথার ক্যাড়া উঠে যাবে। এ- জন্যই নিজের হস্তাক্ষরে লিখে গেছে। গুরুত্বটা তার বুঝছ। 

পিলু জানে তাদের বাবা এ-রকমেরই। ঈশ্বর ছাড়া তাঁর কোনো আর অবলম্বন নেই। না হলে সেই কবে এমন একটা বনজঙ্গলে ঘরবাড়ি বানাতে সাহস পায়। ছেলেপুলে নিয়ে সংসার। সামনে পুলিশ ক্যাম্প ছাড়া আর কোনো মানুষের বসতি নেই। রাতের বেলা বেড়ার পাশে শেয়াল খাটাস ঘুরে যায়। পুলিশ ক্যাম্পও খুব কাছে না। পানীয় জল আছে, প্রথমেই সেদিন বাবার ছিল এই আপ্ত বাক্যটি সার। কপর্দকশূন্য মানুষের যা হয়ে থাকে। 

—এখানে ঠাকুরকর্তা ঘরবাড়ি বানালেন। কে আছে? 

—কেন, ঈশ্বর আছেন। গাছপালা বনজঙ্গল আছে। মাটি আছে। আকাশ আছে। হাওয়া আছে! কী নেই বল? 

সুতরাং এমন বাবার সঙ্গে তার তর্ক করা বৃথা। সে সকালে এক পেট পাত্তা খেয়ে আর কোনো কথা না বলে সাইকেলে বের হয়ে গেল! 

বাবা বিরক্তিতে বললেন, যত্তসব! খুঁজবেন। বের কর খুঁজে। দেখি কী করতে পার। আরে তাঁর মর্জি না হলে, তোমার দাদা নিখোঁজ হন। তাঁর মর্জি না হলে, তিনি কখনও ফিরে আসেন। 

একদিন মিমি হুড়মুড় করে রিকশা থেকে নেমে ছুটে এল। পিলু দেখছে, পরীদি কেমন রোগা হয়ে গেছে। এর আগেও প্রায়ই খবর নিয়ে গেছে, আর খবর শুনে মুখ কালো হয়ে গেছে। ফেরেনি। কোনো চিঠিও দেয়নি। পরীদি তারপরও বলেছে, মেসোমশাই ভাববেন না—আমি বসে নেই। লোক লাগিয়েছি। কলকাতায় আমাদের কাগজের জানাশোনা ছেলেরা আছে। ওদের সব খুলে লিখেছি। সম্ভবত বিলু কলকাতায় গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে। কফি-হাউসে খোঁজখবর নিতে বলেছি। খবর পেলেই চলে যাব। 

—তুমি চলে যাবে কেন? তোমার দাদামশাই দুঃখ পাবেন। আমিই যাব। কলকাতায় আমি গেছি! ভাববে না, আমি কলকাতা চিনি না। মা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছিল। মা বাবার কথা সহ্য করতে পারে না। বলল, তুমি গেলেই হয়েছে। বাপ বেটা দু’জনকে খুঁজতেই তখন আবার পরীকে হন্যে হয়ে ছুটতে হবে। 

বাবা পরীদির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, বোঝো! অর্থাৎ যেন বলা, বোঝো আমি কী শান্তিতে আছি। 

সেই পরীদি রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নামল। শাড়ি সামলে এক হাতে ছুটে আসছে জাম গাছতলার নিচ দিয়ে। পিলু বারান্দায় মাদুর পেতে পড়ছিল। আর তখনই রিকশার ঘণ্টি বাজছে—সে দেখছে রাস্তা থেকে পরীদি ছুটতে ছুটতে আসছে। মুখে চোখে উত্তেজনা! পরীদি কী দাদার খোঁজ পেয়েছে! সে চিৎকার করে বলল, বাবা, পরীদি আসছে। সেও পরীদির কাছে ছুটে গেল। দাদার নিশ্চয়ই কোনো খবর আছে। না হলে এ-ভাবে কেউ ছুটে আসে না। আর তখনই মাথায় পোকা ঢুকে যায়, কোনো খারাপ খবর নয় তো! পরীদি তো সাইকেলে আসে। কলোনিতে পরীদি পার্টির কাজ করে বেড়ায়। কার লোন বের হয়নি, কার ক্যাসডোল মেলেনি, কারা নতুন এল—বসতি কোথায় দেওয়া হবে, নানা কাজে এখন পরীদি আসে। মাঝে মাঝে রাত বেশি হয়ে গেলে শহরে ফেরে না। দাদার ঘরে মায়াকে নিয়ে শোয়। সে তখন বাবার পাশে শুয়ে থাকে। সেই পরীদি রিকশাতে। খুবই জরুরী খবর— না হলে রিকশায় যেন আসতে পারে না। কাছে আসতেই দেখল পরীদির চোখে মুখে উচ্ছ্বাস। ঠিক এই পরীদিকে পিলু চেনে না। 

সে বলল, পরীদি তুমি! দাদার কোনো খবর পেলে! 

পরীদি বলল, পেয়েছি। 

পিলু লাটুর মতো পাক খেয়ে বলল, মা মা, বাবা বাবা–মায়া, দাদার খোঁজ পাওয়া গেছে। বাবা ঘরে কিছু করছিলেন। করছিলেনটা আর কী! তাঁর গামছায় বাঁধা পুঁটুলিটা ঘাঁটছিলেন। যখন তিনি অথৈ জলে পড়ে যান, ওটা করে থাকেন। এরই ভিতর তাঁর টাকা পয়সা গোঁজা থাকে। কেউ ধরলেই ক্ষিপ্ত হয়ে যান। পুঁটুলিটা তাকের উপর তুলে রাখেন। বাড়িতে ঠাকুর দেবতার পর এই পুঁটুলিটাই বাবার সব। সিঁদুর মাখা একটি রুপোর টাকাও থাকে পুঁটুলিতে। টাকাটা বাবা দেশ থেকে সঙ্গে এনেছিলেন। মাথা নেড়া একজন মানুষের মুণ্ডুর ছাপ টাকাতে। সে একবার গোপনে খুলে টাকাটা হাতে নিয়ে দেখেছিল। তাঁর পোঁটলা কেউ ধরলেই টের পান। সেদিন বাবা অগ্নিশর্মা। আমার গৃহলক্ষ্মীর উপর কার দয়া হল! কে ধরেছে। কেউ স্বীকার করে না। সেও না। বাবা গজগজ করছিলেন, আমার জিনিসে কার যে এত দরকার বুঝি না। কিছুই খোয়া যায়নি—কিন্তু কিছুতেই বাবার মেজাজ প্রসন্ন করা গেল না সেদিন। 

দাদার খবর পাওয়া গেছে শুনে সবাই ছুটে বের হয়ে এলেও বাবাকে দেখা গেল না। নবমী পর্যন্ত তার ঘর থেকে বড় দাদাঠাকুরের খবর পাওয়া গেছে শুনে গুড়ি মেরে বের হয়ে এসেছিল। কেবল বাবার সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। 

পরীদি ছুটে এসে বারান্দায় বসে গেল। মাটি উঁচু করে ঘরের বারান্দা। গোবরজলে নিকানো। পরীদির এই স্বভাব। মাটির দাওয়ায় বসলে আকাশের নক্ষত্র নাকি খুব কাছে দেখা যায়। অদ্ভুত সব কথা। পরীদি উচ্ছ্বাসে প্রায় যেন ভেঙে পড়েছে। মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, এক গ্লাস জল খাওয়া। 

কী খবর কিছুই বলছে না। কোথায় আছে দাদা তাও বলছে না। পিলু অপেক্ষা করছে উঠোনে— দাদা কোথায় আছে? কবে আসবে? কিন্তু পরীদি কিছুই বলছে না দাদার সম্পর্কে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, মেসোমশাই বাড়ি নেই! 

ভিতর থেকে গলা পাওয়া গেল, যাই। দেখ না, কোথায় যে রাখলাম। 

খুবই জরুরী কিছু বাবা হারিয়ে বসে আছেন। দাদার খবরের চেয়েও জরুরী বিষয় বাবার এখন আর কী থাকতে পারে পিলু বুঝতে পারছে না। এমন কী অমূল্য নিধি তাঁর হারিয়েছে যা দাদার খবরের চেয়ে বড়। পরীদি যতবারই এ-বাড়িতে এসেছে— দেখেছে বাবা ঝোপজঙ্গলে গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত। আগাছা সাফ করছেন। গাছের গোড়ায় মাটি দিচ্ছেন। সেই বাবা ঘরের ভেতর কী করছেন এখন কে জানে! পরীদিও হয়েছে, বাবা বারান্দায় এসে না বসলে যেন কোনো খবরই কাউকে দিয়ে লাভ নেই। 

পিলু আর পারল না, দাদা তোমাকে চিঠি দিয়েছে। 

—তোর দাদাকে এই চিনলি এত দিনে। সে চিঠি দেবে! তা হলেই হয়েছে। সে চিঠি দেবার পাত্র।

—তবে কে জানাল? তুমি কলকাতায় গেছিলে! 

পার্টির মিছিল গেলে পরীদি কলকাতায় যায়। পরীদি এমনিতেও যেতে পারে। কলকাতায় তার কাকা থাকেন, এক পিসি থাকেন। তাদের বাড়ি ঘর আছে। বেড়াতে যেতে পারে। কত কারণেই পরীদি যখন তখন কলকাতায় চলে যেতে পারে। এক-দু’দিন থেকে ফিরে আসতে পারে—যদি সেখানে দাদার কোনো খবর পায়। 

পরীদির হাতে সুন্দর মলাটের একটা বই। এত যত্ন করে রেখেছে, এবং কোলের উপর রেখে যাতে ভাঁজটাজ না পড়ে—যেন এই বইটা পরীদির কাছে বাবার চণ্ডীস্রোত্রের চেয়ে মূল্যবান। কারণ পরীদি আঁচল দিয়ে এরই মধ্যে মলাটে ধুলোবালি না লাগে, মুছে আবার নিজের মুখ মুছল। কার্তিকের বেলা—রোদের তাপ কম—তবু পরীদি ঘামছে। এত যত্নে আলতো করে আঁচলে বই-এর মলাট কেউ মুছে দেয় পিলু এই প্রথম টের পেল। নিজের মুখের চেয়েও দামি বই-এর সুন্দর মলাট—এমনই মনে হল তার। 

বাবা বিরক্ত হয়ে যেন এবার বাইরে বেরিয়ে এলেন। বারান্দায় জলচৌকিতে বসে বললেন, তা হলে শ্রীমানের খবর পাওয়া গেল। আসার কোনো খবর দেয়নি! 

পরী বলল, না তা দেয়নি। খবর পাওয়া যায়নি! 

—কী বলছ। এই যে পিলু গলা ফাটিয়ে বলল, দাদার খবর পাওয়া গেছে। 

—তা পাওয়া গেছে। 

—সেটা কী! বাবার কেমন তিক্ত গলা। 

পরী যত্ন করে পত্রিকাটা এগিয়ে দিল।

—এটা কী! এটা দিয়ে আমি কী করব! 

—কলকাতার খুব বড় কাগজ।

–কী আছে এতে?

—বিলুর কবিতা!

—কবিতা! 

পিলু দেখল বাবার চোখ মুখ কুঁচকে গেছে। পরীদি কী যে করবে ভেবে পাচ্ছে না। এটা তাহলে বই নয়। পত্রিকা। দাদার কোনো খবর নেই। দাদার কবিতা ছাপা হয়েছে। বাবা যে এতে কুপিত হবেন বোঝাই যায়। দাদার কবিতা নিয়ে বাবার যত ক্ষোভ। গোল্লায় গেল। মাথায় পোকা ঢুকে গেছে। আখের সর্বনাশ! 

পরীদি বলল, বিলুর কবিতা ছাপা হয়েছে। 

—ছাপা হয়েছে তো আমি কী করব। 

—কত নামি কাগজ মেসোমশাই—।

যেন পরীদির এত দিনে জীবন সার্থক। পিলু জানে, দাদা বন্ধুদের গর্ব—দাদা পরীদির আবিষ্কার। পরীদিই ব্লেকমেল করে দাদাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়েছে। ব্লেকমেল কী পিলু জানে না। তবু দাদার সঙ্গে ঝগড়া বেঁধে গেলে, পরীদি চেঁচিয়ে বলত, আমি তোমাকে কবিতা লেখার জন্য ব্লেকমেল করেছি বিলু! 

—হ্যাঁ করেছ। কে যায় ও-পথে। তুমিই তো অযথা ভয় দেখালে। প্রতারণা করেছ। 

—প্রতারণা! তোমার সঙ্গে! 

—কার সঙ্গে তবে! তোমার তো একজনই আছে প্রতারণা করার লোক। তুমি বলনি, বলে দেব।

—কী বলে দেব বলেছি। 

—আমি যে গ্যারেজ থেকে গোবিন্দের কৌটা ভেঙে কুড়ি টাকা নিয়ে সেবারে পালিয়েছিলাম বলনি! বলনি, আমি চোর। চোরকে কালীমন্দিরের পুরোহিত করা যায় না! 

—হায় সর্বনাশ, বিলু তোমার মিছে কথা বলতে জিভে আটকাল না! চোর না বললে তো মন্দিরে পুরুতগিরি করতে। সব তো ঠিক হয়ে গেছিল। দাদামশাই, তোমার মানুকাকা, মেসোমশাই মিলে ঠিকই করে ফেলেছিল। মনে নেই ছুটে এসেছিলে, পরী আমাকে বাঁচাও। বাবার যা কাছাখোলা অবস্থা রাজি হয়ে যাবেন। বর্তে যাবেন। রক্ষা কর। কার্তিক ঠাকুরকে তখন কে রক্ষা করেছিল! 

—না বলিনি। 

—মিছে কথা বলবে না। একদম বলবে না। বলনি, এখন আমি কী করব পরী!

পিলু দেখেছে, দাদা আর কথা বলতে পারত না। একেবারে চুপ করে যেত।

পরীদি তখনও গজ গজ করছে—আমি যত নষ্টের গোড়া না! নষ্ট করেছি। ঠিক করেছি। আরও করব। পারলে একশবার করব। হাজারবার করব। কবিতা লিখতে বললে মানুষকে নষ্ট করা হয়! 

দাদা আবার গর্জে উঠত, চুপ। তুমি বলনি, বিলু, সব করব। কবিতা লেখ। তুমি পারবে। তোমার চোখ মুখ বলছে পারবে। তোমার ভিতর জ্বালা আছে। অনুভূতি আছে স্বপ্ন আছে। তুমি পারবে। কলেজ ম্যাগাজিনের কবিতাটি দাও। তবেই দাদামশাইকে বলব, বিলুটা একটা চোর। গ্যারেজ থেকে টাকা চুরি করে একবার পালিয়েছিল। একটা চোরকে বাবাঠাকুরের জায়গায় বসাবে। ভাল দেখাবে! তোমার মা কালী রাগ করবেন না! কী বলনি! বল চুপ করে থাকলে কেন। কে আমাকে রাস্তায় টেনে নামিয়েছিল। 

পরীদি বলত, বেশ করেছি। তোমার সর্বনাশ আমি চাই। আঃ কী কবিতা! পরী আমার সর্বনাশ। আর কোনো লাইন খুঁজে পেলেন না তিনি! 

দাদার ঘরে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। বাইরে থেকে কেউ শুনছে। সেই পরীদি কত উচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছে, আর বাবা কেবল বসে বসে তামাক টানছেন। পত্রিকাটা মাটিতে পড়ে আছে। পরীদির কাছে যা গৌরবের, বাবার কাছে বোধ হয় তা খুবই অগৌরবের। 

হঠাৎ বাবা প্রশ্ন করলেন, এতে কী পেট ভরে মা! এই যে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বাবু দুম করে অন্তর্ধান করলেন, ফল ভাল হবে! কবিতা লিখলে পেট ভরবে! 

পরীদি মাথা নিচু করে বসে আছে। 

মা বললেন, মিমি, বিলুর কোনো খবর নেই কাগজে! 

—আছে মাসিমা। কাগজটাইতো খবর। বিলু কী সুন্দর কবিতা লিখেছে। বলে সে মা’র কাছে কাগজটা নিয়ে গেল। 

বাবা বললেন, ওনি তো কবিতা বোঝেন! 

আসলে ঠেস দিয়ে কথা। 

পরীদি বলল, কবিতা বোঝার জন্য কেউ লেখে না মেসোমশাই। পড়ে ভাল লেগে যায়। দূরের কথা বলে। স্বপ্নের কথা বলে। বেঁচে থাকার কথা বলে। কত পাঠক পড়বে। নাম জানবে। আমি তো আর কিছু চাইনি। 

বাবা বললেন, বেশ ছিল, এখানে কাগজ নিয়ে পড়েছিল। কুকর্ম সুকর্ম তার এখানকার বন্ধুরাই সামলাত। এত বড় শহরে গিয়ে কবিতা লিখে শেষে দেশসুদ্ধ যজালি! 

পরী মেশোমশাইকে জানে। তার প্রতি মেসোমশাইয়ের এ-কারণে চাপা ক্ষোভও আছে। যদি তিনি পাতা উল্টে দেখেন, পড়েন। কত বড় বড় কবির পাশে তার কবিতা ছাপা হয়েছে। না দেখলে বুঝবেন কী করে! তারপরই মনে হল, মানুষের দারিদ্র্য অনেক কিছু বোধহয় হরণ করে নেয়। ঝড়, জল, অন্ন চিন্তা, মুষ্টি নির্ভর জীবন কোন কবিকেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে দেয় না। তিনি দেখলেও এর গাম্ভীর্য কিংবা গুরুত্ব টের পাবেন না। পরীর নিজেরই ইচ্ছে হল একবার সবটা পড়ে শোনায়। 

তখনই পিলু বলল, তুমি যে বললে, দাদার খবর আছে, এই খবর! 

—হ্যাঁ। তোর দাদা কলকাতায় গা ঢাকা দিয়ে আছে। কতদিন থাকতে পারে দেখব। পত্রিকা অফিসে গেলেই ওর খবর পাওয়া যাবে। কফি হাউসে গেলে পাওয়া যাবে। কবিরা মুখচোরা স্বভাবের হয়। আড়ালে আবডালে থাকতে ভালবাসে জানি। তবু সে ভালই আছে। এর চেয়ে বড় খবর আর কী পেতে চাস বুঝি না। আমার কাছে এর চেয়ে বিলুর আর অন্য কোনো বড় খবর যে থাকতে পারে না। কথা বলতে বলতে মিমির গলা ধরে এল। 

এতে বাবার বোধ হয় সামান্য লেগেছে। বললেন, দেখি। তারপর তিনি পাতা উল্টাতে থাকলেন কাগজটার।  

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *