প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

অন্নভোগ – ৭

সাত 

বিকেল পড়তেই নবমীর সঙ্গে পিলুর চোটপাট শুরু হয়ে গেল। নবমী আজকাল বাবাঠাকুরের বাড়িতে উঠে এসে চোপা করতে শিখে গেছে। অবশ্য পিলু জানে, নবমীর চোপা আগেও কম ছিল না। কেবল তাকে দেখলেই বুড়ির মাথা ঠাণ্ডা হত। তার সমবয়সীদের উৎপাতের কথা জঙ্গলটায় ঢুকলে বুড়ির কাছে শুনতে পেত। নবমীর নালিশ ছিল, দেখেন দা-ঠাকুর আমারে ঢিল মেইরেছে। দ্যাখেন—বলে পায়ের গোড়ালির উপর হাত দিয়ে দেখাতেই চটে গেছিল—নাম জান, কে, কে করেছে! 

নবমী মাথা নেড়েছিল। 

—মুখ চেন? 

নবমী তাও যেন ঠিক জানে না। তবু যারা পরিত্যক্ত ইটের ভাটার বনজঙ্গলে ঢুকে উৎপাত করতে পারে তাদের সে চেনে। সবাইকে নবমীর কাছে নিয়ে গেছিল। 

নবমী ঠিক চিনতে পেরেছিল। 

—তুই ঢিল ছুঁড়লি। 

—আমারে আকথা কু-কথা কয় পিলুদা। 

নবমীর সাফ কথা, না দা-ঠাকুর, মিছা কথা 

—তুমি আমারে ছাগলের বাচ্চা কও নাই। 

—হ কইছি। 

—তুমি আমারে কও নাই ওলাওঠা হইয়ে মরবি। 

—হ কইছি। 

—তুমি আমারে কও নাই বংশে বাতি দিতে থাকব না। 

—হ কইছি। 

পিলু নবমীকেই তেড়ে গেছিল।

—কেন বললে। বল। ছাগলের বাচ্চা কেন বললে। এটা কু-কথা না! 

—আমার ছাগলের বাচ্চা নিয়া নিব কয়। কু-কথা হইব ক্যান। 

—তুমি বোঝ না ভয় দেখায়। 

—ঘর থেইকে তাড়িয়ে দেবে কয়। 

—এটা ঘর। এটাতে মানুষ থাকতে পারে। বনজঙ্গলে থাক, আর এটা তোমার ঘর হয়ে গেল।

—আমার স্বামীর ভিটে পিলুদা। বনজঙ্গল বলেন ক্যানে! 

—স্বামীর ভিটা! ভয়ে তো মর, রাতে সাপ ঢোকে। সারারাত ঘুমাও না। লাঠি নিয়ে দরজায় বসে থাক। শেয়ালে খটাশে টেনে নিয়ে যখন যাবে, কে রক্ষা করবে! হ্যাঁ কে তোমাকে রক্ষা করবে বল। শাপশাপান্ত করলে ঢিল ছুঁড়বে না। 

তারপর পিলু কেমন ফুঁসে উঠত— তোরাই বা কী! বুড়ির কিছু আছে। নবমীর কাছে তোদের নিয়ে আসাই ঠিক হয়নি। আগে তো ভয়ে জঙ্গলটায় ঢুকতিস না। 

—না পিলুদা, বনটায় ডাইনি থাকে। লোকে স্বচক্ষে দেখেছে। নবমী ডাইনি। হ্যাঁ–কি রে, কথা বলছিস না কেন। বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। ফলপাকুড় যা পায় খায়। ছাগলটা নিয়ে জঙ্গলের মাঠে ঘাস খাওয়ায়। গাছের সঙ্গে কথা বলে, সে কী মানুষ আছে! একটা গাছ হয়ে গেছে না! গাছের সঙ্গে তোদের যত বাঁদরামি! আর কোনোদিন নবমী যদি নালিশ করে ঠ্যাং ভেঙ্গে খোঁড়া করে দেব বলে দিলাম। 

–পিলুদা, একখানা কথা! 

—কী কথা আবার। 

—নবমী য্যান আমাদের ছাগলের বাচ্চা না কয়। 

—নবমী, আর কখনও যদি শুনি, এদের মুখ করেছ, তবে তোমার ভাত জল বন্ধ। তোমার খোঁজখবর নিতে আমার বয়ে গেছে। 

—না দা-ঠাকুর, মুখ কইরব না। আপনি না এইলে আমার যে দিন যায় না দা-ঠাকুর। 

সেই দা-ঠাকুরের সঙ্গে নবমী চোপা শুরু করেছে। পরী আর মায়া বিলুর তক্তপোষে শুয়েছিল। ভাদ্র মাসের গরম। জানালার খলপাটা তুলে দেওয়ায় ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। আকাশে দুপুরের দিকে মেঘ করেছিল, আবার মেঘ কেটে গেছে। সামনের মাঠটায় আউস ধানের চাষ—ধান পেকে গেছে, জানালায় বসে সব দেখা যায়। ঘরটা তার এত চেনা, মনেই হয় না এটা তার পরবাস। 

পিলুর এক কথা, পারব না। রোজ রোজ বায়না। কে নিয়ে যায়! মানুষের আর কাজ কাম নেই। এই সেদিন গেলে স্বামীর ভিটে দেখতে। আজ আবার মাথায় ক্যাড়া উঠেছে। আমি পারব না। স্কুলের মাঠে ভলিবলের কোট কাটতে যাব। 

মিমি ঠিক বুঝতে পারছে না কেন বুড়ির এত চোপা! নবমী বুড়ির বনটা সেও চেনে। একবার কারবালার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আসার সময় পিলু বলেছিল, জান পরীদি, এই জঙ্গলটায় একটা বুড়ি থাকে। 

মিমি অবাক হয়ে গেছিল শুনে। 

সেই প্রথম তার বিলুদের বাড়ি দেখতে আসা পালিয়ে। লক্ষ্মীকে নাকি বিলুই সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। রাস্তাটা লক্ষ্মী সে-জন্য চেনে। কালীবাড়িতে বিলুর সঙ্গে জোর করে পরিচয় করতে গিয়েই ফ্যাসাদ। মজা করার জন্যই বলেছিল, তোমাদের বাড়ি আমি যাব। লক্ষ্মী আমাকে নিয়ে যাবে বলেছে। মুখচোরা স্বভাবের বিলু সহসা ক্ষেপে গিয়ে বলেছিল, গিয়ে দেখ না। 

—কেন ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবে। 

—কী করব গেলে বুঝবে। 

সেই থেকে তার জেদ। এবং এই জেদ শেষ পর্যন্ত তাকে বিলুর আত্মপ্রকাশের জন্য মরিয়া করে তুলবে যদি আগে টের পেত— তবে বোধ হয় এ-ভাবে গলায় তার কাঁটা ফুটে যেত না। বিলুর আত্মপ্রকাশের জন্যই যেন অপরূপা কাগজ, কবিতা পাঠের আসর-এবং এক জলছবির মতো একজন বাদ্যকার মাঠ দিয়ে ঢাক বাজিয়ে যায়। গভীর নিশীথে আশ্চর্য স্বপ্নের মতো একজন পুরুষ তার পাশে থাকুক—যার মধ্যে সে কোনো নীরব এবং নিশ্চিত মাধুর্য টের পাবে। তারই প্রতীক্ষায় সে আছে। এবং মায়া আজ তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর বিলুর সেই আক্ষেপ, বার বার কিছু শব্দমালার মধ্যে খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছে। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, বিলু যেন ঠিকই লিখেছে—পরী আমার সর্বনাশ। পরী আমার আকাশ বাতাস। গভীর রাতে নির্জনে হাঁটি। দেখি নক্ষত্র হয়ে সে আছে। মাথার উপরে। তার ডানার ঝাপটায় ধুলো ওড়ে। ওড়ে কাঙ্গালের বসন। উলঙ্গ করে দেয় অজ্ঞাতে— পরী আমার সর্বনাশ/জীবনে/বীজবপনে/বিসর্জনে। 

পরী বার বার উচ্চারণ করছিল, জীবনে, বীজবপনে, বিসর্জনে। এই কথাগুলি ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকাল থেকে যা গেছে। আর ঘুম ভাঙতেই সে শুনছে কী….. 

পিলু বলছে, ডাকাতের বৌ, তার আবার স্বামীর ভিটে। 

ছি পিলু। তুই ওভাবে বলিস না। ডাকাতের বৌ নবমী! 

পরী পায়ে শাড়ি টেনে দরজা খুলে বের হয়ে এল। কিন্তু আশ্চর্য পাশের ঘরে মাসিমা, মেসোমশাই নির্বিকার। তারা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে মনে হয় কথা বলছে। 

পিলু আর নবমীর এই কথা কাটাকাটি তারা যেন গ্রাহ্যই করছে না। 

পরীর এটা ভাল লাগল না। 

সে দেখল বুড়ি কোরা থান পরে হাতে লাঠি নিয়ে বসে আছে। কিছুটা অচল। লাঠি ভর দিয়ে উঠতে পারে। কিছুটা যে হেঁটে বেড়ায় তাও লাঠির সম্বলে। সেই নবমীর কী গলা। ডাকাতের বৌ বলাতেও কোনো আক্ষেপ নেই। কোথাও যাবে বলে সে প্রস্তুত। বাধ সেধেছে পিলু। 

পরী বলল, কী বাজে বকছিস পিলু। 

—আর বল না পরীদি, এই সেদিন ধরে ধরে নিয়ে গেছি। হাঁটতে পারে না। দু-পা গিয়ে পড়ে যায়। না ধরলে মুখ থুবড়ে পড়ে মরে থাকবে। তা তোকে কে বাবাঠাকুরের বাড়ি উঠে আসতে বলেছিল। ডর লাগে! ডর। ধনে তার যখ লেগেছে। ঘুম হয় না। লাঠি নিয়ে দরজায় ধপাস ধপাস। না আমি পারব না। একা পার তো যাও। 

পরী বলল, কিরে যা না। এত করে বলছে। তার স্বামী ডাকাত তোকে কে বলেছে! 

—কে আবার বলবে! জিজ্ঞেস কর না। না বললে আমরা জানব কী করে। তিনি নাকি ডাকাতের বৌ ছিলেন। এক বারে গরিমায় পা পড়ে না। ফোকলা দাঁতে কী হাসি, কী না, সে যদি দেখতে। ডাকাতের বৌ বলেই নাচ শুরু। লাঠিতে ভর করে ঘুরে ঘুরে কোমর বাঁকিয়ে নাচ যদি দেখতে! 

ডাকাতের বৌ, নবমী ডাকাতের বৌ—পরী বড় বড় চোখে দেখছিল। কেমন ডাকাত, কোথাকার ডাকাত, খুনটুন কত করেছে কে জানে! তবে কী জঙ্গলের মধ্যে থাকত ডাকাতের বৌ বলেই। কিন্তু পরী এটাই বা কী দেখছে! ডাকাতের বৌ বলায় নবমী কী খুশি। 

নবমী লাঠি ভর দিয়ে ওঠার সময় কঁকিয়ে বলল, ডাকাতের বৌ বলে কী আমার স্বামীর ভিটে থাকতে নাই। লিয়ে না যান, একাই চইললাম। 

পিলু সেই মতো এক দুর্বাসা যেন।—পা বাড়িয়ে দ্যাখ কী করি! যাও ঘরে। বারান্দায় বসে থাক।

ইস্ পিলুটার মায়া দয়া নেই! জঙ্গলের মধ্যে স্বামীর ভিটে, বেশি দূরেও না, পরী বলল, চল নবমী, আমার সঙ্গে চল। 

মায়া বের হয়ে বলল, তুমি যাবে! আমিও যাব। 

পিলু বলল, তবে আমিও যাব। 

বাবা ঘর থেকে বের হয়ে বললেন, দিলে তো মাটি করে। নিত্যকার যাত্রাপালাটা দেখতে পেলে না। রোজ বিকাল হলে নবমীর নাকি মন কেমন করে। আর সাধাসাধি। পিলু যাবে না। নবমীর গোঁ যাবে। ডাকাতের বৌ বলে তারও জেদ কম না। দু’জনের তর্ক দেখলে তোমার হাসি পেত। 

পিলু বলল, জান পরীদি, কী আস্পর্ধা। বলে, কি না যোয়ান মানুষটা সামনে নাই। থাকলে দেইখতেন। তাঁর বন্ধুরে নির্যাতন! এক আছাড়ে ছাতু কইরে ফেলত। গোট গোট মল বানিয়ে দিয়েছিল। ঘাঘড়া। রেইতের বেলা ফিরে এইলে কোমরে হাত দিইয়ে নেইচেছি কত— কী যেন সব বলে না। তারপরই নবমীর দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, মনে রেখ তুমি ডাকাতের বৌ, আমি বামুনের পোলা। এক ফুয়ে উড়ে যেত তোমার মরদ। 

পিলু ব্রাহ্মণ সন্তান কথাটা স্মরণ করিয়ে দিলেই নবমী জব্দ। বামুনের অভিশাপেই মানুষটা নাকি তার গেছে। কোন এক ব্রাহ্মণীর গা থেকে অলঙ্কার খুলে আনার সময় নাকি অভিশাপ দিয়েছিল, ভেদ বমিতে যাবি। নবমী মনে করতে পারে সব। নবমী মনে করতে পারে সেও ছিল লুটের মাল। বখরায় বনছিল না বলে, তাকে নিয়ে পালাল। কত গ্রাম গঞ্জ রেল ইস্টিশানে তারা পড়ে থেকেছে। তার জন্য মানুষটা পুলিশের তাড়ায় দেশ ছাড়া রাজ্য ছাড়া হয়ে গেল। শেষ বেলায় ইটের ভাটায়। কুলি কামিনের সর্দার। 

পরী আগে আগে হাঁটছে। পিলু, বুড়ির পেছনে। সত্যি বেশ দূর মনে হল তার বাড়ি ফিরতে হবে। রাত করে ফিরলেও কেউ বলার নেই। সে পার্টির কাজে কত জায়গায় যায় মিটিং মিছিল করতে। কত রাতে ফিরতে পারে না। খুব বেশি হলে সুহাসদাকে ফোন—এবং সুহাসদা জানে সে যেখানেই যাক, তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা পার্টির ক্যাডাররাই করে থাকে। আজ দাদু ক্ষোভে অভিমানে ফোনও না করতে পারে। 

বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে উঁচু নিচু পথ। সামনে ঢিবি। ঢিবির পাশে মাটি তোলায় মজা পুকুর। শাপলা শালুক, জলজ ঘাস, এবং কত সব বিচিত্র পাখি উড়ে যাচ্ছে বনটায়। পিলু কিংবা মায়ার যেন মনেই নেই তাদের দাদা নিখোঁজ। পরীদিকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়ে সব দেখাচ্ছিল। ওটা—উ যে চালা ঘরটা দেখছ, ওখানে আমার পিসি বাড়ি করেছে। বাড়ি না বলে জঙ্গলের মধ্যে ঝুপড়ি বললেই হয়। গোপাল করের সীমানা শেষ হতেই বনজঙ্গলের শুরু। কাঁটা গাছ, খেজুরের বন, তাল গাছ, শিশুগাছ চারপাশে। বর্ষাকাল বলে ঝোপজঙ্গল নিবিড় 

পরী বলল, ঠিক রাস্তায় যাচ্ছিস তো! 

পরী আসলে সেই রাস্তাটা চিনতে পারছে না। এমনও হতে পারে বর্ষাকাল বলে, বনজঙ্গল নিবিড় বলে সে যে ঠিক এই রাস্তায় এসেছিল মনে করতে পারছে না—কিংবা দিন দিন বাড়িঘরের সংখ্যা বাড়ায় জঙ্গলে যাবার রাস্তাটা জায়গা বদল করতে পারে। আসলে রাস্তা বলেও কিছু নেই। একটা গভীর সুমার বনে ঢুকে যাচ্ছে তারা। পরী বলল, নবমী, জঙ্গলে একা থাকতে কষ্ট হত না। 

নবমী হাতজোড় করে তখন কার উদ্দেশে যে প্রণাম করত বোঝা ভার। 

পিলু এগিয়ে গিয়ে বলল, জান পরীদি, নবমীর ছাগলের দুটো বাচ্চা। বেশি হলে জঙ্গলে রেখে আসত। 

—জঙ্গলে কেন? 

—কী জানি কেন! ওতো বলে ভূতেরা চাইত 

—ভূতেরা ছাগলের বাচ্চা চাইত। ভারি মজার ভূত তো! 

নবমী লাঠি ঠুকে ঠুকে হাঁটছে। কাঁটা গাছে তার কাপড় জড়িয়ে গেলে পরী উবু হয়ে ছাড়িয়ে নিচ্ছে। কাঁটা গাছ বাঁচিয়ে যাবারও রাস্তা নেই। 

পরী নবমীর কাপড় থেকে কাঁটা গাছ ছাড়িয়ে দেবার সময় শুনতে পেল, ভূত কেন হবে। ঠাকুর দেবতা! 

পিলু বলল, আচ্ছা পরীদি, বনে ভূত ছাড়া কিছু থাকে! ঠাকুর দেবতা থাকে বাড়িতে। নয় মন্দিরে।

নবমীর এক কথা, দা-ঠাকুর বনের দেবতা আছেন। জানেন না গো। একলা এতটা কাল থেইকে বুঝেছি। 

নবমীর সব কথা স্পষ্ট নয়। শুধু জিভ নাড়ে। আর কী বলে বোধহয় পিলু ছাড়া আর কেউ বোঝে না। তবু বনটার কাছে এসে মনে হল পরীর, এক নারী তার যুবতী বয়সে এই জঙ্গলে উঠে এসেছিল। সঙ্গে তার মরদ। বাবুদের ইটের ভাটায় কাজ। শীত বর্ষায় গাছপালার মধ্যে থাকতে থাকতে নবমীর এই বন ছাড়া অন্য কোনো অস্তিত্ব নেই। তবু শেষ বয়সে মেসোমশাই তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। শেয়ালে খাটাসে খেলে মানুষের অসম্মান। এখন সেই নবমী স্বামীর ভিটে দেখার জন্য পাগল। কে করবে এত! 

বিলুদের বাড়িটায় হাঁস কবুতর খোঁড়া বাঁদর গোটা ছয়েক বিড়াল, দুটো কুকুর — কী না ছিল! এখন প্রাণীর সংখ্যা কমে এসেছে। পরী মনে করে একজন উদ্বাস্তু মানুষের নানা সংস্কার গড়ে উঠতে পারে— কোন পাপে দেশ ছাড়া, এমন কোনো উচাটনে পড়েই হয়তো যাবতীয় প্রাণীজগত থেকে গাছপালার প্রতি এক অপত্য স্নেহ গড়ে উঠেছে মানুষটার। তা না হলে এই নবমীকে, যার তিনকাল গেছে, শেষ কালে যাবার সময়, তার জন্য ঘর তুলে দিয়েছে! গীতা কিনে দিয়েছে! পিলু নাকি মাঝে মাঝে রামায়ণ মহাভারতও পড়ে শোনায়। সব বিলুর কাছেই শোনা। বাড়িটা যে চিড়িয়াখানা করে তুলছে তার বাবাটি— সেটাও ক্ষোভের বিষয়। পরী তার বাড়ি যে যায়, তাও বাবা মানুষটিকে দেখতে, তার চিড়িয়াখানা দেখতে। কিন্তু বিলু বোঝে না, এই বুড়ির তিনকুলে কেউ নেই—একজন মানুষের প্রাণ কত বড় হলে তাকে বসবাসের জায়গা করে দিতে পারে। নিজে উদ্বাস্তু না হলে, হয়তো নবমীর কথা মেসোমশাইয়ের মাথাতেই আসত না। 

জঙ্গল থেকে নবমীকে তুলেও আনা হত না। রোগে ভোগে চারপাশে শুধু বনজঙ্গলের জীবজন্তুর সাড়া পাওয়া যেত। পিলুর খোটা দিয়ে কথা বলাটাও পরীর পছন্দ হচ্ছিল না। ডাকাতের বৌ! তোর দাদা কত বড় ডাকাত জানিস। তার মান অপমানের জ্বালা কত জানিস! সে কী ভাবে আমাকে হেনস্থা করত জানিস! 

কিছুই জানিস না। 

ওদের দুই বন্ধুকে সাইকেলে আসতে দেখলেই বুক ধড়াস করে উঠত। সাইকেল থামিয়ে অপেক্ষা করতাম। কতদিন কতভাবে আমাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে। আমাকে দেখেই মুকুল সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াত। তোর দাদা নামত না। অবজ্ঞারও শেষ থাকে। সে সাইকেল নিয়ে ভাঁকুড়ির রাস্তায় উধাও হয়ে যেত। 

কী যে খারাপ লাগত। বুঝবি না! 

আমি কী মুকুলের সঙ্গে কথা বলার জন্য সাইকেল থেকে নেমেছিলাম। যার জন্য নামা তিনি হাওয়া। 

কী ব্যাপার মুকুল! 

খুব চটে আছে। 

কেন? 

আর কেন। কলেজ ডিবেটে যেই তুমি উঠে দাঁড়ালে, ব্যস বাবু বললেন চল। আরে যাবে কী! শোনো মিমি কী বলছে। জোরজার করে বসিয়ে রাখলাম। কিন্তু যত তুমি যুক্তি দিয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তির পক্ষে কথা বলছ, তত খেপে যাচ্ছে। যত তুমি হাততালি পাচ্ছ তত তার মুখ গোমড়া হয়ে যাচ্ছে। আর হঠাৎ জান দেখি পাশে নেই। কখন ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে। বাইরে বের হয়ে দেখছি গঙ্গার ধারে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বললাম, কী বিলু, এখানে! পরী ডিবেটে কী তুখোড় যুক্তি দিয়ে বলল, যদি শুনতে! 

আরে রাখ! বড়লোকের মাইয়া আমি চিনি। মুখে বড় বড় আদর্শের বুলি। আচ্ছা মুকুল, তুমি বিশ্বাস করতে পার এরা কখনও গরীবের দুঃখ বুঝতে পারে। ভণ্ডামী না। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ। সব মানুষের জন্য আহার আশ্রয় উত্তাপ একমাত্র বিজ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়। মানুষের জন্য সমান সুযোগ- কখনও সম্ভব! এরা যতদিন আছে শুধু ভণ্ডামির আশ্রয় নিয়ে গরীব মানুষকে প্রতারিত করবে। আগেকার জমিদাররা পুকুর কেটে, মন্দির বানিয়ে গরীব মানুষদের ধোঁকা দিয়ে গেছে, এরা এখন সমাজবাদের নামে ভাঁওতা দিচ্ছে। পরীর এটা প্রতারণা। তোর কী দরকার, হ্যাঁ কে তোকে বলেছে, মিটিং মিছিলে স্লোগান দিতে, এ-আজাদি ঝুটা হ্যায়। 

মিমি জানে, একজন মেয়ের এই আত্মপ্রকাশ বিলুর একদম পছন্দ নয়। সে মিটিং মিছিলে গেলে বিলু ক্ষেপে যেত। পথ নাটিকায় অংশ নিয়েছে মিমি, শুনলেই ও রাস্তায় যেত না। সে মহেশ নাটকে আমিনার পার্ট করেছে, কলেজিয়েট স্কুলের দোতলার হলঘরে নাটক—সে কার্ড দিতে গিয়ে শুনল, বিলু বাড়ি নেই। মাসিমা মেসোমশাইকে বলেছে, পিলুকে বলেছে, তোরা যাস। সে নাটকে অংশ নেবার আগে বারান্দায় বার বার ছুটে আসত, পিলু যদি আসে। আর কেউ না আসুক পিলু ঠিক আসবে। সেই পিলুর পর্যন্ত পাত্তা নেই। তার যে কী খারাপ লাগত! পরে পিলু এলে মিমিও কথা বলত না। 

পিলুর তখন এক কথা, কী করব দাদা বারণ করেছে। 

মিমি কটাক্ষ করে বলত, একেবারে লক্ষ্মণ ভাই। দাদা বারণ করল বলেই আসবি না। আমি কেউ না। দাদার কথাই বড় হল! 

পিলু বলত, জাননা দাদা কী অশান্তি করতে পারে! 

তোর দাদা স্বার্থপর। মজা দেখাচ্ছি। 

সেও তখন ক্ষেপে যেত। আরও বেশি পার্টিঅফিস, আরও বেশি কলেজ ইউনিয়ান, সারাদিন টো টো করে ঘুরছে—আর মিমি জানে, বিলুটা চোরের মতো দূর থেকে সব দেখবে আর দিনরাত ফুঁসবে। 

এটাও ডাকাতি। আমার ভাললাগা মন্দলাগার বিন্দুমাত্র দাম নেই। জবরদস্তি করে তুমি আমার প্রাণ ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে চাও। 

.

পিলু বলল, মিমিদি, আমরা এসে গেছি। 

সে কেমন হুঁস ফিরে বলল, নবমী কোথায়! 

–ঐ যে আসছে। 

পরী দেখল, এক অশীতিপর বৃদ্ধা কেমন বেহুঁস হয়ে স্বামীর ভিটে দেখার জন্য উঠে আসছে।

গভীর বনজঙ্গলে মিমি কোনো ডেরা পর্যন্ত দেখতে পেল না। নবমী থাকত কোথায়! কুল গাছের জঙ্গল পার হয়ে বড় বড় সব শিরীষ গাছ, আকন্দ গাছের ঝোপ, পিটুলি লতার সমারোহ। লাল বনজ ফল। এক ঝাঁক টিয়াপাখি ঠুকরে খাচ্ছে। মানুষজনের সাড়া পেয়েই তারা উড়াউড়ি শুরু করেছিল। কিন্তু মিমি বুঝল না, শুধু বনজঙ্গলেই স্বামীর ভিটে কী করে হতে পারে। থাকার মতো একটা ঝুপড়ি হলেও বসবাসের জন্য দরকার। সেটা কোথায়? 

পিলু সারা জঙ্গলটায় ঢুকে গিয়ে কেমন এক নেশার মধ্যে পড়ে গেছে। ঝোপে জঙ্গলে কোথাও যদি পাকা পেয়ারা পাওয়া যায়—এই জঙ্গলের মধ্যে কোথাও কোনো গোপন জায়গায় সেই পেয়ারা গাছটা—পিলু বোধহয় সেটাই খুঁজছে। সে গুড়ি মেরে ঢুকছে, মায়া ডাকছে, ছোড়দা তুই কোথায়? মিমি দাঁড়িয়ে আছে একা। ছোট্ট এক তৃণখণ্ডের চারপাশে এত বড় বড় গাছের বনরাজি লীলা দেখতে দেখতে সে কিছুটা অভিভূত। এর কোনো গোপন অভিলাষ আছে সে টের পায়। এখানে একজন পুরুষ তার প্রিয়তমা নারীকে নিয়ে থাকার মধ্যে কোনো গভীর আনন্দ খুঁজে পেতেই পারে। নবমীর স্বামী মানুষটাকে কেন জানি এই মুহূর্তে একজন স্বপ্নের মানুষ মনে হল। সেও হয়তো পালিয়ে কোথাও এখন গোপন করতে চায় নিজেকে। সে আর তার প্রিয় পুরুষ। আহার আশ্রয় উত্তাপের ব্যবস্থা থাকলে এর চেয়ে ভালবাসার জায়গা আর কোথায় থাকতে পারে সে জানে না। 

এবং উলঙ্গ করে দেবার স্পৃহা নিরন্তর যে জন্মলাভ করে মনের মধ্যে, ডাকাত মানুষটি বনজঙ্গলে ঢুকে গিয়ে এটা বোধহয় আরও বেশি টের পেয়েছিল। সে জায়গাটা ছেড়ে যেতে পারেনি। সারাদিন পরিশ্রমের পর কী ঝড় বৃষ্টি, কী শীতের হাওয়ায় অথবা কোনো জ্যোৎস্না রাতে তার পরিভ্রমণ ছিল নবমীকে নিয়ে। প্রতিটি গাছের প্রতি তার মায়া জন্মে যেতেই পারে। এমনকী এই মুহূর্তে তার নিজেরও কেন যে মনে হচ্ছিল জায়গাটা ছেড়ে চলে গেলে সেও আর এক নবমী। নবমী হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে এসে মিমির পায়ের কাছে বসে পড়ল। কথা বলতে পারছে না। 

মিমি বলল, কোথায় তোমার ঘর! 

—ঐ যে হোথায়! 

মিমি কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। শুধু একটা ভাঙ্গা ইট কাঠের আস্তানা। ভিতরে কিছু নেই। যে কোনো মুহূর্তে ওটা ধসে পড়তে পারে। পরিত্যক্ত কোনো আবাস হতে পারে এটা মিমি ভাবতেই পারে না। বাইরে থেকে মনে হয় শেওলা ধরা ইটের পাঁজা। তার ভিতর থেকে, ফাঁকফোঁকর থেকে বনজ উদ্ভিদের জন্ম হচ্ছে। এবং হেমন্তে শীতে কিংবা বর্ষায় এই ইটের পাঁজার মধ্যে শেকড় চালিয়ে বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

—ওর ভিতর তুমি থাকতে! 

নবমীর ফোকলা মুখে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। কিছু বলল না। সে তার আবাসের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। সামনে কবে কোন প্রাচীনকালে মাটি তুলে ইট তৈরি হয়েছিল, তার খানাখন্দ এখনও বিদ্যমান। এই খানাখন্দের জনই ছিল নবমীর জীবনলাভের উপায়। তার রোগ শোক ব্যাধি এবং সুখ সব যাবার সময় জলে বিসর্জন দিয়ে গেছে। 

কেন যে মিমির মনে হল, এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে কেউ যায়। মানুষটার স্মৃতি নবমীকে আটকে রাখতে পারল না। কারণ এই গভীর বনজঙ্গলের মধ্যে সব গাছপালার সঙ্গে একজন মানুষের নিরন্তর অবস্থান যে মরে যায়নি, নবমীর মুখ দেখে সে তা টের পাচ্ছিল। 

মিমি না বলে পারল না, তোমার খারাপ লাগল না, চলে গেলে! 

—সাধে কী গেছি মা ঠাকরুণ! 

—কী হয়েছিল! 

—যথ। 

—যথ! 

—হ্যাঁ মা ঠাকরুণ যখ এসে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করল। কত ডাকতাম, তার সাড়া পেতাম না। ডর ধরে গেইছিল। 

নবমী এ-সব কী বলছে। সারা জীবন এই বনজঙ্গলে বসবাসের পর যখ এসে তাড়া করল তাকে!

মিমি কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়ছে। একজন অনাথ নারীর মধ্যে যখের ভয় কেন উদয় হল, সে তা বুঝতে পারছে না। ক্রমেই সে বিস্ময়ের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। 

সে বলল, তোমার মা বাবার কথা মনে পড়ে না! 

—পড়ে। 

—কষ্ট হয় না? 

–না। 

—কার কথা ভাবলে কষ্ট হয়। 

—মরদের কথা। 

—আর কারো কথা না! 

—না আরও একজন আছেন। পিলু দাদা। আমার দা-ঠাকুর।

—তোমার দা-ঠাকুর। পিলু তো সেদিনের ছেলে। 

—উ তো এসে আমাকে দেখে পালাল না। 

—পালাবে কেন! 

—আমি যে মানুষ না মিমিদি। আমার শনের মতো চুল, কংকালসার শরীর, উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াই, ডাইনি ছাড়া কেউ কিছু ভাবতে পারত না। জঙ্গলটায় ভয়ে লোক ঢুকত না। আমি তুকতাক করে ছাগল ভেড়া বানিয়ে রাখি। বিলুদাও রেগে যেত। দা-ঠাকুর খোঁজ খবর নিতে এলেই বিলু দাদা তাড়া করত দা-ঠাকুরকে। 

নবমী কত কথা বলে যাচ্ছে। 

কবেকার সব স্মৃতি—ভাল করে বোধহয় মনেও রাখতে পারেনি। তার অসংলগ্ন কথা এটা ওটা বাদ দিয়ে জুড়ে দিলে মনে হয়, আশ্চর্য এক গভীর প্রেম ছিল তার ডাকাত মানুষটির সঙ্গে। 

সে বলল, তোমার বাবা কী করতেন! 

—তিনি তো বড় সওদাগর ছিলেন। বয়েল গাড়ি ছেইল তিন গণ্ডা। বাজারে আড়ত — চাল, ডাল, তেলের। মোকাম। ঘর দরজার সীমাসংখ্যা নাই। বাড়িতে ডাকাত পড়ল। ছিনতাই হয়ে গেলাম।

পরী শুনছে। তার মধ্যে কোনো জলছবি ফুটে উঠছে। প্রশস্ত হলঘর — ঝাড় লণ্ঠন, চাকরবাকর, দাঁড়ে কাকাতুয়া এমন এক জলছবি ভেসে বেড়াতে থাকলে সে দেখতে পেল, সেখানে কে একজন লুণ্ঠন করার জন্য গোপনে ঢুকে গেছে। তার ভিতর হাহাকার বাজছে। কোথায় গেল বিলু! কোথায় গিয়ে উঠল। যেন সেই মৃত ডাকাত আবার অন্য ভূমিকায় এসে হাজির হয়েছে বনটায়। সেখানে সে কাউকে তুলে আনতে চায়—আবার অবাঞ্ছিত ভেবে নিজেকে কষ্ট দিতেও ভালবাসে। 

নবমীর জীবন তাকে আজ অন্য কথা বলছে। তার মা-বাবার কথা মনে পড়ে, তবে কষ্ট হয় না। তার মোকামের কথা মনে পড়ে কিন্তু কোনো অসুবিধা বোধ করে না।—দু-তিন গণ্ডা বয়েল গাড়ির কথা মনে পড়ে—কিন্তু তাতে উঠে বসার কোনো আগ্রহ নেই তার। শুধু স্বামীর ভিটায় ঘুরে ফিরে চলে আসতে চায়। পিলু মুখ করে। সে নিয়ে না এলে আজ এই তীর্থক্ষেত্রেরও খবর পেত না। তীর্থ তো মানুষ শান্তির জন্য করে। মানসিক শান্তি। 

তখনই পিলু কোত্থেকে জঙ্গলের মধ্যে উঠে দাঁড়াল। ডাকল, পরীদি, শিগগির এস। 

—কেন। 

—এস না। 

মায়াও জঙ্গলের ডালপালা সরিয়ে দূরে উঁকি দিল।—মিমিদি, এসে দেখ! 

মিমির ইচ্ছে হচ্ছিল না নড়তে। এই বৃদ্ধার সঙ্গে তার কথা বলার আগ্রহ অসীম। সে বলল, যাচ্ছি। যাচ্ছি বলে আবার কথা শুরু করে দিল। 

—তোমার মরদ কী মরে যখ হয়ে গেছিল। 

—না না। মরদ আমার সে-রকম আদমি ছেল না। 

পরী ঘাসের উপর বসে পড়েছে। দাঁড়িয়ে কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিল। সব কথা নবমীর বুঝতেও পারছে না। সে নবমীর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। 

দু’জন মুখোমুখি বসে। 

একজনের ঊষাকাল, অন্যজনের সাঁজ লেগে গেছে। 

পরীর কেন জানি নবমীর মুখ দেখতে দেখতে এমনই মনে হল। তার চেয়ে যে বেশি শ্রী ছিল না নবমীর শরীরে কে বলবে! সে নবমীকে বলল, ডাকাতের সঙ্গে ঘর করতে ভয় করত না। 

নবমীর আবার সেই অপরূপ স্নিগ্ধ হাসি। 

—যম। চোখের পাকে ভিরমি খেত। যমের মতো আমারে ডরাত। বলে কী নবমী! 

—তোমার চোখের পাকে ভিরমি খেত। 

—হা সাচ বুলছি। মিছা বুলছি না। ডাকাতি ছেইড়ে দিল ডরে। 

—বলে কী! 

—হ্যাঁ মিমিদি, আমি মিছা কখনও বুলি না। 

মিমির কেন যে এত আগ্রহ নবমীর সব খোঁজ খবর নেবার। সে বলল, তোমার বাবা মাকে দেখতে ইচ্ছে হত না। 

—হত। তবে মরদের ইজ্জত বড় না আমার ইচ্ছা বড় বুলেন! আমি তারে ছেইড়ে গেলে আতান্তরে পইড়ে যাবে না! 

—সেই ভেবেই যাওনি। 

লজ্জায় নবমী মাথায় আঁচল টেনে দিল। 

এ কী পরীর সহসা আবার অশ্রুপাত কেন! 

সে কথা বলতে পারছিল না। দু-হাটুর মধ্যে মুখ গুঁজে দিল। কোথায় খুঁজবে। সে জানে মেসোমশাই তার সান্ত্বনা পেয়ে আশ্বস্ত হয়েছেন। বাড়ির সবাই। কিন্তু তাকে আশ্বস্ত করবে কে! বিলু যদি কোনো প্ল্যাটফরমে শুয়ে থাকে। সে তো নিজেকে কষ্ট দেবার জন্যই সংসারের স্বচ্ছলতা থেকে সরে গেল। এক দিকে তার নিজের আত্মপ্রকাশের তাড়না, অন্য দিকে পরীর মর্যাদা নষ্ট না হয় ভেবেই সে নিখোঁজ হয়ে গেল। তার হাত পা কাঁপছে। কেন যে দেখতে পাচ্ছে, প্রখর রোদে কেউ হেঁটে যাচ্ছে। মুখচোরা মানুষ। কাউকে নিজের কষ্টের কথা কখনও মুখ ফুটে বলে না। তা ছাড়া সে কলকাতার রাস্তাঘাটও ভাল চেনে না। ভিতরে এমন উতলা হয়ে পড়ল যে কিছুক্ষণ সে আর কোনো কথা বলতে পারল না। 

নবমীর কথাতেই তার হুঁস ফিরে এল। নবমী তো জানে না, সেই শুধু ডাকাত নিয়ে ঘর করেনি। সব নারীকেই কোনো না কোনো ডাকাতের পাল্লায় শেষ পর্যন্ত পড়ে যেতে হয়। 

—আমার নিবাসে চলেন। 

নবমী লাঠি ভর করে উঠে দাঁড়াল। 

পরী আর কী করে! নবমীর জীবন যে আগ্রহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তাতে সে তাকে যেন আর বিন্দুমাত্র অবহেলা করতে পারে না। নবমী এতটা হেঁটে এসেও কোনো ক্লান্তি বোধ করছে না। সে এখন যেন পরীদিকে নিয়ে এই বনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে কী মজা ছিল তার বেঁচে থাকার – দ্যাখ দ্যাখ, ঐ শিরীষের তলায় মরদ শুয়ে আছে, আমি জল নিয়ে গেছি, দ্যাখ দ্যাখ, হোথায় আড়াল হয়ে গেলে মরদ খোঁজাখুঁজি করত। জ্যোৎস্না রাতে ঘুরে বেড়াত গাছের ছায়ায়—আকাশ চাঁদমালা হয়ে বিরাজ করত—এমন ভুবনমোহিনী রূপ তার যেন বনজঙ্গলে না থাকলে ডাকাত মানুষটি টের পেত না। 

ভিতরে ঢুকতে ভয় করছিল পরীর। যেন ইটের পাঁজা সব খুলে মাথার উপরে পড়বে। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল, মেঝে পাকা। দেয়ালে সিমেন্ট বালির পলেস্তারা, একটা বনজ গন্ধ ঘরে। 

শেষ দিকে নবমী ছাগলের দুধ আর বনের ফলমূল খেয়ে বেঁচে থাকত। 

পিলু বলেছে, বাসাটাই যেন বুড়িকে আগলে রাখত। হয়তো নবমী যখের ভয়ে পড়ে না গেলে স্বামীর ভিটে ছেড়ে যেতই না। জঙ্গলেরও থাকে প্রাণ কিংবা ভালবাসা, আর সব প্রাণীসকলের মতো নবমীও ছিল এই জঙ্গলের একজন। শেয়াল, বেজি, গো-সাপ, এমন কি সাপ খোপও ছিল তার প্রিয় সঙ্গী। আর যখন যে গাছে ফল হত, যেন নবমীর হয়ে তারা ঝরে পড়ত নিচে। পিলু গেলেই বাবাঠাকুরের জন্য ফল প্রণামী দিত। বেল, কয়েতবেল, তাল, নারকেল, আম, জাম, গোলাপজাম —কত না বিচিত্র ফলের সমারোহ। কেউ জানতই না, এই কবরভূমি সংলগ্ন জমি সরকারের খাস, আর ভূত প্রেতের উপদ্রবে কত রাতে মানুষ তালকানা হয়ে গেছে, পথ হারিয়েছে—পথ হারালেই জঙ্গলের মধ্যে এলোপাথাড়ি ছুটতে গিয়ে দেখেছে, কোনো জরাগ্রস্ত উলঙ্গ রমণী গাছের নিচে বসে ঝিমুচ্ছে। এই বনজঙ্গলে ঘরবাড়ি ওঠার আগে অঞ্চলের মানুষেরা বনটায় ঢুকতেই সাহস পেত না। নবমী বলে এক যুবতী এই জঙ্গলে প্রেত হয়ে ঘুরে বেড়ায়, নবমীর বন বলে খ্যাত, তাকে কখনও দেখা যায়, কখনও দেখা যায় না, যে দেখে সেই দৌড়ায়। পিলুই আবিষ্কার করেছিল, বনের গভীরে এক বুড়ি থাকে। চাঁদের বুড়ির মতোই ছিল প্রথম দিকে রহস্যময় — কিন্তু পিলুর বেজায় সাহস-নবমীর বনের ভিতর দিয়ে শহর থেকে সর্টকাট একটা রাস্তা সে খুঁজে বের করেছিল। রেল-লাইন পার হয়ে, নীলকুঠির পরিত্যক্ত জঙ্গল পার হয়ে কবরখানা। কবরখানার ভিতর দিয়ে গেলেই নবমীর জঙ্গল। সেই কবে থেকে মানুষেরা নবমীর নিশীথে পরিভ্রমণকে কোনো ভৌতিক ক্রিয়াকাণ্ড ভেবে তার এলাকা পরিহার করে চলেছে। পিলু যেদিন তাকে দেখেছিল, তারও কম ভয় ছিল না। এক হাতে কী একটা ফল কুড়িয়ে লাঠি ভর করে এগিয়ে আসছে। দৌড় দৌড়। এক দৌড়ে গাছপালা জঙ্গল ফেলে সে বাড়ি ফিরে নাকি বলেছিল, বাবা, বনটায় না—তারপর আর কিছু বলতে পারেনি। 

বাবা পাটকাঠির বেড়া বাঁধছিলেন। শুনে বলেছিলেন, বনটায় কী! 

পিলু চোখ বড় বড় করে বলেছিল, বনের অপদেবী। 

—বনের অপদেবী! 

— হ্যাঁ বাবা। লাঠি ঠুকে ঠুকে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

—অপদেবী হবে কেন। চোখের বিভ্রম। অমন জঙ্গলে মানুষ আসবে কী করে। ভিতরে তো শুনেছি ঢোকাই যায় না। কেউ কেউ বলে নবমী বলে এক নারী এক কালে তার স্বামীকে নিয়ে থাকত। তারা তো সেই কবে হেজে মজে গেছে। 

—না বাবা আছে। আমি দেখেছি। 

বাবা হেসে বলেছিলেন, তুমি যে কত কিছু দেখতে পাও! 

বাবার এই কথাটাই পিলুকে নাকি জেদ ধরিয়ে দিয়েছিল। শহর থেকে ফেরার পথে সে বাদশাহী সড়ক দিয়ে আসত না। তার কাছে বাদশাহী সড়কটাও ছিল রহস্যময় এই রাস্তায় সিরাজদৌল্লা ঘোড়া ছুটিয়ে গেছেন পলাশীর মাঠে যুদ্ধ করতে। মোহনলাল মীরমদনের বাহিনী ছুটে চলেছে ঘোড়ায় চড়ে। মীরজাফর হাতীর পিঠে। দামামা বাজছে। সেই রাস্তার পাশে অলৌকিক বনটা তাকে তখন নাকি আরও বেশি টানত। নিঝুম গাছপালা থেকে কেবল পাতা ঝরছে। খস খস শব্দ শুনতে পায়। সর সর করে কারা যেন লুকিয়ে পড়ে তার পায়ের শব্দ পেলে। আর ডাহুক পাখির কলরব কিংবা বনটিয়ার ঝাঁক কোথাও। কোথাও মৌমাছির গুঞ্জন। পিলু ভিতরে ঢুকলে নাকি বিচিত্র কীটপতঙ্গের আওয়াজ পেত। তার মনে হত বনের ভিতর এক অদৃশ্য বাজনা বাজে। 

তার পরীদিকে দেখলেই পিলুর রাজ্যের সব খবর দেবার স্বভাব। বনটায় ঢুকলে তার গা নাকি ফুলে যেত। লোম খাড়া হয়ে উঠত। ঝুপ করে সামনে কে লাফিয়ে পড়ল, আরে বিশাল একটা হনুমান দলে দলে হনুরা তাকে দেখলেই কেমন বিস্ময়ে নাকি তাকিয়ে থাকত। তাকে কিছু বলত না। দু-একটা যে তাকে দেখার জন্য একবারে গায়ের কাছে চলে আসত তাও সে বলেছে। পিলু হনু দেখলে সাহস পেত। এরা তো মানুষের সমগোত্র। তা ছাড়া রামের সেতুবন্ধনে এরা ছিল বলেই রাক্ষসের দেশ থেকে সীতাকে রামচন্দ্র উদ্ধার করতে পেরেছিল। সেও নাকি দেখেছে, জঙ্গলের ভিতর মানুষ চলাচলের একটা গোপন পথ তৈরি হয়ে গেছে। খুব খেয়াল করলে ওটা বোঝা যেত। পথটা অনুসরণ করতে গিয়েই সে নবমীর এলাকায় ঢুকে তাকে দেখে ফেলেছিল। 

তারপর পিলু এই রহস্য আবিষ্কারের জন্য কতবার যে বনটায় ঢুকে গেছে। না কোথাও জনমানবের চিহ্ন নেই। সে দেখতে পেত না নবমীকে। নবমী কী তখন মানুষের সাড়া পেলে ঝোপ জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ত! 

সে তার খুশিমতো যে-সময়কার যে ফল, পেড়ে এনেছে। তালের দিনে তাল, এমন কী একবার জঙ্গলের মধ্যে একটা পাকা আনারসও সে খুঁজে পেয়েছিল! 

কে গাছ রোপণ করে! 

সে নারকেল নিয়ে আসত। ঝুনো নারকেল। এত গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটা নারকেল গাছ, একটা লিচু গাছ পর্যন্ত সে আবিষ্কার করেছিল! 

কে রোপণ করে! 

সেই অনন্ত আগ্রহই পিলুকে কখন যে বনের রাজা বানিয়ে ফেলেছিল। কিংবা নবমী যখন বলে, মাঝে মাঝে সে দেখতে পেত কেষ্টঠাকুরের লীলা—সে নাকি তখন জোড় হাত করে ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ত। তাকে দেখলে ঠাকুরের লীলা যদি আর দেখতে না পায়। এমন কী সে তার ছাগলটাকেও আড়াল করে রাখত। … পিলুর যে কত কথা মনে হয়। 

পিলু গাছে উঠে ডালে বসে থাকত। কখনও গাছের ছায়ায় হেঁটে বেড়াত। বেত ঝোপ থেকে বেতের ডগা নিয়ে যেত। নারকেল পেলে নিয়ে যেত। ঠাকুর পুণ্যবান — ফলমূল তার প্রিয় হবে বেশি কী। একবার দেখেছিল, ঠাকুর ঝুড়ি এনে সারা দিনমান, বন আলু তোলার জন্য মাটি সরাচ্ছে। বিশাল বন-আলুটা ঝুড়িতে ধরছে না। ওটা মাথায় তুলতে বেজায় কষ্ট। সহ্য হয়নি। লাঠি ভর দিয়ে কাছে যেতেই পিলু চমকে উঠেছিল—আরে সেই বুড়িটা। 

পিলুর আত্মারাম খাঁচা। 

নবমী কী বুঝে বলেছিল, জঙ্গলটায় এলেন যখন কৃপা করে, একবার কপালে মাথা ঠেকাতে দিন গো দা-ঠাকুর। 

পিলু দৌড় মারবে কিনা ভাবছিল। 

নবমী তারপর সত্যি গড় হয়ে পায়ের কাছে একটা ঝুনো নারকেল রেখে বলল, দা-ঠাকুর, মানুষ তো এ-বনে ঢোকে না। 

পিলু বলেছিল, তুমি কে? তুমি নবমী। লোকে বলে হেজে মজে গেছে! মরে গেছে! —আমি মরব কেন! বেঁইচে আছি। 

—লোকে যে বলে জঙ্গলে ডাইনি থাকে। 

—না গো দা-ঠাকুর। আমর ঘরে আমি থাকি! ডাইনি থাকবে কেন! 

—তোমার ঘর আছে! 

—আছে না। হুই উদিকটায়। আসেন দা-ঠাকুর। পায়ের ধুলা দিয়ে যান। আপনার পা-খান ছুঁতে দিন। বলেই সে গড় হয়েছিল ফের। 

এর পর আর ভয় থাকে। 

সে বলেছিল, তোমার ভয় করে না! কোথায় তোমার ঘর। 

—বনজঙ্গলে থাকলে দা-ঠাকুর ঘর লাগে না গো। সব কথা শুনি। জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই। উৎপাত 

করলে ভয় দেখাই। 

—ভয় দেখাও মানে। 

—এই আছি, এই নাই। বলেই জঙ্গলে সহসা অদৃশ্য নবমী। 

—এই নবমী, তুমি কোথায়। 

নবমী ঝুপ করে ভেসে উঠেছিল জঙ্গল থেকে। …. পিলুর যে কথা কতা মনে হয়! 

নবমীর পেটে পেটে তবে এত দুষ্টুবুদ্ধি। বনটায় লোকজন ঢুকলে তার অধিকার খর্ব হয়ে যাবে। সে নিজেই নানা রঙ্গ তামাসায় মেতে গেছিল। গাছপালা এবং অরণ্যের মোহ তাকে এত দিন জড়িয়ে রেখেছিল। সেই নারী শেষে যখের ভয়ে উঠে গেল পিলুদের বাড়ি। 

মৃন্ময়ীকে যত গভীর অরণ্যে নিয়ে যাচ্ছে তত তার সব মনে পড়ছিল। পিলুই তাকে নবমীর গল্প করত। পিলুর তো গাঁজাখুরি গল্পের শেষ নেই—এও হয়তো তেমনি। কিন্তু সত্যি তবে নবমী বুড়ি আছে। আছে তার গভীর অরণ্য আর অরণ্যের প্রতি টান। আজ নবমীর সঙ্গে না এলে সে টের পেত না, কোনো নারী একা স্বামীর স্মৃতি আগলে যে কোনো দুর্গম এলাকায় বসবাস করতে পারে। 

বার বার বিলুর মুখ ভেসে উঠছে। 

সে যে কী করবে! 

কোথায় খোঁজ করবে তার। 

বছর তিন আগেও একবার বিলু নিখোঁজ হয়ে গেছিল। তখনও মেসোমশাই ছিলেন নির্বিকার। গেছে—আবার ফিরে আসবে। মেসোমশাইয়ের এত আত্মবিশ্বাস কী করে হয় সে জানে দৈব বিশ্বাসই এর মূলে। তার কাছে মানুষের জন্য এমন কী প্রাণীজগত থেকে সব গাছপালা কী নয়, এক অদৃশ্য শক্তির খেলা। সেখানে কোনো লড়ালড়ি চলে না। 

পিলু গেল কোথায়! 

মিমি ডাকল, এই পিলু, কোথায় গেলি।

অনেক দূর থেকে পিলু সাড়া দিচ্ছে। 

ওরা ওখানটায় কী করছে ভাই বোনে! 

বেলা পড়ে আসছে। গাছপালার ছায়া ক্রমে দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। এবং সে দেখল দূরবর্তী আকাশে বিশাল চাঁদের আবছা উপস্থিতি। পূর্ণিমা পার হয়ে গেছে, প্রতিপদ কিংবা দ্বিতীয়া—সাঁজ লেগে গেলেও ভয় পাবার কিছু নেই পিলু বোধহয় জানে। পিলু কী এই অরণ্যের মধ্যে জ্যোৎস্নায় কখনও হাঁটাহাঁটি করেছে। তার ভয় না থাকারই কথা। কারণ নবমী বনটায় থাকলে রাতের বেলায় সে অনায়াসেই ঘোরাঘুরি করতে পারে। 

পরী বলল, তা হলে শেষে যখের তাড়া খেয়ে স্বামীর ভিটে ছাড়লে! 

—হা মিমিদি। 

ওরা হাঁটছিল। নবমী তার স্বামীর স্মৃতি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। নবমীর এই স্মৃতি ছাড়া আর কিছু যেন সম্বল নেই—যা সে মানুষের কাছে গর্ব করে বলতে পারে। 

মিমি সব শুনছিল না। তাকে এখন আসলে যখ তাড়া করছে। সে বলল, নবমী, যখ তো গুপ্তধন পাহারা দেয়। তোমার ঘরে যখ কী করতে আসবে! 

নবমীর কী মনে হতেই চুপ করে গেল। বাবাঠাকুর তো তাকে চোটপাট করেছে—কী তোমার ইট ক’খানা নিতে হবে! পারব না। কে নেবে! তোমার ছাগল নিতে হবে, আবার কাঠের পেটি নিতে হবে। এত বাহানা চলবে না। যেতে হয় একা চল। ছাগলটা নিচ্ছি। 

কিন্তু নবমীর সেই কড়জোড়ে প্রার্থনা, পেটিখান ফেইলে যাই কী করে। 

দা-ঠাকুরও কম চোটপাট করেনি। এখন যদি খবরটা জানাজানি হয়ে যায় তবে বাবাঠাকুর গোসা করতে পারেন।

—নবমী, আমরা কী তোমার গুপ্তধনের লোভে বাড়ি এনে তুলেছি। বল! আমরা কী জানতাম, তুমি ইট ক’খানা পেটিতে পাহারা দিচ্ছ, গুপ্তধন আগলাচ্ছ আমরা জানতাম! পিলু তো সব ক’টা ইট জলে ফেলে দিতে গেছিল। দশ কান হলে ভাববে না, তোমার গুপ্তধনের খবর পেয়েই বাড়ি তুলে এনেছি, ঘর বানিয়ে দিয়েছি। পিলু মায়া প্রতিদানে তোমাকে বিকালে রামায়ণ মহাভারত পড়ে শোনায়। তোমার সেবা যত্ন সব গুপ্তধন পেয়েছি বলে! বল, বল চুপ করে থাকলে কেন। বাবাঠাকুরের মুখ মনে পড়তেই নবমী কেমন চুপ করে গেল। 

মিমি ফের বলল, যখ দেখেছ চোখে। 

নবমী রা করছে না। 

—যখ ঘোরাঘুরি করে টের পেতে কী করে! 

নবমী রা করছে না। 

—কী হল তোমার! কথা বলছ না! 

নবমীর হাত থেকে লাঠিটা পড়ে গেছে। মিমি ওটা তুলে দিল নবমীর হাতে। যখের কথা তুললেই রা করছে না। নবমীর মুখে সেই প্রসন্নতাও নেই। 

নবমী যেন তার অজ্ঞাতেই সব ফাঁস করে দিচ্ছিল। কী যে হবে! 

তখনই পিলু মায়া লতাপাতা ঝোপজঙ্গল সরিয়ে এদিকে ছুটে আসছে। শিগগির মিমিদি এস, শিগগির। 

—কেন! 

—এসই না। 

—কেন বলবি তো। 

মায়ার মুখ শুকিয়ে গেছে। 

পিলু হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মিমিদিকে। নবমীকে বলল, বোস। আমরা আসছি।

—কোথায় হাত টেনে নিয়ে যাচ্ছিস? 

সামনে বিশাল এলাকা নিয়ে কবরভূমি। মিনার, পরিত্যক্ত মসজিদ, কবরের উপর শ্বেতপাথরের ফলক, কোথাও গম্বুজ আর যতদূর চোখ যায় গাছপালা, পরে লাল সড়ক, একটা গরুর গাড়ি যাচ্ছে, ঝোপ জঙ্গলের ফাঁক থেকে তাও দেখা যায়। 

জায়গায় জায়গায় শুধু ঘাস। তার উপর দিয়ে ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

আর কিছু দূর গিয়েই সে যা দেখল, তার আত্মারাম খাঁচা। তাড়াতাড়ি পালাতে চাইল মিমি। পিলুর এই দুর্জয় সাহস তাকে কেমন বিচলিত করছে। সে কেবল বলছিল, সর্বনাশ! 

—কিচ্ছু করবে না। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন! 

বিশ পঁচিশ গজ দূরে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখার জন্য পিলু তাকে এখানটায় এনে দাঁড় করিয়েছে। পিলুর ভয় ডর কম। তাই বলে কাল নিয়ে খেলা! 

মিমি দু-জনের হাত ধরেই ছুটতে চাইল। কিন্তু পারল না। 

পিলু কেবল বলছে, সাপের সং। কিচ্ছু করবে না। দেখ না। আমরা তো কখন থেকে দাঁড়িয়ে দেখছি। তুমি আসছ না! 

যেন পিলু এই গভীর বনের জন্মরহস্য আবিষ্কারের নেশায় এতক্ষণ তার ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পরীদি আসছে না দেখে সে ছুটে এসেছিল—না দেখে গেলে, পিলু ভাববে, পরীদি কী ভীতু— আলিসান দুই ভুজঙ্গ একে অপরকে জড়িয়ে লতার মতো বেয়ে উঠছে। 

ভাদ্রের শেষ বেলা—মিষ্টি ঠাণ্ডা হাওয়া। গাছের ছায়ায় তারা দাঁড়িয়ে দেখছে। দেখতে দেখতে পরীর শরীর কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছিল। সাপের এই সহবাস তাকে কোনো গভীর অতলে ডুবিয়ে দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের লীলায় সে অধীর। এখন ইচ্ছে করলেও সে নড়তে পারবে না। সে তাকিয়েই আছে। অবিরাম ঘাসের উপর বেয়ে বেয়ে দু’জনের এই সংলগ্ন হওয়া কোনো নারী পুরুষের উপগত হওয়ার মতো। ক্ষণিকের আশ্রয় উত্তাপ অথবা বিষবাষ্প থেকে আত্মরক্ষার সামিল— সাপ দুটো যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে, দু’জনে মুখোমুখি ফণা তুলে দুলছে, ছোবল দিচ্ছে ভূমণ্ডলের হৃৎপিণ্ডে, তারপর আরও ঘন, আরও আরও যেন দুটো দড়ি পাক খেয়ে কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের মতো বাতাসে ভর করে দাঁড়াচ্ছে—তারপর এক অপরূপ নৃত্য, ঘুরে ঘুরে দুলে দুলে নৃত্য। ফুলে ফুলে উঠছে শরীর। রোদে ঝকমক করছে তলপেট এবং বরফের মতো সাদা পেটের সংলগ্ন স্থানে সহ-অবস্থান। শরীরে, রোমকূপে ঝড় তুলে দিচ্ছে। 

বনভূমির কী যে থাকে সবুজ ঘ্রাণ, এই বেলায় বাতাসে তার ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। পরীর চোখ বিস্ফারিত। রোমকূপে ঝড়। আকাশ বাতাস থেকে দেবদূতের মতো উঠে আসছে মাত্র একটি মুখ—সে এতই নিষ্পাপ, সে এতই ভীরু, তার যেন জোরজার করারও ক্ষমতা নেই। এখন আর চোখের সামনে কোনো কালভুজঙ্গ দেখতে পাচ্ছে না। এবার পরী নিজেই কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল—ঠিক সাপের ভঙ্গিতে এই মোচড় তাকে পীড়নের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। চোখ লাল, কান গরম—এমন কী বালক- বালিকার সামনে দাঁড়িয়ে সঙ্গম দৃশ্য উপভোগ করা অশোভনতা পর্যন্ত খেয়াল নেই। শরীরের গভীর অন্তস্তল থেকে দ্রুত কী সব সংকেত পাঠাচ্ছে হৃৎপিণ্ডে। ধক ধক করছে—বুক। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। পিলুর কাঁধে ভর দিয়ে কোনো রকমে বলল, আমার কী হচ্ছে। জোর পাচ্ছি না। শিগগির আমাকে ধর। আমাকে নিয়ে পালা। আমি না হলে মরে যাব। 

পিলু বলল, ভয় পাচ্ছ কেন। ওরা এখন কারো ক্ষতি করবে না। আমি তো ঢিল ছুঁড়েছিলাম। ভ্রুক্ষেপ নেই। দেখ না কত ঢিল ছুঁড়েছি। আমাকে তাড়া করেছে? তবে ভয় পাবে কেন! 

পিলু জানে না, পিলু বোঝে না, সরল বালক। সাপের সং দেখার সৌভাগ্য কম মানুষের হয়। সে বলল, জান পরীদি, ইস্ কী যে খারাপ লাগছে না। যাব দৌড়ে! 

—কোথায় যাবি! কেমন ত্রাসের গলায় কথাটা বলল পরী। 

—এক দৌড়ে যাব, এক দৌড়ে আসব। জান সাপের সং-এর উপর নতুন গামছা ফেলে দিলে পুণ্য হয়। গামছাটা ঘরে রাখলে যার যা মনোবাসনা পূর্ণ হয়। 

—কে বলেছে! 

—বাবা বলেছেন। 

—যাবি! অতি কষ্টে কথাটা বলল। সারা শরীরে ঘুমের মতো কী এক জড়তা নেমে আসছে। আর তখনই দেখল সেই কালান্তক যম প্রায় পাশাপাশি ঘাসের বুক বেয়ে পরিত্যক্ত মসজিদে ঢুকে গেল। 

পরী আর পারল না। বসে পড়ল। তার পায়ে জোর নেই। দু-জংঘার মাঝে অবিরাম নদী প্রবাহ প্রবল প্রতাপে ভেসে যাচ্ছিল। পরী বসে থাকতে পারল না। পরী ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল কাত মানুষের দ্বারা ব্রিজে ফেলল। যেন সে এক গভীর অবশ অলস মুখর রাতে উপগত হবার পর তৃপ্তি নিয়ে শুয়ে আছে। সবাই চলে গেলেও তার কিছু আসে যায় না। রোমন্থনে সেই অমৃতের স্বাদ। সমুদ্র কত গভীর এবং তার সুখে অবগাহন পরীকে বড়ই কাতর করে রেখেছে। হুঁস নেই। 

—পরীদি! কী হল তোমার! ও পরীদি, ওঠো শরীর খারাপ লাগছে! ভয় কী। দেখ কিচ্ছু নেই। ও পরীদি, ওঠো। 

পিলু দেখছে পরীদি চোখ মেলতে পারছে না। সে কেমন হায় হায় করে উঠল। 

—নবমী, নবমী। 

সে চিৎকার করে ডাকছে। নবমী বনজঙ্গলের ভেতর থেকে পিলুর ভয়ার্ত গলা পেয়ে ছুটে আসার চেষ্টা করছে। এসেই সে দেখছে পরীকে। শুয়ে, দিদিমণি অবশ। 

পিলু সব বললে, নবমী ফোকলা দাঁতে হেসে ফেলল। পরীদিকে ডাকাতে ধরেছে গো। বসেন। ঠিক হয়ে যাবে। 

জীবনের এই মাধুর্য পিলুর টের পাবার কথা নয়, নবমী জানে। নবমী তাকাল। এই অরণ্যের কোথায় সেই নিভৃত স্থান, যেখানে সে কত রাতে গাছের ছায়ায়, ঘাসের উপর ডাকাতের হাতে পড়ে উলঙ্গ হয়ে গেছে। সেই মাধুর্য জীবনে আর নেই—কিন্তু তার স্বাদ আজ যেন এক নারীর মধ্যে আবার খুঁজে পেয়েছে। 

নবমী মাথার কাছে বসে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল শরীরে। বেশবাস কিছুটা আলগা হয়ে গেছে। দুই বালক বালিকা কেমন তাজ্জব। পরীদির হিস্টিরিয়া আছে কিনা জানে না। পরীদিকে যদি ভূতে ধরে। এত সুন্দর পরীদিকে নিয়ে কবরখানায় ঢুকে সে ভাল কাজ করেনি! কী যে করবে। 

পিলু প্রায় ছুটে যেতে যেতে বলল, নবমী, তুমি বোস। মায়া, তুই থাক। বাবাকে ডেকে আনছি।

পরীর হুঁস ফিরে আসছে। 

ছিঃ ছিঃ সে এটা কী করে ফেলল! 

নবমী ডাকছে, যাবেন না গো দাদাবাবু। সে বলল, সাপের সং দেখে ভিরমি খেয়েছে। হুঁস ফিরে এসেছে। যাবেন না! 

পিলু চঞ্চল স্বভাবের। সে দৌড়ে এসে দেখল, পরীদি উঠে বসেছে। মাথার চুল ঠিক করছে হাত দিয়ে। আঁচল দিয়ে শরীর ঢেকে দিচ্ছে। 

পিলু হাঁটু গেড়ে বসে বলল, হেঁটে যেতে পারবে তো। 

কোটাল আসার মতো পরীর পরিতৃপ্ত মুখ। নিজেই উঠে দাঁড়াল। তারপর কী ভেবে আঁচল দিয়ে দ্রুত পেছনটা আড়াল দিল। একবার নিজেও পেছন দেখার চেষ্টা করল। আর তারপর পিলু না, আর ভাবতে পারে না! পরীদি ছুটছে। এক হাতে আঁচল কোমরের নিচে টেনে ধরে রেখেছে। আর ছুটছে। বাতাসে আঁচল উড়ে না যায়? পরীদি কোমরের পেছনে হাত রেখে শুধু বলছে, শিগগির আয়। 

কেন এই চাঞ্চল্য পিলু বুঝল না। 

নবমী গাছপালার মধ্যে দ্রুত হাঁটতে পারে না। তাকে ফেলে চলে যাওয়াও যায় না। পরী এটা বোঝে। সে শুধু বলল, আমি যাচ্ছি। তোরা আয়। 

পিলু বলল, মায়া, তুই যা পরীদির সঙ্গে। জঙ্গলে হারিয়ে গেলে রাস্তা খুঁজে পাবে না। 

মায়া তাড়াতাড়ি ছুটছে। তার ফ্রক উড়ছিল, বাতাসে পরীদি টানা ছুটছে না। ঝোপ জঙ্গল ভেঙ্গে দ্রুত ছোটাও যায় না। কোথাও বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, হাঁপাচ্ছে। আবার ছুটছে। আবার দাঁড়াচ্ছে। হাঁপাচ্ছে, আবার ছুটছে। মায়াও পরীদির সঙ্গে ছুটছে, দাঁড়াচ্ছে, হাঁপাচ্ছে। 

মায়া পরীদির এই মতিগতির কিছু অর্থ ধরতে পারছে না। আর বাড়ি এসে অবাক, পরীদি কাউকে না বলেই মা’র শাড়ি সায়া ব্লাউজ নিয়ে পুকুরঘাটে চলে গেল। 

বাবা পরীদির ছুটে আসা দেখে কিঞ্চিৎ তাজ্জব হয়ে গেছিলেন। বললেন, ওরা কোথায়!

পরীদি জল ঢালতে ঢালতে বলল, ওরা আসছে। 

নবমীও বাঁশতলা দিয়ে হেঁটে আসছে। বোধহয় জোর ছিল না—হাঁটতে আর পারছিল না। পিলু ধরে নিয়ে আসছে। এক হাতে নবমীর লাঠি। ফিরে এসেই নবমী ধপাস করে বসে পড়ল। এক গ্লাস জল খেল আলগা করে। বাঁ-হাতে মুখ মুছে দেখল, পরীদি চান করে ভিজা কাপড়ে বিলুদার ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। নবমী কেমন প্রসন্ন গলায় বলল, তীর্থ করে এলাম বাবাঠাকুর। 

—ভাল করেছ। মনে জোর পাবে। মানুষের দাঁড়াবার জায়গা একটা বড় দরকার। যখন মনে হয় চলে যাবে। পিলু না যায় মায়াকে নিয়ে যাবে। নিয়ে যাবার লোকের তো অভাব নেই। 

পরী ঘর থেকে সব শুনতে পাচ্ছিল। সে ভাল নেই। জঙ্গলে যা হল। সে কেমন আশ্চর্য এক সুখ, ঠিক সুখও বলা যায় না, জীবনে বেঁচে থাকার জন্য তারও যে দরকার ছিল নিজেকে আবিষ্কার করার। কোনো পুরুষই একজন নারীর জন্য অপেক্ষা করে না। নারীও না। তবু কেউ অদৃশ্য ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করে। সে তার পিছু হাঁটে। কোনো দুর্গম অঞ্চলই তার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। বিশ্ব, তুমি কী চাও! আমাকে আর কত কষ্ট দিতে চাও। নিজে আগুনের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ। আমি কী ভাল আছি! এ কী শাস্তির মধ্যে ফেললে। এখন আমি তোমাকে কোথায় খুঁজব! 

সাড়া শব্দ না পেয়ে বাবা বললেন, দেখ তো পিলু, মিমি কী করছে! 

দরজা বন্ধ! অনেকক্ষণ হয়ে গেল। সহসা তিনি ত্রাসের মুখে পড়ে গিয়েই বলেছেন, হয়তো নিজেই দৌড়ে যেতেন। কেন এই ত্রাস তাঁর! 

পিলু দরজা ঠেলে অবাক।

পরীদি দাদার বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সন্তর্পণে দরজা ভেজিয়ে সে বাবার কাছে ছুটে গেল। কানে কানে ফিস ফিস করে বলল, বাবা, পরীদি না কান্নাকাটি করছে। বাবা বিস্ময়ের গলায় বললেন, কাঁদছে! কেন! শরীর খারাপ! তারপরই কী ভেবে বাবা মাথা নিচু করে বসে থাকলেন। নিখোঁজ পুত্রের কথা ভেবে তাঁরও মন খারাপ হয়ে গেল। তবু তিনি উঠে দাঁড়ালেন। পরীকে সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। আজ তিনি কেন জানি পরীকে শুধু রায়বাহাদুরের নাতনি ভাবতে পারলেন না। সে এ-পরিবারের একজন। দরজার কাছে গিয়ে বাবা তাঁর ইদানীংকার আপ্তবাক্যটি বললেন, বুঝলে মিমি, কেহ আত্মাকে আশ্চর্য মনে করে— কেহ বা আশ্চর্যবৎ বলিয়া আত্মাকে বর্ণনা করে। আবার কেহ আশ্চর্য বলিয়া শোনে। কিন্তু ইহার বিষয় শুনেও কেহ ইহাকে বোঝে না। কান্নাকাটি কর না। সে ঠিক ফিরে আসবে। 

পিলু শুনছিল। সে জানে বাবা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার সময় সাধু বাক্য বলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *